তোকে ঘিরে পর্ব-৬৫+৬৬

0
856

#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৬৫.
#ফাবিয়াহ্_মমো

স্যালাইনের নল ও যন্ত্রপাতির কক্ষ থেকে নরমাল বেডে আনা হয়েছে পূর্ণতাকে। শরীরের মধ্যে দূর্বলতার রেশ এখনো কায়েম রয়েছে। খোদেজা কিছু ঔষুধ খাইয়ে পূর্ণতাকে রেস্ট নিতে বলেছে। কিন্তু পূর্বের জন্য সেটা সম্ভব হয়নি একদমই। খোদেজা যেখানে কাউকে থাকতে নিষেধ করেছিলো, সেখানে অটল হয়ে বেডের পাশে পূর্ব বসে রইলো। এদিকে সদ্য জন্ম নেওয়া নবজাতকের দেহের তাপমাত্রা পৃথিবীর তাপমাত্রার সাথে বজার রাখার জন্য খোদেজা পূর্বের কোল থেকে নাতীকে নিয়ে টেম্পেরেচার কক্ষে চলে যায়। পরপর সবাই যখন পূর্ণতার সাথে দেখা করে রুমের বাইরে চলে গেলো তখন পূর্ণতার বুকটা ধড়ফড়-ধড়ফড় করতে লাগলো। পূর্ব এখন পাশে, কিছুটা দূরত্বে, খুবই নিকটে। কিন্তু পূর্ণতার দীর্ঘদিনের ধৈর্য্য এখন চরম অভিমানে পরিণত হয়েছে। পূর্বের দিকে তাকাতে যেয়ে হঠাৎ চোখাচোখি হয়ে যায় ওর। ওমনেই পূর্ণতা দ্রুত চোখ বন্ধ করে ফেললো। পূর্বকে এইভাবে সামনে পেয়ে মনের অন্দরে প্রচুর তোলপাড় চলছিলো। নিজেকে শান্ত করার জন্য পরপর কয়েকবার ঢোক গিললো পূর্ণতা। মনেমনে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলো, সে কিভাবে এই গুমোট পরিস্থিতিটা সামাল দিবে? পূর্ব যদি এভাবেই চুপচাপ বসে থাকে তাহলে পূর্ণতার অভিমান দুই মিনিটের মধ্যে ধূলো করে দিবে। চোখ বন্ধ করলেও পূর্ণতা স্পষ্ট করে বুঝতে পারছিলো পূর্ব ওর দিকেই একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সেই ধারালো দৃষ্টি, সেই শান্ত গভীর চাহনি, সেই সম্মোহন করার মতো বশীভূত ক্ষমতা নিয়ে পূর্ব যেনো পূর্ণতার সমস্ত মুখ ঘিরে রেখেছে।। এসব ভাবতেই পূর্ণতার বুকের ধড়ফড়ানি থামার বদলে আরো তীব্র উৎকন্ঠায় বেড়ে উঠছে। বেডে বসা পূর্ব কানের দুইপাশ থেকে রাবার টেনে মাস্কটা খুলে ফেললো। পান্ঞ্জাবীর পকেটে মাস্কটা ঢুকিয়ে সে পূর্ণতার দিকে ধীরগতিতে একধাপ এগুলো। পূর্ণতা তখনো চোখ বন্ধ করে ছিলো, হৃৎযন্ত্রের বেগতিক ক্রিয়াকলাপের জন্য লম্বা-লম্বা শ্বাস টানছিলো। পূর্ব ধীরে-ধীরে পূর্ণতার মুখের কাছে গিয়ে স্থিরদৃষ্টিতে তাকালো।

পূর্বের দুইহাত পূর্ণতার কানের দুইপাশে সাদা বালিশের উপর রাখা। পূর্ণতার ক্লান্তিপূর্ণ মলিন চেহারার দিকে পূর্ব নিবিষ্টে তাকিয়ে থাকলে আচমকা পূর্ণতা চোখ খুলে ফেলে। যতোটা শান্ত হয়ে ও চোখ খুলেছিলো তার চেয়ে অধিক মাত্রায় অপ্রস্তুত হয়ে গা কাঁপিয়ে শিউরে উঠলো পূর্ণতা। চোখ বড় বড় করে থরথর করে নরম ওষ্ঠজোড়া কাঁপাতে থাকলে পূর্ব পূর্ণদৃষ্টিতে ওর চোখের দিকে তাকালো। সেই দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলাতেই পূর্ণতার বুকটা ধ্বক করে মোচড়ে এলো আবার। পুরোনো ব্যথায় আচড় লেগে পূর্ণতার চোখ অশ্রুতে ছলছল করে উঠলো। জোরে জোরে শ্বাসকার্য চালাতেই অকস্মাৎ বর্ষণের মতো চোখ খিচ মেরে নিচের ঠোঁট কামড়ে কেদেঁ দিলো পূর্ণতা। দেহের ব্যথায় কাতর হয়ে মানুষ আচমকা যেভাবে অঝোরে কেদেঁ উঠে, মনের ব্যথায় জর্জরিত হয়ে পূর্ণতার ছোট্ট বুকটা টুকরো-টুকরো হয়ে ছিড়ে যাচ্ছিলো যেনো। গর্ভাবস্থায় একবারের জন্যও দেখতে আসলো না পূর্ব। একটাবারও হাত ধরে চুমু খেয়ে বললো না, ‘আমি আছিতো।’ দিনগুলো সহ্য করা গেলেও রাতগুলো প্রচণ্ড দুঃসহ ছিলো। চারপাশ নিরব হয়ে গেলে মনের যন্ত্রণা কুড়ে কুড়ে শেষ করতো। পূর্ণতা ফুপিয়ে কাঁদতে থাকলে পূর্ব ডানহাতে পূর্ণতার মাথাটা বালিশ থেকে খানিকটা উঁচুতে তুললো। কপালে পরম আবেশে ওষ্ঠযুগল ছুঁয়িয়ে দিয়ে পূর্ণতার কান্নারত মুখের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে কম্পমান ওষ্ঠের দিকে এগুতেই পূর্ণতা তৎক্ষণাৎ পূর্বের ঠোঁটে হাত চাপা দিয়ে বসলো। কান্নাসুরে তেজ দেখিয়ে সে বললো,

– এখন এই দরদ কিসের? কেনো আমার প্রতি ভালোবাসা দেখানো হচ্ছে? কে আমি? আমি তোমার কেউ? আধঘন্টা আগে যদি দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতাম বেশ শান্তি পেতে না? তুমি আর কক্ষনো আমার সামনে আসবেনা ওয়াসিফ পূর্ব! কোনোদিনও আমার সামনে আসবেনা। তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল আমি তোমাকে ভালোবেসেছি। আমি একটা পাষাণতুল্য মানুষের জন্য নিজের জীবনটা অন্ধকার করেছি। এইটুকু বুঝ আমার মধ্যে হয়নি যে, তুমিতো কোনোদিনও আমাকে প্রথম পর্যায়ে রাখোনা। রাস্তার ছ্যাঁচড়া কুকুরের মতোই আমাকে দেখো। একটা ভিখারির উপর মানুষও দয়া করে, আমার উপরে একটুখানি দয়া দেখিয়েছো? একবারের জন্য ভেবেছো জেল থেকে বের হয়ে সোজা বাড়ি যাই? আজ জ্যামের মধ্যে গাড়িটা যখন আটকালো তখন বারেবারে মনে হচ্ছিলো আমি হয়তো তোমার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে পারবো না। ওই দমবন্ধকর পরিবেশে আমি মারা যাবো। আর জীবনেও তোমাকে দেখতে পাবোনা। আমার প্রচুর শ্বাস টান হচ্ছিলো ওয়াসিফ পূর্ব। ব্যথায় শরীরের হাড্ডি পযর্ন্ত চিনচিন করছিলো। যখন মনেহয় আমি একটা পাষাণের জন্য দিনরাত কেঁদেছি, শরীরের সব যন্ত্রণা মুখে তালা লাগিয়ে সহ্য করেছি, সেই পাষাণতুল্য মানুষ আমার সামনে এসে আজ দরদ দেখাচ্ছে, ভালোবাসা বোঝাচ্ছে, আদরে চুমু খাচ্ছে। আমি চিৎকার করেই কেদেঁছি পূর্ব, তোমার প্রতিটা যন্ত্রণা দেখে আমি কেদেঁ ফেলেছি। কিন্তু আমার যন্ত্রণা দেখে তোমার একটুও মায়া হয়নি। আমাকে চার-চারটা মাস তুমি কষ্ট দিয়েছো। আজ আমি কেনো বেঁচে রইলাম নিজেও জানিনা। সত্যিই জানিনা, জানা নেই…

শক্ত হয়ে গেলো পূর্বের মুখ। চোখের দৃষ্টিও কঠোর হয়ে উঠলো ওর। পূর্ণতার কাছ থেকে ধীরে-ধীরে মাথা তুলে বেড থেকে উঠে দাড়ালো। পূর্ণতা দুহাতের তালুতে মুখ ঢেকে তুমুল অশ্রুধারায় কাঁদছিলো। পূর্ব সেদিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে পেছনের দিকে পিছিয়ে যাচ্ছিলো। দরজার কাছে যখন পিঠ ঠেকে গেলো তখন পূর্ব নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। ঠিক ওইসময় আয়মানের মুখোমুখি হয়ে যায় পূর্ব। অপ্রস্তুত হয়ে আয়মানের সামনে যখন দাড়িয়ে পরলো তখন আয়মান কৌতুহল পানে কেবিনের বদ্ধ দরজায় তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ পূর্বের দিকে দৃষ্টি ফেললো। পূর্বের হাবভাবে কোনো বিরূপ অবস্থা বোঝা না গেলেও আয়মানের মনে সুক্ষ কৌতুহল কাজ করছিলো।সে উদ্বেগপূর্ণ গলায় কিছুটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো,

– পূর্ব ভাই, কিছু হইছে?

পূর্ব খুব সাবধানে গলা ভিজালো যেনো। তারপর খুব শান্ত সুরে বললো,

– না, কিছু হয়নি।

আয়মানের মন শান্তি পেলো না উত্তর শুনে। কিন্তু পূর্বকে পাল্টা প্রশ্ন করতে পারলো না সে। পূর্ব হনহন করে করিডোর পেরিয়ে টেম্পেরেচার কক্ষে চলে গেলো। উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে আয়মান পূর্বের যাওয়া দেখে উশখুশ মনে শেষে চিন্তা করলো পূর্ণতার কেবিনে গেলেই হয়তো কাহিনির জট খুলবে। আয়মান সাথেসাথে কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই হকচকিয়ে থমকে যায়। পূর্ণতা হাউমাউ করে মুখ ঢেকে কাঁদছে। তাড়াতাড়ি আয়মান দরজা চাপিয়ে পূর্ণতার কাছে দৌড়ে আসে। বেডের কাছে স্টিলের টুলটা টেনে বসতে-বসতেই প্রচণ্ড উত্তেজনায় আয়মান প্রশ্ন ছুঁড়ে,

– দোস্ত কি হইছে?কাঁদোস ক্যান? ভাই তোরে কিছু বলছে? ছেড়ি তুই এমনে কাঁদলে কি চলবো? আমারে বলবিনা? পূর্ণতা বল, কি হইছে? কাঁদিস না, চুপ কর।

আয়মানের জোড়াজুড়িতে অনেকক্ষন পর পূর্ণতা একটু শান্ত হলো। দুচোখ হাতের তালুতে মুছে আয়মানের দিকে দৃষ্টি দিলো। আয়মান টুলে বসে ওর দিকে উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে। পূর্ণতা শুকনো গলা ভিজাতে গিয়ে একটু অপ্রসন্ন বোধ করলো। হাতের ইশারায় পানির বোতল দেখিয়ে দিলে আয়মান দ্রুত গ্লাসে পানি ঢেলে ওকে খাইয়ে দিলো। গ্লাসটা আগের জায়গায় রাখতেই আয়মান বলে উঠলো,

– এখন বল কি হইছে? ক্যান এইভাবে কাঁদতাছিলি? ভাই তোরে কিছু বলছে? আমার মনেতো হয়না,ভাই তোরে ওমন কিছু বলবো। ঠিক কইরা বলতো, কি হইছে?

পূর্ণতা আবার ভেজা চোখ মুছে নিলো। গলা একটু ঠিক করে হালকা কেশে ঠান্ডা গলায় বললো,

– কিছুই হয়নি।

আয়মান দারুণ রাগ দেখিয়ে কপাল কুঁচকে ফেললো। চেঁচিয়ে বললো,

– আবার মিথ্যা বলোস কোন্ সাহসে? চটকানা না খাইয়া সোজাসাপ্টা বল তোর কি হইছে ভাইয়ের লগে? তুই ভাইরে কি বলছোস? আমি জানি তুই পাকনামি কইরা ভাইরে আজাইরা বকছোস, আর বইকা নিজেই দুনিয়া ভাসায়া কাঁদতাছোস। ঢপ না মারায়া তাড়াতাড়ি ক, কি বলছোস ভাইরে।

পূর্ণতা কয়েক মিনিট চুপ করে থাকলো।সিলিংয়ের দিকে নিরবে তাকিয়ে থাকতেই অশ্রুপূর্ণ চোখে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বললো,

– আমার সামনে থেকে ওই লোককে চলে যেতে বলেছি। আমি ওই লোকের মুখ দেখতে চাইনা।

পূর্ণতার ওইটুকু কথা শুনে প্রচণ্ড অবাক হয়ে যায় আয়মান। ঝট করে টুল থেকে আকস্মিক দাড়িয়ে যায় সে। চোয়াল ঝুলিয়ে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে থাকলে ওই মূহুর্তেই আয়মান বিষ্ময়সূচকে বলে উঠে,

– তুই সত্যিই এইগুলা বলছোস ?

পূর্ণতা চোখ বন্ধ করে ফেললো। বন্ধ করতেই অশ্রুগুলো দুকোল বেয়ে বালিশে গড়িয়ে পরলো। আয়মান হতবুদ্ধির মতো কতক্ষণ নির্বাক ছিলো জানা নেই, যখন সৎবিৎ ফিরে পেলো তখন পূর্ণতার উপর প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে হুঙ্কার দিয়ে বললো,

– তুই থাবড়া খাইলে সোজা হবি? তুই এগুলা কি করলি পূর্ণতা? কেন তোর ঘিলুর মধ্যে এইটা ঢুকেনা এই ‘ওয়াসিফ পূর্ব’ নামের পোলা তোরে ছাড়া আর কিচ্ছু বুঝেনা! বারবার তুই একই তামশা ক্যান করোস? তুই কি জানোস ভাই এতোদিন কি করতে গেছিলো? ভাই এতোদিন…

তীব্র গলায় ঝরঝর করে শব্দ বর্ষন করতেই হঠাৎ থমকে গেলো আয়মান। মুখ থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত কথাগুলো বেরিয়ে যেতেই নিজেকে অন্তিম মূহুর্তে সামলে নিলো। কিন্তু পার পাওয়া গেলো অবশ্য। পূর্ণতা শেষোক্ত কথা শুনে ওমনেই চকিতে দৃষ্টি ছুড়ে জোর গলায় প্রশ্ন তুললো। আয়মান কোনো উত্তর না পেয়ে দৃষ্টিনত করলো সাথে-সাথে । পূর্ণতার মধ্যে অন্যরকম চিন্তা তখন জেঁকে ধরেছিলো। তীব্র উৎকন্ঠা এবং মাতাল অবস্থা এই দুই পরিস্থিতিতে মানুষ না চাইতেই সত্য উগলে দেয়, আয়মানের ক্ষেত্রেও এখন তাই। পূর্ণতা বিষ্মিত দৃষ্টিতে উত্তরের জন্য অনবরত প্রশ্ন করলে আয়মান তাড়াতাড়ি সেগুলো না বুঝিয়ে প্রস্থান করে। অনেকটা চোরের মতো গা ঢাকা দিয়ে নিজেকে আড়াল করলো আয়মান। পূর্ণতার জিদ আরো প্রখর হয়ে উঠলো তখন। পূর্বের নিরুদ্দেশ হওয়ার ব্যাপারে আয়মান যেখানে সবই জানে, সেখানে পূর্ণতাকে জানানো প্রয়োজন বোধ করেনি পূর্ব। তারমানে এখনো বিশ্বাসের ডোরটা দৃঢ় হয়নি পূর্ণতার জন্য। পূর্ণতা বুকভর্তি দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লো। মনের গোচরে বহু প্রশ্নের আনাগোনা হলেও জিদের প্রভাবটা বেশি ছিলো। আয়মান সবটা জেনেও কেনো ওকে জানালো না? কি কারন? কি জন্য? কি উদ্দেশ্য?

.

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে পূর্ণতা গাড়ির কাছে আসলো। এ কদিন খোদেজার পর্যবেক্ষণ ও নার্সদের যত্ন পেয়ে পূর্ণতা দূর্বলতা কাটিয়ে সুস্থ হয়ে উঠলো। নরমাল ডেলিভারির কেস হওয়ার জন্য হাসপাতাল ওকে পন্ঞ্চম দিনে ছেড়ে দিলো।

কবির, আয়মান ও পূর্বের গাড়ি পরপর সিরিয়ালে সাজানো ছিলো। খোদেজা পূর্ণতাকে পূর্বের গাড়িতে বসতে বলে কবিরের গাড়িতে উঠে বসলো। পূর্ব আজ ভিন্নবেশে সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট পরে এসেছে। দুহাত ভাঁজ করে গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে গম্ভীরতার ছাপ আজও বেশ স্পষ্ট। আজও শার্টের স্লিভ যথারীতি নামানো। আয়মান অফিসের ফরমাল পোশাকে থাকা সত্ত্বেও পূর্ণতার জন্য অপেক্ষা করছে। আয়েশা আজ আসেনি হাসপাতালে, তিনি পলাশের সাথে আছেন ওয়াসিফ ভিলায়। সাবিহা আয়মানের তুখোড় ধমক খেয়ে শিকদার বাড়িতে রয়ে গেছে। আসেনি পূর্ণতাকে দেখতে। পূর্ণতা ছেলেকে নিয়ে দাড়িয়ে থাকতেই কবির প্রশ্ন করলো,

– আমার মেয়ে দাড়িয়ে আছে কেনো? পূর্বের গাড়িতে উঠবেনা?

পূর্ণতা বাবার দিকে সরল দৃষ্টিতে তাকালো। মৃদ্যু হেসে জবাব দিলো,

– বাবা, আমি তোমার গাড়িতে উঠি?

কবির আহাম্মক হয়ে গেলেন মেয়ের কথায়। পূর্বের দিকে দৃষ্টি ছুঁড়ে তিনি দেখলেন, পূর্ব পকেট থেকে গাড়ির রিমোট বের করছে। ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে সে ইতিমধ্যে বসে পরেছে। পূর্ণতাও কথা শেষ করতেই কবিরের গাড়িতে উঠে বসেছে। দুইজন দুই গাড়িতে কিভাবে উঠলো এটাই তিনি ভেবে কূল পাচ্ছিলেন না। সম্পর্কের মধ্যে কোনো ফাটল ধরলো কিনা, তিনি কিছুই মিলাতে পারছিলেন না। অন্যমনষ্ক হয়ে এসব ভাবতে লাগলে পূর্ণতা যাত্রার জন্য তাগাদা দিলো। কবির চুপচাপ গাড়িতে উঠে স্থির অবস্থা ছেড়ে দিলেন। কিন্তু তিনি ব্যাকসাইডের লুকিং মিররে দেখলেন, পূর্ব পেছন থেকে নিজের গাড়িটার গতি স্লো করে অন্য রাস্তায় ঢুকে গেলো। এদিকে গাড়ির মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, পূর্ণতার মুখও বিষণ্ণতায় লেপ্টে আছে। খুশির আমেজ নেই মুখটার মধ্যে।

.

ওয়াসিফ ভিলায় বহুদিন পর রমরমা অবস্থা ধারণ করলো। হাসি-ঠাট্টায় বাড়ির আনাচে-কানাচে স্বহাস্যে কলোরব উঠলো।পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো শূন্য বাড়ির কোণাগুলো। দুপুরে সবাই একসাথে খেতে বসলো। আয়েশা নিজ হাতে সবার জন্য খাবার পরিবেশন করলো । খোদেজা, কবিরের পাশাপাশি আয়মানের পরিবার হিসেবে আফিয়া, আনোয়ার ও সাবিহাও আসলো। দুপুর বারোটায় শাহজালাল বিমানবন্দরে ফ্লাইট অবতরণের মাধ্যমে পূর্বিকাও এ আয়োজনে জমায়েত হলো। আসার কথা ছিলো সেই কবে, কিন্তু বিদেশের মাটিতে মাইগ্রেশনজনিত সমস্যার জেরে দ্রুত ফিরতে পারেনি পূর্বিকা। আদরের ভাইকে দুর্দশাগ্রস্ত দেখেও না ফেরার দুঃখে চোখের পানি ফেলেছে সেই অপরিচিত দেশে। আজীবন বড়বোন হিসেবে আগলে রাখার পরও এই প্রথম পারলোনা পূর্বের পাশে থাকতে। ভাতিজাকে কোলে তুলে খুশির আনন্দে কেদেঁ দেয় পূর্বিকা। এ যেনো আরেক পূর্ব, আরেক রাগীর আগমন।

দুপুরের খাওয়া শেষে সবাই গ্রাউন্ড ফ্লোরে অতিথি কক্ষে একত্র হলো। সেখানে রেস্টের উছিলায় আড্ডার গুজব ঘন্টার-পর-ঘন্টা চলতে থাকলো। পূর্ণতা রুমে ফিরে গোসল সেরে দেখলো পূর্বের গাড়ি গেট দিয়ে ঢুকছে। সকালের সেই ঘটনার পর এতোক্ষনে সে বাড়িতে ফিরছে। পূর্ণতা সুস্থ হয়ে উঠলে আগের বেশভূষায় ফিরে আসে। ম্যাক্সি পড়া বাদ দিয়ে এখন শাড়ি পরে। আজ বাড়িতে বহু মানুষের ঢল দেখে বাসন্তী রঙের জামদানী শাড়ি পরে পূর্ণতা। বিকেলের জন্য হালকা নাস্তার তাগিদে সে রান্নাঘরে গিয়ে নূরানীকে নিয়ে নাস্তা বানিয়ে ফেলে। এদিকে ময়নাকে দিয়ে পূর্বের জন্য দুপুরের যে খাবার পাঠিয়েছিলো সেগুলো ফেরত এসেছে। পূর্ণতা কপাল কুঁচকে ময়নাকে প্রশ্ন করে,

– তোর ভাই খায়নি কেন?

ময়না প্লেটের উপর ঢাকনা দিয়ে বললো,

– ভাইয়ের বলে শরীল বেদনা করতাছে। খাইতো না।

শরীর ব্যথার কথা শুনে পূর্ণতা একটু চিন্তিত হয়ে উঠলো। সে আড় ভেঙে জিজ্ঞেস করলো,

– তোর ভাই কি করছে রুমে? বিছানায় শুয়ে আছে? নাকি ছেলে নিয়ে খেলছে?

ময়না ফ্রিজ থেকে ফল-ফলাদি বের করে অকপটে বললো,

– ভাইয়ে ধুমায়া সিগারেট টানতাছে ভাবী। ধুয়ার লিগা রুমে ঢুকা যায়না। বাবু ঘরে নাই। বড় আপার কাছে খেলতাছে।

সিগারেটের কথা শুনতেই তালগোল পাকিয়ে ফেললো পূর্ণতা। হাতের ছুড়ি ফেলে সে নূরানীকে কাজ বুঝিয়ে ওমনেই সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। রুমের কাছে এসে যেই নব্ ঘুরাবে ওমনেই নিজেকে দমিয়ে ফেললো। পূর্ব যদি সিগারেট খায় তাতে ওর কি? ওর তো কিছু হওয়ার কথা নয়। যেই ব্যক্তি বেহায়ার মতো আচরণ শুরু করেছে তার জন্য বিন্দুমাত্র চিন্তা করাও পাপ! পূর্ণতা পা ঘুরিয়ে আবার চলে আসলো। রাগী মুখে প্রতিটা কাজ করতে লাগলো। ময়না ওর দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকলেও নূরানী আড়চোখে প্রায় সবই বুঝলো। পূর্ণতার অবস্থা দেখে ও কিছু বলার সাহস পেলো না। আজ যে দুজনের মধ্যে কেমন সংঘর্ষ হবে কেউ জানেনা।

.

আয়েশার তোষামোদের জন্য খোদেজা সিদ্ধান্ত নিলেন কিছুদিন তিনি মেয়ের সঙ্গে থাকবেন এবং নাতীর প্রতি খেয়াল রাখবেন। আয়েশা যথেষ্ট যত্নবান হলেও পলাশের দিকে খেয়াল রাখা আবশ্যক। পূর্বিকা আসার পর একবার-কি-দুইবার পূর্ণতার সাথে কথা বলেছে। কথার মধ্যে এটুকু বুঝে গেছে পূর্বের সাথে কোনোকিছুই ঠিক নয়। এদিকে পূর্ব রুমের দরজা আটকে রেখেছে বিকেলের পর থেকে। নূরানীকে বলে খবর পাঠিয়েছে, সে বেঘোরে ঘুমাবে ওই সময় কেউ যেনো ডিষ্টার্ব না করে। পূর্বিকা চালাকি করে ভাতিজাকে কোলে নিয়ে আবদার করলো, ভাতিজা তার ফুপির সাথে আজ রাতটুকু ঘুমাবে। যদি সে ভাতিজা মহাশয়কে না সামলাতে পারে তাহলে পূর্ণতার কাছে এসে দিয়ে যাবে। পূর্ণতা সেসব কথা যথাযথ মেনে ঠিক দশটার দিকে রুমের কাছে আসলো। নব্ মোচড়ে দেখলো সেটা লক।চরম বিরক্তিতে পূর্ণতা দরজায় পরপর নক করলো। রুমের ভেতর থেকে ক্রুদ্ধ গলায় বললো,

– কে বাইরে? আমি না করার পরও কেনো আসা হয়েছে?

পূর্ণতাও সেই সুরে তাল মিলিয়ে তেজ দেখিয়ে বললো,

– এটা আমারও রুম। যদি এখান থেকে বের করে দিতে চাও তাহলে আমার কাপড়-চোপড় নিতে দাও। আমি চলে যাবো।

কথাটুকু বলে ঠিক ‘ দুইমিনিট ‘ অপেক্ষার জন্য দাড়ালো পূর্ণতা। তবে সময় ততো অতিক্রম হলো না। ঠিক এক মিনিটের মধ্যেই দরজা খুলার শব্দ হলো। পূর্ণতা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই নাকে ভক করে বিষাক্ত ধোঁয়ার গন্ধ গেলো। ওমনেই পূর্ণতা আচঁলে মুখ চেপে চারপাশটা দেখার চেষ্টা করলো। অন্ধকারে সবকিছু আরো ঘুটঘুটে অন্ধকার লাগছিলো। পূর্ণতা তাড়াতাড়ি রুমের লাইট জ্বালিয়ে দেখলো পূর্ব জলন্ত সিগারেট হাতে সোফায় বসে আছে। মাথাটা ফ্লোরের দিকে নিচু করে ঝুঁকিয়ে রেখেছে। নিকোটিনের ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছে পূর্ণতার। সে দ্রুত দখিন দিকের জানালাটা খুলে বাকি দুটো জানালাও খুলে দিলো। এসি বন্ধ করে ফ্যান ছেড়ে দিতেই পূর্বের সামনে গিয়ে মৃদ্যু ভঙ্গিতে কাশতে-কাশতে পূর্ণতা রাগান্বিত স্বরে বললো,

– লজ্জা করেনা বাড়ির মধ্যে এইভাবে সিগারেট টানতে? আম্মা এসে দেখলে কি ভাববে এটুকু জ্ঞান নেই?

টনক নড়লোনা পূর্বের। যেভাবে বসেছিলো, সেভাবেই স্থির হয়ে বসে রইলো। বাঁ হাতের সিগারেটটা জ্বলতে জ্বলতে ছাই হয়ে ফ্লোরে পরছিলো। কোনো হেলদোল নেই ওর। পূর্বের ভাবগতি দেখে পূর্ণতা ক্ষুদ্ধ হয়ে হাত ঝাড়া মেরে সিগারেটটা নিচে ফেলে দিলো। সেটা ফ্লোর থেকে তুলে জানালা দিয়ে বাইরে নিক্ষেপ করলো। পুনরায় পূর্বের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে দুগাল দুহাতে ধরে ওর মুখ তুলে বললো,

– আমি কি বলেছি শুনতে পাওনি? তুমি এইভাবে সিগারেট খাচ্ছো কেন? নিজের ছেলের কথা বাদই দিলাম! বাড়িতে যে তোমার অসুস্থ বাবা পরে আছে সেই খেয়াল নেই?

পূর্ব শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো। যেই দৃষ্টিতে কষ্ট-বিষণ্ণ-কাতরতা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিলো। পূর্বকে কয়েক চোট বিশ্রী ভাষায় গালি দিতে গিয়ে থমকে গেলো পূর্ণতা। শুকনো মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে কপালের ডানকোণায় নজর পরলো ওর। সেখানে সাদা ব্যান্ডেজ এখনো লাগানো। কিছু এলোমেলো চুলের কারনে ব্যান্ডেজটা একটু ঢাকা ছিলো। পূর্ণতা বৃদ্ধাঙ্গুলে চুল সরিয়ে দেখলো জায়গাটার ক্ষত কিছুটা শুকিয়ে এসেছে। হুট করে জেলের অত্যাচারগুলো মনে পরলো ওর। ধড়ফড় করে উঠলো সেই রক্তাক্ত অবস্থার কথা ভেবে। পূর্ণতার বিহ্বল হয়ে যাওয়া মুখ দেখে পূর্ব অদ্ভুত সুরে বললো,

– সিগারেট খাইনি। চুমু খেয়ে দেখো আমি সত্যি সিগারেট খাইনি।

পূর্ণতা তৎক্ষণাৎ পূর্বের গাল ছেড়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরালো। আলমারির দিকে দৃষ্টি যেতেই ক্ষণিকের জন্য ভুলে যাওয়া কাজটি মনে পরলো। সে পা চালিয়ে আলমারি খুলে শাড়ির সবগুলো হ্যাঙ্কার বের করতে লাগলো। পূর্ব অসহায় দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই নিরবে হেঁটে গিয়ে দরজার সিটকিনি তুলে দিলো। পূর্ণতা তখন আলমারি থেকে কাপড় বের করতে ব্যস্ত ছিলো। খেয়াল করেনি সে পূর্বের উপর। পূর্ব আবার সোফার জায়গায় চলে গেলো, কিন্তু স্থান একটু পরিবর্তন ঘটিয়ে ঠিক জানালার কাছে গিয়ে আকাশে দৃষ্টি রাখলো।
সাদা পর্দা বাতাসের মৃদ্যু ঝাপটায় উড়ছে। বাইরে থেকে মন-মাতানো বাতাস এসে দেহমন প্রশান্ত করে দিচ্ছে। পূর্ব প্যান্টের পকেটে দুহাত পুড়ে পরম শান্তি, পরম মায়ায় চোখ বুজে সুর তুললো।সেই সুরো যেনো কিছুটা আবেগমিশ্রিত, কিছুটা দুঃখপূর্ণ, কিছুটা আকাঙ্ক্ষীত। মনকে অতলস্পর্শ করে বেশ শান্ত ও ঠান্ডা গলায় গান গাইতে লাগলো ,

কি করি বলো, তুমি হীনা…

থেমে গেলো পূর্ণতার মূহুর্ত। আটকে এলো শ্বাস। পূর্বের মুখ নিঃসৃত সুর যেনো হৃৎযন্ত্র আবার বাড়িয়ে তুলছে পূর্ণতার। ঠিক সেইদিনের মতো, যেদিন দরজার বাইরে দাড়িয়ে সহসা পৃথিবী থমকে গিয়েছিলো।

আমি পারিনি তোমাকে
আপন করে রাখতে,

আমি পারিনি তোমাকে
আবার আমার করে রাখতে।

তুমি বুঝনি, আমি বলিনি

তুমি স্বপ্নতে কেন আসনি?
আমার অভিমান তোমাকে নিয়ে
সব গেয়েছি।

গানে গানে সুরে সুরে কত কথা
বলেছি তোমাকে,
তুমি বুঝনি, বুঝনি।

কখনো যদি, আনমনে চেয়ে
আকাশের পানে আমাকে খুঁজো,
কখনো যদি, হঠাৎ এসে
জড়িয়ে ধরে বলো ভালোবাসো।

গানের শেষটুকুতে এসে গলাটা কান্নায় সিক্ত হয়ে গেলো পূর্বের। আকাশের পানে নিবদ্ধ দুইচোখ ঝাপসা হয়ে উঠলো তখন। পকেটের ভেতর সিগারেটের শূন্য প্যাকেটটা দুমড়ে-মুচড়ে ফেলছিলো গানের প্রতিটি সুরে। একপর্যায়ে পকেট থেকে সেটা বের করে জানালা দিয়ে ছুড়ে মারলো বাইরে। মাথা নিচু করে কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে পূর্ব বলে উঠলো অসহন কন্ঠে,

– আমি সিগারেট খাইনি পূর্ণতা। আমি জেল থেকে বেরিয়ে খারাপ জায়গায় যাইনি। একবার চুমু খেয়ে দেখো আমি মিথ্যা বলছি কিনা। একবার আমার কথা শুনে দেখো আমি এতোদিন কোথায় ছিলাম। আমি আর সহ্যক্ষমতার মধ্যে নেই, হাপিয়ে গিয়েছি, প্রচুর ক্লান্ত হয়েছি, সব হারিয়ে ফেলেছি। একে-একে সব। আমার রূহটা বাদে বাইরের সবকিছু আমার হারিয়ে গেছে। আমার দীর্ঘ সাধনার ইচ্ছাটা কবরে স্থান নিয়েছে। আমার জন্য কিছুই অবশিষ্ট নেই। কিছুই নেই…

– চলবে

#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৬৬.
#ফাবিয়াহ্_মমো

সিগারেটের উৎকট গন্ধ এখন আর নেই। রুমে অনেকক্ষন যাবৎ কোনো সাড়াশব্দ হয়নি। পূর্ব জানালার কাছে তখনো দাড়িয়ে রইলো, দৃষ্টি নত করে দুহাত পকেটে গুঁজে ছিলো। দখিনা বাতাস এসে মাথার ঠিক তালুর চুলগুলো উড়িয়ে দিচ্ছে পূর্বের। রাতের প্রহরগুলো আরো নিস্তব্ধতায় ধীরেধীরে আচ্ছন্ন হচ্ছে। পূর্ণতা নির্বাক হয়ে শাড়ির হ্যাঙ্কার হাতে পূর্বের দিকে তাকিয়ে আছে। কালো শার্ট পড়ুয়া মানুষটার দিকে দৃষ্টি আটকে সবকিছু যেনো থমকে গেছে। পূর্ণতা স্থিরদৃষ্টিতে শুকনো গলায় ঢোক ফেললো। কিন্তু মনের চন্ঞ্চলতা, প্রচণ্ড উৎকন্ঠায় নিজেকে সামলাতে গিয়ে খুব হিমশিম খাচ্ছিলো। ধুক-ধুক করে বুকের ধুকধুকনি আরো দ্রুতবেগে চলতে লাগলো ওর। শব্দহীন পরিবেশে প্রতিটি ধুকপুকনির আওয়াজ কানের পর্দায় ধড়াস-ধড়াস করে অনুভব করলো। তাক লেগে যাচ্ছে কানের পাতলা পর্দায়। অসহ্য লাগছে শরীর-মন, পুরো দেহে। অবিরামভাবে বর্ষণের জন্য চোখের কোলে মেঘ জমেছে। যেকোনো মূহুর্তে ঝমঝমিয়ে অশ্রু-বর্ষণ হতে চলেছে পূর্ণতার। পূর্ণতা স্পষ্ট টের পেলো ওর সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। হাতের হ্যাঙ্কারটাও কাঁপুনির জন্য মৃদ্যু-মৃদ্যু নড়ছে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় আরেকবার অশ্রু চোখে ঢোক গিললো পূর্ণতা। ওমনেই সিক্ত চক্ষুকোল থেকে অশ্রু গড়িয়ে পরলো তার। ওর ইচ্ছে ছিলো অভিমানের এই শক্ত খোলসটা এতো সহজে নড়বড়ে হতে দিবেনা। কথা বলবেনা সে পূর্বের সাথে। ওর কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে এ রুম থেকে পালিয়ে যাবে। কিন্তু পূর্ণতা কিছুই ভাবার সময় ও সুযোগ পেলো না। পূর্ব ঠিক ওই মূহুর্তে নিরবতা চ্ছিন্ন করে গাঢ় গলায় অসহায় ভঙ্গিতে বললো,

– তুমি আমার কথা একটাবার শুনো পূর্ণ, আমিতো তোমার কাছে কখনো মিথ্যা বলিনি। আমার কথাগুলো না শুনে যদি দূরে দূরে থাকো, আমি কিভাবে ভুল শুধরাবো? একবার শুনো পূর্ণ, আমি তোমাকে অনুরোধ করছি আমার কথা একটু শুনো।

শক্ত দৃষ্টিতে তাকালো পূর্ণতা। গলা দিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারণ করলো না। অনেকটা অনুভূতিশূন্য ব্যক্তির মতো নিজেকে দমিয়ে নিলো সে। চোখের পানিও মুছে ফেললো শাড়ির আচঁলে। আজ সে শুনতে ইচ্ছুক পূর্ব কি কথা বলার জন্য আকুতি-মিনতি করছে। কেনো সে তামাশা করে সিগারেট জ্বালিয়ে ঘন্টার-পর-ঘন্টা বিষাক্ত ধোয়া সৃষ্টি করেছে, সবই পূর্ণতা শুনতে ইচ্ছুক এখন। পূর্ব জানালার কাছ থেকে ঘুরে দাড়ালো। প্যান্টের পকেট থেকে দুহাত বের করে পূর্ণতার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো। কিন্তু পূর্ণতার চাহনিতে কোনো বিশেষ ভাবাবেগ নেই, উলটো এর পরিবর্তে প্রচণ্ড রাগ এবং ডোন্ট কেয়ার ভাব চোখেমুখে বেশ পরিদৃষ্ট। পূর্ব গলা ভিজিয়ে চোখ বন্ধ করে ছোট্ট নিশ্বাস ছাড়লো। পুনরায় পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ সুরে বললো,

– আজ তোমার সামনে যেই পূর্বকে দেখতে পাচ্ছো, আর জেল থেকে যেই পূর্ব বেরিয়েছিলো তার মধ্যে বিশাল তফাত ছিলো পূর্ণ। যে পাচঁমাস আমি বন্দিজীবন পার করেছি সেগুলো মোটেই ভালো ছিলো না। আমি খুব খারাপ অবস্থায় ছিলাম পূর্ণ। বিশ্বাস করো, জেল থেকে বেরিয়ে আমি তোমার কাছে ফিরতে চেয়েছিলাম। তোমাকে দোহাই দিচ্ছি, আমি একটা কথাও মিথ্যা বলছিনা। আমি তোমার কাছে আসার জন্য ব্যকুল হয়ে ছিলাম। কিন্তু যেখানে আমিই মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরেছিলাম সেখানে ওই বিধ্বস্ত অবস্থায় তোমার কাছে কিভাবে আসতাম? তুমি আমার সামান্য আচঁড় দেখলেই কেদেঁ উঠো, আর ওরা পাচঁ মাসে আমার কি অবস্থা বানিয়েছিলো সেটা যদি দেখতে, তুমি কি স্থির থাকতে? থাকতে না পূর্ণ। তুমি কাঁদতে কাঁদতে নিজের অসুখ ডেকে আনতে। আমি কিভাবে এই ভুল করতাম বলো? তোমার ওই মুখ দেখার সাহস আমার কিভাবে হতো? তুমি তো ওই মূহুর্তে একা ছিলেনা। তোমার পেটে আমার চিহ্নটার অস্তিত্ব ছিলো। তোমার কিছু হলে ও যে আবার হারিয়ে যেতো, সেই দুঃখ কি করে তুমি সহ্য করতে? আমি তোমাকে কষ্ট দেওয়ার কথা চিন্তা করিনি পূর্ণ। আল্লাহ জানেন, আমি তোমার কথা একমূহূর্তও ভাবতে ভুলিনি। তুমি আমার জন্য কতটা পাগল আমিতো জানি, আমিতো জানি তুমি আমার অবস্থা দেখে কতটুকু অস্থির হতে পারো। তোমাকে যে বুকে টেনে শক্ত করে জড়িয়ে রাখবো সেই হাতটাও ভাঙা ছিলো পূর্ণ। প্লাস্টার হাতে তোমাকে একটুও ধরতে পারতাম না। আরেক হাত দিয়ে যে তোমায় আগলানোর চেষ্টা চালাবো সেটাও ক্ষতবীক্ষত ছিলো। জেলের ভেতর আমার রক্তাক্ত বিশ্রী ঠোঁটে তুমি চুমু খাও আমিতো মরার আগ পযর্ন্ত সেই দৃশ্য ভুলবো না পূর্ণ। আমার ওই করুন দশা দেখে সেদিন তুমি কাছে টানতে একটুও ভুলোনি। আজও মনে পরে সেদিন তুমি একটা মূহুর্ত্তের জন্য কান্না থামাতে পারোনি। নিকাবের আড়ালে তোমার ব্যকুল চোখদুটো বারবার আমার জন্য কেমন করে কেঁদেছে, আমি কি ভুলে যাবো? ভুলবো নাতো। সেলের বাইরে বসে দুহাত বারিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরার জন্য ছটফট করেছে, সেই কাতরানোর দৃশ্য আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না। আজ আমার খুব যন্ত্রণা হচ্ছে, দেখো আমি তোমার মতোই ছটফট করছি, কিন্তু কোনোভাবেই তোমাকে দেখাতে পারছিনা। আমি যন্ত্রণায় ভুগছি, প্রকাশ করতে পারছিনা। তোমাকে কাছে পেয়েও দূরে থাকার দুঃখে কাতর হয়ে গেছি, অথচ জোর খাটিয়ে তোমার কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিনা পূর্ণতা। তুমি আমার সাথে এরকম করো না। আমার জীবনে তোমাকে ছাড়া আমি আর কিচ্ছুই রাখতে পারিনি। আমার সব চলে গেছে। সব আমার কাছ থেকে দূরে চলে গেছে। আমার নূন্যতম যোগ্যতাও আর নেই।

কন্ঠরুদ্ধ হয়ে আসলো পূর্বের। নিজেকে বিবশ অবস্থা থেকে সামলাতে গিয়ে চোখ নিচু করে ফেললো সে। সমস্ত শরীর ধীরে-ধীরে ফ্লোরে ছেড়ে দিলো হাঁটুতে ভর দিয়ে। নিস্তব্ধ রুমটার ভেতর কান্নার মৃদ্যু ফিসফাস শব্দ হচ্ছিলো। পূর্ব চোখ নিচু করে ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিলো। ভারাক্রান্ত মনটা যেনো নিংড়ে দিয়েছে কেউ, বীভৎস যন্ত্রণায় বুকটা ছিড়ে আসতে চাইছে। নিজেকে চূড়ান্ত সীমায় সামলে নিয়ে পূর্ব ঝাপসা দৃষ্টি তুলে পূর্ণতার দিকে তাকালো। পূর্ণতার দৃষ্টি তখন অটল, শান্ত, স্থির ছিলো। কিছু বলার জন্য গাঢ় করে ঢোক গিললো পূর্ব। অশ্রু বিহ্বল চাহনিতে ক্লিষ্ট কন্ঠে বললো,

– জেল থেকে কখনো বেরুতে পারতাম না পূর্ণ। আমার মতো মানুষ কখনো জেল থেকে সুস্থ সবল বের হওয়ার সুযোগ পায়না। যতবার আমার উপর অত্যাচার করতো আমি চোখ বন্ধ করে কালেমা পরে ফেলতাম। এই বুঝি আমার রূহটা চলে গেলো। আমি বোধহয় আর কোনোদিন তোমার কাছে ফিরতে পারবো না। ফার্স্ট ভিজিটটাই তোমার সাথে আমার শেষ দেখা। কিন্তু একদিন কি ভেবে যে আমার শত্রু আমার সামনে এসে উপস্থিত হলো আমি জানিনা। সেলের ভেতর আমি তখন অর্ধচেতন ছিলাম। মাথা ফেটে রক্ত পরছিলো। রোলারের বেকায়দা বারি খেয়ে মাথার ডানদিকটা ইন্ঞ্জুর্ড হয়ে গেছে শেষ। ইমতিয়াজ এসে চেয়ারে বসলো। আমার অবস্থা এতোই খারাপ ছিলো যে, ফ্লোর থেকে উঠার শক্তিটুকু আমার ছিলোনা। ওই লোক তখন প্রস্তাব দিলো তার শর্ত যদি পূরণ করি তাহলে আমাকে জেল থেকে বের হতে সাহায্য করবে। আমি শর্ত না শুনতেই ওকে ‘ না ‘ করে দিয়েছি। যখন জানোয়ারটা দেখলো ওর প্রস্তাবে আমি কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিনা, তখন ওই কুলাঙ্গার বাচ্চা তোমাকে নিয়ে হুমকি দিলো পূর্ণ। তুমি আমার দূর্বল দিক এটাতো জানো। নাকি এটুকুও তুমি আজ বিশ্বাস করতে প্রস্তুত না? আমি সব সত্যি বলছি পূর্ণ। তোমার কিছু হলে আমি কি করতাম? কিভাবে সহ্য করতাম আমি? ওই জেলের মধ্যে আমি যেখানে সুস্থ ছিলাম না, সেখানে ও যদি তোমাকে কিছু করতো? আমার পুরো জীবনে এমন অসহ্য অবস্থার মধ্য দিয়ে কোনোদিন যাইনি পূর্ণ। আমি স্বামী হয়েও তোমার ইজ্জত রক্ষার মতো অবস্থায় তখন ছিলাম না। নাহলে ওই জানোয়ারের কলিজা আমি আস্তো রাখতাম না। যদি ওই জানোয়ার তোমাকে কিছু করতো এটা ভাবলেই —-

গলা আটকে এলো পূর্বের। নিশ্বাস নিতেও হাঁশফাস করছে। চাপা কান্নার জন্য গলা শুকিয়ে এলে আচমকা জোরে জোরে কাশতে থাকে সে। নাক বন্ধ হওয়ার কারনে মুখ খুলে অনবরত নিশ্বাস নিচ্ছে পূর্ব। তবুও বুকের অবস্থা বেগতিক হয়ে উপর-নিচ করছে ওর। পূর্বের এমন অপ্রকৃতিস্থ অবস্থা দেখে পূর্ণতা অস্থির হয়ে উঠলো। হাতের হ্যাঙ্কার ফেলে দিয়ে তাড়াতাড়ি টেবিল থেকে পানি নিয়ে পূর্বের সামনে ফ্লোরে বসে পরলো। পূর্বের ঠোঁটের কাছে গ্লাস ধরে সম্পূর্ণ পানি খাইয়ে দিলো। পানি খাওয়া শেষে চোখ বন্ধ করে ফেললো পূর্ব। পূর্ণতা ততক্ষণে গ্লাসটা আগের জায়গায় রাখতে গিয়েছে। পূর্ব একটু শান্তি বোধ করলে আবার বাকি কথাটুকু চোখ খুলে বলতে শুরু করলো,

– ওর প্রস্তাব ছিলো, আমি যেনো ওর পা ধরি। ওর কাছে আকুলিবিকুল করে নিজের সমস্ত কীর্তিকলাপের জন্য ক্ষমা চাই। যদি ওর এই প্রস্তাব আমি মেনে নেই তাহলে ও তোমাকে কিছুই করবেনা। খুশী হয়ে বখশিশ হিসেবে আমাকে জেল থেকে বের করার সুপারিশও করবে। আমার যা কিছু আটকে রেখেছে সব ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। আর যদি নিজের আর্দশ ক্ষুণ্ণ করে মাফ না চাই তাহলে ও তোমাকে বি-ব-স্ত্র করে —

কথা শেষ করতে পারলোনা পূর্ব, অসহ্য যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে আবারও দৃষ্টি নত করে ফেললো। বুকের উপর ভারী চাপ অনুভূত হচ্ছে ওর। কিচ্ছু সহ্য হচ্ছেনা পুরোনো দিনগুলো স্মরণ করে। বারবার ওই দৃশ্যটা মাথায় ঘুরছে। চোখের পাতায় না চাইতেই পূর্ণতার করুন দশার চিত্র ভাসছে। যদি ইমতিয়াজ পূর্ণতার সাথে এমন কিছু করতো, তাহলে কি পূর্ব মানসিক ভারসাম্য ঠিক রাখতে পারতো? এদিকে পূর্ণতা যতো শান্ত আচরণ করছিলো, ভেতরে-ভেতরে যেনো কালবৈশাখীর ঝড় ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে ওকে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ওর। বুকের হৃৎপিন্ড প্রচণ্ড অস্থিরতায় দম আটকে ফেলছে। পূর্ণতা আর নিজেকে সামলাতে পারলো না ওই মূহুর্তে, দৌড়ে পূর্বের সামনে এসে ফ্লোরে বসে পরলো তখন। নিচু করে রাখা পূর্বের মাথাটা শক্ত দুহাতে ধরে নিজের দিকে তুললো। পূর্বের অশ্রুপূর্ণ লাল হয়ে যাওয়া চোখদুটোর দিকে তাকাতেই বুকটা মোচড়ে এলো পূর্ণতার। মূহুর্তেই সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো তুমুল কান্নায়। চোখের কার্নিশ বেয়ে পানি পরতে লাগলো বড় বড় ফোটায়। পূর্ণতা পূর্বের দিকে তাকিয়ে কান্নারত অবস্থায় ধীরগতিতে ডানেবামে মাথা নাড়ালো। পূর্ব তখন ভেজা পাপড়ির অসহায় দৃষ্টিতে পূর্ণতার দিকে তাকালে ওর ‘ না ‘বোধকের ইশারাটা বুঝতে পারে। কান্না না করার জন্য পূর্ণতা ‘ না ‘ করছিলো। ব্যাপারটা বুঝতেই পূর্বের ঠোঁটে সুক্ষ্ম হাসির আভাস দেখা দিলো। হাসির ওই মূহুর্তটুকু দেখে পূর্ণতার ভেতর কাপঁন শুরু হয়ে যায়। থেকে-থেকে চাপা কান্নার জন্য পূর্বের অধরজোড়া কাঁপছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে কান্না গেলার জন্য অধরদুটো লাল হয়ে আছে। পূর্বের মাথা থেকে ধীরে-ধীরে হাতদুটো গালে নামালো পূর্ণতা। দুহাতের মাঝে পূর্বের মুখটা আবদ্ধ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই গালে চার আঙ্গুল বসিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল এগিয়ে চোখের নিচটুকু মুছে দিলো। নিজের নরম ওষ্ঠ এগিয়ে পূর্বের বদ্ধ চোখের উপর প্রগাঢ়ভাবে চাপ দিলো ও। বহুদিন পর পরমভাবে উষ্ণস্পর্শ পেলো পূর্ব। অস্থির হয়ে উঠা হৃৎযন্ত্র আস্তে-আস্তে শান্ত হতে লাগলো। একে-একে দুই চোখের উপর অধরযুগল ছুঁয়িয়ে দিলো পূর্ণতা। কপালও পরমাহ্লাদে চুমু খেলো। গাল ছেড়ে পূর্বের ঘাড়ের কাছে হাত রেখে দিলো। আরেকহাতটা এগিয়ে পূর্বের কপালের কাছে ডানদিকটায় ব্যান্ডেজটা স্পর্শ করে দেখলো। আঙ্গুলে ক্রস ব্যান্ডেজটা দেখতেই শান্ত সুরে বললো,

– এখনো ব্যথা করে?

পূর্ব নির্লিপ্তে মাথাটা ‘ না ‘ সুচকে মৃদ্যু নাড়লো। পূর্ণতা উত্তরটা পেয়েও আবার ব্যান্ডেজটার উপর আঙ্গুল স্পর্শ করলো। ঘাড় থেকে হাত সরিয়ে পূর্বের হাতদুটো মুঠোয় নিয়ে অজস্র চুমু খেলো সে। পূর্বের দুটোহাতের তালুতে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে দিতেই পূর্ব ওকে বললো এখন ঘুমিয়ে পরতে। রাত বেশ হয়েছে এবং ঔষুধগুলো খেয়ে এখুনি শুয়ে পরতে। পূর্ণতাকে বিছানায় শুতে বলে ছেলের জন্য একবার বেরুলো পূর্ব। কোনোকিছুর প্রয়োজন আছে কিনা সেটা দেখার জন্য পূর্বিকার রুমে নক করলো। কিছুক্ষণের মধ্যে দরজা খুলতেই সে দেখলো, কাঙ্ক্ষিত শিশুটা পূর্বিকার কোলে ঘুমাচ্ছে। পূর্ব একগাল হেসে দিয়ে ওর কোল থেকে ছেলেকে নিলো। সাদা বেবি ওয়েপারে ছোট্ট নবজাতক চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছে। পূর্বিকা বিছানার দিকে রাবার ক্লথটা ঠিক করতেই ভাতিজার শোয়ার জায়গাটা ঠিক করে বললো,

– তুই কি আমার সাথে রাগ করেছিস?

প্রশ্ন শুনে ছেলের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে পূর্বিকার দিকে কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকালো পূর্ব। জিজ্ঞাসু সুরে প্রস্তুত ভঙ্গিতে বললো,

– রাগ করলে আমার ছেলেকে নিশ্চয়ই তোর কাছে পাঠাতাম না।

পূর্বিকা হোচট খেলো। ভাতিজির বালিশটা ঠিক করতে যেয়ে হাত থামিয়ে ওমনেই পূর্বের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো,

– তাহলে আসার পর থেকে কেনো আমার সাথে কথা বলছিস না?

পূর্ব ধীরে ধীরে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। পূর্বিকার ঠিক করা ছোট্ট নরম বিছানার মধ্যে ছেলেকে শুইয়ে দিলো পূর্ব। পূর্বিকা একদৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে মমতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কয়েক মূহুর্ত পেরিয়ে গেলে পূর্বিকা ভাতিজির দিকে তাকিয়ে শান্ত সুরে হেসে বলে,

– লাল টুকটুকে হয়েছে। গালদুটো একদম লাল। ওর নাম ভেবেছি লাল্টুস রাখবো, কি বলিস বজ্জাত?

পূর্ব এমন বিদঘুটে নাম শুনে প্রচণ্ড ক্ষেপে গেলো। সঙ্গে এখন ছেলে না থাকলে পূর্বিকার অবস্থা ভালোই টাইট করতো ও। পূর্ব রাগ সংবরন করে স্বর নামিয়ে দাঁত চিবিয়ে বললো,

– তোকে কে বলেছে আমার ছেলের নাম রাখতে? ভুলেও ওই নামে ডাকবিনা! ডাকলে তোর বরের চুল একটাও মাথায় থাকবেনা!সাবধান হ!

পূর্বিকা কপাল কুঁচকে রাগ দেখাতে গিয়ে আচমকা মুখে হাত চেপে হেসে দিলো। অনেকদিন পর পূর্বিকার মুখে প্রাণখোলা দেখে পূর্বের শৈশবের কথা মনে পরলো। ছোট থেকেই পূর্বিকা ছোট ভাইয়ের শাষন খেয়ে বড় হয়েছে। স্বাভাবিক ভাইবোনের মতো ঝগড়া করেছে, কথা কাটাকাটি হয়েছে, মারামারি অবশ্য ওরকম কখনো করেনি। পূর্ব পুরোনো দিনের কথা ভেবে স্নিগ্ধ হলো। পূর্বিকাও হাসিটা অল্প-অল্প কমিয়ে পূর্বের কাছে এগিয়ে গেলো। মাথায় হাত রেখে চুলে আঙ্গুল চালাতেই কেমন আবেগের সুরে বলে উঠলো,

– তোর জেলে যাওয়ার কথা শুনে প্রচুর কষ্ট হয়েছে পূর্ব। তোর কাছে এই প্রথম থাকতে পারলাম না ভাই। তোকে কোনোদিন আমি দুঃখ পেতে দেইনি, আব্বুর বকুনি থেকে কতবার বাঁচিয়েছি। কিন্তু শকুনের কাছ থেকে তোকে বাঁচাতে পারিনি রে। তোকে কতবার বলেছি এসব রাজনীতি তুই করিস না। তুই ভালো ছাত্র, লেখাপড়া কর, ভালো একটা রেজাল্ট করে বিদেশে চলে যা। এই দেশে থাকিস না। তুই আমাদের কারোর কথাই শুনলি না। আমার বিয়ের মধ্যেও পূর্ণতার যেই ঘটনা ঘটলো বিশ্বাস কর, এখনো রাতের বেলা ঘুম না ধরলে ওই দৃশ্য ভাসে। তোকে ওইভাবে চিৎকার করতে জীবনেও দেখিনি পূর্ব। ছোট থাকতে তোর ডান পায়ে তারকাটা ঢুকেছিলো। ওই ব্যথায় তুই যতটা না কেদেঁছিস, তারচেয়ে বহুগুণ বেশি পূর্ণতার রক্তাক্ত বেহুঁশ দেখে তুই কেদেছিলি পূর্ব। তোর জীবনটা এমন কেন রে? তোর জীবনের কষ্টগুলি কি আমাকে দেওয়া যায়না? আমাকে দিয়ে দে ভাই। তুই আমার সুখগুলী নিয়ে নে। তোর কষ্টের কথা চিন্তা করলে আমি ওই বিদেশের মাটিতে শান্তিতে থাকতে পারিনা। যদি আল্লাহ্ আমাকে এমন কিছুর ক্ষমতা দিতো তাহলে তোকে আমি কোনোদিন কষ্ট পেতে দিতাম না পূর্ব। তোর মতো ভাই কারোর কপালে পাওয়াও ভাগ্য। তুই আর কোনোদিন ওইপথে যাস না ভাই। তোর সন্তানটার দিকে খেয়াল দে, একটু স্বার্থপর হওয়ার চেষ্টা কর। সমাজের মানুষ নিয়ে আর মাথা ঘামাস না। ওরা তোর উদারতা পাওয়ার যোগ্য না পূর্ব।

পূর্বিকা সাথেসাথে দুচোখে বৃদ্ধাঙ্গুল ও তর্জনী চাপলো। পূর্বের মাথা থেকে হাত সরিয়ে ওড়না টেনে চোখ মুছে ফেললো। পূর্ব তখন গাঢ়দৃষ্টিতে পূর্বিকার দিকে তাকিয়ে আছে। এটা দেখে পূর্বিকা একটু অপ্রস্তুত হয়ে পরলে তাড়াতাড়ি নিজের আবেগান্বিত অবস্থা ঢাকার জন্য ভাতিজার দিকে তাকিয়ে বললো,

– বললি না ছেলের নাম কি রেখেছিস?

পূর্ব ওর কাছ থেকে চোখ সরিয়ে ছেলের দিকে তাকালো। ছোট্ট আঙ্গুলের হাতটা এনে প্রতিটা আঙ্গুলে চুমু খেয়ে বললো,

– ওয়াসিফ প্রণয়।

পূর্বিকা আশ্চর্য হতে গিয়ে হেসে দিয়ে বললো,
– প্রণয়? কি ভেবে এই নাম রাখলি?

পূর্ব ওর দিকে দৃষ্টি দিয়ে আবার ছেলের দিকে তাকিয়ে নরম সুরে বললো,

– প্রণয় অর্থ ভালোবাসা। ও আমার ভালোবাসার চিহ্ন আপি। অনেক কষ্টের পর ও দুনিয়ার আলো দেখেছে। ওকে নিয়ে আমার আর পূর্ণতার স্বপ্ন আছে। আমি চাইনা ও বাবার মতো হোক। আমি চাইনা ও মায়ের মতো নরম হোক। আমাদের দুজনের সব ভালো গুণ নিয়ে ও পৃথিবীর আলোতে বেড়ে উঠুক। আমার জীবনে তোর মতো বড় বোন, মায়ের মতো আর্দশ নারী, বাবার মতো বলিষ্ঠ মানুষ পেয়েছি। আমার প্রণয় যেনো সবার ভালোবাসায় বড় হোক আপি। আমার জীবনে আর কিছুই আমি চাইনা।

কথাটুকু শেষ করতেই পূর্ব প্রণয়ের কপালে চুমু খেলো। পূর্বিকার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো ছেলের প্রতি ধ্যান রাখতে। এরপর চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। নিজের রুমে এসে দেখলো পূর্ণতা লাইট নিভিয়ে শুয়ে পরেছে। ঘুমিয়ে গেছে কিনা বোঝা যাচ্ছেনা। পূর্ব নিরবে রুমে ঢুকে দরজা চাপিয়ে শার্টটা খুলে ফেললো। আলমারি খুলে টিশার্ট বের করে সেটা পরে নিলো। বিছানার দিকে আসতেই দখিন দিকে জানালাটা খুলে শুয়ে পরলো। শহরে এখন আর জাঁকিয়ে শীত নেই। ঠান্ডার রেশ বক্ষস্থল পযর্ন্ত কাঁপিয়ে দেয়না এখন। গায়ের কম্বলটা এজন্য পাতলা। ভারী কম্বল নামাতে হয়না। পূর্ব মাথার নিচে হাত দিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। মনের মধ্যে কেমন খচখচ করছে পূর্ণতার জন্য। পূর্ব বামপাশে তাকালে। পূর্ণতা আজ অদ্ভুত ভাবে শুয়েছে। কোলবালিশ টেনে মুখ লুকিয়ে রেখেছে পূর্বের একটু রাগ হলো। স্বামী পাশে রেখে বালিশকে জাপটে ধরার মানে কি? পূর্ব তৎক্ষণাৎ পূর্ণতার বাহুটা টেনে এমনভাবে নিজের ঘুরালো যে, পূর্ণতার দিকে তাকাতেই পূর্ব ভ্রুঁ কুঁচকে উদগ্রীব কন্ঠে বললো,

– কাঁদছো কেন পূর্ণ? আসো, কাছে আসো। আসো জলদি!

পূর্ব দ্রুত দুহাত বারিয়ে পূর্ণতাকে বুকের কাছে টানলো। মুখের উপর থেকে পূর্ণতার চুলগুলো সরিয়ে দিলো। কম্বলটা টেনে গা ঢেকে দিতেই পূর্ব ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

– এখন আমি আছি তো। কাঁদতে চাইলে আমার বুকে মুখ গুঁজে কাঁদো। আমি একটুও কষ্ট দিবো না। আর ওভাবে বালিশ টেনে ঘুমাবেনা পূর্ণ। আমাকে ধরে ঘুমাবে।

আবছা অন্ধকারে পূর্ণতা মুখ তুলে পূর্বের মুখের পানে তাকালো। শেষে হাত বারিয়ে পূর্বের পিঠ আকড়ে বুকে মুখ লুকিয়ে ফেললো। গুটিশুটি হয়ে পূর্ণতা চোখ বন্ধ করলে পূর্ব ওর মাথায় থুতনি রেখে ঘুমিয়ে পরলো।

.

ঘড়ির কাটায় ‘ সময় ‘ এবং ক্যালেন্ডারের পাতায় ‘ দিন ‘ দুটোই পেরিয়ে গেলো বহুদিন। ওয়াসিফ ভিলায় এখন আর খা খা শূন্যতা বিরাজ করেনা। মানুষের হৈচৈ এবং প্রণয়ের কান্নাকাটিতে বাড়ির মধ্যে শব্দের ধারা চলতেই থাকে এখন। আজ পূর্বের কাছে প্রচুর ঝারি খেয়ে কথা বন্ধ করে দিয়েছে পূর্ণতা। সেই সঙ্গে পূর্ণতা স্থির করেছে এখান থেকে চলে যাবে সে এবং সোজা গিয়ে খোদেজা ও কবিরের কাছে উঠবে। পূর্ব সাফসাফ বলে দিয়েছে, যেতে চাইলে যাও কোনো বাধা নেই। কিন্তু প্রণয়কে সঙ্গে নিয়ে কোত্থাও বের হওয়ার সাহস না দেখায়। পূর্বের এমন কথা শুনে পূর্ণতা মনেমনে ঠিক করলো সে ইচ্ছে করে পূর্বের সাথে কথা বলতে যাবেনা। যদি পূর্ব নিজ থেকে কথা বলে বা কাছে আসে তাহলে সেটে অন্য কথা। প্রণয়কে পেয়ে অন্যমাত্রায় রূপ পেয়েছে পূর্বের ব্যক্তিত্ব। সে এখন আর বাইরে যাওয়ার জন্য খুব সকালে উঠেনা, পার্টির নাম মুখ থেকে বেরুয় না, কোনো দলবল নিয়ে চলার কথাও সে উচ্চারণ করেনা। আগের মতো কোনোকিছুতেই সে আর নেই। জেলে থাকাকালীন পূর্ব তার সদস্যপদ হারিয়ে ফেলে এবং দল থেকেও তাকে বহিস্কার করা হয়। এরপর জেল থেকে বের হয়ে সে অন্য জায়গায় নিজেকে নিয়োগ করেছে। তাও সেটা চুপিচুপি, চুপিসারে, কাউকে না জানিয়ে। পলাশ ওয়াসিফ পুরোপুরি সুস্থ কখনো না হলেও এখন একটু-আধটু পরিস্কার কথা তিনি বলতে পারেন। নাতীর লাল মুখটা দেখে তার অন্তরটা ঠান্ডা হয়ে যায়। ছেলের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা দেখে পরান জুড়িয়ে যায়। তিনি কান্নায় নিজের সুখটাকে এখন বেশি প্রকাশ করেন। আগের মতো ধমক বা উচ্চস্বরে কথা তিনি বলেন না। পূর্বিকা কয়েক মাস কাটিয়ে আবার বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর মধ্যে পূর্বিকার স্বামী কয়েকবার এসে সবার সাথে দেখা করে গেছে।

.

পড়ন্ত বিকেলের কমলাভ সূর্যটা পশ্চিমে হেলার প্রস্তুতি নিয়েছে। আকাশে একঝাঁক পাখি অনেকক্ষন ধরে উড়ছে। পরিবেশটা শান্ত ও কোমল হয়ে এসেছে। পূর্ণতা শুকনো কাপড়গুলো ভাঁজ করে আলমারিতে রাখছে। পূর্ব সকাল থেকেই বাড়িতে নেই, আসার নামগন্ধও প্রায় বোঝা যাচ্ছেনা। ফোন দিলে সেই আগের মতো ফোন ধরছেনা। প্রণয় আয়েশার কাছে ঘুমাচ্ছে, পূর্বিকা পলাশের সাথে গল্পগুজব করে সময় কাটাচ্ছে। কিন্তু চিন্তিত পূর্ণতা আজ হঠাৎ করেই বেশি চিন্তায় বিভোর হলো। পূর্বকে নিয়ে শুধু একটাই চিন্তা ওর মাথায় ঘুরপাক খায়, যেনো কখনো ওই রাজনীতির পথে ও ফিরে না যায়। ঘড়িতে আরেকবার চোখ রেখে হতাশার শ্বাস ফেললো। চারঘন্টা শেষ হয়ে পাঁচঘন্টা হতে চললো। এবার যেনো ধৈর্য্য রাখতে পারলো না পূর্ণতা। আলমারি বন্ধ করে ফোনটা হাতে নিলো। পূর্বকে কল দিয়ে প্রচণ্ড খারাপ কথা শোনাবে এটাই মনেমনে স্থির করলো। কল দিলো ঠিকই কিন্তু পূর্ব রিসিভ করলো না। পরপর আটটা কল শেষে পূর্ণতা যখন রাগে,অভিমানে ফোন বিছানায় ছুঁড়বে ওই মূহুর্তে ফোন বাজতে লাগলো। রাগের উত্তেজনায় স্ক্রিনে না তাকিয়ে পূর্ণতা রিসিভ করে ফেললো। মুখ খুলে যেই অশ্রাব্য কথা উচ্চারণ করবে ঠিক ওই মূহুর্তে ওপাশ থেকে মেয়েলি সুরে কেউ কাঁদতে কাঁদতে বললো,

– আমাকে উদ্ধার করো, ও চলে যাচ্ছে। ও আজীবনের জন্য চলে যাচ্ছে। আর নাকি ফিরবেনা। মুখও দেখাবেনা। আমাকে উদ্ধার করো…

– ‘ চলবে ‘

#FABIYAH_MOMO