নীল বুনোলতা পর্ব-০৩

0
200

#নীল_বুনোলতা ( ৩)
লেখনীতে #রেহানা_পুতুল
একটু পরে লতাও উঠে এলো নিজের রুমে সজীবকে জাগানোর জন্য। কিন্তু রুমের দরজায় পা রাখতেই লতা অবিস্বাস্য চোখে চেয়ে রইল বিছানার দিকে।

ইতিকা সজীবের উপর ঝুঁকে আলিঙ্গন করার চেষ্টা করছে। সজীব ইতিকাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। দরজায় তার দৃষ্টি যেতেই দেখল লতা বেকুবের মত হা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সজীব ইতিকার গালে সপাটে চড় বসিয়ে দিল।

লতা ব্যস্ত পায়ে ছুটে গেল রান্নাঘরে। গোল গোল চোখে কাঁপা কাঁপা গলায়,

মা একটু আমাদের রুমে আসবেন। ইতিকার সাথে উনার কি যেন ঝামেলা হচ্ছে।

সুজানা উঠে এলো তড়িতেই।

কি হয়েছে ইতিকা?

খালামনি আমি সজীব ভাইরায় কাছে বসে ভাবিকে নিয়ে দুষ্টমি করে এটা ওটা বলছি। ভাবি রুমের দরজায় দাঁড়ানো ছিল। সজীব ভাইয়া ভাবিকে দেখামাত্রই আমার গালে চড় বসিয়ে দিল। কিন্তু তার আগে কিছুই বলেনি সে। এমন তো আগেও দুষ্টমি করেছি উনার রুমে এসে। তোমাদের বাড়িতে আর আসবইনা। বিয়ে করেই যেন সাধুর বেশ ধরল।
বলেই ইতিকা কান্নাজড়িত মুখে হনহন পায়ে বেরিয়ে এলো।

সুজানা কিছুই বলছেনা। শুধু সজীবের দিকে মুখ তুলে একবার চাইল।

সজীব গর্জন করে উঠল পশুর মতো সুজানার দিকে চেয়ে। আপনাকে এখানে আসতে বলল কে? নিজে এক নষ্টা। বোনের মেয়ে আরেক নষ্টা। শুনলেন ও কিভাবে ব্লেইম দিয়ে গেল। ও সবসময় আমার গায়ে পড়ে ভাব জমাতে আসে।

বাবা। ওতো তোমাকে অনেক ভালোবাসে খালাত ভাই হিসেবে। কিন্তু কিভাবে কি হলো এখন বুঝলামনা।

রাখেন আপনাদের ভালোবাসা। আপনাদের ভালোবাসা আমার ঢের জানা আছে। কটাক্ষ করে বলল সজীব।

আলতাফ মিয়া সজীবের রুমের সামনে এলো।
বলিষ্ঠ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
কি হলো সজীব? তোর বজ্রকন্ঠ শুনলাম। ওদিকে ইতিকাকেও দেখলাম চলে গেল?

সুজানা মলিনমুখে স্থান ত্যাগ করল।

সজীব উপস্থিত ঘটে যাওয়া ঘটনা বলল তার দাদাকে। সাথে আরো বলল,
এই মেয়েটা সবসময় আমার গায়ে পড়তে চায়। সে নাকি আমাকে ভালোবাসে। লতা কি ভাববে এবার বলেনতো। আস্ত একটা বেহায়া মেয়ে।

লতা কিছুই মনে করবেনা। চোখের দেখার মাঝেও মানুষের ভুল থাকে। এই বলে তিনি চলে গেলেন।

লতা আহাম্মক বনে গেল সুজানার সাথে সজীবের এমন নির্দয় আচরণে। সে রুমে ঢুকলে সজীব ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।

তুমি মাইন্ড করেছ লতা?

আমি মাইন্ড করেছি বা কতটুকু করেছি। সেটার চেয়েও অনেক বেশী মাইন্ড করেছি আপনি নিজের জন্মধাত্রী মাকে নষ্টা শব্দের মত নিকৃষ্ট শব্দ ব্যবহার করেছেন। আপনি কেমন সন্তান। মা নষ্টা হলে তাকে সেটা বলতে পারে অন্যরা। নিজের সন্তান কখনো এটা বলতে পারেনা। এটা অন্যায়। আমার খুবই খারাপ লাগছে। মাকে আমিই ডেকে এনেছি। নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগছে। ডেকে এনে উনাকে আঘাত দিলাম আমি। আমি এই কয়দিন খেয়াল করেছি। আপনি উনাকে সামনাসামনি কখনো মা বলে ডাকেন নি। উনার সাথে হেসে ভালোবাসা দিয়ে কথা বলেননি। কারণটা আমায় বলবেন একটু?

সজীব লতার মাথাটা বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। লতার শাড়ির ভিতরে হাত গলিয়ে দিল। সরু কোমরখানি দুইহাত দিয়ে ভিড়িয়ে নিল নিজের দিকে। লতার সারাগাল উষ্ণ ছোঁয়ায় ভরিয়ে দিল। এবং বলল আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমার বিয়ে করা স্ত্রী। স্রষ্টার দেওয়া উপহার। তুমি প্লিজ আমাকে ভুল বুঝনা।

লতা নিজেকে আলগা করে নিয়ে বলল,
নাহ। আমি ভুল বুঝেনি। কেউ কাউকে পছন্দ করলে নিজ থেকে যেচেও সান্নিধ্য পেতে চায়। এখানে আপনার কোন দোষ নেই। কিন্তু আমার জানতে চাওয়া হলো,
মাকে কেন নষ্টা বললেন? আর আমাকে যে সেদিন বললেন, সাবধানে থাকতে। চোখকান খোলা রাখতে। এটার জবাব দেন। ক্লিয়ার করে না বললেতো কিভাবে সাবধানে থাকব বলেন?

আচ্ছা বলব পরে। এখন ক্ষুধায় পেট ছোঁ ছোঁ করছে। আমার নাস্তা নিয়ে আস টেবিলে। বা চুমকিকে বল। তুমি খেয়েছ?

নাহ খাইনি।

একসাথে খাবো। নিয়ে আস।

লতা এক আকাশ মন খারাপ নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। দেখতে পেল সুজানা ফোনে তার বোনের সাথে হেসে হেসে স্বাভাবিক স্বরে কথা বলছে। লতা নির্বাক হয়ে গেল। তার ধারণা ছিল সুজানাকে আবিষ্কার করবে ক্রন্দনরত অবস্থায়। সেখানে দেখল তার বিপরীত পরিবেশ।

তবুও সে বলল,
মা আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। উনি যে এমন বাজে আচরণ করবে আপনার সাথে। এটা আমি বুঝতেই পারিনি।

বাদ দাও মা। ও সহজে রাগেনা। তবে রেগে গেলে কাকে কি বলা উচিত। সেই হিতাহিত জ্ঞান ও হারিয়ে ফেলে। তাই আমিও কিছু মনে রাখিনা।

অদ্ভুত তো। এটা কোন কথা। কোন লজিক হলো। অতিরিক্ত রাগ দমনের বিভিন্ন কাউন্সেলিং আছে। বিভিন্ন মোটিভেশনাল স্পিচ আছে ইউটিউবে। এসব রাগ নিয়ন্ত্রণ করার উপায়গুলো জানলে, শুনলে কিছুটা হলেও কাজে আসবে উনার।

সেটা পারলে তুমি বলে দেখিও। ধরো। তোমাদের নাস্তা নিয়ে যাও।

আপনি খাবেন না মা?
নাহ। আমরা সবাই খেয়েছি।

লতা নাস্তার ট্রে নিয়ে গেল ডাইনিংয়ে। সজীব লতাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিল। অপেক্ষা করে আছে লতাও তাকে খাইয়ে দিবে। কিন্তু লতা তা করলনা। তার এসব হ্যাংলামো পছন্দ না। আদিখ্যেতা মনে হয়। লতা ঝটপট খেয়ে উঠে গেল। এদের সংসারে তেমন কাজ করতে হয়না তার।

এদের পরিবারে তেমন মানুষ ও নেই। সজীবের দাদা,সজীব,সুজানা,চুমকি ও লতা। মোটে জন চারেক। কাজ বেশী হলে পাশের বাড়ি থেকে দুই তিনজন গরীব জুটে যায় কাজ করার জন্য।

তবে সজীবের এক চাচা আছে। তিনি আমেরিকায় থাকে পরিবার নিয়ে। পাঁচ বছর পরপর দেশে আসে। তার এক ছেলে এক মেয়ে। তারা আসলে বাড়ি ভর্তি অতিথি থাকে। তাই বড় করে দোতলা দালান করেছে সজীবের দাদা। সজীব ঢাকায় ব্যবসা করে। তার দাদা বাড়ি দেখাশুনা করে।

সজীব বাজারে চলে গেল চা খাওয়ার জন্য। লতা চা বানিয়ে দিতে চাইলেও না করল। লতা নিজের রুমে গিয়ে পরিবারের সবাইর সাথে কথা বলে নিল একে একে। ছোট ভাই সবুজ ও রুমকির পড়াশোনার খবর নিল সে।
মাসুদা ছাড়া তারা সবাই লতাকে দেখার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করল। লতা জানাল সজীব ঢাকায় চলে গেলেই এসে কয়দিন বেড়াবে।

মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে লতা বের হয়ে গেল। সুজানা রসুই ঘরের উঠানে খরগোশ গুলোকে চুমকির সাহায্য নিয়ে খাবার দিচ্ছে। লতা তাদের পাশে গিয়ে বসল।

খরগোশগুলো পিঠে আদুরে স্পর্শ দিতে দিতে বলল,
খরগোশ আমার ও দারুন প্রিয়। রাতে অনেক বেশী আকর্ষণীয় লাগে তাদের তুলতুলে শরীরের মাঝে জ্বলজ্বলে চোখগুলো দেখতে।

রাইট ভাবিজান। মনে হয় হ্যাজাক লাইট।

হ্যাজাক লাইট মানে? জিজ্ঞেস করল লতা।

বর্ষাকালে রাইতে যে খাল বিল ডোবা থেকে মাছ ধরে হ্যাজাক লাইটের আলো মাইরা মাইরা। চিনেন না?

হুম চিনলাম।

মা এই খরগোশ কি কিনে এনেছেন? কে শখ করে পালছে এগুলো? আপনি?

খরগোশ আমাদের সবার পছন্দেই পালা হচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে কারোনা।

সজীব সেদিন বাড়ি গেল রাত করে। লতা দুপুরে ফোন দিল ভাত খাওয়ার জন্য। সজীব কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে দুপুরে গেলনা আর। লতা ধরে নিলো তার কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে সজীব।

হেলে দুলে হাঁটতে হাঁটতে বড় ঘরের সামনের উঠানে গেল লতা। ঘরের শোভা কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে দিল দুপাশে চাল বেয়ে উঠা দুটো বাগান বিলাস ফুল গাছ। বেশ ঝোঁপালো। দুটো দুইরকম। একটায় ধরে আছে থোকায় থোকায় সাদা বাগান বিলাস ফুল। আরেকটায় গোলাপি বাগান বিলাস ফুল। উঠানে অজস্র ফুল ছড়িয়ে আছে। যেন পুষ্পউদ্যান এটা। লতা বিভোর হয়ে ফুলের সৌন্দর্য দেখতে লাগল। সজীবদের পরিবারের মানুষের তুলনার তাদের বাড়িটাই বেশী মন কেড়েছে যুবতী বধু লতার। সে উঠান পার হয়ে বাড়ির বাইরে গেল কি নাম এত জমকালো বাড়িটার। তা দেখার জন্য। কিন্তু কোন নেইম প্লেট দেখতে পেলনা। সে হতবাক হয়ে গেল।

ভিতরে এসেই গলা তুলে সুজানাকে জিজ্ঞেস করলো,
মা এত চমৎকার বাড়িটার কোন নাম নেই কেন?

সুজানা হালকা বিরক্তি নিয়ে বলল,
এই প্রশ্ন শুনতে শুনতে আমার দুকান ঝালাপালা হয়ে গিয়েছে। এত এত নাম বের করেও সজীবের ও তার দাদার কোন যুতসই নাম পছন্দ হলোনা। ভবিষ্যতে পছন্দের কোন নাম পেলে তখনই নাম ফলক দিবে বলছে সজীব।

রাতে সজীব বিছানায় গেলে লতা জানতে চাইল সুজানার বিষয়ে।

লতার চাপাচাপিতে না বলে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছেনা। সজীব লতাকে হুঁশিয়ারি সংকেত দিয়ে বলল,
যদি কারো কাছে কিছু বল, জানে মেরে ফেলব। মনে রেখ।

উনি আমার জন্মধাত্রী মা নই। আমার আপন মায়ের হত্যাকারী! আমার বাবাকে ধ্বংসকারী!

কিহহ! বলে লতা বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইল সজীবের মুখপানে।

ক্রমশ….(৩)