গল্পের নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:৯
,
,
,
,
,
,
সাজির পরীক্ষা শেষ হলো আজ দুদিন। শুধু একটা ব্যবহারিক পরীক্ষাই বাকি । যদিও সেটা নিয়ে তেমন একটা মাথা ব্যাথ্যা নেই। তাই সারা বাড়ি দৌড়ে বেড়াচ্ছে। তার সাথে যোগ দিয়েছে রেনুর দুই ছেলে মেয়ে রাফি আর চাঁদ। নামের মতই তার ছেলেমেয়ে দুটো সুন্দর।
দুইজনই সাজিকে খুব পছন্দ করে। রাফির বয়স পাঁচ হলেও সে পাকনা বুড়োর মতো কথা বলে। চাঁদ সবে হাঁটতে পারে আর আধো আধো বুলিতে কথা বলে। সব মিলিয়ে সাজির দিন ভালোই কাঁটছে।
সকাল হতে না হতেই সেঁজুতি হাসান তড়িঘড়ি করে ব্যাগ প্যাক করতে লাগলো। সাজি আধ খোলা চোখ কচলাতে কচলাতে মায়ের ঘরের দিকে যায়।
সেঁজুতি একপ্রকার কাঁদতে কাঁদতে ব্যাগে জামা কাপড় নিচ্ছে।
সাজি মায়ের কান্নায় বিচলিত হয়ে ছুটে গেলো।
,, কি হয়েছে আম্মু? কাঁদছ কেন??ব্যাগ গুলোই বা নিচ্ছো কেন?
সেঁজুতি কান্নারত গলায় বলল,, তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে নে। তোর দাদীর অসুস্থ তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
সাজি কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেল। দাদী ভক্ত নাতনী সাজি।
বাড়িতে গেলেই দাদির আঁচল ধরে ঘুরে বেড়ানোই তার উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। রাতে দাদিকে জড়িয়ে ধরে না ঘুমালে দাদি বাড়ি যাওয়াটা বৃথা মনে করে সাজি।
তেমনি সাজির দাদি জুবায়েদা খাতুনও সাজিকে চোখে হারায়। তার ছোট ছেলে জুবায়েরের একমাত্র মেয়ে বলে কথা। সাজির নামটাও তিনি রেখেছেন।বড্ডো বেশি আদর করেন তিনি। বাড়ি গেলেই সাজিকে বুকে জড়িয়ে চুপটি করে বসে থাকতেন। সাজি আসার সময় লুকিয়ে চুরিয়ে সাজির হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলতো,, সেঁজুতিকে বলবিনা বুড়ি। বললেই নিয়ে যাবে। এই গুলো দিয়ে ফুচকা কিনে খাবি ঠিক আছে!
দাদির কথা গুলো মনে করেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সাজি। তাড়াতাড়ি করে ব্যাগে জামা কাপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বোরখা গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লো।
সেঁজুতি হাসান রেনুকেও নিয়ে নিলো সাথে করে। একা বাড়িতে রেনু আর তার বাচ্চাদের রেখে যাওয়া মোটেও ঠিক না। বাচ্চা দুটোকে নিয়ে কি ভাবে থাকবে! এই ভেবেই তৈরি হতে বললো।
,
,
এই দিকে অনিলা রহমান কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। সাদ গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বললো,, আর কতো কাঁদবে মা! নানুর তেমন কিছু হয়নি তো। যাষ্ট প্রেশার লো হওয়াতে অ*জ্ঞান হয়ে গেছে।
অনিলা রহমান ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বললো,, তোর মা সুস্থ আছেতো তাই বুঝতে পারছিস না।
সাদ চুল ঠিক করতে করতে বিরবির করে বলে উঠলো,, ইন্টারন্যাশনাল ইমোশনাল ব্ল্যা*ক*মে*ইল করছে। না জানি মামুনির কি অবস্থা।
সাদ সাজিদের বাড়ির সামনে গাড়ি থামালো।
দুইবার হর্ন দিতেই দারোয়ান গেইট খুলে দিলো।
সেঁজুতি কাঁদতে কাঁদতে গাড়িতে উঠে বসলো। তার সাথে রেনু আর তার দুই বাচ্চা।
সাজি ইতি মধ্যে চোখ মুখ লাল করে ফেলেছে। গুটি গুটি পায়ে সামনের সিটে বসে পড়লো।
একটা গাড়িতে সাদ আর রেনুর দুই বাচ্চা ছাড়া চার মহিলাই গুনগুনিয়ে কাঁদছে। সাদ লম্বা দম নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। তাড়াতাড়ি এই চার নারীকে নানু বাড়ির সামনে ঢেলে দিয়ে আসলেই মুক্তি।
*
*
জুবায়েদা খাতুন সোফায় বসে টিভি দেখছে। আর কিছুক্ষণ পর পর চানাচুর মুখে পুরে চিবোচ্ছে। আজ অনেক দিন পর মনে হচ্ছে জিবনে একটা ভালো কাজ করেছে।
জুবায়েদা খাতুনের পাশে বসে আছে তার বড় ছেলের বউ রাজিয়া। জুবায়েদা খাতুন মেয়ে আর ছোট ছেলের বিয়ে নিজে পছন্দ করে দিয়েছেন। তবে বড় ছেলেটা নিজের পছন্দ মত বিয়ে করে।
পছন্দের বিয়ে বলেই বড় ছেলে ঠকে গেছে বলে মনে করেন জোবায়েদা খাতুন।
“বউ না এনে সাক্ষাৎ রিনা খান নিয়ে এসেছে আমার হাবলা ছেলেটা!” আড় চোখে রাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো জুবায়েদা খাতুন।
চানাচুর মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে রাজিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,, মুখটা বাংলার পাঁচ করে বসে আছো কেন? যাও রান্না ঘরে যাও! আমার দুই মেয়ে আর নাতি নাতনি আসছে। খাতিরদারিতে যেন কোনো ত্রুটি না থাকে। এমন ভাবে আপ্যায়ন করবে ঠিক যেমনটা তোমার মা বোন আসলে করো। রান্না গুলোও যেন তেমন মজা হয়।
রাজিয়া দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বললো,, বুড়ি সুধরাবে না। নিজের মিথ্যা রো*গের কথা রটিয়ে পুরো গুষ্টি ডেকে আনছে। এখন আমাকেই সবার কাজের বেটি হতে হবে।
জুবায়েদা খাতুন আড় চোখে রাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,, আমাকে মা*রা*র প্ল্যান না করে। রান্না বসাও আর হ্যা আমার নাতিটা ঝাল খেতে পারে কম। সব রান্নায় মরিচের পরিমাণ কম দিবে।
রাজিয়া জোর পূর্বক হেসে বলল,, ঠিক আছে আম্মা।
রাজিয়া চলে যেতেই জুবায়েদা খাতুন মুখ বেঁকিয়ে বললো,, এমন ভাবে বলছে যেন এই আম্মাকে মনে মনেও আম্মা ডাকে। নাতি নাতনি গুলোর জন্য ,নয়তো আমার আনিসকে আরেকটা বিয়ে করিয়ে দিতাম। রিনা খানের বংশধর কোথাকার। আমার সাজানো সংসারটাকে ছি*ন্ন*ভি*ন্ন করে আমার স্বামীর ভিটেমাটি কামড়ে বসে আছে।
____________________
সাদ গাড়ি থামাতেই অনিলা রহমান, সেঁজুতি আর সাজি দৌড়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো। রেনু চোখ মুছে সাদকে উদ্দেশ্য করে বলল,, ভাইয়া এইটা কার বাড়ি?আর কার কি হয়েছে?
সাদ কয়েক সেকেন্ড অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,, সত্যি জানিস না?
রেনু চাঁদকে কোলে নিতে নিতে বলল,, না ভাইয়া। শুধু খালাম্মা বলেছে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে তাইতো তৈরি হয়ে চলে এসেছি।
সাদ দুই আঙ্গুলে কপাল ঘষতে ঘষতে বলল,, তাহলে কাদছিস কেন??
,, খালাম্মা আর আপা কাঁদছিল তাই।
সাদ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, রাফি আর চাঁদকে নিয়ে ঘরে যা। আমি ব্যাগ গুলো নামিয়ে আসছি।
,, ভাইয়া আমি সহ নেই,?
,, দরকার নেই। তুই ঘরে গিয়ে রাফিকে সাজির কাছে দিয়ে চাঁদকে বিছানায় সুইয়ে দে।
রেনু মাথা নেড়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লো। সাদ ভাই রাগি হলেও তার বাচ্চা দুটোকে খুব আদর করে।প্রতিবার আসার সময় দুইটার জন্য চকলেট কিনে আনে। তাইতো শতবার ধমক দিলেও মন খারাপ করেনা রেনু। ভয় পেলেও শ্রদ্ধাটা মন থেকেই করে।
*
বাড়ির ভেতরের দৃশ্য অন্যরকম। জুবায়েদা খাতুন মেয়ে,বউ আর নাতনিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। চোখ মুছে খুশির ঝিলিক দেখা যাচ্ছে। চেহারায় অসুস্থতার রেশ মাত্র নেই। তার ঠিক সামনে বসে আছে রেনু। তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। বরং সে জুবায়েদা খাতুনের দিয়ে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
সাদ ব্যাগ পত্র নিয়ে সোফায় বসলো।
শার্টের বোতাম দুটো খুলে বুকের ভেতর ফু দিতে দিতে জুবায়েদা খাতুনকে উদ্দেশ্য করে বলল,, বুড়ি এতো নাটক করার কি দরকার ছিল? খামোখাই তিন রমনীর চোখের পানি গুলো অপচয় হলো।
জুবায়েদা খাতুন টিপ্পনি কেটে বললো,, তিনজনের চিন্তাই করছিস! নাকি একজনের কথা ইঙ্গিত করে বলছিস ভাই?
নানির কথা শুনে কাশি উঠে গেলো। সাদ কাশতে কাশতে তাড়াতাড়ি উঠে বাইরের দিকে চলে গেলো। নানি তার একটু বেশিই চালাক। ওইখানে বসে থাকলে বে*ফাঁ*স কথা বার্তা দিয়ে এতো বছরের লুকিয়ে রাখা সব কিছু ফাঁ*স করে দিবে নিশ্চিত। সাথে মান সম্মান সব যাবে।
*
*
*
সেঁজুতি আর অনিলা, রাজিয়ার সাথে হাতে হাত মিলিয়ে রান্নার কাজ করছে।
জুবায়েদা খাতুন প্রথমেই ঘোষণা করে দিয়েছে,রেনু এই বাড়ির মেহমান তাই এই বাড়িতে তার কাজ করা নিষেধ । এতে সবাই সহমত পোষণ করলো। আপাতত রেনু তার মেয়ে চাঁদকে ঘুম পাড়াতে ব্যাস্ত।
সাজি রাফিকে নিয়ে বাড়ির উঠোনে লাগানো গাছ গুলো দেখছে। আর অপেক্ষা করছে কখন ইরিনা আসবে।
ইরিনা সাজির জেঠাতো বোন। তার জেঠার এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে নাম ইহান আর মেয়ের ইরিনা। ইরিনা সাজির এক বছরের ছোট হলেও ইহান গুনে গুনে সাজির দুই বছরের বড়।
সাদ তার বড় মামা আনিসের সাথে বাজারে গেছে। মায়ের আদেশ তাই এক মাত্র ভাগ্নেকে নিয়ে বাজার করার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিল।
বাজার শেষে দুইজন বাড়ি ফেরে। দুই হাতে ব্যাগ আর ব্যাগ ভর্তি বাজার। এলাহি কারবার সব।
বাড়ির উঠোনে সাজিকে দেখেই আনিস ডাক দিলো। বাজারের ব্যাগ গুলো কাজের লোকের কাছে দিয়ে হাত খালি করলো ততক্ষণে।
সাজি জেঠুর ডাক শুনেই ছুটে এলো।
আনিস পকেট থেকে চকলেট বের করে সাজির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,,
,, এইগুলো আমার মায়ের জন্য।
সাজি খুশিতে গদগদ। তার জেঠু সেই ছোট বেলা থেকেই তার জন্য এমন করে চকলেট নিয়ে আসে। জেঠু বাইরে থেকে ফিরেছে মানেই তার পকেটে ভর্তি চকলেট।
চকলেট গুলো নিয়ে মুচকি হেসে বলল,, তুমি কখনোই ভুলো না জেঠু। সব সময় কি ভাবে মনে থাকে?
আনিস সাজির মাথায় হাত বুলিয়ে মুচকি হেসে বলল,, সময় আর সম্পর্ক যেমনই হোক।কিছু জিনিসের কথা কখনোই ভোলা যায় না মা।
সাজি মনিল হেসে আনিসকে জড়িয়ে ধরলো। আনিস দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সাজির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,, মন খারাপ করিস না মা। হাসি খুশি থাক।
আনিস যেতেই সাজি দুটো চকলেট রাফির দিকে এগিয়ে দিলো।
রাফি চকলেট গুলো নিয়ে ঘরে চলে গেল।
এতক্ষণ পেছনে দাঁড়িয়ে সব কিছু শুনছিলো সাদ। তার বড় মামার কথার অর্থ বুঝতে দেরী হলো না।লোকে বলে” সংসার সুখে হয় রমনীর গুনে।” কিন্তু কিছু রমনীর করেন সংসারের সুখ ধুলিসাৎ হয়ে যায়। তার একটা জলজ্যান্ত প্রমাণ তার বড় মামুনী।
সাজি চকলেটের প্যাকেট খুলে মুখে পুরবে এমন সময় সাদ চকলেট কেড়ে নিয়ে নিজের মুখে পুরে দিয়ে বললো,, একা একা আর কতো খাবি! আশে পাশে মুরুব্বি আছে তাদেরকে সাধলেও তো পারিস।
সাজি থমথমে খেয়ে বললো,, আপনি!
সেই দিনের গাড়ির ঘটনার পর থেকে সাজি সাদের দিকে সরাসরি তাকায়নি। সাদের দিকে তাকাতেই লজ্জায় আড়ষ্ট হয়।সাদ ঘুমের ঘোরে সাজির হাত জড়িয়ে ধরে কিছু বুলি আওড়ালো। যা শুনেই চমকেছিলো সাজি। নিজের মনকে বুঝিয়েছিলো ভুল শুনেছে কিন্তু মস্তিস্ক মানতে নারাজ। সব মিলিয়ে বি*শ্রী একটা অবস্থা। তাইতো সাদের থেকে নিজের অবাধ্য নজর লুকাতে ব্যাস্ত সাজি।
,, হ্যা আমি! কেন তুই আর কাকে আশা করেছিস? বাই এনি চান্স ইহানকে নয়তো?
সাজি আমতা আমতা করে বলল,, না মানে তা বলিনি।
,,না বললেই ভালো। বাইদা ওয়ে তোকে ইহানের আশে পাশে যেন না দেখি। ইহান থেকে দুরে থাকবি।আই হোপ বুঝিয়ে বলতে হবে না।
সাজি মাথা নেড়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সাদ ইহানকে পছন্দ করে না। কি সেই কারন আজ ওবদি খুঁজে পেলো না সাজি । তবে সব সময় সাদ ভাইয়ের মুখ থেকে একটা কথাই শুনেছে, “” ইহান থেকে দুরে থাকবি”।
ইনশাআল্লাহ চলবে,,,