#তোকে_ঘিরে❤
#পর্ব_৪০
#ফাবিয়াহ্_মমো🍁
সকাল সাতটা বাজতেই বনানীর উদ্দেশ্যে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে পূর্ব। বাড়িতে পূর্ণতা সবার সাথে সকালের নাস্তাটা সারলেও পূর্ব যে খেয়ে যায়নি এ নিয়ে ভীষণ চিন্তাগ্রস্ত। পলাশ ওয়াসিফ তাঁর দুই ভাইকে নিয়ে অফিসে চলে গেছে। আয়েশা চলে গেছে ডাক্তারের কাছে রেগুলার চেকাপ করতে। মেজো চাচী এসে রুমের দরজায় নক করে জানালো,
– আমরা একটু শপিংয়ে যাচ্ছি পূর্ণতা। তুমি কি আসবে?
পূর্ণতা ভাবনা ছাড়াই জানিয়ে দিলো, না বড় চাচী। আপনারা যান। আমি আরেকদিন যাবো কেমন?
মেজো চাচী কয়েকবার তোষামোদ করলো এতে বিশেষ কোনো লাভ হলোনা। পূর্ণতা বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে সিলিংয়ের দিকে চোখ স্থির রেখে। এসিটা বাড়িয়ে গায়ে কাথা টেনে নিয়েছে। পূর্বকে একটা কল করবে? বাইরে থেকে কিছু খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করবে? গতরাতে ফোনটা সিমসুদ্ধো দিয়েছে পূর্ব। পূর্ণতা ফোনটা হাতে নিয়ে কয়েকবার কললিস্টে চাপ দিতে যেয়েও দিলো না। এতো অস্বস্তি হচ্ছে কেন? পূর্ব ওকে হাইড রাখছে এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ক্লিয়ার ব্রিফ দিয়েছে একদিন। পুরো দুনিয়া জানবে ওয়াসিফ পূর্ব বিয়ে করেছে কিন্তু কাকে করেছে এ বিষয়ে কেউ জানবেনা। পূর্বের রাজনৈতিক কার্যকলাপে আনিশাও সমান তালে ক্ষতির তালিকায় ভুগতে পারতো কিন্তু আদৌ পূর্ব ওকে গোপন করে রাখেনি। আজ কেনো পূর্ণতার জন্য এতো কড়াকড়ি নিয়ম? বাইরে যেতে চাইলেও বোরখা পরে মুখে নিকাব মেরে যাওয়া লাগবে, ভার্সিটি যেতে চাইলে আগেরদিন বাবার বাড়িতে দিয়ে আসবে পরদিন সেখান থেকে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা দিবে, শপিংয়ে যাওয়া একদম নিষিদ্ধ। যা কিছুর প্রয়োজন সবকিছু লিস্ট করে কেয়ারটেকারকে দিয়ে দিবে। পূর্ব কাল রাতে বহু উদ্ভট নিয়ম তৈরি করেছে পূর্ণতার জন্য। চিন্তার অতল গহ্বরে ডুবে যেতেই হঠাৎ ফোন বাজতে লাগলো পূর্ণতার। ধড়ফড় করে শোয়া থেকে উঠে বসতেই ফোনের দিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে গেলো সে। কলটা আনিশা করেছে। পূর্ণতা ফোনটা রিসিভ করে বেডে গা ছেড়ে দিয়ে বলে উঠলো,
– হ্যালো,
– ভালো আছিস?
– হ্যাঁ আছি, আলহামদুলিল্লাহ..
– তোর কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন?
– এমনেই কিছুনা। কি জন্যে স্মরন করলে?
– আমি কি তোকে কল করতে পারিনা?
– পারো।
– তোর অসুবিধে হলে রেখে দেই। মনে হচ্ছে ঠেলে ঠেলে কথা বলছিস।
– না ঠিক আছি, বলো। একটু মাথা ধরেছে তো এজন্য এমন শোনাচ্ছে।
– কি বলিস! ফোন রেখে দেই তাহলে। তুই ঘুমা।
– না বলো, অতো ব্যথা নেই।
– আমার খুব যন্ত্রণা হচ্ছে পূর্ণতা। কিছুদিন ধরে অনুশোচনায় নিজেকে খুব অসহ্য লাগছে। তুই কি আমায় মুক্তি দিবি?
– পূর্বের ব্যাপারটা নিয়ে এখনো পরে আছো? আমিতো কবেই ভুলে গেছি। তবে অনুশোচনা আমার হওয়া উচিত। সেদিন তোমার গায়ে ওভাবে হাত তুলে খুব জঘন্য কাজ করেছি। আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিও আপু।
– তুই কি আমাকে আরো ছোট করবি? কেনো মাফ চাচ্ছিস বলতো? বড় হয়ে তোর সাথে যা আচরন করেছি সেগুলোর জন্য যদি পা ধরে ক্ষমা চাই তাও তো কম। তুই কি আমাকে ক্ষমা ভিক্ষা দিবি? আমি দিহানকে নিয়ে একটু বাচঁতে চাই পূর্ণতা! কৃপা কর আমার উপর!
– একটা শর্ত আছে, তাহলে করবো।
– বলে ফেল। তোর পা ধরে সারাদিন বসে থাকতে বললেও আমি রাজি। তবুও আমাকে মাফ কর বোন। আমি দিহানকে আর কষ্ট দিতে পারছিনা। মরে যাচ্ছি!
– তোমার আমার মধ্যে যত মনোমালিন্য হয়েছে সবকিছুতে মাটি দাও। আমরা ছোটবেলায় কিভাবে মিল দিয়ে খেলতাম মনে আছে?
আনিশা স্বচ্ছ হাসি দিয়ে বললো,
– হ্যাঁ। দুজনের বৃদ্ধাঙ্গুল মিলিয়ে গলা জড়িয়ে বসে থাকতাম।
– একদিন আসো আপু। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
– দিহানের ছুটি…এই পূর্ণতা তোর কি মন খারাপ রে? কি হয়েছে খুলে বলতো!
– আপু ও আমার উপর নিয়মকানুন নিয়ে জোর দিচ্ছে…
– এ নিয়ে তোর মন খারাপ? তুই কি একটু মানিয়ে চলতে পারবিনা?
– এটা কি মানিয়ে চলা আপু? আচ্ছা বাদ দাও। দিহান ভাই কেমন আছে?
– ছুটি শেষ হতেই চলে গেলো। ওকে ছাড়া আমি এক মূহুর্ত থাকতে পারিনা। রাতে একঘন্টার জন্য কল করে তাও আমার মন তৃপ্তি পায়না। একঘন্টা কি কোনো টাইম হলো বল? অসহ্য লাগে। কালকে একটু বকা দিয়েছি। ওর কি মন খারাপ হবে আমারই কান্না পাচ্ছে।
আনিশা আপু একটু একটু করে পূর্বকে ভুলতে শুরু করেছে। যেখানে নিজের কোনো মূল্য নেই তাকে আকড়ে রাখার কোনো মানে হয়না। আপুকে নিয়ে সব পুরোনো অতীত একনিমিষে ভুলে নতুনভাবে শুরু করতে মন সায় দিলো। আমার মনের অস্বস্তিগুলো পূর্বের হালচাল না জানা পযর্ন্ত শান্তি পাবেনা। ঠিক করলাম পূর্বকে এবার কল করবোই করবো। ওর পার্টি জাহান্নামে যাক! আমি ওর খোঁজ না নিয়ে কল করা ছাড়বোনা। যতবার কলের টোন টু টু করে যাচ্ছে আমার হার্টবিট ফুলস্পিডে কড়াঘাত করছে। বিশাল প্রহরের মতো সাত জনম শেষে বুঝি পূর্ব কলটা রিসিভ করার সুযোগ পেলো। রিসিভ করতেই ধমক মেরে বললো,
– নাম্বার ব্লকলিস্টে ফেলবো? যদি লজ্জাবোধ থাকে কলটা সেকেন্ড টাইম করবে না!
টুট টুট টুট করে শব্দ হতে লাগলো, পূর্ব কলটা কেটে দিয়েছে। বাড়িতে থাকলে আমাকে জ্বালিয়ে মারে যেই লোক, বাড়ির বাইরে গেলেই সে আমাকে চিনেও না। ভাবটা এমন, যেন কোনো পর মহিলা এসে তাকে জ্বালাতন করছে। দুইগালে দশটা চড় মারলেও আমার শাস্তি পূরন হবেনা ভাই। খাল কেটে মানুষ কুমিরকে ঘরে আনে, আমি যে একদম কোলে করে যত্ন করেছি!!!
.
দুপুরের গোসল শেষে খাবারের জন্য ডাইনিং টেবিল থেকে ডাক আসে আমার। সায়মা মুখটা পটকার মতো কালো করে আমাকে নিয়ে ডাইনিং স্পেসের দিকে যাচ্ছে। ওর পোশাক দেখে এতো লজ্জায় মাথা নুইয়ে চলতে হচ্ছে। হাটু পযর্ন্ত পিংক শর্ট প্যান্ট, হোয়াইট লেডিস টিশার্ট। টিশার্টের গলা টেনে বাঁ কাধটা হা করে রেখেছে সেখানে চিকন পার্পেল স্ট্রিপ দেখা যাচ্ছে। বুঝলাম বাড়িতে বয়স্ক কেউ নেই তাই বলে ভাইদের সামনে এইভাবে চলাফেরা? ডাইনিং টেবিলে পূর্বিকা আপু, ফুয়াদ, জাওয়াদ, মিথুন বসে আমাদের অপেক্ষা করছিলো আমরা আসতেই সবাই খেতে শুরু করলো। পূর্বিকা আপু আমাকে ডেকে নিজের পাশেরটা চেয়ারটা টেনে দিলেন। আমি বসতেই সায়মা আমার অপজিট চেয়ার টেনে ফুয়াদের পাশে বসলো। আপু আমার প্লেটে মাছের টুকরো তুলে দিয়ে বললেন,
– ওই বদের সাথে কথা হয়েছে পূর্ণতা? সকালেও বদমাইশটা না খেয়ে বেরিয়েছে! কি যে করি!
আমি খাওয়া শুরু করলাম মিথ্যা কথা বলে,
– ও ব্যস্ত আপু। বললো, পরে খাবে।
খাওয়ার মধ্যপর্যায় যখন চলছিলো আমার মনে হলো পায়ের উপর কেউ পা ছোঁয়াচ্ছে। আমি একবার দুইবার ব্যাপারটা ইগনোর করলাম কিন্তু তৃতীয়বারের বেলায় সবার মুখের দিকে তীর্যক দৃষ্টি দিলাম। যেই এখন আমার চাহনি দেখে থতমত খাবে সেই পায়ে পা স্পর্শ করছে! সবাই কি সুন্দর নিরিবিলি খাচ্ছে কিন্তু একজন না একজন আমার সাথে জঘন্য ফাজলামি করছে! আমি চট করে টেবিলের নিচে মাথা নুয়ে দেখি পা-টা ফুয়াদের! পাশ থেকে খাওয়া থামিয়ে পূর্বিকা বলে উঠলো,
– পূর্ণতা কিছু হয়েছে? নিচে কি?
আমি তাড়াতাড়ি মাথা উঠিয়ে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলে উঠি,
– মশা কামড়াচ্ছে আপু। কিছু না।
আমার উত্তর শুনে ফুয়াদের মুখে শয়তানি হাসি লক্ষ করলাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে কেমন একটা সূচালো হাসি দিয়ে টিস্যুতে হাত মুছে চলে গেলো!! সবার খাওয়ার শেষে সায়মা দৃঢ় গলায় আমার পাশে এসে বললো,
– পূর্ণতা? আর ইউ ফ্রি? আই ওয়ান্ট টু ডিসকাস উইথ ইউ। প্লিজ কাম ইন মাই রুম।
পূর্বিকা আপু প্রথম দফায় খুব অবাক হলেও সায়মা ভাওতাবাজি করে বেশ দক্ষভাবে সামলে নেয়। আমি টিস্যু নিয়ে হাত মুছে ওর রুমে যেয়ে দেখি রুমের ভেতর সায়মা নামের কোনো মানুষ নেই! পুরো রুম ফাঁকা! জানালার কার্টেন উড়ছে, বিছানায় টেডি বিয়ার রাখা, গোলাপী দেয়ালগুলোতে ওর শৈশব থেকে কৈশোরের ছবি সাজানো। খুব খটকা লাগছে! ও আমাকে রুমে ডেকে নিজে কোথায় গেলো? আমি দুমিনিট অপেক্ষা করে নিজের রুমের দিকে পা ঘুরিয়ে চলে গেলাম। চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে ঘুমিয়ে পরার ধান্দা আমার।
পূর্ণতা ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা আটকে দিয়ে ঘুরে দাড়াতেই চিৎকার দিতে যেয়েও দিতে পারেনা। দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ভয়জনিত কন্ঠে বলে,
– তুমি এখানে কেন! এখানে কি করছো! আমার ওয়াশরুমে কি! তুমি কখন এলে! বেরিয়ে যাও! বেরিয়ে যাও বলছি! আমি চিৎকার করে সবাইকে ডেকে আনবো!!!
পূর্ণতা ভয় পেলেও বাইরে থেকে সেটা প্রকাশ করলো না। ফুয়াদ চালবাজি করে সায়মাকে দিয়ে এই কাজ করেছে এতক্ষনে সমীকরণ মেলানো শেষ! ফুয়াদ ধুমিয়ে সিগারেট টানছে, নাক দিয়ে ভো ভো করে নিকোটিন ছাড়ছে। মুখ দিয়ে একস্তুপ ধোয়া ছাড়তেই সৎবিৎ কন্ঠে বলে উঠলো,
– ভাবি আমি কথাটা ঘুরিয়ে পেচিয়ে বলতে চাচ্ছিনা। সোজাসুজি বলছি, আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। আই ওয়ান্ট টু হেভ এ্যান ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড উইথ ইউ!
পায়ের নিচ থেকে সমস্ত শরীরে হিম বয়ে গেলো পূর্ণতার। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ঢোক গিলে দুবার গলা ভেজালো। পায়ে একজোড়া স্যান্ডেল পরে আসা উচিত ছিলো অন্তত স্যান্ডেলটা তুলে ওর গাল লাল করে দিলে একটু শান্তি লাগতো। পূর্ব নিজের বেডরুম থেকে ওয়াশরুমটা এতো নিট এন্ড ক্লিন রাখে জুতা পরে বেড়ানোটা দৃষ্টিকটু লাগে কিন্তু এখন একজোড়া স্যান্ডেল দরকার! দুহাতে দুটো স্যান্ডেল বসিয়ে এই কুত্তার গায়ে, মুখে, পিঠে ইচ্ছামতো পেটানো গেলে ঠিক হবে! পূর্ণতা পরিস্থিতি ঠান্ডা মাথায় সামলে বললো,
– আমি যে তোমার বড় ভাইয়ের বউ সেটা ভুলে গেছো? তোমার ভাই যদি এই কথা শুনে! তোমাকে কুত্তার মতো পেটাবে ফুয়াদ!
– আই ডোন্ট কেয়ার। আপনি ওকে না জানালেই তো হয়। তাছাড়া আ’ম এ্যাম এ্যা গুড বেড পার্ফোমার! আমার সাথে একরাত থাকলেই বুঝবেন পূর্বের চেয়ে আমি আপনাকে আনন্দ দিতে পারবো।
পূর্ণতা চোখ বন্ধ করে নিজেকে আরো একবার সামলালো। পূর্ব যদি ভুলেও এইকথা শুনে ফুয়াদের কি কঠিন অবস্থা হবে পূর্ণতা কল্পনা করতেও ভয় পায়।
– আপনি এতো চিন্তা করছেন কেন? আমার সাথে একবার স্টে করলেই আপনি বুঝতে পারবেন পূর্ব যা করতে পারেনি আমি সেটা আপনাকে দ্বিগুণ দিচ্ছি।
পূর্ণতা শান্ত গলায় বললো,
– ফুয়াদ দেখো, আমি তোমার ভাবী হই। তুমি হয়তো ভাবছো আমি তোমার মতো মর্ডান জেনারেশনের মেয়ে। এটা ভুল। আমি ভালোয় ভালোয় বলছি তুমি সভ্য ছেলের মতো এখান থেকে বেরিয়ে যাও। আমিও ওয়াদা করছি তোমার প্রথম ভুল ভেবে ওকে কিছু বলবো না।
ফুয়াদ কপাল কুঁচকে সিগারেটের শেষ অংশটা হাই কমোডে ফ্লাশ করে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
– ভাবীজান আপনাকে আমার ভালো লেগেছে এটা আপনার সৌভাগ্য! আপনার শরীর তো দেখান না তাও কিভাবে কোমরের ওটুকু অংশ দেখে মাথানষ্টে ভুগছি সেটা বলতে পারছি নাতো!! দেখুন আপনাকে প্রমিস করছি একটুও কষ্ট দিবো না।
পূর্ণতা একচুলও তোয়াক্কা না করে ঠাস করে থাপ্পর মারলো ফুয়াদের গালে। ফুয়াদ রাগে গর্জে উঠবে তার আগেই দরজার সিটকিনি খুলে বেরিয়ে এসে বাইরে থেকে লাগিয়ে দেয় পূর্ণতা। ফুয়াদ ধামধাম করে দরজা ধাক্কাচ্ছে, দরজাটা মজবুত! নাহলে এতোক্ষনে যে হুলস্থুল লাত্থি দেওয়া শুরু করেছে তাতে ভেঙ্গে যাওয়ার কথা। পূর্ণতা নিজের কান্না আটকে রেখেও আটকাতে পারছেনা চোখ থেকে অশ্রান্ত অশ্রুগুলো পরছে। হাতের উল্টো পিঠে চোখ ডলে ফোনটা নিয়ে পূর্বকে কল করে। অনেকবার কল করে পূর্ব ধরেনা। ওদিকে ফুয়াদ জোরে জোরে দরজা ধাক্কাচ্ছে। এ বাড়িতে সবার রুমগুলো এতো দূরত্ববিশিষ্ট যে চিৎকার দিলেও কারোর কানে পৌঁছায়না, কেয়ারটেকারকে পাঠিয়ে খবর দেওয়া লাগে। দুপুরের পর পূর্বিকারা বাড়ির লনসাইডে চলে গেছে। বড়রা এখনো বাড়ি ফিরেনি। এই নিরুপায় সিচুয়েশনে পূর্ণতা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ফোনের স্ক্রিনে দ্রুত কিছু লিখে পাঠালো,
‘ Tumi amr call receive koro, Purbo!’
ঠিক দুমিনিট পর পূর্বের মেসেজ,
‘ I’m busy in seminar, please don’t disturb me. I’ll call you back ‘
মেসেজটা দেখে শব্দ করে তপ্তকর নিশ্বাস ফেললো পূর্ণতা। বিপদের বেলায় এখন তুমি নেই সেখানে আমিও আর থাকতে পারছিনা! মনেমনে কথাগুলো বলতেই ওয়াশরুমের বিকট শব্দের দিকে একপলক তাকিয়ে আলমারির দিকে পা চালিয়ে এগিয়ে গেলো। দুইদ্বার খুলে পার্স ব্যাগটা নিয়ে ফোনটা সুইচ অফ করে ঢুকিয়ে রাখলো। রুমের নব মোচড়ে মাথায় ঘোমটা টেনে চুপচাপ নিচে নেমে ড্রয়িং স্পেসে একটা চাকরকে দেখে বলে দিলো দশ মিনিটের মধ্যে আসছে। মাথার ঘোমটা লম্বা করে টেনে দারোয়ানকে দিয়ে সিএনজি ঠিক করিয়ে উঠে বসলো। সিএনজি মামা গাড়ি টেনে নিলে আলিশান গেটের সোনালী নেমপ্লেটটায় ‘ওয়াসিফ ভিলা’ দেখতে দেখতে হঠাৎ পিছে চলে যায়। পূর্ণতা মাথার ঘোমটা নামিয়ে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসে পরে। দুইকোণা থেকে পানি ঝর্ণার মতো পরছে। পূর্বিকা-কে যেয়ে কথাগুলো বলতে পারতো কিন্তু বলার আগেই যে কান্না এসে হামলে ধরবে!! মুখের ভাষা ছিনিয়ে আবেগান্বিত করে কাঁদিয়ে দিবে! পূর্ণতা মায়ের কাছে যেতে চাচ্ছে। মা ওকে হাজার বার মারলেও মান ইজ্জতের ব্যাপার কখনো নিলামে উঠতে দেয়নি। অশান্ত ক্ষুদ্ধ বিক্ষিপ্ত মনটা মায়ের কোলে মাথা রাখতে চাচ্ছে। আজ এবং এই প্রথম ওর মায়ের কথা স্মরন হচ্ছে।
.
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে। রাতের বেলা হালকা বৃষ্টিতে নিয়ন বাতির প্রতিফলনে রাস্তাঘাট চকচক করছে। পূর্ব গাড়িটা পার্কিং এরিয়ায় রেখে এসে বাড়িতে ঢুকতেই দেখে পরিবেশ থমথমে। সবাই গ্রাউন্ড ফ্লোরে ড্রয়িংরুমের সোফায় একত্র হয়ে বসে আছে। পলাশ পায়ের উপর পা তুলে সোফায় মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। পূর্বকে দেখতেই পলক ওয়াসিফ বলে উঠলো,
– তুমি কোনো খবর জানো পূর্ব?
– না তো, কিসের খবর বড় চাচ্চু?
পলক উত্তরের বদলে ফুস করে নিশ্বাস ছাড়লো। আয়েশা করুণ চাহনিতে ছেলের দিকে তিরিক্ষি গলায় বলে উঠলো,
– তুই বউমাকে কি বলেছিস!
পূর্ব ভ্যাবাচেকা খেয়ে ভ্রু অসম্ভব কুঁচকে বলে,
– পূর্ণতাকে কি বলবো? আমার অনুপস্থিতিতে কিছু হয়েছে?
এবার কথার উত্তরে পূর্বের বড় চাচী বলে উঠলো,
– পূর্ণতা বাড়িতে নেই। কুদ্দসকে বলে গেছে দশ মিনিটের মধ্যে আসবে। এখনো আসেনি।
পূর্ব কিছু মনে হওয়ার ভঙ্গিতে তাড়াতাড়ি প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করলো। ওহ্ শিট…বলে হুঙ্কার দিয়ে হনহন করে সিড়ির দিকে চলে গেলো। তিন সিড়ি একসঙ্গে ভেঙ্গে উঠছে পূর্ব! রুমের নব ঘুরিয়ে দরজা খুলেই দেখে রুম নিস্তেজ। পূর্ণতা সত্যিই নেই। প্রতিদিন নিয়ম করে রাতে ফিরে পূর্ণতার দেখা পেলে সমস্ত ক্লান্তি শরীর নিংড়ে বেরিয়ে যেতো। পূর্ণতা কেনো এই কাজ করলো? কোথায় গেলো? কেনো তখন উতলা হয়ে কল করেছিলো?
.
বিছানায় উপুড় হয়ে বালিশ আকড়ে শুয়ে আছে পূর্ণতা। রুমটা সবসময়ের মতো ঘুট্ঘুটে অন্ধকার করে লাইট নিভিয়ে রেখেছে। বিকেলে এ বাসায় ফিরেই স্বাভাবিক ভাবে আচরন করেছে যেনো কিছুই হয়নি, এমনেই সবাইকে দেখতে এসেছে। নূরানী পূর্ণতাকে পেয়ে খুশিতে গদগদ। রান্নাঘরে চলে গেছে পছন্দসই খাবার তৈরি করতে। টানা আড়াইঘন্টার শাওয়ার নিয়ে শাড়ি পাল্টে নরমাল সালোয়ার কামিজ পরেছে পূর্ণতা। বিয়ের পর এই প্রথম আবার সালোয়ার কামিজে। খোদেজা আর্জেন্ট একটা ডেলিভারী কেস সামলাতে হসপিটালে গিয়েছে। পূর্ণতার বাবা পূর্ণতার আসার খবর শুনেই খুলনা থেকে রওনা দিয়েছে। আসতে আসতে ভোর ছয়টা। বর্তমানে খালি ফ্ল্যাটবাড়িতে অন্ধকারময় রুমে নিস্তব্ধ রাত্রিরে শুয়ে আছে ও। নূরানী রুমের লাইট জ্বালিয়ে বললো,
– আপা খাইতে আসেন। ঠান্ডা হইয়া যাইবো।
– লাইট অফ কর নূরানী। আমার খিদে নেই। প্রচুর ঘুম পাচ্ছে তুই যা।
– আপা খালায় রাগ করবো।
– করুক। তুই খেয়ে নে। আমার চিন্তা করবিনা, আমি পরে খাবো।
নূরানী লাইট অফ করে দরজা চাপিয়ে চলে যায়। বাইরে থেকে দূরের বিল্ডিংয়ের খুবই কম আলো ঢুকছে এ রুমে। পূর্ণতার মন চরমাবস্থায় খারাপ হয়ে আছে। সিএনজির জার্নিটা ভালো যায়নি ওর, রাস্তাঘাটের বাজে দশার জন্য মাথার ভেতর এখনো দপদপ করছে। হঠাৎ রুমের দরজা খুলার শব্দটা এতো আস্তে হলো যে পূর্ণতা মনের ভ্রম ভেবে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলোনা। কানে কিছু অদ্ভুত শব্দ হলে ঘুমে ঢুলু চোখদুটো দিয়ে অন্ধকারে তাকিয়ে বলে,
– নূরানী? নূরানী প্লিজ যা। আমি খাবো না বলছি। বিরক্ত করিস না। তুই খেয়ে না!!!
পূর্ণতা আবার বালিশে মাথা লাগিয়ে সোজা হয়ে শুয়ে পরে। চোখ বন্ধ করতেই হঠাৎ ওকে কেউ পাজকোলে তুলে বারান্দার দোলনায় নিয়ে যায়। পূর্ণতা রাস্তা থেকে আসা উজ্জ্বল আলোতে দেখে পূর্বের মুখ, সাদা শার্ট, সাদাটে গ্যাবার্ডিন প্যান্ট। দোলনায় লম্বা হয়ে শুয়ে পূর্ণতাকে বুকের হাড়ের উপর টেনে নেয়। এলোমেলো চুলগুলো আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে গাল ভরে অজস্র ঠোঁটে ছুঁয়িয়ে দেয়। সাদা শার্টের ভেতর থেকে বুকের কিছু উন্মুক্ত হয়ে আছে পূর্বের। পূর্ব ঠান্ডা গলায় বলে উঠে,
– বাড়িতে সবাই তোমার জন্য চিন্তিত ছিলো। একটাবার ওদের বলে যেতে?
পূর্ণতা নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে পূর্বের বুকে মাথা এলিয়ে দিতেই পূর্ব ওর গালে হাত রেখে দিলো। পূর্বের হাতের পিঠে হাত রাখতে যেয়ে পূর্ণতার সেখানে চিপচিপে লাগলো। তৎক্ষণাৎ হাত সরিয়ে সেটা চোখের সামনে এনে দেখলো রক্ত! ঝট করে পূর্বের বুক থেকে মাথা তুলে ওর হাত টেনে দেখলো হাতের মুঠোবন্দির জায়গাগুলোতে রক্ত লেগে আছে! কাউকে বেধড়ক ঘুষালে যেমন ক্ষত হয়ে যায় তেমন ক্ষতবীক্ষত হয়ে আছে হাতে!
– ‘ চলবে ‘
#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৪১
#ফাবিয়াহ্_মমো
মুষ্টিবদ্ধ হাতের উচুঁ হাড়গুলোতে চামড়া উঠে রক্ত লেগে আছে। পূর্ণতা ধপ করে উঠে বসে ছটফট করে হাতটা চোখের সামনে এনে ফু দিতেই এমন ভঙ্গিতে অস্থির হয়ে উঠলো যেনো ব্যথাটা ওর করছে। ভীষন উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো,
– তুমি ওকে মেরেছো না? ওকে মারলে কেনো? এ কি করলে হাত? তোমাকে নিয়ে আমি কি করবো!!
বলতে বলতেই তিনগুণ বেশি চান্ঞ্চল্যে কামিজের শেষ কোণাটা টেনে পূর্বের হাতের উপর চেপে ধরে। পূর্ব ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে মাথার নিচে হাতের তালু রেখে নিরুদ্যম কন্ঠে বললো,
– মাথা ঠান্ডা! কিচ্ছু হয়নি। হাত ছাড়ো।
পূর্ণতা চোয়াল কঠোর করে চোখ রাঙিয়ে এমন দৃষ্টিতে তাকালো পূর্ব বাধ্য হয়ে নতজানু স্বীকার করে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। পূর্ণতা মলম, এন্টিসেপটিক লিকুইড ও তুলা এনে জায়গাটা খুব সাবধানে জীবাণুমুক্ত করে ভায়োডিন(Viodin-মলম) লাগিয়ে দিলো। দোলনায় পূর্ব শোফার মতো করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলে পূর্ণতা সব সামগ্রী রেখে এসে, দেখে পূর্ব ঘুমিয়ে পরেছে। একটা নরম পশমী কম্বল এনে পূর্বের পেট পযর্ন্ত ঢেকে দিলো পূর্ণতা। শহরে দুপুর টাইমে তীব্র তাপদাহ থাকলেও রাতের দিকে অদ্ভুতকাণ্ডের মতো এমন হিমভাব দেখা দেয় তখন গায়ে কিছু না জড়ালে নির্ঘাত ঠান্ডা লাগতে বাধ্য। পূর্ব এমনভাবে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে যেনো গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। কিন্তু তাই বলে কি বারান্দায় শুতে দেওয়া যায়? ন’তলা ফ্ল্যাটের বারান্দায় কেউ শুলে দূর-দূরান্ত থেকে সহজে না দেখা গেলেও নিজের কাছেই তো কেমন অদ্ভুত লাগে। তাছাড়া এতো তাড়াতাড়ি কেউ ঘুমায়? পূর্ব সারাদিন বাইরে কেমন ধকল সহ্য করতে থাকে তা যদিও অনুমানের বাইরে তবুও আন্দাজ করা যায় দৌড়ঝাঁপের চেয়ে সেটা কম না। দোলনাটা বেশ চওড়া ও দৈর্ঘ্যে বেশ লম্বা ছিলো বলে পূর্বের মতো বিশাল লম্বাটে মানুষ সাচ্ছন্দ্যে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেছে।
আচ্ছা? হাতে যেহেতু ক্ষত ছিলো শরীরের অন্যত্র কোথাও আঘাত লেগেছে? লাগলেও তো পূর্ব সেটা বলবেই না। পূর্ণতা ঘুমের মধ্যেই ওর শার্টের কলার টেনে গলা, কাধ দেখলো। হাতের কনুই পযর্ন্ত এপিঠ ওপিঠ দুইপিঠেই চেক করলো। যাক শান্তি আর কোনো ক্ষত নেই। পূর্ণতা একবার ভাবলো পূর্বকে ডেকে বিছানায় শুতে বলবে পরক্ষনে চিন্তা করলো কি দরকার স্বার্থপরের মতো এতো সুন্দর ঘুমটা ভাঙানোর? একদিন কষ্ট করে ঘুমালে কিচ্ছু হবেনা ওর। পূর্ণতা রিস্ক নিয়ে দোলনার যতটুকু অংশ পূর্বের শোয়ার পর বাকি ছিলো সেটুকু অংশতে এক কাত হয়ে পূর্বের দিকে ফিরে কম্বলে ঢুকে পরলো। যদি ভুলবশত সে ওকাত ফিরতে যায় তাহলে কোমর থেকে পিঠের হাড্ডি চুরচুর! কিন্তু এই মূহুর্তে পূর্বকে ছাড়া শোওয়ার লোভ সে কোনোভাবেই সামলাতে পারবেনা, কাজেই ঝুঁকিটা নিতেই হয়। ছোট্ট কুশনে মাথা হেলিয়ে পূর্ব সোজা হয়ে শুয়ে ছিলো , পূর্ণতা ওর ডানপাশে এককাত হয়ে পূর্বের বুকের উপর হাত রেখে চোখ বন্ধ করলো। সময় কতক্ষণ অতিবাহিত হয় পূর্ণতার খেয়াল নেই হঠাৎ পূর্ব ওর দিকে ঘুরে দুহাতে এমনভাবে চেপে ধরলো পূর্ণতার দম কঠিন ভাবে বন্ধ হয়ে আসলো। এরপর ওকে কিছু বলতে না দিয়েই ওকে সম্পূর্ণ ডানপাশ থেকে বামপাশে শুইয়ে দিলো পূর্ব। পূর্ণতা চমকানো দৃষ্টিতে বৃহৎ আকারে চোখ বড় করে ছিলো, মুখ হা করে অনবরত শ্বাস ছাড়তেই বললো,
– একাজ করলে কেন? যদি তোমার বাহুর পিষ্টনে মরে যেতাম!! আল্লাহ্, এখনো ধড়ফড় ধড়ফড় করছে…
পূর্ব প্রশ্নটার ছিটেফোঁটা গুরুত্ব না দিয়ে কম্বলটা টেনে পূর্ণতাকে আলতো করে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করলো। পূর্ণতাকে সেইফটি দেয়ার জন্যই মূলত পাশ পরিবর্তন করে দোলনার দেয়াল ঘেঁষে শুয়িয়েছে পূর্ব। দোলনা যতই চওড়া হোক, ঘুমের ঘোরে পূর্ণতা যদি বায় চান্স তাল বিগড়ে উল্টে পরে এতে অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা প্রবল ছিলো। পূর্ব যদিও জানে সে ঘুমের মধ্যে পূর্ণতার নড়াচড়া অনুভব করতে পারে তবুও সে তিলফোঁটা রিস্ক নিতে চাইলো না। পূর্ণতা এখনো বিষ্ময় কাটাতে পারেনি। একের পর এক বিরাট চমক খেয়ে যাচ্ছে যার কোনো উত্তর সে পায়নি। পূর্ণতা বললো,
– তুমি আমাকে এপাশে আনলে কেনো?
– তুমি ওপাশে থাকলে পরে যাবে।
– এটা কেমন হিসাব! আমি শুলে পরবো! আর তুমি শুলে পরবেনা?
– একটা মারবো! ঘ্যানঘ্যান করা বন্ধ করবে? চুপচাপ ঘুমাও।
পূর্ব আড়ম্বরপূর্ণ ভঙ্গিতে পূর্ণতাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো কিন্তু নিরর্থক ভাবে প্রশ্নটার উত্তর দিলোনা সে। পূর্ণতা দুইহাতে নিজের দিকে এমন আকড়ে ধরেছিলো যেনো পূর্ব কোনোভাবে পিছিয়ে না যায়। গেলেই ব্যথা পাবে।
– কুত্তার বাচ্চাটা কতদিন ধরে জ্বালাচ্ছিলো? আমাকে এ ব্যাপারে কেনো বললে না!
পূর্বের মুখে আচমকা এমন কথা শুনে প্রচণ্ডরূপে শিউরে উঠে পূর্ণতা। গলার ঝাঁজটাই যেনো আগুনের লাভায় চুবানি খেয়ে তপ্ত স্ফুলিঙ্গ ছড়াচ্ছিলো। পূর্ণতা খপ করে পূর্বের পিঠের শার্ট খামচে ভয়ে ধরে। পরপর গলায় ক’টা ঢোক গিলে ধাতস্থ সুরে বললো,
– আস্তে পূর্ব! রাতেরবেলা মাথা গরম করো না। কি করেছো ওকে?
– আদর করে চুমু খেয়েছি। কোলে এনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছি, ঠিক করেছিনা বলো?
পূর্ব যত হাস্যকর ভাবে কথাটা উচ্চারণ করছে ঠিক ততটাই ভয়ানক কিছু ঘটিয়ে এসেছে ওখানে। কি কান্ড করেছে সেটা আজ নয়তো কাল এমনেই জানা যাবে কিন্তু সাংঘাতিক কিছু যে করে এসেছে এটুকু আঁচ করে প্রচুর চিন্তান্বিত পূর্ণতা। খুব কষ্ট করে চোখের পাতা বুজে ঘুমাতে চেষ্টা করলো ও। ঠিক কখন যে তন্দ্রাঘোরে ডুবে যায় খেয়াল থাকেনা পূর্ণতার।
.
বাড়ির ফটক পেরিয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে ঠিক ড্রয়িংরুমেই শ্বাশুড়ি ও দুই চাচীকে জড়ো দেখে পূর্ণতা। সবার মুখ থমথমে বিষন্ন ও করুণ চেহারা। পূর্ব চুলের ব্যাকব্রাশ করতে করতে সিড়ি ধরে উপরে চলে যায়। এদিকে পূর্ণতার আগমনে আয়েশা কিছুটা অভিমান গলিয়ে পূর্ণতাকে খাবার টেবিলের দিকে নিয়ে যায়। পূর্ণতা একটা ব্যাপার লক্ষ করে পূর্বের বড় চাচী খুব চটে আছেন, রাগে উনার চোখদুটো দপদপ করে উঠছে। তার পাশে বসা ছোট চাচী চোখ এমনভাবে রাঙিয়ে আছেন যেনো একপলকের জন্যও চোখের পাতা ফেলেনা। পূর্ণতা আশেপাশে কোথাও ফুয়াদ, জাওয়াদ ও সায়মাকে দেখতে পেলো না। আয়েশা পাউরুটিতে ওরেন্জ জেলি মাখিয়ে পূর্ণতাকে খেতে দিয়ে বলে,
– কাল রাতে কিছু খেয়ে ঘুমিয়েছো?
পূর্ণতা আয়েশার দিকে তাকিয়ে মিইয়ে যায়। রাতে ও কিছুই খেয়ে ঘুমায়নি এমনকি সকাল সাতটা না বাজতেই পূর্ব এমন জোর খাটালো যে পূর্ণতার মা খোদেজা রাগে পূর্বকে কটু কথা শোনালেন। এমনেই সে পূর্বকে দেখতে পারেনা তার উপর নাস্তা না খাইয়ে পূর্ণতাকে নিয়ে যাওয়ার কথা তুলতেই ভীষন রেগেমেগে কথা শোনায় পূর্বকে। পুরো রাস্তায় পূর্ব টু শব্দ না করলেও খোদেজার আচরণ বেশ রূঢ়-ই ছিলো, অন্যকেউ হলে সম্পর্ক চ্ছিন্ন করার কথা বলতো পূর্ব সেটা করেনি। পূর্ণতা নাস্তা খেয়ে পূর্বের জন্য রুমে ট্রে নিয়ে গেলে পূর্বিকাকে পূর্বের পাশে বসে থাকতে দেখে। পূর্ব সোফায় বসে নিচের দিকে ঝুকে দুহাতে মাথা টেনে ধরে আছে আর পূর্বিকা অনবরত ওকে শান্ত হতে বলছে।
কালরাতে পূর্ব যখন রুমের দরজা খুলে দেখে পূর্ণতা নেই, বুকটা খা খা করে উঠে ওর। তীব্র অপরাধবোধে দরজা চাপিয়ে আলমারি খুলতেই হঠাৎ অদ্ভুত একটা শব্দ শুনতে পেয়ে স্থির হয়ে যায়। শব্দটা রুমের ভেতর হচ্ছে কিন্তু কোথা থেকে হচ্ছে সেটা বুঝতেই পূর্ব কয়েক মিনিট চারিদিকে চোখ ঘুরালো। আবিষ্কার করলো ওয়াশরুমের দরজায় কেউ ঠকঠক করে নক করছে। পূর্ব সর্তক হয়ে দরজায় পাশে এসে কান পেতে শুনতে পায় পুরুষালী গলা। অশ্রাব্য, অকথ্য বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করছে পূর্ণতার নাম ধরে। যার কথাগুলো ছিলো এমন,
– একবার দরজা খোল পূর্ণতা! আজ যদি তোকে বেডে না আনি! তোর ভাব যদি চুরমার নি করি দেখিস! কিরে মা* দরজা খোল!
নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনা পূর্ব! ছিটকিনি টেনে দরজা খুলতেই দেখে ফুয়াদ। ফুয়াদ ভেবেছিলো পূর্ণতা হবে তাই মুখে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠেছিলো কিন্তু হরিণের জায়গায় বাঘকে দেখে ফুয়াদ তৎক্ষণাৎ ফ্লোরে লুটিয়ে হাতজোর করে মাফ চাইতে লাগলো। পূর্ব ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতায় নেই, না আছে নিজেকে সামলানোর মতো ক্ষমতা! এই মূহুর্তে দুনিয়া কাঁপিয়ে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ওকে ভয়ঙ্কর শাস্তি দেওয়ার পৈশাচিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে পূর্ব। কোমর থেকে চামড়ার মোটা বেল্টটা খুলে হাতে পেঁচাতে পেঁচাতে ব্যায়ামের মতো ঘাড় একাত ওকাত করছে। ফুয়াদ তাই দেখে জীর্ণশীর্ণ ভঙ্গিতে তাড়াতাড়ি পূর্বের পা ধরে ক্ষমা চায়। ও জানে পূর্বের রাগ আর যাই হোক কোনো বীভৎস তান্ডবলীলার চেয়ে কম না! একফোঁটা দয়াও ওর কাছ থেকে পাওয়া বৃথা। ফুয়াদ নিরুপায় হয়ে কেদেঁ দেয়, ওর বাবা মাকে ব্যর্থ চেষ্টায় ডাকতে থাকে কিন্তু কেউ শুনতে পায়না। পূর্ব রুমে ঢুকতেই দরজার নবে লক চেপে ঢুকেছে, অতপর ফলাফল শূন্য! শত চিল্লিয়েও লাভ নেই! এরপর যে দৃশ্য শুরু হয় তা যে কেউ দেখলে ভয়ে, আর্তনাদে মুখের উপর হাত চেপে পালিয়ে যেতো। পূর্ব প্রতিটি গালির, প্রতিটি অকথ্য ভাষার, প্রতিটি কটুক্তির জন্য পাই পাই হিসাব চুকিয়ে ক্লান্ত দেহ নিয়ে পোশাক হাতে ওয়াশরুমে ঢুকে। মাথার রগরগে দারুণ উত্তপ্ত অনুভব করছে পূর্ব। শাওয়ার ছেড়ে দেয়ালে একহাত রাখতেই হঠাৎ চাপা উত্তেজনা ঠেলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে! শান্তি নেই! মনে আজ শান্তি নেই পূর্বের!
পূর্বের কর্মকাণ্ডে প্রচণ্ড ক্ষেপে পলাশের উপর রাগ ঝেড়েছে পরশ। ছেলেকে এমনভাবে পিটিয়েছে এখন হাসপাতালের সিসিইউ-তে ভর্তি করতে হয়েছে ফুয়াদকে। ওর অবস্থা নাজুক। প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে, ডাক্তার রক্ত বন্ধ করতে পারছেনা। নাক থেকে রক্ত আসছে বিধায় ওর শ্বাসকার্য চালানো কঠিন হয়ে পরেছে। ডাক্তার টেস্ট করার সময় পাচ্ছেন না, প্রচুর টেনশনে ফুয়াদকে হ্যান্ডেল করছে। ফুয়াদের মা একটু পর পর সেন্সলেস হয়ে আজেবাজে বকছে, কাউকে চিনতে পারছেনা। মিথুন রুমালে মুখ ঢেকে কাঁদছে। সায়মা হঠাৎ হঠাৎ পাগলের মতো চেঁচামেচি করে উঠছে। মোটকথা বাড়ির অবস্থা এতো নাজেহাল হয়তো আগে কখনো হয়নি। আয়েশা ছেলের কাছ থেকে পুরো ঘটনা শোনার পর কাউকে দোষারোপ করতে পারছেন না। ওদিকে ফুয়াদের দোষ থাকলেও পূর্ণতা কেনো কথাটা সবাইকে জানালো না এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছে সবাই। পলক চুপ থাকলেও মাঝেমাঝে যেটুকু কথা বলে সবটাই পূর্ণতার বিপক্ষে এবং পূর্বের দোষের কথা এহলান করে।
পূর্বিকা পূর্ণতাকে দরজার কাছে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভেতরে আসতে বলে। পূর্ণতা গুটিগুটি পায়ে চুপচাপ ট্রে-টা টেবিলের উপর রেখে পূর্বের দিকে তাকিয়ে থাকে। পূর্ব ভ্রুক্ষেপ না করে মাথা নিচু করেই থাকে। পূর্বিকা শান্ত কন্ঠে বলে উঠে,
– কাল আমাকে ডাকলে এখন এমন পরিস্থিতি হতো না পূর্ণতা। হাসপাতালে ফুয়াদের অবস্থা খুবই খারাপ যাচ্ছে। এখনো ব্যাগে ব্যাগে ব্লাড সাপ্লাই দিতে হচ্ছে।
বলতে বলতেই ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে ফুস করে নিশ্বাস ছাড়ে পূর্বিকা। পূর্বের পাশ উঠে পূর্ণতার কাধে হতাশ ভঙ্গিতে হাত রেখে চলে যায় রুম থেকে। পূর্ণতা পূর্বের পাশে সোফায় বসলো। পূর্বের পিঠে নির্লিপ্তে হাত রাখতেই পূর্ণতা বলে উঠলো ,
– আমি কি ভুল করেছি বলো? চাচী আমার সাথে এমন করছে কেনো?
পূর্ব চোখ বন্ধ করে মাথার চুল টেনে ধরে। পূর্ণতা বিকেলে কল করেছিলো কিন্তু পূর্ব একটা জরুরী কাজে ব্যস্ত ছিলো বলে ধরতে পারেনি। পূর্ণতার সেই অসহায় সময়টাতে যদি ফুয়াদ সত্যিই ক্ষতি করে বসতো তখন? তখন পরিবার ফুয়াদকে কিসের শাস্তি দিতো? আইনের শাস্তি? যেখানে মার্ডার কেসেরই শাস্তি হয়না আর সেখানে রেপের কেসে সাজা হবে তা তো কল্পনার কথা। পূর্ব মাথা তুলে সোজা হয়ে বসলো। পূর্ণতার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাতেই ঝাঁপিয়ে পরলো ওর উপর। পূর্ণতার মাথায় হাত বুলিয়ে গালে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে পূর্ব বলে উঠলো,
– তুমি যেখানে ভুল করোনি সেখানে তোমাকে দোষারোপ করার মানে হয়না। ওই কুত্তার বাচ্চাকে বাঁচার জন্য ওভাবে মারিনি! মরার জন্যই পিটিয়েছি! ও বাঁচুক তা আমি চাইবো না!
পূর্ণতা জোরে নিশ্বাস ছেড়ে চোখের পাতা বুজে ফেললো। সামনে খুব বড় ঝড় আসতে চলেছে। হয়তো এ ঘটনার প্রেক্ষিতেই পূর্বের আপন মানুষগুলো ওর সাথে সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইবে। পূর্ণতা আজ নিরুপায়, নিরুদ্দিষ্ট, নিরুত্তেজ! ঠিক কি কি সহ্য করতে হবে ওর…জানা নেই।
সকালটা না হতেই তুলকালাম ঘটনা বাধিয়ে ফেললো পরশ ওয়াসিফ। বড় ভাইয়ের সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সম্পত্তি ভাগাভাগির কথা উঠলো। পূর্ব তখন সদ্য ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করছিলো নিচ থেকে চাচা ও বাবার গলা শুনে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিচে গেলো। পূর্ণতা অনেক আগেই নাস্তার টেবিলে সবার জন্য সকালের নাস্তা সাজাচ্ছিলো ড্রয়িংরুম থেকে চিল্লাচিল্লি শুনে সে-ও কাজ ফেলে সেখানে দৌড়ে গেলো। পূর্ব ততক্ষণে চাচাকে শান্ত হওয়ার জন্য অনুরোধ করছিলো চাচা উল্টো ওর দিকে তর্জনী উঁচিয়ে উঁচু গলায় বললো,
– তুমি কথা বলতে আসবেনা পূর্ব! যেই ছেলে বিয়ের পরপরই বউয়ের কথায় উঠবস করে তাকে আমি দুচোক্ষে সহ্য করতে পারিনা!
– সেক্ষেত্রে তো দাদার উচিত ছিলো তোমাকে বিয়ের পরদিনই বের করে দেওয়া। দিয়েছে?
– খবরদার পূর্ব! এতো স্পর্ধা দেখাবেনা ! তোমার বউ কতখানি খাটি সেটা আগ বারিয়ে বিচার করা উচিত ছিলো!
– ওহ্! আমার বউ খাটি না বাসি তা আমি জানিনা? না জেনেই রেন্ডম মেয়েকে বিয়ে করেছি বলে ভাবো?
– অবশ্যই! নাহলে যেই ছেলেকে বিয়ের জন্য হাজার হাজার ছবি দেখানো হলো, শেষে কিনা ঘোষনাও দিলো সে জীবনেও বিয়ের মতো পাপ কাজ করবেনা হঠাৎ এতো উতলা হলো কি করে?
– সেটা তো তোমার দেখার বিষয় না চাচ্চু। আমি বিয়ে করেছি সেটা কমপ্লিটলি আমার ডিসিশান! এখানে ইনিয়ে বিনিয়ে তোমার জাওড়া ছেলের জন্য আমার বউকে তো দোষারোপ করতে পারো না।
– আমার ছেলেকে নিয়ে একটাও বিশ্রী কথা বলবেনা তুমি!
– কেনো? গায়ে লাগছে? তাহলে আমার বউকে যখন প্রস্টিটিউটের মতো গালিগালাজ করছিলো আমার তখন কেমন লাগছিলো সেটা একটু বুঝো!
– বারবার ‘আমার আমার’ করা বন্ধ করো। দুদিনের মেয়ে এসে কেমন রঙ খাইয়ে দিয়েছে তা তো চোখে দেখতেই পাচ্ছি! আমিতো আর কানা না!
– আমিও অন্ধ নই চাচ্চু! তোমার বেশশরম ছেলে ‘বন্ধু’ বলে কোন মেয়েদের বাড়িতে আনতো সে সম্পর্কেও আমার কাছে লম্বা ইনফরমেশন আছে! আমাকে তুমি জ্ঞান দিতে এসো না।
ভাই ও ছেলের অহেতুক ঝগড়ার রেশে পলাশ ওয়াসিফ চিন্তান্বিত হয়ে ধপ করে সোফায় বসে পরে। পূর্বিকা বাবার পাশে দৌড়ে এসে দেখে পলাশ গোসলের মতো ঘামছে, ঘাড় ঘুরাচ্ছে। পূর্বিকা চটজলদি পালস রেট চেক করতে যেয়ে অসাড়শূন্য মুখে পূর্বের দিকে তাকিয়ে বলে,
– ভাই? আব্বুর পালস রেট হাই হচ্ছে। কিছু কর!
পূর্ব চলমান তর্কযুদ্ধটা হঠাৎ থামিয়ে পূর্বিকার করুন চাহনি ও বাবার অসুস্থ মুখের দিকে তাকিয়ে অস্থির হয়ে যায়। পলাশ চোখ বন্ধ করে হাপানির মতো নিশ্বাস টানছে। পূর্ব গালে আলতো ধাক্কা মেরে বলতে থাকে,
– আব্বু? আব্বু চোখ খুলো? খুব খারাপ লাগছে? হসপিটালে নিবো?
পলাশ ওভাবেই নিশব্দে মাথা ডানেবামে নেড়ে বুকের বাঁ পাশে ঘুষাতে থাকে।। লক্ষন শুভ নয়! পূর্ব একহাত কাধে তুলে তাড়াতাড়ি বাবাকে রুমের দিকে নিয়ে যায়। বাড়ির যত চাকর ছিলো সবাইকে মাথায় তুলে পূর্ব প্রচণ্ড অপ্রকৃতিস্থ হয়ে বাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে যায়। ডাক্তারকে বাসায় ডেকে চেকআপ করাতেই জানতে পারে ০.৯ মাত্রায় হার্ট এ্যাটাক করেছে পলাশ ওয়াসিফ। পূর্ব এতোটা বিহ্বল হয়ে ভেঙ্গে পরেনি যতোটা বাবার অসুস্থতার এমন খারাপ খবর শুনে সে হয়েছে। পূর্ণতা বোবার মতো চুপচাপ হয়ে যায়। সকালের নাস্তা, দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সবকিছু অরুচির তালিকায় চলে যেতে থাকে। একদিকে ফুয়াদের ক্রিটিক্যাল অবস্থার জন্য হাসপাতালে সবাই কাঁদছে অন্যদিকে পলাশ ওয়াসিফের ছোট্ট মাত্রায় হার্ট এ্যাটাকের খবর পরিবেশটা আরো গুমোট করে দিয়েছে। দেখতে দেখতে ক্যালেন্ডারে দুটো দিন কাটা পরে যায়। কিন্তু সকাল হয়ে রাত হলেও পরিস্থিতি আগের মতোই শ্বাসরুদ্ধকর থাকে। আয়েশা হাইপ্রেশারের পেশেন্ট সেই সাথে শরীরে কিডনি জনিত সমস্যার জন্য বহুদিন যাবৎ অসুস্থ। পূর্ণতা শ্বাশুড়ির প্রতি মনোযোগী হলে অপরদিকে পূর্ব বাবার দিকে মগ্ন থাকে। কিছু সম্পর্ক ধীরে ধীরে খোলস ছাড়িয়ে আসল রূপ দেখিয়ে দেয়। পরশ ওয়াসিফের প্ররোচনায় পলক ওয়াসিফও পূর্বকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর যুদ্ধে নেমে পরে। পূর্ব যতদিন এ বাড়িতে থাকবে সম্পত্তি বিষয়ক কাজে কন্টক হয়ে বাধা দিবে।।
ফুয়াদের অবস্থা আগের থেকে উন্নতিলাভ করে। ডাক্তার ওকে সিসিইউ থেকে আইসিইউতে শিফট করে। তবুও নাকে নল ঢুকিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস চালানোর সিস্টেমে উন্নতিলাভ হয়নি ওর। কোমার মধ্যেই চিকিৎসা চলছে ফুয়াদের। বাড়ির প্রকৃতি নিস্তব্ধ মৃত্যুপুরীর মতো লাগে পূর্ণতার। সকালে বিকালে দফায় দফায় খোটা খায় পূর্ণতা। বড় চাচী একদফা বলে গেলে ছোট চাচী এসে সেটা রসালো করে আরেকদফা খোচা মেরে যায়। এদিকে পূর্বের উপর পারিবারিক, রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক চাপগুলো একসঙ্গে ধেয়ে আসে। পলাশ ওয়াসিফের অসুস্থতার খবর পেয়ে অনেক ইনভেষ্টমেন্টরা তাদের মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে, পূর্বের শূন্যতায় দলের মধ্যে নানা দন্ড-বিরোধ হচ্ছে, পূর্ণতাকে নিয়ে কথা বলতে সুযোগ ছাড়েনা কেউই। পূর্ব বিধ্বস্ত হয়ে উপায়ন্তর না পেয়ে আরো গম্ভীর হয়ে যাচ্ছিলো দিন দিন। সব সম্পর্কের জন্য অবনতির জন্য পূর্ণতার সাথেও স্বাভাবিক সম্পর্কটা ঠিকঠাক ভাবে চালাতে পারছেনা পূর্ব। পূর্ণতাকে দেখলে এখন মনেহয় মূল দোষটা ওরই! যদি পাকনামো না করে সে ফুয়াদের ঘটনাটা আগেই কাউকে বলে দিতো তাহলে এ পর্যায়ে ঘটনাটা এগুতো না। পলাশের হার্ট এ্যাটাকেও পূর্বের ব্রেন কোনো না কোনো ভাবে পূর্ণতাকে দায়ী করে। আবার এক মূহুর্তের জন্য ভাবে এতে পূর্ণতার দোষ নেই। দোষটা ওর নিজের। ফুয়াদকে ওভাবে না মারলে ঠিক হতো কিন্তু পূর্ণতার বিরুদ্ধে একটা অক্ষর শুনলে ওর আত্মা যেভাবে পৈশাচিক রূপ ধারন করে এতে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই পূর্বের। ফুয়াদের সাথে যা হয়েছে তা একদম যোগ্য কাজ হয়েছে! ওর মরে যাওয়া উচিত। পূর্ব সামনের পথটা খুব ঘোলাটে, ধোয়াশা, ধুম্রাবস্থা দেখছে। পূর্ণতার জন্য সবার সাথে সম্পর্কটা যেভাবে নিচুস্তরে তলিয়ে যাচ্ছে হঠাৎ করে ‘বিচ্ছেদ’ শব্দটা ‘উড়ে এসে জুড়ে’ বসে কিনা কে জানে?
‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO