তোকে ঘিরে পর্ব-৬৭ এবং শেষ পর্ব

0
1947

#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৬৭.
#ফাবিয়াহ্_মমো.

হাউমাউ করে কান্নার আওয়াজ শুনে পূর্ণতা স্তব্ধ হয়ে গেলো। চোখের সামনে শ্রেয়ার সেই শেষ দৃশ্যটা ভাসছিলো। হাসপাতালের বেডে কয়েক মিনিটের জন্য শ্রেয়া যখন সেন্সে ছিলো সবার আগে পূর্ণতার সাথেই দেখা করেছে। ওটাই ছিলো শেষ দেখা। আখেরী দেখা। দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার মতো শেষ সাক্ষাৎ। এরপর আর শ্রেয়া ফিরেনি। আজীবনের জন্য হারিয়ে গেছে, সবাইকে বিদায় জানিয়ে অজানার কায়নাতে পাড়ি দিয়েছে। ও আর কোনোদিন ফিরবেনা। পূর্ণতা ফোনটা কেটে দিতেই বুঝতে পারলো তার চোখ থেকে আবারও পানি পরছে। পুরোনো দিনগুলো মনে পরছে ভীষণ। শ্রেয়ার কথা মনে পরছে প্রচুর। আজ থেকে কয়েক বছর আগে এভাবেই তো কান্না করে পূর্ণতা মনের সব কথা শ্রেয়াকে বলতো, সমস্যার সমাধান চাইতো, নানা কাজে শ্রেয়ার পুরোদমে সাহায্য পেতো। আজও সেদিনের স্মৃতি ভাসে, মনের অন্দরে বিভৎস দিনের কথা মনে পরে, ভুলে যেতে ইচ্ছে করে সব ঘটনা। একটা ভুল হলেও সেই ভুলের জন্য শ্রেয়ার ক্ষমা হলো না। কিন্তু দিনশেষে মৃত ব্যক্তি আর কখনো জীবিতাবস্থায় ফিরবেনা। পূর্ণতা চোখ কুঁচকে ভেতরের অশান্ত বিষাদের ঝড়টা থামানোর চেষ্টা করলো। ফোনটা মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে রেখে পাশে থাকা বিছানার উপর বসে পরলো। মিনিটের কাটা তিরতির করে চলে যেতে লাগলো নিঃশব্দে, নিঃশর্তে, নিঃসংশয় হয়ে। পূর্ণতা দ্রুত নিজেকে সামলানোর জন্য গলা শক্ত করে ভেতরে চাপিয়ে রাখা কান্নাটা কয়েক মূহুর্তের মধ্যে শান্ত করে। মনটা একটু শান্ত হলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চিন্তা করে, সাবিহা এখন কেনো কল করেছে? আয়মান কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, কি কারন? পূর্ণতা কিছুই বুঝতে পারছেনা এখন। তাড়াতাড়ি সব ঠিকঠাক করার জন্য ফোনটা পার্সে ঢুকিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলো। সদর গেটের কাছে চলে গেলে আবার পা ঘুরিয়ে আয়েশার রুমে গিয়ে প্রণয়কে দেখতে গেলো। ছেলের কাছে ছুটে গিয়ে ওমনেই শ্বাশুড়ির কাছে পুরো ঘটনা খুলে বললো। সব শুনে আয়েশা প্রচন্ড চিন্তিত হয়ে উঠলেন। তিনি উদ্বিগ্ন সুরে পূর্ণতাকে তাড়াতাড়ি সেখানে যেতে বললেন। এদিকে পলাশের রুম থেকে ডাক এলে আয়েশা কিছু সময়ের জন্য সেখানে চলে গেলেন। পূর্ণতা এতোক্ষন পর ছেলের দিকে দৃষ্টি দিলো। প্রণয় তখন বিছানায় পা দুলিয়ে সাইকেলের মতো খেলছে। লাল টুকটুকে গালদুটোতে ভর রেখে নিষ্পাপ হাসি দিচ্ছে। স্বচ্ছ পরিস্কার নির্মল চাহনিতে অবুঝ মায়ায় তাকিয়ে আছে। ছোট ছোট নরম আঙ্গুলগুলো মুখে ঢুকিয়ে মনের আনন্দে খেলছে প্রণয়। তার গায়ের রঙটা ফর্সা, কিছুটা লালচে, কিছুটা রাঙা-রাঙা। গালদুটোয় একদম লালচে আভা। পূর্ণতা পার্সটা বিছানায় রেখে বেবি রেপারসহ কোলে তুলে নিলো প্রণয়কে। বাবার মতো পাওয়া চোখদুটো দিয়ে প্রণয় ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে হাসছে। একটুও বাদ রাখেনি পূর্বের মতো চোখদুটো পেতে। সম্পূর্ণ চক্ষুচাহনি একদম খাপে-খাপে পূর্বের সাথে মিলে। পূর্ণতা পরমাহ্লাদে প্রণয়ের লালচে গালে চুমু খায়। মৃদ্যু হাসি দিয়ে মায়াবী চোখদুটোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,

– তুই অবিকল তোর বাবার প্রতিরূপ পেয়েছিস। একদম তোর বাবার মতো চোখদুটো। এই চোখ দিয়ে যে, বড় হয়ে কতজনকে নাশ করবি জানা নেই। তোর বাবার চোখদুটোর জন্য আমি কখনো রাগ পুষে থাকতে পারিনি। চোখের দিকে তাকালেই আমি রাগ ভুলে যেতাম। তোকে পেটে নিয়ে সারাক্ষন তোর বাবার কথাই চিন্তা করতাম। একটুও শান্তি পাইনি প্রণয়। না তোকে শান্তি দিয়েছি, না আমি স্বস্তিতে থেকেছি। তোর বাবার কথা চিন্তা করলে বুকটা শুকিয়ে যায়। জেলে কম কষ্ট করেনি। আমি ওর জায়গায় থাকলে কি করে টিকতাম? তোর জন্য কিছু না করলেও নিজের সবটা শেষ করে দিয়েছে এই ব্যক্তি। জানিস, তোর বাবার মতো রাশভারী মানুষকে একমাত্র তুই কাঁদিয়েছিস। তোকে কোলে তুলে আমার সামনেই অশ্রু ঝরিয়ে ফেলেছে। রাতে কতবার তোর আঙ্গুল ধরে চুমু খায় সে হিসেবে তুই জানবিনা প্রণয়। এখনো ওকে কাঁদতে দেখি। চোখদুটো ভেজা থাকে। শুধু তোর দিকে তাকিয়ে তাকে। চোখ দিয়ে টলমল করে পানি পরে। ওর বুকে যে কি নিয়ে এখনো দুঃখ, আমি জানিনা বাবা। ওইটুকু বুকটার মধ্যে কি কি ও লুকিয়ে রেখেছে আমাকে কিছুই বলেনা। তোর বাবাটা মুখচাপা মানুষ। আমার কাছে সহজে কিছু বলেনা। তুই যেদিন দুনিয়ায় আসলি সেদিন ওকে যা-তা করে বকেছি। ও আমাকে পাল্টা করে কিছুই বলেনি। অন্যকেউ হলে সত্যিই আমাকে ফেলে চলে যেতো। জেল থেকে বেরিয়ে হাসপাতালে গিয়েছে, এটাই আমাকে বলেনি। এখনো শার্ট-পান্ঞ্জাবীর হাতা গুটায় না। স্লিভ নামিয়ে রাখে। এখনো সবার কাছ থেকে হাতদুটো লুকিয়ে রাখে। ডান হাতের প্লাস্টার খুলা হয়নি। বাম হাতের কনুইয়ে এখনো কালো হয়ে আছে। মলম লাগাতে গিয়ে প্রচুর ব্যথা পায় তবুও একটা টু শব্দ উচ্চারণ করেনা। অথচ দ্যাখ, ওই দুহাতেই দাবড়ে বেরিয়ে কাজ করছে, তোকে কোলে নিচ্ছে, সবার খেয়াল রাখছে। সারাদিন শেষে রাতের বেলার যখন ঘুমাতে আসে তোর মুখটা যেনো ওর ক্লান্তি কাটিয়ে দেয়। তুই তোর বাবাকে কোনোদিন কষ্ট দিবিনা। যদি আমি নাও থাকি তবুও তোর বাবাকে দেখে রাখবি প্রণয়। আমি চাই তুই তোর বাবার মতোই হ, কঠিন হ, রাগী হ। তুই ওয়াসিফ পূর্বের মতোই পুরো দাপট নিয়ে চলবি, সামনে-পিছে তাকাবিনা। ও যেমন কাউকে পরোয়া করে চলেনা তেমনি বেপরোয়া হবি। শুধু সত্যের জন্যই বেহায়া হবি, মিথ্যার জন্য আদবে চলবিনা। তোকে দুনিয়ায় দেখাটা তোর বাবার শেষ ইচ্ছা। আর বিশ্বাস কর, আমি স্বার্থক। ও তোকে আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসে। একটু বড় হলেই বুঝবি তোর বাবা মানুষটা কেমন। আচ্ছা, তোর বাবার চেয়ে রাগী হবি? তোর চুল যে এতো খাড়া-খাড়া, আমি যে এখনই চিন্তায় মরছি! আবার হাসি? খালি হাসি। এতো খিলখিলিয়ে হাসলে তো সমস্যা। তুই সব বুঝে গেলি নাকি?

প্রণয় মুখের কাছে আঙ্গুল এনে পূর্ণতার দিকে হাসি দিয়ে তাকিয়ে হাসছে। হাসিমাখা চোখে পিটপিট চাহনিতে এমন ভাবে দৃষ্টি দিয়ে আছে, যেনো পূর্ণতার সব কথা সে বুঝে ফেলেছে। পূর্ণতার বুকটা শান্তিতে ছেয়ে যাচ্ছিলো। অদ্ভুত শীতলতার পরশ পেয়ে মনের ভেতর ঠান্ডা হচ্ছিলো। মুখ নামিয়ে ছেলের কপালে গাঢ় করে চুমু খেলো ও। কয়েক মিনিটের মধ্যে আয়েশা এসে পরলে প্রণয়কে রেখে পূর্ণতা রওনা দিলো।

আকাশটা কালো মেঘে ঘনিয়ে আসছে। চারধার ভয়ঙ্কর অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। আড়াল হয়ে যাচ্ছে সূর্যের আলো। চারদিক থেকে মানুষের মনে শঙ্কার উদ্ভব হলো। পূর্ণতা গাড়িতে বসে জানালার বাইরে দৃষ্টি রেখেছিলো। এতো ভয়াবহ অন্ধকার আগে কখনো দেখেনি। নির্মল আকাশকে নির্মমভাবে গ্রাস করে নিচ্ছে কালো মেঘ। এমন আবহাওয়া দেখে গা-টা কেমন শিরশির করে উঠছে। পূর্ণতার মনে একমাত্র ভয়টা শুধু পূর্বকে নিয়েই হলো। সকাল থেকেই পূর্বের কোনো লাতাপাতা নেই। কল দিলে কল ধরছেনা, কোথায় আছে খবর নেই। পূর্ণতা ঢোক গিলে পূর্বকে আরেকবার কলে দিলো, মনেমনে সুস্থতার জন্য জপ করছিলো। কিন্তু মনের উৎকন্ঠা হ্রাস না হয়ে আরো বেগতিক হয়ে উঠলো। পূর্ব কল ধরলোনা। ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে সামনে দৃষ্টি দিয়ে জিজ্ঞেস করে দিলো পূর্ণতা,

– আকবর চাচা, সকালে তো আপনি দারোয়ানের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলেন। আপনি কি পূর্বকে যেতে দেখেছেন?

প্রবীণ বয়সী আকবর সর্তক ভঙ্গিতে গাড়ি চালাতেই পূর্ণতার জন্য সরল গলায় উত্তর দিলো,

– বাবা তো ফোনে কথা কইতে কইতে গাড়িত চড়তাছিলো। হেরপর গাড়ি চালু দিয়া কই জানি চইলা গেলো, আমি আর দেখিনাই।

এটুকু শুনে আর প্রশ্ন করার অবস্থা রইলো না। শুকিয়ে আসা গলা কোনোমতে ঢোক গিলে ভেজানোর চেষ্টা করলো পূর্ণতা। বুকটা ভয়ংকর ভাবে ধুকধুক করছে। যদি কিছু হয় —! গুমোটপূর্ণ আকাশের দিকে করুন দৃষ্টি রাখলো সে। পূর্ব হয়তো আবারও পুরোনো রাস্তায় ফিরে গিয়েছে। এটুকু ভাবতেই অস্থির হয়ে উঠেছে পূর্ণতা। এসির ভেতরে চুইয়ে ঘামতে শুরু করেছে সে। আর ভাবতে পারলোনা পূর্ণতা। চোখ বন্ধ করে ফেললো তৎক্ষণাৎ। এক বোতল পানি পুরোটা খেয়ে ফেললো। ওমনেই গাড়ি এসে পৌঁছলো শিকদার বাড়িতে। বোতলটা ডাস্টবিনে ফেলে বাড়ির ভেতরে ঢুকেই গায়ের লোম দাড়িয়ে গেলো পূর্ণতার! সাবিহার অবস্থা খুবই খারাপ! মাথা ঘুরে পরে গিয়ে বেকায়দায় বমি করে রুম ভাসিয়েছে। রুম একদম নষ্ট হয়ে গেছে। এদিকে বাড়িতে দ্বিতীয় কেউ নেই। আয়মানের নানা হাসপাতালে ভর্তি বিধায় আফিয়া মূলত সেখানেই গিয়েছে। সাবিহাকে জোরাজুড়ি করেও সঙ্গে নিতে পারেনি। সাবিহার মুখ শুকিয়ে কয়েক ঘন্টার মধ্যে বির্বণ আকার ধারণ করেছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে চোখ ঘোলাটে দেখাচ্ছে। এদিকে হাত-পা ঠান্ডা হওয়া ভালো লক্ষণ না, পূর্ণতা তাড়াতাড়ি সাবিহাকে শাড়ি পাল্টাতে বলে রান্নাঘরে চলে এলো। তাক থেকে খুজেঁ-খুজেঁ চিনির বয়াম বের করে মূহুর্তের মধ্যেই চিনির পানি গুলিয়ে আনলো। ততক্ষণে সাবিহার দূর্বল, ক্লান্ত, নেতানো দেহ বিছানায় সেঁটে গেছে। পূর্ণতা ওকে চটজলদি চিনির পানি খাইয়ে দেয়। কয়েক মিনিট যেতেই আবার ভক করে বমি করে সাবিহা। বিছানার চাদর নষ্ট করে ফেলে। অত্যধিক দূর্বলতার জন্য চোখ খুলেও তাকাতে পারছেনা সে। পূর্ণতা মাথায় হাত দিয়ে চরম বিপাকে ফেঁসে গেছে। আয়মানকেও অনবরত কল করতে থাকে। শেষে নিরুপায় হয়ে ডাক্তার ডেকে আনে। ডাক্তার এসে সাবিহার পালস রেট চেক করে, চোখের পাতা মেলে দেখে এবং পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত সুরে বলে,

– ক্লিনিকে টেস্ট করানো দরকার। বাসায় রেখে অবস্থা বোঝা যাচ্ছেনা।

পূর্ণতা হতবিহ্বল হয়ে চিন্তায় ক্লিষ্ট হয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে কিছু একটা মনে পরার ভঙ্গিতে জবাব দেয়,

– ওর পেটে সমস্যা? প্রচুর বমি করছে যে। পেটে গ্যাস হলো কিনা বুঝতে পারছিনা। আপনিই কিছু করুন।

পূর্ণতার চিন্তান্বিত মুখ দেখে ডাক্তার ছোট্ট নিশ্বাস ছাড়ে। সাবিহার দিকে একপলক তাকিয়ে শেষে পূর্ণতার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলে,

– মনে তো হচ্ছে অন্তঃসত্ত্বা।

প্রথমে বজ্রাহতের মতো তাকালো পূর্ণতা, পরক্ষনে তীব্র খুশিতে চোখ টলমল করে হেসে দিলো সে। ডাক্তার পূর্ণতার অভিব্যক্তি দেখে একটু হেসে বললেন,

– যদিও নাড়ি টিপে ধারণা দিলাম। বাকিটা ক্লিনিকে গিয়ে টেস্ট করলেই জানতে পারবেন।

বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। আকস্মিক বৃষ্টিতে প্রকৃতির সব ধূলো-ময়লা পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে। নির্মল হয়ে উঠছে গাছের সবুজ নব্য পাতা। আকাশে শুরু হয়েছে মেঘের হুঙ্কার। ফুলে ফেঁপে উঠছে মেঘ পুন্ঞ্জীভূত কালো আকাশ। কেঁপে উঠছে মাটি, বৃষ্টির তীব্রতায় দুলে উঠছে গাছ। পূর্ণতা বৃষ্টির মধ্যেই ক্লিনিকে নিয়ে গেলো সাবিহাকে। ইতিমধ্যে রাস্তায় পানি জমতে শুরু করেছে। মানুষ বৃষ্টি মাথায় দৌড়াচ্ছে গন্তব্যের দিকে, কেউ ছুটছে ছাউনির উদ্দেশ্যে। ক্লিনিকে এনে দ্রুত টেস্ট করালো সাবিহাকে। সত্যি-সত্যি ধরা পরলো সাবিহা প্রেগনেন্ট! নিজের গর্ভবতী হবার খুশিতে পূর্ণতাকে জাপটে ধরে কেদেঁ দিলো সাবিহা। খুশির জোয়ার উপচে পরলেও ক্ষণিকের মধ্যে মুখ ভার হলো সাবিহার। পূর্ণতা শিকদার বাড়িতে ফিরতে ফিরতে সাবিহার কাছে পুরো ঘটনা শুনলো। আয়মান ইদানিং খিটখিটে স্বভাবের হয়ে গেছে, কাজের মধ্যে ব্যস্ত হয়ে নাস্তানাবুদ অবস্থা। সাবিহাকে পাসপোর্ট করার জন্য তাগাদা দিলে ও পরিস্কার শব্দে বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে নাকোচ করে দেয়। সাবিহা বিদেশ যেতে ইচ্ছুক না। কিন্তু আয়মানও এ কথায় নারাজ। সে কিছুতেই এদেশে থাকতে রাজি নয়। সব কাজ গুটিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়ে সেখানেই সেটেল হতে চায়। আফিয়া অনেক বুঝিয়েও ছেলেকে রাজি করাতে পারেনি। আয়মান এককথায় অটল, অনড় এবং অবিচল হয়ে রইলো। সাবিহা যখন শ্বাশুড়ি ও দেশ ছেড়ে সঙ্গে যেতে না করলো, আয়মান তখন আর ওকে বাধা দিলো না। সে নিজেই ভিসা কনফার্ম করে টিকিট কেটে চুপচাপ লাগেজ গুছিয়ে বিদায় হলো। এমন দিনেই রওনা দিলো, যেদিন আফিয়াও বাড়িতে নেই। সাবিহার অনেক জোড়াজুড়ির পরও আয়মান থাকেনি। উপায়ন্তর না পেয়ে শেষে পূর্ণতাকে কল দিয়ে সাবিহা বাড়িতে আনে। কিন্তু শারীরিকভাবে সপ্তাহ খানেক ধরে সাবিহা বেশ অসুস্থ ছিলো, এ ব্যাপারে কাউকে জানায়নি। ব্যস্ত হয়ে থাকা আয়মান সাবিহার দিকে পরোখ করেনি। পূর্ণতা চুপচাপ সবটা শুনে সাবিহাকে শান্ত হতে বলে বিছানায় শুতে বললো। একটু ঘুমানোর চেষ্টা করতে বলে পূর্ণতা বারান্দার দিকে চলে এলো। ফোনের পাওয়ার বাটনটা অন করতেই বুঝতে পারলো আয়মানের ফ্লাইট এতোক্ষনে টেক-অফ করে ফেলেছে। ফোন এখন টোটালি বন্ধ থাকবে। ইউএসের এয়ারপোর্ট পযর্ন্ত পৌঁছতে আটচল্লিশ ঘন্টা লাগবে। এরপর কাঙ্ক্ষিত স্টেটের ফ্লাইটে লাগবে আরো ছয়ঘন্টা। আয়মানের সাথে তিনদিন পযর্ন্ত কোনো যোগাযোগ সম্ভব না। পূর্ণতা ওর নাম্বারে মেসেজ ছেড়ে দিলো। বৃষ্টিমুখর আকাশের দিকে তাকিয়ে মনটা কেমন উদাস, বিষণ্ণ এবং বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। কেমন শূন্যতা ভর করলো মনের আঙিনায়, যেন কিছু নেই-কিছু নেই ভাব। আকাশ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সাবিহার দিকে একপলক তাকালো পূর্ণতা। বদ্ধ চোখের দুই চক্ষু কার্নিশ বেয়ে অশ্রুফোঁটা ঝরছে। ঈষৎ ভঙ্গিতে কান্নার দোলে সাবিহার বুক উপর-নিচ কাঁপছে। এদিকে পূর্ণতার ফোনে প্রণয়ের জন্য তাড়াতাড়ি ফেরার তাগিদ আসলে সাবিহার জন্য চিন্তায় পরলো পূর্ণতা।কলটা পূর্বিকার নাম্বার থেকে এসেছে। কলটা রিসিভ করে পূর্ণতা কানে ফোন দিতেই পূর্বিকা কেমন সর্তক সুরে বললো,

– পূ-পূ-পূর্ণতা —

সাড়া দিতে গিয়ে বেশ হোচট খেলো পূর্ণতা। অদ্ভুত শোনাচ্ছে পূর্বিকার কন্ঠটা। প্রচণ্ড কৌতুহল কাজ করলো ওর। পূর্ণতা তৎক্ষণাৎ পূর্বিকাকে পাল্টা প্রশ্ন করলো,

– আপু কিছু কি হয়েছে?

প্রশ্ন করার পর পূর্বিকার উত্তরটা আসলো না। পূর্ণতা কান থেকে ফোন সরিয়ে স্ক্রিন দেখে কলের টাইম এখনো কন্টিনিউ চলছে, কিন্তু পূর্বিকা কোনো সাড়াশব্দ করছেনা। পূর্ণতা কৌতুহল চাপতে না পেরে অস্থির হয়েই জিজ্ঞেস করলো,

– আপু? আপু কি শুনতে পাচ্ছো? কি হয়েছে? আপু বাড়িতে সব ঠিকঠাক আছে? প্রণয় কি কান্না করছে? হ্যালো? আপু জবাব দাও!

অনেকগুলো প্রশ্ন শেষে হাপিয়ে উঠার মতো শ্বাস টানতে লাগলো পূর্ণতা। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে! পূর্বিকার কন্ঠ অদ্ভুত শোনাচ্ছে! পূর্বও বাড়ি নেই! আবার কোনো শত্রু আসলো কিনা! প্রণয় বাড়িতে একা! এসব কিছু চিন্তা করতেই মারাত্মক অস্ঋইর হয়ে পূর্ণতা। এদিকে পূর্ণতার এমন অপ্রকৃতিস্থ অবস্থা দেখে সাবিহা ওকে শান্ত হতে বলে। কিন্তু পূর্ণতা আর শান্ত হয়না। সাবিহা ওকে দ্রুত ওয়াসিফ ভিলায় যেতে বললো। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখানকার পরিস্থিতি দেখা উচিত। সাবিহার এ কথা শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে পূর্ণতা দৌড়ে নিচে নামলো। গাড়ির দরজা খুলে এক্ষুনি ওয়াসিফ ভিলায় যেতে বললো। ড্রাইভার মাথা ঘুরিয়ে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে আহত সুরে বললো,

– মা, বাইরে এহন প্রচুর বৃষ্টি। রাস্তায় পানিও জমছে। একটু পর বাইর হইলে ভালো হয়না?

কোনো কথা শুনতে পূর্ণতা রাজি না। সে পরিস্কার কন্ঠে জানিয়ে দিলো রাস্তায় টাইফুন শুরু হলেও গাড়ি যেনো না থামে। এই মূহুর্তে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে যেনো ওয়াসিফ ভিলায় সোজা রওনা দেয়। পথে কোনোভাবে যদি গাড়ি থামে তাহলে পূর্ণতার রূঢ় আচরণ দেখবে! ড্রাইভার পূর্ণতার রণচন্ডীর অগ্নিমুখ দেখে কোনো কিছু বলার সাহস পেলোনা। সে ইন্ঞ্জিন চালু দিয়ে পানি ভেঙে এগুতে থাকে। বৃষ্টির জন্য যেখানে পাঁচ মিনিটের পথ পনের মিনিট লাগে, আজ সেখানে একঘন্টার পথ আড়াইঘন্টা লাগছে। বৃষ্টির প্রখরতা একটু যেনো কমেছে, কিন্তু পূর্ণতার অস্থিরতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। কাউকে ফোন দিয়ে সে পাচ্ছেনা। পূর্বিকা, আয়েশা, নূরানী, ময়না কেউ কলটা ধরছেনা।

আকাশটা এখনো হিংস্রভাবে কালো হয়ে আছে। প্রকৃতি কেমন গুমিয়ে গেছে এই রূপ দেখে। গাড়িটা ওয়াসিফ ভিলার গেট ভিরিয়ে পার্কিং সাইডে থামতেই পূর্ণতা গাড়ি থেকে বাড়ির গেট পযর্ন্ত দৌড়ে ভেতরে ঢুকলো। এরপর মাথা ঝেড়ে কাপড় ঠিকমতো ঝাট দিতেই চোখ তুলে গ্রাউন্ড ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি আটকালো। ওমনেই ভ্রুঁ কুঁচকে এলো ওর। বাইরে মেঘের জন্য ঘুটঘুটে অন্ধকার, অথচ বাড়িতে কেউ লাইট জ্বালায়নি। বাদলার দিনে এমন অন্ধকার অবস্থা আগে কখনো হয়নি। এমন কেনো হচ্ছে দিনটা? সব বিপদের আভাস কি আজই আছড়ে আসছে? পূর্ণতা গলা তুলে পা এগিয়ে আয়েশার উদ্দেশ্যে ডাকে,

– আম্মা? আম্মা আপনি কোথায় আছেন? আম্মা আপনি কি ঘরে? আম্মা?

পূর্ণতার এক ডাকেই হড়হড় করে সাড়া দেয়া ব্যক্তিটা আজ এতো ডাকেও সাড়া দেয়নি। পূর্ণতার বুকটা কেমন কামড়ে এলো, অদ্ভুত ভাবে গা শিরশির করে উঠলো। পুরো গ্রাউন্ড ফ্লোর যেই অন্ধকার, তার চেয়ে আরো বীভৎস অন্ধকার হয়ে গেছে দোতলায়। পূর্ণতা সবাইকে ডাকতে-ডাকতে রুমে চেক করলো। পূর্বিকা নেই, আয়েশার রুমে আয়েশা নেই, পলাশের রুম শূন্য, প্রণয়ের জন্য পূর্ণতা ভয়ে কেঁপে উঠলো। পূর্ণতার অনুপস্থিতিতে কেউ এসেছিলো? কেউ কি সবাইকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে গেছে? পূর্ণতা এটুকু ভাবতেই এক চিৎকার দিয়ে ‘ আম্মা, আপু, নূরানী ‘ বলে ডাকতে লাগলো। তন্নতন্ন করে প্রতিটা রুমের বাথরুম, বারান্দা চেক করতে লাগলো। কেউ নেই, কেউ নেই এখানে। আকাশটা যেনো পৈশাচিক হাসি দিয়ে বিকট গর্জন করছে। একেকটা ভয়ংকর বজ্রপাত ভূমিতে এসে দাপট দেখাচ্ছে। শো-শো করে হাওয়ার তেজ বাড়ছে, সেই সাথে তাল মিলিয়ে বৃষ্টিও মুষড়ে পরছে। প্রকৃতির এমন তান্ডবলীলায় পূর্ণতা হাউমাউ করে কেদেঁ উঠলো। বাড়ির মানুষগুলো কোথায় গেলো? ওয়াসিফ ভিলায় এতো অন্ধকার আগে কখনো দেখেনি পূর্ণতা। ক্রমশ অন্ধকার যেনো আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবার চোখে লাইট ছাড়া কিছু দেখা সম্ভব না। পূর্ণতা হাতের ফোনটা থেকে ফ্ল্যাশ অন করলো। ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দোতলায় উঠলো। করিডোরে আলো ফেলে দেখলো সেখানে সুনশান অবস্থা। পুরো বাড়িটার মধ্যে পূর্ণতা কেবল একা! চোখ মুছতেই আবার অশ্রুতে ভরে উঠলো ওর। ফ্ল্যাশ অন করা হাতটা উঁচু করে নিজের রুমের দিকে এগুলো। রুমের সামনে আসতেই দেখলো দরজা বন্ধ করা। অথচ যাওয়ার পূর্বে দরজা খোলাই ছিলো। পূর্ণতা কান্নার হিড়িকে কাঁপতে-কাঁপতে কম্পমান হাতটা দরজার নবে রাখলো। মৃদ্যু একটা ঢোক গিলে নব মোচড় দিতেই দরজা খুলে ফেললো। দৃষ্টি ভেতরে দিতেই শরীরের প্রতিটি পশম কাটা দিয়ে উঠলো ওর! বিস্ফোরিত চাহনিতে তাকিয়ে থাকতেই গলা রুদ্ধ হয়ে এলো। ওর শরীরে কেউ যেনো বরফ রেখে দিয়েছে, এমন থরথর করে পূর্ণতা কাঁপছে। রুমের সেন্টারে ছোপ ছোপ রক্ত। কিছু রক্ত একটা জায়গায় লম্বা হয়ে লেপ্টে আছে। মনে হচ্ছে কাউকে টানতে-টানতে নিয়ে গেছে। পূর্ণতা নির্বাক দৃষ্টিতে রোবটের মতো দাড়িয়ে পরলো। কান্না, ভয়, চিৎকার সব এক লহমায় ভুলে গেলো। উচুঁ করে রাখা হাতটা ধপ করে নিচে পরলো তখন। ফোনটা ধীরে-ধীরে হাত থেকে ছেড়ে দিলো। মৃদ্যু আওয়াজে পায়ের কাছে ফোনটা পরে যেতেই নিস্তেজ পরিবেশে আবদ্ধ হয়ে গেলো পূর্ণতা। সময়ের কাটা কয়েক মিনিট ওভাবেই চলে গেলো, কিন্তু পূর্ণতা আর আগের মতো অস্থির হয়ে উঠলো না। ধীরে-ধীরে পা ফেলে রক্তিম স্থানটার দিকে এগুলো। চোখের কাছে স্থানটা এগুতে-এগুতে একপর্যায়ে ঠিক পায়ের কাছে আটকে গেলো। চোখ নিচু করে রক্তমাখা ফ্লোরে দৃষ্টি ছুড়লো। আকাশ চিড়ে বিদ্যুপৃষ্ট হতেই বিকট শব্দ করে জানালা দিয়ে আলো এসে আবার ঘুটঘুটে অন্ধকার ছেয়ে গেলো। পূর্ণতা একটুও নড়লো, শব্দ করলো না, চলেও গেলো না। হঠাৎ মনেহলো কেউ ওর শাড়িটা পেছন থেকে ধরেছে। কাধের কাছে আচঁলটায় মৃদ্যু টান লাগছে। কানে কারো চুপিচুপি আসার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বৃষ্টির কারনে মনের ভ্রম ভেবে পূর্ণতা সেদিকে মনোযোগ দিলো না ঠিকই, কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মাথায় কোমরে হাতের স্পর্শ পেলো পূর্ণতা। আকস্মিকভাবে শিউরে উঠে সাথেসাথে মাথা নুয়ালো। দেখার জন্য রুমে আলো নেই, বাইরের বিদ্যুপৃষ্ঠের জন্য অপেক্ষা করতেই ততক্ষণে হাতটা কোমর ছেড়ে পেটের উপর অস্তিত্ব বোঝালো। ঠিক ওই সময় বাইরে থেকে বিদ্যুপৃষ্ট হতেই রুম আলোকিত হয়ে হাতটার গড়ন দেখা গেলো। ঢোক গিলতেই মাথা সোজা করে হাতটার উপর নিজের হিম হওয়া কম্পিত হাতটা রাখলো। ওমনেই কানের কাছে শিহরণ জাগিয়ে ঠান্ডা সুরটা যেনো এলো,

– হাত এতো ঠান্ডা কেন?

শীতের প্রবলতা এবং ঠান্ডা কথা দুটোই দারুণভাবে আক্রমণ করলো ওকে। পূর্ণতা অন্তঃসারশূন্য হয়ে নেতিয়ে পরলো ফ্লোরে। নেত্রপল্লব বন্ধ হয়ে গেলো আপনা-আপনি। কোনোকিছু দেখতে পেলো না স্পষ্টরূপে।

.

মাথা প্রচণ্ড ঝিমঝিম করছে পূর্ণতার। দুহাতে মাথাটা ধরে শোয়া থেকে উঠে বসলো। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকতেই মাথার ঝিমঝিমানি ভাব একটু যেনো কমলো। চোখ খুলতেই চারপাশ পরিস্কার দেখতে পেলো পূর্ণতা। তখনই আবিষ্কার করলো, সে এই রুমটা চিনেনা। দ্রুত বিছানা থেকে নামলো ও। আশেপাশে দৃষ্টি দিয়ে পূর্ণতা এগুতেই সিড়ি দেখতে পেলো। সিড়িটা উপরের দিকে যাচ্ছে এবং সেখানে একটা খোলা দরজা আছে। সেই দরজা দিয়েই হো-হো হাসির কলরব শোনা যাচ্ছে। পূর্ণতা সিড়ি ধরে উপরে উঠতে লাগলো এবং খোলা দরজার কাছে আসতেই হতভম্বের মতো দাড়িয়ে পরলো। সেকেন্ডের মধ্যে হাসাহাসির শব্দ বন্ধ হয়ে গেলো তখন। হাসির ব্যক্তিগুলো পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে রইলো। পূর্ণতা তাদের দেখে অবুঝের মতো ভেতরে পা দিয়ে কাছে যেতে লাগলো। আর ঠিক তখনই চায়ের কাপে এক তৃপ্তির চুমুক দিয়ে পূর্ণতার উদ্দেশ্যে বললো,

– শরীর ভালো লাগছে এখন?

পূর্ণতা এগিয়ে এসে চুপচাপ দাড়ালো। সকলের দিকে দৃষ্টি দিয়ে শেষে রাগী সুরে উত্তরটা দিলো,

– আমার সাথে এরকমটা করার মানে কি পূর্বিকা আপু?

পিনপতন নিরবতায় ছেয়ে খেলো তখন। পূর্বিকা, আয়েশা, খোদেজা, কবির নিজেদের মধ্যে চাওয়া-চাইয়ি করলো কিছুক্ষণ। তারপর পূর্ণতার উদ্দেশ্যে আয়েশা শান্ত সুরে বললো,

– পূর্বিকার দোষ নেই মা। ও কেনো এরকম করতে পারে তুমি তো জানোই। এখন আর দাড়িয়ে থেকো না। আসো তোমাকে খেতে দেই।

পূর্ণতা অটলভাবে জবাব দিলো,
– আমি খাবো না আম্মা। প্রণয় কোথায়?

পূর্ণতার কথা শুনে খোদেজা একটু নড়েচড়ে বসলো। শাড়ির আচঁলটা কোলের উপর থেকে সরিয়ে দিতেই প্রণয়কে দেখতে পেলো পূর্ণতা। নানীর কোলে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে প্রণয়। খোদেজা সর্তক কন্ঠে বলে উঠলো,

– এইযে তোর প্রণয়। রোদ পোহাতে এনেছি। আমার কোলে ঘুমিয়ে পরেছে। আয়, নিয়ে যা।

পূর্ণতা এগিয়ে গিয়ে দুহাত বারিয়ে প্রণয়কে কোলে তুলে নিলো। আদুরে মুখটা নিজের গলার সাথে জড়িয়ে নিচে চলে গেলে পূর্বিকা সেখান থেকে উঠে ওর পিছু পিছু নামলো। প্রণয়কে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রুমটা ভালোভাবে দেখছে পূর্ণতা। কোথায় আসলো, কেনো আসলো, কার বাড়ি, কোন্ জায়গায়, কিছুই বুঝতে পারছেনা পূর্ণতা। এর মধ্যে পূর্বিকা খাবারের প্লেট হাতে রুমের দরজায় নক করলো। মিষ্টি করে হেসে বললো,

– আসবো?

পূর্ণতা তার কৌতুহলী চোখ ক্ষণিকের জন্য স্বাভাবিক করে ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে আসতে বললো। পূর্বিকা খাবারের প্লেট নিয়ে বিছানায় রেখে পূর্ণতাকে সামনে বসিয়ে নিলো। পূর্ণতা প্লেটের দিকে দেখলো, খিচুড়ির সাথে একপাশে ডিম ভাজা, অন্যপাশে শুকনো মরিচের সাথে পেঁয়াজ ভর্তা। পূর্বিকা পেঁয়াজের ভর্তা দিয়ে কয়েক লোকমা গরম খিচুড়ি মাখাতেই সরল গলায় বলে উঠলো,

– কাল ওভাবে কল দেওয়ার জন্য দুঃখিত পূর্ণতা। যদি সন্দেহ না ঢুকাতাম তাহলে তুমি সারপ্রাইজটা পেতেনা।

পূর্ণতা শান্ত দৃষ্টিতে পূর্বিকার দিকে তাকালো। পূর্বিকা গরম লোকমায় ফু দিয়ে হালকা ঠান্ডা করে পূর্ণতার ঠোঁটের কাছে ধরে বললো,

– হু, হা করো। খাইয়ে দেই। আবার কবে দেশে আসি, আবার কবে খাইয়ে দেই, কোনো কিছুই ঠিকনা। তাকিয়ে থেকো না, হা করো।

পূর্বিকার দিকে তাকিয়ে থাকতেই পূর্ণতা হা করে লোকমাটা মুখে পুড়লো। পূর্বিকা দ্বিতীয় লোকমাটা রেডি করতেই পূর্ণতার কৌতুহল মিটিয়ে বললো,

– গতকাল তুমি যখন সাবিহার ওখানে গেলে তার ঠিক আধাঘন্টা পরেই পূর্ব বাড়িতে ফিসেছে। ফিরেই আমাকে বলে তোমাকে কল দিয়ে চলে আসতে। কিন্তু তখন আয়মানের ঘটনা ও জানতো না। পরে একটা প্ল্যান বানায় তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে। আমাকে ওইভাবে কথা বলার জন্য পূব-ই বাধ্য করেছে। তুমিতো ওকেই চিনোই, ও কি পরিমাণে নাছোড়বান্দা আমার আর বলা লাগবেনা। আমি তোমাকে কল দিয়ে যখন কল কাটলাম ও সবাইকে গাড়ি করে এখানে পাঠিয়ে দিলো। একা-একা ওখানে রইলো। আল্লাহ্ তায়ালাই জানে ও তোমার সাথে কি করেছে। হঠাৎ ফোন করে পাগলের মতো বলতে লাগলো তুমি নাকি বেহুঁশ হয়ে গেছো। পরে ওকে বললাম মাথা ঠান্ডা করে তোমাকে চটপট এখানে নিয়ে আসতে। যতদূর তোমার অবস্থা দেখে বুঝলাম, তুমি অতিরিক্ত ভয় পেয়ে সেন্স হারিয়েছো। এদিকে প্রণয়ের হায়রে কি চিৎকার! কান্নার জন্য চোখ আর খুলেনা! আমি কোলে নেই, মা কোলে নেয়, আন্টি কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে, আঙ্কেল কোলে নিলে উল্টো ঘর কাঁপিয়ে কাঁদে। তুমি আর হুঁশে ফিরো না। পূর্ব ওই বৃষ্টির মধ্যে কোথা থেকে ডাক্তার খুজেঁ আনে, ও-ই ভালো জানে। পরে তোমার অবস্থা দেখে বলে তুমি দূর্বল হয়ে গেছো, রাতটুকু সম্পূর্ণ রেস্টে থাকতে বলে। প্রণয়ের কান্না দেখে কে! পূর্ব সারারাত প্রণয়কে কোলে নিয়ে পায়চারী করেছে। শেষে তিনটার দিকে একটু শান্ত হলে সাড়ে তিনটার দিকে ঘুমিয়ে যায়। আমাদের সবাইকে ঘুমাতে বলে বাকি রাতটা তোমার পাশেই কাটিয়ে দেয়। এখন সকালে কোথায় যে বেরুলো কাউকে বলে যায়নি। শুধু এটুকু জিজ্ঞেস করাতে বলে গেছে, বিকেলের দিকে ফিরবে। তুমি খাওয়া শেষ করো। খালি মুখে বসে থেকো না। তুমি যদি না খাও, তাহলে তোমার প্রণয় কিন্তু খাবার পাবেনা পূর্ণতা। নাও, হা করো।

প্রচুর প্রশ্নের আনাগোনা চলছিলো মনে। পূর্ব কেনো নতুন জায়গায় এসেছে এ নিয়েও বেশ শঙ্কিত। পূর্ণতা দ্বিতীয় লোকমাটা মুখে নিতেই প্রশ্নাত্মক কন্ঠে বলে উঠলো,

– নতুন জায়গায় সবাইকে আনলো কেন আপু? কারন কি? তুমি কি কিছু জানো? ও কি কোনো বিপদে পরেছে? নাকি এমনেই এখানে এনেছে?

পূর্বিকা ওর অস্থির অবস্থা দেখে খিলখিল করে হেসে ফেললো। খিচুড়ির সাথে ডিমভাজা মাখাতেই পূর্ণতার জন্য বললো,

– এই বাড়ির নাম দেখেছো? এই বাড়ির নামকরণ পূর্ব করেছে। ঘরের মধ্যে যা যা দেখতে পাচ্ছো সবই পূর্বের আদেশ মোতাবেক। আসবাবপত্র থেকে শুরু করে সবকিছুই ওর ইচ্ছামত। তোমার সকল প্রশ্নের জবাব ও দিবে। আমাকে চুপ থাকতে বলে গেছে। তুমি চিন্তা করো না পূর্ণতা। তুমি যেটা নিয়ে চিন্তায় আছো আমি অন্তত বুঝে গেছি। ও আর কখনো রাজনীতি করবেনা। তুমি এখন থেকে নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।

ঘড়িতে দুপুর বারোটা বেজে আট মিনিট। সকালের নাস্তা হিসেবে খিচুড়ি খাওয়া শেষ। পূর্ণতা শুধু অপেক্ষার জন্য সময় গুণতে লাগলো। এদিকে পূর্বের আসার কোনো খবর নেই। রাতে ফোনটা কোথায় ফেলেছে ঠিক করে মনে করতে পারছেনা। সাবিহাকে ফোন দেওয়া উচিত সেটাও সম্ভব হচ্ছেনা। খোঁজখবর নিতে পূর্বিকার ফোনটা চেয়ে নিলো সে। সাবিহার নাম্বারটা খোদেজার ফোন থেকে নিয়ে কল দিয়ে ফেললো। সাবিহার সাথে কিছুক্ষণ কথা সারতেই মনের স্বস্তিতে বাকি কাজে মনোযোগ দিলো পূর্ণতা।বাড়িতে ফিরে এসেছে আফিয়া এবং শুভ সংবাদ শুনে ইতিমধ্যে তিনি সাবিহার যত্ন নেওয়া শুরু করেছেন। আয়মানের কোনো খোঁজ না পেলেও এতোক্ষনের মধ্যে কাতার এয়ারপোর্টে অবতরণ হয়ে গেছে। কাতার থেকে ডিরেক্ট আমেরিকার ফ্লাইট ধরবে।

.

বাড়িটির নাম ‘ স্বপ্নমহল ‘। আজ নতুন বাড়িতে যেনো আনন্দমেলার সমাগম। বাড়ির সর্বত্র অতিথির আগমনে গমগম হয়ে আছে। এক সপ্তাহ আগে সবাইকে যে দাওয়াত হয়েছে সেটা আয়েশা ও পূর্বিকা ছাড়া কেউ জানতো না। আজ আবারও সেই উৎসবের ঢল নেমে এসেছে স্বপ্নমহলের বুকে। পূর্বের কেনা নতুন এই বাড়িটির সবটা জুড়ে আধুনিকতার ছোঁয়া। শৌখিন বেশে সাজানো হয়েছে বাড়ির প্রতিটি রুম। রাতের অন্ধকারে জ্বলে থাকবে বাড়ির সামনের বাগানটা। সবুজ ঘাসে পুরো বাগানটা ছেয়ে থাকবে। শীত আসলে ঘাসের মধ্যে শিশির জমে রবে। পূর্ব নিজেদের রুমটা বেশ দক্ষ হাতে সাজিয়েছে। নিজ হাতে প্রতিটি জিনিস যত্ন করে গুছিয়েছে। পূর্বিকার কাছে বলে গেছে পূর্ণতা যেনো ক্লোজেট থেকে সাদা শাড়ি বের করে। সেটা পরেই যেনো সবার সামনে আসে। আজ পবিত্র জুম্মার দিন বলে বাড়িতে সব পুরুষরা পান্ঞ্জাবী পরে এসেছে। কবির পূর্বের দেওয়া কালো পান্ঞ্জাবী পরেছে, পলাশকে পরানো হয়েছে ধূসর রঙের পান্ঞ্জাবী। আয়েশার গায়ে মাখন রঙের সুতির শাড়ি, যার পাড়টায় সোনালী সুতার কাজ। পূর্বিকা পরেছে সবুজ রঙের লাল পাড়বিশিষ্ট শিফনের শাড়ি, খোদেজা হামেশার মতো নীল রঙের জামদানী। আজ আনিশাও এসেছে পূর্বের দাওয়াত পেয়ে। সঙ্গে এসেছে আনিশার মেয়ে দিশা। দিহান এ যাত্রায় আসতে না পারলেও পূর্ণতাকে কল করে মনের দুঃখবিলাস করেছে। দুটো মাইক্রো করে পূর্ণতার খালারা এসেছে। সেই সাথে খালাতো ভাই-বোন ওয়াকিল, সুহাশ ও তানিয়া। খালা ও ভাইবোনদের আগমন দেখে একটুও খুশি হয়নি পূর্ণতা। চরম বিপদের বেলায় কেউ একটা কল পযর্ন্ত করেনি, অথচ দাওয়াত পেয়ে ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে এসেছে অতীত ভুলেই। এটাই হয়তো আত্মীয়তা। মনের সকল বিরূপ চিন্তা আজকের জন্য স্থগিত রাখলো পূর্ণতা। ভাবলো, পূর্ব যেহেতু সবাইকে দাওয়াত করেছে, তাই ডেকে এনে ঝাড়ু দেখানোর মানে হয়না। পূর্ণতা হাসিমুখে পুরোনো ঘটনায় মাটি চাপা দিয়ে সকলের সঙ্গে একত্র হলো। দুপুরের খাওয়া বেড়ে সবাইকে পেটপুড়ে খাওয়ালো এবং গল্পগুজবের জন্য পাঠিয়ে দিলো অতিথি রুমে।

পড়ন্ত বিকেলের সূর্যটা ধীরে-ধীরে অস্তমিত হলো। চারধার সন্ধ্যার আগমনে অন্ধকার হয়ে গেলো। নিচে সবাই আড্ডা দিচ্ছে। কিছুক্ষণ হলো পূর্ব বাড়িতে ফিরেছে। খাবারটা খেয়ে আর রুমে আসেনি পূর্ণতাকে দেখতে, সেখানে বসেই সবার সঙ্গে আড্ডা-গুজবে বসে গেছে। প্রণয়কে কোলে নিয়ে বিছানায় বসে আছে পূর্ণতা। চোখের দৃষ্টি জানালার দিকে স্থির। হঠাৎ দরজায় টোকার আওয়াজ হলে চোখ ঘুরিয়ে দেখলো আনিশা দাড়িয়ে আছে। বহুদিন, বহুমাস পর আজ আকস্মিকভাবেই দুজনের দেখা-সাক্ষাৎ হলো। পূর্ণতা হাসি দিয়ে ওকে ভেতরে আসতে বললো। আনিশা নিঃশব্দে ভেতরে এসে পূর্ণতার পাশে বিছানায় উঠে বসলো। কাধে দিশার ঘুমন্ত হেলে আছে দেখে পূর্ণতা একটা বালিশ এগিয়ে দিশাকে শুইয়ে দিতে বললো। প্রথম কথাটা আনিশাই বললো,

– কেমন আছিস?

পূর্ণতা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেসে দিলো। দিশার দিকে একপলক তাকিয়ে শেষে প্রণয়ের দিকে দৃষ্টি দিয়ে নিচু কন্ঠে বললো,

– এইতো আছি। ভালো আছি।

আনিশা একটু এগিয়ে প্রণয়কে দুহাত বারিয়ে কোলে নিলো। ঘুমন্ত প্রণয়ের কপালে ঘন করে চুমু খেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

– ছেলেটাকে মানুষের মতো মানুষ করবি পূর্ণতা। পূর্বের বেপরোয়া বানাস না। কোনোদিন খারাপ দিকে যেতে দিবি না, সবসময় আগলে-আগলে রাখবি।

কথাটুকু শেষ করতেই প্রণয়ের গালে চোখ বন্ধ করে চুমু খেলো আনিশা। একপ্রকার পালিয়ে যাওয়ার মতো দিশাকে নিয়ে সেখান থেকে উঠে পালালো। কান্না চলে এসেছিলো ওর। আজ পূর্ণতার জায়গায় ও-তো হতে পারতো? বাচ্চাটা ওর সন্তান হতে পারতো। পূর্বের স্ত্রী হিসেবে আদর-সমাদর-ভালোবাসা সবকিছুই ওর হতো, কিন্তু বিধির ইচ্ছায় সব হয়েছে অন্য কারোর।

.

অনেক প্রতীক্ষা-অপেক্ষার পর পূর্ব রুমে এলো। পূর্ণতা ক্লোজেটে খোদেজার দেওয়া নতুন পোশাকগুলো রাখছিলো। পেছন থেকে যে পূর্ব এগিয়ে আসছে সেটা বুঝতে পারেনি ও। পূর্ব চুপচাপ হেঁটে খোপার পিন সবসময়ের মতো টান মারলো। চমকে উঠে সমস্ত গা-সহ কেঁপে উঠলো পূর্ণতা। পেছন থেকে হাসির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিলো তখন। লজ্জায়-রাগে-অভিমানে পূর্ণতার চোখ টলমল করে উঠলো। পূর্বের দিকে চোখাচোখি দৃষ্টিতে ঘুরে দাড়াতেই পূর্ব তার হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকালো। হাত বারিয়ে যেই পূর্ণতার গাল স্পর্শ করবে ওমনেই পূর্ণতা অশ্রান্ত অশ্রু চোখে কর্কশ কন্ঠে চিল্লিয়ে উঠলো,

– লজ্জা করেনা এমন ইয়ার্কি করতে? বিবেকেও বাধেনা আমি কতটা ভয় পেতে পারি? ওয়াসিফ ভিলায় নকল রক্ত দিয়ে আমাকে জ্বালিয়েও তুমি শান্তি পাওনি, তাইনা? কেন এই রকম নাটক সাজাতে গিয়েছো? আমাকে ভয়ের মধ্যে রেখে তুমি মারাত্মক আনন্দ পাও না? সকাল থেকে তোমার খোঁজ নেই! কত্তগুলো কল করেছি, একটাও ধরোনি! কেনো আমার সাথে এগুলো করলে? তোমার লজ্জা তো…

আর কথাটুকু শেষ করতে পারলো না পূর্ণতা। অর্ধপূর্ণ বাক্যটা ওভাবেই রয়ে গেলো গলার ভেতরে। দুহাতে বুকের কাছে টেনে পূর্ব তার অধরপল্লব মিলিয়ে দিয়েছে। খুলে আসা পূর্ণতার চুলে নিজের শক্ত হাতটা ডুবিয়ে রেখেছে। চুলের চামড়ায় আঙ্গুলের চাপে অধরমায়ায় আবদ্ধ রেখেছে নিজের সাথে। জানালা থেকে দমকা হাওয়া আসছে তখন। পূর্ণতার নেত্রজোড়া ভিজে যাচ্ছিলো অশ্রান্ত বারিধারায়। পূর্বের মোহপূর্ণ বদ্ধ দৃষ্টির পানে চোখ খুলে পূর্ণতা তাকায়। আজ আবারও পুরোনো দিনগুলো মনে পরে যায় ওর। স্মৃতির পাতায় স্পষ্টরূপে ভাসছে সেই প্রথম চাহনির মূহুর্তগুলো। সেই ট্রেনযাত্রা, সেই গ্রামের সময়, সেই ঠান্ডা কন্ঠের ‘পূর্ণ’ ডাক, সেই জেলের নির্মম দৃশ্য। পূর্ণতা ওইমূহূর্তে ফুপিয়ে কেদেঁ উঠলো। আকড়ে ধরলো পূর্বের বুকের পান্ঞ্জাবী, চোখ কুঁচকে কেদেঁ দিলো স্মৃতির পাতা হাতড়ে। পূর্ব ওর ফোপানো কান্না দেখে তৎক্ষণাৎ ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে উঠলো। কান্নারত মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত করার উপায় না পেয়ে জাপটে ধরলো কাধ ও গলার মাঝে। অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো,

– আর কাঁদতে দিবো না, কেদোঁ না পূর্ণ। তুমি চুপ করো। ওরকম ফাজলামি আমি করবো না। আর কেদোঁ না। একটু থামো।

বলতে-বলতেই পূর্ব ওকে ছেড়ে দিয়ে পাগলের মতো সমস্ত মুখে উষ্ণ স্পর্শ করলো। হাতদুটো মুঠোয় নিয়ে আঙ্গুলের ফাঁকে আঙ্গুল গুঁজে দিলো। দৃষ্টি তুলে তাকালো পূর্ণতার ভেজা চোখে। কোমল চাহনি দিয়ে তাকিয়ে থাকতেই পূর্ণতা সরাসরি দৃষ্টি রাখলো পূর্বের চোখে। নির্মল হাসিতে পূর্ব আরেকবার ওর ললাট চুম্বন করলো ওর। নেত্রজোড়ার দিকে দৃষ্টি রেখে শান্ত সুরে বললো,

– আজকের পর কোনোদিন চোখে পানি আনবেনা পূর্ণ। তুমি জীবনে শুধু দুইবার কাদঁবে। তোমার মা হওয়ার খুশিতে আনন্দে কাদঁবে, আরেকবার কাদঁবে আমি পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার শোকে। এর আগপযর্ন্ত তুমি ভুলেও আমার সামনে কাঁদবেনা পূর্ণ। আমি তোমার কান্না সহ্য করতে পারিনা। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে তুমি ওয়াদা করো, আর কখনো তুমি কাঁদবেনা।

নাক টেনে অশ্রুচোখে ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে সায় দিতেই তৎক্ষণাৎ আবদ্ধ হয়ে গেলো পূর্বের বাহুযুগলের মধ্যে। শূন্য বুকের মাঝে পূর্ণ আবেশে পূর্ণতার মাথাটা আটকে রাখলো শক্ত করে। চুলের মাঝে অজস্র অধরকার্য সেরে পূর্ব বলে উঠলো দৃঢ় কন্ঠে,

– আমি এভাবেই তোমাকে বুকে চেপে রাখবো পূর্ণ। সহস্রাধিকবার তোমাকে চুমু খাবো। জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হিসেবে আমি আমরণ তোমায় আগলে রাখবো। শেষ নিশ্বাসের আগ পযর্ন্ত তোমায় ছেড়ে যাবো না পূর্ণ। যদি বেহায়া হতে হয়, হবো। আমি কাউকে পরোয়া করিনা শুধু এটুকু মনে রেখো।

.

বিমানবন্দরের বাইরে দাড়িয়ে আছে আয়মান। ভয়ে দুদফা ঢোক গিলে ফেললো সে। চোখের সামনে দুহাত ভাঁজ করে যে ব্যক্তি দাড়িয়ে আছে তাকে দেখে বুকটা ফুলস্পিডে ধড়ফড় করছে। তার চোখে যে রাগের তীক্ষ্ণতা দেখা যাচ্ছে সেটা মোটেই ভালো না। আয়মান লাগেজের হ্যান্ডেল আকঁড়ে সামনে এগুতে লাগলো। একপর্যায়ে মুখোমুখি হয়ে দাড়িয়ে পরলে বাতাসের বেগ ঠাস করে শব্দ হলো। আশেপাশের মানুষজন এদিকেই তাকিয়ে আছে। নিজেদের অবস্থা ভুলে গিয়ে এমন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে যেনো ফ্রিতে সিনেমা দেখছে এখানে। আয়মান গালে হাত দিয়ে সেইযে দৃষ্টি নিচু করলো, আর সেই দৃষ্টি তুলে তাকানোর জো খুজেঁ পেলো না। দৃষ্টি নত করেই সে কাঁচুমাচু কন্ঠে বললো,

– পূ-পূ-পূর্ব ভা-ভাই, আমি —-

অসহ্য অপরাধবোধে গলা আটকে এলো ওর। আয়মান গালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। মুখ দিয়ে কিছুই বেরুতে চাইছে না তখন। পূর্ব আশেপাশের অবস্থা দেখে আর কোনো তামাশা করতে চাইলো না। চুপচাপ হাত এগিয়ে তর্জনী তুলে গাড়িতে বসার ইশার করলো। আয়মান আদেশ মতো চুপচাপ সিটে বসে পরলে পূর্ব গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। হাইওয়ের সড়কে উঠে নিরবতার চ্ছিন্ন করে বললো,

– তোমাকে আমি ম্যাচিউর ভেবেছিলাম আয়মান। তুমি যে এমন নষ্টালজিক কাজ করবে আমি কল্পনাও করতে পারিনি।

আয়মান জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেলে বাইরের প্রকৃতি দেখছিলো। পূর্বের পাশ থেকে কথা শুনে চোখ ফিরিয়ে পূর্বের দিকে তাকালো। পূর্ব প্রচণ্ড রাগে টাইট হয়ে আছে। এই প্রথম পূর্বের হাত থাপ্পর খেয়েছে আয়মান। কখনো ভাবতেও পারেনি পূর্ব ওকে মানুষের সামনেই মারবে। আয়মান লজ্জা ও অপরাধ মিশ্রিত কন্ঠে পূর্বের দিকে তাকিয়ে বললো,

– আমাকে মাফ করে দিও পূর্ব ভাই।

উত্তরটা শুনেই তীব্র হুঙ্কারে চেঁচিয়ে উঠে পূর্ব। গাড়ির পকেট থেকে রিপোর্ট বের করে সোজা আয়মানের দিকে ছুঁড়ে মারে। আয়মান আরো মিইয়ে গিয়ে রিপোর্টটা হাতে নিলো। পুরোটা চেক করে উদাস কন্ঠে বললো,

– কবে পেয়েছে খবর?

পূর্ব আড়চোখে ওর দিকে তাকালো। কঠোর ভঙ্গিতে ক্রুদ্ধ সুরে বললো,

– বউ যে চোখের সামনে কিসের জন্য অসুস্থ ছিলো খেয়াল করোনি? প্রেগনেন্ট করার সময় হুঁশ-জ্ঞান ছিলো না? লজ্জা হওয়া উচিত তোমার! নিজের বউকে এভাবে একা ফেলে যাওয়ার চিন্তা কিভাবে করলে?

আয়মান সংকুচিত কন্ঠে জড়তার ভঙ্গিতে বললো,

– ও আমাকে ডাক্তারের জন্য বলেনাই পূর্ব ভাই। আমি কিভাবে এসব মেয়েলি ব্যাপার বুঝবো?

পূর্ব এ কথা শুনে মারাত্মক ক্ষেপে গিয়ে দাতঁ চিবিয়ে বললো,

– মূর্খ তুমি? মুখে আঙ্গুল দিয়ে পড়াশোনা করেছো? সব ছেলেরা এই ব্যাপার এক সেকেন্ডে বুঝে যায়, আর সেখানে তুমি আমার সাথে ঢঙ করছো?

আয়মান এবার আকুতির সুরে বলে উঠলো,
– দোহাই পূর্ব ভাই, আমি এইসব ব্যাপার বুঝিনা। ও যে কোন্ ধরনের অসুস্থতায় ছিলো আমি বুঝতে পারিনাই। তাছাড়া আমি ভাবছি হয়তো গ্যাসজাতীয় সমস্যা হইছে। এজন্য বমি করছে। আমি আরো পেটের সমস্যা ভেবে ফার্মেসী থেকে এমোডিস এনে দিলাম।

আয়মানের বোকামি দেখে গাল বাজিয়ে থাপড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে পূর্বের। যাকে এতোদিন বুদ্ধিমান ভেবে আগে-পিছে সব কথাই শেয়ার করেছে, সেই ব্যক্তি একটা ব ও-আকার বো, ক আ-কার কা। পূর্ব রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো,

– ফার্মেসী থেকে এমোডিস না এনে একটা টেস্ট-কিট এনে ধরিয়ে দিলেই পারতে। শুধু-শুধু কাহিনী করার তো মানে ছিলো না। যা করেছো খুবই জঘন্য কাজ করেছো।

আয়মান মাথা চুলকে আনমনে বলতে লাগলো,

– তখন প্যাঁচটা বুঝতে পারিনাই পূর্ব ভাই। আমি ফার্মেসীর বেটারে বললাম আমার বউ প্রচুর বমি করতেছে, একপাতা পেটের ঔষুধ দিতে। বেটা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো রোগীর কি মাথা ঘুরায় নাকি। আমি এ কথা শুনে বেটারে এক ধমক মাইরা বললাম, কুলির মতো বমি করতাছে, আর আপনে মিয়া চুদুরবুদুর মারান। আচ্ছা পূর্ব ভাই, দোষটা ওই বেটার না?

পূর্ব এমন আহাম্মক মার্কা কথা শুনে আয়মানের দিকে ক্ষিপ্ত দৃষ্টি ছুড়লো। আয়মান সেই দৃষ্টি দেখে তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরিয়ে জানালার বাইরে বললো, আহ্, আকাশটা কি সুন্দর। বৃষ্টি হইলে ভালো হয়।

সারা রাস্তায় আর কথা বললো না পূর্ব। গাড়িটা শিকদার বাড়ির সামনে থামিয়ে আয়মানকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। আয়মান লাগেজ টানতে-টানতে সামনি-সামনি পরলো আফিয়ার। আফিয়া রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে। পাশে দাড়িয়ে আছে সাবিহা, ওর চোখদুটো ফোলা-ফোলা। আনোয়ার কোনোকিছু না বলেই ঠাস করে গাল বাজিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন। এতোক্ষন ছেলের গালে পটাশ করে মারার জন্যই হয়তো অপেক্ষায় ছিলেন। পূর্ব এসব দৃশ্য শক্তমুখে দেখছিলো। শেষে আফিয়ার কাছে এসে নরম সুরে বললো,

– আন্টি মাথা ঠান্ডা করুন। এই মূহুর্তে রাগ ঝারবেন না। যার সাথে অন্যায়টা হয়েছে, সে এখানে কিছু বলুক। আপনি ভেতরে চলুন। আসুন আন্টি। আমাকে এক কাপ কফি বানিয়ে দিন।

আফিয়ার কাধ ধরে রান্নাঘরের দিকে যেতে-যেতেই পূর্ব চোখ দিয়ে আয়মানকে ইশারা করে গেলো। সেটা দেখে আয়মান ঈষৎ ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে সায় বোঝালো। লাগেজের হ্যান্ডেল ছেড়ে সাবিহার নতমুখের সামনে এলো আয়মান। আশেপাশে না দেখেই সোজা সাবিহার পেটে হাত রেখে দিলো। এমন কান্ডে শিউরে উঠে সাবিহা চোখ তুলে আয়মানের দিকে তাকালো। আয়মান অসহায় দৃষ্টিতে বিষণ্ণ সুরে বললো,

– আমি বুঝতে পারিনি সাবিহা। তুমি যে আমার কারনে অসুস্থ হয়েছো, আসলে ব্যাপারটা কনসিডার করা উচিত ছিলো। আমি একটা বোকার মতো কাজ করেছি।

সাবিহা পেটের উপর থেকে আয়মানের হাত সরিয়ে দিলে আয়মান ক্ষুদ্ধ হয়ে গেলো। দুহাতে কোমর ধরে কাছে টেনে বললো,

– বললাম না সরি? কানে শোনো না? আমি তো বুঝিনি তুমি প্রেগনেন্টের জন্য অসুস্থ হয়ে গেছো। আমাকে একবার বলছো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে? বলো নাই। যাইহোক তোমার এই গুনাহ্ মাফ! এখন কান্না-ফান্না বন্ধ করো। আমি এখন দেশেই আছি। বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছাও মাটি করে দিছি। এখন চলো, শুয়ে থাকবা।

সাবিহা লজ্জারুণ মুখে দৃষ্টি মেলাতে হিমশিম খাচ্ছিলো। তবুও আড় ভেঙ্গে বললো,

– আপনি যেখানে হাত দিছেন, সেখান থেকে হাত সরান। মা দেখে ফেলবে।

সাবিহার কথায় সৎবিৎ ফিরতেই দ্রুত কোমর থেকে হাত সরিয়ে ফেলরো আয়মান। কয়েক পা পিছিয়ে লাগেজ টেনে রুমে চলে আসলো সে। শিকদার বাড়ির তলব শেষে স্বপ্নমহলে ফিরলো পূর্ব। আয়মানকে কাতার এয়ারপোর্ট থেকে পরের ফ্লাইটে ফিরিয়ে এনে মনে মনে শান্তি অনুভব করলো সে। শেষমেশ এদিকের ঘটনা চুকে গেলো ভালোভাবে।

.

সাতশো ত্রিশ দিন পেরিয়ে গেলো পৃথিবীর আয়ু থেকে। দুটি বছর পিলপিল করে চলে গেলো চোখের পলকে। এখন আর আগের মতো কষ্টের দিন নেই। আগের মতো দুর্ভিক্ষ আসেনি। আগের মতো কষ্টের সাগরে কেউ হাবুডুবু খায়নি। কেউ চোখের অশ্রু ফেলে অপেক্ষার যাতনায় ধুকেধুকে মরেনি, কেউ নির্মমভাবে অত্যাচারের কাছে পরাধীন হয়ে থাকেনি। নতুনত্বের ভিড়ে নিজেকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রকাশ করেছে কেউ। রাজনীতির অঙ্গনে নয়, সমাজের মধ্যে এসেছে কেউ। ধৈর্য্য, শ্রম, বুদ্ধি দিয়ে দুই বছর পর ওয়াসিফ পূর্ব নিজের সব বিলিয়ে নতুন পরিচয়ে এগিয়ে এসেছে। ছেড়ে দিয়েছে পুরোনো নীতি, পুরোনো ধারা, পুরোনো সব চিন্তাভাবনা। আলিঙ্গন করেছে নিজের নতুন রূপ, নতুন ভূবন, নতুন কাজের সাক্ষ্যবার্তা। যাদের কাছে পরাজয় মেনে পা ধরে একদিন ক্ষমা চেয়েছিলো, আজ তারাই সেই আসনে বসে নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ছিনিয়ে নিয়েছে পূর্বের সেই পদচ্যুতির দল, অধিকার করেছে সেই সংসদ সদস্যপদ। পূর্ব নিজের বাবার অর্থসম্পদ একীভূত করে ব্যবসা দাড় করেছে। যতগুলো গাড়ি ছিলো তন্মধ্যে দুটো গাড়ি রেখে সব বিক্রি করে দিয়েছে। বাড়ি হিসেবে রেখেছে নিজের ‘ স্বপ্নমহল ‘ এবং বাবার আমলে তৈরী করা ‘ ওয়াসিফ ভিলা ‘। দাদাবাড়ি থেকে প্রাপ্ত সম্পত্তিটুকু সমাজের কল্যাণে মসজিদ তৈরিতে লাগিয়ে দিয়েছে। গতবছর সেই মসজিদের নামকরণটা দাদার নামানুসারে উদ্বোধন করেছে। সেই মসজিদে নিয়ম করেছে কোনো মুমিন যদি অভুক্ত অবস্থায় থাকে, তাদের জন্য চব্বিশ ঘন্টা আহারের ব্যবস্থা থাকবে। শুকনো পেটে কেউ আর সালাতে জন্য দাড়াবেনা। আল্লাহ্ পাকের ঘরে কেউ অনাহারে থাকবেনা। অর্থের প্রয়োজন হলে সেটার যথাযথ কারণ ব্যাখ্যা দিয়ে মসজিদের ইমাম থেকে অর্থ প্রয়োজনমতো অর্থ গ্রহণ করবে। সেই অর্থের সম্পূর্ণ জোগান পূর্বের কাছ থেকে আসবে। শহরের বুকে থাকা ওয়াসিফ ভিলা এখন আর শূন্য হিসেবে নেই। বৃদ্ধাশ্রম এবং অনাথাশ্রম এ দুটোকে মিলিয়ে করেছে ‘ কায়নাত ‘। যে সন্তানরা নিঃস্ব, দুঃস্থ, অসহায় বাবা-মা-দের গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় তাদের জন্য ওয়াসিফ ভিলার দ্বার আজীবনের জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করেছে পূর্ব। পৃথিবীতে বাবা-মায়ের ছায়া, মমতা, ভালোবাসা হারিয়ে যে শিশুরা অক্ষত, অনাহারে, অভুক্ত হয়ে বেঁচে থাকে তাদের জন্য বৃদ্ধাদের সঙ্গেই তৈরী করেছে কায়ানাত। সেখানে একদল অবহেলিত বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কাছে অভিভাবকহীন সন্তানরা বসবাস করবে ভালোবাসার ডোরে। কিছু ছেলেপিলে সেখান থেকে পাবে বাবা-মা, খালা, মাসি মামা, চাচা, ফুপু, পিসি। কেউ পাবে নাতী, নাতনী, কেউ পাবে ভাতিজা, কেউবা পাবে রক্তের সম্পকহীন সন্তান। কায়নাতে সবাইকে দেখার জন্য নিজেদের চাকরগুলো ছেড়ে এসেছে পূর্ব। সার্বক্ষণিক তাদের দেখাশোনা, খাওয়া-দাওয়া, প্রয়োজনমতো শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থাও করে দিয়েছে। স্বপ্নমহলে শুধু নূরানী এবং ময়না থাকে। তারাই সেবার জন্য সকলের জন্য স্বপ্নমহলে নিয়োজিত।

নিজের বেকারত্বের অভিশাপ ঘুচাতে গিয়ে পূর্ব ব্যবসায় নামতে বাধ্য হয়। নানা বাধার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও হাল ছাড়েনা সে। প্রথম আটমাস নিস্ফল অবস্থায় থাকার পর সফলতার শীর্ষে পৌঁছার মতো মনোবল ফিরে পায় সে। লেগে পরে ব্যবসার দক্ষ নীতিতত্ত্বে। কবিরের সহায়তায় একের-পর-এক ব্যবসায়িক ডিলে নিজের বুদ্ধির সাহায্যে কর্মদক্ষতা প্রদর্শন করে। এগিয়ে যায় কর্মক্ষেত্রে। যুবক, পুরুষের পাশাপাশি মহিলাদের জন্য আলাদা করে সেক্টর খুলে। সেখানে আলাদা ডিপার্টমেন্ট হওয়ার ফলে বৈষম্যমূলক আচরণ সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য এবং নির্যাতনের শিকারও কোনোভাবে হওয়ার নেই। পুরো পেশামূলক কাজে নারী-পুরুষের একীভূত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলেও সেক্টর আলাদা হওয়ার কারনে সকলের চোখে অনন্য হয়ে উঠে সেটা। পূর্ব মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতো, পুরুষরা কর্মক্ষেত্রে ‘ বল ও শ্রম ‘ দিলে নারীরা ‘ বুদ্ধি ও মেধা ‘ দেওয়ার উপর্যুক্ত। একদল বুদ্ধির কাছে হেরে গেলে আরেকদল বুদ্ধি দিয়ে তাদের উঠিয়ে দিতো, আবার একদল বলের কাছে হেরে অপরদল বল দিয়ে এগিয়ে দিতো। সমান-সমান ভারসাম্য রাখার নীতিতে পূর্ব খুব কম সময়ে ব্যাপক সফলতা অর্জন করে দেখায়। একপর্যায়ে দেখা যায়, বিদেশের ঘাঁটিতেও দেশীয় প্রতিষ্ঠান গেড়ে দেওয়া সম্ভব। পূর্ব সেই দিক বিবেচনা করে বিদেশের মাটিতে বিভিন্ন ব্রান্ঞ্চ প্রতিষ্ঠা করে এবং নিজ দেশ থেকে দক্ষ শ্রমিকদের সেখানে কাজে লাগিয়ে নতুন দ্বার উন্মোচন করে। টানা দুটো দেশে একই নীতিতে দুটো ব্রান্ঞ্চ স্থাপন করে ফেললে শুরু যায় দেশীয় পণ্যের রপ্তানি। সকলের নজরে এসে যায় ওয়াসিফ গ্রুপের নামখ্যাতি।

প্রণয় এখন দৌড়াতে পারে ভালোই। দুবছরের মাথায় নিজেকে দারুণ চন্ঞ্চলতার পরিচয় দিয়েছে। আধো-আধো কন্ঠে ‘ বাবা ‘ ডাকটা সবার আগে শিখেছে, এরপর শিখেছে ‘ মা ‘। আদরে-সাদরে প্রণয় এখন দুই বছরের বাচ্চা। আয়মানের ঘরে চলে এসেছে মেয়ে সন্তান। পূর্ণতার জ্বালাতনে আয়মান এখন বিয়ের মত ঘুরিয়ে ফেলেছে। প্রণয়ের মতো দুষ্টু ছেলের কাছে নিজের আদরের মেয়েকে অবশ্যই দিবেনা সে। যদি প্রণয় বড় হয়ে সভ্য, শান্ত হওয়া শিখে, তাহলে সেটা পরে বিবেচনা করা যাবে। আয়মান ও পূর্ণতার এসব অহেতুক কথা শুনে পূর্ব শুধু হাসে। ছুটির দিনে ছেলেকে নিয়ে ঘুরতে যায়, অফিসে আসে, সবার দেখা করিয়ে আবার কায়নাতে চলে যায়। সেখানে বয়োবৃদ্ধদের সাথে রঙিন মূহুর্ত কাটিয়ে স্বপ্নমহলে ফিরে আসে। মাঝে-মাঝে একা বেরিয়ে একদিনের জন্য নিরুদ্দেশ হয় পূর্ব। কোথায় যায়, কেনো যায় আজও পূর্ণতা সেই কারণ উদঘাটন করতে পারেনি। কিন্তু না পেরেও কারন জানার জন্য কখনো জোর জবরদস্তি করেনি। পূর্ব ভোরবেলায় বের হয় সেদিন। সবার আগে শ্রেয়ার কবরস্থান দেখে আসে। নিরব সময় কাটায়, কবরের চারপাশে ফুলের গাছগুলোতে পানি দেয়, আবার নতুন কিছু গাছও লাগিয়ে আসে। সেখান থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে আসে আরেক জায়গায়। শ্মশানের ঠিক কাছের নদীতে। নদীর দিকে তাকিয়ে থেকে ঝাপসা হয়ে আসে চোখ। শার্টের হাতায় অনবরত চোখ মুছতেই সেটা ভিজে যায়। মনে পরে কৈলেশ নেই। দাহ করার পর ছাইয়ের অস্তিত্বটুকু এ নদীতেই ফেলে দেওয়া হয়। এ নদীর দিকে তাকালেই মনে পরে কেউ যেনো ডাকছে, ‘ পূর্বদা? ‘। বুকটা কান্নায় চিড়ে পূর্বের। মাঝেমাঝে সহ্য করতে না পেরে মাটিতে হাটুগেড়ে হাউমাউ করে কেদেঁ উঠে। পূর্বের বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে কৈলেশকে ওরা মেরে ফেলেছে। জেলে যাওয়ার দ্বিতীয় দিন থেকে কৈলেশ নিখোঁজ ছিলো, সবাই বলতো ও ধোকা দিয়েছে পূর্বকে। শুধু পূর্বের অন্তরটাই এ কথা বিশ্বাস করতে পারেনি। জেল থেকে বেরিয়ে চারমাসের মধ্যে কৈলেশের খবরটা সে জানতে পেরেছে। যেই খবর আজও সকলের কাছে অজানা। কৈলেশের বিধবা মা এবং বিবাহিত বোন ছাড়া কৈলেশের নির্মম মৃত্যুর কথা কেউ জানে না। এরপর গাড়ি দ্বিতীয় এবং শেষ দিকটার দিকে যায়। টঙ্গীর কাছাকাছি জায়গায় গিয়ে সবুজের পরিবারের সাথে দেখা করে আসে। কিছুক্ষণ সবুজের কথা মনে করে পূর্বকে জড়িয়ে ধরে ওর মা কাঁদে। পূর্ব নিজের অশ্রুমোচন করে পাড়ি দেয় সবুজের কবরের দিকে। ডেবে যাওয়ার মাটির উপর দুহাত রেখে অশ্রু ফেলে। নির্বাচনের ওই মূহুর্তগুলো বেশ মনে পরে। কতদিন একসাথে দুপুরের খাবার খেয়েছে, কতদিন একসাথে কেটেছে সেই সময়। অথচ আজ সবুজ নেই, মাটিতে আজীবনের জন্য শয্যা গ্রহণ করেছে সে। পূর্ব সেদিনের মতো তিনটে পৃথিবী ত্যাগী মানুষের সাথে গোপন সাক্ষাৎ করে। আবার ফিরে আসে নিজের নীড়ের ভিড়ে স্বপ্নমহলে। ফোলা-ফোলা চোখদুটো ঢাকার জন্য রাত তিনটার দিকে বাড়িতে ঢুকে। ছেলেকে মায়ের কাছে রেখে এসে পূর্ণতার ঠোঁটের কাছে কপাল ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পরে। পূর্ণতার মনটা সবসময় রহস্য নিয়ে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু পারেনা, পূর্বের সারা মুখে চুমু খায়। দীর্ঘক্ষন সময় নিয়ে অধরযুগল আকঁড়ে রাখে। চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে ঘুমের জন্য চোখ বন্ধ করতে বলে। পূর্বের মধ্যে কিছু একান্ত ব্যাপার আজীবন একান্তরূপেই রাখতে সাহায্য করে, কোনোদিন জানার জন্য জোর করেনা পূর্ণতা।

.

সকালে টিভির পর্দায় খবর দেখাটা যেনো নিত্যকর্ম। সোফায় বসে কফির মগে চুমুক দিচ্ছিলো পূর্ব, ঠিক ওই মূহুর্তেই পূর্ণতা বমির তেঁতো ঢেকুর তুলে ওয়াশরুমে দৌড়ে গেলে আর কফিটুকু খেতে পারলো না পূর্ব। চকিত ভঙ্গিতে উঠে দাড়াতেই তৎক্ষণাৎ ওর পা ও চোখ আটকে গেলো। টিভির দিকে দুই চোখ স্থির রাখতেই শুনতে পেলো, উপ-নির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ইমতিয়াজ উদ্দিনের একমাত্র ছেলে গতকাল সন্ধ্যায় ব্রেন-স্ট্রোকে ইন্তেকাল করেছে। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মরহুমের জানাজা বাদ জোহরের পর ঢাকার কেন্দ্রীয় মসজিদে অনুষ্ঠিত হবে। দীর্ঘদিন ধরে ব্রেনের অসুস্থতায় ভুগছিলো এবং বিদেশে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গিয়েছে।

টিভির পর্দায় এটুকু নিউজ শুনে পূর্বের গা কাটা দিয়ে উঠলো। প্রকৃতির কি ভয়ানক বিচার! কি ভয়াবহ প্রতিশোধ! দুনিয়ার মানুষ ন্যায় বিচার করতে না পারলে সমগ্র বিশ্বের মালিক সেই বিচার করতে সর্মথ্য। পূর্বের অন্তর আল্লাহ্ পাকের বিচার দেখে শীতল হয়ে গেলো। মনেমনে উচ্চারণ করলো, আল্লাহ্ ছাড় দেন, ছেড়ে দেন না।

অনেকক্ষন পর ওয়াশরুমের দরজা খুলে বের হলো পূর্ণতা। শাড়ির আচঁলে মুখটা মুছতে-মুছতে হঠাৎ পূর্বের দিকে নজর পরতেই লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেললো। পূর্ব কয়েক পা এগিয়ে মাথা একটু নিচে ঝুঁকিয়ে হাসি দিয়ে বললো,

– বাবা হচ্ছি?

পূর্ণতা লজ্জায় আর কথা বলতে পারলো না। দৃষ্টি নিচু করে ফ্লোরে তাকিয়ে রইলো। পূর্ব ওর অবস্থা দেখে গাঢ় করে হেসে দিয়ে জাপটে ধরে বললো,

– তৃতীয়বারের জন্য আবারও ধন্যবাদ পূর্ণতা কবির।

—- সমাপ্ত ।

#পাঠ_সংক্ষেপ : দূর্ঘটনা থেকে আকস্মিকভাবে সাক্ষাৎ ঘটে পূর্ব-পূর্ণতার। পথে নানা কাহিনীবৃত্ত হলেও দূরত্ব থেকে যেনো ভালোবাসার সৃষ্টি। প্রকৃতি যেনো বারবার সেই ভালোবাসার পরীক্ষা নিতে ব্যস্ত ছিলো। বন্ধুত্বের ধোকা, পারিবারিক ঝগড়া, রাজনীতির ধূর্ততা, ভাগ্যের কঠোরতা, সবকিছুর উর্ধ্বে ছিলো তাদের ভালোবাসার প্রগাঢ়তা। বারবার পরাজিত হয়েছে নিয়তির কাছে, তবুও মাথানত করেছে নিজেদের ভালোবাসা এবং বিশ্বাসের দ্বারে। সমাজ বা কিছু মানুষের কাছে বেহায়া আখ্যা পাওয়া পূর্ণতা নিজেকে ইতিবাচক বেহায়ারূপেই পরিচয় দিয়েছে সবার নিকট। অপরদিকে কখনো কঠোর, কখনো নরম, কখনো রাগের পরিচয় দিয়ে রাশভারী পূর্ব নিজেকে খুলে দিয়েছে অন্যরূপে, অন্যবেশে, অন্যমাত্রায়। মিথ্যার কাছে হার না মানা ব্যক্তি, মৃত্যুকেও যে আলিঙ্গন করতে চেয়েছে, সেই ব্যক্তি আপনজনকে রক্ষার জন্য মিথ্যার কাছে মাথা ঠেকিয়ে ধূলো গ্রহণ করতে কুন্ঠা বোধ করেনি। ভেঙ্গে ফেলেছে নিজের শক্ত খোলস, চুরমার করে দিয়েছে নিজের সত্যপ্রিয় সাধনা। কিন্তু জীবনের কাছে হার মানেনি সে। আবার নিজেকে তিলতিল করে গড়ে তুলেছে। অর্জন করেছে নিজের হারানো সবকিছু, ছিনিয়ে নিয়েছে নিজের আর্দশ-চেতনা, চলতে শিখেছে সমাজের বুকে সমাজের নীতি মেনে। পৃথিবীর আদালতে হেরে যাওয়া বিচার, জাহানের মালিক সেটা সুষ্ঠুভাবে করে দিয়েছে সকলের অগোচরে। দেখিয়ে, বুঝিয়ে, প্রমান করে দিয়েছে এ কথা সত্য! চরম সত্য, প্রকৃতিতে সত্যিই ‘ রিভেন্ঞ্জ অফ নেচার ‘ বলতে এখনো অবশিষ্ট আছে।

.

#উপন্যাস_তোকে_ঘিরে
#FABIYAH_MOMO
#ফাবিয়াহ্_মম