তোমাতে_আমাতে ২
পর্ব ০৯
আশিকা জামান।
সন্ধ্যে নেমেছে বিকেলের ধোয়া উঠা চায়ের কাপে। বারান্দায় বসে বসে প্রকৃতি দেখা আর মন খুলে গল্প করতে আমার বেশ লাগে। আজকেও লাগছে। তবে একটু অন্যকারণে। ভাবিকে আজকে একটু অন্যরকম ভালো লাগছে। আবিষ্কার করলাম ভাবি বড্ড মিশুক। নানারকম ভাবেই আমাকে হাসাতে চাচ্ছে। ইন্টারেস্টিং গল্পও করছে যার ম্যাক্সিমামটাই তার ছেলেবেলার। আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনছি,
” আদৃতা জানো আমি না ছোটবেলায় ভাবতাম প্রেম করলে বোধ হয় নাচতে হয় গাইতে হয়৷ ওই যে মুভিতে দেখাতো তাইজন্যেই ওমন ভাবনার সূত্রপাত। আমার ঝুমুখালা ওই যে ইউশার মা চিনোতো উনি আর আংকেল তখন প্রেম করতেন। তখন আমার টুয়েলভথ বার্থডে, তো আমি খালাকে খুব করে ধরলাম গান শোনাতে। খালারতো পুরা হাতে পায়ে ধরার মত অবস্থা সে গান জানেনা, গাইতে পারবে না। আমিও নাছোড়বান্দা। তুমি গান জানো, হুমায়ুন আংকেলের সাথে দেখা করার সময় গানের সাথে সাথে নাচোওতো। আমিতো নাচতে বলিনি শুধু গাইতেই বলেছি। খালাতো হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। মুখলুকিয়ে একটা প্রশ্নই করলো, তোমাকে এসব কে বলেছে?
আমি বললাম, কেন প্রেম করার সময়তো সবাই নাচে হাত ধরে গান গায়। তারমানে তুমিও তাই করো। নানাভাইতো খুব রেগে গেলেন, হ্যাঁ তার মেয়ে প্রেম করে! খুব হাম্বি তাম্বি করলেন। মজার কথা হলো ওইদিনই হুমায়ুন আংকেলের সাথে বিয়েটা দিয়ে দিলেন। এখনো দেখা হলে খালা এই কথাটা তুলবেই। আর আমিও বেশ লজ্জা পাই।”
আমি না হেসে পারলাম না। হুট করেই কথাটা মাথায় এলো তারপর জিজ্ঞাস করেই ফেললাম,
” আচ্ছা ভাবি, তোমাদের ঐ ইউশার বিয়ে দিচ্ছো না কেন?”
” কি জানি বাপু, সবাইতো খুব করে ধরলো মেয়েরতো বিয়ে করার বিন্দুপরিমাণ শখ নেই৷ এখন আবার নতুন কাহিনী যোগ হইছে। বিয়ের কথাতো তোলাই যাচ্ছে না।”
” নতুন কাহিনী মানে?”
” অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে ওখান থেকে ফিরেই নাকি বিয়ে করবে। আমরা আর কি করব বলো? যাদের মেয়ে তাদের সমস্যা নাই আমাদের কি?
তাছাড়া ভালো স্টুডেন্ট ব্রাইট ফিউচার স্কলারশিপ পেয়ে যাচ্ছে ওর উপরতো আর মিডিল ক্লাস এথিকস খাটানো যায় না। থাক বাদ দে। ইমনের কি খবর? সময় টময় দেয়। বুঝলি ফুল প্রেগনেন্সি টাইমটাকে এনজয় করবি।”
আমি চাইছিলাম স্বাভাবিক ভাবে থাকতে কিন্তু কথাটা শোনারপর আমি আর স্থির থাকতে পারছিলাম না। হুট করেই আবিষ্কার করলাম ভাবিকে আমার কাছে বড্ড বিরক্ত লাগছে৷ আমি তার প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই। হাফ এন আওয়ার তার হাবীজাবী বকবক কেন শোনলাম? এতোটা টাইম কেন ওয়েস্ট করলাম।পরক্ষনেই মনে হলো শুধুমাত্র ইউশার বোন বলেই কি ভাবির প্রতি এতোটা বিতৃষ্ণা পুষে রাখা সম্ভব! তাছাড়া ভাবিতো জানেইনা আমার আর ইউশার মাঝে কিসের দ্বিধা! কিসের বিরোধ!
আদৌ কি আমার আর ইউশার মাঝে কোন বিরোধ আছে? ইউশার চ্যাপ্টারতো সেই তিনবছর আগেই ক্লোজড। আবার কেন আমাদের মাঝে ঘুরেফিরে ও আসছে? আমি হাপিঁয়ে উঠলাম। কপাল জুড়ে সুক্ষ্ণ চিন্তার ভাজ আর বিন্দু বিন্দু ঘাম ভাবীর চোখ এড়ায় নি।
” আদৃতা, তোমার বোধ হয় শরীর খারাপ লাগছে। আর এখানে বসে থাকতে হবেনা বিছানায় চলো।”
ভাবী দায়িত্ব নিয়ে আমাকে একপ্রকার জোর করে টানতে টানতে বিছানায় নিয়ে শুয়ে দিলেন। খবর পেয়ে মা ও বিছানায় আমার পাশে বসলেন।
” নিশ্চিয় ঠিক করে খাচ্ছিস না৷ তাই শরীর খারাপ লাগছে। ”
” আমি ঠিকঠাক খাচ্ছি। আর তেমন কোন শরীর খারাপ না।”
” সে, বললেই হলো? তোর শাশুড়ী ঠিকঠাক যত্ন নিচ্ছেতো। নাকি সারাদিন শুয়েই থাকছে?”
” উফ্ মা আমার খুব যত্ন নিচ্ছে৷ আর মামনীর বিষয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলবা নাতো।”
” হ্যাঁ সেতো জানিই বিয়ের পর মাতো পর হবেই। মায়ের কথা শুনতে তো তিতা লাগবেই।”
” দেখ তুমি মোটেই আমার পর নও। আর তিতা লাগছে না আমার এখন বিরক্ত লাগছে। মাথা ব্যাথা করছে। প্লিজ এবার থামো।”
মা উঠে চলে গেলেন ঠিকি কিন্তু পরক্ষণেই বাটি চামচ হাতে ফিরে এলো।
বিরক্তি নিয়ে উঠে বসতে বসতে বললাম,
” এটা কি? আমি কি পিচ্চিবাবু?”
” নাহ্ তুমি পিচ্চিবাবুর আম্মু। তাই পাচঁ মিনিটের মধ্যে তোমাকে এই সাবুর পায়েস খেতে হবে। আমি বেশি করে দুধ দিয়ে অনেক মজা করে রান্না করেছি। নাও হা করো।”
” হুয়াট মা? আমি খাচ্ছি না।”
” দেখ তুমি দুধ খাবে না জানি তাই এই অভিনব পন্থা। নাও হা করো।”
মা একপ্রকার জোর করেই খাওয়াতে লাগলো। তারপর ভাবি হাতে করে আপেল কাটা আর আঙুর নিয়াসলো।
মুখ টিপে হেসে বললো,” এগুলো সবটা কিন্তু খেতে হবে। ”
আমি শুধু মুখে বললাম,” তোমাদের এখানে দেইখো আর আসবোনা। তোমরা আমাকে খাওয়াতে খাওয়াতে ঠিক মেরে ফেলবে।”
রাত সাড়ে আটটা বাজতেই ভেতর ভেতর কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। অবশ্য হওয়াটাই স্বাভাবিক।ইমনের আসার কথা থাকলেও এতোক্ষণেও এলোনা। ভেতরটা সক্ষ্ণ অভিমানে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।
আমি বিছানা থেকে উঠে আস্তে আস্তে আবার ব্যালকনিতে গেলাম। একটুপরেই আবার ফিরে আসতে হলো ঘর কাপাঁনো রিংটোনের শব্দে ।
” হ্যালো আদি, আমি না একটা বড়সড় ব্লান্ডার করে ফেলেছি। ভুল করে আমাদের বাসায় এসে পড়েছি। একদমই খেয়াল ছিলো না। আচ্ছা এখন কি আসবো? ”
আমি শান্ত গলায় বললাম,
” আসতে হবে না। ভাইয়া না হয় বাবা কাউকে সাথে নিয়ে চলে আসব।”
” আচ্ছা, তাহলে তাড়াতাড়ি এসো। আমি ওয়েট করছি।”
ইচ্ছে হচ্ছে ফোনটাকে ছুড়ে মারতে কিন্তু মারলাম না। এখন এতোটা উত্তেজনা আমার জন্য ভালো নয়। যথাসম্ভব মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। আমি বেডসাইড টেবিল থেকে পানিভর্তি গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে পুরা গ্লাস ফাকা করে দিলাম।
ডিনার শেষ করে বাবাকে বললাম আমাকে রেখে আসতে। বাবা ভীষণ রেগে গেলেন তার এক কথা সে আমাকে আজকে কিছুতেই যেতে দেবে না। একটা রাত আমার এখানে থাকা চাইই।
আমিও লক্ষী মেয়ের মত চুপ করে থাকলাম। তাছাড়া মেয়ে হিসেবে বাবা মায়ের ইচ্ছে অনিচ্ছের প্রাধান্য ও আমাকেও দিতে হবে।
বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই আমি গভীর ঘুমে ঢলে পড়লাম। যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন প্রবল চাপ ইমিডিয়েট ওয়াশরুমে যাওয়া দরকার।
অন্ধকার হাতড়ে ফোন বের করে দেখি সাড়ে তিনটে বাজে। আর ফোনে সেভেনটিন মিসড কল৷ সবগুলোই ইমনের। বেশ হয়েছে!
ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে আমি আবার শুয়ে পড়ি। তবে এবার আর ঘুম আসেনি। শুধু এপাশ ওপাশ করেছি।
তারপর কখন যেন আবার ঘুমিয়ে পড়ি।
সাতসকালে ফোন বাজার শব্দে আমি একরকম হকচকিঁয়ে উঠি। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলি,
” হ্যালো।”
” আসবে না যখন সেটা কি একবার বলা যেতোনা? নাকি আমি মানা করতাম।”
” ভুলে গিয়েছিলাম। “বড্ড নির্লিপ্ত গলায় বললাম।
” হুয়াট? এটা কোন এক্সিউজ ই নয়। একদম বাজে এক্সিউজ দিবেনা।”
” হুম আমিতো তাই বলি এটা খুবই বাজে এক্সিউজ। কিন্তু কি জানোতো তুমি নিজে যখন সেইম কাজটা করো তখন একবারের জন্যেও মনে হয়না যে এটা আসলেই খুব লেইম এক্সিউজ হয়ে যাচ্ছে।”
” আদৃতা ইউ নো আমি সারারাত ঘুমাইনি। তোমার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম৷ আর তুমি ইচ্ছে করে আমার উপর প্রতিশোধ নিলে৷ ভালোতো খুব ভালো। ক্যারি অন।”
আমার ইচ্ছে করছিলো বলতে আমিও তোমার জন্য সারাদিন অপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু তার আগেই সে ফোন কেটে দেয়। সে যাই হোক আমার পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। জীবনে প্রথমবারের মত আবিষ্কার করলাম ইমনের ইমোশন নিয়ে খেলতে আমার মজা লাগছে। বড্ড হাসতে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু কি মনে করে যেন সত্যিই আমার দুচোখ জলে ভরে উঠছে৷ উপচে পড়া চোখের জল গাল বেয়েও পড়ছে…
অঝোর ধারায়। অবিরাম।
চলবে…