#দুই_পৃথিবী
#লেখিকা- রিতু
পর্ব-১
একটি মেয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।পরণে তার লাল টকটকে শাড়ি,হাটু সমান লম্বা কেশ,বড় বড় দুটি চোখ,দুধে আলতা গায়ের রঙ,ঠোটের নিচে বড় একটি তিল আর গলার বেশ নিচেই ছোট আরো একটি তিল।
ছবিটা দেখেই কিছুক্ষণ এর জন্য দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল স্নেহার।এই মেয়েটি আর কেউ নয়,সে নিজে।তার নিজের এই রূপের খুঁটিনাটি বর্ণনা সে নিজে আগে কখনো খেয়াল করে দেখি নি।অথচ যে এই পোট্রেট টা করেছে সে যে অনেক গভীর ভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করেছে সেটা বোঝায় যাচ্ছে।
স্নেহা এই পোট্রেট টা দেখলো ফেসবুকে।নিউজ ফিডে ঘুরতে ঘুরতেই সামনে এসে পড়লো তার।সে নিজের পোট্রেট টা কিছু সময় নিয়ে দেখে খোজ করতে লাগলো এই ছবির আর্টিস্ট এর।যে ছবি টি আপলোড করেছে তাকে ম্যাসেজ দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো সে।নাহ!কোন উত্তর নেই।একের পর এক ম্যাসেজ করার পর অবশেষে ম্যাসেজ সিন করলো ছেলেটি।
Akramul Islam-wait wait.etto gulo msg deyar mane ta ki??
Sneha Sarkar-উপরের ম্যাসেজ গুলো পড়ুন।
২ মিনিট পর ম্যাসেজের রিপ্লাই করলো ছেলেটি।
Akramul Islam-যে পোস্ট এ আমি ক্যাপশন দিয়েছি যে ‘তোমার ঠোঁটের নিচের তিলের প্রেমে পড়তে চাই’ ওটা??
Sneha Sarkar-জ্বি।
Akramul Islam-Oh..I see.bt ami artist k chini na.ami pic ta 1 ta group a paici.?
Sneha Sarkar-কোন গ্রুপ?আমার জানাটা খুব জরুরি।
Akramul Islam-keno?ar apnar profile pic dekhe mone hocche ami jar Thoter nicher til er preme porte chai se e apni???
এই ম্যাসেজ টা দেখে স্নেহার মনে হচ্ছিল ছেলেটার দুই গালে দু টা থাপ্পড় বসিয়ে দিতে।অসভ্য একটা।কিন্তু স্নেহা রাগ টা কন্ট্রোল করে বললো
Sneha Sarkar-ভাইয়া প্লিজ আপনি চাইলে পারবেন আর্টিস্ট খুঁজে বের করতে।আমাকে এই হেল্প টা করুন।
Akramul Islam-seta thik j ami parbo.bt seta korle apni amk ki diben??
Sneha Sarkar-কি লাগবে আপনার বলুন?
Akramul Islam-beshi kicu na.cholun na ek din ek sathe lunch kori.?
Sneha Sarkar-সিউর?কিন্তু আগে আর্টিস্ট।
Akramul Islam-kal sokale janabo?
স্নেহা ম্যাসেজ টা সিন করে বের হয়ে এল ফেসবুক থেকে।
রাত ১ টা।চোখে ঘুম নেই স্নেহার।বার বার শুধু ছবিটার কথা মনে হচ্ছে।কে এঁকেছে তার ছবি?এতো টা নিখুঁত ভাবে তাকে লক্ষ ও করেছে?তার সাথে দেখা না হওয়া পর্যন্ত স্নেহার ঘুম আসবে না।সে ঘড়ি দেখে রুম থেকে বের হয়ে এল বারান্দায়।তাদের বাসা টা দোতালা।পুরানো বাড়ি।স্নেহারা থাকে দোতালায়।আর নিচ তলা টা ভাড়া দেওয়া।সেখানে জামিল সাহেব নামের একজন তার স্ত্রী সন্তান নিয়ে থাকে।আর উপরে থাকে সে তার বাবার সাথে।স্নেহার মা নেই।মা ছাড়াই বড় হয়েছে সে।মা নেই সেই কথা টা ও সত্যি না।মা আছে।কিন্তু তাদের সাথে থাকে না।স্নেহার যখন ৩ বছর বয়স ওই সময়েই তার মা তার বাবা কে ছেড়ে অন্য এক লোকের হাত ধরে বেড়িয়ে যায় এ বাড়ি থেকে।আর আজ তার ১৯ বছর বয়স।লালমাটিয়ায় অনার্স প্রথম বর্ষতে ভর্তি হলো সে এ বছর।তার বাবা তাকে একাই বড় করেছে।বিয়েটাও করে নি স্নেহার দিকে তাকিয়ে।সৎ মা কে জানে কেমন হবে!
সকালে আনিস সাহেবের ডাকে ঘুম ভাঙল স্নেহার।তার বাবা আনিস সরকার।ছোট্র ব্যবসায়ী।কিসের ব্যবসা সেটা স্নেহার জানা নেই।কখনো আগ্রহ করে জানতে চায় ও নি স্নেহা তার বাবার কাছে।
স্নেহা উঠে রান্না ঘরে গেল চা করতে।সকালে উঠেই বাপ বেটি মিলে বারান্দায় বসে চা খাওয়া আর আড্ডা দেওয়া অভ্যাস হয়ে দাড়িছে ওদের।চা নিয়ে স্নেহা বারান্দায় আসতেই আনিস সাহেব বললেন
-দেশের কি অবস্থা মা দেখেছিস?
-নাহ।ওগুলো আমার ভালো লাগে না এটা তুমি জানো।
-হুম।আচ্ছা তারপর বল কি খবর?
-বাবা দেখ এই ছবি টা।
স্নেহা ফোন বের করে তার বাবা কে তার নিজের পোট্রেট টা দেখালো।তার বাবা ও তার মতো কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলো।তারপর বললো
-ও মাই গড।এটা আমার মেয়ে!
স্নেহা হালকা হেসে বললো
-বাবা,আমি আর্টিস্ট টাকে খুজছি।আমার এই লোক কে দরকার।অন্য অার্টিস্ট দের দেখেছি আকার পর ছবির নিচে সিগনেচার করে।বাট এই লোকটি সেটাও করে নি।
-বলদ হবে হয়তো।
-প্লিজ বাবা বলদ বলবে না।
আজ স্নেহা কলেজে যাবে না।একটু আগে সে আর্টিস্ট কে খুঁজে পেয়েছে।আকরামুল নামের ছেলেটি তাকে বের করে দিয়েছে।ভদ্র লোকটির ফেসবুক আইডির নাম ‘Afsaan Abir’।স্নেহা বার বার আইডি চেক করেছে।কিন্তু তার নিজের কোনো ছবি আইডিতে দেওয়া নেই।শুধু কোথায় জব করে,কি থেকে পড়াশোনা করেছে,আর তার আকা কিছু ছবি দেওয়া।স্নেহার ছবি টি বর্তমানে তার আইডির কভার ফটো তে দেওয়া।ক্যাপশন দেয়া ‘তোমাকে আঁকতে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে।’কমেন্ট এ অনেকে বলেছে ‘কি রে ভাবি নাকি!!’
স্নেহা রেডি হয়ে বেরিয়েছে জগন্নাথ ইউনিভারসিটির উদ্দেশ্যে।ফেসবুকের ডিটেইলস অনুযায়ী আফসান জগন্নাথের চারুকলা বিভাগে অধ্যাপনা করে।জয়েন করছে নতুন।এর আগের বছর পাস করে এই বছর অধ্যাপনা শুরু করেছে।রিক্সায় উঠার। পর স্নেহা ফোন দিল তার বান্ধবি সাফা কে।ও এই বছর জগন্নাথে ভর্তি হয়েছে।অবশ্য ও চারুকলা তে পড়ে না।কিন্তু আফসান কে খুঁজতে হেল্প করতে পারবে নিশ্চয়।
-তুই শিউর যে আফসান নাম?
-হ্যা।আফসান আবির।
-আমার একটা ফ্রেন্ড চারুকলা তে আছে।দাড়া ওকে কল করি।
স্নেহা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সাফা বলল
-আরে পাইছি।নতুন জয়েন করছে।ক্লাস দু একটা এটেন্ড করছে।এর জন্য তেমন কেউ চেনে না।অবশেষে পাইলাম।চল।শুনলাম অফিস রুমে আছে।
স্নেহা ও সাফা অফিস রুমে এসে আফসান কে পেল না।সে নাকি চলে গেছে।কিন্তু তারা ঠিকই তার বাসার ঠিকানা জোগাড় করে ফেলল।সাফা কে বিদায় দিয়ে স্নেহা রিক্সা নিল।তার গন্তব্য আফসানের বাসা।সে আজ আফসান কে না দেখে কথা না বলে যাবে না।যে তার এত সুন্দর একটা ছবি এঁকেছে তাকে দেখার ইচ্ছা অসংগত কিছু নয়।
ঠিকানা ১৩/৬ পশ্চিম মালিবাগ।রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে স্নেহা এগুলো বাড়ি টার দিকে।৪ তলা বিরাট এক বাড়ি।বাড়ির সামনে যেতেই এক লোক এল।দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই বিশাল বাড়ির গেট খোলা বন্ধের দায়িত্বে সে কর্মরত।লোকটা স্নেহার দিকে তাকিয়ে বললো
-কারে চান?
-আফসান আবির সাহেব কি এ বাসাতেই থাকে?
-সে কি পরোফেসর?
-জ্বি,প্রোফেসর।
লোকটি তার সব দাঁত বের করে হেসে বললো
-জ্বে।সে এ বাসায় ভাড়া থাকে।
-সে কি আছে বাসায়?
-জ্বে।সে ৫ মিনিট আগেই আইছে।ভেতরে যান।৩ তলার ২ নম্বর ফ্লাটে সে থাকে।
স্নেহা এক এক করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে।তার সাথে বাড়ছে তার হার্টবিট।
২ নম্বর ফ্লাটের যে দরজা খুললো সেই লোকটির বয়স হয়তো ২৮/৩০ হবে।খালি গাঁ য়ে তাকে যে খারাপ লাগছে তা নয়।জিম করে হয়ত।বডি ফডি দেখা যাচ্ছে।লম্বায় ৬ ফিটের উপরে হবে হয়তো।গায়ের রঙ হালকা শ্যাম।মোট কথা যে কেউ তাকে প্রথম দেখাতেই সুদর্শন পুরুষ বলবে।আবার অনেক তরুণী হয়তো প্রেমে ও পড়বে।
আফসান হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সে তার নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছে না।এই মেয়ে তার বাসায়!এটা কি সত্যি ঘটছে?নাকি স্বপ্ন?
-এটা কি আফসান সাহেবের ফ্লাট?
আফসান এতোটাই অবাক যে সে এখনো নিজেকে ধাতস্থ করতে পারছে না।সে যে খালি গায়ে একটা তরুণীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে এটা তার এখনো মাথায় আসে নি।মাত্রয় বাসায় ঢুকে কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়েছিল সে।এর মাঝেই বেল বাজতেই দড়জা খুলে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে স্নেহার দিকে সে।
-হ্যালো?এই যে??
আফসান নিজেকে কন্ট্রোল করে বললো
-জ্বি।আমি আফসান।
-ভেতরে আসি?
-আসুন।
-আসুন বলে তো দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন?
-অহ হ্যা আসুন।
স্নেহা বাড়ির ভেতরে ঢুকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো।পুরো টা দেয়াল আঁকানো।গাছ,লতা পাতা,ফুল,পাখি,আর একটি মেয়ে।নৌকায় বসে পা হাটু পর্যন্ত ঢুবিয়ে রেখেছে।চুল গুলো পানিতে এসে পড়ছে।মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে সে নদীর পানির দিকে।
এই প্রথম এমন একটি বাসা স্নেহা দেখলো যে বাসায় দেয়ালে রঙ এর পরিবর্তে এতো সুন্দর করে গাছপালা আঁকানো।
স্নেহা ড্রইং রুমে বসতেই আফসান ও বসে পড়লো।তারপর তার মনে পড়লো তার গায়ে কিছু নেই।সে কিছুটা অস্বস্তির সাথে বললো
-বসুন।আমি আসছি।
একটা টি শার্ট পড়ে ঝটপট দু কাপ কফি করে আফসান নিয়ে এল ড্রইং রুমে।এতোক্ষন তার মনে চলছিল নানান প্রশ্ন।এই মেয়ে এখানে কেন,কিভাবে!
আফসান কে দেখেই স্নেহা উঠে দাঁড়াল।আফসান বসতে বসতে বললো
-বসুন।না জিজ্ঞাস করেই কফি করে আনলাম।
স্নেহা হালকা হেসে বললো
-সমস্যা নেই।
স্নেহার এই হাসি দেখে যেন আফসান এর জ্ঞান হারাবার উপক্রম হলো।সে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো
-হাসবেন না।হাসলে ঠোঁটের নিচের তিল টা খুব বেশি এট্রাক্টিভ লাগে।
বলেই আফিসান জিভে কামড় দিল।ইস!মনের কথা টা সে জোড়ে বলে ফেলেছে!পরোক্ষণেই পরিস্থিতি সামলাবার জন্য বললো
-কিছু মনে করবেন না।ঠাট্রা করলাম।তো কিসের জন্য এলেন?
স্নেহা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে নাহ।আফসান কে কাল থেকে দেখার আগ্রহ তার এতোটাই ছিল যে সে আজ বাসায় উপস্থিত।আর দেখার পর আরেক দফা ধাক্কা।সে কি প্রেমে পড়ে গিয়েছে আফসান নামের এই লোকটির?আরে নাহ!তা কিভাবে হয়!এক বার দেখে কি কারো প্রেমে পড়া যায় নাকি!আর এই লোকটা ও তাকে কি চিনতে পারছে নাহ!যার ছবি এঁকেছে তাকে বলছে কি দরকারে এসেছে!স্নেহা বিরক্ত মুখে বলেই ফেললো
-বাব্বাহ!যার ছবি এঁকেছেন তাকে চিনতে পারছেন নাহ?
(চলবে)