তোকে ঘিরে পর্ব-৪৪+৪৫

0
1947

#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৪৪
#ফাবিয়াহ্_মমো 🍁

বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত। এ্যাম্বুলেন্সটা দ্রুত হসপিটালে পৌঁছনোর সকল বন্দোবস্ত করে দিয়েছে পূর্ব। দলের ছেলেপিলে ডেকে দুটো গাড়ির ব্যবস্থা করে একটা এ্যাম্বুলেন্সের পেছনে টহল দিচ্ছে আরেকটা সিকিউরিটি দিচ্ছে সবাইকে আনার জন্য বড় মাইক্রোবাসটার পেছনে। পূর্ব একা ড্রাইভ করে সামনে থেকে রাস্তা ক্লিন করে দিচ্ছে এ্যাম্বুলেন্স যাওয়ার জন্য! আজ যে করেই হোক শ্রেয়াকে বাঁচানো চাই! পূর্ণতাকে নিজের গাড়িতে তুলেনি পূর্ব। ইতিমধ্যে মানুষজন জেনে গিয়েছে পূর্ব একটা রোগীকে হাসপাতালে পাঠানোর জন্য রাস্তায় নেমেছে, কাজেই পূর্ণতা পাশে থাকা মানে প্রত্যক্ষ ভাবে বিপদ! ওকে পরিবারের অন্যান্য সকলের সাথে মাইক্রোতে তুলে দিয়েছে দ্রুত আসার জন্য। শো শো করে সারিবদ্ধ ভাবে একসঙ্গে হাসপাতালের গেইট দিয়ে ঢুকলো অনেকগুলো গাড়ি। পূর্বের কালো গাড়িটা সবার প্রথম ঢুকতেই ডাক্তারদের একদল টিম রেডি হয়ে স্ট্যাচার আনতে নির্দেশ দিলো। মিনিটের মধ্যে এ্যাম্বুলেন্স থেকে ধরাধরি করে বের করলো শ্রেয়াকে। ওয়ার্ড বয়, নার্স, ডাক্তার সবাই দৌড়ে ছুট লাগালো ট্রিটমেন্ট চালু করার জন্য।। হাসপাতালের বাইরে থাকা মানুষজন কৌতুহল দৃষ্টি যার যার জায়গায় দাড়িয়ে হা করে আছে। সেকেন্ডর মধ্যেই সুনশান নিরব হাসপাতাল প্রাঙ্গণে হুলস্থুল অবস্থা দেখে হতবাক সবাই। পূর্ব হাত ঘড়িতে সময় দেখতে দেখতে মাইক্রো থেকে নামা সবাইকে হাসপাতালের ভেতর জলদি যেতে বললো। শ্রেয়ার মা পাগলের মতো ছুট দিলে উনার পিছু পিছু সবাই হনহনিয়ে দৌড়ে যায় ভেতরে। পূর্ব প্রচন্ড ব্যস্ত ভঙ্গিতে কানে ব্লুটুথ লাগিয়ে হাতে ফোন নিয়ে কাউকে কল দিতেই পূর্ণতা ছুটে এলো পূর্বের একদম সামনে। ঢোলা কালো বোরখার নিচের দিকে কাদায় মেখে গেছে পূর্ণতার। দু’হাতে বোরখা কোনোরকম একটু উঁচু তুলে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,

– আয়মান ফোন ধরছেনা, কি করি? আমার মাথা কাজ করছেনা পূর্ব। ও কেনো এমন করছে?

পূর্বকে ঘিরে এখনো আশেপাশে থাকা বিভিন্ন রোগীর স্বজনরা ড্যাবড্যাবে তাকিয়ে আছে। পূর্ব মুখে হাত দিয়ে দেখে মাস্ক নেই! মানুষ ওকে দেখে চিনবেনা এমন পাবলিক সম্ভবত নেই! পূর্ব ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে তাড়াতাড়ি পকেটে হাত দিয়ে মাস্ক বের করতেই পূর্ণতাকে চোখ দিয়ে একটা ইশারা করে। পূর্ণতা চমকে উঠতেই হঠাৎ আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সবাই ওদেরকে দেখছে। মাথা ঘুরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখে পূর্ব মুখে মাস্ক লাগিয়ে হাঁটা দিয়ে হাসপাতালের প্রবেশপথের দিকে। পূর্ণতা চোখ নিচু করে বোরখা ধরে পূর্বের পিছু পিছু যেতেই একটা ওয়াশরুমের মতো নিরিবিলি জায়গায় এসে পরলো। পূর্ণতা অবাক দৃষ্টিতে নিরিবিলি জায়গাটা দেখতেই বুঝতে পারলো এটা অনেকটা চেন্জিং রুমের মতো যেখানে বাইরে থেকে আসা মানুষের তাৎক্ষণিক পোশাক পরিবর্তনের জন্য করা হয়েছে। হাসপাতালটা প্রাইভেট ও বিলাসবহুল বিধায় এখানে মানুষ তুলনামূলক কম। পূর্ণতা রুমের সেন্টারে দাড়াতেই পূর্ব যেয়ে রুমটার দরজা লক করে দিলো। চকচক করা আভিজাত্য বেসিনের কাছে গিয়ে ট্যাপ ছেড়ে বেসিনের ডানপাশ থেকে টিস্যুবক্স নিয়ে পূর্ণতার পায়ের কাছে হাটু মুড়ে বসলো পূর্ব। পূর্ণতা চেচিয়ে উঠলো,

– কি করছো তুমি? পায়ের কাছে বসছো কেন? তুমি খবরদার বোরখায় হাত দিবেনা!

পূর্ব কথা শুনলো না, কথা সম্ভবত কানেও নিলেনা। নির্বিকার ভঙ্গিমায় ফস ফস করে বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে পূর্ণতার বোরখার কাদা মুছতে লাগলো সে। পূর্ণতা চেচামেচি আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিলে পূর্ব এমন দৃষ্টিতে তাকায় পূর্ণতা সঙ্গে সঙ্গে চুপ! হঠাৎ পকেট থেকে ফোন বেজে উঠলে কানের ব্লুটুথে ট্যাপ করে কথা বলতে বলতে কাদা পরিস্কার করা অব্যাহত রাখলো সে।

– এটা কি সিমেক্স ব্লাডব্যাংক? আমি ওয়াসিফ পূর্ব বলছি। আমার ইমিডিয়েটলি পাঁচ ব্যাগ রক্ত লাগবে। এক্ষুনি সবকিছু সিকু্য়েন্স করুন আমি লোক পাঠাচ্ছি।

কথার মাঝেই পূর্ব আবার উঠে দাড়িয়ে ট্যাপের পানিতে অনেকগুলো টিস্যু ভিজিয়ে বাড়তি পানি চিপড়ে ফিরে এলো পূর্ণতার পায়ের কাছে হাটু গুজিয়ে। এই মানুষটা বড়ই অদ্ভুত। কখনো নিজের দিকে তাকায় না। কখনো নিজের জন্য ভাবেনা। নিজের বলতে যে একটি ব্যক্তিগত ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা আছে সেটা সর্বদা ফলায় না। এমন দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াতেও পরিবারের অন্যান্য মানুষরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতো, ডাক্তারের ত্রুটিতে শ্রেয়ার প্রাণ হয়তো ঝরে যেতো, হারিয়ে যেতো একটা মেয়ে কোনো মায়ের বুক খালি করে, বাবার মমতা ভরা ‘মা’ ডাককে আজীবনের জন্য ছিনিয়ে নিয়ে যেতো সেই মানুষটা অকাল মৃত্যু ডেকে। এই শ্রেয়া কতোবার পূর্ণতাকে আগলে রেখেছে। কখনো বোনের মতো জড়িয়ে ধরেছে, কখনো পাশে থেকেছে বন্ধুর মতো। পূর্বের তো কিছুই হয়না শ্রেয়া তবুও পূর্ণতার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের শেষটুকু দিয়ে বাঁচানোর তাগিদে আছে পূর্ব। পূর্ণতার চোখ থেকে বৃষ্টি ফোটা জোড়ায় জোড়ায় ঝরছিলো গাল ভিজিয়ে। পূর্বের দিকে মাথা নুয়ে তাকালে ওকে জাপটে ধরে কাছে টানতে ইচ্ছে করে। মানুষটা সবার জন্য ভাবলেও নিজের জন্য স্বার্থপর হতে পারেনা। এইযে বিরাট বড় হাসপাতালে নিয়ে এলো, বড় বড় ডাক্তারদের বাড়ি থেকে তুলে এনে শ্রেয়ার জন্য মজুদ করলো, রক্ত শংকটে যদি না পরে এরজন্য রক্তের যোগানও দিয়ে ফেলেছে সে। পূর্বকে জীবনে পেয়ে পূর্ণতার যদি হাজারবার, অসংখ্য বার, অগণিত কষ্ট সহ্য করা লাগে তাও করবে। প্রচণ্ড সুখের চেয়ে যদি কষ্টের পাল্লা ভারি হয় সেটাও মাথা পেতে মেনে নিতে রাজি পূর্ণতা। এই অসভ্য, ফাজিল, বেয়াদব, রাগী, রাশভারী মানুষটাকেই পূর্ণতার চাই।

পূর্ব পুরো বক্স খালি করে পূর্ণতার বোরখায় লেগে থাকা কাদাটে অবস্থা পরিস্কার করে উঠে দাড়ালো। টিস্যুর বক্সটা জায়গা মতো রেখে হাত ধুয়ে পূর্ণতার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো। কালো নিকাব ভেদ করে ছলছল চোখের দিকে সম্পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পূর্ণতার হাতদুটো ধরলো পূর্ব। সাথেসাথে পূর্ণতা চমকে উঠলো। পূর্বের হাতদুটো কি ঠান্ডা! তড়িৎ গতিতে ওর খেয়াল হলো পূর্বের কালো শার্টটা পুরো ভিজে গায়ের সাথে লেগে আছে। পূর্ণতা অস্থির কন্ঠে পূর্বের গাল ধরে বললো,

– তুমি গাড়িতে থাকার পরেও ভিজলে কি করে? দেখি কপাল দেখি। জ্বর আসলে তোমার খবর আছে দেখে নিও! আমি তোমাকে ছাড়বো না!

পূর্ব ঠোঁট প্রসার করে গালের দুপাশে সুক্ষ্ম হাসির ভাঁজ ফেললো। পূর্বকে হাসতে দেখে পূর্ণতা মুখ ফুলিয়ে ভ্রুদ্বয়ের মাঝে ভাঁজ ফেলে বললো,

– তুমি হাসছো? আমি ইয়ার্কি করছি? জবাব দাও না কেনো?

পূর্ব কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে পূর্ণতার হাতদুটোয় চুমু দিয়ে দিলো। পূর্ণতা রাগী রাগী চাহনিতে পূর্বের দিকে তাকিয়ে আছে। পূর্ব দুই গালে দু’হাত রেখে নিকাবের উপরেই পূর্ণতার ওষ্ঠযুগলের উপর ঠোঁট ছুয়িয়ে দিয়ে দিলো। বুকের কোথাও কাটা ফুটে উঠলো পূর্ণতার। পূর্বের শরীর বেশ ঠান্ডা হয়ে আছে। চকিত দৃষ্টিতে পূর্বের গাল, কপাল ও গলায় হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে পর্যবেক্ষণ ভঙ্গিমায় উৎকন্ঠাযুক্ত কন্ঠে পূর্ণতা বললো,

– তোমার সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে! কি করবো আমি তোমাকে নিয়ে? নিজের নূন্যতম খেয়ালটুকু রাখোনা আমি..আমি

রাগে, ক্ষোভে অদ্ভুত জেদীপনায় পূর্ণতা কথা শেষ করতে পারলো না, দাঁতে দাঁত চেপে থেমে গেলো। পূর্ব ফিক করে ঝকঝকে দাঁতে সুন্দর করে হাসতেই মোলায়েম কন্ঠে বললো,

– বাসায় গেলে একটু আগলে নিও। তোমার উষ্ণতায় একটু উষ্ণ করে দিও তাতেই আমার চলবে। এটুকু বিশ্বাস করতে পারো আমি অসুস্থ হবো না। ঝড়বৃষ্টি গায়ে মেখে দেদারসে থাকতে পারবো। নো টেনশন! ঠিক আছে?

সাবলীল হাসিতে পূর্ণতার দিকে ডান চোখটা টিপ মেরে দরজার কাছে চলে গেলো পূর্ব। পূর্ণতা কয়েক সেকেন্ড ঝিম মেরে চুপটি করে থাকতেই হঠাৎ ঝাঝালো গলায় বলে উঠল,

– আমার কথা জীবনেও শুনবেন? কখনো শুনবেন? আমার উপর মর্জি খাটিয়ে দারুণ শান্তি পান তাইনা? আসলে আমি তো আপনার কেউই না, থাকা না-থাকা একসমান!

ফোঁস করে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললো পূর্ণতা। রাগ যখন ওরও উঠে তখন পূর্বকে একচুল ছেড়ে কথা বলেনা সে। দরজার লকে মোচড় দিয়ে পূর্ব মাথাটা পেছনে ঘুরিয়ে এক টুকরো মিষ্টি হাসিতে বললো,

– আমার সবকিছু যখন তোকে ঘিরে। পূর্ণতা ছাড়া পূর্বকে বড়ই বেখাপ্পা লাগে।

পূর্ণতা অটলভাবে দাড়িয়ে রইলো। পূর্বের যাওয়াটা একদৃষ্টিতে দেখে স্তব্ধ ভঙ্গিতে ঢোক গিলে গলা সিক্ত করলো পূর্ণতা। প্রাণঘাতী হাসিটা বুকের কোথাও বিদ্ধ করেছে। আঘাত পেয়ে বুকের যন্ত্রটা ক্রমাগত লাফাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে মায়াময় শান্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিটা কল্পনায় স্পষ্ট ভাসতেই বিড়বিড় করে উঠলো নিজের সাথে, তোমায় নিয়ে যতো স্বপ্ন দেখেছি তা ছিলো বেহিসেবী। আমার কল্পনায় যতো সুন্দর চিত্র দেখেছি, বাস্তবে তার চেয়ে বড্ড সাংঘাতিক তুমি। তোমার শান্ত হাসিটা দেখলে বারবার নিজেকে ভুলে যাই। বাধ্য হই তোমার ধারালো দৃষ্টিতে সম্মোহন হতে।।ইশশ, সত্যি তুমিহীনা আমারও নিজেকে বেখাপ্পাই লাগে…

হেসে ফেলে পূর্ণতা। বোরখা ধরে বেরিয়ে যায় রুম থেকে।
.

শ্রেয়াকে ওটিতে ঢুকানো হয়েছে আধ ঘন্টা হলো। রুমের বাইরে সারিবদ্ধ চেয়ারগুলোতে এক এক করে সবাই বসে দোয়া প্রার্থনা করছে। শ্রেয়ার মা কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে রাজিবের মায়ের কাধে মাথা হেলিয়ে দিয়েছেন। আয়মানের মা চোখ বন্ধ করে আঙ্গুলে টুকে টুকে জপমালা করছেন। খোদেজা এদিক ওদিক কিছুক্ষণ পায়চারী করে আয়মানের মায়ের পাশে বসলেন। পূর্ণতা শ্রেয়ার ঘুমন্ত বোনকে আগলে ধরে সিটে বসে আছে। পুরুষরা সবাই কিছুটা দূরে দাড়িয়ে হা হুতাশ ভঙ্গিতে একে অপরের সাথে কথা বলছেন। কথার মধ্যে শ্রেয়ার বাবা হুটহাট করে কেদেঁ দেন হাউমাউ করে। পূর্ব ডাক্তারদের প্রেসক্রাইভ মেডিসিনগুলো বহুবার চেক করিয়ে নানা স্পেশালিস্টদের কাছ থেকে রিকোমান্ড নিয়ে তারপর ওটিতে পাঠিয়ে দিচ্ছে। দলের নয়জন ছেলেকে ব্লাড আনা, মেডিসিন পাঠানো, বাইরে দাড়িয়ে টহল দেওয়ার মতো বিভিন্ন কাজে লাগিয়ে দিয়েছে পূর্ব। পূর্বের সুপারিশে অভিজ্ঞ নার্সরা রাত্রিকালীন ডিউটি ছেড়ে যেতে পারেনি। তবে পূর্ব নিজ দায়িত্বে সকল নার্সদের ঠিকঠাক মতো তাদের বাড়ি পৌঁছে দিবে বলে নিশ্চয়তা দিয়েছে। সম্পূর্ণ ব্যয়ভার পূর্ব নিজের কাধে নিয়েছে, শ্রেয়ার বাবা থেকে চেকটা পযর্ন্ত হাতে না নিয়ে নাকোচ করে দিয়েছে সে। ঘন্টাখানিক পর ডাক্তার এসে সবাইকে জিজ্ঞেস

– পেশেন্ট কি মানসিক অসুস্থতায় ভুগছিলো?

সবাই হুঁশ ফেরার মতো চৈতন্য দৃষ্টিতে তাকালে পূর্ব একধাপ জোরে হেঁটে এসে বলে,

– শারীরিক অবস্থাটা কেমন?
– পেশেন্ট সম্ভবত এ্যান্টি ডিপ্রেশ্ড ঔষুধ নিতো। ঔষুধগুলো খুব পাওয়ারফুল বলে মাথায় এ্যাটাক করেছে।
– ব্রেনে সমস্যা?
– আমরা এখনো এমআরআই(MRI) রিপোর্ট চেক না করে বলতে পারছিনা। তবে হাতের যে শিরাটা কেটেছে খুবই গভীরভাবে কেটে গেছে। ব্লিডিং অফ করা খুব কষ্টসাধ্য হলেও এখন কম পরিমাণে ব্লিডিং হচ্ছে।

পূর্ব কয়েক সেকেন্ড চিন্তার ভঙ্গিতে ভেবে হঠাৎ চকিতে বলে উঠলো,
– ব্লাড কি আরো লাগবে? আনুমানিক কতটুকু লাগবে যদি বলতেন?
– ব্লাড আর লাগবে বলে মনে হয়না। পালস রেট স্বাভাবিক হলে আমরা যে মেডিসিনটা দিবো সেটা আনিয়ে রাখুন।

পূর্ব সাথেসাথে পেছনে ঘুরে দলের একজনকে তর্জনী তুলে মেডিসিন আনতে নির্দেশ দিলো। ডাক্তারকে রিকুয়েস্ট করে পূর্ব একটু প্রাইভেট টক সারতে আলাদা জায়গা নিয়ে বললো,

– মূল সমস্যাটা বলুন। দেখুন ডাক্তার, যত টাকা লাগবে আপনি আমাকে বলবেন। তবুও আপনি দয়াকরে আমার পরিবারের সামনে ওর ব্যাড নিউজটা দিতে যাবেন না।
– আপনি আমাকে সত্য বলতে বারন করেছিলেন মিস্টার। সত্যি বলতে, ওই হসপিটালে শ্রেয়ার প্রাথমিক যে চিকিৎসাটা হয় সেটা একদম ভুল। ওটার সাইড ইফেক্টস হিসেবে ওর ব্রেনের বাম দিকটায় জমাটবদ্ধ অবস্থা। আপনাকে একটা সত্য বলি? রোগী হয়তো বাঁচবে না। আমি মিথ্যা আশা দেওয়ার মতো ডাক্তার নই। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারি কিন্তু বাঁচা-মরার দায়ভার উপরওয়ালার। পেশেন্টের সিচুয়েশন সিরিয়াসলি খুব খারাপ! আপনি কিভাবে ম্যানেজ করবেন, করুন। দোয়া করুরন যেনো বিপদটা কেটে যায়।

পূর্ব শক্ত হয়ে যায় সত্য কথা শুনে। ডাক্তার ওর কাধে একমুহূর্ত হাত রেখে পরক্ষনে হতাশ মুখভঙ্গিতে চলে যায়। মাথা আর কাজ করতে চাইছেনা পূর্বের। মনেহচ্ছে শ্রেয়া ইচ্ছে করেই মৃত্যুর পথটা থেকে বাঁচার কোনো চান্স রাখেনি। সোজাসাপ্টা মরতে চাওয়াটাই ওর একমাত্র মূখ্য উদ্দেশ্য ছিলো। কিন্তু কেনো শ্রেয়া এই ভয়াবহ পথ বেছে নিলো? কি ছিলো রহস্য? অনুশোচনার ভারে তিলে তিলে কষ্ট পোহানোর চাইতে মৃত্যুটাই কি যোগ্য ভেবেছিলো? পূর্ব চোখ বন্ধ করে বুকভর্তি লম্বা নিশ্বাস টেনে নাসাপথ ও মুখছিদ্র(ঠোঁট) পথে ছেড়ে দিলো। শ্রেয়া আজ যদি মরেও যায় অনেক রহস্য আধুরা রেখে যাবে….

– ‘ চলবে ‘

#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৪৫
#ফাবিয়াহ্_মমো 🍁

আকাশ পাতাল এক করে তুখোড় বৃষ্টি হচ্ছে দুটো দিন যাবৎ। গত কয়েক বছরে ঢাকাবাসী এমন বর্ষন দেখেছে কিনা সন্দেহ। নানা জায়গায় সাংবাদিকরা প্রতিটি চ্যানেলে ফলাও করে দেখাচ্ছে এমন বৈরী আবহাওয়ার দূর্যোগপূর্ণ খবর। সবাই অবাক, হতবাক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে বৃষ্টির এমন বিধ্বংসী তান্ডব দেখে। বৃষ্টি যেনো গোগ্রাসে সবাইকে দাপট দেখিয়ে খুন করতে এসেছে। পাহাড়ি এলাকায় জনজীবন প্রায় মূঢ় হয়ে গেছে নিজেদের ভিটেবাড়ির অস্তিত্ব নিয়ে। নিম্নান্ঞ্চলগুলোর অবস্থা আরো করুন। সেই সাথে ঢাকার মধ্যেও হাটু সমান পানি। কালো মেঘের আড়ালে পৈশাচিক গর্জনে ঢেকে আছে তেজস্বী সূর্য। সূর্য্যিমামার দেখা নেই আজ নিয়ে দুদিন হলো। অথচ মনেহচ্ছে কতোদিন যেনো সূর্য দেখেনা মানুষ। কেমন একটা উদাসী, হাহাকার, উৎকন্ঠার অবস্থা। পকেটে হাত গুজিয়ে থাই গ্লাসের জানালা ভেদ করে দৃষ্টি চলে গেছে আকাশের গুমোটভরা দৃশ্যপটে। কালো শার্টটা ভিজে জবজবা হয়ে দেহের ভাঁজে ভাঁজে লেপ্টে ফিটনেসটা চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছে। বেহায়া কালো চুলগুলো ফর্সা কপালের উপর সারিবদ্ধ ভাবে ঠাঁই নিয়ে আছে তার। চুলগুলোর শেষপ্রান্ত থেকে পানি টুপ টুপ করে নিচে পরছে। কিছু পানি খোচা খোচা দাড়ির উপর গড়িয়ে পরতেই চোয়ালের কাছ থেকে শার্টে পরছে এখন। লালচে ঠোঁটটা যেনো বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে আরো কোমল হয়ে লালচে দেখাচ্ছে। শান্ত, মায়াময় ঘন পাপড়িযুক্ত চোখের ভেতরটা একটু পরপর ঝাপসা হয়ে আসছে তার। টলটল নোনা পানিতে বাইরের কালো আকাশটা ঘোলাটে দেখতে দেখতে আবার স্বচ্ছ করে দেখতে পায় সে। কারো বুকফাটা চিৎকারে বুকের ভেতরটা বিষযুক্ত শূল দিয়ে এফোড়ওফোড় করে দিচ্ছে। ফ্লোরে বসে দুহাতে অনবরত পাগলের মতো মেঝে থাপ্পড়ে চলছে কেউ। বৃষ্টির বজ্রগর্জনে আড়াল হতে পারছেনা একঝাঁক কান্নাকাটির আহাজারি। থমথমে প্রাইভেট হাসপাতালটায় স্বজন হারানোর তীব্র দুঃখে কলিজা ফেটে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে সবার। খানখান করে ছিড়ে যাচ্ছে বুকটা। চোখের অঝোর কান্নায় ভেতরের অভিব্যক্তি সবার মতো প্রকাশ করতে না পারলেও নিশ্চুপ হয়ে গেছে ওয়াসিফ পূর্ব। সময় যেনো রহস্য সৃষ্টি করে থমকে গেছে। পূর্ণতা কাঁদতে পারেনা এমন ভঙ্গিতে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে সিটে। তার পাশেই রাজিবের মা মাথায় হাত দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। পূর্ণতা ও শ্রেয়াকে কখনো আপন সন্তানের চেয়ে কম ভালোবাসেনি রোবেদা। পূর্ণতার বিয়েতে কত উৎফুল্ল মেজাজে খাটাখাটনি করলো, একই রকম মনয়কামনা শ্রেয়ার বিয়ে নিয়েই ছিলো। সেই মেয়েটা হঠাৎ করে কোথায় চলে গেলো? আজীবনের জন্য সে পাড়ি দিলো নিরুদ্দিষ্ট পথে। আর কখনো শ্রেয়া বলবেনা, আন্টি, আপনি না দেখতে একদম শাবানার মতো! পুরাই নায়িকা!’ কান্না আজ থামছেনা। অকাল মৃত্যুটা সহ্য হচ্ছেনা বুকে। চিৎকার দিয়ে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছেন শ্রেয়ার মা। মেয়েকে বুকের মধ্যে আগলে রেখে মানুষ করেছেন। প্রথম সন্তান হিসেবে মা হওয়ার সুখটা আজ কেড়ে নিলো সৃষ্টিকর্তা। শ্রেয়ার মা চিল্লিয়ে কেদেঁও থামতে পারছেন না। কেনো নিষ্ঠুরভাবে চলে গেলো শ্রেয়া? একটাবার ভাবলো না মা কি করে থাকবে? মায়ের বুক খালি করে সন্তান চলে যাওয়াটা কতোটা বেদনাদায়ক, কতটা কষ্টের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ জানেন না। মৃত্যুর সংবাদ শুনে খোদেজা কতক্ষণ বুক চাপড়ে কেদেঁছেন তা বলা বাহুল্য। পূর্ণতার সাথে একই বিছানায় দুজন বোনের মতো শুয়েছে কতোদিন। পূর্ণতার পাশে শ্রেয়াকেও উনি দ্বিমাত্র মেয়ের মতোই ভালোবেসেছেন। কি হলো হঠাৎ? কেনো শ্রেয়া এরকম একটা পথ বেছে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলো? খোদেজা উত্তর পান না। আয়মানের মা নিজেই এখন আবোলতাবোল বলছেন। শ্রেয়ার মাকে বুঝ দিতে গিয়ে নিজেই বেখেয়ালী ভঙ্গিতে কথাবার্তা বলছেন।

পূর্ণতা লাশঘরে বসে আছে। সাদা কাপড়ে মুখ ঢাকা মেয়েটার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। জীবনে এই প্রথমবার সে মৃত মানুষের শরীর স্পর্শ করতে যেয়ে খুব ভয় পেয়েছে। কি ঠান্ডা! গোলগাল মুখটা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে। পূর্ণতা পাথর বনে গেছে শ্রেয়ার মতো প্রানবন্ত মেয়েটার মৃত্যুতে। বুকে ভারি পাথর জমাট বেধে আছে। পূর্ণতা ডুকরে কেদেঁ দিয়ে চিল্লিয়ে বলে উঠে শ্রেয়ার ঠান্ডা হাত ঝাঁকিয়ে,

– তোকে ক্ষমা করার সুযোগটা দিলি না শ্রেয়া…তুই কেন এই কাজ করলি, আমি কি নিয়ে থাকবো রে দোস্ত? আমার বুকটায় কি যন্ত্রণা দিলি রে…আমি এই কষ্ট কিভাবে সহ্য করবো…শ্রেয়ারে বোন আমার, একটাবার উঠনা? উঠে দেখ, আমি তোর কাছে আছি। আমি তোকে কিচ্ছু বলবো না। পূর্বের সাথে কি করেছিস কিচ্ছু মনে রাখবো না। দোস্ত তুই উঠনা? তোর পা দুটো ধরি…আমি তোর যাওয়া মানতে পারছিনা দোস্ত..

ঠান্ডা দেহের উপর ঝাঁপিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে পূর্ণতা। পুরো লাশঘরের চারদিকে কান্নার তীব্রতা মুখরিত হচ্ছে। আজ দেয়ালগুলো সাক্ষী কোনো আপন মানুষের মৃত্যুতে কেউ রক্তের সম্পর্ক ছাড়া কাঁদছে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে সদ্য লাশকে আকড়ে ধরে কাঁদছে। শৈশবের সেই অবুঝ বয়স থেকে একসঙ্গে বেড়ে উঠা মেয়েটার মৃত্যু বুকের ভেতর সবকিছু চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছে। পূর্ণতার অবস্থা বেগতিক দেখে অনেকটা শঙ্কিত মুখেই একটা ওয়ার্ড বয় খোদেজার কাছে খবর পাঠায়। খোদেজা এতোক্ষন চৈতন্যশূন্য অবস্থায় কাঁদছিলো পূর্ণতার কথা খেয়াল হতেই তাড়াতাড়ি কান্না মুছে পূর্বকে খুঁজতে থাকে। ছেলেটা গেলো কই? ডাক্তারের কাছ থেকে নিউজটা পেয়ে কোথায় উধাও হলো? খোদেজা কান্নার ভিড়টা পেরিয়ে লম্বা পথটা একটু হেটে ঠিক ডানদিকে তাকাতেই জানালার দিকে দৃষ্টি আটকায়। পকেটে হাত গুজে জানালার বাইরে দৃষ্টি রেখে স্ট্রিট দাড়িয়ে আছে পূর্ব। খোদেজা এগিয়ে এসে পেছন থেকে পূর্বের কাধে হাত রাখে। পূর্ব চকিত দৃষ্টিতে সঙ্গে সঙ্গে পিছু তাকাতেই প্রস্তুত ভঙ্গিতে বলে উঠে,

– মা কিছু প্রয়োজন?

এই প্রথম খুব মুগ্ধ নয়নে পূর্বকে দেখছে খোদেজা। ছেলেটার ফর্সা মুখের সুন্দর দুটো চোখ খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। কেমন গভীর একটা চাহনি! সেই চাহনিতে তাকিয়ে থাকলে কেউ ওর দৃষ্টি থেকে চোখ ফেরাতে পারবেনা। মুখটায় কি অদ্ভুত নিষ্পাপের অদ্ভুত ছোঁয়া! সারারাত না ঘুমিয়ে বেকায়দায় খাটনি করার ফলে চোখদুটো এখন প্রচুর ক্লান্ত দেখাচ্ছে।। বৃষ্টির মধ্যেও নানা কাজে বেরুতে একচুল ভাবেনি। খোদেজাকে এমন চুপচাপ দেখে নিরবতার জালটা ছেদ করলো পূর্ব,

– মা কিছু বলবেন? কোনো প্রয়োজন?

খোদেজা শান্ত ভঙ্গিতে পূর্বের কপালের চুলগুলো আঙুলে ঝেড়ে দিলো। ঝাটের ফলে বিন্দু বিন্দু পানির জন্য পূর্ব চোখ বন্ধ করতেই খোদেজা বললো,

– পূর্ণতার দিকে একটু খেয়াল দেওয়া দরকার।

পূর্ব ঝট করে চোখ খুলতেই কিছু মনে হওয়ার স্থিতিতে অস্থির হয়ে বললো,

– ও কোথায়? আপনাদের সাথে না?
– না। শ্রেয়ার কাছে।

কথাটুকু শুনেই দৌড় লাগালো লাশঘরের দিকে। খোদেজার ততক্ষণে চুলের বাড়তি পানি ঝাড়া শেষ। পূর্বের দৌড়ের দিকে খোদেজা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আরো একবার আচঁলে চোখ মুছলো। পূর্ব একছুটে দৌড়ে এসে লাশঘরের দরজার মুখে হাপাতে হাপাতে দেখে পূর্ণতার বেহাল অবস্থা! পূর্ব ওই অবস্থাতেই পূর্ণতার কাছ থেকে শ্রেয়াকে ছাড়িয়ে নিতেও প্রচুর বেগ খাটালো। পূর্ণতার হাত ধরে সেখান থেকে টেনে একটা খালি কেবিনে নিয়ে এলো।দরজাটা লক করে তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে পূর্ণতার মাথার পেছন থেকে নিকাবের বাধন খুলতেই একটানে নিকাব খুলে আনলো পূর্ব। কান্নায় পূর্ণতার সারা মুখ লাল হয়ে নাক ফুলে আছে। চোখের পাতা এমনভাবে ফুলেছে ও ঠিক করে বুজতেও পারছেনা। পূর্ব ওকে বেডে বসিয়ে পাশে নিজেও বসে পরলো। পূর্ণতাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে পকেট থেকে রুমাল নিয়ে চোখ মুছে দিতেই শান্ত গলায় বললো,

– এভাবে কাঁদলে বাকিদের সামলাবে কিভাবে? আন্টিরা কিভাবে কান্নাকাটি করছেন দেখেছো? এখন তুমিও যদি ভেঙ্গে পরো উনাদের কে দেখবে?

পূর্ণতা আবারও ঠোঁটে উল্টে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে উঠলো,
– ও আমাকে ছেড়ে গেলো কেন? আমি কি ওকে ক্ষমা করতাম না? বলো না? আমি কি দোষ করেছি ওর কাছে? ও কেনো চলে গেলো?

পূর্ণতার প্রশ্নচিহ্নে উত্তর খুজে পায় না পূর্ব। নিজেকে অনেক ছোট লাগছে ওর। শ্রেয়াকে বাঁচানোর জন্য সবকিছু করেও মেয়েটার ভাগ্য ওকে বাঁচতে দিলো না। চোখ বন্ধ করে মুখ সিলিংয়ের দিকে করে জোরে নিশ্বাস ছাড়ছে সে। চোখের দুকোনা থেকে শিশির ফোটার মতো অশ্রু গড়াচ্ছে গাল বেয়ে। মৃত্যুটা কেন হলো? ভুলের শাস্তি কি মৃত্যু হলেই পাওয়া হয়ে যায়?ভাগ্য এতোটা নিষ্ঠুর না হলে পারতো না? পূর্ণতা কান্নার চোটে ধপ করে পূর্বের কাধে কপাল ঠেকিয়ে দিলো। কি বলে পূর্ণতাকে বোঝাবে শব্দ মিলাতে পারছেনা পূর্ব। আজ শব্দ ভান্ডারের অর্থতত্বের অক্ষরগুলোও ভুলে গেছে পূর্ব। বদ্ধ চোখের কোনা দিয়ে থেমে থেমে বারিধারা হচ্ছে তার। পূর্ণতার ঘাড়ের উপর হাতটা রেখে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করতে চাইলো কিন্তু বিক্ষিপ্ত মনটা আজ পূর্ণতার কান্না সহন করতে পারছেনা।

.

সবাইকে দুঃখ দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে শ্রেয়া। ডাক্তার ওর বাঁচার ফিফটি পার্শেন্ট চান্সকে যখন টুয়েন্টি পাশেন্ট বললো তখনই ওর পালস রেট ড্রপ হতে শুরু করলো। এর মধ্যে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো অবস্থায় একবার চোখ খুলেছিলো শ্রেয়া। ওই কক্ষে ওই মূহুর্তে ওই বিরল দৃশ্য দেখে ডাক্তার চমকে উঠলেও কারিস্মা ভেবে ডাক্তার নিজেকে আশ্বস্ত করে সবাইকে সেটা জানাতেই খুশিতে শুকরিয়া জ্ঞাপন করতে লাগলো। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে হাসি ফুটে উঠলো সবার। পূর্ণতা অনেক জোরাজুরি করে, অনেক মিনতি করতে থাকে কক্ষে একবার দেখা করার জন্য। ডাক্তার ওকে বারন করলে পূর্ব পেছন থেকে ইশারা দেয় ওকে যাওয়ার অনুমতি দেয়ার জন্য। পূর্ণতা রুমে ঢুকলে শ্রেয়া মৃদ্যু শব্দে চোখ খুলে তাকায়। পূর্ণতাকে দেখতেই চোখে বর্ষনের অশ্রু জমা হয় ওর। ঠোট কামড়ে পূর্ণতা সুক্ষ্ম হাসি ফুটিয়ে ওর কাছে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে পাশে বসে। ওমনেই শ্রেয়ার চোখ থেকে জমাটপূর্ণ মেঘগুলো পানি ছেড়ে দেয়। পূর্ণতা হিচড়ে কান্না আড়াল করতে মাথা নুয়ে ফেলে। শ্রেয়া হাত নাড়াচাড়া করতে চাইলে পূর্ণতা সাথেসাথে ডানেবামে মাথা নাড়িয়ে বাধা দেয়। শ্রেয়ার গাল থেকে তখন মোটা মোটা অশ্রুগুলো পরছিলো, অক্সিজেন মাস্কের আড়ালে ঠোঁটজোড়া কিছু বলার জন্য কাঁপাচ্ছিলো। কিন্তু কিছুইতেই কোনো শব্দ ভেদ করে বলতে পারছিলো না। বলতে না পারার দুঃখে চোখ কুচকে নিঃশব্দে পানি ফেললো শ্রেয়া। পূর্ণতা নাক টেনে শ্রেয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দেয়। ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

– আমরা আবার সানি মামার ফুচকা খাবো দোস্ত। ট্রিটটা আমি দিবো। একটু সুস্থ হয়ে যা?

শ্রেয়া নিরব চাহনিতে চোখের অশ্রু অনবরত ফেলতে থাকে। কত চেষ্টা করলো একটু কথা বলার জন্য, কত হাসফাস করলো একটা শব্দ উচ্চারণ করতে, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে গেলো শ্রেয়া। পূর্ণতা বেরিয়ে আসার ঠিক দুইঘন্টা পর কক্ষ থেকে বেরিয়ে নার্স চেচিয়ে ডাক্তারকে ডাকলো,

– সাইফুল স্যার! জলদি আসুন! স্যার, স্যার রোগীর বডি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে! পালস রেট একদম লো!

ওই কথা শুনে আবারও কাল এসে ভর করে সবার মুখগ্লানিতে। ডাক্তার ঠিক পনের মিনিট পর মুখের মাস্ক খুলে বির্মষ ভঙ্গিতে মাথা নুয়ে জানায় মানুষটা পৃথিবী থেকে অন্য দুনিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে। সে আর নেই। কেউ বিশ্বাস করতে পারলো না! একটু আগেই তো শ্রেয়ার সাথে কথা বলে আসলো! একটা সুস্থ মানুষ কিভাবে মরে গেলো? কেউ বিশ্বাস না করতে পারলেও পূর্ব ব্যাপারটা পুরোপুরি বিশ্বাস করে নিজেকে সবার কাছ থেকে আড়াল করে নিলো। করিডোরের শেষ কোণাটায় গিয়ে জানালার কাছে দাড়িয়ে পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করলো। কাগজটার উপরে সুন্দর করে লিখা – ‘If i die then please read.’

কাগজটা খুললো পূর্ব। পড়তে লাগলো হাতের লেখাগুলো,

আমার সুন্দর জীবনে কত মধুর স্মৃতি করেছি। কিছু সম্পর্ক আমার জন্য এতোটাই খাটি ছিলো সেগুলো আমি বুঝতে পারিনি। আমি নিজের সুন্দর পরিপাটি দুনিয়াটা নিজের হাতে খুন করেছি। আমার আর বাঁচার ইচ্ছে হয়না। কোন্ বিবেকে আমি জঘন্য একটা কাজ করেছিলাম সেটার উত্তর আমি জানিনা। আজ বড্ড কষ্ট হচ্ছে আমার। রাতগুলোতে এখন বালিশ ভাজিয়ে কাঁদি। ওয়াশরুমে ঘন্টার পর ঘন্টা দেয়াল ধরে মাথা নুয়ে কাঁদি। এতোটা কষ্ট আমি কখনো পাইনি। মানুষ ভুল করলে মাফ চাওয়া লাগে। আমি কোন্ মুখে মাফ চাইবো? মাফ চাওয়ার যোগ্যতাটাও আমি রাখিনি। আমি কখনো এমন তো হতে চাইনি। কখনো ওই অশ্লীল মনোভাবের মেয়েও ছিলাম না কিন্তু সেদিন কি যে হয়েছিলো, ওয়াসিফ পূর্বকে দেখে আমি সবকিছু ভুলে যাই। বেপরোয়া হয়ে ওয়াসিফ পূর্বকে চোখে চোখে রাখতে থাকি। ওর নামটা যতো সুন্দর মানুষটা দেখতেও সৌন্দর্যের মনোরমে ভরপুর। আমার না ওকে পুরো নামে ডাকতে ভালো লাগে। “ও য়া সি ফ পূ র্ব “! একসময় পূর্ণতার পাগলাটে ব্যবহারে খুব চটে যেতাম। রাগারাগী করতাম প্রচুর। ‘কি আছে ওই ছেলের মধ্যে? মধু আছে?’ এভাবেও বলেছি কিন্তু সামনাসামনি যখন ওই মুখটা প্রথম দেখেছি আমার বুকের ভেতরটা অদ্ভুত ভাবে ধুকধুক করছিলো। শান্ত চোখে কি হিংস্র চাহনি! আর চোখগুলো তো সর্বনাশ! মানুষটা রাজনীতি করে শুনলে সবাই চকিতে তাকিয়ে থাকবে। কারন, ওমন সুর্দশন ছেলেদের আমরা এসির নিচে বাবার বিজনেস করতে দেখি নয়তো দামী গাড়ি নিয়ে পাব-ক্লাবে আওয়ারা করতে দেখি। এই ছেলে ছিলো পুরোই ভিন্ন! পূর্ণতার উপর এটা নিয়ে খুব হিংসা হতে লাগলো। আমি কখনো এতোটা কেয়ার কাউকে করতে দেখতাম না। ওয়াসিফ পূর্ব যত দূরেই থাকুক পূর্ণতার খেয়াল রাখতে ভুলতো না। এমনো দিন গিয়েছে ওয়াসিফ পূর্ব দলের মিটিংয়ে ব্যস্ত কিন্তু কানে ব্লুটুথ লাগিয়ে পূর্ণতার প্যাচাল ঘন্টার পর ঘন্টা শুনছে। যতো মানসিক কষ্টেই পূর্ণতা থাকুক, ওয়াসিফ পূর্ব কোত্থেকে উদয় হয়ে পূর্ণতার কাছে চলে আসতো সেটা আজো অজানা। সেদিন মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো আমার। আমি পূর্বের সাথে ঠিক যা করতে চাইছিলাম তা ভাবলে আমাকে প্রস্টিটিউট বলতে কেউ পিছপা হবেনা। কিন্তু এদিকেও ওয়াসিফ পূর্ব চুপ থাকলো। আমার ব্যাপারে কারো সাথে এমনকি পূর্ণতার সাথেও কিছু বলেনি। মা আমার এই ঘটনা শুনলে দা এনে গলা কেটে দিতো, অথচ ওরা দুজনই চুপচাপ সব ভুলে গেলো। কি করে নিজের অসভ্য চেহারাটা সামনে নিয়ে মাফ চাইতাম? আমি আয়মানকে খুব কষ্ট দিয়ে কথা বলেছি। ওকে একসময় আমার সহ্য হতো না। ষষ্ঠইন্দ্রিয় দ্বারা ঠিকই বুঝতাম আয়মান আমাকে পছন্দ করে। কিন্তু রাজিবের মতো ওমন নোংরা পছন্দ না। আমি না আয়মানকে অজান্তেই দুঃখ দিয়ে ফেলেছি। আমার এখন হাসি পায়। প্রচুর হাসি পায় কেনো আয়মানের মতো বন্ধুকে হারালাম? মানুষ হীরা খুজতে যেয়ে কোহিনূর হারিয়ে ফেলে। আমি তো সবচেয়ে দামী জিনিসকে পা দিয়ে লাত্থি মেরেছি। আমি আয়মানকে হারিয়ে ফেলেছি। রুদ্ধকর জীবনটায় কি নিয়ে বাঁচতাম? অনুশোচনার তীব্র ঝড়ে আমি মাটিতে মিশে গিয়েছি। দিনের পর দিন ক্যালেন্ডার উল্টাতাম আর ভাবতাম আজই পূর্ণতার পা ধরে ক্ষমা চেয়ে আসবো। আয়মানের পাশে বসে বলবো, ইবলিশ? আমাকে একটা শেষ সুযোগ দে? আমি তোকে ওয়াদা দিচ্ছি কখনো কোনো ভুল করবো না। আমি আয়মান ইবলিশকে মুখোমুখি করার জন্য সাহসও জুটিয়েছিলাম কিন্তু ইবলিশটা আমার সাথে যোগাযোগ চ্ছিন্ন করে দিয়েছে। তবে আমি একটা জিনিসের জন্য ঠিকই বন্দোবস্ত করে সাহস জুটিয়েছি। সেটা হলো মরার জন্য। মরতে কিন্তু অনেক সাহস লাগে। ট্রেনের নিচে যেয়ে মরতে চেয়েছি, পারিনি। ছাদেও উঠেছি কিন্তু পারিনি। শেষে চোখ বন্ধ করে হাতটা ছুড়ি দিয়ে একদম কেটে ফেললাম।

পূর্ব এমন ভাবে নিশ্বাস ছাড়লো যেনো আটকে থাকা নিশ্বাস সে মাত্র ছাড়তে সক্ষম হলো। কাগজটার মাঝে আর কোনো লেখা নেই, ফাঁকা। শেষে ত্যাড়াবাকা করে লেখা, আমাকে ক্ষমা দিও সবাই।

.

সময় একটা বিশ। ভারি বর্ষনে কিছু রাস্তায় হাটুর উপরে পানি পৌঁছে গেছে। গাড়ি চলাচল একদম নেই বলে শ্রেয়ার জানাজা ওদের বাড়িতে করা সম্ভব হয়নি। জোহরের নামাজ শেষে সাদা টুপি মাথায় দিয়ে পূর্বের সাথে অন্য পুরুষরাও বেরিয়ে এলো মসজিদ থেকে। এল এল হাসপাতাল থেকে পূর্বের বাড়ি কাছে বলে শ্রেয়াকে সেখানেই গোসল দিয়ে গোরস্থানে যাওয়ার জন্য ব্যবস্থা করতে বলেছে। ঝুম বৃষ্টির মধ্যে ওয়াসিফ ভিলার বাড়ির লন সাইডে গোসল শেষ শ্রেয়ার। সবাই বৃষ্টির মধ্যে খাটিয়া ঘিরে জমায়েত হয়ে আছে লনসাইডে। আশেপাশের যতো মানুষ ছিলো পূর্বের আত্মীয় মারা গেছে শুনে বৃষ্টির মধ্যেই জানাজা পরতে এসেছে। ভিড়টাও দেখার মতো, একদম রাস্তা পযর্ন্ত গিজগিজ করছে। পূর্ব সবকিছু ঠিকঠাক দেখে শ্রেয়ার লাশের খাটিয়ে কাধে তোলার জন্য হাত দিলো। প্রথম সারিতেই পূর্ব ও শ্রেয়ার বাবা খাটিয়ার বাঁশ ধরলো। এরপর রাজিব, আয়মান ও পূর্ণতার বাবা-সহ কিছু ছেলেরাও ধরে যাত্রা শুরু করলো। পূর্বের চোখের অবস্থা আজ বৃষ্টির পানির আলিঙ্গনে বুঝতে পারা কঠিন। শ্রেয়াকে বোনের মতোই ভালোবাসতো পূর্ব। মেয়েটা অনুতপ্তে আজ দুনিয়া ছেড়ে দিলো সেটা নিয়ে নিজেকেই এখন চরম অপরাধী মনেহচ্ছে ওর। যদি একবার শ্রেয়ার সাথে কথা বলতো? এতোগুলো দিন ওর সাথে না পূর্ণতা যোগাযোগ রেখেছে, না আয়মান। ধুকে ধুকে মরেছে মেয়েটা। যদি অলৌকিকভাবে সবাই মাফটা করে দিতো? তাহলে শ্রেয়া কি নতুনভাবে নিজের ভুল শুধরে বাঁচতো না? পূর্বের মনেহচ্ছে এতো ভারি ওজন বোধহয় ওর শরীর সইবেনা। অথচ এর চেয়েও ভারি ওজন সে একাই বহন করার সার্মথ্য রাখে। গোরস্থানে পৌঁছে খাটিয়াটা কর্দমাক্ত মাটিতে রেখে উর্পযুক্ত জায়গাটার দিকে খেয়াল করে তাকাতেই আশ্চর্য হয়ে গেল! আয়মান লাঙল নিয়ে মাটি খুড়ছে। বৃষ্টিতে সাদা শার্টটা ভিজে শরীর পরিদৃষ্ট, মাথায় সাদা টুপি, হাতাগুলো কনুইয়ের মধ্যে গুটানো। আয়মান গর্ত খুড়ার কাজ শেষ করে পূর্বের সাথে খাটিয়া নামাতেও সাহায্য করলো। নির্বাক লাগছে আয়মানকে। যেনো কিছুই হয়নি। সামান্য কাজ করতে এসেছে। অতঃপর মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যেই দাফন কার্য সম্পন্ন করে সবাই যার যার অবস্থানে চলে গেলো। পূর্ব তার বাবাকে আদেশ দিলো সবাইকে এখান থেকে নিয়ে বাসায় যেতে। কিছুক্ষণের মধ্যে জনমানবশূন্য হয়ে পরলো গোরস্থান। কিন্তু সদ্য কবর দেয়া জায়গাটার কাছে হাটু ভেঙ্গে মাটিতে বসা অবস্থায় দেখা গেলো আয়মানকে। হাতদুটো উঁচু হয়ে থাকা নতুন কবরটার উপর রাখা। বৃষ্টির দাপট থাকা সত্ত্বেও পূর্ব যেনো বুঝতে পারলো পৃথিবীর বুক থেকে কেউ চলে গেলেও মন থেকে যেতে পারলো না আর। পূর্ব আকাশের দিকে মুখ উঁচু করে চোখ বন্ধ করে ফেললো। চোখের ভেতর শ্রেয়ার শেষ লেখাগুলো যেন এখনো ভাসছে। কিছু লেখা ছিলো আয়মানকে নিয়ে,

‘ প্রিয় আয়মান,

আমার মৃত্যুর খবর পেলে,

আমার কথাগুলো ভুলে যেও,

যা বেঁচে আছে তোমার মনের মাঝে

সব ভুলে নতুন করে শুরু করো ‘

– ‘ চলবে ‘

#FABIYAH_MOMO