পুতুল বউ পর্ব-১৬+১৭

0
258

#পুতুল_বউ
#Afxana_Junayed
#পর্ব_১৬

চারোদিকে পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখোরিতো হয়ে আছে।মিষ্টি গোল রোদ্দুরটা কমল ভাবে আলো দিচ্ছে,পুরো আকাশটা একদম পরিস্কার হয়ে আছে।সেই স্পষ্ট আকাশের স্পষ্ট রোদের কিরণ পড়ছে সামিরের বারান্দায় রেলিং বেয়ে।কাচের দরজা থাকায় আলোটা সরাসরি তাদের দুজনের মুখে লাগছে।বেলকনির একদম কোনায় রাখা আছে একটা সাদা দোলনা,দোলনায় হেলান দিয়ে বুকে থাকা মানুষটাকে যত্ন করে আগলে রেখেছে সামির!তার চোখও ঘুমের তল দেশে ঘুরছে,কিন্ত হঠাৎ মুখে কেমন সুরসুরির অনুভব হতেই হালকা চোখ খুলে সামির,তখনি রোদের ঝলক এসে সামিরের সারা মুখে পরে।সামির আবার চোখ খিচে বন্ধ করে নেয়,চোখ বন্ধ অবস্থায় মুখে হাত বুলিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কিসের জন্য সুরসুরি লাগছে,বুঝতে পারে এটা পুতুলের চুল।হাত দিয়ে চুলগুলো সরিয়ে চোখ খুলে,দেখে পুতুল তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে, হালকা হাসে সামির।

কালকে রাতে কান্না করতে করতে সামিরের বুকেই ঘুমিয়ে যায় পুতুল।সামিরো আস্তে আস্তে গিয়ে সামনের দোলনাটাতে বসে পারে,ভাবে একটু পর ঘরে গিয়ে দিয়ে আসবে।কিন্তু একটু ক্লান্ত থাকায় যে সেও কখন ঘুমিয়ে পরে খেয়াল করে নি।

পুতুল দু পা উচু করে সামিরের কোলে ঘুমিয়ে আছে,মনে হচ্ছে দশ মাসের বাচ্চা এই ছোট যায়গায় নিজের পুরো শরীর দিয়ে ঘুমিয়ে আছে এতোটাই পিচ্চি এই মেয়ে।সারারাত একভাবে বসে থাকায় পা দুটো অবশ হয়ে আছে সামিরের।আস্তে করে এক পা নিচে নামিয়ে একটু ঝাড়া দেয়,তখনি পুতুলের ঘুম ভেঙে যায়,ঘুম থেকে উঠে নিজেকে সামিরের কোলে আবিস্কার করে।সামিরকে ছেড়ে হাত দিয়ে চোখ ডলে বারেক দুবার চোখ ফেলে,”না সে ভুল দেখছে না সে সামিরের কোলেই বসে আছে।তার মানে সারারাত তারা এখানেই ছিলো?” পুতুল চারো দিকে একবার তাকায়।কি হলো হঠাৎ ধরফরিয়ে সামিরের কল থেকে নামতে যায় কিন্তু সেটা দোলনা থাকায় নরে উঠে ফলে পুতুল কিছু বুঝতে না পেরে নিচে পরে যায়।সামির গিয়ে পুতুলকে ধরে উঠায়,এভাবে পরে যাওয়ায় খানিকটা লজ্জা পায় পুতুল।কিন্তু ব্যথা পায়,,
সামির পুতুলকে ধরে দাড় করিয়ে বলে,

-ব্যথা পেয়েছো??

-একটু!!

-এতো হাইপার হওয়ার কি ছিলো সেই তো নিজেই ব্যথা পেলে,,

-বুঝতে পারি নি।

সামির পুতুলের হাত ছেড়ে দেয়।হাত পা দুটোকে টান টান করে বলে,

-সারারাত এক ভাবে থেকে হাত পা পুরো অবশ হয়ে গিয়েছে,এনিওয়ে!এখন তুমি ঠিক আছো তো,কালকের জন্য আবার আপসেট নয় তো?

পুতুল মাথা এদিক ওদিক ঝাকায় যার অর্থ “না” আবার কি যেনো একটা মনে পড়তেই পুতুল ঘরের দিকে ছুট লাগায়,ঘরে এসে বিছানায় ওইভাবে স্নিগ্ধাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে বুকে হাত দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে।পেছন পেছন সামির এসে পুতুলকে বলে,

-ও এখনো ঘুমিয়ে আছে,তুমি ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হও আমি মাকে বলবোনি স্নিগ্ধাকে রেডি করাতে।একটু পর আমাদের হসপিটালে যেতে হবে আলরেডি সাতটা বেজে গেছে।

হসপিটালের কথা শুনে পুতুল ‘আচ্ছা’ বলে চটজলদি নিজের ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হতে শুরু করে।পুতুল ঘর থেকে যাওয়ার একটু পরেই স্নিগ্ধা ঘুম থেকে উঠে যায়,সামির তাকে কোলে করে সামিয়ার কাছে দিয়ে নিজেও ফ্রেশ হতে চলে যায়।

নিচে নেমে সবাই নাস্তা করে নয়টার মধ্যে বাসা থেকে বের হয়ে যায়।সামিয়া আর ফায়াজ পরে খাবার নিয়ে যাবে,,সামির গাড়ি বের করে পুতুল আর স্নিগ্ধাকে নিয়ে হসপিটালে আসে।পুতুল স্নিগ্ধার হাত ধরে দ্রুত গতিতে হাঠছে,তখন সামির পেছন থেকে বলে উঠলো

-একটু দাড়াও!

পুতুল পেছনে ঘুরে ভ্রু কুঁচকায়,সামির দৌড়ে মেডিসিন সেন্টারের ওখানে যায় কারো সাথে ফোনে কিছুক্ষণ কথা বলে।পুতুল সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে,কিছুক্ষণ পর সামির আবার দৌড়ে পুতুলের কাছে আসে পুতুল দেখে সামিরের মুখে মাস্ক পুতুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

-মাস্ক কেনো?এখন তো করোনা নেয়,,

-আরে গাধী মানুষকি শুধু করোনার জন্য মাস্ক পরে নাকি?

-তাহলে?

-হসপিটালের স্মেলটা আমার ভালোলাগেনা,,তাই মাস্ক পড়তে হয়।

এটা শুনে পুতুল বিড়বিড়িয়ে বলে “হু ঢং” সামির পুতুলকে সামনে ঠেলে বলে, “চলো”

পুতুল কেবিনে এসে বাবার পাশে গিয়ে বসে,তার এখনো জ্ঞান ফিরে নি।পাশে বসা ফুপিকে দেখে বেশ খুশি হয় পুতুল।পুতুলের ফুপি ইলিয়া!থাকে ঢাকায়।বিয়ে হয়েছে সতেরো বছর কিন্তু হতাশার বিষয় তাদের ঘরে কোনো সন্তান নেই,এতে তার এবং তার স্বামীর কোনো আফসোসও নেই।পুতুলকে নিজের মেয়ের মতোই দেখে,ভাইকেউ খুব ভালোবাসে ভাই এর অসুস্থতার খবর শুনে ছুটে এসেছে।পুতুলকে দেখে ইলিয়া জড়িয়ে ধরে ভলে,

-কেমন আছিস আমার ডল।

-হুম ফুপি তুমি কেমন আছো।

পুতুলের সাথে কথা বলে ইলিয়া তার পেছনে থাকা সামিরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ‘ও কে?’ পাশ থেকে পুতুলের মা বলে উঠে,

-আরে ফায়াজ ভাই এর ছেলে।

সামির ইলিয়াকে সালাম দেয়,ইলিয়া সালামের উত্তর নিয়ে সামিরের দিকে তাকিয়ে বলে,

-বাহহ ফায়াজের ছেলে তো অনেক বড় হয়ে গিয়েছে,মাশাল্লাহ!!

সামির মুচকি হাসে,,

পুতুলরা আসার একটু পর শ্রেয়া আর পুতুলের মা রওনা দেয় বাসায় যাওয়ার জন্য।সারারাত এখানে থেকেছে তারা এখন বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তারপর আসবে,,শ্রেয়া ব্যাগ পত্র নিয়ে বের হতে যাবে ওমনি পুতুল পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে। শ্রেয়া কিছু বলে না চুপ করে থাকে,বড্ড অভিমান হয়েছে এই মেয়েটাও উপর, কিছুক্ষণ এভাবে থেকে শ্রেয়া বলে,

-ছাড় আমার যেতে হবে।

-ভাবিপু প্লিজ সরি,আমি ওই কথাগুলো বলতে বাধ্য হয়েছিলাম।আমি এখন বুঝতে পারছি ভাবিপু প্লিজ এখন যদি তুমি আমাকে না বুঝো তাহলে তো আর আমার কেউ থাকবে না সাপোর্ট করার মতো।

তারপর পুতুল আস্তে আস্তে সব বলে,সব শুনে শ্রেয়া পুতুলেত দিকে ঘুরে পুতুলের বাহু জড়িয়ে ধরে বলে,

-কথাটা আমাকে আগে বললেই পারতিস জানিস তো তোর ক্ষতি আমরা কেউ চাইবো না।

-হুম ভাবি সরি আর হবে না,

শ্রেয়া পুতুলকে জড়িয়ে চুমু দিয়ে বলে,

-আমিও সরি সোনা তোমাকে মারতে চাই নি কিন্তু রাগটা কন্ট্রোল করতে পারি নি।আচ্ছা এখন তো সব ঠিক আছে,তুই থাক আমাদের যেতে হবে একটু পর তোর সামিয়া আন্টিরা এসে পড়বে।

-আচ্ছা!!

শ্রেয়ারা চলে যেতেই পুতুল কেবিন থেকে বের হয়ে সামিরের কাছে এসে বলে,,

-অনেক্ষণ তো মুখে এই মাস্ক পরে রইলেন,নিশ্বাস নিচ্ছেন কীভাবে?

-আমার অভ্যাস আছে।

-তবুও!!আচ্ছা যাই হোক আসার সময় দেখেছি হসপিটালের নিচে খুব সুন্দর বাগান আছে,যাবেন?

-যাবে তুমি??

-হ্যা সেখান গেলে মনটা একটু ফ্রেশ ফ্রেশ লাগবে,আর এখানে তো ফুপি আছেই।

-আচ্ছা চলো।

বলে সামির পুতুলের হাত ধরে।পুতুল অবাক হয়ে একবার হাতের দিকে আরেকবার সামিরের দিকে তাকায়,সামির পুতুলের হাত ধরে হাঠতে হাঠতে বলে,

-বাচ্চা পুতুল হারিয়ে যাবা।

পুতুল সামিরের কথার সারমর্ম বুঝতে পেরে হেসে দেয়,পাঁচ তলা থেকে লিফট দিয়ে নেমে বাগানে যায়।সারি সারি সবুজ ঘাসের মাঝে রাস্তা,সামনে ঝর্ণা খুব সুন্দর একটা যায়গা পুতুল একটা বড় করে প্রশান্তির শ্বাস নেয়।সেখানে লাল গোলাপের বাগানো আছে,লাল গোলাপ দেখে পুতুলের কালো গোলাপের কথা মনে পরে,সামিরের দিকে তাকিয়ে দেখে সামির তার দিকেই তাকিয়ে আছে,না চাইতেও তার চোখটা নেমে যায়।পুতুল মাথা নিচু করে সামিরের হাত ধরে হাটতে থাকে।

_________
শিশ বাজাতে বাজাতে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে সিজান!অবশ্য এখন তার কোনো তাড়া নেই,তবে এই স্প্রিটে গাড়ি চালাতেই তার ভালোলাগে রাস্তায় তেমন গাড়িও নেই।এক কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনছে আর ড্রাইভ করছে,চোখে কালো সানগ্লাস।হঠাৎ সামনে একটা রিকশা এসে পরে,এক্সিডেন্ট হবে না হবে না বলেও হয়ে গেলো,তার কিছু হয় নি। সামনে থাকা রিকশারো কিছু হয় নি,রিকশা পরে যাওয়ার আগেই রিকশা ওয়ালা সেটাকে ধরে দাড় করিয়ে দেয়,তবে সেখানে বসা মেয়েটা ছিটকে পরে যায়,সিজান ভয় পেয়ে যায়।এখন পালানোরো কোনো রাস্তা নেই,সিজান নিজেকে স্বাভাবিক রেখে গাড়ি থেকে বের হয়,দেখে চকলেট কালার হিজাব পরিহিত একটা মেয়ে,মুখ দেখা যাচ্ছে না মাথা নিচু করে আছে।সিজান মেয়েটির সামনে গিয়ে নিচু স্বরে বলে,

-sorry for they..!

মেয়েটি এইবার মাথা উঁচু করে।সিজান হা হয়ে যায়।এতো সুন্দর মেয়ে,চোখের চশমা খুলে মহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।এতোক্ষণে মেয়েটা উঠে দাঁড়ায়,হাত ঝাড়া দিয়ে সিজানের দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

-এই বেডা কানা নাকি,গাড়ি কি মাল খেয়ে চালান নাকি?দেখে তো তাই মনে হচ্ছে,যত্তসব!!

এদিকে মেয়েটার একটা কোথাও কানে যাচ্ছে না সিজানের,সে একি ভাবে হা করে তাকিয়ে আছে।মেয়েটি কিছুক্ষণ বক বক করে রিকশায় উঠে চলে যায়।রিকশাটা সিজানের চোখের অগ্রচর হতেই হুশ ফিরে তার।দেখে কেউ নেই তার মানে চলে গেলো?

-ইশশ কি মেয়েরে মাইরি…!

বলে সিজান গাড়ি নিয়ে চলে যায়।এইবার কিছুটা আস্তে গাড়ি চালায়,আর রাস্তার চারোপাশে দেখতে থাকে কোথাও মেয়েটাকে পাওয়া যায় নাকি।

হসপিটালের এসে গাড়ি পার্ক করে হাতে চাবি নিয়ে তা আঙুল দিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে ভেতরে ঢুকে সিজান।হঠাৎ আঙুল থেকে চাবিটা ছিটকে কোথাও পড়ে যায়,

-আরে ভাই আবার গাড়ির চাবি গেলো কোথায়,ধুর বেশি ভাব নিতে গেলে এমনি হয়।

বিড়বিড় করতে করতে এতো মানুষের ভীরে চাবিটা খুজতে থাকে সিজান।অবশেষে পেয়েও যায়,”ফাইনালি” বলে নিচ থেকে চাবিটা উঠাতে যায়,তখন কারো পা সামনে এসে যায় মুখ হা করে উপরে তাকিয়ে ব্যক্তিটিকে দেখে আবার হা হয়ে যায়।রিকশার ওই মেয়েটা!!!

মেয়েটা সিজানকে এখানে দেখে অবাক হয়ে বলে,

-আপনি এখানে?এই আমাকে আবার ফলো করছেন না তো??

-আজব আমি আপনাকে ফলো করবো কেনো আমি আমার আঙ্কেলকে দেখতে আসছি।আপনি এখান কি করেন??

-সেটা কি আপনাকে বলতে হবে?

-হু এতো ভাব কীভাবে আসে,দেখতে তো পুরা চকলেটের মতো লাগে।

মেয়েটি সিজানের কথা শুনে চোখ ছোট ছোট করে বলে,

-মানে??

-না মানে চকলেট,,

সিজান আর কিছু বলার আগেই পেছন থেকে কেউ বলে উঠে, “মারজিয়া”

সিজান পেছনে তাকিয়ে দেখে পুতুল আর সামির দাঁড়িয়ে আছে?সিজান একবার পুতুল আরেকবার মারজিয়ার দিকে তাকায়।মারজিয়া দৌড়ে পুতুলের কাছে এসে বলে,

-এই তুই কই ছিলি আমি তোকে কতবার কল দিয়েছি দেখেছিস?এতো কানা মানুষের ভীরে যদি আমি হারিয়ে যেতাম তাহলে কি হত?

-মানে??আর তোরা দুজন এভাবে ঝগড়া করছিস কেনো তুই চিনিস?

-আরে না চিনিনা!তুই চিনিস?

পুতুলকে না বলতে দিয়ে সামির বলে,

-পরে কথা হবে আগে উপরে চলো এখানে অনেক ভীর!

পুতুল সামিরের হাত ছেড়ে মারজিয়াকর কাছে যায়।তারা লিফটের সামনে চলে যায়,সিজান এখনো সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, বুকে হাত দিয়ে বিড়বিড় করে বলে ‘আহহ মারজিয়া মুঝে মার দিয়া’ সিজানের ভাবনার মাঝেই সামির ডেকে উঠে,

-এই সিজান আয়,,

সিজান এক লাফে লিফটের ভেতরে চলে যায়।

চলবে..!

#পুতুল_বউ
#Afxana_Junayed
#পর্ব_১৭

হসপিটালে মনে হয় রোগির থেকে গার্ড এর সংখ্যা বেশি।চেয়ারম্যান সাহেবের অসুস্থতার খবর কালকে বেশি সংখ্যাক মানুষ না জানলেও আজকে ছড়িয়েছে পুরো গ্রাম।তাই তো বড় বড় পদের মানুষ থেকে শুরু করে গ্রামের সকলেই চেয়ারম্যানকে দেখতে আসছে।এখানে আবার শত্রুরও অভাব নেই,তাই গত কালের থেকে আজকে গার্ডের সংখ্যা বেশি বাড়ানো হয়েছে।গ্রামের একজন সৎ ব্যক্তি ছিলেন তিনি তাই সবার কাছেই বেশ পছন্দের মানুষ।বাহিরে প্রেস মিডিয়া!সবাই জানেনা চেয়ারম্যান এর গায়ে গুলি লেগেছে,শুধু জানে এক্সিডেন্ট হয়েছে।তবুও এটা নিয়ে অনেক প্রশ্ন তুলছে মিডিয়া,কেউ কেউ বলছে চেয়ারম্যান এর কোনো শত্রু এই এক্সি’ডেন্টটা করিয়েছে যাতে করে তিনি এই পদ থেকে বাদ পরে যায়,আরো না না কিছু।এইগুলো সব সামাল দিচ্ছে প্রণয় সামির সাথে সিজান সহ!

কচ্ছপের গতিতে বাবার কেবিন থেকে করিডরের চেয়ারে বসে পড়লো পুতুল আর মারজিয়া।মারজিয়া ক্লান্ত হয়ে হিজাবের পিন ঠিক করতে করতে বলে,

-বাবা গো এর থেকে তো আমরা নরমাল মানুষরাই খুব ভালো আছি রে,,না আছে কোনো শত্রু আর না পোহাতে হয় এতো ঝড়!আর এই মিডিয়ার লোকেরা কি সব আজাইরা প্রশ্ন করছিলো,কিন্তু তোর সুপারম্যান ভাই আর স্মার্ট বয়ফ্রেন্ড তো সব সামলে নিলো।

শেষের কথাটুকু পুতুলের দু কাধে হাত রেখে অতি খুশি হয়ে বলল মারজিয়া।পুতুল ভ্রু কুঁচকে বলল,

-মানে তুই কি মিন করতে চাচ্ছিস?

-হু তুই যা ভাবছিস তাই,,এই ওয়েট এইইই পুতুলের বাচ্চা তুই কত দিন ধরে ওই কালো গোলাপ নেওয়ার জন্য কত কিছু করলি শেষ পর্যন্ত চোর বলেও উপাধি পেলি।আর এখন তো ওই বাড়িতে থাকিস নিশ্চয়ই সারাদিন কালো গোলাপ দিয়ে বেড বানিয়ে ঘুমিয়ে থাকিস!তুই না বলেছিলি ওই গোলাপ পেলে তুই রান্না করে খাবি,খেয়েছিলিস কেমনরে?আচ্ছা ঘ্রাণ কেমনরে নরমাল গোলাপের মতো নাকি??

পুতুল ভীষণ রকমের বিরক্ত হয়।এমনি তো মুডের বারোটা বেজে আছে তার উপর তার এই লজিকহীন কথা।পুতুল রাগি লুক নিয়ে মারজিয়ার দিকে তাকায়,মারজিয়া বুঝতে পারে পুতুলের এখন মেজাজ চাঙ্গা হয়ে আছে তাই আর কিছু বলে না চুপ করে থাকে।চোখ উল্টিয়ে বিড়বিড় করে বলে “না বললি হু”

মারজিয়া আবার নিজের হিজাব ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পরে,,পুতুল একবার নিজের দিকে তাকায়,সাদা ঘিয়ে কালার হাটু পর্যন্ত একটা নরমাল ফ্রক পড়া। সকালে সেন্ডেলটা বদলিয়ে সাদা কেস পরেছে,কারণ হসপিটালের টাইলস গুলো এতোই পিচলা যে পুতুলের হাঠতে কিছুটা ভয় হয়।

ভাবনার মাঝেই তার মনে হয় কেউ তাকে ডাকছে, কে সেটা দেখার জন্য সামনের দিকে চোখ তুলে তাকায় পুতুল।কিন্তু বেশি চোখ ঘুড়িয়ে খুজতে হয় না মানুষটাকে,,কারণ তখনি সিজান হালকা দৌড় দিয়ে পুতুলদের সামনে এসে পরে।তার মানে সেই ডাকছিলো।পুতুল হাত নাড়িয়ে হাই দিয়ে বলে,,

-হাই আপু!!

সিজান অস্থির হয়ে তাদের সামনে এসে পুতুলের আরেক পাশে বসে হাক ছেড়ে মেয়েদের মতো হাত দিয়ে বাতাস করতে করতে বলে,,

-উফফ বার্বি ডল বাংলাদেশের মেয়েদের রু’পের আ’গু’নে পুরে ছা’ই হয়ে যাচ্ছি,এতো রুপ নিয়ে তারা রাতে ঘুমায় কীভাবে?

পুতুল ফিক করে হেসে দেয়,,মারজিয়া চোখ ছোট ছোট করে সিজানের দিকে তাকায়।সিজান তা পাত্তা না দিয়ে পুতুলের দিকে তাকিয়ে বলে,

-এইই বার্বি ডল এক দিনে দেখি তুমি শুকিয়ে গেছ!এই গুলুমুলু ডলকে কিন্তু এরকম শুকনো দেখতে একদমি ভালো লাগে না,

পুতুল কোনো প্রতিত্তোর করে না।মারজিয়া পুতুলের হাত খপ করে ধরে এক টানদিয়ে দাড় করিয়ে বলে,

-চল এখান থেকে,

সিজান পুতুলের আরেক হাত ধরে টান দিয়ে আবার বসিয়ে দেয়,মারজিয়াও আবার একি কাজ টান দিয়ে দাড় করিয়ে দেয়,,পুতুল তো হতভম্ব হয়ে যায়,এদের দুজনের মাঝখানে থাকলে এখানেই সে আ’হ’ত হবে নিশ্চিত!পুতুল বিরক্ত হয়ে বলে,

-আরে হচ্ছেটাকি?

মারজিয়া আবার পুতুলের হাত টান দিয়ে দাড় করিয়ে বলে,

-পুতুল তুই আমার সাথে চল!!

একিভাবে সিজান পুতুলকে বসিয়ে দিয়ে বলে,

-বার্বি ডল তুমি এখানেই বসে থাকবে,আমি তোমাকে কোনো রুপনগরের পেত্নীদের সাথে যেতে দিবো না,এতে তোমার রিস্ক হতে পারে।

মারজিয়ে এইবার ব্যঙ্ক মেরে বলল,

-ইশশ আসছে আবার মানবতার ফেরিওয়ালা!দু দিন ধরে পরিচয় হয়ে এতো চিন্তা! আপনি জানেন পুতুল আর আমার কত বছরের সম্পর্ক?

সিজান তার চোখ মার্বেলের মতো করে অবাক হওয়ার ভান করে বলে,

-সম্পর্ক?কিসের সম্পর্ক তোমরা,,ছি ছি আমি এইসব কি ভাবছি আমার বার্বি ডল মোটেও এরকম না।

-যার যেমন মাইন্ড তার মনে সেরকম ভাবনা তো আসবেই,

পুতুল এইবার নিজের দুই কানে হাত দিয়ে চেপে ধরে খানিকটা উচ্চ স্বরে বলে,

-চুপপপপপ..!

দু জনে চুপ হয়ে যায়,সামনে দিয়েই একটা নার্স হাতে একটা ট্রে নিয়ে যাচ্ছিলো পুতুলের হঠাৎ চিল্লানি শুনে খানিকটা কেপে উঠে নার্সটা,পুতুল বুঝতে পারে সে একটু বেশি জোরে বলে ফেলেছে।তাই একটা ঢোক গিলে কিছুক্ষণ চুপ থাকে।নার্সটা চলে যেতেই পুতুল মারজিয়ার দিকে রাগি লুকে তাকিয়ে বলে,

-বস এখানে,,

-না আমি বসবোনা চলে যাবো!!

মারজিয়ার কথা শুনে সিজান মিটিমিটি হেসে বিড়বিড় কম নিচু কন্ঠে বেশি স্বরে বলে,,

-বনবাসের টিকিট লাগলে বলতে পারে,,

কিন্তু কথাটা পুতুল মারজিয়া উভয়েই শুনতে পায়,মারজিয়া হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়,তা দেখে পুতুল মারজিয়ার হাত ধরে অনুনয়ের স্বরে বলে,

-প্লিজ এখন আর কিছু করিস না,এটা হসপিটাল!

মারজিয়া ধুপ করে চেয়ারে বসে পড়ে,,পুতুল বড় করে শ্বাস নেয়।সিজান হালকা করে পুতুলের কাধে মাথা রেখে বলে

-হা আমি শেষ।

পুতুল ডেব ডেব করে সিজানের দিকে চায়।কয়েকবার পলক ফেলে অন্যপাশে ঘুরে মারজিয়ার দিকে তাকায়,দেখে মারজিয়া রাগে ফুসছে। এখনি মনে হয় বম ব্লাস্ট হবে।পুতুল ইশারা করে না করে,কিন্ত মারজিয়া পুতুলের কথা না শুনে পুতুলের কাধ থেকে সিজানের মাথা সরিয়ে দিয়ে বলে,

-একদম আমার পুতুলকে ছুবেননা।

-ইশশ যেনো একদম লিখিতো ভাবে নিয়ে নিয়েছে যে পুতুল তার!

বলে আবার পুতুলের কাধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে নেয় সিজান।এদিকে পুতুলের খুব আনইজি লাগছিলো,এখানে গ্রমের অনেক মানুষি তার বাবাকে দেখার জন্য আসা যাওয়া করছে,কেউ যদি দেখে ফেলে ভুল বুঝবে।

পুতুল একবার সিজানের দিকে তাকাচ্ছে একবার লম্বা করিডরের দিকে তাকাচ্ছে কেউ আসছে কিনা,ইমনের হাত থেকে বাচা সম্ভব কিন্তু গ্রামের মানুষের কথা থেকে বাচা সম্ভব না।সামনে কারো আসার শব্দ শুনে সামনে তাকায় পুতুল মারজিয়া।সামনে আসা মানুষটাকে স্পষ্ট দেখতে পেয়ে হালকা ভাব নিয়ে পায়ের উপর পা তুলে আরামে বসে পরে মারজিয়া।পুতুল তো ভয়ে শেষ সিজানের কাছ থেকে ছাড়ার জন্য চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না।

এদিকে পুতুলের বার বার কাধ নাড়ানোর ফলে সিজান খানিকটা বিরক্ত হয়ে ‘চ’ শব্দ করে বলে,

-প্লিজ বার্বি ডল, আমি খুব ক্লান্ত একটু থাকতে দাও এখানে,,

পুতুল তাও এরকম করতে থাকে,সিজান কপাল ভাজ করে চোখ খুলে সামনে তাকায়,দেখে আকাশি রঙের একটা ফরমাল ড্রেসের সাথে সটান হয়ে হাত ভাজ করে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সামির!এই মুহূর্তে তাকে এখানে আশা করে নি সিজান।দ্রুত পুতুলের কাছ থেকে সরে শার্টের কলার ঠিক করে বসে,সামির ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

-এখানে কি হচ্ছে?

সিজান এইবার মনে সাহস নিয়ে সামিরকে পাল্টা প্রশ্ন করে

-তুই এতো গুলো মেয়ের মাঝখানে এসেছিস কেনো??

সামির এইবার শয়তানি হাসি দিয়ে বলে,,

-ওহহ সরি আমি তো ভুলে গিয়েছিলাম তুইও তো মেয়ে..!

এইবার আর মারজিয়া তার হাসি দমিয়ে রাখতে পারলোনা,ফিক করে হেসে দেয়।সে যখন থেকে এসেছে একটা জিনিস খেয়াল করেছে যখনি সামির আর সিজান একসাথ হয় তখনি কোনোনা কোনো ভাবে সামির সিজানের কথার পাল্টা জবাব দিয়ে তাকে হেনস্তা করবেই।এইবারো তাই করলো, মারজিয়া মুখ চেপে হাসছে।পুতুল তার দাঁত দিয়ে নখ কামরাচ্ছে,সামিরের কথায় সিজান খানিকটা অপমান হয় তবুও সামলে নিয়ে বলে,

-একদম বাজে কথা বলবিনা,,

সামির সিজানের কথায় পাত্তা না দিয়ে পুতুল যে হাতের নখ কামরাচ্ছিলো সেই হাত শক্ত করে ধরে একটানে বসা থেকে তার পাশে দাড় করিয়ে দেয়।
“আবার হাত ধরে টান?” পুতুল এইবার নিজের হাত ধরে বলে,

-আজকে আমি শেষ,আ আমার হাত!!

সামির পুতুলের দিকে তাকিয়ে বলে,

-কি হয়েছে,,

পুতুল কিছু বলার আগেই মারজিয়া লাফ দিয়ে উঠে বলে,

-আরে ভাইয়া আর বলিয়েন না এই আপু আক্তার ভাইয়া আমার পুতুলের হাত ধরে টানাটানি করছিলো তখন খুব ব্যথা পেয়েছে,,

পুতুল চোখ বড় বড় করে তাকায়,প্রথমে শুরু করলো সে আর দোষ দিচ্ছে অন্যজনের। কি সাঙ্গাতিক ব্যপার স্যপার।

সামির আর কারো কথা না শুনে পুতুলকে নিয়ে চলে যায়।তারা চলে যেতেই সিজান মারজিয়ার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলে,,

-এটা কি বললে?

-আমি আপনাকে কিছু বলেছি?

বলে মারজিয়া ব্যাগ কাধে নিয়ে কেবিনের দিকে চলে যায়।সিজান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পকেট থেকে ফোন বেড় করে ঘড়ির টাইম দেখে,”সময় হয়ে গিয়েছে।” সিজান আবার পকেটে ফোন রেখে চারোদিকে তাকিয়ে খুব সতর্ক ভাবে কোথাও চলে যায়।

মারজিয়া কেবিনে ঢুকার আগে একটু পেছনে তাকিয়ে নেয়,কিন্তু সিজানকে আর সেখানে দেখতে পায় না। ‘ও মা কোথায় গেলো?এক পলকে হাওয়া!’ সে ওতটা পাত্তা না দিয়ে ভেতরে চলে যায়।ভেতর গিয়ে দেখে পুতুল একটা চেয়ারে বসে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে আছে,মারজিয়া খানিকটা হাসে।এই বাবাটা কত ভালো পুতুলকে সবসময় আগলে রাখে,অথচ তার বাবাকে দেখো এক বেলা না খেয়ে থাকলেও তাদের খবর নেয় না,শুধু মাত্র পুতুলের বাবার সাহায্যে সে আর তার মা একটু শান্তিতে থাকতে পারছে ভালো স্কুলে পড়তে পারছে নাহলে কবেই মা মেয়েকে রাস্তায় পরে থাকতে হতো।তার আপন বাবার মার কাছ থেকে সে যতটা না আদর পেয়েছে তার থেকেও অধীক স্নেহ মায়া পেয়েছে এই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের কাছ থেকে।

মারজিয়া ভেতরে ঢুকতেই সবাই তার দিকে তাকায়,মারজিয়াও মুচকি হাসে,পুতুলের বাবার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে

-কেমন আছেন আঙ্কেল।

-হ্যা মা আলহামদুলিল্লাহ এখন একটু সুস্থ!তুমি কেমন আছো।

-জ্বী আঙ্কেল আলহামদুলিল্লাহ!

পুতুল সামনে তাকিয়ে দেখে সামির বসে ফোন চালাচ্ছে,হাতের গতি দেখে মনে হচ্ছে কারো সাথে মেসেজ করছে।তখন সামির তাকায়,দেখে পুতুল তার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে,তার তাকানো দেখে দ্রুত গতিতে চোখ নামিয়ে নেয় পুতুল।খানিকটা লজ্জা পায়।সামির আরেকবার ফোনের দিকে চোখ বুলিয়ে পকেটে ফোনটা রেখে দাঁড়িয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-আঙ্কেল আন্টি আমি একটু বাহিরে যাবো,দুঃখিত আজকে হয়তো আর আসতে পারবোনা কিছু কাজ আছে,একটু পর আম্মু আব্বুরা এসে পড়বে।

সামিরের কথা শুনে পুতুল তার দিকে তাকায়।পুতুলের বাবা হেসে বলে,

-অসুবিধা নেই বাবা।আমরা তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকবো বাবা তোমরা আমাদের জন্য যা করলে,,

-না আঙ্কেল আপনাদের বিপদে পাশে দাড়াতে পেরেছি এটাই অনেক,এখন আমি আসি।ভালো থাকবেন আমি প্রণয়কে সব বুঝিয়ে দিবোনি।

-আচ্ছা বাবা যাও..!

সামির আর এক সেকেন্ড সময়ও অতিবাহিত না করে দ্রুত গতিতে কেবিন থেকে বের হয়ে যায়

চলবে..!