তোমাতে আমাতে ২ পর্ব-১৪

0
944

#তোমাতে_আমাতে ২
লেখা আশিকা জামান
পার্ট ১৪

ইমনের প্রচন্ড রাগ হয়েছিলো। রাগ হয়েছিলো বলতে এমন রাগ সেদিনই বাড়ি থেকে চলে আসতে হয়েছিলো। এরপরের দিনগুলো স্বাভাবিকভাবেই কাটছিলো। কেবল মামনিকে বড্ড বিষন্ন চুপচাপ থাকতে দেখতাম। তবে ইমন তার মায়ের পাশে ছায়ার মতো থাকতো। মামনির লুকিয়ে লুকিয়ে কান্নাটাও একদিন ও ঠিক ধরে ফেলে। তবে মা ছেলের ভালোবাসার কোন ঘাটতি আমার চোখে পড়েনি। এতোদিন পর্যন্ত সব ঠিকি ছিলো। হঠাৎ করেই ইমন আগের থেকে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে ওদের হস্পিটালে অস্ট্রেলিয়া থেকে মেডিক্যাল টিম আসায়৷ আমাকে প্রোপারলি সময়টুকু ও দিতে পারতো না৷ ভেতরে ভেতরে খুব অভিমান হতো। এর মাঝে ওর অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসতে থাকে। একদিন ডিনার টাইমে সবাই একসাথে ডিনার করছিলাম, ইমন কি মনে করে সেই প্রসঙ্গটা সেদিনই প্রথম ওর মাকে একদম খোলাখুলি ভাবে জানায়। অনলি ফিফটিন ডেইজ! এরপরে ই ও চলে যাবে খুব কষ্ট হচ্ছিলো তবুও চুপচাপ ছিলাম। আমি চাইনা এরকম একটা সাধারণ ইস্যু নিয়ে আমাদের মাঝে আর কোন ঝামেলা হোক।
কিন্তু ঝামেলা যদি হওয়ার থাকে তাকে বোধ হয় কোনভাবেই এড়ানো যায়না।
মামনি লাফিয়ে উঠে বলে,
” অনলি ফিফটিন ডেইজ! তুমি অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছো এটা এখন আমাকে জানাচ্ছো! হুয়াই ইমন!”
” মামনি সরি, আসলে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম! আই থিংক আমার স্কলারশিপ পাওয়ার খবরটা শুনে তুমি সবচেয়ে বেশী খুশি হবে। এম আর রাইট!”
” ইউ আর রং! আমি সব থেকে বেশী আহত হয়েছি। আমি তোমার থেকে এমনটা আশা করিনি। স্কলারশিপে এপ্লাই করার সময় তুমি আমার পারমিশন নিয়েছিলে? নাওনি। তোমার বাবার স্পাউস হিসেবেইতো ইমিগ্রেশনটা হয়ে গেছে তাই না। ইমন আমি ঠিক কতোটা কষ্ট পাচ্ছি তুমি বুঝতে পারছো!”
আমি বুঝতে পারলাম না মামনি এত কষ্ট কেন পাচ্ছে। আর বাবাও কেমন খাওয়া ছেড়ে থুম ধরে বসে আছে। মুহূর্তেই ঝলমলে পরিবেশটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেলো।
” মামনি প্রবলেমটা কোথায়! আমি এগেইন সরি সত্যিই আমার তোমার থেকে পারমিশন নেয়ার দরকার ছিলো।”
” ইমন আমি তোমাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছি তোমার যাওয়া হচ্ছে না। না মানে না এই প্রসঙ্গে আর একটা কথাও হবেনা। ”
ইমন আহত হয়ে বাবার দিকে তাকায়।
” বাবা, প্লিজ মামনিকে বুঝাও। আমি এই ডিগ্রীটা না নিতে পারলে শান্তি পাবো না প্লিজ মামনিকে একটু বোঝাও।”
বাবা মামনির দিকে তাকিয়ে বললেন,
” নীলা একটু বুঝার চেষ্টা করো। ইমনের স্বপ্নটা ভেঙ্গে দিয়ে কি তুমি শান্তি পাবে? পাবে নাতো! তবে কেন এমন করছো? ওকে যেতে দাও। ”
” তুমি সব জেনে-বুঝে আমার ছেলেকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছো? এই প্রেগন্যান্ট মেয়েটাকে দেখো, দেখেছো ওর চোখের নিচের আঁধারগুলো কতোটা ধারালো। ওর থেকে ওর হাজব্যান্ডকে দূরে যেতে বলছো? কি করে এই ফুল প্রেগন্যান্সি পিরিয়ড একা একা পার করবে বলতে পারো? বাচ্চাটার প্রতি কি কেবল আদৃতারই দায় পড়েছে ইমনের দায় নেই!”
মামনি কথা শেষ করতে পারে না তার আগেই ইমন উঠে চেয়ার ছেড়ে চলে যায়।
জানিনা মামনি বাবার মধ্যে শেষ কি কথা চলছিলো আমিও উঠে চলে আসি।
ইমন রুমে বসে একমনে সিগেরেট টানছিলো।
রুম এর জানালা বন্ধ থাকায় পুরো রুম একটা ধোয়াশায় পরিণত হয়েছে। উৎকট গন্ধে আমার গা গুলাচ্ছিলো।
” ইমন আমার বমি বমি লাগছে। তুমি রুমে বসে সিগেরেট খাচ্ছো? ছিঃ গন্ধ।”
” খুব বেশী খারাপ লাগলে অন্যরুমে যাও। বেশী বমি লাগলে ওয়াশরুমে যাও।”
” তুমি এরকম রুমে বসে সিগেরেট খেতে পারো না। ফেল বলছি। এক্ষুনি ফেলবে। ”
” আমি আরো অনেক কিছুই পারি। যেটা এখন থেকে তুমি দেখবে।”
কথাটা বলেই ইমন আরেকটা সিগেরেট ধরাতে গেলো আমি ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালালাম। কিন্তু ও এমনভাবে আমার হাতের কব্জি ধরে ফেললো যে আমি ব্যাথায় কেকিয়ে উঠলাম।
” বলেছিনা বিরক্ত করবেন৷ নিজে বিরক্ত হলে অন্যরুমে যাও। প্লিজ লিভ মি এলোন।”
ইমনের ক্ষুব্ধ কন্ঠের উচ্চ্বস্বরে বলা কথাগুলি ভিতরে ভিতরে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিচ্ছিলো। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছিলাম না।
” ইমন প্লিজ মামনির কথায় কষ্ট পেয়োনা। এভাবে এখনি এতো রিএক্ট করো না। একটু সময় দাও মামনি ঠিক বুঝবে।”
ইমন হঠাৎ করেই বাঘের মত গর্জন তুলে আমার দিকে তেড়ে আসে।
” আদৃতা, প্লিজ আর কোন নাটক করবে না। এমনিতেই অনেক নাটক হয়ে গেছে৷ যখন দেখলে কোন নাটকেই কাজ হলোনা তখন মামনিকে ধরলে। তোমার যদি ইউশাকে নিয়ে এত অনিশ্চিয়তা থাকে তাহলেতো আমার নিজেকে গৃহবন্দি করে রাখা উচিৎ। আফটার অল তোমার মানিসিক শান্তির ব্যাপার! আমাকেইতো সব বুঝতে হবে তাই না৷”
ইমন অগ্নিচোখে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। চোখে মুখে অস্বাভাবিক ক্রোধ! যে ক্রোধের আগুনে আমার ভেতর বাহির জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে৷
” ইমন, আমি মামনিকে কেন এসব বলতে যাবো। বিশ্বাস করো আমি মামনিকে কিছু বলিনি উনি যা করছেন স্বইচ্ছায় করছেন। কেন করছেন জানি না।”
” আমি তোমার থেকে কোন এক্সপ্লেইন চেয়েছি। চাই নিতো। নিজের মত থাকো যা খুশি করতে পারো। তবে আমার মাকে আমি চিনি তাকে উল্টো পালটা বুঝিয়ে কনভেন্স তুমি করিয়েছো। তাই এখন আমার সাফল্যে আনন্দ না হয়ে দুঃখিত হয় যেমনটা তুমি প্রথমবার শুনেই হয়েছিলে। অস্বাভাবিক রিএক্ট করেছিলে যা নয় তাই বলেছিলে।”
” ইমন তুমি ভুল বুঝছো!”
” আদৃতা এতোটা নিচে না নামলেও পারতে?”
বলেই রুম থেকে বের হয়ে যায়।
চারপাশ ঝাপঁসা লাগছিলো কেবলই কানে বাজছিলো ইমনের কথাগুলো।
বিয়ের পর আরেকটা রাত লেখা হয়েছিলো ব্যার্থতা আর গ্লানির অশ্রু দিয়ে।

এরপরে আমি আরেকটা চেষ্টা করেছিলাম মামনিকে বোঝনোর। মামনি তার সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও নড়েনি। ইমন আমাকে ভুল বুঝেছে এটা শোনার পর মামনি হয়তো ব্যাপারটা নিয়ে আরেকবার ভাবতো। কিন্তু ইমন যে ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে সেটার কথা শুনে বামনি আরেকদফা অস্থির হয়ে পড়ে। বাবাও চেষ্টা করেছিলো কিন্তু মামনির এক কথা অন্য কোন দেশে যাক আই হ্যাভ নো প্রবলেম। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না অস্ট্রেলিয়াতে কি সমস্যা।
কয়েকদিনে বাসার পরিস্থিতি আরো খারাপ হলো। ঘূর্ণিঝড় এর তীরটা কেবল প্রকট আকারে আমার দিকেই ধেয়েঁ আসছিলো। আধাঁরে মুখ লুকিয়ে কাদঁতাম ইমন দেখেও না দেখার ভাণ করে শুয়ে থাকতো। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলাও যেন বারণ।
এক রাতে আর নিজেকে থামাতে পারিনি৷ ওর বদলে যাওয়াটা নিষ্প্রভ চেহারাটা আর সহ্য করতে পারছিলাম না।
” ইমন, প্লিজ তুমি আমার থেকে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিও না আমি সহ্য করতে পারছিনা। বিয়ের পর থেকে আমার প্রত্যেকটা দিন শুরু হয়েছিলো তোমায় ভেবে। প্রত্যেকটা রাত শেষ হয়েছে তোমার বুকে মাথা রেখে৷ তুমি ছাড়া আমার আকাশজুড়ে কেবল বিষাদের ছায়া।”
ইমন কেবল কাষ্ঠ হাসি দিয়ে বলেছিলো,
” তোমার কাছেই আছি। চোখের সামনেই আছি। তবুও এতো কম্পলিকেশন থাকলেতো সমস্যা।”
” আমি এভাবে কাছে আসতে চাইনা। পাশাপাশি থেকেও যদি স্বামী স্ত্রীর মাঝে যদি এক আলোকবর্ষ দ্বৈরথ তৈরী হয় তবেতো বেচেঁ থাকাই বৃথা।”
আমার খুব কান্না পাচ্ছিলো। আমি ডুকরে কেদেঁ উঠলাম।
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থেকে ইমন বললো,
” আই নিড টাইম। আদৃতা আমার মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে কিছু সময় লাগবে। আই থিংক কয়েকদিনের মাঝে আমি গোটা ব্যাপারটাই ভুলে যাবো। ততোদিন পর্যন্ত সরি।”
ইমন কথাটা বলেই চলে গেলো আর সে রাতে ঘরে ফিরলো না।
বাধঁভাঙ্গা অভিমানটা তখনই প্রবল হলো। ইচ্ছে করছিলো চিরতরে হারিয়ে যেতে।

নির্ঘুম সারারাত এর সাক্ষীটা বোধ হয় দূরের তারাগুলোই হলো। একরাশ ক্লান্তি আর হতাশাকে সঙ্গী করে আমি সত্যি বাড়ি ছেড়ে এলাম। আসার আগে গেস্ট রুমে ইমনের ঘুমন্ত মুখটার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে কপালে শুষ্ক চুমো দিয়ে এসেছি। মনে মনে চেয়েছি ভালো থাকো অম্লান হোক স্বপ্নেরা।
চলবে