নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-৩৪+৩৫

0
5484

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_৩৪||

নিচে থেকে চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দে জয় খানিকটা অবাক হলো। এতো সকালে এতো হট্টগোল কিসের? সারারাত ঘুম না হওয়ায় মাথাটাও ঝিমঝিম করছে। একটু ফ্রেশ হলে ভালো লাগতে পারে।

জয় আলমারি থেকে কাপড় বের করবে, এই উদ্দেশ্যে আলমারির দরজা জোরে টান দিয়ে খোলার সাথে সাথে একটা খাম ওপরের তাক থেকে ফ্লোরে পড়ে গেল।

জয় ভ্রু কুঁচকে সেটা তুলে নিয়ে দেখলো, এটা হাসপাতালের কোনো একটা কাগজ এবং তার ওপর গোটা গোটা অক্ষরে ‘Fahmida Ahmed Moon’ নামটা লিখা। জয় আর কালক্ষেপণ না করে দ্রুত হাত চালিয়ে ভেতর থেকে কাগজটা বের করে ফেললো।

পেপার গুলো পড়ার পর জয়ের হাত থেকে পেপারটা ফ্লোরে পড়ে গেল। এতোটাই দুর্ভাগা সে, এটা তার জানা ছিল না! নিজে বাবা হতে চলেছে এটার আনন্দ উপলব্ধি করাটাও তার ভাগ্যে ঘটলো না!

সে কি কোনোদিক থেকেই সুখী হতে পারবে না? যাকে ঘিরে বাঁচতে চেয়েছে, যার মধ্যে নিজের জন্য সুখের অস্তিত্বে খুঁজে পেল, যার কারণে জীবনটা রঙিন হয়ে উঠেছিল ; আজ সেই নিজের থেকে দূরে।

ভাগ্যটা এমন কেন হয়! প্রকৃতি এতো নির্মম কেন?
____________

তনিমা আপাতত রেগেমেগে বোম হয়ে আছে, যেকোনো মুহূর্তে ফেটে পড়তে পারে। আহিলের বেশ মজা লাগছে তনিমাকে ক্ষেপিয়ে। এখন তার একটাই উদ্দেশ্য- এই ঝামেলাটাকে এ বাড়ি থেকে বের করা।

আহিল হালকা ব্যাঙ্গ করে বললো,
—“মিসেস তনিমা, রেডি হয়ে নিন। আপনার বরকে খাতিরদারি করার জন্য অলরেডি কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছি। আপনাকেও নিতে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। ”

তনিমা ভয় পেয়ে গিয়ে বললো,
—“কেন? আমরা কোনো অন্যায় করিনি। সো, আমাদের কারাগারে নেওয়াটা সম্পুর্ন ইল্যিগ্যাল।”

—“আরে, আগে ঢুকুন। পরে তো সেই বেরই হয়ে যাবেন। ততোদিনে আমরা একটু শান্তি নেই।”

তনিমা বিড়বিড় করে বললো,
—“শান্তি, না? আমি থাকতে কেউ শান্তি পাবে না। শান্তি আমি অলরেডি কেঁড়ে নিয়েছি। কিন্তু তোমার জন্য আমি কোথাও শান্তি পাই না, আহিল। কারন তুমি একটু বেশিই চালাক।”

—“কী বিড়বিড় করছেন? আমায় গালাগাল করে লাভ নেই! ”

হঠাৎ একদল পুলিশ এসে পুরো বাড়ি ঘিরে ফেললো। বাড়ির সবাই এর মধ্যে হলরুমে উপস্থিত, শুধু জয় বাদে। আহিল মহিলা পুলিশদের বললো, তনিমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তনিমা কিছুতেই যাবে না। বারবার শুধু চিৎকার দিয়ে এটা-সেটা বলছে। অবশেষে পুলিশ ওকে টেনেটুনে নিয়ে গেল। সাথে সাথেই আহিল একটা শান্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।

—“এটা কী হলো? ওকে কিসের ভিত্তিতে ধরে নিয়ে গেল?”

অদ্রির প্রশ্ন শুনে আহিল সংক্ষেপে বললো,
—“কোনো কিছুর জন্য না। জাস্ট কয়েকদিন শান্তিতে ফিহুকে খুঁজে বের করার জন্য ওদের বন্দী করে রাখলাম। পাশাপাশি ওরা যেন কারো ক্ষতিও না করতে পারে, সেজন্য এর থেকে ভালো উপায় পেলাম না।”

জায়েদ চিন্তিত স্বরে বললো,
—“বুদ্ধিটা ভালোই। কিন্তু ফিহুকে খুঁজে বের করতে হবে মানে? ও কোথায়? ”

আহিল মাথা নিচু করে বললো,
—“জানি না। ও বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। আমি ওকে খুঁজে বের করার সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। এখনো একটু ভরসা আছে তাই। ”

আয়েশা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—“আমার সংসারে কেন সবসময়ই ঝামেলা লেগে থাকে? আজ ঐ বেহায়া মেয়েটার জন্য আমার ঘরের লক্ষ্মী নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে!”

জাহিদ চোখে মুখে বিরক্তি ছাপিয়ে বললো,
—“সব দোষ তো তোমার ছেলেরই! ওকে আমরা অনেকবার সতর্ক করেছি, ঐ মেয়েটার সাথে না মিশতে। কিন্তু ও শোনেনি। একসাথে দুটো মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে, এজন্য ওকে আমি কখনো ক্ষমা করবো না। আহিল, তুমি যতো তাড়াতাড়ি পারো, মুনকে খুঁজে আনো। আর ঐ মেয়েটাকে ও ছেড়ে দিও। যতই হোক ও অন্তঃসত্ত্বা! আর এর জন্য যেহেতু আমার ছেলেই দায়ী, তাই তার সমাধান আমাকেই করতে হবে।”

আহিল কিছু বলতে যাবে তার আগেই জয় সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললো,
—“আমাকে আর কতো ব্লেইম করবেন মিস্টার জাহিদ মাহমুদ? একটা মেয়ের মুখের কথা আর কয়েকটা কাগজ কখনো প্রমাণ করেনা যে আমি দোষী। আমি যে নির্দোষ, তার যথাযথ প্রমাণও আমার কাছে আছে।”

জয়ের মুখভঙ্গি অনেকটাই গম্ভীর এবং স্বাভাবিক। সবাই ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কিন্তু এতো জয়ের বিন্দুমাত্র যায়-আসে না। যখন তার পরিবারের সাপোর্টের দরকার ছিল, সবার বিশ্বাস আর সঙ্গের প্রয়োজন ছিল, তখন তো কেউ তার পাশে এসে দাঁড়ায় নি। বরং সবাই তাকে অবিশ্বাস করেছে। একমাত্র একজনই ওকে বিশ্বাস করেছিল, সব ষড়যন্ত্র বুঝতে চেয়েছিল, কিন্তু সেও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে দূরে চলে গেল। ব্যাপার না! সব কিছু ঠিক হবেই।

জায়েদ ভরসার গলায় বললো,
—“যে যাই বলুক না কেন, আমি জানি তুই এমন জঘন্য কাজ করতে পারিস না।”
বলেই আড়চোখে নিজের বাবার দিকে তাকালো।

আবার জিজ্ঞেস করল,
—“কিন্তু তোর কাছে কী প্রমাণ আছে? ”

—“দাঁড়াও, দেখাচ্ছি। ”
বলেই টিভিতে একটা ভিডিও প্লে করলো জয়।

ভিডিও দেখে সবার চোখ কপালে উঠে গেল। ভিডিও তে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, তনিমা নিজের মুখে স্বীকার করছে যে, সবকিছু ওর প্ল্যান ছিল। এটা দেখার পর সবার চোখে মুখে অনুতাপের রেশ ফুটে উঠলো।

কিন্তু কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে জয় বলে উঠলো,
—“এটার কথা এখন ছাড়ো। আমার এখন মুনকে দরকার। ওকে পেলে আমি আগে ঠাটিয়ে দুটো চড় মারবো। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহারটার কথা না জানিয়েই চলে গেছে ও।”

সবাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
—“কিসের কথা?”

জয় নিজের চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে না দিয়েই বললো,
—“এটাই যে, এ বাড়িতে নতুন অতিথি আসতে চলেছে। কিন্তু আমি সেই আনন্দটুকু উপভোগই করতে পারলাম না। হাহ…. ভাগ্যের কী সুন্দর পরিহাস, তাই না? ”

নতুন অতিথির কথা শুনে ক্ষণিকের জন্য হলেও সবার মুখ আনন্দে চিকচিক করে উঠলো। কিন্তু মুহুর্তেই আবার তা কালো হয়ে গেল। কারণ আসল মানুষটাই যে চলে গেছে!

আহিল জয়ের দিকে ভরসার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—“চিন্তা করিস না, একদম। ফিহু ঠিকই ফিরে আসবে। আমি এয়ারপোর্টেও মানুষ ঠিক করে দিয়েছি, যাতে ও দেশের বাইরে যেতে না পারে।”

আহিলের কথায় যেন জয় একটু আশ্বাস পেল।
_______________

এখন আমি চট্টগ্রামে একটা গার্লস হোস্টেলে আছি। এ জায়গাটা বেশ নিরাপদ, কারণ এখানে আমায় কেউ খুঁজতে আসবে না। এক সপ্তাহ ধরে এখানেই আছি। তবে কালকে আবার চলে যাবো। শুধু এখান থেকেই না, বরং এই দেশ থেকে। আরো আগেই যেতাম, কিন্তু ইউকে যাওয়ার সব প্রসেসিং করতে এক সপ্তাহ লেগে গেছে। আমি নিজের জমানো টাকা দিয়ে ই সব করেছি। আপাতত ট্রাভেলিং ভিসায় যাচ্ছি, ওখানে গিয়ে পার্মানেন্ট হওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে।

জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে রাতের আকাশ নিয়ে গবেষণা করতে ইচ্ছে করছে খুব। আকাশটা কী অদ্ভুত, তাই না? দিনের বেলায় কত সুন্দর আলোর সমারোহ দেখতে পাওয়া যায়! কিন্তু রাতে যেন তাকে সম্পুর্ন নিঃস্ব মনে হয়, যদি না তার মধ্যে কোন চাঁদ বা তারা না থাকে।

আমার জীবনটাও এরকমই। কখনো আলোকিত, আবার কখনো অন্ধকার। তবে ভুলটা আমারই। আমিই সবসময় মরীচিকার পেছনে ছুটি, নিজের ভ্রমটাকে আঁকড়ে বাঁচতে চাই। তেলে আর জলে কোনো দিন মিশে না, তেমনি আমি আর জয়ও কোনোদিন মিলতে পারবো না। এটা আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল।

আজ আমি এদেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছি শুধু মাত্র নিজের জন্য। জয় হয়তো আজ না হয় কাল তনিমাকে মেনে নেবে, আবার নাও নিতে পারে। তাতে আমার কী? কিন্তু আমি এখানে থাকলে সুন্দর ভাবে বাচতে পারবো না। আজ না হয় কাল, সবকিছু জানাজানি হবেই। তখন এই সমাজের কটাক্ষ শুনতে শুনতে আমায় গুমরে গুমরে মরতে হবে। কিছু দিন পর সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে, তবে আমার জীবনটা তো ঠিক হবে না। কিন্তু সেটা হতে দেওয়া যাবে না। একজন ভুল মানুষের জন্য আমি আমার ও আমার সন্তানের জীবন নষ্ট করতে পারি না। আমাদের ভবিষ্যৎটা সুন্দর ভাবে গুছানোর জন্য, জীবনে সফল হওয়ার জন্য, আমার স্বপ্ন গুলো পুরন করার জন্য হলেও আমাকে এদেশ ছাড়তে হবে।

পরের দিন বিকেলে,,,,,,
এয়ারপোর্টে বসে আছি। চট্টগ্রাম থেকে রাতেই রওয়ানা হয়েছিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। তাই ঠিক সময়েই পৌঁছাতে পেরেছি। আর কিছুক্ষণ পরেই ফ্লাইট। ভাবতেই অবাক লাগে, এদেশে আমি আর কোনো দিন ফিরবো না। সত্যিই ফিরবো না! আমার সন্তানকেও ফিরতে দেবো না। এদেশ আমায় কিছুই দেয়নি। আমি তাই কিছু আশাও করি না।

কিছুক্ষণ পর এনাউন্সমেন্ট শোনার সাথে সাথে আমি ইমিগ্রেশনের দিকে এগিয়ে গেলাম। এতো ভেবে কাজ নেই। আমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তা আমার মতে ঠিক।
_____________

—“কী হলো, আহিল? এক সপ্তাহ হয়ে গেছে। এখনো কি তুই আমায় শান্ত থাকতে বলবি?”

জয়ের রাগী কন্ঠ শুনে আহিল কী উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। এদিকে কথাও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। দুই বাঘের মুখে এখন নিজেকে একটা হরিণের বাচ্চার মতো মনে হচ্ছে।
শুকনো গলায় বললো,
—“আমার উপর কেন চেঁচাচ্ছিস? আমি কি চেষ্টা কোনো ত্রুটি রেখেছি? সবার অত্যাচারে হাফ মরে গেছি আমি। এখন পুরোই মেরে ফেল আমায়।”

কথা চোখ গরম করে তাকিয়ে বললো,
—“তোমায় মারলে কি ফিহুকে খুঁজে পাবো? তোমায় বলেছি না যেখান থেকে পারো ওকে খুঁজে আনবে?”

—“খুঁজছি তো! কিন্তু না পেলে আমি কী করবো?”

জয় চিন্তিত স্বরে বললো,
—“ও যদি প্রেগন্যান্ট না থাকতো, তাহলে একটা রিস্ক ছিল যে, ও নিজের ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিয়র যে, ও নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। তবে, কোথায় রাখতে পারে? ”

কথা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—“আমি কিছু জানি না, তোমরা ফিহুকে খুঁজে বের করবে, এটাই আমার শেষ কথা। আমার একটা মাত্র বোন ও। আজ ও কোথায় চলে গেল?”

হঠাৎ রুমে থাকা ল্যান্ড ফোনটা বাজতে শুরু করলো। এতো রাতে কে ল্যান্ড ফোনে কল দিবে? জয় এগিয়ে গিয়ে ফোনটা তুললো।
—“হ্যালো, কে বলছেন? ”

ফোনের ওপাশ থেকে কেউ একজন একমিনিটের মধ্যে কিছু একটা বললো, যা শুনে জয় ধপ কর ফ্লোরে বসে পড়লো।

-চলবে…..

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_৩৫||

পাঁচ বছর পর,,,,,,,

জয় নিজের অন্ধকার ঘরে বসে বসে আপন মনে সিগারেট টানছে আর ধোঁয়া উড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে মুচকি মুচকি হাসছেও। প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটের অবশিষ্টাংশ জানলা দিয়ে ফেলে নিজের ইজি চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে বলতে লাগলো,

—“চলে তো গেলে, সাথে আমাকে শেষ করে দিয়ে গেলে। কী অদ্ভুত আমাদের জীবন! তোমাকে আমি কন্ট্র্যাক্টে বিয়ে করেছিলাম। সেই তোমাকেই কীভাবে ভালোবেসে ফেললাম। আজ তোমার জন্য আমি মরি! অথচ তুমিই নেই। চলে গেছো স্বার্থপরের মতো! এমন জায়গায় গেছো যেখান থেকে আর ফিরিয়ে আনতে পারবো না। আরে, চলেই যখন যাবে, তখন এসেছিলে কেন? না-ই আসতে আমার জীবনে। নয়তো আমাকে সাথে নিয়ে যেতে! আচ্ছা, তুমি কি আর সত্যিই ফিরবে না? পাঁচ বছর ধরে ওয়েট করছি কিন্তু! তুমি কি তবুও ফিরবে না?”

আহিল জয়ের ঘরে খাবার নিয়ে ঢুকতেই পুরো ঘর অন্ধকার দেখতে পেল। তার ওপর কারো বিড়বিড় করে বলা কথা শোনা যাচ্ছে। এটার সাথে আহিল বেশ ভালো ভাবেই পরিচিত। তাই আর দেরি না করে দ্রুত ঘরের লাইট অন করলো।

—“জয়, দ্রুত খাবারটা ফিনিশ কর তো! উঠে বস।”

আহিলের অর্ডার শুনে জয় বিরক্ত হয়ে বললো,
—“উফ, তুই আবার এসেছিস! এই তুই আর ভাইয়া কি আমায় একটুও শান্তি দিবি না। তোদের দুজনকে তো আমি আমাকে খাওয়ানোর চাকরি দেইনি।”

আহিল ডোন্ট কেয়ার মুড নিয়ে বললো,
—“যাই বলিস, আমার গায়ে লাগবে না। তবে তুই যেদিন একটু স্বাভাবিক হবি সেদিন থেকে তোকে আর জ্বালাবো না।”

—“অস্বাভাবিকের কী আছে? আমি তো ঠিকঠাক আছি। তোদের কথা শুনি, সপ্তাহে দুদিন অফিস সামলাই। আর কী চাস তোরা?

—“এটাই যে তুই বাড়ির সবার সাথে মিশিস, আগের মতো হাসি খুশি থাক, এই একঘরে পড়ে থাকা বন্ধ কর।”

—“আ’ম সরি বস। আমি যে আমার ভালোবাসাকে চিরকালের জন্য হারিয়েছি, তার জন্য এ বাড়ির মানুষ গুলো কোনো না কোনো ভাবে দায়ী। তাদেরকে আমি ক্ষমা করতে পারবো না।”

—“অতীতটাকে আঁকড়ে ধরে এখনো বসে থাকবি? তোর বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববি না?”

জয় কঠিন গলায় বললো,
—“আমার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ঘিরে শুধু একজনেরই অস্তিত্ব বিদ্যমান। সেটা হলো ফাহমিদা আহমেদ মুন। ওকে তোরা যতোই মৃত বলে দাবী করিস না কেন, আমার বিশ্বাস ও এই পৃথিবীতে আছে। আমার সন্তানও আছে। আমার ভালোবাসা এতো ঠুনকো না যে, এতো তাড়াতাড়ি হারিয়ে যাবে।”
বলেই খাবারের প্লেট টা নিয়ে খেতে বসে পড়লো।

এদিকে আহিল ভাবছে, ‘সেদিনের কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে ফিহু কীভাবে ফিরে আসবে? যদি ও বেঁচেই থাকতো, তাহলে এ কদিনে নিশ্চয়ই কোনো খবর পেতাম! ”

সেদিন,,,,,,
জয় পাথরের মতো ফ্লোরে বসে আছে। আহিল ওর কাছে গিয়ে বললো,
—“কী হয়েছে? এমন স্ট্যাচু হয়ে পড়ে আছিস কেন? কে ফোন দিয়েছে?”

জয় কিছু বলতে পারছে না। ওর গলা কাঁপছে অনবরত।

আহিল ওকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
—“কী রে! বল।”

জয় অস্ফুটস্বরে বললো,
—“আজ রাতে ইউকে যাওয়ার পথে একটা প্রাইভেট প্লেন ক্র্যাশড হয়েছে। ঐ প্লেনে থাকা কেউই বেঁচে নেই।”

আহিল এ কথা শুনে ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,
—“তো! এটা তো প্রায়ই হয়, সাধারণ একটা ব্যাপার! এই বিমান বিধস্তের তদন্তটাও আমার ঘাড়েই পড়বে, এটা শিয়র থাক। কিন্তু তুই এতে এতো শকড কেন? ”

জয় ভাঙা গলায় বললো,
—কারণ….

—হুম, কী কারণ?

—“কারণ ঐ প্লেনে মুনও ছিলো!

—হোয়াট?

আহিল চোখ দুটো রসগোল্লার মতো করে তাকিয়ে আছে। পরবর্তীতে সবকিছু ঘেঁটে এটা জানা যায় যে, মুন ট্রাভেলিং ভিসায় ইউকে যাচ্ছিলো আর সবকিছু ঠিক থাকলে মুনেরও ঐ প্লেনে থাকার কথা। কিন্তু প্লেনটি সমুদ্রে ক্র্যাশ হওয়ায় শুধুমাত্র কয়েকজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা গিয়েছিল।

কিন্তু তখন পরিস্থিতির চাপে আহিলের মাথায় একটা কথা একবারের জন্যও আসেনি। তবে এখন সেটা অনেক বেশী করে মাথায় ঘুরপাক খায়। আর সেটা হলো…..

—এতো কী ভাবছিস? এই দেখ আমার খাওয়া হয়ে গেছে। আর শোন, আমার জন্য তোদের কারো খাবার আনতে হবে না। আমিই কালকে থেকে নিজে নিচে গিয়ে খেয়ে আসবো।”

—যাক, তোর সুমতি হয়েছে তাহলে! খুশি হলাম শুনে।

জয় সেই আগের মতোই গম্ভীর ভাবে বসে রইলো। তার মধ্যে কোনো অনুভূতি কাজ করছে না।
_______________

In Australia…

—একি, তুমি আজও নিজেকে ভিন্নরূপে সাজানোর চেষ্টায় মত্ত! যতোই এসব সাজসজ্জা ধারণ করো না কেন? এসব তো তোমার ওপরের খোলস মাত্র! তুমি নিজেকে যতোই বদলানোর চেষ্টা করো না কেন? আমার কাছে তুমি আগের মতোই থাকবে। আচ্ছা, তোমার কি কষ্ট হয় না? একবারো কি মনে পড়ে না আমার কথা? হয়তো মনে পড়ে না। হয়তো ভুলে গেছো আমায়! কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি আজও তোমাকে ভুলতে পারিনি! আমি ভালো নেই তোমাকে ছাড়া। তোমার অনুপস্থিতি যে বড্ড পোড়ায় আমায়! বুঝো না তুমি? নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করে আছো? শুনতে পাচ্ছো কি আমার আর্তনাদ? আমি ভালো নেই! ভালো নেই আমি!!”

আয়নার সামনে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটা আয়নার দিকে রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকালো। তার চোখ দিয়ে পানি এবং রাগ যেন সমান তালে ঝরছে! হাতের কাছে থাকা ফুলদানিটা আয়নার গ্লাসের ওপর ছুঁড়ে মারলো সে। পুরো বাড়ি কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে বললো,
—“বিশ্বাসঘাতক, মিথ্যাবাদী, প্রতারক! তুই আবার এসেছিস আমার সামনে! তোর মতো একটা নির্লজ্জ লোকের চেহারা দেখতেও আমার ঘেন্না হয়। ইউ নো হোয়াট? ইউ আর আ ইমপোস্টার গায়। তুই কারো ভালোবাসা ডিজার্ব করিস না। তুই শুধু মাত্র একজন ঘৃণার পাত্র।”
বলেই পুরো ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর শুরু করলো।
নিচ থেকে মিহাদ চৌধুরী, তার স্ত্রী মালিহা চৌধুরী এবং তাদের ছেলে মিরাজ চৌধুরী ছুটে রুমে এসে দেখে, মেয়েটা চিৎকার করছে আর সারা ঘরে ভাঙচুর করছে।

মিহাদ চৌধুরী তাকে থামানোর জন্য বললো,
—“মালিশা, মাই প্রিন্সেস। কী করছো কী তুমি? বন্ধ করো এসব!”

মিরাজ আটকানোর চেষ্টা করে বললো,
—“আপুমনি, স্টপ ইট। তুই নিজেই ব্যথা পাচ্ছিস। বুঝতে পারছিস না কেন?”

মালিশা কারো কথা না শুনে বলতে লাগলো,
—“ছেড়ে দাও আমায়! আজ ও আবার আমার কাছে এসেছিলো। ওর এতো বড় সাহস! সব শেষ করে ফেলবো আমি। ”

মালিহা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—“তোমরা থামাও আমার মেয়েটাকে! ও আবার এবনরমাল আচরণ করছে।”

কোনো উপায় না পেয়ে মিহাদ চৌধুরী মালিশার গাল একটা চড় বসিয়ে দিলো আর সাথে সাথে ও অজ্ঞান হয়ে গেল। সবাই জানে যে, বর্তমানে এটাই ওর একমাত্র ওষুধ। এছাড়া ওকে শান্ত করা যাবে না।

মিহাদ চৌধুরী মালিশাকে বেডে শুইয়ে দিতে দিতে বললো,
—“মিরাজ, ডক্টর নিখিলকে ফোন করো। আর মালিহা, সার্ভেন্টদের বলো রুমটা ভালো করে পরিষ্কার করে দিতে।”

মালিহা চোখের পানি মুছে চলে গেল সার্ভেন্টদের আনতে, আর মিরাজ ডক্টরকে ফোন দিতে লাগলো।

কিছুক্ষণ পর,,,,,,,

একজন বেশ হ্যান্ডসাম দেখতে ছেলে ঘরে প্রবেশ করতে করতে বললো,
—“কী হয়েছে আমার জানপাখির? এতো রাতে আসতে বললে কেন মিরাজ? ”

মিহাদ চৌধুরী বেশ থমথমে মুখ করে বসে আছেন। মিরাজ হালকা হেসে বললো,
—“জানপাখি, না? এখন যদি, বায় এনি চান্স, আপুমনির সেন্স থাকতো, আর জানতে পারতো যে, তুমি ওকে জানপাখি বলে ডেকেছো; তোমার শ্যুট করে দিতে ও দ্বিতীয় বার ভাবতো না, নিখিল ভাইয়া।”

ডক্টর নিখিল মুখে ক্লোজ আপ হাসি টেনে বললো,
—“এখন তো আর সেন্স নেই! বলতে বাঁধা কোথায়? যাইহোক, বলো এখন কী হয়েছে ওর?”

মিরাজ মুখ কালো করে বললো,
—“কী আবার হবে? অ্যাগেইন আগের মতো চিল্লাফাল্লা আর ভাঙচুর করেছে।”

ডক্টর নিখিল কিছুক্ষন চেক-আপ করে বললো,
—“টেনশনের কিছু নেই। ও আবারও সেই হ্যালুসিনেশনের শিকার হয়েছিল। আপাতত একটা ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দিচ্ছি। ঘুম থেকে উঠলে দেখবেন, সব ভুলে গেছে।”

মিহাদ চৌধুরী এবার ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
—“কিন্তু ডক্টর নিখিল, এভাবে আর কতো দিন? আমার মেয়েটা আর কতো সহ্য করবে? আপনার কথায় তো আমরা ওর লাইফস্টাইল পুরোই চেঞ্জ করে দিয়েছি। তবুও কেন ও স্বাভাবিক হচ্ছে না? ”

ডক্টর নিখিল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
—“দেখুন আংকেল, ওর সমস্যাটা অনেক গভীর যা ওর ব্রেইনে বাজে ভাবে এফেক্ট করে। এজন্য আমাদেরকে আরো ওয়েট করতে হবে। হতে পারে ও কোনোদিন স্বাভাবিক হতে পারবে না, আবার হতে পারে ও স্বাভাবিক হয়েও যেতে পারে। সো, নাথিং ইজ ইন আওয়ার হ্যান্ড নাও। উই নিড টু ওয়েট ফর দ্য প্রোপার টাইম।”

-চলবে……