তোমাতে আমাতে ২ অন্তিম পর্ব

0
1345

#তোমাতে_আমাতে ২
অন্তিম পর্ব
লেখা আশিকা জামান

আনমনে হাটতে হাটতে ঠিক কোথায় চলে এসেছি একদম খেয়ালই ছিলো না। আমি পার্কের খোলা রাস্তা ধরে হেটে চলেছি। সাত সকালে জগিং করতে অনেককেই দেখা যাচ্ছে। রাস্তা ধরে অনেকেই আপন গতিতে দৌড়াচ্ছে। ঠিক এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে আমার মাথাটা টলছে। এক্ষুনি পড়ে যাবো যাবো ভাব। চারপাশটা ঝাপসা হয়ে কখন যেন চোখের কোণে আধাঁর নামিয়ে দিলো। কেবলই মনে হচ্ছিলো গাঢ় আধাঁর আমাকে দুই হাত দিয়ে আষ্টৃপৃষ্টে বেধে রেখেছ যেন এখান থেকে কোন মুক্তি নেই।

আঁধার আমাকে মুক্তি দিয়েছিলো। হ্যাঁ ঝলমলে আলোর ঝলকানিতে আমার চোখ একরকম ঝলসে উঠছিলো। আমি হকচকিয়ে কিং সাইজের বিশাল বেডে উঠে বসি। চকিতে তাকিয়ে চারপাশটা দেখতে থাকি। এ মোটেই আমার চেনা পরিবেশ নয়, আমি শিউরে উঠলাম। মাথায় প্রচন্ড পেইন হচ্ছিলো৷ অজান্তেই কপালে হাত চলে যায়। মাথায় ব্যান্ডেজ করা! কিছু মনে করতে পারছি না কোথা থেকে কি হয়ে গেলো?
আমি উঠতে চাইলাম কিন্তু পায়ের শব্দে পিছিয়ে গেলাম। শব্দটা আমার দিকেই আসছিলো।
আমি চমকে উঠা চোখে তাকাই এক শ্বেতাঙ্গ বিদেশিনী আমার সামনে দাড়ানো। তবে বয়সটা আন্দাজ করা খুব কঠিন ব্যাপার! মধ্যবয়স্কা হিসেবে চালিয়ে দিলেও কেমন যেন খুঁতখুতেঁ লাগছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো উনাকে আমার চেনা মনে হচ্ছে কিন্তু কোথায় দেখেছি মনে করতে পাচ্ছি না।
” হাউ আর ইউ ইয়াং লেডি। ”
” আ’ম নাও ওকে বাট ইউ….?”
” আমি ডক্টর কুরী ফ্রাঙ্কেল। নাউ অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে আছি। এখানে একটা রিসার্চ এর কাজে এসেছি। কিন্তু তুমি সাডেনলি রাস্তায় পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে। এবং মাথায় হালকা ইনজুরি হয়েছিলো।”
” আপনি বাংলা জানেন।”
শ্বেতাঙ্গ মহিলা ম্লান হেসে বললো,
” ইয়া। আই নো! বাট তুমি এভাবে রাস্তায় একা একা কেন হাটছিলে? ”
আমি চুপ করে থাকলাম।
” ওকে নাউ ইউ গিভ মি ইউর এড্রেস এন্ড ফোন নম্বর।”
” না আমি একা যেতে পারব।”
” আর ইউ শিউর! ”
” হ্যা শিউর। শিউর।”
” বাট আমিতো তোমাকে একা ছাড়বো না। আফটার অল ইউ আর এ প্রেগন্যান্ট উইমেন, এরকম ব্যাস্ত হাইওয়েতে তোমাকে একা ছাড়া, সো মাচ রিস্কি!”
আমি তখনো এড্রেস দিতে অসম্মতি জানাই ।
” ওকে নো প্রবলেম। তুমি টাইম নাও দ্যান আমাকে এড্রেসটা দাও কেমন।” মহিলা মিষ্টি হেসে উঠে গেলেন সাথে করে এক বাটি স্যুপ নিয়ে ফিরলেন।
” আই থিংক ইউ আর সো মাচ হাংগরি! প্লিজ। ”
আমি গোগ্রাসে গিলতে থাকলাম সত্যিই খিদে পেয়েছিলো।
আমি লক্ষ্য করলাম উনি বেশ স্বাভাবিক ভাবেই আমার সাথেই মিশছেন যেন আমি উনার পূর্ব পরিচিত।
উনার সাথে গোটা একদিন কাটালাম। পশ্চিমা দেশের মানুষরা অজানা অচেনা মানুষকে মুহুর্তেই আপন করে নিতে পারে সত্যিই ভাবি নি।
উনার কথায় ভাবছিলাম। উনি আমাকে চমকে দিয়ে একপর্যায়ে বললেন,
” আই থিংক, তুমি তোমার স্বামীর সাথে অভিমান করে কাউকে কিছু না বলে চলে এসেছো?”
আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম।
” ইউ নো রাগ, অভিমান, মিথ্যা অহং কাউকে সুখী করতে পারে না বরং সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে নিঃস্ব করে দেয়। যাকে ভালোবাসো শুধু তাকে নয় তার প্রত্যেকটা কার্যকলাপকে ভালোবাসতে হবে। তাকে বুঝতে হবে যথার্থ সময় নিয়ে ধৈর্য্য সহকারে। তবেই দেখতে পাবে চারপাশটা কেমন সুখের ভূবনে পরিণত হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি তোমার দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন করতে না পারছো ততক্ষণ কিন্তু সুখী হতে পারবে না। তোমার সুখী হওয়াটা কিন্তু তোমার উপরই নির্ভর করছে। ”
” আপনি নিশ্চয়ই আপনার ব্যাক্তিগত জীবনে খুব হ্যাপি। আপনার কথায় সত্যিই লজিক আছে!”
উনি ম্লান হেসে বললেন,
” আমার সুখী মুখটার পিছনে কিন্তু এক দুঃসহ অতীত আছে! এতোক্ষণ যা যা বললাম সব ঠেকে শিখেছি। কিন্তু বুঝেও কোন লাভ হয়নি কারন ততোদিনে সময় অনেক দূরে হারিয়ে গেছে।” উনি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে আবার বললেন,
“জানো এখানে একটা রিসার্চ এর কাজে আসলেও আমার ছেলেটাকে দেখার বড্ড অবাধ্য ইচ্ছে হচ্ছে! জানি ওর সামনে দাড়ানো সৎসাহস বা অধিকার কোনটাই আমার নেই।তবুও ইচ্ছেটা,বড্ড অবাধ্য।”

উনি উনার পার্স থেকে একটা ছবি বের করে আমাকে দেখাতে চাইলেন। আমার মাথা টলছিলো কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না। আমি ঘোর লাগা চোখে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম এই ছবিটা কোথায় পেলেন? কে এই বাচ্চাটা? আপনার সাথে কি সম্পর্ক?
ইমনের ২ কি তিন মাস বয়সের ছবি যার ব্যাগগ্রাউন্ডটা বিদেশি আদলে। আমার সেদিনও খটকা লেগেছিলো আজঁও লাগছে। মামনিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ” মামনি ইমনের ডেলিভারিটা কি বিদেশে হয়েছিলো? তোমরা কি আগে বিদেশে থাকতে?”
মামনি বিরক্তি নিয়ে ছবিটা কেড়ে নিয়ে বলেছিলো, ” এই ছবিটা এখানে কি করে এলো?”
মামনির বিরক্তির আতিশয্যে সেদিন আর কিছুই বলে উঠতে পারিনি। তবে এই বিদেশিনীকে এখন আমার মনে পড়েছে। সেদিন গ্রামের বাড়িতে একটা ছবির এলবাম খুঁজে পেয়েছিলাম। পরে দেখব বলে ওটা আমি আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম। ওখানের একটা ছবিতে আমার চোখ আটকে গিয়েছিলো। বাবার পাশে এক বিদেশি মহিলা চোখে মুখে একরাশ খুশির ঝিলক। ভালোভাবে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম এ সেই! কিছু অজানা আশঙ্কায় বিদ্যুৎ এর চমকে উঠার ঠিক আগ মুহুর্তে আমি দ্বিগুন চমকালাম
” আদৃতা, এ আমার ছেলে! তবে আমি ওকে হারিয়ে ফেলেছি চিরতরে। আমার নিজের ভুলে আজঁ আমি বড্ড একা।”
আমি হতবাক হয়ে উনার কথা শুনতে লাগলাম।
কিছুক্ষন থুম ধরে বসে থেকে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনার ছেলে কোথায় আছে জানতে ইচ্ছে করেনা? কিছু মনে না করলে বলবেন কিভাবে হারিয়ে ফেলেছেন।”
” ইচ্ছে করে হারিয়ে ফেলেছি। ইলিয়াস আর আমার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে প্রথম দেখা হয়। একসময় ভালোবেসে ফেলি আবেগের তাড়নায়। এরপর ও দেশে ফিরে আমার কথা ফ্যামিলিতে জানায়।ওর বাবা অস্বিকৃতি জানায় আমাকে মেনে নিতে। উনি দেশে নীলা নামের এক মেয়ের সাথে ওর বিয়ে দেয়। ইলিয়াস মেয়েটাকে মানতে পারেনি তবে মেয়েটা ওকে খুব ভালোবাসতো। এরপর ও আবার অস্ট্রেলিয়াতে ফিরে আসে। আবেগটা এতোটাই গাঢ় ছিলো আমরা বিয়ে করে নেই৷ এরপর প্রেগন্যান্ট! এটাই ছিলো তখনকার প্রথম ভুল। পড়াশোনা আনকম্পলিট অনেক গ্যাপ পড়ে যায়, সবকিছু মিলিয়ে ডিপ্রেশনে ছিলাম। একপর্যায়ে ইলিয়াসকে আমার অসহ্য লাগতো। ও ওর মিডিলক্লাস এথিক্স,গুলো আমার উপর এপ্লাই করতে চাইতো যেগুলো আমার কাছে মিনিংলেস মনে হতো। পদে পদে আমরা বুঝেছিলাম আবেগে একটা খুব মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি। আমাদের নিজস্ব কালচার, মুল্যবোধ আমাদের সম্পর্কে ফাটল ধরালো। পোস্টপার্টাম প্রেগনেন্সিতে ভুগতে থাকলাম। নিউ বর্ন বেবি এন্ড হিজ ফাদার দুজনকেই আমার বিরক্ত লাগতো। তাছাড়া একরাশ অস্বস্তি আর অনিহা নিয়ে কোন সম্পর্ক কন্টিনিউ করার ইতিহাস আমাদের পাশ্চাত্য দেশে বিরল। আমিও পারিনি। দুজনেই মিউচুয়াল ডিভোর্স নিয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাচঁলাম। এরপর আবার চেষ্টা করেছিলাম সুখী হওয়ার। কিন্তু পারিনি আমার সেকেন্ড হাজব্যান্ড এর থেকে আলাদা আছি ৯ ইয়ার্স। জান আজঁ আমি বড্ড একা। ”
উনি অঝোরে কাদঁতে লাগলেন। আমি জানিনা কিভাবে শান্তনা দেওয়া উচিৎ কেননা আমি নিজেই তখন শকড! ইমন এই সত্যিটা জানতে পারলে মরেই যাবে । আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারছিনা।
” আচ্ছা আমি যদি আপনাকে আপনার ছেলের সাথে দেখা করিয়ে দেই! আপনি কি রাজি হবেন।”
” তোমার কি মনে হয় আমি চাইলে ওর সাথে দেখা করতে পারতাম না! পারতাম। কিন্তু কোন মুখে দাড়াতাম। আমিতো কোন দায়িত্বই পালন করিনি৷ আমি কখনোই ওর মম হওয়ার যোগ্যতা রাখি না।
তবে বড্ড সাধ জাগে লুকিয়ে যদি একবার দেখতে পারতাম। কতোটা বড় হয়েছে? কেমন দেখতে হয়েছে ? কেমন কাটছে দিনকাল, তাহলে হয়তো মরেও শান্তি পেতাম। তুমি সত্যিই পারবে? চেনো ওকে চেনো?”
চোখে মুখে কৌতুহলের ছাপ স্পষ্ট।

আমি আমার ব্যাগ থেকে ফোন বের করতে গিয়ে সেদিনের পুরোনো অ্যালবাম দেখতে পাই। আমি
অ্যালবাম থেকে ছবিটা দ্রুত বের করে কুরীকে দেখাই। উনি ছুঁ মেরে ছবিটে কেড়ে নিয়ে বললেন, ” কোথায় পেলে এই ছবি।”
আমি উনাকে ওই মুহূর্তে সবটা বললাম জানিনা কেন বললাম। আমার মনে হয়েছিলো উনার জানা উচিৎ ইমনের ও সবটা জানা উচিৎ। আর যাই হোক অপ্রিয় হলেও সত্যিটা সত্যিই হয়।
*****
ফোনটা অন করতেই অসংখ্য মিসড কল এলার্ট এলো। সবাই হয়তো হণ্যে হয়ে আমাকে খুঁজছিলো । ইমনের ফোন এলো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই। তারমানে ও এতোক্ষণ কেবল আমারই নম্বর ডায়াল করছিলো।
” আদি, তুমি কোথায়? একবার বলো কোথায় আছো? প্লিজ আমার ভুলের জন্য এরকম শাস্তি দিও না। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না। প্লিজ এবারের মত ক্ষমা করো। এতোটা অভিমানী হয়ো না।আমার প্রকাশভঙ্গিটা হয়তো সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় কিন্তু অনুভূতির শিকড়টা কিন্তু তোমাতেই নিহিত….”
ইমনের কথাগুলো কেবলই কান্নার উদ্রেক ঘটালো। কিছু বলতে পারলাম না কেবল
আমি ইমনকে লোকেশনটা মেসেজ করে দিয়ে অপেক্ষায় থাকি।
অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সবাই আসে আমার সমস্ত চিন্তাভাবনাকে ধূলায় মিশিয়ে দিয়ে। শুধু মাত্র ইমনকেই আমি প্রিফার করেছিলাম, এখন মামনি, বাবাই, ডঃ কুরীকে কি কিরে সামলাবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
মামনি বাবাই দুজনেই ডঃ কুরীকে দেখে বিস্মিত বনে যায়। ডঃ কুরী ইমনের দিকে কেমন মমতাময়ী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ তবুও জড়িয়ে ধরার মতো ভুল করলো না৷ নিজেদের ইমোশন সংযত রাখতে পশ্চিমাদের
কেবল ইমনই দেখামাত্রই আমাকে জড়িয়ে ধরলো। নীল চোখে সেই ঘন কালো বিষাদের ছায়া, এক পৃথিবীর বিনিময়েও সেই বিষাদ আমার কাম্য নয়। অজান্তেই আমার কাধঁ ভিজে যেতে থাকলো। এ কান্না আমি মরে গেলেও দেখতে পারিনা। ঘরভর্তি মানুষের মাঝেও নিজেকে ইমনের নিভৃতচারিনী ভাবতে থাকলাম। চারপাশ শূন্য কেউ নই শুধু দুজন দুজনার।
” আদি, তুমি মাথায় আঘাত পেয়েছো? কিভাবে পেলে? কতটুকু ব্যাথা পেয়েছো? খুব বেশি কষ্ট পেয়েছো? বলনা! ও আদি বলনা।” ইমন মুহুর্তেই অস্থির হয়ে উঠে।
” যতোটা কষ্ট তোমার অবহেলায় পেয়েছি তার কাছে এ ব্যাথা তুচ্ছ। এ কোন ব্যাথা নয় কেবল বাহিরে দেখা যাচ্ছে কিন্তু অভ্যন্তরে ব্যাথার আগুন দাউ দাউ করে ঝলছে। ইশ এ যদি দেখানো যেত তবে তোমার অস্থির থেকে অস্থিরতর মুখটা আমার ভেতরটা তোলপাড় করে দিত।” আমি ম্লান হেসে কথাগুলো বললাম।
” আ’ম সরি। এগেইন সরি। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেলো। আমি মানসিকভাবে ডিস্টার্ব থাকায় সম্পূর্ণ রাগটাই তোমার উপর পড়েছে। আই থিংক আমি আমার স্বপ্নগুলো নিয়ে একটা নিজের মত গন্ডি তৈরী করে ফেলেছিলাম, যেখানে তুমি ছিলে বৃত্তের বাইরে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম তুমিহীন সমস্ত স্বপ্নগুলো বাস্তবতার অতলে হারিয়ে যাবে। এটাই স্বাভাবিক প্রকৃতি এটাই বলে। তুমি ছাড়া আমি যে অসম্পূর্ন এই চিরন্তন সত্যটাকে অবহেলা করেছিলাম! কি করে করেছিলাম? কেন করলাম।”
ইমন নিজের মাথার চুল নিজেই টানতে লাগলো।
আমি ওকে জোর করে থামাই।
” ইমন থামো, এখানে হয়তো তোমার তেমন দোষ নেই, কেননা পরিস্থিতি তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে৷ আর তুমিও নিজের যুক্তি দিয়ে ভাবোনি পরিস্থিতির তালে তাল মিলিয়েছো। জীবনে প্রত্যেকটা সম্পর্ক একসময় না একসময় পরিস্থিতির কাছে হেরে যায়! টিকেতো থাকে তারাই যারা নিজেরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রন করতে পারে। প্লিজ তুমি আর কষ্ট পেয়োনা।”
নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলরে চারপাশটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম।
বাবার উচ্চ্বস্বরে মামনির নাম ধরে ডাক শোনে দুজনেই চমকে উঠি। মামনি সেন্সলেস হয়ে গেছে।কিছুতেই সেন্স ফিরছিলো না। কুরী ফ্রাঙ্কেল ও প্রায় দিশোহারা অবস্থায় পড়ে যায়।
পুরো দুইদিন হসপিটালে কাটানোর পর মামনির সেন্স ফিরে। সেন্স ফিরতেই মামনি ইমন ইমন বলে কাদঁতে থাকে। পালাক্রমে আমিরা হসপিটালে থেকেছি কুরী ম্যাম ও সর্বক্ষন আমাদের পাশে ছিলো।
ইমন মামনির হাত ধরে অনেকক্ষণ নিঃশব্দে কেদেঁছিলো। তারপর সে নিজেই বলে,
” মামনী তুমি আমাকে নিয়ে এতো ভাবছো কেন? আমি তোমার ছেলে! কিসের ভয় তোমার।”
মামনি ইমনকে ধরে ডুকরে কেদেঁ উঠলেন।
” হারানোর ভয়! আমি তোকে হারাতে চাইনা। কথা দে তুই আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবিনা৷”
ইমন মায়ের হাত আলতো হাতে ছুঁয়ে তারপর বললো,
” আমি জানি তুমি অনেকটা চিন্তিত তবে সবটা আমাকে ঘিরেই। আজকে তোমার এই অবস্থা তা শুধু আমার জন্যেই। আমার মনে হয় তোমাকে কিছু বলা জরুরি! আমি কখনো ভাবিনি এই টপিক নিয়ে তোমার সাথে আমার খোলাসা করে কথা বলতে হবে। আমি অপ্রস্তুত তবুও বলবো। ” ইমন কিছুক্ষণ থামলো। তারপর বললো,
” মামনি তোমার মনে আছে, আমার এইটিন বার্থডেতো বাবা প্রমিজ করেছিলো আমি যা চাইবো তাই দিবে। জানো বাবা আমাকে তাই দিয়েছিলো। আমি কি চেয়েছিলাম জানো আমার নীল চোখের রহস্য! হ্যাঁ এটাকে আমি রহস্যই বলবো।”
” তুই জানিস! সবটা জানিস!”
মামনির সাথে আমিও স্তব্ধ হয়ে গেলাম৷ তারমানে ও সবটা জানে? সব জেনেও এতোটা স্বাভাবিক! আমি বিস্মিত না হয়ে পারছি না।
” জানো সবটা জানার পর অন্যকেউ হলে হয়তো অনেক অস্বাভাবিক রিএক্ট করতো কিন্তু আমার ক্ষেত্রে কিন্তু তেমনটা হয়নি। এটাকে কোন ইমপোর্টেন্ট ইস্যু হিসেবে আমার মনেই হয়নি। আমার চোখে মনিতে কেবল তোমার নিঃস্বার্থ ভালোবাসাই আজীবনের জন্য সেটে আছে। তুমি আমার এতোটুকুও অপূর্ণ রাখোনি যে অন্য কারো দিকে আমার ধাবিত হতে হবে। আজঁ এতদিন পর ডঃ কুরীকে দেখে কিন্তু আমার কোন ভাবান্তর হয়নি। তুমি সেটা দেখেছ তবুও তোমার কি করে মনে হলো উনি চাইলেই আমি উনার কাছে চলে যাবো। বা অস্ট্রেলিয়াতে গেলেই আমি হারিয়ে যাবো। আমি এই গোপন সত্যিটা জেনেও কিন্তু তোমাকে কোন প্রশ্নবিদ্ধ করিনি৷ কেন করবো বলতে পারো আমার মামনি যে আমার জন্য, আমাকে ভালো রাখার জন্য বন্ধ্যাত্ব নামক অভিশাপটা ইচ্ছে করেই ডেকে নিয়েসেছিলো৷ যাতে আমার কখনো না মনে হয় যে তুমি আমাকে আগের মতো ভালোবাসো না বা একটু কম ভালোবাসো। এই একটা কারণে গোটা পৃথিবী তোমার বিরুদ্বাচারন করলেও তুমি কিন্তু আমায় একটুও অবহেলা করোনি। মামনি তুমিতো আমাকে দুহাত ভরে দিয়েছো। জীবনের এই ২৮ টা বসন্ত তো তোমার ছায়ার তলায় নিমিষেই পার করলাম তোমার কি একটাবারের জন্যেও মনে হলোনা তুমি ছাড়া আমার সমস্ত পৃথিবীটাই অন্ধকার, পথ চলতে ভীষণ কষ্ট, আমি যে অন্ধকার ভীষণ ভয় পাই তুমি জানোনা। তোমার বিশ্বাসটা কি এতোটাই ঠুনকো! কেউ এসে হুট করে দাবী করলেই পুরো পৃথিবীটাকে যার চোখ দিয়ে চিনেছি তাকে ভুলে অন্যে গা ভাসাবো। ইট’স ইমপসিবল মামনি! আমার কাছে নতুন কোন সত্যি সামনে আসার নেই। আমি সবটাই জানি। ”

মামনি কাদঁতে কাদঁতে বললো,
” আমার ভুল হয়ে গেছে খুব বড়রকমের ভুল। আমি তোকে ভুল বুঝেছিরে। কেবলই মনে হয়েছে তুই অস্ট্রেলিয়া গেলেই বুঝি তোর বাবার মতো হারিয়ে যাবি৷ আমি দ্বিতীয়বার কষ্ট পেতে চাইনি। তোকে হারিয়ে যে আমি বাচতে পারতাম নারে সেই ভয়টাই সবসময় আমাকে তাড়িয়ে বেড়াতো।”
মা ছেলে অনেকটা সময় নিলো যাতে নিজেদের মধ্যে যতোটা দ্বিধা সংশয় ছিলো সবটাই কেটে এক স্বচ্ছতার আবেশ দুজনকেই আচ্ছন্ন করে রাখে। আমার কেবলই ডঃ কুরীর কথা মনে পড়ছিলো। ইমন সবটা জানা সত্বেও উনার প্রতি কোন অনুভূতিই দেখায়নি। সত্যিইকি উনার প্রতি ওর কোন অনুভূতিই কাজ করেনা। ইমন কেন বাবাও কেবল ফর্মাল কথাবার্তা চালিয়ে গেছেন। ব্যাপারটা এমন যেন অনেক দূরের কোন অতিথি হুট করে দেখা হয়ে গেলে আমরা ঠিক যেভাবে রিএক্ট করি। কিন্তু ডঃ কুরী! ফিরে যাওয়ার সময় উনার চোখের জল আমি দেখেছি। ঐ চোখের ভাসা আমি পড়েছি, আমি স্তব্ধ হয়ে ভেবেছি। সব হারিয়ে নিঃস্ব মানুষের করুন আর্তনাদ আমাকে কয়েকটা রাত ঘুমোতে দেইনি। আমি পারিনি মানুষটাকে ভুলতে।

******
মামনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতেই পুরো পরিবেশটাই পূর্বের মতো হাসি আনন্দে ভরে উঠে। ঠিক যেমন পূর্বে ছিলো যেন কোন অতীত নেই যা আছে সবি বর্তমান আর ভবিষ্যৎ এর ঝলমলে হাতছানি। কেবল আমিই ভুলতে পারিনি। ইমনকে কয়েকবার চেয়েছি বলতে একবার যোগাযোগ করতে! কিন্তু সেটাও গলা দিয়ে নামেনি। ইমনের নিরাসক্তি, অনীহা আমাকে আর সে পর্যন্ত যেতেই দেয় নি।
ডঃ কুরী আজ সকালে আমাকে ফোন করে জানায় সে চলে যাচ্ছে, যে রিসার্চ এর কাজে এসেছিলো সেটাও আনকমপ্লিট রেখেই যেতে হচ্ছে।
আমি নিজেকে আটকাতে পারিনি ইমনকে মুখ ফসকে বলে ফেলেছি।
ইমন কেবল সরুচোখে চেয়ে কেবলই বললো,
” আদি, অযথা অতীত ঘাটতে গিয়ে বর্তমানটাকে জটিল করোনা। প্লিজ আমাকে ঐ মহিলার কথা মনে করিয়ে দিও না।”
আমি চুপ করে গেলেও ডিসাইড করলাম শেষবারের মত এয়ারপোর্টে উনার সাথে দেখা করতে যাবো।
ইমন বাসা থেকে বের হয়ে গেলে আমি অনেক ভেবেও নিজেকে আটকাতে পারিনি আমি সত্যিই এয়ারপোর্টে আসি। আসার সময় মামনিকে মিথ্যে বলে আসতে খুব খারাপ লাগতে থাকে। আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে উনাকে খুঁজতে থাকি। যখনি ফোন করতে যাবো ঠিক তখনই হাস্যজ্জ্বল মুখের নীল চোখ ওয়ালা শ্বেতাঙ্গিনী আমার নাম ধরে ডাক দেয়। আমি ঝাপসা চোখে উনার দিকে পলকহীন ভাবে তাকায়। উনি আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
” আমি জানতাম তুমি আসবে৷ সবসময় ভালো থেকো।”
অজান্তেই আমি উনাকে জড়িয়ে ধরি। উনিও আমাকে পরম মমতায় আকঁড়ে ধরেন। সে এমন টান যা উপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। আমি কাদঁছিলাম জানি না কেন?
উনি আমার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন
” ডোন্ট ক্রাই মাই প্রিন্সেস!”
উনার হাত থেকে একটা সবুজ পান্নার আংটি আমার হাতে পরিয়ে দিয়ে বললেন,
” এটা তোমার কাছে থাক।”
কিছুক্ষণ থেমে আবার বললেন,
” তুমি তোমার বেবির ছবিটা আমাকে মেইল করবে কিন্তু! ইউ নো আ’ম সো মাচ এক্সাইটেড ওকে ঠিক কেমন দেখতে হবে।”
আমি মৃদু হেসে এদিক সেদিক তাকালাম। আমার বিস্ময় ভরা চোখ কেবল নীল চোখেই সীমাবদ্ধ থাকলো। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের অদ্ভুত দ্যোতনায় দুলতে দুলতে ইমন আমার পাশে এসে দাঁড়ায়।
ডঃ কুরী ইমনের দিয়ে অবাক চোখে কিঞ্চিৎ তাকিয়ে বললো,
” তুমি কি আজকেই বউকে খুজঁতে খুঁজতে এখানে এসেছো?”
” না মানে?”
কিছুক্ষন আমতা আমতা করে তারপর আবার বললো,
” চলে যাচ্ছেন তাই..”
কথাটা শেষ করতে পারলোনা গলাটা ধরে আসছিলো।
” বাই এনি চান্স তুমি কি আমাকে সি অফ করতে এসেছো?।
দেখোনা কি একটা এমব্রেসিং কন্ডিশন ক্রিয়েট হলো! হুট করেই তোমাদের লাইফে আমি কিভাবে ঢুকে গেলাম। ট্রাস্ট মি আমি এভাবে চাইনি পুরোটাই কাকতালীয়। ”
” প্লিজ, এভাবে ভাববেন না আমার নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হবে।”
উনি মৃদু হেসে ইমনের দিকে তাকিয়ে বললো,
” আমারতো সময় হয়ে এলো। আসি কেমন!”
” আল্লাহ হাফেয। ভালো থাকবেন।”
উনি দূর থেকে ইমনের মাথায় হাত রাখার মত করে বললেন,
” গড ব্লেস অফ মাই সান।” বলতে গিয়েও দু চোখের কোণে বিন্দুবিন্দু জল জমে গেলো।
এই মুহুর্তে আমি ভীষণ অবাক হলাম। ইমন হুট করেই উনাকে জড়িয়ে ধরলো অস্ফুট স্বরে বললো মা।
ডঃ কুরী ইমনকে আঁকড়ে ধরে বললো,
” এ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া! আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই। এবার মনে হয় মরেও শান্তি পাবো।”

********
আরহানের সাথে রাতদিন গল্প করতে করতে কখন যেনো আরো চার মাস কেটে যায়৷ এবারতো আমি ব্যাকুল হয়ে পড়ি ওকে দেখার জন্যে। আজকেই ডেলিভারির ডেট! উত্তেজনায় আমার চোখের ঘুম হারাম। রাত বারোটায় মিঃ ইমন ফ্রি হয়ে কল দিলো,
” তাড়াতাড়ি ঘুমায় যাবা। বুঝছো কোন টেনশন করবা না। একদম ভয় পাবা না৷ সবসময় ইজি থাকবা। এখন কেমন লাগছে? দুষ্ট বাবাটা কি করছে?”
” আমার সাথে গল্প করছে। ওকে আমি শেখাচ্ছি কিভাবে বাবার সাথে আড়ি দিতে হয়৷ তুমি কতোটা পঁচা ওটাই ওকে বলছি।”.
” আচ্ছা পচাঁ! কেন আমি আবার কি করলাম।”
” তুমি ওর মাকে কাদিঁয়ে একা একা অস্ট্রেলিয়া পড়ে আছো। ওর কতো ইচ্ছে ছিলো সবার প্রথমেই ওর বাবার কোলে উঠবে! তুমি প্রথমদিনেই ওর ইচ্ছেটাকে মাটিচাপা দিয়েছো হুহ!”
” অবশ্যই তাহলেতো আরহানের বাবার খুব কঠিন শাস্তি প্রাপ্য!
আমি না ভাবছি অন্য কথা, আচ্ছা ওর মায়ের কি একটুও বাবাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে না৷ নাকি ছেলে আসার আনন্দে ছেলের বাবাকে একদম ডিলিট করে দেয়া হয়েছে।”
” কি বলছো উল্টাপাল্টা!”
” হুম আবার এটাও হতে পারে, মায়ের ইচ্ছেটা এখন ছেলের ঘাড়ে গছানো হচ্ছে। আল্লাহ ই জানে সামনে না জানি আর কি কি দেখতে হয়।”
” কি বললে তুমি! হ্যাঁ কি বললে? আমি ছেলের ঘাড়ে সব গছাই?”
আমি অতি রাগে ফোন কেটে দিলেও ওকে প্রচন্ডভাবে মিস করতে লাগলাম। খুব করে ইচ্ছে ছিলো ওটিতে আমার হাত ধরে ও বসে থাকবে। নীল চোখের দিকে তাকিয়েই সমস্ত কষ্ট ম্লান হবে!

********
আমার কোলে আমার ছোট্ট নীল চোখওয়ালা আরহান! হাতটা শক্ত করে ধরে ইমন আমার পাশে বসে একবার ছেলের দিকে আরেকবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমাকে সারপ্রাইজ দিতে আমার ডেলিভারির ঠিক আগমুহূর্তে ও ঠিকি আসে। বিস্ময়ভরা চোখে ওর কোলে আমার ছোট্ট আরহানকে দেখে অঝোর চোখের ফেলেছিলাম।
এই মুহুর্তে মিথ্যে শান্তনায় ইমন আমাকে ভরিয়ে দিচ্ছে,
” দেখো আদি একদম তোমার মত ঠোট, নাক, চোখ, সব!”.
” ওর চোখতো নীল! ”
” ওহ হ্যাঁ তাইতো! কিন্তু বাকি সব তোমার মত। এই দেখো!”
” আমি জানি ও পুরোদস্তুর তোমার মত! আমি কিন্তু একটুও আফসোস বা অখুশি নই।”
আমার কপালে চুমো খেয়ে ইমন ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
” এই চোখ বন্ধ কর! আরে একটু লজ্জা শরমতো রাখ।বাবা মা রোমান্স করলে এইভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকাতে হয়না।”
আমি হাসতে লাগলাম। আরহান চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে।
” এই ভালো হবে না বলছি! চোখ বন্ধ করে কুইক বন্ধ কর । নইলে তুই যতবার গার্লফ্রেন্ড এর সাথে দেখা করতে যাবি না দেখবি প্রত্যেকবার ধরা খাইছস।”.
আমি হাসতে হাসতে আবার ইমনের কাধে মাথা রাখলাম।
” গগণে উঠেছে চাঁদ,
জানি না কোন লগনে।
তোমাতে আমাতে হয়েছে মিলন
কোন এক সন্ধিক্ষণে ”
সমাপ্ত।