#নিভৃতে_যতনে
#Part_24
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
রোয়েনকে রান্না করতে দেখে আমার চোখ চড়কগাছ। বিস্ময়ে অভিভূত আমি। অবিশ্বাস্য নয়নে তাকিয়ে থাকি সামনে। স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে বলে উঠি,
— আপনি রান্না জানেন?
আমার কন্ঠ শুনে রোয়েন মাথা তুলে আমার দিকে তাকান। ভ্রুকুটি কুঁচকে বলেন,
— রান্না না জানলে কি রান্নাঘরে আসতাম?
কথাটা শোনা মাত্র আমি থমথম খেয়ে যাই। অস্ফুটস্বরে বলি,
— না মানে ছেলেদের কখনো রান্না করতে দেখিনি তো তাই একটু…
আমার কথার মাঝে রোয়েন ফোঁড়ন দিয়ে বলে,
— রেস্টুরেন্টে তো দেখছ নাকি?
আমি কিছুক্ষণ ভেবে মাথা দুলিয়ে বলি,
— হ্যাঁ।
— রেস্টুরেন্টে কিন্তু রান্না থেকে শুরু করে থালাবাসন ধোঁয়া, খাবার সার্ভ করা, টেবিল ও ফ্লোর পরিষ্কার করা সবই ছেলেরা করে। তখন কিন্তু তাদের দেখে কারো অবাক লাগে বরং স্বাভাবিকই লাগে। অথচ এই একই কাজই যদি ছেলেরা বাসায় করে তাহলে সকলে যেন অবাকের শেষ চূড়ায় চলে যায়। ব্যাপারটা অদ্ভুত না?
আমি এতক্ষণ রোয়েনের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। রোয়েনের কথা শেষে কথাগুলো যেন আমার মস্তিষ্কেও টনক নাড়ে। আসলেই তাই তো! আমি রোয়েনের দিকে থমথম দৃষ্টিতে তাকাতেই সে বলে,
— এর মূল কারণ কি জানো? আমাদের সমাজ। তারা আমাদের সকলের মধ্যে একটা চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, মেয়েরা ঘরের কাজের জন্য আর ছেলেরা বাহিরের কাজের জন্য তৈরি। আর এই চিন্তা পোষণ করেই তো সকলের চিন্তা ধারা এমন হয়েছে যে, যে কাজ বাহিরে ছেলেদের জন্য সম্মান সেটাই ঘরের চারদেয়ালে অসম্মান।
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলি,
— কথাটা ভুল বলেন নি। কিন্তু কতজনেই বা ভাবে এইভাবে?
— যে কয়জন ভাবেই তাতেই হবে।
— সে যাই হোক! আপনি রান্না কিভাবে শিখলেন?
রোয়েন চপিং বোর্ডে শসা কাটতে কাটতে বলে,
— জব পাওয়ার আগ পর্যন্ত ব্যাচেলর বাসায় থেকেছি আমি। তো সেই সুবাদে রান্না-বান্নাটা রপ্ত করতে হয়েছিল।
— আপনি ব্যাচেলর বাসায় থাকতেন?
— হুম।
— আচ্ছা আপনি যান বাকিটা আমি করে নিচ্ছি৷
— আরেহ হয়েই গিয়েছে সব।
— তাও আপনাকে রান্নাঘরে দেখতে অস্বস্তি লাগছে আমার।
রোয়েন আমার মুখ পানে তাকিয়ে বলে,
— সংসার যেহেতু দুইজনের সেহেতু দায়িত্বও দুইজনেরই। তুমি করো আর আমি করি একই কথা।
আমি ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে রোয়েনের দিকে তাকিয়ে বলি,
— তাহলে এরপরের শিফট আমার।
— আচ্ছা।
____________________________
আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় চারদিক আজ বেশ নীরব। তেমন কোন সোরগোল নেই।দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে আমি বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা বই নিয়ে বসি আর আমার পাশেই বসে রোয়েন ল্যাপটপ চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি বেশ ক্ষানিকটা সময় এইভাবেই বইয়ের পাতা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে রেখে দেই। কেন জানি না বইয়ের পাতায় মন ঠেকছে না আজ। ঘরের মাঝে থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। বার বার বাহির থেকে ঘুরে আসতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি একবার রোয়েনের দিকে তাকাই। উনি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি গলা ঝেড়ে বলি,
— এই যে শুনছেন?
উনি ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেন,
— হুম বলো।
— বাসায় ভালো লাগছে না। দমবন্ধ হয়ে আসছে।
রোয়েন আমার দিকে শীতল চাহনিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন,
— বাহিরে যেতে চাও?
আমি মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেই। তা দেখে রোয়েন ল্যাপটপে কিছু একটা করে অফ করে দেন। বিছানা ছেড়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলেন,
— যাও! তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।
_________________
দেখতে দেখতে আরও বেশ কিছু সময় চলে গেল। শীত এসে পড়লো সপ্তপর্ণে। কুয়াশার চাদর লেপ্টে গেল শহরের আনাচেকানাচে। সেই সাথে ভারী হলো ঘুমের পাল্লা। শীত সকালের মিষ্টি ঘুম ছেঁড়ে উঠতে উঠতে বেশ দেরি হয়ে গেলো আমার। যার ফলে শেষের দিকে তাড়াহুড়ো লেগে গেল আমার। আজ রোয়েনের এক কাজিনের বিয়ে। সম্ভবত শুভ ভাইয়ার।দুপুর একটার মধ্যে থাকতে তাঁদের বাসায়। সেখান থেকে বরযাত্রী বের হবে এক সাথে। আত্মীয়তা বেশ ভালো বলে গ্রাম থেকে বাবা-মাও চলে এসেছে এই বিয়ে খাওয়ার জন্য। আপাতত তাঁরা শুভ ভাইয়ার বাসাতেই আছে। গতকাল বিকেলে এক কাজে তাদের শুভ ভাইয়াদের বাসায় যেতে হয়েছিল। এরপর কাজ শেষ হতে বেশ রাত হয়ে যাওয়ায় শুভ ভাইয়ার বাসায়ই থেকে যান তাঁরা। তাই রোয়েন সকালেই তাঁদের কাপড় পাঠিয়ে দিয়েছেন যাতে তাঁদের অসুবিধা না হয়।
আমি বেশ তাড়াহুড়ো করছি কিন্তু তাও দেরি হয়েই যাচ্ছে৷ এর মূল কারণ শাড়ি৷ শুভ ভাইয়ার বাসা থেকে আমাকে একটা শাড়ি দেওয়া হয়েছে এবং বলে দেওয়া হয়েছে বিয়েতে আমি যেন এইটাই পড়ি৷ যার জন্য না চাওয়া সত্ত্বেও বাধ্য শাড়ি পড়তে হচ্ছে আমার। এক তো হাতে সময় কম তাঁর উপর এই শাড়ি। ঝামেলা আর ঝামেলা। কথায় আছে না, তারাহুরো করলে কোন কাজ ঠিকভাবে হয় না। আমার সাথেও আজ ঠিক তাই হচ্ছে। আমি বারংবার শাড়ির কুঁচি ঠিক করার চেষ্টা করছি কিন্তু বার বারই তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিছুটেই ঠিক হচ্ছে না। আমি যখন এই শাড়ির কুঁচি নিয়ে একদফা যুদ্ধ করছি ঠিক তখনই রোয়েন রুমে এসে বলে,
— কি হয়নি তোমার।
সাথে সাথে আমি পিছনে ঘুরে চেঁচিয়ে বলি,
— এই আপনি! নক করে আসতে পারেন না। আমি শাড়ি পড়ছি তো।
রোয়েন নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলে,
— সেটা তো বিগত এক ঘন্টা ধরেই পড়ছো।
আমি কোনোমতে ভাঁজ করা শাড়ির আঁচলটা ছেড়ে দিয়ে অর্ধেক কুঁচি করা শাড়ির ভাঁজগুলো হাতে নিয়ে রোয়েনের দিকে ঘুরে তাকিয়ে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলি,
— কুঁচিগুলোই তো হচ্ছে না। কি করবো আমি?
রোয়েন অন্যদিকে তাকিয়ে বলেন,
— আমি কি জানি?
আমি নতজানু হয়ে মিইয়ে যাওয়া গলায় বলি,
— একটু সাহায্য করেন।
রোয়েন একবার আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে৷ অতঃপর আমার সামনে হাটু গেঁড়ে বসে বলে,
— তুমি উপর দিয়ে কুঁচি ঠিক করো আমি নিচ দিয়ে ঠিক করে দিচ্ছি৷
আমি মাথা দুলিয়ে কুঁচি করতে মন দিলাম। অবশেষে গিয়ে কুঁচিগুলো ঠিক হলো। উনি নিজ দিয়ে কুঁচি ঠিক করে দাঁড়িয়ে পড়েন। আমি তাঁর দিকে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলি,
— থেংক ইউ!
উনি আমার সামনে এসে কানের কাছে ঝুঁকে শীতল কন্ঠে বলেন,
— সে শুধু আমার হাতটি সামলে নিক বাকি আজীবন আমি তার কুঁচি সামলে নিব।
কথাটা বলেই তিনি দুই-তিন কদম পিছিয়ে গেলেন। আমার দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তি কন্ঠে বলেন,
— তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। আর হ্যাঁ, শাড়িতে পিনআপ ভালো মত করবে। বিয়ে-শাদির মহল সবসময় তোমার দিকে নজর রাখা সম্ভব না।
কথাটা বলেই তিনি দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে যান আর আমি হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি তাঁর যাওয়ার দিকে। মুখে নেই রা। ঠোঁট যুগল আমার কিঞ্চিৎ ফাঁক। আমি দরজার পানে তাকিয়ে থেকে আনমনেই বলে উঠি, ‘লোকটা এমন অদ্ভুত কেন? একে বুঝা বড় দায়।’
#চলবে
#নিভৃতে_যতনে
#Part_25
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
চারদিকে হট্টগোল। মেয়েপক্ষের সকলে ব্যস্ত বরযাত্রীদের আপ্যায়ন করতে। ছুটাছুটি চলছে এইদিক সেদিক। আমরা শুভ ভাইয়ার বাসায় যেতেই সকলে ক্ষণেকের মাঝে রওনা দিয়ে দেয়। যার জন্য কেউ তখন ভালো মত আমায় পরোক্ষ করতে পারেনি। অতঃপর কমিউনিটি সেন্টারে এসে যখন সবকিছু একটু স্থির হলো তখন সবাই হামলে পড়লো আমার উপর। মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম বিধায় মা নিজ থেকেই আমায় সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমিও হাসি মুখে তাদের বরণ করলাম। আমাকে নিয়ে একেকজনের একেক কথা। কেউ ভালো বলছে তো কেউ খুঁত ধরছে। কেউ বা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞেস করছে। বলতে গেলে, বাঙ্গালী আত্মীয়দের আসল কাজ যা আরকি। প্রথমে এতটা বিরক্ত না লাগলেও আমি এখন চরম বিরক্তি। কখন না জানি মুখ ফোসকে কিছু একটা বলে বসি আর তা বোমা বিস্ফোরণ মত বিস্ফোরিত হয়ে উঠে। একান্ত ব্যাপারটা ব্যক্তিগত হলে এতক্ষণে হয়তো কথা শুনিয়ে দিতাম কিন্তু বিষয়টা যে ব্যক্তিগত না৷ আমি কিছু একটা বললেই তা এখন তিল থেকে তাল হবে, সেই সাথে অপদস্ত হবে মা ও বাবা। যা কিছুতেই আমি চাই না। যারা আমায় এত ভালোবাসে তাদের অসম্মান কি আর মানা যায়? আমি কোনভাবে জায়গাটা থেকে কেটে পড়তে চাইছি কিন্তু এই আত্মীয়রা আমরা পিছে কাঁঠালের আঠার মত লেগে আছে। ছাড়ছেই না আমায়। অসহ্য! বেশ কিছুক্ষণ পর কোথ থেকে জেরিন আর ফাহিম এসে হাজির হলো। জেরিন জানালো যে, নুরি আর নীলা আপু আমায় খুঁজছে। আমার সাথে কি যেন কাজ আছে তাদের। কথাটা শুনে মাও আর নাকচ করলেন না। পাঠিয়ে দিলেন ওদের সাথে। আত্মীয় নামক বিচ্ছু বাহিনীর দল থেকে মুক্তি পেয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচি আমি ৷ ক্ষণেই একবার চোখ বুলিয়ে জেরিন আর ফাহিমকে দেখে নিলাম। দুইজনই সমবয়সী। তাই চঞ্চল ভাবটা একটু বেশি। বেশ কিছু দূর যেতেই দেখি রোয়েন সটান হয়ে দাঁড়িয়ে এক হাতে মোবাইল টিপছে আর অন্য এক হাতে গাড় নীল পাঞ্জাবীর পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছে। জেরিন আর ফাহিম গিয়ে রোয়েনের সামনে দাঁড়াতেই আমিও দাঁড়িয়ে পড়ি। জেরিন আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,
— ভাবী তুমি থাকো আমরা আসছি।
আমি জেরিনের মুখের দিকে কৌতূহল দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি,
— কিন্তু নুরি আর নীলা আপু কোথায়? তারা না আমার খোঁজ করছিল?
জেরিন কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফাহিম বলে উঠে,
— ভাবী যে তোমার খোঁজ করছিল আমরা ঠিক তার কাছেই তোমাকে নিয়ে এসেছি।
কথাটা কর্ণপাত হওয়া মাত্র বিস্ময়ে আমার নয়ন দুইটি বৃহত্তম আকার ধারণ করে। ঠোঁট দু’টির মাঝে বিরাজমান হয় কিঞ্চিৎ ফাঁক। জেরিন কনুই দিয়ে ফাহিমের পেটে গুতা দিয়ে বলে,
— বেশি কথা বলিস তুই। চুপ থাকতে পারিস না।
ফাহিম পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
— রোয়েন ভাইয়া দেখো এইখানে পুরুষ নির্যাতন হচ্ছে। তুমি কিছু বলো।
রোয়েন এইবার তাঁর মুঠোফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলেন,
— বেশি কথা বলার শাস্তি এমনই হয়। জেরিন এই গর্দভকে নিয়ে বিদাই হো তো।
জেরিন কিছু না বলে ফাহিমকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। ওরা যেতেই আমি চট জলদি জিজ্ঞেস করে বসি,
— আপনি মিথ্যে বলে আমায় কেন আনালেন?
রোয়েন আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
— স্বাদে কি তোমায় ডাফার বলি? আত্মীয়দের সামনে যদি ওরা গিয়ে বলতো আমি খোঁজ করছি তাহলে বিষয়টা কেমন হতো? খোঁচাচ্ছিল তো এইভাবেই এরপর তা মাত্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যেত।
রোয়েনের কথার মর্ম বুঝতে পেরে মিইয়ে যাই আমি। তার মানে রোয়েন এতক্ষণ সবই দেখছিল আর আমার বিরক্তিটা বুঝতে পেরেই সেখান থেকে বের করে নিয়ে এসেছে আমায়। কিন্তু তাও কথাটা না বুঝার ভাণ করে মিনমিনে গলায় বলি,
— খোঁজ করছিলেন কেন?
রোয়েন পাঞ্জাবীর পকেটে মোবাইল পুড়তে পুড়তে বলে,
— নিজের দিকে একবার তাকাও তো।
আমার এইবার ভ্রু কুঁচকে আসে। আমি রোয়েনের দিকে একবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। কিন্তু বিষয়টা ধরতে না পেরে রোয়েনের দিকে তাকাতেই উনি স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে উঠেন,
— কোমরের পাশ দিয়ে শাড়ি নেমে গিয়েছে। বলেছিলাম না ভালো মত পিন করতে? করো নি কেন?
ঘটনাক্রমে বুঝতে আমি দ্রুত পিছন দিয়ে আঁচল টেনে সামনে নিয়ে আসি।
— না মানে..
রোয়েন আমার কথা অনাগ্রহ করে বলেন,
— শাড়ি যদি সামলাতে না পারো তাহলে পড়ো কেন?
আমি মিনমিনে গলায় বলি,
— আপনি সামলাবেন বলে।
কথাটা মুখ ফোসকে বলে ফেলি আমি। যার ফলে এখন আড়ষ্টে পড়ে যাই। তিনি গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
— সামলানোর মানুষ আজ আছে তো কাল নেই। তাই নিজেই নিজের উপর নির্ভরশীল হওয়া শেখো।
কথাটা শোনা মাত্র আমার মন বিষিয়ে যায়। ভিতরটা কেমন হাহাকার করে উঠে। চুপ হয়ে যাই আমি। আমাকে এইভাবে চুপ থাকতে দেখে রোয়েন তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন,
— যাও! ওয়াশরুমে গিয়ে ঠিক করে নাও। আর আমি তোমার আশেপাশেই আছি৷ বিব্রতবোধ করার দরকার নেই।
_____________________
শুভ ভাইয়ার বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় সপ্তাহখানেক হলো। সকল অনুষ্ঠান শেষে পুনরায় যে যার মত জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বাবার স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা শেষে শীতের ছুটি চলছে বলে আপাতত বাবা-মা দুইজনই আরও সপ্তাহখানেক থাকবেন৷ এতে অবশ্য আমি অনেক খুশি। এখন আর একা সময় পার করতে হবে না। কথা সঙ্গী হিসাবে তারা আছে। সেই সাথে তাদের অতুল ভালোবাসাও আছেই। নিজের আপন মেয়ের চাইতে কম ভালোবাসেন না তারা আমায়। অনেক সময় আমি নিজেই দ্বিধায় পড়ে যাই এরা আসলে আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি নাকি আসল বাবা-মা। বাহিরের মানুষের কথা না হয় বাদই দিলাম।
গোধুলির লগ্ন। শীতে আছন্ন পরিবেশ। কনকনে শীত না হলেও মোটামুটি ভালোই শীত পড়েছে এইবার। গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে ড্রয়িং রুমে বসে মা-বাবার সাথে বসে বাদাম চিবুচ্ছি আর গল্পগুজব করছি। বাবা তার ছোট বেলার কাহিনী শুনাচ্ছেন। সেই সাথে তিনি যুদ্ধের সময় কি দেখেছিলেন, করেছিলেন, তার পরিবার কিভাবে বেঁচে ছিল, কিভাবে তারা বাঙালী যোদ্ধাদের সাহায্য করেছিলেন তাও বলছেন। আমি অবশ্য বেশ মনোযোগ দিয়েই এইসব শুনছি। আমার এত আগ্রহ দেখে বাবা যেন দ্বিগুণ উৎসাহের সাথে গল্পগুলো বলা শুরু করলেন। গল্প গুজব করতেই করতে কখন যে সন্ধ্যা ছয়টা অতিক্রম করে রাত নয়টা বেজে যায় তা টেরই পাইনি আমরা। হঠাৎ ঘড়ির দিকে নজর যেতেই টনক নাড়ে। রোয়েন কোথায়? সে তো সবসময় ছয়টা কি সাড়ে ছয়টার মাঝে বাসায় এসে পড়ে। আর দেরি হলে তো উনি ফোন করে জানিয়ে দেন। কিন্তু আজ তো উনি আমায় কোন ফোন করেন নি। মাকে করেছিলেন নাকি? তাৎক্ষণিক আমি মাকে জিজ্ঞেস করি,
— মা! উনি কি আজ আপনাকে ফোন করে বলেছিলেন যে তার দেরি হবে বা এমন কিছু?
মা নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর দেন,
— না এমন কিছু তো বলেনি মা। কেন?
— তিনি তো সাধারণ এত দেরি করে না আর দেরি করলেও জানিয়ে দেন।
মাঝ দিয়ে বাবা বলে উঠেন,
— ফোন দিয়ে না-হয় দেখো।
আমি আর সময় অবচয় না করে দ্রুত রোয়েনকে ফোন লাগাই। কিন্তু একি তাঁর ফোন বন্ধ। আমি আরও বেশ কয়েকবার চেষ্টা করি কিংবা না ফোন বন্ধই। এইবার আমরা সকলে চিন্তায় পড়ে যাই৷ রোয়েনের অফিসের নাম্বার বা কোন কলিগের নাম্বার আমার কাছে নেই। কখনো দরকার পড়ে নি বিধায় আগ বাড়িয়ে আর রাখাও হয়নি। যার ফলে এখন চেয়ে আমি তার অফিসে ফোন করে তাঁর খোঁজ নিতে পারছি না। বাবা আর আমি মিলে অগণিত বার রোয়েনের নাম্বারে ফোন দিতে থাকি কিন্তু প্রতিবারই সেই একই তিক্ত ধ্বনি কম্পিত হচ্ছে, “নাম্বারটি এখন বন্ধ আছে। অনুগ্রহ করে আবার চেষ্টা করুন।”
ধীরে ধীরে মায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে আসে। চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েন তিনি। হাঁসফাঁস করতে থাকেন তিনি। মলিন হয়ে আসে মুখ৷ বাবাও কেমন চিন্তিত হয়ে পড়েন।এইদিকে আমার মনও খচখচ করতে শুরু করে দেয়। চঞ্চল ভঙ্গিতে আমি বার বার রোয়েনের মোবাইল ফোন মিলাচ্ছি। কিন্তু ফল প্রতিবারই শূন্য। সময় যত যেতে থাকলো ততো আমাদের দুশ্চিন্তার পরিমাণ বাড়তে থাকলো। কখন যে ঘড়ির কাটা নয়ের ঘর থেকে গড়িয়ে দশের ঘরে গিয়ে ঠেকে বুঝাই গেল না। বেশখানিকটা সময় পেরানোর পর বাবার ফোনে একটা কল আসলো। জানা গেলো রোয়েন বাইক এক্সিডেন্ট করেছেন। তাকে হসপিটালে নেওয়া হয়েছে আমরাও যাতে সেখানে পৌঁছে যাই। কথাটা শোনা মাত্র আমি স্থির হয়ে গেলাম। পা দুটো যেন অসাড় হয়ে পড়লো। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকু যেন আমি হারিয়ে ফেলি। হৃদস্পন্দন প্রায় থেমে যায়। বার বার কর্ণধারে বাজতে থাকে রোয়েনের এক্সিডেন্টের কথা। পাশে মা কাঁদছেন এবং পাগল প্রায় আচরণ করছেন হসপিটালে যাওয়ার জন্য। বাবাও যাওয়ার জন্য তোড়জোড় লাগিয়ে দিয়েছেন। সকলের এত উত্তেজনা ভাব-ভঙ্গির মাঝেও আমি নীরব। স্থির। প্রতিক্রিয়া দিতে ভুলে গিয়েছি আমি৷
#চলবে