#নীরবে_তুমি_রবে
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ০২
.
উঠনের বারান্দায় হেঁটে হেঁটে মোবাইলে কথা বলছিলো তাসফি। পালন করছিলো তাকে দেওয়া বড় মামার দ্বায়িত্বগুলো। কালকের দিনটা ভালোভাবে কে’টে গেলেই যেন বাঁচে, তারপর সোজা ঢাকা চলে যাবে।
ফোনে কথা বলা শেষ করে উপরেই যাচ্ছিলো তাসফি। সিঁড়ি দ্বিতীয় ধাপ ফেলতেই রান্নাঘর থেকে চিৎকার ভেসে উঠে। সোজা তাকাতেই দেখতে পায় আ’গুনের শিখা, সাথে স্পষ্ট হয় রূপার চেহারা। সময় ব্যায় করে না তাসফি, ছুটে আসে রান্নাঘরে। রূপার গায়ের ওড়নাটা ফেলে দিয়েই তাকে একহাতে কাছে টেনে নেয়, পা দিয়ে আ’গুন নেভানোর চেষ্টা করে পাশে থেকে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দেয় আ’গুণ লাগা ওড়না ‘টায়, নিভে যায় আ’গুন। তাসফি তাকায় রূপার দিকে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠে,
“রূপা! এ্যাই রূপা, ঠিক আছো তো তুমি? লাগেনি তো কোথায়? এ্যাই মেয়ে…..!”
কোন জবাব এলো না রূপার থেকে। মেয়েটা ভয়ে গুটিয়ে আছে তাসফির বুকের অতি নিকটে, দু’হাতে তার হাতের বাহু খামচে ধরে দাঁড়িয়ে আছে, কেঁপে কেঁপে উঠছে, হেঁচকি তুলে কেঁদে চলেছে। পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটাও যেন দায় হয়ে পড়েছে মেয়েটার জন্য। তাসফি বুঝতে পারলো রূপার পরিস্থিতি। তাকে নিয়ে আর দাঁড়াতে চাইলো না সেখানে। এক হাতে রূপার কোমর জড়িয়ে ধরলো তাসফি। রূপাও তাসফির বুকের সাথে আরও গুটিয়ে নিলো নিজেকে, ভর ছেড়ে দিলো তাসফির বুকে, ফুঁপিয়ে কেঁদে গেল। মুহুর্তেই নিজের স্তম্ভিত হারিয়ে ফেললো যেন তাসফি, টিপটিপ শব্দের প্রতিধ্বনিতে দানা বেঁধে নিলে তার বুকে। কি হচ্ছে তার সাথে? কেন হচ্ছে তার অদ্ভুত অনুভূতি? কোন কিছুই যেন তার মস্তিষ্কে ধরা দিলো না, শুধু মনটায় যেন দগ্ধ হতে লাগলো।
কিছুই যেন ভাবতে পারলো না সে। একটা নারীকে প্রথম বারের মতো এতটা কাছে পাওয়ার জন্য’ই কি এই অদ্ভুত অনুভূতির সাথে পরিচয় তার? কিছু বুঝতে পারলো না তাসফি, আর না কিছু ভাবতে পারলো। জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে যথাসম্ভব সামলানোর চেষ্টা করলো, মুহুর্তেই যেন সফলও হলো। রূপার ভর’টা নিজের উপর নিয়ে বেড়িয়ে এলো তাসফি রান্নাঘর ছেড়ে।
.
ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে রূপা। ভয়ের তাড়নায় কেঁপে কেঁপে উঠছে শুধু, কেঁদে চলছে সমানে। ছাড়ে নি তাসফির হাত, গায়ের সর্বচ্চ শক্তিতে এখনো দু’হাতে তার হাত খামচে ধরে আছে। মাথা ঠেকে আছে তাসফির বুকের সাথে। অন্য সময়টাতে কখনোই তাসফির এতটা কাছে আসতো না রূপা, নিজেকে তাসফির থেকে যতটা সম্ভব দূরে দূরেই রাখে। কিন্তু এই মুহুর্তে যেন আশেপাশের কোন ধারণায় নেই তার মস্তিষ্কে, শুধু আছে বিশ্বাসযোগ্য কেউ একজন। যার হাত খা’মচে ধরে বুকে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে, কেঁদে চলছে। মানুষটাকে দেখার ইয়ত্তাও যেন করলো না রূপা, আর না প্রয়োজন করলো।
রান্নাঘরের পাশেই খাবার ঘর, তারপরই বসার ঘর। রূপাকে নিয়ে সেখানেই চলে এসেছে তাসফি, সোফায় বসে বার দুয়েক জিজ্ঞেসও করেছে, কোথায় লেগেছে? শান্ত হতে। কিন্তু আগের মতোই তার জবাব মিলে নি। হয়তো তাসফির কথাগুলো তার কর্ণপাত হলেও মস্তিষ্কে ধারণ করতে পারে নি। হতাশার নিশ্বাস ছাড়লো তাসফি। এক হাতে রূপার মাথা প্রায় টেনেই উঠিয়ে নিলো, গালে এক হাত রেখে আদুরে গলায় বললো,
“এ্যাই! মেয়ে, কোথায় লেগেছে? বলো আমাকে।”
এবার কান্নার দমক কিছুটা কমে এলো রূপার, হুস এলো মুহুর্তেই। বুঝতে পারলো সে, তাসফি তার অতি নিকটে, খুব কাছে। যতটা কাছে সে কল্পনাও করে নি তাসফি কে। তড়িৎ গতিতে সরে এলো তাসফির থেকে, গরম চা পড়া শরীরের বিভিন্ন অংশে কিঞ্চিৎ ব্যাথা পেতেই মৃদু আর্তনাদ বেড়িয়ে এলো মুখ ফুটে। উত্তেজিত হয়ে উঠলো তাসফি, এগিয়ে এলো রূপার কাছে। বলতে লাগলো,
“দেখি দেখাও আমাকে, কোথায় লেগেছে? পুড়েছে কোথাও? কোথায় ব্যাথা করছে….. ”
কথার মাঝেই থেমে গেল তাসফি, তার নজর পড়লো রূপার পায়ের দিকে। ডান পায়ের পাতায় পুরোটায় লাল হয়ে আছে। টকটকে লালচে ঝলসানো টাইপ হয়ে আছে পা’টা। পায়ের অবস্থার গতিবেগ দেখে কিছুটা আঁতকে’ই উঠলো যেন তাসফি।
“এ-কি…. এটা কিভাবে হলো? এতটা পুড়ে গেল কিভাবে?”
বলেই রূপার থেকে সরে এসে নিচু হয়ে পায়ে হাত দিলো তাসফি, সাথে সাথে ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো রূপা। আগের চেয়েও বেশ শব্দ করে যেন কান্না করে দিলো। ব্যাথায় নিজের ভারসাম্য রাখতে না পেরে একহাতে তাসফি কাঁধে চেপে ধরলো, খামচে ধরলো কাঁধের টি-শার্টের অংশ।
“কে এত রাতে চেঁচিয়ে উঠলো? তাসফি! রূপা, এত রাতে তোরা এখানে? হয়েছে টা কি….. ”
বসার ঘরের দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো রূপার বড়মা। ঘরে ঢুকেই তাসফি কে ঝুঁকে রূপার পা ধরে বসে এবং রূপাকে কান্নারত অবস্থায় দেখে নিলো। কথার মাঝেই চুপ হয়ে গেলেন তিনি।
পাশেই তার রুম ও ঘুম’টা হালকা হওয়ায় রূপার করা চিৎকার সহসায় কানে যায় ওনার। ঘুমের ঘোরে ভুল কিছু শুনেছে ভেবে আর ভাবনায় নেয় না বিষয়’টা। কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন স্পষ্ট শুনতে পেল আবার সেই আওয়াজ আর দেরি করলেন না তিনি। ছুটে এলেন এগিয়ে।
তাদের দু’জনকে এমতবস্থায় দেখে এগিয়ে এসে তাসফির পাশে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞাসা করলেন,
“তাসফি! কি হয়ছে রূপার? এত রাতে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো কেন?”
“বলছি মামী, আগে বরফ নিয়ে আসো তাড়াতাড়ি। ওর পা অনেকখানি পুড়ে গেছে।”
“সে কি? কি করে পুড়লো?”
“তুমি বরফ’টা আগে নিয়ে এসো, প্লিজ! ওর পায়ে লাগাতে হবে।”
আর বাক্য ব্যায় করলো না তাসফির বড় মামী ও রূপার বড়মা। ছুটে গেলেন বসার ঘর ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে, খুব অল্প সময় নিয়ে আবার ফিলেও এলেন। বরফ কুঁচি গুলো তাসফির হাতে দিতেই তা হাতে নিয়ে সোফায় থাকা একটা কাপড়ের সাথে পেচিয়ে নিলো, তারপর ঘোষতে লাগলো রূপার পায়ে। পোড়া জায়গায় ঠান্ডা কিছু পেয়ে যেন জ্বালাপোড়া হতে লাগলো। আবারও চেঁচিয়ে উঠলো রূপা, পা ঝাঁকিয়ে বরফ ঘোষতে বারণ করলো তাসফি কে। রূপর কথাগুলো কানে নিলো না তাসফি, নিজের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলো। রূপার বড়মা রূপার কাছে বসলেন, গালে পিছে হাত নাড়িয়ে শান্ত হতে বললেন। বরফ দিলে আরাম লাগবে সেটাও বোঝানেন। কিন্তু তার কোন কিছুই যেন রূপার কানে গেল না। যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলো, ঠান্ডা ছোঁয়ার অনুভব হতেই আরও শিরশির করতে লাগলো, যন্ত্রণা তীব্র হতে লাগলো। বড়মা কে জড়িয়ে ধরলো রূপা, বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকলো। রূপাকে সান্ত্বনা দিয়ে তাসফি কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
“কিভাবে এমনটা হলো রে তাসফি? রান্নাঘরে দেখলাম চায়ের পাতিল সহ গরম চা পড়ে আছে মেঝেতে।”
“গরম চা পড়েছে? আমি তো ভাবলাম আ’গুন….. ”
“আ’গুন? আ’গুন কোথা থেকে আসলো?”
হতাশার নিশ্বাস ছাড়লো তাসফি। তারপর সবটা বলতে লাগলো মামীকে। তাদের কথা শেষ হতেই বসার ঘরে এলেন তাসফির মা রেহেনা পারভিন। মূলত এত রাতে আলো জ্বলতে দেখেই তিনি বসার ঘরে ঢুকেছেন। তাদের কে একসাথে এত রাতে বসার ঘরে দেখে ভেতরে এলেন। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রূপাকে কান্নারত অবস্থায় দেখে অবাক হলেন। উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, ‘কি হয়েছে?’ মায়ের দিকে তাকালো তাসফি। বিরক্ত হয়ে ওনাকেও সবটা খুলে বললো। আদরের ভাতিজির এমতবস্থায় ব্যাপক উত্তেজিত হয়ে উঠলেন রেহেনা। মেয়েটাকে এগিয়ে নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। নিজেও কান্না কান্না ভাব করে হায়! হায়! করতে লাগলো মেয়েটার জন্য।
মায়ের এমন কান্ডে ব্যাপক বিরক্ত হয়ে উঠলো তাসফি। বড় মামী কে যেন তেন বলে সামলে নিলেও তার মা’কে বুঝ দেওয়া যে ঠিক কতটা কঠিন, তা শুধু তাসফি নিজেই জানে। আর এটা তো তার মায়ের আদরের ভাতিজি। মেয়েটাও ফুপির আল্লাদে আটখানা। একটু আল্লাদ পেয়ে যেন আরও আবেগি হয়ে উঠেছে।
রূপাকে কি না বললেও মা’কে প্রায় ধমকে’ই চুপ করিয়ে দিলো তাসফি। সকালে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে বলে আসস্থ করলো। বড়মাও থামতে বললো, হু হা করে থেমে গেল রেহেনা। রূপাকেও শান্ত হতে বললো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে থেমে গেল রূপা। কিছুটা সময় অতিক্রম হতেই ধীরে ধীরে জ্বালাপোড়া কমে এলো, তাসফিও থেমে গেল। রুমে গিয়ে ঘুমাতে বললো রূপাকে। বড়মা ও রূপার ফুপি মিলে নিয়ে যেতে লাগলো রুমে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে না পারায় রেহেনার রুমেই থাকতে হলো। সবাইকে আবারও আসস্থ করলো তাসফি, ব্যাথার ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে বললো। মা, মামীকে বলে রুম ছেড়ে বেড়িয়ে আসার আগে একবার তাকালো রূপার দিকে। এতটুকু সময়েই চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে মেয়েটার, কান্নার দাপটে হলুদ ফর্সা মুখটা লালচে ধারণ করেছে। খুব সময় তাকিয়ে থাকতে পারলো না তাসফি। অজানা এক মায়ায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে চাইলে যেন। মনে হতে লাগলো কিছুক্ষণ আগে রূপার এতটা কাছে আসা, তার বুকে মাথা রাখা। সুপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো তাসফি, নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস চালালো। রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে মনে মনে বলে উঠলো,
“উফ্! তাসফি, কি হচ্ছে তোর সাথে এগুলো? সময় থাকতেই সামলে নে নিজেকে।”
.
.
চলবে…..