তোমাতে আমাতে ২ পর্ব-১০

0
779

#তোমাতে_আমাতে ২
পর্ব 10
আশিকা জামান।

ইমন ড্রাইভ করছে আর আমি চুপচাপ পাশে বসে আছি। তবে কেউ কারো সাথে কথা বলছিনা। আমি অতোটাও আশা করিনি যে,ও আমাকে নিতে সকাল সকাল এসে পড়বে। আমি যে খুব একটা খুশি হয়েছি এমনটাও না। অবশ্য কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ গাড়িতে উঠেছিতো উঠেছিই। আমার কিছু একটা খটকা লাগছে ও গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ির রাস্তায় না গিয়ে অন্য পথ ধরেছে। কেন যাচ্ছে কি দরকার কিছু জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছে করছে না। লেকের কাছাকাছি গাড়ি থামিয়ে আমার দিকে তাকায়,
” নামো, আমি গাড়িটা পার্ক করে আসছি?”
” নামবো কেন? আমাদেরতো বাড়ি ফেরার কথা ছিলো।”
” হ্যাঁ ছিলো। তবে আমি অন্যরকম কিছু ভেবেছি।”
” নামবো না। বলেছিতো। ”
প্রতুত্তরে কিছু না বলে হুট করে দরজা খোলে আমাকে কোলে তুলে নেয়৷ পড়ে যাওয়ার ভয়ে ওর কাধে বেশ শক্ত করেই হাত রাখি। আমাকে নামিয়ে দিয়ে ও পার্কিং সাইটে চলে যায়। আমি লেকের শুভ্র সাদা জলের দিকে হত-বিহবল হয়ে তাকাই। ইচ্ছে করছে দুফোঁটা নোনা জল লেকের অথৈ জলে মিশে যাক চিরতরে৷ কিন্তু আশ্চর্য বৃথা চেষ্টা! অভিমানগুলো হুট করেই জমাট বাধা বরফে পরিণত হয়েছে। জানিনা কি করে গলবে? আদৌ গলবে কিনা! চারপাশের পৃথিবীটা কেমন ধোয়াশাঁয় আচ্ছন্ন!
কাছের মানুষগুলো যেন বড্ড অচেনা। চেনা রুপের বাইরেও যেন এক অচেনা সত্বা লুক্কায়িত!
” আদি, তুমি এতোক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে কেন, বসো।” ইমন আমার হাত টেনে ধরে জোর করে ওর কাছে নিয়ে বসায়।
দীর্ঘ হাতের আংগুল নিয়ে বাচ্চাদের মত খেলতে লাগলো।
কিছুক্ষন কেটে গেলো কিছ বেয়াড়া চুলের দস্যিপনা ঠেকাতে।।
হুট করেই কিছু বুঝার আগেই ইমন আমার সামনে হাটুগেড়ে বসে পড়ে।
বিস্ময় ভরা চোখে ওর দিকেই তাকাই।
” আদি, এটা তোমার।”
আমার হাতে একটা হলুদ গোলাপ গুজেঁ দিয়ে ইমন কান ধরে ওভাবেই বসে পড়ে।
আমি ওর কাধ ধরে টেনে তুলি।
” ইমন, প্লিজ এভাবে আমাকে ছোট করোনা।”
ইমন আমাকে শক্ত কিরে জড়িয়ে ধরে বলে,
” আদি, আমি তোমাকে ছোট করিনি৷ শুধু এটা বলো তুমি আমাকে ক্ষমা করেছো।”
” তুমি আমার কাছে কোন দোষ করোইনি তাহলে ক্ষমা আসছে কোত্থেকে?”
” উঁহু কোন এক্সপ্লেনেশনে যাচ্ছি না। সিম্পল হ্যাঁ অর না।”
” দেখো তাহলেতো আমাকেও সরি বলতে হয়। কারণ আমিওতো..”
ঠোটের উপর শক্ত আংগুলের চাপে পুরো কথাটা আর শেষ হয়না। কিছু সময় কাটে প্রকৃতি আর নীরব ভালোবাসার সান্নিধ্যে। আমি এরপরেই বাড়ি ফেরার তাগিদ দিতেই ইমন আমাকে একটা শপিং মলে নিয়ে যায়। জোড় করে নিজে পছন্দ করে শাড়ি কিনে দেয়। বেবি শপের সামনে যেতেই বুকের ভেতর অদ্ভুত ভালোলাগা ছেয়ে যায়। ইচ্ছে করে এটা কিনি ওটা কিনি? ইমন হয়তোবা আমার ফিলিংসটা বুঝেছিলো নয়তোবা বাবা হিসেবে ফিলিংসটা ওর মধ্যেও এসেছে। জোর করে নিউবর্ন বেবির জিনিসপত্র কিনতে লাগলো। আমি বেশ শক্ত হাতে ওকে থামাই।।ওর এক কথা,” আদি, এগুলো চোখের সামনে থাকলে তোমার মন ভালো থাকবে। অন্যরকম সুখ সুখ ফিলিংস হবে। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড, এইসময় তোমার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ডিপেন্ড করেই কিন্তু বেবির ব্রেইন ডেভলাপ হবে। ”
” ইমন, আগে ও পৃথিবীতে আসুক! তারপর যা ইচ্ছে হয় কিনবো। তাছাড়া মামনি রাগ করবে। কারন জন্মানোর আগে কিছু কিনতে হয় না তাহলে অমঙ্গল হয়।”
ইমন শব্দ করে হেসে উঠলো।
” তুমি এগুলো বিশ্বাস করো? আল্লাহ, আমি আমার এডুকেটেড বউ এর মুখে কি শুনছি!
আমারতো পাত্তালে ঢুইক্যা যাইতে মন চাইতেছে। ”
” চাইলে যাও। অন্তুত আমার বেবিকে নিয়ে কোন বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝখানে যাচ্ছি না।”
ইমন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেবলি বললো,
” হায়রে বাঙ্গালী রমনী!”
আমার বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল। দুপুরে লাঞ্চ করে তবেই ফিরি।
এতো দেরি দেখে মামনি খুব রেগে যায়। আদৌ৷ রাগার মত কোন কারণ আছে কিনা জানা নেই।
” এই অবস্থায় তুই ওকে নিয়ে যেখানে সেখানে ঘুরতে গেছিস। কোন বাধ বিচার নেই৷ ভর দুপুর বেলা ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘুরিয়ে আনলেন। যাবি ভালো কথা তার জন্যতো সময়জ্ঞান থাকাট জরুরি । ”
” মামনি এই ভরদুপুর বেলা ব্যাপারটা কি? আর এইসব সময় অসয়ের উপর কোন শুভ অশুভ নির্ভর করে না। এতো কুসংস্কার ধরে নিয়ে বসে থাকলেতো সমস্যা। আমি বুঝিনা আমার মা হয়ে এই টাইপের কুসংস্কার বিশ্বাস করো কি করে?
তোমার থেকে তোমার ছেলের বউ এখন সংক্রমিত হচ্ছে। এরপর ওর থেকে আমার নেক্সট জেনারেশন সংক্রমিত হবে!
প্লিজ এবারতো এসব ছাড়ো!”
” তোর মা হতে গেলে কি আমার সব ভুলে যেতে হবে।”
” উফ্ আমি কিন্তু একবারো সে কথা বলিনি।”
” আদৃতা যা মা তাড়াতাড়ি ঘরে যা। আর ফ্রেস হয়ে নে। আর ইমন আগামী ১২ ঘন্টা তুই আমার সাথে কোন কথা বলবিনা। তুই খুব খারাপ কাজ করেছিস।”

ডিনার শেষে মামনি টিভি দেখছিলো৷ হুট করে ইমন মায়ের পাশে বসে পড়ে।
” কি কিছু বলবি?
এইভাবে গা ঘেঁষে বসলি যে?”

” আমি চলে গেলে কি তোমার খুব কষ্ট হবে মামনি?”
” এসব কি কথা? কোথায় যাবি?”
মুখ ঘুরিয়ে মামনি বললো।
“হাইয়ার স্টাডিস এর জন্যে হলেওতো আমার বিদেশ যাওয়া উচিৎ। কি বলো মামনি।”
” এই একদম না।, কোত্থাও যাওয়া লাগবে না।”
মামনী হঠাৎ খাপছাড়া ভাবে ইমনকে বাচ্চাদের মতন করে কাছে টেনে নেয়।
” কোথাও যাবি না। আমি কোত্থাও যেতে দেব না৷ আমার খুব ভয় হয়। প্রচন্ড ভয় হয়। বাবা আমি তোকে হারাতে চাই না।”
” মামনি কিসের এতো ভয়!”
” তুই বুঝবি না। ”
চোখ মুছতে মুছতে বললো।
” মামনী ১২ ঘন্টা কিন্তু ওভার হয়নি। তার আগেই তুমি আমার সাথে কথা বললে।”
ইমন ফিক করে হেসে একবার মামনির দিকে আরেকবার আমার দিকে তাকায়।
” যাহ্ উঠ। ১২ ঘন্টা ওভার হলে তবেই আসবি? দিন দিন বাদঁর হচ্ছিস!।
আরে ব্যাটা এবার বাপ হচ্ছিস একটুতো চেঞ্জ হ। আর কতোদিন এমন থাকবি।”
” কোন চেঞ্জ টেঞ্জ হচ্ছিনা, এরকমই থাকছি।”
ইমন আবার মামনির কোলে মাথা এলিয়ে দেয়।
” আদৃতা, এই বাদরটাকে একটু মানুষ করতে পারছো না?”.
মামনির প্রশ্নে আমি থতমত খেয়ে যাই। অনেক্ষন চুপ থেকে মা ছেলের খুনসুটি দেখছিলাম। আমার কি উত্তর কাটা উচিৎ কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
তারপর মামনিই আবার বলে উঠলো,
” আচ্ছা তুমি অনেক্ষন চুপ করে আছো৷ কোন কারণে ডিস্টার্ব! শরীর খারাপ লাগছে?”
ইমনের দিকে তাকিয়ে আবার বললো,
” তুই ওকে একটু রুমে নিয়ে যা। আর যা শোয়ে পড়। এখানে বসে থাকতে হবেনা।”
” কিন্তু তুমি?”
” তোর বাবা না আসা অব্দি বসে আছি। তোরা যা। তোর আবার ৭ টায় হস্পিটালে যেতে হবে।”
ইমন আমার হাত টেনে ধরে একরকম টানতে টানতে রুমে নিয়াসে।
দরজাটা লাগিয়ে দেয়। আমি বিছানায় বসে পড়ি।
ইমন আমার গালে আলতো করে হাত ঠেকিয়ে একরকম চেচিয়ে ই উঠলো,
” মরার মত বসে ছিলে কেন? জামাই মারা গেছে।”
আমি ইমনকে সজোরে ধাক্কা দেই ও বিছানায় পড়ে যায়।
” মুখে কিছু আটকায় না৷ যা খুশি বলে দাও। ”
” হ্যাঁ সকাল থেকে এখন অব্দিতো, বিরক্তি ছাড়া আর কিছু প্রকাশ করোনি। আমার নিজের কাছে নিজেকে মৃত মনে হচ্ছে। এটাই সত্যি।”
ইমন বিছানা থেকে উঠে শপিং ব্যাগগুলো আমার সামনে এনে ছুড়ে মারে,
” এগুলো কি এখন অব্দি এখানে থাকার কথা! এগুলো কি শুধু শুধু কিনেছিলাম! আমি তোমার চাহিদা ডিমান্ড কিচ্ছু বুঝিনা এটাতো প্রায়শই বলো?
তুমি বুঝো? আমি কি চাই? কেন চাই? কিভাবে চাই? বুঝো?”
ইমন রাগে গজগজ করতে করতে ব্যালকনিতে চলে যায়। যাওয়ার আগে গ্লাসটা শরীরের সমস্ত শক্তি খাটিয়ে লাগিয়ে দেয়।
চলবে..