নীল বুনোলতা পর্ব-০৪

0
235

#নীল_বুনোলতা ( ৪)
#লেখনীতে #রেহানা_পুতুল
উনি আমার জন্মধাত্রী মা নই। আমার আপন মায়ের হত্যাকারী! আমার বাবাকে ধ্বংসকারী!

কিহহ! বলে লতা বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইল সজীবের মুখপানে।

ভীষণ আশ্চর্য লাগছে তাইনা লতা?

আমার একদম বিশ্বাস হচ্ছেনা। আচ্ছা আপনাদের বাড়িটা কি ভূতুড়ে বাড়ি? কেমন সব আউলাজাউলা। পুরো বাড়ি কি শৈল্পিক। গোছানো। অথচ আপনাদের সবার মাঝেই প্যাঁচগোছে ভরা। আমার একদম ভালো লাগছেনা। আপনিও মনে হয় মুখোশধারী ভদ্রলোক।

সজীবের আঁতে ঘা লাগার উপক্রম হলো মুখোশধারী শব্দটা শুনে।

ডিম লাইটের আবছায়া আলোয় লতার দিকে চেয়ে নরম গলায় জানতে চাইলো,
তোমার এমন মনে হওয়ার কারণ?

যথেষ্ট কারণ আছে। আপনিতো শুরু থেকে আমার সাথে ভালোই ভালোবাসা দিয়ে কথা বলছেন। এইযে খানিক আগে বললেন,
জানে মেরে ফেলবেন। এটা কোন মানুষের ভাষা? এটা অমানুষের ভাষা। পশুর ভাষা। আমাদের দুজনের মাঝে এত বড় নিষ্ঠুর বাক্য বলার মত আদৌ কিছু হয়েছে কি?নিজের বিবেক কে জিজ্ঞেস করুন। বলেই থামল লতা। কন্ঠে উপচানো অনুযোগ, ক্ষোভ ও অভিমান।

ওহ হো! দেখলে নিজে বলে নিজেই ভুলে গেলাম। খুউব স্যরি লতা। আর কোনদিন যদি এমন আচরণ করি তোমার সাথে, যেন আমার জিভ খসে পড়ে। রাগ উঠলে মাথা এলোমেলো হয়ে যায় আমার। রাগ চড়লে কি বলি না বলি তার কোন ঠিক থাকেনা।

তাহলে কাউন্সেলিং করান। দেখবেন উপকৃত হবেন।

আমার জেদ কি এতটাই মারমুখী? কাউন্সেলিং করাতে হবে?

আমার কাছেতো তাই মনে হয়।

যদি তাই হয়। তাহলে সেটার দায়িত্ব তুমিই নাওনা।

আচ্ছা চেষ্টা করে দেখব।

সজীব লতার মন ভালো করার জন্য একটা জোকস বলতে চাইল। কিন্তু লতা শুনতে চাইলনা। উনি আপনার মাকে কেন হত্যা করল বলেন?

লতা প্লিজ। এখন বলতে ইচ্ছে করছেনা। আমার ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায় তখন। মার ছবিখানি শুধু চোখের সামনে ভেসে উঠে। তোমাকে ছুঁয়ে প্রমিজ করছি। সব বলব। আর বাড়িতে কোন ভূত প্রেত নেই।

তাহলে সাবধানে থাকতে বললেন কেন? এটা অন্তত বলেন?

এটা বলছি। ধরো আমাদের বাড়িটাতো বিশাল একা বাড়ি। তুমি হয়তো দিনে দুপুরে বা বেলা অবেলায় এদিক সেদিক যাবে। তখন নির্জনতা দেখেও ভয় পেতে পার। আর আমাদের কিছু শত্রু আছে গ্রামে। ওরা উল্টাপাল্টা কিছু বলে তোমার কান ভারি করে দিতে পারে। ইভেন উনিও। যাকে তুমি শাশুড়ী হিসেবে জান। তিনিও আমার বিপক্ষে কিছু বলতে পারে তোমায় কৌশলে। চুমকিও কম না। উনার চামচা। এইই। অন্যকিছুই নয় লতা।

ও হ্যাঁ তোমাকে বলে রাখি। আমাদের বাড়ির পুকুর, নারকেল, সুপারির,ফলের বাগান ,গাছগাছালী, দেখাশোনার জন্য একজন পাহারাদার আছে। তিনি বাড়ির বাউন্ডারির ভিতরেই থাকেন। বাড়ির দক্ষিণ পাড়ের দিকে একচালা ঘর করে থাকেন তিনি। নাম রইস।

হুম বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আপনাদের শত্রু কেন তৈরি হলো? আপনারা কি খারাপ মানুষ? বিজ্ঞের মত হতাশ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল লতা।

বোকা মেয়ে। শত্রু কি তৈরি হয় খারাপ মানুষ হলেই? যার অর্থ সম্পদ প্রভাব প্রতিপত্তি বেশি। তার শত্রু অটোমেটিক তৈরি হয়ে যায় সব লুটপাটের জন্য।

লতা বুঝদারের মত চুপ মেরে রইলো।

শোন আমি বিয়ে উপলক্ষেই এতদিন বাড়ি আছি। পরশু চলে যাব। তুমি রাতে চুমকিকে সাথে নিয়ে ঘুমাবে । ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিও ভালো করে।

আমার খোঁজ আপনি কিভাবে পেলেন?

জাননা?

নাতো।

আমার দাদা বীরপুরুষ আলতাফ মিয়া দিয়েছে। উনিই তোমাকে পছন্দ করেছে। আমায় ডেকে বলল তোমাকে বিয়ে করতে হবে। ব্যাস করলাম।

তার মানে আপনার কোন পছন্দ ছিলনা?

দাদার পছন্দের উপর আমার অগাদ বিশ্বাস আছে৷ তাই তোমাকে আগে দেখার প্রয়োজন মনে করিনি।

তাহলে আপনাদের পরিবারের কর্তা কি আপনার দাদা?

কিছুটা বলতে পার। আমি ঢাকায় থাকি। উনি যদি তেজস্বী পুরুষ না হতো। কবেই বাড়ি জঞ্জালে পরিপূর্ণ হতো। এতবড় বাড়ি দেখাশোনা করতে একজন আলতাফ মিয়ার বিকল্প নেই।

লতা মনে মনে ভাবে,হতেই পারে। উনি দেখতেও বলিষ্ঠবান বেশ। যেমন লম্বা তেমন পেটা শরীর। গায়ের রংটাও সুন্দর। বয়স তেমন নয় মনে হয়। পোষাকেও বেশ সচেতন পুরুষ বলা যায়। কথাবার্তা ও ভারি মজবুত। দৃঢ়চেতার বলা যায়।

দাদার ও আপনার শরীরের কাঠামো একইরকম। স্বভাবেও কি আপনাদের মিল আছে নাকি?

তা একদম না। হেসে বলল সজীব।

আপনি চলে গেলে আমি বাবার বাড়ি যাব কিছুদিনের জন্য।

আমি চলে গেলে নয়। তার আগেই নিয়ে দিয়ে আসব।

সজীব ও লতা কথা বলতে বলতে রাত গড়িয়ে গভীর হলো। সুখনিদ্রায় তলিয়ে গেল তারা দুজন।

তার দুইদিন পরে সজীব লতাকে দিয়ে আসল তাদের বাড়ি। ভ্যানভর্তি দামী সুস্বাদু সব মিঠাই,ফলফলাদি জিনিসপত্র দেখে মাসুদার চোখ চকচক করতে লাগল সোনার খনি হাতে পাওয়ার ন্যায়। বাকি সবাই লতাকে কাছে পেয়ে দারুণ উচ্ছ্বসিত। লতাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার বাবা ও দাদী পুকুর পাড়ের দিকে গেল। সাথে এলো তার ছোট দুই ভাইবোন। সবুজ ও রুমকি।
তারা চারপাশ থেকে লতাকে ঘিরে ধরল তার শশুরবাড়ির গল্প শোনার জন্য।

লতা উদাস ভঙ্গিতে বলতে লাগল গল্পের মত করে,
একদা ছিল এক মা হারা দুঃখী শিশু রাজকন্যা। লতার মত তরতরিয়ে বাড়তে লাগল বলে দাদী তার নাম দিল লতা। সেই লতা বড় হতে লাগল দাদী আর পিতার অপার স্নেহ যত্নে। প্রকৃতির নিয়মে সেই শিশু রাজকন্যাটি কিশোরী হলো। তা পেরিয়ে তারুণ্যে পা দিল সেই রাজকন্যা। বাড়ন্ত বয়সের লাগামহীন দুরুন্তপনা ও চঞ্চলতা আঁকড়ে ধরল সেই রাজকন্যাকে। সময়ের রথে চড়ে সেই রাজকন্যা পূর্ণ যৌবনাবতী হয়ে উঠল। জ্ঞানে,শিক্ষায়,বুদ্ধিতে, চতুরতায় সেই রাজকন্যা হয়ে উঠল দূর্বার সাহসী।গৃহকার্যে কেউ সামান্য ভুল করলেই সে ধরিয়ে দিত চোখে আঙ্গুল দিয়ে। হয়ে গেল কারো চক্ষুশূল।
উঠে পড়ে লেগে গেল তাকে পাত্রস্থ করার একান্ত উদ্দেশ্যে।

অতঃপর তার বিবাহ হলো সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা,অদেখা এক সুদর্শন,সুঠামদেহী রাজকুমারের সাথে।
তাদের বাড়ি যেন মায়াপুরী। শানবাঁধানো পুকুর ঘাট। পুষ্প কানন। আম্র কানন। কিন্তু অদ্ভুত। নামহীন সেই আভিজাত্যপূর্ণ রাজকীয় বাড়িটি। সেখানে কোন জন সমাগম নেই। যারা আছে তারা নিরবে আসে নিরবেই প্রস্থান করে। কারো সাথে কারো বিবাদ নেই। তর্ক নেই। পরিবেশ শান্তিপূর্ণ। প্রচুর ধন সম্পদ। কিন্তু কে ভোগ করে জানিনা। অঢেল ফলফলাদির বৃক্ষ। খায় মনে হয় কাক পক্ষী।

লতার গল্প থেমে গেল তার মুখে রুমকির হাত চাপা পড়াতে। বুবু আর বলনা দোহাই। আল্লাহর দোহাই। সব বলে ফেললে আমি দেখার মজা কিভাবে পাব। আমার নয়নকে সার্থক করতে চাই সজীব ভাইদের বাড়ি গিয়ে। দাদীকেও নিয়ে যাব। উফফস! কি লোভনীয় বর্ণনা দিলেনা বুবু। আমি স্কুল ছুটি পড়লেই বেড়াতে আসব কিন্তু।

আচ্ছা আসিস। কিরে সবুজ চুপ করে রইলি যে?

বুবু আমি ভাবছি এত ধনী পরিবারে আমাদের ঘরের মেয়ের বিয়ে হওয়াটা কি মানিয়েছে। না জানি কবে এই সুখ তোমার কপাল থেকে ছিটকে পড়বে উল্কার মত।

মালেকা বানু সবুজের পিঠে চাপড় মেরে বললেন,
তোর মুখে হগল সময় অলুক্ষণে কথা। তুই যা ভাগ এখান থেকে। রুমকির মায় লতারে এখানে বিয়া দিছে। এটার কৃতিত্ব পুরাটাই তার। নারে লতা?

হ্যাঁ দাদী। অবশ্যই উনার।

তার বাবা জয়নুল বলল,
তোর মুখে এত প্রশংসা শুনে আমারই বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করছে সেই বাড়ি।

তোমরা সবাই গিয়ে বেড়াতে পারবে আব্বা। আরো কয়মাস যাক। আমি একটু পুরনো হই।

তবে মা, মাসুদার এই ঋণ তুই কোনভাবেই শোধ করতে পারবিনা।

আব্বা আমি চেষ্টা করব শোধ করে দিতে। মনে রাখবেন।

মাসুদা থালবাটি ধোয়ার জন্য পুকুর ঘাটে এলো। বলল,
সবাই মিলে গালগপ্প করলে হবে? খাইতে হবেনা। আম্মা রান্ধন হইয়া গ্যাছে। খাইতে আসেন।

চুমকি আজ হঠাৎ ঘুমিয়ে গিয়েছে বিকেলের দিকে। এই সুযোগে সুজানা আলতাফ মিয়ার রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

কিছু বলবা তুমি?

হুম বলার জন্যই আসলাম।

বল শুনি।

আমার মুক্তি চাইই। বিরস গলায় বলল মাসুদা।

মুক্তি কি চাইলেই পাওয়া যায়? তাহলে কি সেই জায়গা ফিরায়ে দিবে?

মাসুদার কলিজা ধক করে উঠল। জায়গা ফিরিয়ে দিলে আমি যাব কোথায়?

তাহলে যাইতে চাও ক্যান? সময় হলে আমিই তোমারে বিদায় দিয়া দিমু। এখন যাও।

চলবে…৪