তোমাতে আমাতে ২ পর্ব-১২

0
812

#তোমাতে_আমাতে ২
লেখা আশিকা জামান
পার্ট ১২

সেদিনের ডোজটা বোধ হয় কাজে দিয়েছিল! ইমন হ্যাঁ ইমন যে নিজের ক্যারিয়ার গুছাতে গুছাতে হিমশিম খাওয়ার দ্বারপ্রান্তে,সেই এখন পুরোদমে স্ত্রৈন! হাসি পাচ্ছে? আমারো পায় যখন মাঝরাতে ডেকে তুলে জোছনা বিলাস করার কথা বলে। বলা নাই কওয়া নাই হুটহাট কোলে তুলে নেয়৷ ঘর অন্ধকার করে যখন এক ঝাঁক জোনাকি ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ আমার আনন্দের উচ্ছ্বাস দেখতে থাকে। আমার ওকে পাগল ছাড়া আর কিছু মনে হয়না। এতগুলো জোনাকি কোথায় পেলো এটা ভাবতে গেলে আরেকদফা হাসি পায়। রোজ দুইটা করে গোলাপ দিয়ে বলবে একটা তোমার, আরেকটা বাবার। শুধু মুখে বলেই খান্ত হবেনা পেটের কাছটায় ফুল ছুঁইয়ে বেবির সাথে মুখ লাগিয়ে কথা বলবে। কত ইনিয়েবিনিয়ে গল্পই যে করতে পারে, আগে জানা ছিলোনা। তবে আরেকটা বিরক্তিকর ব্যাপার ও আছে! যতক্ষন সাথে থাকবে ততক্ষণ নিয়ম করে ক্যালরি মেপে মেপে এটা খাও ওটা খাও। এটা কম হয়েছে আরেকটু খাও এই হলো অবস্থা। খাবার দেখলেই দৌড় দিতেই মন চায়। কিন্তু বেকায়দায় পড়লে যা হয় আরকি..।
অনেকদিন সবাই মিলে বেড়াতে যাওয়া হয় না৷ না ইচ্ছেটা ছিলো কিন্তু সময় সংকুলান ঠিক হয়ে উঠছিলো না। এমনি এক দ্বিধা দ্বন্ধে সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়া হলো। ইমনের দাদা বাড়ি মানিকগঞ্জে ওখানেই যাওয়া হলো। অনেকদিন থেকেই যাওয়ার তাগিদ দেয়া হলেও আমার ক্ষেত্রে আজঁই প্রথম। তবে অদ্ভুতভাবে মামনী বাবাইকে ওখানের কিছু জিজ্ঞাস করলে তেমন উত্তর কাটতে চাইতো না৷ উনারা ওখানে যেতেন না বললে ভুল হবে খুব কম যেতেন। ইমনের মুখে শুনেছি ও তখন ক্লাস সেভেনে তখন ওর দাদা মারা যায় সেবারই প্রথম গ্রামে যাওয়া। আর যাওয়া হয়নি তবে এতবছর পর মামনী বাবাই কি যেন কি মনে করে ওখানে নিয়ে যেতে রাজি হয়েছেন।

ইমনের দাদা বাড়িটা পুরোনো হলেও কেমন যেন আভিজাত্যের ছোঁয়া আছে। বাংলো বাড়িটার দিকে চোখ পড়তেই মনটা ফুরফুরে লাগে। বাড়ির মেইন ফটকেই বৃহদাকার দুটি বট গাছ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক দিনের পুরোনো। কেমন যেন গা ছমছমে ভাব।নানা জাতের দেশি বিদেশি জাতের সৌখিন গাছপালায় বাড়ির আঙিনা ছেঁয়ে আছে।
বাড়িতে ঢুকতেই সবাই হৈ হৈ করে বেরিয়ে এলো। কেউ একজন এসে ভেতরে যেতে বারণ করলো। মামনী বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
” কি সমস্যা? হচ্ছেটা কি?”
আটপৌরে শাড়ি পড়া এক থুরথুরে বুড়ী ফোকঁলা দাতে হাসতে হাসতে সামনে এসে দাঁড়ায়। পেছনে ইমনের দুই চাচী সাথে বরণ ডালা।
” আমার নাত বৌ আইছে! তারে বরণ না করে কি ঘরে তুলোন যাইব।”
মামনী সালাম দিয়ে বললো,
” ফুফু আম্মা আপনার শরীর ভালো?
আপনি যে এসেছেন সেটাতো জানতাম না।”
” বড় ভাবি, তোমরা আসবে শুনেইতো ফুফুআম্মা সহ আমরা সবাই আসছি।” ইমনের দূর সম্পর্কের এক ফুফু বললো।
” ভালাই আছি। নাইলে কি আসতাম। সরো সরো আমার নাত বৌরে একটু বরণ করি।”
আমার দিকে কতক্ষণ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে বললেন,
” নীলা,এই হুরপরীডারে কইত্থে ধইরা আনছো? মাশঅাল্লাহ! ”
উত্তরে মামনী শুধু হাসলো।
তারপর ইমনের দিকে তাকিয়ে বললো, ” “দাদুভাই কত্ত বড় হইছো? আজকা তোমার দাদা দাদী বাইচ্যা থাকলে কতইনা খুশি হইত৷” উনি কিছুক্ষণ প্রলাপ করে চোখের জল ফেলে আমাকে ধান দূর্বা দিয়ে বরণ করতে লাগলো। বিরক্তি লাগলেও চেহারায় কিঞ্চিৎ ছাঁপ রাখলাম না। এইকাজটা আমি বেশ ভালোই পারি।
রাতে আমাদের ইমনের দাদার ঘর শুতে দেওয়া হলো। দখিনের জানালা খুলে দিলাম হু হু করে বাতাস বইতে থাকলো। শরীর মন জুড়িয়ে যাচ্ছে এ এক অন্যরকম প্রশান্তি।
” আদি, জানালা খুলেছো কেন? তাত্তাড়ি বন্ধ কর।”
আমি সরু চোখে তাকিয়ে বললাম,
” বারে, কি সুন্দর হাওয়া! খামোকা বন্ধ করতে যাবো কেন?”
” তোমার বুঝি ভুতে ভয় নেই। তাহলে থাক।”
” মানে কিসের ভুত! ধুর কি সব বলো।”
” জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাও, তেতুল গাছ দেখেছো! ওই গাছটাই হলো আসল কালপ্রিট বুঝেছো। আমার দাদির একটা মাথা কাটা ইয়া বড় ভুত ছিলো শুনেছি ওটা নাকি ঐ গাছেই থাকতো। তবে দাদির সাথেও থাকতো৷ আছর করতো যখন তখন।
দাদিকে নাকি সেই সময় পরিস্থানের পরীদের মতন লাগতো! দাদি মারা যাবার পর এই গাছটা নাকি অনেক কাটার চেষ্টা করা হয়েছিলো কিন্তু কেউ কাটতে পারেনি। যে যে কাটতে এসেছিলো সবাই নাকি কিছুনা কিছু ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলো তাই আর কেই ভুলেও সাহস করেনি৷ কিন্তু ওই ভুতটা নাকি এখনো দেখতে পায় অনেকেই। ভয় দেখায় আর কি কি করতে পারো আই হ্যাভ নো একস্পেরিয়েন্স! প্লাস পয়েন্ট এটা দাদির ঘর এখন ভুতটা যদি তোমায় ধরে..?”
” ভুত..!!” বলেই চিৎকার করে আমি খাট থেকে লাফ দেই ইমন আমাকে ধরতে গিয়ে সে নিচে পড়ে যায় আর আমি তার কোলে। বিড়বিড় করে একমনে কালিমা পড়ছিলাম।
” এইভাবে কেউ লাফ দেয়। না ধরলে কি হতো?”
” ভুত..”
“আদি চোখ খুলো, ভুত কোথায় নেই তবে জিন আছে। এই যে তোমায় জড়িয়ে ধরে আছে। ”
” এখানে ভুত আছে আগে কেন বলোনি আসার আগে আমি দুইবার ভাবতাম।”
আমি শক্ত করে ওকে তখনো ধরে ছিলাম।
” তুমিতো ভুতের ভয়ে আমাকে মেরেই ফেলবা। ওহে পেত্নী এভাবে কেউ গলায় ধরে। হাস ফাস লাগছেতো। তাত্তাড়ি ছাড়ুন নাহলে সেকেন্ড ভুত হয়ে তেতুল গাছে আজন্ম থাকতে হবে। আমি আবার আমার সুন্দরী বউকে ছেড়ে একমুহুর্ত ও থাকতে পারবোনা।”
আমি চোখ খুলে ওকে ছেড়ে দিলাম।
” তুমি আমাকে পেত্নী বললে? আমি পেত্নী!!”
” পরে যে সুন্দরী বউ বললাম ওটা শুনোনি? তুমি দুইটার কম্বিনেশন এক অনন্য সৃষ্টি, এবার হ্যাপি।”
” না আমি এত খুশি হইনা৷ সত্যি করে বলোতো এতক্ষন যা যা বললে সব সত্যি?
” আংশিক।”
” এই একদম হেয়ালি করবেনা৷ আমার কিন্তু খুব ভয় করছে৷ যাও জানালা লাগিয়ে দাও ভয় লাগছে।”
” আমি??”
” হ্যাঁ তুমি। যাও বলছি। ”
ইমন আমষেটে মুখ করে উঠে জানালা লাগিয়ে দিয়াসে। ঘরের ভেতর কেমন যেন গা ছমছমে ভাব। দেয়ালের এক পাশে ইমনের দাদা আর দাদির ছবি বাধানো। ইমনের দাদার সাথে ওর চেহারার অনেক মিল শুধু চোখদুটো নীল না হলে ওকে ওর দাদার কার্বন কপি মনে হতো। ঘরের এক কর্নারে একটা শোকেস যেটায় অনেক পুরোনো আমলের জিনিসপত্র দিয়ে ভরপুর। একটা অ্যালবাম খুঁজে পেলাম ধুলো
ঝেড়ে খুলতে লাগলাম, ইমন পেছন থেকে জড়িয়ে ধরায় আমি ওটা আবার বন্ধ করলাম।
” কিগো করছোটা কি?”
” কিছুনা।”
” তাহলে খামোকা এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? চলো বাহিরে যাই।”
” না কেউ জানলে বকা দিবে। এইরকম রাতের বেলায় বাহিরে যাবো পাগল নাকি! একটু আগেওতো ভুতের কথা বলছিলে। তাহলে! ”
” তুমি কি সত্যিই ভয় পেয়েছিলে নাকি?”
” তাহলে কি আমি মিথ্যে মিথ্যে ভয় পেয়েছিলাম নাকি! চল।”
আমি ইমনের হাত টেনে ধরলাম।
” কোথায়?”
“ওয়াশরুমে। ”
” মানে কি আমি কেন ওয়াশরুমে যাবো?”
” আমি যাবো তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে। পাছে ভুত এসে তোমার সুন্দরী পেত্নী বউকে নিয়ে যায় !”

” কি বলো! কেউ দেখলে কি ভাববে?”
” সেটা তাদের উপর ছেড়ে দাও যা খুশি ভাবুক। আমাদের কি?”
ইমন কিছুক্ষণ ইতস্তত করলেও আমি ওকে সাথে করেই নিয়ে গেলাম। আমরা যে ঘরে ছিলাম ওটা একেবারে কর্নারে তার ঠিক সামনের লম্বা করিডোরের ডানদিকে ছিলো ওয়াশরুম। আমার খুব গরম লাগছিলো আমি আবার গোসল করে বের হই। ইমনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুশি হলেও ওর রাঙা দিদাকে খুব একটা খুশি হতে পারলাম না। সামনে যেতেই যেটুকু শুনতে পেলাম তা হলো,
” তুইতো দেহি তোর দাদার মতই বউকে চক্ষে হারাস। তোর দাদা সে কি বউ পাগলা আছিল আর কি বলবো?” বলেই ফোকঁলা দাতে সে কি হাসি। ইমনকে কাষ্ঠ হাসি হাসতে দেখা গেলো। শেষ কবে ওকে ঠিক এইভাবে হাসতে দেখেছিলাম ঠিক মনে নেই।
বুড়ীর ফোঁকলা দাতের হাসি আমাকে দেখে কেন যেন মিইয়ে গেলো বুঝে উঠতে পারলাম না।
” ভর সন্ধ্যেবেলা কিসের গোসল!”
চোখ কপালে তুলে বললো। আমি আর ইমন হতবাক হয়ে চোখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম। উনি সেটাও লক্ষ্য করলেন।
” ইমন, তুমি গোসল করো নাই কেন?যাও এক্ষুনি যাও। আমি যদি আগে জানতাম তাইলে এইখানেই আসতাম না। অবশ্যি আইসে ভালোই হইছে তোমাগো শিক্ষার অভাব যে আছে এইডা তো আগেই বুঝছি। যাও গোসলে ঢুকো। আর পোয়াতি মাইয়াগো লগে যখন তখন এইসব চলে না বাধ বিবেচনা রাইখো। যাও এক্ষুনি যাও।”
উনি একরকম চোখ রাঙিয়ে ইমনকে ওয়াশরুমে পাঠায়। হাসবো নাকি কাদঁবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

ইমনের ঠান্ডা লেগে গেছে একটুপর পর হাঁচি দিচ্ছিলো। ওর ঠান্ডা পানি সহ্য হয়না রাঙ্গা দিদার ভয়ে নাকানিচুাবানী খেয়ে ওর আজঁ বেহাল দশা। আমার নিশ্চয় সমব্যাথিত হওয়া উচিৎ উল্টা হাসি পাচ্ছে। খিলখিল করে হাসতে ইচ্ছে করছে।
ইমন হাঁচি দিতে দিতেই কোনরকমে বললো,
” খুব হাসা হচ্ছে না। তোমার জন্য অসময়ে গোসলটা করতে হলো। সব তোমার জন্যে!”
” আপনি রাঙ্গা দিদার কথায় ভয় পেয়ে এভাবে৷ ছিঃ ছিঃ। ” আমি আবার হাসতে লাগলাম।
ইমন হঠাৎ করেই আমাকে কোলে তুলে নেয়৷
” শোধ তুলবো। হুম আপনার কোন ছাড় নেই। খুব বেড়েছেন।”
” তাতে কি আপনার আবার ঠান্ডা লাগবে! আমার আর কি? আপনি মজা বুঝবেন।”
” তাহলে ঠান্ডা সারাজীবন লাগুক। চাইনা ওটা আর ভালো হোক। ”
ইমন আমাকে কাছে টানতে থাকে গভীরভাবে। তখন ও ডুবন্ত অথৈ সাগরে আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম,
” পোয়াতি মাইয়াগো লগে যখন তখন এইসব চলেনা একটু বাধঁ বিবেচনা রাইখো!”
ইমন আর আমি দুজনেই শব্দ করে হেসে উঠলাম । ওর হাসিটা কেমন লাজুক রাঙার মত! ছেলেদেরো কি লজ্জামাখা হাসি পায়! আজন্ম মনে রাখার মত সেই হাসি৷
” আইছে, আমার নানি। মুখ বন্ধ।”
ইমন এক গাল হাসি হেসে আমার ঠোটের ভাজেঁ ঠোট গুজেঁ দেয়। হয়তো এখনি সেই মধুর লগ্ন ভালোবাসার চাঁদরে দুটি হৃদয় আচ্ছাদিত হবার।
চলবে…