#পরিণয়
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৩
ঘুম ঘুম চোখে ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে একটা মেয়ে কন্ঠ ভেসে আসলো।পল্লবী বুঝতে পারলো তার মা নুরজাহান বেগম কল দিয়েছে। পল্লবীর ঘুমটা পরক্ষণেই হাওয়া হয়ে মিলিয়ে গেল। আস্তে গলায় বলল
– হ্যাঁ মা বলো কেন কল দিয়েছ?
নুরজাহান বেগম কান্না জড়িত কন্ঠে বলল
– তোর কী সত্যিই সাহিলের সাথে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে?
– হ্যাঁ মা আজকে সকালে সব সম্পর্ক চুকিয়ে নিয়েছি। সাহিলকে মুক্তি দিয়ে দিছি।
– কেন রে মা আরেকটু চেষ্টা করতি। সংসারে তো ঝামেলা হয়েই তাই বলে এমন কাজ কেন করলি?
– মা যে সম্পর্কটা সে রাখতে চাচ্ছে না সেটা চাইলেও তো আমি রাখতে পারব না। আমি তো অনেক চেষ্টা করেছি। পারিনি মা। আমার কপালটায় হয়তো ভালো না মা।
বলেই পল্লবী কাঁদতে লাগল। নুরজাহান বেগম পল্লবীর কান্না শোনে কন্ঠটা গম্ভীর করে বলল
– কতবার না করেছিলাম সে ছেলেকে বিয়ে করিস না। তবুও তো কথা শোনিসনি। নিজের পায়ে তো নিজে কুঁড়াল মারছিস। এখন এভাবে কেঁদে লাভ কী? আজকে বাপ মায়ের কথা যদি শোনতি তাহলে এভাবে কাঁদতে হত না। এখন বুঝ কেমন লাগে।
– মা আমার মনটা এমনিই ভালো না তার মধ্যে তুমি এভাবে কথা বলতেছ? কোথায় তুমি আমাকে একটু সাপোর্ট দিবে, তা না করে আমার মনটা ভেঙ্গে দিচ্ছ।আমি কী জানতাম সাহিল এমন করবে? তুমিই তো কিছুদিন আগে বলেছিলে যে সাহিলের মতো ছেলে তোমরা খুঁজতে গেলেও পেতে না।আর আজকে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে বলে তুমিই উল্টা কথা বলছো? বাকিরা কী বলবে সেটা নাহয় বাদেই দিলাম। কিন্তু তোমার কাছে এটুকু আশা করিনি।আমার দোষটা কোথায় বলো? সংসারটা কী আমার জন্য ভেঙ্গেছে? আমি তো চেষ্টার ত্রুটি রাখিনি সংসার টিকিয়ে রাখতে। তাহলে আজকে এত কষ্ট আর কথা কেন আমাকে শোনতে হচ্ছে বলো? আজকে তোমাদের পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করলে এমন হলে কী পারতে এতগুলো কথা শোনাতে?
– শোন আমরা অন্তত জাতপাত দেখেই তোকে বিয়ে দিতাম। তোর পছন্দ ছিল জাতপাত ছাড়া।শুধু তোর জন্য মেনে নিছিলাম। এখন বুঝ কেমন লাগে। নিজের জীবন তুই নষ্ট করছিস এর দায়ভার আমদের কারও না। এখন কোথায় আছিস তুই?
– অধরার বাসায়।
– সেখানেই থাকবি নাকি বাসায় আসবি?
– এখানে কিছুদিন থেকে একটা চাকুরির ব্যবস্থা করে বাসায় আসব।
– যা ইচ্ছা কর তুই। তোর আগে পরে আমি আর নেই। এমনিতেই তোর বিয়ে নিয়ে তোর বাবা, ভাইয়ের অনেক কথা শোনেছি। আর কত শোনতে হবে কে জানে। মেয়েরা নাকি মায়ের কষ্ট বুঝে। আর তুই উল্টা আমার কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ালি।
বলেই নুরজাহান বেগম কাঁদতে কাঁদতে কলটা কেটে দিল। কলটা কেটে আরও কাঁদতে লাগল। নুরজাহান বেগম এতগুলো কথা বলতে চায়নি। তবে পরিস্থিতির কাছে সে ও বাঁধা। পল্লবীর বাবা আসগর সাহেব মারা গেছে এক বছর যাবত। এর পর থেকে পল্লবীর ভাইয়ের উপর খাচ্ছে, পড়ছে। নিজের জীবনেই সুখ নেই তার। নিজের ছেলের কাছেই সে পরগাছা তার মধ্যে পল্লবীর কথা শোনলে তো আরও বিপদ। ছেলে বউয়ের কথায় উঠে আর বসে। মূলত এ কারনেই নুরজাহান বেগম পল্লবীকে এত কথা শোনিয়েছে। অপরদিকে পল্লবী কলটা কাটার পর আবারও কাঁদতে লাগল। মনে মনে ভাবতে লাগল সে তো সংসার টিকানোর জন্য কম লড়াই করেনি তবুও কেন তাকে এত কথা শোনতে হচ্ছে।চারপাশের সবাই যেন আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে সবটা দোষ তার। সংসারটা যেন তার জন্যই ভেঙ্গেছে। কিন্তু কেউ এটা বুঝতে চায় না সংসারটা ভেঙ্গেছে সাহিলের জন্য। এ সমাজ কোনোকিছু হলেই কেন নারীর উপর আঙ্গুল তুলে? প্রশ্নটা যেন পল্লবীর মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। নিজেকে আজকে সবচেয়ে অসুখী মনে হচ্ছে মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ার জন্য। আনায়নার দিকে তাকিয়ে কষ্টটা যেন আরও বেড়ে গেল। আনায়নাকে বুকে জড়িয়ে হালকা দম নিয়ে বলল
– আমি তোকে কোনো কষ্ট পেতে দেবো না।এভাবেই বুকে আগলে রাখব সবসময়।
পল্লবী কথাগুলো বলতে লাগল আর আনায়নাকে ধরে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে গেল টেরেই পেল না। ঘুম ভাঙ্গল আনায়নার আলতো হাতের স্পর্শে। পল্লবী আনায়নার হাতটা মুখে নিয়ে দুই ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে রাখল। আনায়নাও পল্লবীর সাথে খেলতে লাগল। আনায়নার মিষ্টি মুখটা দেখলে যেন পল্লবীর সকল গ্লানি কষ্ট দূর হয়ে যায়। পল্লবী আনায়নাকে নিয়ে শুয়া থেকে উঠে বসল। এর মধ্যেই কলিং বেলের শব্দ কানে আসলো পল্লবীর। বসা থেকে উঠে দরজার দিকে একটু এগিয়ে যেতেই অধরা কোথায় থেকে যেন দৌঁড়ে এসে পল্লবীকে আটকে দিয়ে বলল
– তুই বস আমি দেখছি। পরশ এসেছে হয়তো।
পরশ অধরার স্বামী। ওদের বিয়ে হয়েছে একবছর যাবত।অধরা মূলত তার স্বামীকে নিয়ে এ বিশাল বাসায় একাই থাকে। পল্লবী অধরার কথায় আর সামনের দিকে না এগিয়ে ডাইনিং রুমের চেয়ারটা টেনে বসল। অধরা দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলল।পরশ ঘরে ঢুকে পল্লবীকে দেখেই বলল
– আরে আপু কেমন আছেন?
– ভালো আছি তুমি?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। এতদিন পর আসার সময় হলো তাহলে। সেই যে বিয়ের প্রথম দিন এসেছিলেন এরপর তো আপনার দেখায় পেলাম না।
পল্লবী পরশের কথাটার উত্তর দিতে যাবে এমন সময় অধরা পাশ থেকে বলে উঠল
– পল্লবী কিছুদিন এখানেই থাকবে।
পরশ হালকা হেসে উত্তর দিল
– তাহলে তো ভালোই হয়। আর যাইহোক অধরা কিছুদিন একটা সঙ্গী পাবে। সারাদিন বাসায় একা থেকে বেচারি একদম বোরিং হয়ে গেছে। আপনি এসেছেন খুব ভালো হয়েছে। তা সাহিল ভাইয়া কোথায়? সে আসেনি?
সাহিলের কথা শোনতেই পল্লবী একদম নিশ্চুপ হয়ে গেল। পল্লবীর ভাবভঙ্গি এমন দেখে পরশ একটু বিচলিত হয়ে বলল
– সাহিল ভাইয়ার সাথে কী ঝগড়া হয়েছে আপনার? ভাইয়ার সাথে রাগ করে চলে এসেছেন বুঝি? সমস্যা নেই আমি নিজে গিয়ে সাহিল ভাইকে নিয়ে আসব। সংসারে তো ঝামেলা হয়েই এসব নিয়ে মন খারাপ করবেন না।
এবারও পল্লবী নিশ্চুপ। কিছুই বলতে পারছে না। বুক ফেটে কান্না আসছে তার তবুও কাঁদতে পারছে না।অধরা পাশ থেকে নীচু গলায় বলল
– পল্লবীর সাথে সাহিল ভাইয়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে।
পরশ অধরার মুখে কথাটা শোনে একটু চুপসে গেছে। মুখটা গোমরা করে তেমন কিছু না বলেই রুমে চলে গেল। অধরা পরশের পেছন পেছন গেল। পল্লবী খানিকক্ষণ চেয়ারটায় বসে রুমের দিকে অগ্রসর হলো। একটু অগ্রসর হতেই পরশ আর অধরার কথোপকথোন কানে আসলো। যদিও কারও কথা শোনা অনধিকার চর্চা তবুও কেন জানি পল্লবী দাঁড়িয়ে পরল। বুঝতে পারল তাকে নিয়ে পরশ আর অধরার মধ্যে ঝামেলা চলছে। পরশ অধরাকে বলছে
– অধরা তোমার কী আক্কেল জ্ঞান নেই?
– কেন বলতো?
– একটা ডিভোর্সি মেয়েকে নিজের কাছে রেখেছ। আমি চাচ্ছি না পল্লবী এখানে থাকুক।
– ডিভোর্স তো কী হয়েছে? তার দোষে তো হয়নি। হয়েছে তো সাহিল ভাইয়ের কারনে। সাহিল ভাই পরকিয়ায় আসক্ত ছিল তাই।
– শোনো অধরা কোনো ছেলে এমনি এমনি পরকিয়া করে না। দেখো গিয়ে তোমার বোন হয়তো সাহিল ভাইয়ের সাথে সারাদিন অশান্তি করত তাই উনি শান্তি খুঁজতে অন্য মেয়ের কাছে গেছে।
– সবসময় মেয়েদের আঙ্গুল তুলে কথা কেন বলো? পল্লবীকে আমি চিনি। সে কেমন মেয়ে আমি জানি। সাহিলের চরিত্রের সমস্যার কারনে তুমি পল্লবীকে দোষ দিতে পারো না।
– তুমিও তো দেখি তোমার বোনের পথ ধরে হাঁটতেছ। বেশ কথা ফুটেছে তোমার মুখে। এ মেয়ে তো এসেই তোমার ব্রেন ওয়াশ করে দিয়েছে। এভাবে তর্ক তো কখনও করোনি আমার সাথে। আজকে এ মেয়ের জন্য আমার সাথে বেয়াদবি করছো। এ মেয়ে তো আমার সংসার ও নষ্ট করবে। নিজের সংসারটা গিলে খেয়ে এখন নিজের বোনের সংসারে ঝামেলা পাঁকাইতে আসছে। কেন তোমার কাছে আসতে হবে? মা ভাইয়ের কাছে যেতে পারে না? নষ্টা মেয়ে মানুষ।
অধরা কথাগুলো শোনেই জোরে চেঁচিয়ে বলল
– পরশ তুমি মাত্রা ছাড়িয়ে কথা বলছো। এতদিন তর্ক করেনি কারন এতদিন তুমি অন্যায় কিছু বলোনি। আজকে যা বলতেছ যা করতে বলতেছ সেটা অন্যায়। অন্যায়কে নিশ্চয় প্রশ্রয় দেওয়া উচিত না।
পরশ অধরার কথাটা থামিয়ে দিয়ে বলল
– আমি চাই না তুমি পল্লবীকে এখানে রাখো। ডিভোর্সি কোনো মেয়ের সংস্পর্শে থাকো সেটা আমি চাই না। তোমার ব্রেন অলরেডি তোমার বোন ওয়াশ করে দিয়েছে। আমার কথা তাই তোমার ভালো লাগছে না। আমার ইচ্ছা নেই পল্লবীর থাকার ব্যপারে। তারপরও যদি তুমি রাখো আমার কিছু করার নেই। তবে আমি চাই না এটা মনে রেখ।
অধরা কন্ঠটা তীক্ষ্ণ করে বলল
– আস্তে বলো পল্লবী শোনতে পাবে।
– শোনলে শোনুক আমার কী?
অধরা গলাটা গম্ভীর করে টান দিয়ে বলল
– পরশ….
পরশ আর পাল্টা কোনো জবাব দিল না।চুপ করে বিছানায় এলিয়ে পড়ল।
অপরদিকে পল্লবী কথাগুলো শোনে মনের অজান্তেই কেঁদে দিল। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি সে পাচ্ছে না।চুপ করে রুমে ঢুকে আনায়নাকে শুইয়ে দিয়ে, খাটের কোণে মাথাটা এলিয়ে খাটে বসে রইল। এর মধ্যেই অধরা এসে বলল
– কী রে কী করছিস?
– কিছু না রে।ভাবছি কাল পরশু মায়ের কাছে যাব।
– তুই না বললি চাকুরি জোগাড় করে যাবি।
– না রে মায়ের জন্য মন কেমন করছে। মায়ের কাছে গিয়েই চাকুরির ব্যবস্থা করব।
– বিশ্রাম কর তুই৷ কালকে ভাবা যাবে কী করবি।
সেদিন সারাটাদিন অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে পার করল পল্লবী।পরদিন সকাল ভোরেই পল্লবীর রুমে আসলো পরশ।পরশ কে দেখে হালকা ভয় পেয়ে গেল পল্লবী। ভয় ভয় কন্ঠে বলল
– আপনি এখানে এত সকালে।
পরশ কোনো কথা না বলেই পল্লবীর দিকে তাকিয়ে বলল-