দু’মুঠো প্রেম পর্ব-১১

0
6030

#দু’মুঠো_প্রেম
#ফারজানা_আফরোজ
১১

— চুলগুলো খোঁপা করবে নাকি কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলবো?

— আমার চুল আমি খোলা রাখবো নাকি খোঁপা করব সম্পূর্ণই আমার ইচ্ছা। আপনি বলার কে?

— তোমার অবাধ্য চুলগুলো আদুরীকে জ্বালাচ্ছে তাড়াতাড়ি খোঁপা করো নয়তো ওর ঘুমের অসুবিধা হবে।

আদিবা খেয়াল করলো আসলেই তার লম্বা চুলগুলো আদুরীর মুখে গিয়ে পড়ছে। এই প্রথম তার মনে ফয়সাল সম্পর্কে অন্য এক ধারণা সৃষ্টি হলো। নিজের চুল খোঁপা করে চোখ বুজে সিটে হেলান দিয়ে শুয়ে রইলো সে।

প্রায় ছয় থেকে সাত ঘণ্টা পর এসে পৌঁছাল সাজেক তারা। ঠাণ্ডা পরিবেশ। আকাশে চাঁদ তাঁরা না থাকলেও জায়গাটা তাদের ভীষণ আকর্ষণ করেছে। দুইটা রুম বুক করা হলো। একটিতে থাকবে অরিন, আদিবা ও আদুরী। অন্যটিতে ফয়সাল ও আরিফ।

সারাদিনের ক্লান্তি তাদের সবাইকে ঘিরে ধরেছে। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। রাত এগারোটা, আদিবার প্রচণ্ড ক্ষুধা লাগায় ঘুম থেকে উঠে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো সেই অচেনা অজানা মানুষটির চেনা নাম্বারটি তাকে রাত নয়টায় তিনটা কল দিয়েছে। তড়িঘড়ি করে ফোনটা নিয়ে সেই নাম্বারে ডায়াল করতেই দেখলো ফোন বন্ধ। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

— আপনি মানুষটি বড় অদ্ভুদ। যেখানে রাত বেড়াতে ছেলে মেয়েদের চোখের ঘুম কেড়ে নেয় এই মুঠোফোন সেখানে আপনি ফোন বন্ধ করে ঘুমাচ্ছেন। অদ্ভুদ বলেই আপনার সাথে কথা বলতে ভীষণ ভালো লাগে। কিন্তু এই ভালো লাগা কখনোই ভালোবাসা হতে পারে না। কারণ আমরা দুজন ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। আমি জানি আপনি আমাকে কিছু বলতে চান সব বুঝা সত্বেও আমি এড়িয়ে চলি কারণ, আমি চাই আমরা অচেনা অজানা থেকেই বন্ধু হয়ে থাকতে। যে সম্পর্কের কোনো নাম নেই শুধু আছে অনুভূতি।

ফোনটা বিছানার উপরে রাখলো। অরিন ও আদুরী বেঘোরে ঘুমাচ্ছে কিন্তু তার চোখের ঘুম এখন আর আসবে না। তাই ধীরে ধীরে দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা খুলে বারান্দা দিয়ে একদম কর্নারে গিয়ে দাঁড়ালো। মৃদু বাতাসে তার খোলা চুলগুলো বার বার এলোমেলো হয়ে দুল খাচ্ছে। আকাশে কয়েকটা তারা আর অর্ধেক চাঁদকে দেখে মুচকি হাসলো। সামনে দেখা যাচ্ছে বিশাল পাহাড় দাঁড়িয়েছে আছে। লাইটের আলোতে ভীষণ চমৎকার চারপাশটা বুঝা যাচ্ছে তবে সাদা মেঘের ভেলা স্পষ্ট বুঝা না গেলেও অস্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে আদিবার চোখে। হাতে ফোন না থাকায় ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। এই সময়ে তো কয়কটি পিক সে তুলতেই পারতো কিন্তু এখন মোটেও তার যেতে ইচ্ছে করছে না রুমে। এত সুন্দর প্রকৃতির ভালোবাসা রেখে কি করেই বা সে যাবে।

“বালিকা তুই ভুল করিয়া
খুলিসনে তোর চুল
না হয় আমি নয়ন জুড়িয়ে
করতে পারি ভুল
নয়ন জুড়ানো রেশমি চুলে
হৃদয় ছুঁয়ে যায়
আদর করে দিবো তোকে
আমার স্বপ্নে আয়“।

আবেগময়ী কণ্ঠস্বর শোনে পিছন ঘুরে ফয়সালকে দেখতে পেতে রেলিংয়ের উপর হাত রেখে উত্তর দিল আদিবা,

— আপনি এইখানে? ঘুমাননি?

— তোমার খোলা চুলের নেশা যদি আমার চোখ থেকে না কাটে তাহলে ঘুমাবো কিভাবে? খোলা চুল তুমি বলে দাও কেনো মুগ্ধ না হবে কেউ তোমার মায়ায়?

ফয়সালের কবি কবি ভাবের কথা শোনে মুচকি হাসলো আদিবা। ফয়সাল এইবার সেই হাসির দিকেই তাকিয়ে থেকে চোখ বন্ধ করে শ্বাস ছেড়ে বলল,

— আমাকে ভালোবাসা যায় না? তোমার আব্বু আর তুমি কেন আমায় দেখতে পারো না। আমি তো খারাপ কোনো কাজ করি না বরং লোকের উপকার করি। আমার কাজ নিয়ে তো তোমার কিংবা তোমার পরিবারের গর্ব করা উচিৎ।

আদিবা কথা ঘুরানোর জন্য বলল,

— প্রচণ্ড ক্ষুধা লাগছে কিছু খেতে পারবো?

মুচকি হেসে উত্তর দিলো ফয়সাল,

— চলো।

রাতের খাবারে ছিল ব্যাম্বু চিকেন। যা ওখানকার বিশেষ খাবারের মধ্যে অন্যতম। এখানেও সেই বাঁশের সুনিপুণ ব্যবহার। আগুনের অনিয়ন্ত্রিত তাপে বাঁশের ভেতরেই সেদ্ধ হয় মুরগির মাংস। আর সাথে পরোটা।

খাওয়া শেষে ফয়সাল ও আদিবা রাতের সৌন্দর্য দেখতে এগিয়ে গেলো হেলিপ্যাডের কাছাকাছি একটি জায়গায়। যেখানে বেঞ্চের ধারেই অর্ধেক চাঁদের আলোয় আলোকিত ছিল পুরো উপত্যকা। কয়েকটি তাঁরা থেকে এখন শত শত তাঁরা আকাশে বিরাজ করছে। হঠাৎ আকাশে হালকা মেঘ তাদের দুজনের চোখের মধ্য ভেসে উঠলো।

— দেখেছেন জায়গাটা কত সুন্দর দেখেই চোখে নেশা ধরে যাচ্ছে।

— একদম তোমার এলোমেলো কালো লম্বা চুলের মতো। যতবার দেখি ততবারই নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি আমি।

— বড্ড অসভ্য লোক আপনি। আচ্ছা বলেনতো সাজেকের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা কোনটি?

— সাজেকের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা হচ্ছে কংলাক পাহাড় ও হ্যালিপ্যাড। কংলাক পাহাড়ের সৌন্দর্যের কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সাজেক ভ্রমণে আসা ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে এক প্রধান আকর্ষণ এই কংলাক পাহাড়। এটি মূলত কংলাক পাড়ায় অবস্থিত। যা সাজেক ভ্যালির একেবারে শেষ প্রান্তে অবস্থিত লুসাই জনগোষ্ঠীর দ্বারা অধ্যুষিত একটি এলাকা। কংলাক পাহাড়ের পরেই আসে হেলিপ্যাডের কথা। সূর্যোদয়ের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখা যায় এই হেলিপ্যাড থেকে।

— সাজেক ভ্যালী নিয়ে দেখছি পিএসডি অর্জন করে ফেলেছেন।

— যখনি শুনেছি তুমি আসবে তখন থেকেই সাজেক নিয়ে পড়াশোনা করতে থাকি।

অবাক হয়ে গেলো আদিবা। সাজেক নিয়ে পড়াশোনা করা যায় নাকি? মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে বলল,

— সাজেক নিয়ে পড়াশোনা আবার হয় নাকি?

— হাহাহা। নাহ আসলে সাজেক ভ্যালি সম্পর্কে জানার জন্য গুগোল, ম্যাপ, ইউ টিউব, এমনকি বন্ধুরের কাছ থেকে অনেক কিছু জেনেছি। কোথায় কি আছে? কোন জায়গা ভীষণ সুন্দর এই আর কি। তোমাকে তো ঘুরাতে হবে তাই না। বিয়ের পর আমরা শুধু ঘুরবো কেমন?

— অসভ্য লোক। আমি একটা বললে উনি আরেকটা বলে। রুমে চলুন আদুরী উঠে পরবে।

আদুরীর কথা মনে হতেই ফয়সাল বলল,

— বুড়িটা কিছু খেয়েছে? অরিনও মনে হয় খায়নি কিছু।

— ওরা ঘুমাচ্ছে।

ফয়সাল দোকান থেকে কিছু খাবার প্যাকেট করে নিয়ে গেলো। রিসোর্টে গিয়ে আদিবার হাতে দুইটা খাবারের প্যাকেট তুলে দিয়ে বলল,

— রাতে না খেয়ে থাকা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এখন ওদের ডেকে খাইয়ে দিবে। আর শুনো জোরে জোরে ডাকবে না আস্তে আস্তে ভালোবেসে ডাকবে। ঘুমানো ব্যাক্তিকে জোরে ডাকলে তার ব্রেনের সমস্যা হয়। বুঝছো?

আদিবা তার মাথা এদিক ওদিক হেলিয়ে বুঝালো সে বুঝছে। খাবারের প্যাকেট নিয়ে রুমে যেতে নিলেই আচমকা ফয়সাল হাত ধরে টান দিয়ে একদম কাছে মিশিয়ে আদিবার চুলে মুখে ডুবিয়ে চুলের উপর ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে মুচকি হেসে বলল,

— নেশাটা কমানোর জন্য এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সরি আদু। লাভ ইউ। যাও ঘুমিয়ে পড়ো।

আদিবা আর কথা বাড়ালো না। সে চলে গেল রুমে। রাতে আদুরীকে আর অরিনকে ঘুম থেকে উঠিয়ে খাবার খাইয়ে দিয়ে তিনজন একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালে গরম চা হাতে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়ের আমেজ উপভোগ করছে আদিবা ও অরিন। আদুরী এখনও ঘুমাচ্ছে। অরিন আকাশ পানে তাকিয়ে থেকে বলল,

— শুভ্র মেঘের পিছুপিছু ছুঁটে যেতে কার না ইচ্ছে করে। মেঘের ভেলায় হারিয়ে যেতে, আকাশের মেঘদের সাথে কথা বলতে চায় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু কংক্রিটের এই শহরে মেঘেদের নাগাল পাওয়া দায়। তাইতো মানুষ মেঘের রাজ্যে গমন করার জন্য ছুঁটে আছে এই সাজেক। চোখের সামনে যখন বিশাল বড় পাহাড় আর শুভ্র মেঘের ছোঁয়া পাওয়া যায় তখন এই মন বারবার বলে উঠে, কংক্রিটের শহরে না থেকে চলে আয় প্রকৃতির সবুজ রঙের দেশে, চলে আয় শুভ্র রাঙা মেঘের দেশে।

আদিবা শব্দ করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,

— ভদ্রতার খাতিরে নিশব্দে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে এসেছি এতদিন কিন্তু আজ প্রকৃতির সাথে থেকে মনের ভিতরে থাকা বড়োলোকের ভাবটা কমিয়ে ভীষণ ভালো লাগছে। নিশব্দে চায়ের কাপে চুমুকের নেই কোনো আনন্দ কিন্তু শব্দে করে চায়ের কাপে চুমুক দিলে মনে হয় চায়ের কাপটা বলছে, আজ বেজেছে নূপুরের শব্দের মতন তোমার ঠোঁটের শব্দ আমার গায়ে। এই শব্দে আমি বারবার হারাতে চাই কিন্তু তোমরা ভদ্রতার নাম করে বড়লোকি স্বভাবের কারণে আনন্দ থেকে বঞ্চিত হই আমি।

চলবে,