পরিণয় পর্ব-১৬

0
1364

#পরিণয়
#লেখিকা – শারমিন আচঁল নিপা
#পর্ব-১৬

দুজন দুজনকে দেখে চমকে গেল। কারণ পল্লবী দেখতে পেল ভার্সিটির সবচেয়ে কাছের বান্ধবীটা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পল্লবী বুঝতে পারে নি সাদেক সাহেবের আশালতায় যে পল্লবীর কাছের বান্ধবী লতা হবে।

যার সাথে পল্লবীর যোগাযোগ নেই অনেকদিন যাবত। যদিও লতায় যোগাযোগ বন্ধ করে দিছিল। কারণ গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করার পর লতার একটা এক্সিডেন্ট হয়। এরপর পল্লবী লতাকে হাসপাতালে দেখতেও গেছিল। সেখান থেকে জানতে পারে লতা কখনও মা হতে পারবে না। এক্সিডেন্ট টা লতার মা হবার ক্ষমতা কেড়ে নেয়। এরপর থেকে লতার জীবনের অভিশাপ শুরু হয়। লতা ছিল ভার্সিটির সবচেয়ে সুন্দরী আর মেধাবী মেয়ে। সবচেয়ে সুন্দরী আর মেধাবী মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও তাকে কেউ বিয়ে করতে চাইত না।এ নিয়ে লতা অনেক ডিপ্রেশনে চলে যায়। সে ডিপ্রেশন থেকে আস্তে আস্তে সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। অনেক খুঁজার পর ও পল্লবী লতার খোঁজ পায়নি। আজকে লতাকে দেখে পল্লবীর মনটা আনন্দে নেচে উঠল। বুক ধুকপুক করতে লাগল। কাঁপা কাঁপা গলায় লতাকে জড়িয়ে ধরে বলল

– এতদিন কোথায় ছিলি তুই? তোকে কত খুঁজেছি।আড়াইটা বছর তোকে খুঁজে কোথাও পায়নি। তোর আগের বাসায় কত গিয়েছি কেউ তোর ঠিকানা দেয়নি। তোর মোবাইলে কত কল করেছি নম্বরটা বরাবরেই বন্ধ পেয়েছি। হুট করে তোকে এভাবে দেখব ভাবতেই পারিনি। কেমন আছিস তুই?

আশালতার চোখও আনন্দ অশ্রুতে ছলছল করছে। পল্লবীকে ভাঙ্গা সুরে জবাব দিল

– জীবনটা ভীষণ বিষিয়ে গিয়েছিল। নিজের থেকে অযোগ্য ছেলেদের কাছেও রিজেক্ট হচ্ছিলাম বার বার। সবাই কেন জানি না আমার দিকেই আঙ্গুল তুলত। বাচ্চা হবে না এটা যেন আমার ভুল। কেউ এটা বুঝে না এটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল। নিজের জীবনের হতাশা গুলো আরও বেড়ে চলছিল। তাই সবার থেকে আলাদা হয়ে যাই। নিজেকে নতুন করে গুছানোর স্বপ্ন দেখি। চাকুরির প্রস্তুতি নিই আর একটা ভালো চাকুরিও পেয়ে যাই। এরপর ও অনেক প্রস্তাব এসেছে কিন্তু ঐ যে মা হতে পারব না এটা শোনার পর সবাই রিজেক্ট করেছে।এরপর আর বিয়ের কথা চিন্তা করে নি। বয়স ও হয়ে গেছে। এখনের সমাজে তো ২৭-৩০ বছরের ছেলেকে বলা হয় যুবক আর ২৭-৩০ বয়সের মেয়েকে বলা হয় বুড়ি। তাই বিয়ের স্বপ্ন বাদেই দিয়েছিলাম।

এর মধ্যে আমার জীবনে সাদেকের আগমণ ঘটল ছয়মাস আগে। সে মোটামোটি আমাকে দেখে অনেক পছন্দ করে। তবে আমি একদম সিরিয়াস ছিলাম না।কারণ আমি জানতাম আমি যখন তাকে আমার বিষয়ে সবটা অবগত করব সে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। একদিন সাদেক আমাকে প্রপোজ করল।আমি না করে দিলাম। সে কারণ জানতে চাইলে আমি কারণ টা বললাম।তখন সে কোনো কিছু না বলেই বাসায় চলে যায়। আমি তো ধরে নিয়েছিলাম সে আর আমার জীবনে আসবে না। তবে আমার ধারণা পাল্টে দিয়ে পরদিন এসে বলল

-তুমি চাইলে আমি তোমাকে বিয়ে করব। আমাদের বাচ্চার দরকার হবে না। কারণ আমার বোনের বাচ্চা আছে। আর তোমার এক্সিডেন্টে তো তোমার হাত নেই। এটা তো বিয়ের পরও হতে পারত। সুতরাং আমি তোমাকে এভাবে মানতে রাজি।

– তোমার বোনের বাচ্চা তো আর আমাকে দিবে না। তোমাকে কোনোদিন আমি বাবা হওয়ার আনন্দ দিতে পারব না। এসব জেনেও কেন তুমি আমাকে চাচ্ছ?

– কারণ আমার বোনের বাচ্চাটা আমাদের সাথেই থাকে। তার একটা মা প্রয়োজন।

– মা প্রয়োজন মানে?

– হ্যাঁ একটা মা প্রয়োজন। আমার বোনটা মারা গেছে। তার বাচ্চার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য একজন মা প্রয়োজন। আশা করি এবার দ্বিমত করবে না।

আমি ভেবেছিলাম হয়তো সে আবেগে এসব বলছে তাই কিছুটা গম্ভীর গলায় তাকে উত্তর দিলাম

– আবেগ দিয়ে সব চলে না।তুমি চাইলে আমার থেকে অল্পবয়সী দেখতে সুন্দর মেয়ে বিয়ে করে নিতে পারবে।

– আমার বয়স ৩২। সুতরাং আবেগের সময় এখন না। তোমাকে বিয়ে করার মতো যোগ্যতা আর বয়স আমার আছে। তুমি চাইলে আমি আমার পরিবার রাজি করে বিয়ের ব্যবস্থা করব। আপাতত আমি আমার বাবার ব্যবস্যাটায় সামলাচ্ছি। তোমার অসুবিধা না হলে আমি আগাব। তোমাকে জোর করব না। চাইলে সময় নিতে পারো।

এরপর পুরো একমাস চিন্তা করলাম।সাদেকের সাথে কথা বললাম। ওর আচরণ আর ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে না করতে পারলাম না।আজকে বলল ওর বড় বোনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে।আমিও আসলাম দেখা করতে। তুই যে সেই বড় বোন জানতাম না।ওর মুখে এই একমাস অনেক শুনেছি তোর কথা। বয়সে ছোট হয়েও সাদেকের বড় বোনের জায়গাটা দখল করে নিছিস। সত্যিই তোর তুলনা হয় না। সাদেকের মুখে তোর সমস্ত ঘটনা শুনেছি। যাইহোক যা হয় ভালোর জন্য এটা আগে বিশ্বাস করতাম না এখন করি।

পল্লবী আশালতার কথা শুনে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে আলহামদুলিল্লাহ বলল। আর এটা ভাবতে লাগল সাদেক সাহেব সত্যিই অনেক বড় মনের মানুষ। তা না হলে সে লতাকে মেনে নিতে পারত না। এদিকে সাদেক সাহেব আশালতা আর পল্লবীর কথোপকথন শুনে অনেকটা বিস্ময় নিয়ে আশালতাকে জিজ্ঞেস করল

– তোমরা কী একে অপরকে চিনো?

আশালতা একটু হেসে বলল

– পল্লবী আমার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী হয়।আজকে তোমার জন্য তাকে ফিরে পেয়েছি।

সাদেক সাহেব হাসতে হাসতে পল্লবীকে বলল

– আপাই ট্রিট তো এখন দুইটা পাই একটা হলো প্রথম বেতন পেয়েছ সে ট্রিট আরেকটা হলো তোমার বান্ধবীকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছি সেই ট্রিট।

– তুই যা চাস দেবো। চল এবার কোথাও বসি। খেয়ে নিবি। সকালে তো নাস্তা করেছিস নাকি সেটাও ট্রিট দিব দেখে করিস নি?

পল্লবীর কথা শোনে সাদেক সাহেব অট্ট হেসে বলল

-নাস্তা করে আসলেও খেতে পারব। চলো রেস্টুরেন্টের ভেতেরে যাওয়া যাক।

বলেই তিনজন রেস্টুরেন্টের ভেতর ঢুকে বসলো। পল্লবী সাদেক সাহেবকে ম্যানুটা এগিয়ে দিয়ে বলল

– তোর যা পছন্দ অর্ডার কর।

সাদেক সাহেব হালকা লাজুক গলায় বলল

– আশালতাকে বলো পছন্দ করতে। ওর কী খেতে ভালো লাগে সেটাই অর্ডার করুক।

পল্লবী হালকা হেসে আশালতার দিকে ম্যানুটা এগিয়ে দিয়ে বলল

– নে তোর পছন্দ মতো অর্ডার কর। তোর প্রিয়তম আবার তোর পছন্দ ছাড়া খাবে না।

আশালতা হালকা মৃদু হেসে পল্লবীকে জবাব দিল

– কী যে বলিস না। আচ্ছা সমস্যা নেই আমিই অর্ডার করছি।

বলেই কিছু খাবার অর্ডার দিল। আর এদিকে পল্লবী, সাদেক সাহেব, আর আশালতা গল্প করতে লাগল। পল্লবী সাদেক সাহেবকে জিজ্ঞেস করল

– কী রে বিয়ে কবে করছিস? পরিবারকে কী জানিয়েছিস?

সাদেক সাহেব লজ্জামাখা কন্ঠে জবাব দিল

– আশালতা চাইলে সামনের সপ্তাহে আংটি পড়াতে যাব।

পল্লবী আশালতার দিকে তাকিয়ে বলল

– তোর কী এখনও আপত্তি আছে নাকি আরও সময় নিবি?

– নাহ আর সময় লাগবে না। আমি রাজি। আমার বাবা মা সাদেকের ব্যপারটা জানে। তারা রাজি হয়েছে খুশি মনে।

পল্লবী সাদেক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল

– তোর পরিবার মেনে নিয়েছে তো?

– আমার পরিবারকে আরও দুইমাস আগেই রাজি করিয়ে নিয়েছিলাম। আশালতা সময় চেয়েছিল তাই সময় দিয়েছি। এখন তো ও বলল রাজি সুতরাং আগামি সপ্তাহেই মা, বাবা, তুমি আর সুবাইতা কে নিয়ে যাব।

পল্লবী হালকা গলায় বলল

– সুবাইতাটা কে?

সাদেক সাহেব মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল

– তোমাকে তো মাধবী আপুর মেয়ের নামটা বলায় হয় নি। মাধবী আপুর মেয়ের নামেই সুবাইতা।

– ওহ আচ্ছা।

এর মধ্যে খাবার চলে আসলো। খাবার খেতে খেতে গল্প করতে লাগল তারা। খাবার খাওয়া শেষে সাদেক সাহেব পল্লবীকে বলে উঠল

– আজকে আর তোমাকে অফিস যেতে হবে না।আমার কী কী লাগবে তোমাকে লিস্ট করে দেবো। এই সাতদিন শুধু সেগুলো আশালতাকে নিয়ে কিনবে।

পল্লবীও হাসিমুখে সবটা মেনে নিল। আশালতাকে বিদায় জানিয়ে বাসায় আসলো। পল্লবী বাসায় এসেও আশালতার কথা ভেবে মনটা শীতল করল।কারণ সে এটা ভেবে স্বস্তি পাচ্ছে যে প্রতিটা মানুষেই কষ্টের পর একরাশ স্বস্তি পায়। সৃষ্টিকর্তার লীলাখেলা বুঝা বড় দায়। তিনি যে কাকে কখন খুশি করবেন অথবা কষ্ট দিবেন সেটা শুধু তিনিই জানেন।

বাসায় ফিরেও নিজের পরিবারের সাথে পল্লবী বেশ ভালো সময় পার করল। ইদানীং পল্লবীর পেটের বাচ্চাটাও বেশ দুষ্ট হয়ে গেছে হুটহাট লাথি মারে। আর পল্লবী সে অনুভূতি গুলো পরম যত্নে উপভোগ করে।

এর মধ্যেই সাদেক সাহেব মস্ত বড় একটা লিস্ট ধরিয়ে দিল পল্লবীর হাতে। পল্লবী লিস্টটা হাতে নিয়ে আশালতাকে কল দিল। পরদিন বের হওয়ার সময় ঠিক করল। স্থির করল পরদিন সকাল ১০টায় বের হবে।

পরদিন সকালে আশালতা আর পল্লবী বের হলো শপিংয়ের উদ্দেশ্যে। গাড়ি থেকে নামতেই পল্লবী আশালতাকে দেখল, সে দাঁড়িয়ে আছে শপিং কমপ্লেক্সের সামনে। পল্লবী আশালতার কাছে গিয়ে বলল

– কতক্ষণ আগে এসেছিস?

– এইতো কিছুক্ষণ হলো।তোর আসতে কষ্ট হয়নি তো?

– আরে না, কষ্ট কেন হবে?

– পেটে যে একজন আছে সেজন্য বললাম।

– হাহাহা। বাবু আর আমি একদম ঠিক আছি।চিন্তা করতে হবে না। চল যাওয়া যাক।

কথাটা বলেই পল্লবী আশালতাকে নিয়ে শপিংমলের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। অগ্রসর হতে হতেই হুট করে পল্লবী দাঁড়িয়ে পড়ল। পল্লবীকে এভাবে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে আশালতা জিজ্ঞেস করল

– কী রে দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?