#পাগলীর_ভালোবাসা(পর্ব ১)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
আজ চার বছর পর দেশে ফিরেছে তন্ময়। আশে পাশে মামা মামি সহ প্রায় সবাইকেই দেখা গেলেও তার খুব প্রিয় এখটা মুখ এখনো সামনে এলো না। সকলের মুখ হাস্যজ্জল। তন্ময় হাসি মুখে মামার দিকে চেয়ে বলে,
“ফারিণ কোথায় মামা? সবাইকে দেখছি বাট সে নেই। সে কি আসেনি?”
মূহুর্তেই সবার হাসি মুখ মলিন হয়ে গেলো। নিশ্চুপ হয়ে গেলো সকলে। আচমকাই এমন কিছু হওয়ায় বিষ্মিত হলো তন্ময়। মামির দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকালে মামি মলিন মুখে কিছুটা হাসি রাখার চেষ্টা করে বলে,
“আছে সে বাসায় আছে। শরির খারাপ দেখে এখানে আসতে পারেনি।”
তন্ময়ের কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হলো কথাটা। ফারিণকে সে ছোট বেলা থেকেই চেনে। তন্ময় আসছে শুনলে সে কিছুতেই বাসায় বসে থাকবে না। যত শরির খারাপই হোক।
বিষয়টা নিয়ে খুব একটা ভাবার সময় পেলো না সে। তার আগেই পাশ থেকে মা এসে তন্ময়ের হাত ধরে বলে,
“মাত্র বাসায় ঢুকেছিস। ক্লান্ত তুই। এখন ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিবি চল।”
,
,
ওদিকে একটি বন্ধ ঘরে বন্ধি অবস্থায় পড়ে আছে ফারিন। হটাৎই পাশে থাকা পানির গ্লাস টা সজোড়ে ফ্লোরে ছুড়ে মেরে চিৎকার করে উঠে সে। তারপর জগটাও। তারপর তার পাশে রেখে যাওয়া খাবারের প্লেটটাও। হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই ছুড়ে মারছে এক এক করে। যেন উম্মাদ হয়ে উঠেছে সে।
তবে তার এই অবস্থা দেখার মতো বাসায় দ্বিতীয় কোনো মানুষ অবশিষ্ট নেই। একটু পর পর চিৎকার করছে নিজের মতো করে। তাকে শান্ত করার মতো কেউই নেই। সবকিছু ভাঙচুর করেও যেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি সে। হটাৎই ডুকরে কেঁদে উঠে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়ে ফ্লোরে। নিরবে কিছুক্ষণ কেঁদে কাঁদু গলায় নিজের মাঝে বিড়বিড় করে বলে,
“দরজা খুলে দাও আম্মু। আমাকেও নিয়ে যাও তোমাদের সাথে। আমিও তন্ময় ভাইয়াকে দেখতে যাবো।”
,
,
মামা-মামি ও পরিবারের সবাইকে নিয়ে দুপুরের খাবার শেষ করল তন্ময়। কথাবার্তা আলোচনায় পুরো ঘর জমজমাট। এত বছর বাইরে সময় কেমন কেটেছে? পড়াশুনা ঠিকঠাক ভাবে শেষ হয়েছে কিনা? এখন কি করার প্ল্যান আছে? তন্ময়ের সাথে এসব নিয়ে একেক জনের একেক রকম আলোচনা। উদাসিন ভাবে সবার নানান প্রশ্নের উত্তর দিলেও তন্ময়ের মন পড়ে আছে অন্য জায়গায়। সেটা অবশ্যই ফারিণ। যেটা আগেও তন্ময়ের ভালো থাকার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর প্রায়ই ফারিনের সাথে কথা হতো তার। সময় গুলো খুবই সুন্দর ছিল। ফারিণ ছিল দুষ্ট প্রকৃতির। সব সময় হাসি খুশি থাকতো। দুষ্টুমিতে, খুনশুটিতে সময় গুলো সুন্দর কাটতো খুব।
কিন্তু গত ছয় মাস ধরে ফারিণের সাথে একবারের জন্যও কথা হয়নি। মামা-মামিকে ফারিণের কথা জিজ্ঞেস করলেই তারা বিষয়টা কোনো না কোনো ভাবে এড়িয়ে যেত। ফারিণ কখনো কলেজে গেছে, কখনো কোচিং-এ, কখনো ঘুমাচ্ছে। এসব অজুহাতে কথা হয়নি ছয় মাস। বাবা মাকে বিষটা জিজ্ঞেস করলেও তারা খুব একটা সিরিয়াস ভাব দেখায়নি কখনো। তারাও বলতো সামনে এক্সাম, তাই হয়তো পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত আছে খুব।
মাঝে মাঝে বিষয় গুলো তাকে ভাবালেও একটা শান্তানায় নিজেকে চিন্তা থেকে মুক্ত করতো তন্ময়৷ আর কয়েক মাস পর তো ফিরছি দেশে। সব ব্যস্ততা শেষে তখন নাহয় আগের মতো সেই সুন্দর দিন গুলো ফিরে আসবে।
আলোচনার মাঝে তন্ময় মামা-মামির দিকে চেয়ে বলে,
“ফারিণের শরির কি খুব খারাপ মামা?”
মামা-মামি দুজন দুজনের দিকে তাকালো। তাদের মাঝে কি চলছে তা বুঝে উঠতে সক্ষম হলো না তন্ময়। মামি জোড় পূর্বক কিছুটা হেসে বলে,
“হ্যা বাবা, মোটামুটি। তাই তো আসতে পারেনি।”
মামির কথা শেষ হতেই তন্ময় বলে,
“তাহলে বিকেলে গিয়ে ফারিণকে দেখে আসবো আমি। শরির কিছুটা ভালো মনে হলে এখানে নিয়ে আসবো।”
ফারিণের প্রতি এখনো ছেলের এতো আগ্রহ দেখে পাশ থেকে তন্ময়ের মায়ের মুখে যেন শ্রাবনের কালো মেঘ এসে ভর করল। এই ছয় মাসের দুরুত্বও কি ফারিণের প্রতি তন্ময়ের দুর্বলতা টা একটুও কমেনি? ছেলের মাঝে এখনো আগের মতোই অস্থিরতা দেখে কিছুটা হতাশ হলো সে। মুখ খুলে বলে উঠে,
“আজ যাওয়ার দরকার নেই বাবা। সময় হলে আমরা সবাই মিলে যাবো। এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি। শরির নিশ্চই ক্লান্ত। আজ বরং বিশ্রাম নে।”
তন্ময় মায়ের দিকে চেয়ে বলে,
“সমস্যা নেই মা, আমি ঠিক আছি।”
ছেলের কথায় আবারও হতাশার ছাপ ভেষে উঠলো মায়ের মুখে।
,
,
বিকেলে তন্ময়ের সাথে মামা-মামিও রওনা দেয় বাড়ির উদ্দেশ্যে। ফুরফুরে মেজাজে বাইরে দিকে দৃষ্টি রেখে বসে আছে তন্ময়। পেছনের সীট থেকে মামা শান্ত গলায় বলে উঠে,
“গাড়িটা একটু সাইড করতে বলো তো বাবা। তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে।”
মাঝ রাস্তায় কি এমন জরুরি কথা থাকতে পারে তা জানা নেই তন্ময়ের। ড্রাইভারকে বলে গাড়িটা একপাশে পার্ক করে নেমে গেলো তারা। এক পাশে গিয়ে বসলো তারা। এত বছর পর হালকা বাতাসে বিকেলটা ভালোই লাগছে তন্ময়ের। যেন অনেক দিন পর প্রান খুলে শ্বাস নিচ্ছে।
মামা পাশ থেকে শান্ত গলায় বলে,
“বিষয়টা ফারিণের সম্পর্কে। আমার মতে তোমার আপাতত তার কাছে না যাওয়াটাই ভালো হবে। তোমার বাবা মায়ের সামনে সরাসরি নিষেধ করতে পারিনি। তাই এখন তোমাকে বলছি। ঐ বাড়িতে যেও না। ফারিণের থেকে দুরে থাকাটাই তোমার জন্য ভালো হবে।”
তন্ময় কিছুটা বিষ্ময় নিয়ে বলে,
“এমনটা কেন বলছেন মামা! আগে তো কখনো এমনটা বলেন নি! দুরুত্বের এই এই চার বছর পর হুট করে সবাই এমন পাল্টে গেলো কেন? কেন যেন মনে হচ্ছে আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছেন আপনারা।”
মামা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“ছয় মাস আগে ফারিণের একটা এক্সিডেন্ড হয়েছিল। আঘাত খুব গুরুতর ছিল। দুই মাস হসপিটালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে বেচে ফিরেছে সে। তবে কিছুটা মেন্টালি প্রব্লেম দেখা দেয় তার মাঝে। কখন কি করে কোনো কিছুতেই খেয়াল থাকে না। সারাক্ষণ চুপচাপ রুমে বসে থাকে। আর কোনো কারণে রেগে গেলে সব ভাঙচুর করে। পাগলের মতো আচরণ করে সে। চিকিৎসা চলছে তার। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে কিনা তার নিশ্চয়তা দেয়নি কোনো ডাক্তার। তবে একটা আশা দিয়েছে, ভাগ্য ভালো হলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলেও ফিরতে পারে।”
সবটা শুনে যেন স্তব্দ হয়ে গেলো তন্ময়। কিছুক্ষণ চুপচাপ মামার দিকে চেয়ে বলে,
“এত কিছু ঘটে গেছে, কেউ আমাকে একবারের জন্যও জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি?”
মামা স্বাভাবিক ভাবে বলে,
“তোমাদের দুজনকে ছোট বেলা থেকেই বুঝি আমরা। আমরা সবাই জানি এসব শুনে তুমি কখনোই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতে না। তখন তোমার পড়াশুনার শেষ টাইম ছিল। ঐ সময়টায় এমন খবর শুনে, তোমার ক্যারিয়ারের কোনো ক্ষতি হোক, এটা চাইনি আমরা। তাই না চাইতেও বিষয়টা তোমার থেকে গোপন রাখতে হয়েছিল।”
তন্ময় মুহুর্তেই করুন গলায় বলে উঠে,
“এখন কেমন আছে সে? কি করছে? বাসায় কার কাছে রেখে এসেছেন তাকে?”
মামা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলে,
“দেশে ফিরে প্রথম দিনই এমন ঝামেলা ফেস করো তা চাইনি। তাই তাকে ঘরে তালাবদ্ধ করে রেখে এসেছি। বুঝতেই পারছো, তার অবস্থা কেমন। তাই বলছি তার থেকে দুরে থাকাটাই তোমার জন্য ভালো হবে।”
তন্ময় চোখ বুজে নিলো। এই মুহুর্তে মামাকে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, নিজের মেয়ের সাথে এমন অমানুষিক আচরণ কিভাবে করছে তারা। তবে হাজার হোক গুরুজনরা সম্মানিত ব্যাক্তি। তাই নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো সে। তার দেখাদেখি মামা-মামিরাও উঠে গেলো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে। তারা ভালোই বুঝতে পারছে, এই ছেলেকে এখন হাজার বুঝিয়েও কোনো লাভ হবে না।
,
,
তন্ময়ের মা শুকনো জামা কাপর গুলো গোছাতে গোছাতে বলে,
“দেখলেই পাচ্ছো তোমার ছেলের পাগলামি। বাড়িতে পা না রাখতেই ঐ পাগল মেয়েটার কাছে ছুটে গেলো।”
তন্ময়ের বাবা বসে রইলেন চুপচাপ। মা কাপর গোছানো শেষ করে পূনরায় বলে,
“ছেলের মতিগতি ভালো মনে হচ্ছে না আমার। কোনো পাগল মেয়েকে আমার একমাত্র ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতে পারবো না আমি।”
তন্ময়ের বাবা শান্ত গলায় বলে,
“সারা জীবন তুমি নিজেই তো সব সময় বলে এসেছো, ভাইয়ের মেয়েকেই ছেলের বউ করে নিয়ে আসবে।”
কথা শেষ হতেই মা বলে,
“এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। আবেগ দিয়ে দুনিয়া চলে না। আমার হীরের টুকরো ছেলের জন্য মেয়ের অভাব হবে না দেশে।”
বাবা শান্ত ভাবে বলে,
“এখন তোমার মতলব টা কি, খুলে বলো।”
“সোজা হিসেব, তন্ময়ের জন্য কোনো ভালো পাত্রীর সন্ধান করা। বিয়ের পর অন্য কারো মায়ায় পড়ে গেলে সে আবেগ থেকে বেড়িয়ে বাস্তবতা বুঝতে শিখবে।”
,
,
গাড়ির শব্দ শুনতেই চুপচাপ জানালার পাশে গিয়ে দাড়ালো ফারিণ। বাবা মায়ের সাথে তন্ময় নামলো গাড়ি থেকে। সেদিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে। হাসছেও না, কাঁদছেও না। ঘিরে আছে এক রাশ নিরবতা।
তন্ময় ঘরে ঢুকতেই মামা তার কাধে হাত রেখে বলে,
“এভাবে তার কাছে যাওয়া ঠিক হবে না তোমার। রাগের মাথায় তোমাকে আঘাত করতে পারে সে।”
মামার হাতের উপর নিজের হাত রেখে তন্ময় কিচুটা মুচকি হাসির ভাব রেখে বলে,
“সমস্যা নেই মামা। আমি সামনে নিব।”
দরজা খুবে ভেতরে ঢুকতেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য ফ্লোরের দিকে তাকালো তন্ময়। ভাঙচুর করে যা-তা অবস্থা। মাথা তুলে জানালার পাশে দাড়ানো ফারিনের দিকে তাকায় সে। টি-শার্ট ও প্লাজু পরে জানালার গ্রিল ধরে খোলা চুলে বাইরের দিকে চেয়ে আছে।
তন্ময় কয়েক পা এগিয়ে তার কাছে গিয়ে দাড়িয়ে শান্ত গলায় বলে,
“ফারু।”
শান্ত মেয়ের মতো চুপচাপ তন্ময়ের দিকে ফিরে তাকায় সে। কিছুক্ষণ নিরবতায় ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে তন্ময়ের দিকে। কোনো কথা বলছে না। ফর্সা মুকটা ফ্যাঁকাশে হয়ে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে কিছু সময় কাঁন্নায় পার করেছিল সে।
তন্ময় আলতো করে ফারিনের গাল ছুয়ে দিয়ে বলে,
“আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি তোর তন্ময় ভাই।”
To be continue……………….