২১শ পর্বের পর থেকেঃ-
”নিরব সে”
#সাদিয়া_সৃষ্টি
২২শ পর্ব
–আমাকে সব বল, এতদিন যেই কথাগুলো বলতে চাইছিলে।
–আমি বলব, ডাক্তার সাহেব?
নিজের প্রশ্নের উত্তর হিসেবে আরেকটা উত্তর পেয়ে খুশি হল না ওয়াফিফ। সে রেগে গেল। তবু নিজের রাগ কমাতে চোখ বন্ধ করে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নিজের মনে মনে কয়েকবার বলল –
”এতদিন আমি ওকে ভুল বুঝেছি, ও রাগ করতেই পারে। ওকে? কিন্তু আমার রাগ করা যাবে না।”
তারপর চোখ খুলল সে। সামনে জিনিয়াকে দেখে এই প্রথমবার তার অন্যরকম অনুভূতি হল। চাঁদের আলো না হোক, লাইটের আলোতেও খারাপ লাগছে না। আগেও জিনিয়াকে অনেকবার দেখেছে সে। কিন্তু এভাবে ভেবে দেখে নি ওয়াফিফ। সে হা করে তাকিয়ে রইল জিনিয়ার দিকে। জিনিয়া নিজেও ওয়াফিফ কে অনেকদিন পর সামনাসামনি দেখে কান্না করবে করবে অবস্থা। তার চোখের কোণে পানি জমছে। কিন্তু তবুও কান্না করছে না। করবে কেন সে? এতদিন ধরে একবারও খোঁজ নেয় নি ওয়াফিফ। তার সামনে নিজেকে দুর্বল হিসেবে জিনিয়া নিজেকে প্রকাশ করতে রাজি নয়।
ওয়াফিফ এর ধ্যান তখন ভাঙল যখন ওর মুখের সামনে দিয়ে একটা মাছি ভনভন করতে করতে উড়ে গেল। এমন রোম্যান্টিক সময়ে অন্য মিউজিক শুনে তার খেয়াল হল সে কোথায় আর কেন এসেছে। এবার সে নিজের মনে মনে মাছিটাকে এই জন্য ধন্যবাদ জানালো যে সে খোলা মুখ পেয়ে মুখের ভিতর ঢুকে যায়নি। ভদ্র মাছি।
তারপর সে আবার জিনিয়ার সামনে ঠিক হয়ে দাঁড়াল। জিনিয়াকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসে পড়ল। জিনিয়া তখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। সে বোঝার চেষ্টা করছে আসলে ওয়াফিফের কি হয়েছে। ওয়াফিফ কথা বলা শুরু করল,
–জিনিয়া দেখো…
বলেই কি দিয়ে কথা শুরু করবে সেটাই ভাবতে থাকল ওয়াফিফ। জিনিয়া তার দিকে সেভাবেই তাকিয়ে আছে। ওয়াফিফ মাথা তুলে আবার জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
–কি?
জিনিয়া এর জবাব দিল,
–আপনিই তো বললেন দেখতে, তাই দেখছিলাম।
–তুমি … তুমি না। আচ্ছা, জিনিয়া, এবার সিরিয়াস একটা কথা বলি, মনোযোগ দিয়ে শুনো। তুমি সেদিন জাবিরের সাথে দেখা করতে যাওয়ার আগে ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলে, কিন্তু আমি দেখিনি। আর পরে চেকও করা হয় নি কারণ আমি ভেবেছিলাম তুমি জাবিরের কাছে ফিরে যেতে চাও। আর এটা ভাবার কারণ তার কিছুদিন আগে ছবি ফিরে এসেছিল আর ওর কথা মনে পড়াতেই আমার মনে ভয় চলে আসে যে তুমিও আমার সাথে একই কাজ করবে, সেই জন্যই আমার অনেক খারাপ লেগেছিল। বলতে গেলে তোমার প্রতি অভিমান হয়েছিল আমার। তাই আমি ওরকম ব্যবহার করে ফেলেছিলাম তোমার সাথে। এমন করা উচিত হয় নি। আমার ভেবে দেখা উচিত ছিল। সব বিচার বিবেচনা করে কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু আমি তখন ওই পরিস্থিতিতে ছিলাম না, তাই তোমার উপর নিজের সব রাগ ঝেড়ে ফেলেছিলাম। আমি অমনটা করতে চাই নি। কিন্তু তোমার সাহে জাবিরকে দেখার পর আমার আরও বেশি রাগ হয়েছিল। তাই আমি কি করেছি না করেছি আমি নিজেই জানি না আর…
ওয়াফিফ আর কিছু বলতে যাবে তার আগেই জিনিয়া ওয়াফিফকে জড়িয়ে ধরল। জিনিয়ার জন্য এতটুকু কথাই অনেক ছিল। জিনিয়া শুধু এটাই চাচ্ছিল যেন ওয়াফিফ তাকে বিশ্বাস করে। আর সেটা ওয়াফিফ করেছে। শুধু বিশ্বাস করে নি, জিনিয়াকে নিজের কাজের ব্যাখ্যা দেওয়াকে প্রয়োজনীয় বলে মনে করেছে, সে চেয়েছে জিনিয়াকে নিজের কথা বলার সুযোগ দিতে। এটাই অনেক। জিনিয়া আজ ওয়াফিফের বুকে নিজের মুখ লুকিয়ে কান্না করে দিল। কিন্তু এবার জাবিরের জন্য না, ওয়াফিফের জন্য। বেশ কিছু সময় কান্না করার পর জিনিয়া ধীরে ধীরে শান্ত হয়। তবুও সে ফুঁপিয়ে চলেছে। আর ওয়াফিফ তাকে সামলাচ্ছে। জিনিয়া নিজেকে ঠিক করে সেভাবেই বসে রইল। ওয়াফিফ জিনিয়াকে আগের থেকে ভালো অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করল,
–এখন ঠিক লাগছে?
–হুম।
–এবার আমাকে বলবে কি বলতে চেয়েছিলে?
–হুম।
–তুমি এতদিন আমার থেকে দূরে থেকেও হুম এর থেকে বেশি কিছু বলা শিখতে পারলে না জিনিয়া।
–হুম।
বলেই যখন জিনিয়া বুঝতে পারল ওয়াফিফ তাকে কি বলেছে সে ওয়াফিফের বুকে হালকা ঘুষি মারল। ওয়াফিফ ও নিঃশব্দে হেসে দিল। সে আবার বলব,
–আর এই নিয়ে তুমি আমার থেকে আলাদা থাকতে এসেছিলে যাতে নিজের কি কি বলতে চাও সেটার জন্য সাহস জোগাড় করতে পারো।
–আপনি জানলেন কি করে?
–তোমাকে আমি তোমার থেকেও ভালো বুঝি জিনিয়া, শুধু আমাকে তুমি বুঝলে না, আর ওই বাড়িতে একা ফেলে চলে আসলে।
হতাশ সুরে বলে উঠল ওয়াফিফ। ওয়াফিফের বলার ধরন শুনে জিনিয়া আবার হেসে ফেলল।
–আমি আপনাকে একা ফেলে আসলাম মানে?
–এই তো, আমাকে একা রেখে নিজের বাবার বাড়ি চলে এলে।
–আপনি না…
–আমি কি?
–উহুম।
–এখন আবার উহুম মানে কি?
–উহুম।
-আচ্ছা, বুঝছি। তুমি হুম থেকে উহুম বলা শুরু করেছ।
–উহুম।
একটু রেগে বলে উঠল জিনিয়া। ওয়াফিফ এবার বলল,
–আচ্ছা আর জ্বালাচ্ছি না। এবার তো সব বলে ফেলো। রাত অনেক হয়েছে। বেশি রাত জাগা তোমার জন্য ঠিক না। আর আজ রাতে না বলতে পারলে তুমি ঘুমাতেও পারবে না। তাই ঝট করে বলে ফেলো তো জিনিয়া।
-তেমন কিছু না। কয়েক দিন ধরে জাবির বার বার আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমি না করেছি। সেসব আপ্নাকেও বলার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আপনি আমার কোন কথাই শোনেন নি। আর তারপর আমার বান্ধবী রাইসার সাথে কথা বলি। ও আমার আর জাবিরের সম্পর্কে সব জানত তাই। ও আমাকে বলে এক দিনে কথা বলে সব শেষ করতে। আমিও তাই মনে করি। এজন্য আপনার কাছে অনুমতি নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তখনও আপনি আপনার ছবির সাথে ব্যস্ত ছিলেন। তাই আমি আমার বান্ধবিকে নিয়ে সেখানে যাই । আর সব কথা শেষ করি। জাবির আর আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না।
–তোমার বান্ধবী কোথায় ছিল? আমি তো শুধু তোমাদের দুজনকে দেখলাম।
–আসার আগে ও ওয়াশরুমে গিয়েছিল। তখন দেখে থাকতে পারেন।
–বাই দ্য ওয়ে, তুমি কি জেলাস জিনিয়া? তখন যেভাবে বললে, আমার ছবি।
–হুম।
–সিরিয়াসলি?
–না না। আমি কেন জেলাস হবো। আমি কিছু না। কিন্তু আপনি আমাকে জাবিরের সাথে দেখে রেগে গিয়েছিলেন?
–মেইবি আমি জেলাস ফিল করেছিলাম।
–অ্যা ।
–অ্যা না, হ্যাঁ, হতেই পারে, তুমি আমার ১০ টা না, ৫ টা না , একটা মাত্র বউ হও, তোমাকে নিয়ে জেলাস হবো না তো কাকে নিয়ে হবো?
–জানি না।
–আচ্ছা, আজ আল তোমাকে জ্বালাচ্ছি না, কাল থেকে আবার হবে। এখন আমি যাই, কাল নিতে আসব। ব্যাগ গুছিয়ে রেখ। আর যদি এখানে থাকার প্ল্যানিং করে থাক তাহলে বলে দিচ্ছি, আমিও এখানে তোমার সাথে থেকে যাবো। কিন্তু মাকে রাজি করানোর দায়িত্ব তোমার। বাই বাই। দরজা লাগিয়ে দেও।
বলেই এক মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা না করে ওয়াফিফ চলে গেল। জিনিয়া কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বুঝল আসলে এতক্ষণ কি কি হল। তারপর সে গিয়ে দরজা লাগিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ল।
।
।
।
৪ মাস পর,
–জিনিয়া, এই জিনিয়া, কোথায় গেলে? তাড়াতাড়ি রেডি হও, আমাদেকে হাসপাতালে যেতে হবে।
–আসছি।
–হ্যাঁ, তো সেটাই বলছি, আসো না।
ওয়াফিফের কথা বলতে বলতে জিনিয়া হাজির। ওকে ধরে রেখেছে আফিয়া রহমান। আফিয়া রহমানই ওকে রেডি হতে সাহায্য করছিলেন। ওয়াফিফ জিনিয়াকে দেখে আবার হা করে রইল। আফিয়া রহমান সেটা দেখে আসতকরে থাপ্পড় মারলেন ছেলের গালে।
–মুখ বন্ধ কর, আর আলহামদুলিল্লাহ্ বল, হা করে তাকিয়ে না থেকে।
–মা।
–কি মা? এটা আমার মেয়ে আর তুই আমার ঘর জামাই।
–মা।
–এতো ম্যা ম্যা করিস না তো, ছাগল বলে ডাকবে সবাই।
–আম্মাজান।
–আচ্ছা, যা এখন দেরি হয়ে যাচ্ছে না। আর সাবধানে যাবি। জিনিয়াকে না নিয়ে গেলে হত না, দরকার হলে ডাক্তার ঘরে আনতে পারতি।
–নাহ মা, ঘরে আনলে শুধু ডাক্তার না, পুরো হাসপাতাল তুলে আনতে হবে চেক আপের জন্য। তাই তোমার বউ মা কে সরি, মেয়েকে নিয়ে যাই ? সাবধানেই নিয়ে যাবো।
–কিসের ডাক্তার হয়েছিস তুই? নিজের বউ এর চেক আপ করে দিতে পারলে তো আর ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া লাগত না।
–আর অপমান করো না মাতা, অলরেডি বোটম লাইন পার করে গিয়েছে। জিনিয়া চল, নাহলে পুরো এলাকা ডেকে এনে এবার আমার সুনাম শুরু করবে মা।
বলেই জিনিয়ার হাত ধরে নিয়ে গেল ওয়াফিফ। জিনিয়ার এখন ৮ মাস চলছে। ওয়াফিফ আর জিনিয়া ছাড়া কেউ জানে না যে এটা ওয়াফিফের সন্তান না। তবুও ওয়াফিফ যেভাবে জিনিয়ার খেয়াল রাখে, একবারও মনে হয় না যে ওয়াফিফ আসল বাবা না। জিনিয়াও রোজ শুকরিয়া জানায় সৃষ্টিকর্তাকে। আর রোজ ভয়ে ভয়েও থাকে। তবু কিছু বলে নি কারণ ওয়াফিফ তাকে চুপ করে থাকতে বলেছে। ওয়াফিফ তো এই কথা এক প্রকার ভুলেই গিয়েছে যেন।
জিনিয়াকে নিয়ে চেক আপে যাওয়ার জন্য ওয়াফিফ আবার ড. আফসানা রায়ের কাছে গেল। উনি জিনিয়ার সম্পর্কে সব জানেন। আর ওয়াফিফের বন্ধু হওয়ায় আজ পর্যন্ত সব গোপন রেখেছেন।
অন্যদিকে ওয়াফিফের হাসপাতাল থেকে একটা ব্যাগ দিয়ে যায় ওয়াফিফের এক কলিগ। বাসায় আফিয়া রহমান ছিলেন শুধু তাই তিনিই সেটা নিয়ে নেন। ওয়াফিফের ঘরে রেখে আসার সময় সেটা হাত থেকে পড়ে যাওয়ায় আফিয়া রহমা সেটা এক এক করে আবার ব্যাগে রাখতে শুরু করেন। সব ছিল পেশেন্টের রিপোর্ট। হঠাৎ একটা কাগজে জিনিয়ার নাম দেখে অবাক হয়ে যান। তিনি ভালো করে চোখ বুলালে নিজেই অবাক হয়ে যান। সাথে রাগ এসে ভর করে তার মধ্যে।
চলবে।
[রিচেক করি নি, ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ]
Sadia Hq Sr.