পাগলীর ভালোবাসা পর্ব-০২

0
259

#পাগলীর_ভালোবাসা (পর্ব ২)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

“আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি তোর তন্ময় ভাই।”
নিজের পরিচয় দিয়েও ফারিণের মাঝে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা গেলো না। এখনো চুপচাপ চেয়ে আছে তন্ময়ের দিকে। তন্ময় আর কিছু বলতে যাবে তার আগেই অচেতন হয়ে ঢলে পড়ে ফারিণ। ফ্লোরে আছড়ে পড়ার আগেই তন্ময় ধরে ফেলে তাকে। ফারিণের গালে হাত দিয়ে টোকা দেওয়ার মতো স্পর্শ করে শান্ত গলায় ডেকে উঠে, ফারিণ!

বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে ফারিণ। সময় তখন সন্ধা ৭ টা। মামি কিছুক্ষণ আগে ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাচের টুকরো গুলো ভালো ভাবে পরিস্কার করে নিল। ডাক্তার এসে দেখছে তাকে। পাশেই অস্থিরতা নিয়ে বসে আছে তন্ময়। কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও অস্থিরতা কমছে না তার। ডাক্তার তার কাজ শেষে জানালো, সারাদিন প্রচুর চাপ নিয়েছিল সে। সেই সাথে কিছু না খাওয়ায় শরির দুর্বলতার কারণে এমনটা হয়েছে। এটা সিরিয়াস কিছু না। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। এর মাঝে খাবারের ঘাটতি পূরণ করে দূর্বলতা কাটাতে স্যালাইন দিতে হবে তাকে।

তখন গভির রাত। ফারিণের স্যালাইন শেষ হলেই খুলে ফেলতে হবে। যার জন্য এক মুহুর্তের জন্যও চোখ বন্ধ করেনি তন্ময়। একটা চেয়ার টেনে ফারিণের পাশে বসে ছিল পুরোটা সময়। চোখে মুখে ক্লান্তি থাকলেও সেই ক্লান্তিকে খুব একটা প্রাধান্য দিলো না সে। আমি আছি বলে, মামা-মামিকে জোর করে সেখান থেকে পাঠিয়ে দিয়েছে ঘুমানোর জন্য।

তন্ময়ের ফোনটা বেজে উঠলে হাতে নিয়ে দেখে মায়ের ফোন। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মা বলে,
“গতকাল রাতও ঘুমাতে পারিসনি। যার্নি করে বাসায় আসতে প্রায় দুপুর হয়ে গেলো। খাবার খেয়ে আবার চলে গেলি তোর মামার বাসায়। এখন বাজে রাত ২ টা। অথচ এখনো জেগে আছিস তুই। এসবের মানে কি তন্ময়?”
তন্ময়ের মাঝে সত্যিই ক্লান্তি ভর করে আছে খুব। গতকাল সারা রাত ফ্লাইটের কারণে ঘুম হয়নি। ছেলের ব্যাপারে মা সব কিছুই খুব ভালো ভাবে খোঁজ রেখেছে। চোখে মুখের ক্লান্তির ছাপ দুর করে তন্ময় কিছুটা হাসি মুখে মাকে বোঝানোর জন্য বলে,
“আরে মা চিন্তা করো না। আমি ঠিক আছি।”
মা এই ব্যাপারে আর কথা বাড়ালো না। কর্কশ গলায় বলে,
“ভোর হতেই বাসায় ফিরবি তুই।”
বলেই চুপচাপ লাইন কেটে দিল সে। তন্ময় ফোনটা এক পাশে রেখে ফারিণের দিকে তাকায়। ফারিনের এক হাতের আঙুলের ভাজে আঙুল দিয়ে সেই কখন থেকে ধরে রেখেছিল তা ভালো করে মনে করতে পারছে না সে। শুধু মনে আছে, এক হাত অপর হাতকে আকড়ে ধরে আছে অনেকটা সময়।
বেলকনির দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে উঠতেই এবার ফারিণ নিজে থেকেই শক্ত করে চেপে ধরলো তন্ময়ের হাতটা। উঠতে গিয়েও থেমে গেলো তন্ময়। দৃষ্টি রাখলো ফারিণের মায়াবি মুখটার দিকে। চোখ বুজে রাখা ঘুমন্ত চেহারা যেন আরো মায়াবী করে তুলেছে তাকে। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল সেই মায়াবী মুখের অধিকারী মানুষটার দিকে। ইশ, আজ কত বছর পর। ভাবতেই যেন সব ক্লান্তি মুহূর্তেই দুরে সরে গেলো তার।
,
,
আজ শুক্রবার। ফারিণকে মোটামুটি ভালোর দিকে দেখলে পরদিন সকালে বাসায় ফিরে তন্ময়। মা তার সামনে টেবিলে বিরিয়ানির প্লেট রেখে বলে,
“তোর ফেভারিট বিরিয়ানি।”
তন্ময় প্লেট টা নাকের সামনে নিয়ে সুবাস নিয়ে মায়ের দিকে চেয়ে বলে,
“আজ কত বছর পর তোমার হাতের বিরিয়ানি। জানো, সেখানে থাকতে কত মিস করেছিলাম। মাঝে মাঝে বিরিয়ানি খাওয়ার সময় মনে হতো, কখন দেশে ফিরবো, আর তোমার হাতের স্পেশাল বিরিয়ানির স্বাদ পাবো।”
বলেই হাত ধুয়ে খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তন্ময়। কিছুটা হাসলো মা। বাবাও যোগ দিল তাদের সাথে। কথার ফাঁকে মা কিছুটা হাসি মুখে বাবার দিকে চেয়ে বলে,
“খুব শিগ্রই ছেলের জন্য এমন একটা লক্ষ্মী বউ ঘরে নিয়ে আসবো, যার অবশ্যই চমৎকার বিরিয়ানি রান্নার গুন আছে।”
খাবার মুখে তুলতেই থেমে গেলো তন্ময়। মায়ের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো, মা কথার ফাঁকে অন্য কোনো মেসেজ দিয়েছে কিনা। বাবা হেসে বিষয়টাকে ফান হিসেবেই পরিবর্তন করে নিলো। তন্ময়ও বিষয়টাকে আর খুব একটা সিরিয়াসলি নিলো না। চুপচাপ খাওয়া শুরু করলো সে।
,
,
দুপুরের খাবার খেয়ে চুপশচাপ বিছানায় বসে ছিল ফারিণ। পাশে তন্ময়। এখন অব্দি ফারিণের মুখ থেকে একটা কথাও শুনতে পারেনি সে। সেই শুরু থেকেই চুপচাপ বসে থাকে। আর কিছু বললেও তন্ময়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
ফারিণের নিরবতায় তন্ময় ফোন বের করে দুজনের সেই পুরোনো দিনের দুষ্টু মিষ্টি ছবি গুলো বের করে। একটা ছবি ফারিণের দিকে বাড়িয়ে দেয়। যেখানে পেছন থেকে তন্ময়ের গলা জড়িয়ে পিঠে ঝুলে আছে ফারিণ। তন্ময় নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলেও ফারিণের মুখে ছিলো প্রশারিত হাসি।
“তোর মনে আছে ঐ সময় গুলোর কথা।”
ফারিণের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে তন্ময়। ফারিণ ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চুপচাপ বিছানা থেকে নেমে রুমের এক পাশে রাখা আলমারিটার দিকে এগিয়ে গেলো। ভেতর থেকে তার ফোনটা বের করে নিল। যেটা এখন বন্ধ অবস্থায় আলমারিতে পরে থাকে। ফোনটা অন করে তন্ময়ের দেখানো সেম পিকটা খুঁজে বের করে তন্ময়ের দিকে বাড়িয়ে ধরে। সাথে ফারিণের মুখে হাসির ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে। তন্ময় এক পলকে তাকিয়ে রইল সেদিকে। সাথে ফারিণের হাস্যজ্জল মুখটার দিকে। আসার পর এই প্রথমবার গম্ভিরতা বাদ দিয়ে হাসতে দেখছে তাকে।

দরজার পাশে দাড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে ফারিণের মা। মেয়েকে দেখে অবাকই হচ্ছে সে। তন্ময়ের সাথে কত স্বাভাবিক আচরণ। দেখে মনে হচ্ছে যেন সেও অন্য মেয়েদের মতোই স্বাভাবিক।
কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে রুমে প্রবেশ করলেন তিনি। মামিকে দেখে তন্ময় স্বাভাবিক ভাবে বলে,
“মামি আসুন, বসুন এখানে। বিকেলে ফারিণকে নিয়ে একটু বের হবো ভাবছি। হয়তো বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসলে ভালো লাগবে তার।”
মামি কিছুটা মলিন মুখে বলে,
“হসপিটাল থেকে ফেরার পর গত চার মাস সে বাড়ি থেকেও বের হয়নি। আমরাও চেস্টা করেছিলাম। কিন্তু ঘর থেকে বের করতেও রাজি করাতে পারিনি। এখন কি তোমার সাথে যাবে? কিরে যাবি?(ফারিণের দিকে চেয়ে)”
মায়ের প্রশ্নে উপর নিচে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সুচক সম্বতি জানায় ফারিণ। আজ হটাৎ মেয়ের আচরণের এমন পরিবর্তন দেখে আরেক দফা অবাক হলেন তিনি।
,
,
কিছুক্ষণ গাড়িতে একা একা বসে ছিল ফারিণ। হাতে এক গুচ্ছ লাল গোলাপ ও আইসক্রিম নিয়ে তার পাশে এসে বসলো সন্ময়। মুখে হাসির ভাব রেখে বলে,
“তোর ফেভারিট গোলাপ ও আইসক্রিম। ছোট বেলায় মাঝে মাঝে বায়না ধরতি এনে দেওয়ার জন্য। মাসে একবার হলেও তোদের বাড়িতে এসে তোকে কোথাও ঘুরতে না নিয়ে গেলে রাগ করতি খুব। এখনো তোকে দেখলে মনে হয় সেই ছোট্ট ফারিণ। আমাকে দেখলেই যার মাঝে হাজারও বায়না প্রস্তুত হয়ে যায় মুহুর্তেই। আর এখন এত দুর পথ পাড়ি দিয়ে তোর কাছে ছুটে আসলাম। অথচ এখন অব্দি একটুও কথা বলিস নি। আমার পিচ্চিটাকে কি এমন চুপচাপ থাকা মানায়?”

এখনও কোনো কথা বললো না ফারিণ। চুপচাপ তন্ময়ের দিকে চেয়ে আছে। তবে এখন চেহারায় কোনো গম্ভিরতার ছাপ নেই। হাতে থাকা ফুটন্ত গোলাপটার মতোই ফুটফুটে সেই চাহুনি।

বাইরে হালকা বাতাসে বাস্তার পাশে গাছের পাতা গুলো দুলছে। আশে পাশে ঘুরতে আসা অনেক মানুষ এই মুক্ত বাতাসে হাটছে। সুন্দর বিকেলটা উপভোগ করছে তারা। তাদের দেখে তন্ময় ফারিণের দিকে চেয়ে বলে,
“ওদের মতো হাটবি?”
ফারিণ মাথা কাত করে হ্যাঁ বুঝালো। তন্ময় গাড়ি থেকে নেমে অপর পাশে গিয়ে ফারিণকেও নামালো। মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিলো সে। কি যেন ভেবে ফারিণের পেছনে দাড়িয়ে চুল গুলো খুলে দিল সে। এই মায়াবতীর চুল গুলো হালকা বাতাসে উড়তে দেখার মুহুর্তটা মিস করতে ইচ্ছে করছে না তার।
এমন সময় পেছন থেকে একটা মেয়েক কন্ঠস্বর ভেষে আসে,
“আরে তন্ময় না!”
পেছন ফিরে দেখে তার ভার্সিটি লাইফের বান্ধবি আরিয়া। তন্ময়ও হাসি মুখে বলে,
“আরিয়া! কেমন আছো?”
“ভালো আছি। দেশে ফিরলে কবে?”

তাদের মাঝে কুশল বিনিময় হলো। পুরোনো বন্ধু হিসেবে ফ্রি মাইন্ডে হাসি মুখে হাগ করেছিল দুজন। তাদের কাছে বিষয়টা স্বাভাবিক মনে হলেও পাশ থেকে ফারিণের হাসি মুখটা মুহুর্তেই গম্ভির হয়ে গেলো। রাগে কিছুক্ষণ শ্বাস নিয়ে আচমকাই আরিয়ার গলায় হাত দিয়ে গাড়ির সাথে চেপে ধরলো তাকে। কয়েক সেকেন্ড পার হয়ে গেলেও ছাড়লো না। যেন ফারিণের উদ্দেশ্য আরিয়াকে এই মুহুর্তেই মে’রে ফেলা। আশে পাশের কিছু মানুষ চেয়ে আছে তাদের দিকে। এমন লজ্জা জনক পরিস্থিতিতে পাশ থেকে তন্ময় ছাড়িয়ে নিল তাকে। আরিয়া কিছুটা ঝুকে কয়েকটা কাশি দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিলো। ফারিণ এখনো রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আরিয়া কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বলে,
“এসব কি তন্ময়? পাগল নাকি ও?”
বলে আবারও কাশি দিল সে। এমন কিছুর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না তন্ময়। ফারিণ এমন কিছু করবে তা কল্পনায়ও আসেনি তার। ফারিণের হয়ে আরিয়াকে ‘স্যরি’ বলে হাতের ইশারায় তাকে শান্ত থাকতে বলে। অতঃপর ফারিণকে নিয়ে গাড়িতে উঠে দ্রত গাড়ি নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান সে।
বাকি রাস্তা ফারিণ গম্ভির দৃষ্টিতে বাইরের দিকে চেয়ে ছিল চুপচাপ। তন্ময়ের দিকে চেয়ে আর একবারের জন্যও হাসেনি সে।

To be continue…………….