নীরব সাক্ষী পর্ব-০৮

0
404

#নীরব_সাক্ষী
#ফারহানা_ছবি
#পর্ব-৮
.
.
.
প্রিয়ন্তির গলা থেকে যেন আর খাবার নামছে না ৷ না খেয়ে উঠে গেল প্রিয়ন্তি ৷ কিন্তু মুন যেন আজ তৃপ্তি করে খেয়েছে তার শশুর মশাইয়ের হাতে , মুন খেয়ে উঠে বাকি খাবার গুলো গুছিয়ে রেখে টেবিল পরিষ্কার করে রুমে চলে যায় ৷ রুমে গিয়ে দেখে রিদ ল্যাপটপে কাজ করছে অথচ রিদ কাজের ফাঁকে-ফাঁকে আড়চোখে মুন কে দেখছে ৷ মুন কে আজ খুব ফুর ফুরে লাগছে ৷ তার ঘন চুল গুলো ছেড়ে দিয়ে গুন গুনিয়ে গান গাইতে লাগলো ……..

আমারও পরানো যাহা চায়
তুমি তাই , তুমি তাই গো
আমারও পরানো যাহা চায়…..

মুন গুন গুন করে গাইতে লাগলো ৷ রিদ মুনের গান পুরো স্পষ্ট না শুনলেও গুন গুন করে সুর তোলা টা শুনতে পাচ্ছে ৷ এই প্রথমবার মুনের গলায় গান শুনছে রিদ অসম্ভব মিষ্টি গলা মুনের ৷ মুন গুন গুন করতে করতে পুরো রুম গুছিয়ে ফেলে অন্য সময় হলে এ রুমে পা রাখতো না যতোক্ষন রিদ জেগে আছে কিন্তু আজ মুন তা করলো না ৷ হয়তো এবার এই নরক থেকে মুক্তি পাওয়ার লোভে মনের ভিতর এতো খুশি মুনের…….

প্রিয়ন্তি রুমে ঢুকে পাইচারি করছে বার বার ৷ মনের ভিতর এক অজানা ভয় কাজ করছে আজ প্রিয়ন্তির ৷ প্রিয়ন্তি বির বির করে একা একাই বলতে লাগলো “” রিদ ভাইয়া কি ভাবিকে ভালোবেসে ফেলেছে? রিদ ভাইয়া কি আমাকে ছেড়ে দিবে? তাহলে আমার কি হবে? আমার যে সব শেষ ৷ না না না আমি আমার অধিকার এক বিন্দুও ছাড়বো না ৷ রিদ ভাইয়া আমার হবে শুধু আমার ৷ ক্ষমা করে দিও ভাবি ৷ আমি বাধ্য হয়ে তোমার অধিকার কেরে নিতে বাধ্য হচ্ছি৷ “” প্রিয়ন্তি ঝটপট একটা কালো শাড়ি পরে নিলো কারন রিদের কালো রং টা ভিষন প্রিয় আর প্রিয়ন্তির গায়ের রং ধবধবে সাদা হওয়ায় কালো রঙের শাড়িটা প্রিয়ন্তির উপর ফুটে আছে ৷ প্রিয়ন্তি চোখে কাজল হাতে দুটো কালো চুড়ি, কানে ঝুমকো , ঠোটে গাঢ় লাল লিপষ্টিক ৷ প্রিয়ন্তি রেডি হয়ে ধির পায়ে রিদের রুমের সামনে এসে দারাতে থমকে যায় মুনের গান শুনে ৷ কি মিষ্টি গলা ভাবির , শুধু একটু রুপের কমতি ৷ প্রিয়ন্তি রুমে উকি দিয়ে দেখে রিদ কাজ করার ফাকে ফাকে মুনে দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছে ৷ তা দেখে প্রিয়ন্তির আবার ও বুকে চিন চিনে ব্যাথা অনুভব করলো ৷ প্রিয়ন্তি হুট করে রুমে ঢুকে গেল ৷ এভাবে হুট করে রুমে ঢুকায় রিদ মুন দুজনে চমকে চায় ৷ মুন প্রিয়ন্তির দিকে তাকিয়ে তার সাজ দেখে বুজতে পারলো প্রিয়ন্তি কেন এসেছে আর প্রিয়ন্তির উপর থেকে রিদের চোখ যেন সরছে না ৷ এটা দেখে প্রিয়ন্তির ঠোটের কোনে জয়ের হাসি ফুটে উঠলো ৷

“” রিদ ভাইয়া আমি রেডি তুমিও ঝটপট রেডি হয়ে নেও৷””

“” কেন কোথাও যাবে?””

“” ভুলে গেলে আমাদের সপিংয়ে যাওয়ার কথা?””

“” ওহ বাট আজ তো শুক্রবার মল বাজার বন্ধ ৷””

“” বন্ধ হলে হবে চলোতো ঘুড়ে আসি”” মুনের দিকে তাকিয়ে আড়চোখে তাকিয়ে বলতে লাগলো প্রিয়ন্তি ..

রিদ আর না করতে পারলো না প্যান্ট শার্ট নিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকে গেল ৷ মুনে কোন ভাবান্তর হলো না মুন যেন মনে মনে চায়ছে রিদ যাক তাহলে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে পারবে৷

প্রিয়ন্তি মুনের হাফ ভাব দেখে কিছুই বুজতে পারছে না ৷ এর মাঝে রিদ রেডি হয়ে বেরিয়ে হেয়ার ব্রাস করে ফোন , পার্স নিয়ে মুনের দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে বেরিয়ে গেল প্রিয়ন্তিও পিছু পিছু বেরিয়ে গেল ৷ ওদের যেতে দেখে মুন সস্থির নিশ্বাস ফেলে দরজা চাপিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো……

পুরো বিকেল সন্ধা বাইরে ঘুরে রাতে ডিনার করে রিদ প্রিয়ন্তি বাড়িতে আসে ৷ রিয়ানা বেগম খেতে আসতে বলতে প্রিয়ন্তি জানায় তারা বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে ৷ কথাটা একটু জোড়ে বললো প্রিয়ন্তি যাতে মুন শুনতে পায় ৷ মুন প্রিয়ন্তির বাচ্চামো বুজতে দেরি হয়নি কেন এরকম করছে ৷ মুনের ঠোটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো যেটা রিদের চোখ এরায় নি ৷ রাতে মুনের শশুর মুন আর শাশুড়ী এক সাথে খেতে বসে ৷ রিয়ানা বেগম এর কোন ইচ্ছে নেই মুনের সকথে এক টেবিলে বসে খাওয়ার কিন্তু খেতে হচ্ছে তার স্বামীর জন্য কারন এখন যদি কোন প্রকার সিন করে তাহলে না খেয়ে উঠে যাবে ৷ রিয়ানা বেগম খেতে খেতে রিদের বাবাকে জ্বিগাসা করে”” রিদের বাপ উকিল কি বললো বললে না তো?””

“” কয়েকদিন সময় লাগবে তবে কাজটা হয়ে যাবে৷””

“” আচ্ছা দেখো যতো তারাতারি সম্ভব যেন হয়৷ তারপর প্রিয়ন্তি মায়ের সাথে বাবুর বিয়েটা দিয়ে দিবো””

শেষ কথাটা শুনে রিদের বাবা হঠাৎ ক্ষেপে ওঠে ৷

“” প্রিয়ন্তির সাথে রিদের বিয়ে কোন ভাবে-ই হবে না রিদের মা””

রায়হান আহাম্মেদ হুট করে খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলেন ৷ রিয়ানা বেগম যেটা মনে মনে ভয় পাচ্ছিলো আর সেটাই হলো.৷ কিন্তু এর রাগ উপরে পরলো মুনের উপর, কটমট করে তাকিয়ে বলতে লাগলো…. “” বেশ্যার ঝি দেখ তোর জন্য আজ আমার সংসারে কতো অশান্তি তুই মরতে পারিস না ৷””

মুন প্রতি উওরে শুধু মুচকি হাসলো এই হাসি দেখে রিয়ানা বেগমের যেন সারা শরীল জ্বলে উঠলো তিনি উঠে মুনের চুল গুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে টানতে টানতে স্টোর রুমে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে দরজা আটকে দিয়ে রাগে ফুসতে ফুসতে চলে যায়৷ মুনের ঠোটের কোনে এখনো সেই হাসি লেগে আছে ৷ মুনের দু- চোখ যেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে ৷ মুন উঠে স্টোর রুমের জানালা খুলে দিয়ে দারায় হীম শীতল ঠান্ডা বাতাস ছুয়ে যাচ্ছে মুন কে , মুনের গায় নেই কোন গরম কাপড় তারপর দারিয়ে আছে হার কাপানো ঠান্ডায়……

মুনের পুরো মন জুরে আবিদের বসবাস যেখানে রিদ বা অন্য কারোর প্রবেশাধিকারের অধিকার নেই ৷ মুন বির বির করে বলে ওঠে …”” হয়তো আমাকে খুব স্বার্থপর মনে করছো আবিদ ৷ হ্যা আমি সত্যি খুব স্বার্থপর তোমাকে ভালোবেসে আমি স্বার্থপর , তুমি হয়তো ভাবছো আমি ছলনাময়ী কিন্তু বিশ্বাস করো আবিদ আমি ছলনাময়ী নই৷ আমি পরিস্তিতি শিকার আমি বাধ্য , তবে বিশ্বাস করো আবিদ আমি তোমার কাছাকাছি না থেকেও তোমার প্রতি বিন্দু মাত্র ভালোবাসা কমে যায়নি বরং দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ৷ জানো আবিদ ভালোবাসা হলো নরম তুলোর মতো আবেগ, বিশ্বাসে মোড়ানো, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না ৷ জানো আবিদ আমার ভালোবাসায় নেই কোন রঙ নেই কোন ঘ্রান নেই কোন রুপ আর না আছে কোন আকার আকৃতি , শব্দ, শুধু আছে তোমার প্রতি আমার তীব্র অনুভূতির এক অদ্ভুত ক্ষমতা ৷ কথা গুলো বলতে বলতে মুনের দুচোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরতে লাগলো ৷ আবিদ কে যে মুন বড্ড ভালোবাসে কিন্তু পরিনতি হলো অন্য কিছু যেটা আবিদ বা মুনের কেউ ভাবতেও পারেনি ৷ মুন মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে অতীতের ভাবনায় ডুব দিলো…………

আবিদ আর মুনের ভালোবাসাময় দিন গুলো যেন খুব দ্রুত পার হতে লাগলো ৷ দেখতে দেখতে একটা বছর পার হয়ে গেল ৷ মুন এস এস সি দিয়ে সরকারি কলেজে চান্স পেয়ে গেল ৷ কিন্তু বিপত্তি বাধলো অন্য যায়গায় মুনের মায়ের কাছে ধরা পরে গেল মুন আর আবিদ সাথে যেনে গেল ৷ আলিয়া বেগম সেদিন মুন কে প্রচন্ড মারধোর করে ৷ আবিদ চেয়েও সে দিলের মার আটকাতে না পেরে মুন কে কষ্টে ছটপট করতে দেখে আবিদের বুকটা ভেঙে চুরে যাচ্ছে ৷ আবিদের বাবা মা দুজনে আবিদ কে প্রচুর বকা দেয় ৷ আবিদের বাবা আফজাল হোসেন সেদিন-ই মুনের মাকে বাসা খালি করার কথা জানিয়ে দেয় ৷ মুনের মা আলিয়া বেগম রাজি হয়ে যান ৷ পরের দিন মুন আর মৃন্ময় কে নিয়ে গ্রামে চলে যান ৷ ওখানে মৃন্ময় আর মুন কে রেখে দিয়ে আবার খুলনায় চলে আসে ৷ বাসা চেন্জ করে ফেলে মৃন্ময় কে নিয়ে আসে কিছুদিন পর কিন্তু মুন কে আনে না ৷ এক প্রকার আবিদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় অন্যদিকে আলিয়া বেগম সে সুযোগে মুনের পড়াশুনা বন্ধ করে দেয় ৷ মাসে একবার দেখা করতে যখন গ্রামে যেত আলিয়া বেগম মুন আলিয়া বেগমের পা ধরে বসে থাকতো যাতে পড়াশুনা বন্ধ না করে দেয় ৷ হয়তো সে দিন আলিয়া বেগমের কঠিন হৃদয় কিছুটা হলেও নরম হয় ৷ মুন জানায় পরিক্ষার সময় খুলনা গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসতে পারবে কিন্তু আবিদের সাথে যদি কোন ভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে তাহলে পড়াশুনা বন্ধ করে দিবেন সাথে বাড়ি থেকে বের করে দিবে ৷ মুন আলিয়া বেগমের কথায় রাজি হয়ে যায় ৷ মুন গ্রামে থেকে পড়াশুনা করতে থাকে তবে আবিদ কে ভুলে নয় ৷ আবিদের সাথে লুকিয়ে চুরিয়ে কথা বলতো মুন ৷ মুন ইন্টার ফার্স্ট সেমিস্টার পরীক্ষা দেবার জন্য খুলনা আসে ৷মুন আসার পর থেকে আলিয়া বেগম কড়া নজরে রাখতো মুন কে তবে মুন খুব সাবধানে থাকতো ৷ এক মাত্র পরীক্ষা দেবার সময় আবিদ লুকিয়ে মুনের সাথে দেখা করতে যেত ৷ আলিয়া বেগম ভেবে নেয় মুন আবিদ কে ভুলে গেছে তাই তিনি আর মুন কে গ্রামে পাঠায় না খুলনা থেকে যায় ৷ মুন পরীক্ষা দেবার সময় একটা মেয়ে সাথে পরিচয় হয় ৷ প্রথম দিন মেয়েটির সাথে খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে যায় ৷ এভাবে কেটে যায় আরো একটা বছর ……

_________ “বউ মা তুমি স্টোর রুমে কি করছো?””( রায়হান আহাম্মেদ)

মুন তার শশুরের গলা শুনে অতিতের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে ৷

“” বা ,, বাবা আসলে … বাকিটা বলার আগে রায়হান আহাম্মেদ বলে উঠলেন ” থাক বউমা আর বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলার প্রয়োজন নেই আমি বুজতে পারছি কি হয়েছে””

মুন স্টোর রুম থেকে বেরিয়ে এসে ডাইনিং টেবিল পরিষ্কার করে এটো বাসন ধুয়ে বাড়ির বাকি লাইট বন্ধ করে রুমে আসতে দেখে রিদ ল্যাপটপে সামনে বসে কাজ করছে ৷ মুন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত একটা বেজে বিশ মিনিট এতো রাত হয়ে গেল মুন বুজতেই পারে নি অবশ্য যখন আবিদের ভাবনায় বিভোর থাকে মুন তখন সময় কখন চলে যায় মুন বুজতেও পারে না ৷

মুন ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে চুলে আচরে ছোট্ট সোফায় বালিস নিয়ে আর কাথা নিয়ে শুয়ে পরলো৷ রিদ পুরোটাই দেখলো মন রুমে ঢোকার পর ওর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নিজের কাজ করতে লেগে গেল ৷ মুন আর কিছু দিন পর এই রুমে থাকবে না কথা ভাবতেই রিদের বুকের ভিতর ফাকা লাগছে ৷ ইচ্ছে মুনে বুকের সাথে চেপে ধরতে যাতে কোথাও যেতে না পারে ৷

মুন ক্লান্তিতে শোবার পর পরই ঘুমিয়ে পরে রিদ হুট করে মুন কে কোলে করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মুনকে জরিয়ে ধরে শুয়ে পরে ৷

_____________ অন্যদিকে আবিদের দুচোখে ঘুম নেই ফোনের স্কিনে মুনের ছবি বুকের সাথে চেপে ধরে শুয়ে আছে ৷

“” আমি খুব তারাতারি তোমায় আমার কাছে নিয়ে আসবো মনপাখি আর একটু কষ্ট সহ্য করো ৷ একবার তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসার পর কেউ তোমাকে আমার থেকে দুরে সরাতে পারবে না ৷ ভালোবাসি মনপাখি ভিষন ভালোবাসি তোমায় ….”

আবিদ মুনের কথা ভাবতে ভাবতে শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়ে পরে ৷ সকাল হতে আবিদ ফজরের নামাজ পরে দোকানের উদ্দ্যেশ্য বার হতে নিলে সামসু হক আবিদ কে আটকে দিয়ে এক সাথে নাস্তা করে বেরিয়ে যায় দোকানে ,

________ মুনের ঘুম ভাঙতে দেখে রিদ ওকে আস্টে পিস্টে জরিয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে ৷ মুনের কেন যেন রিদের স্পর্শে প্রচন্ড ঘৃনা লাগছে ৷ বার বার মনে পরে যাচ্ছে প্রিয়ন্তি আর রিদের অন্তরঙ্গ অবস্তার দৃশ্য , মুনের রাগ যেন দ্বিগুন বেরে গেল হুট করে রিদ কে ধাক্কা সরিয়ে দিয়ে মুন উঠে পরে আর ঘুমের ঘরে ধাক্কা সামলাতে না পেরে নিচে পরে যায়৷ প্রচন্ড ব্যাথা পেয়ে জেগে যায় রিদ , নিজেকে নিচে দেখে যা বোঝার বুজতে পেরেছে রিদ আগুন দৃষ্টিতে মুনের দিকে তাকিয়ে ……..
.
.
.
.
#চলবে………..