প্রজাপতি উৎসব পর্ব-২৯+৩০

0
288

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ২৯

একটু আগে মোহন আমাদের বাসায় এসেছে। আব্বুর জন্য ব্যাগ ভরে অ্যাপেল, আঙ্গুল, আর কমলা এনেছে। বাবার মুক্তাগাছার মন্ডা পছন্দ। মোহন কোত্থেকে দুই কেজি মন্ডাও এনেছে। মোহন আব্বুর পা ধরে সালাম করে বললো,
-বাবা, প্রতিদিন মনে হয়ে আপনাকে একবার দেখে যাই। কাল রাতে স্বপ্ন দেখলাম আপনি আমায়, এই মোহন, এই মোহন বলে ডাকছেন। ইস বাবা, আপনি কেমন শুকিয়ে গেছেন। নিজের যত্ন নেন না বুঝি?

ফলমূল আর মিষ্টি কথা কে না পছন্দ করে? মোহনের কথায় আব্বু গলে জল হয়ে গেলো। মোহনকে ড্রইং রুমে বসিয়ে আমার ঘরে এসে বললো,
-মোহন কিন্তু আমাদের ঘরে অতিথি। হুট করে ছেলেটার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিস না।

আব্বুর মাথায় বাস্তব বুদ্ধির এক ছটাকও নেই। আব্বুকে বোঝানোর চেষ্টা করেও লাভ হবে না। তবু বললাম,
-আব্বু, তুমি মোহন সম্পর্কে কিছুই জানো না। আর যাই করো, ওর পক্ষ হয়ে কথা বলবে না প্লিজ। আমি ওর সঙ্গে দেখা করবো না। আমি ওকে ডিভোর্স করতে চাই।

আব্বু মুখ কালো করে বললো,
-তোদের বিয়ে হলো মাত্র তিনমাস। একজন আরেকজনকে বুঝতেও তো কয়েক বছর লেগে যায়। আমার মাথায় ঢোকে না, মাত্র তিন মাসে তুই কীভাবে এ রকম সিদ্ধান্তে এলি।

-আব্বু, ওকে আমি তিন মাসেই চিনে ফেলেছি। তুমি তো আর ওর সঙ্গে থাকোনি, আমি থেকেছি।

-রূপা, আমাদের ফ্যামিলিতে কখনো কোন ডিভোর্স হয়নি। ডিভোর্স হচ্ছে লাস্ট রিসোর্ট। তুই শুরুতেই ডিভোর্স ডিভোর্স করলে কারো সাথেই তোর বনিবনা হবে না। আর মানুষ কী বলবে সেটাও মাথায় রাখিস।

-আব্বু, আমি বলতে চাইনি, কিন্তু এখন না বলেও উপায় নেই।

-কী বলিসনি?

-মোহন আমাকে জোর করে অ্যাবর্শন করিয়েছে।

আব্বু অবাক হয়ে বললো,
-কী বলছিস? কবে হলো এটা।

আমি উত্তর দেবার আগেই মোহন আমাদের ঘরে হুড়মুড় করে ঢুকলো। আব্বুর সামনেই মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লো। তারপর আমার পা জড়িয়ে ধরলো। আমি আঁতকে উঠে বললাম,
-এটা কী হচ্ছে মোহন?

কিন্তু মোহন আমার পা তো ছাড়লোই না, উল্টো ভেউ ভেউ করে কান্না আরম্ভ করলো। আব্বু অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
-রূপা, তোরা কথা বল, আমি ও ঘর থেকে আসছি।

মোহন তখন কাঁদতে কাঁদতে আব্বুর দিকে তাকিয়ে বললো,
-না, বাবা, প্লিজ যাবেন না, আপনাকে সত্যগুলো শুনতে হবে। আমি জানি, আর কেউ না বুঝুক, আপনি আমাকে বুঝবেন।

মোহনের কথায় আব্বুর চোখ চকচক করে উঠলো। আব্বু দরজা থেকে ফিরে এসে মোহনের পিঠে হাত ছুঁয়ে বললো,
-ঠিক আছে বাবা মোহন, আমি যাচ্ছি না, আমি এখানেই আছি। তুমি নির্ভয়ে কথা বলো।

মোহন এবার কাঁদতে কাদতে বললো,
-রূপা, রুপামনি, এভাবে তুমি আমাকে ভুল বুঝতে পারলে? আমি কি তোমার ক্ষতি করতে পারি? আমি কি পাষাণ?

-তুমি আমার কন্সেন্ট না নিয়ে বাচ্চা অ্যাবর্ট করিয়েছ। এটা কি তুমি সামান্য ক্ষতি মনে করো?

-রুপামনি, তুমি কি জানো একবার বাচ্চা নিলে কীভাবে মেয়েরা সংসারে বন্দী হয়ে যায়? আমি চাইনি তোমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাক। এই যে বিয়ে করার কারণে পরীক্ষা মিস করলে, বাচ্চা হলে কী অবস্থা হতো ভেবে দেখো?

-আমি কি অ্যাবর্শন চেয়েছি?

-না, তুমি সরাসরি চাওনি, নিজের হাতে এত বড় অন্যায় তুমি করতে পারবে না। তাই তোমার হয়ে আমি এই অন্যায়টা করেছি। সংসারের জালে বন্দী হওয়া থেকে তোমাকে উদ্ধার করেছি। বিনা দোষে আমি হয়েছি পাপের ভাগীদার, তোমাকে করেছি মুক্ত।

এবার আব্বুর দিকে তাকিয়ে মোহন বললো,
-বাবা , রূপাকে একটু বুঝান প্লিজ। একটা ছেলে কখন কী করে তা শুধু আরেকটা ছেলেই বুঝে। আমার আপনার মনের কথা কি মেয়েরা বুঝবে? বলুন বাবা?

আব্বু মোহনের কথায় গ্যাঁড়াকলে পড়ে গেলো। বুঝলো না কাকে সমর্থন করবে। মোহন ফ্যাচ ফ্যাচ করে সর্দি টানতে টানতে বললো,
-বাবা, আপনি মুরুব্বি, আপনি একটা কিছু বলুন। রূপাকে একটু বুঝান, প্লিজ।

আব্বু ইতস্তত করে বললো,
-আমি মাঝখান দিয়ে কী বলবো? আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলে তোমাদের দুজনের মাঝে আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকতে হবে। অনেকেই বিয়ের সঙ্গে সঙ্গেই বাচ্চা নিতে চায়না, ওই যে তুমি যেমন বললো, মেয়েদের উপর চাপ পড়ে যায়, ক্যারিয়ার ব্রেক হয়। কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত দুজন আলাপ করে নিতে হয় বাবা মোহন।

মোহন কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-আমার ভুল হয়ে গেছে। পৃথিবীর এত জটিলতা আমি বুঝিনি। রূপা প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও। তোমার ভালো করতে গিয়ে আমি উল্টো খারাপ করে ফেলেছি। আমি একটা হতভাগা। কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি আর কোনদিন তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবো। দরকার হলে আমি সাইকায়াট্রিস্টের কাছে গিয়ে বিহেভিয়ার থেরাপি নেবো। তবু তুমি আমাকে ক্ষমা করো। তুমি ক্ষমা না করলে আমি কোনদিন শান্তি পাবো না।

মোহন এমনভাবে পা ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে, আমার নিজেরই মন খারাপ হয়ে গেলো। আমার শ্বশুর সাহবে বলেছেন ছোটবেলায় মা হারিয়ে মোহন কেমন খাপছাড়া হয়ে গেছে। কেউ ওকে মানবিক বোধগুলো ঠিকমত শেখাতে পারেনি। আমি মোহনের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বললাম,
-ঠিক আছে মোহন, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। কিন্তু আমাকে তোমার কাছে ফিরে যেতে বলবে না।

মোহন এবার মাটিতে গড়াতে গড়াতে বললো,
-তুমি না এলে আমি বাঁচবো না রূপা। মতিঝিলের সবচেয়ে উঁচু টাওয়ার থেকে লাফ দেবো। রক্তে ভেসে যাবে ঢাকার রাজপথ।

আব্বু এবার অস্থির হয়ে বললো,
-রূপা, মোহন তো নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে, স্যরি বলেছে। আমি দুজনের অভিভাবক হিসেবে বলবো, সংসার কোন আটশ মিটার স্প্রিন্ট না, সংসার একটা ছাব্বিশ মাইলের ম্যারাথন। কোন কিছুতেই তাড়াহুড়া করা ঠিক না। তোমরা ইয়াং জেনারেশন একেবারেই ধৈর্যহীন।

মোহন এবার উঠে দাঁড়িয়ে আব্বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-ইস, আপনি কেন আমার নিজের বাবা হলেন না? এমন করে কেউ কখনো আমাকে বুঝিয়ে বলেনি।
আব্বুর চোখে পানি চলে এলো। আব্বু মোহনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-বাবারে, আমার মেয়ে একটু পাগলী টাইপের, ওর অনেক অভিমান, ওকে একটু বুঝেসুঝে যত্ন করে রেখো। আমি জানি চেষ্টা করলে তুমি সেটা পারবে।

-ইনশাল্লাহ আমি পারবো বাবা। সংসারের রঙ্গমঞ্চে মাত্র অভিনয় করতে নেমেছি, এখন পর্যন্ত ভালোমত স্ক্রিপ্টই মুখস্থ হয়নি। এ কারণে একটু আধটু ভুল হয়ে যাচ্ছে। আমি কি জেনেবুঝে রূপার কোন ক্ষতি হতে দিতে পারি?
-সেটাই তো।

-বাবা, মনে রাখবেন, আপনার মেয়ে আমার কাছে একটা আমানত। আমানতে খেয়ানত করতে নেই।

আব্বু আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-রূপা, আমি তোকে কোন চাপ দেবো না। তুই ভেবে দ্যাখ একজন মানুষ ভুল বুঝে ক্ষমা চাইলে তুই তাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিবি কি দিবি না।

মোহন এখন আপন মনেই বিড়বিড় করছে,
-এই সংসারে কিছুই শিখতে পারলাম না, নিজের বউয়ের সাথে কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তাই আমি জানি না। কী লাভ আমার বেঁচে থেকে? আমি ব্রিজ থেকে লাফ দিবো নাকি টাওয়ার থেকে লাফ দিবো? কোনটা কাছে হয়? ব্রিজ নাকি টাওয়ার?

কেন যেন হঠাৎ মা মরা ছেলেটার প্রতি একটু মায়া হলো। আসলেই হয়তো সে ভালো হয়ে যাচ্ছে। এত সহজে ধৈর্য না হারিয়ে মোহনকে অন্তত একটা দ্বিতীয় ওকে সুযোগ দিতেই পারি। আমি মোহনের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-আমি আব্বুর সামনে সব কথা বলতে পারবো না, তোমাকে ইঙ্গিতে বুঝে নিতে হবে।

-হ্যাঁ, রুপামনি বলো প্লিজ।

-আর কখনো কন্সিভ করলে আমাকে অ্যাবর্শনের জন্য চাপ দিতে পারবে না।

-আর কোনদিন চাপ দিবো না রুপামনি।

-আমি আগামী বছর অনার্সের পরীক্ষা দেবো।

-শিওর, রুপামনি।

-আর যা যা দিনের পর দিন করেছো, ভবিষ্যতে কখনো করবে না।

-কথা দিচ্ছি করবো না। আমাকে না শেখালে কীভাবে শিখবো রুপামনি? আমি একটা রাফ-কাট ডায়মন্ড, আমাকে ঘষে ঘষে মসৃণ করতে হবে।

আব্বু খুশী হয়ে বললো,
-সেটাই তো, ওকে না শেখালে ও কীভাবে শিখবে? এ দেশে তো ছেলেদেরকে কিছুই শেখানো হয় না। এ রকম মোহনে সারা দেশ ভরা।

মোহন সায় দিয়ে বললো,
-ঠিক বাবা, আমার মত মোহন দিয়ে ভরা এই দেশ। এই মোহনদের কে দেখবে স্ত্রী ছাড়া?

-স্বামীস্ত্রী মিলেমিশে থাকতে হয় বাবা, একসাথে থাকতে থাকতে মায়া জন্মায়। ওসব একদিনে হয় না। রূপা, তোর কী মত?

আমি মোহনের দিকে তাকিয়ে বললা,
-আমাকে দুদিন সময় দাও। আমি আরেকটু ভাবতে চাই।

(চলবে)

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ৩০
তিন মাস পর প্রীতিলতা হলে এলাম। সব আগের মতই আছে। সেই ঘন সবুজ গাছপালা আর তার মাঝে থোকা থোকা লাল ইটের বাড়ি। রঞ্জন গ্যাং ধরা পড়বার পর ইউনিভার্সিটির পরিবেশ আগের চেয়ে অনেক নিরাপদ। কিন্তু ক্যাম্পাসে এতদিন নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হবার কারণে ভিসির পদত্যাগের দাবী মিছিল হচ্ছে।
অ্যাম্ফিথিয়েটারের কাছে দেখা হতেই অতন্দ্রিলা আমাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে বললো,
-হোয়াট অ্যা সারপ্রাইজ, তুই কোথা থেকে এলি রূপা?
অতন্দ্রিলা আগের মতই আছে। কালো কামিজ, কালো জিন্স পড়েছে, মুখে কালো লিপস্টিক চড়িয়েছে। আসলে তিন মাসে মানুষ কতই বা বদলাবে? কেবল আমার ভেতরটা অনেক বদলে গেছে। আমার কাছে গত তিন মাস ছিল তিন বছরের মত। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি কেন অতন্দ্রিলার মত শক্ত আর ধারালো হলাম না। তবে এটা সত্য যে অতন্দ্রিলা অনেক আগেই কঠিন এবং নির্মম অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে পেটানো লোহা হয়ে গেছে। ক্যাফেটেরিয়ায় চা খেতে খেতে আমি অতন্দ্রিলাকে সব কথা খুলে বললাম। দেখলাম অতন্দ্রিলার মুখ রাগে থমথমে হয়ে গেছে। আশেপাশে লোকজন আছে বলে ও চাপা গলায় বললো,
-তোর হাজবেন্ড একটা মেল শোভেনিস্ট পিগ। রঞ্জনের চেয়ে খারাপ না হলেও সে রঞ্জনের কাছাকাছি। তবে আঙ্কেল ঠিকই বলেছেন, বেশীরভাগ ছেলেরাই বদমাশ। এ রকম মোহন ঘরে ঘরে। কেউ মামা চাচা সেজে দিনের পর দিন গায়ে হাত দিচ্ছে, কেউ ম্যারিটাল রেপ করছে, কেউ জুয়ায় আসরে বউকে বাজি ধরছে, কেউ দিনের পর দিন বউ পেটাচ্ছে। আমি এমন এক হারামজাদাকে চিনি যে জোর করে ওয়াইফ সোয়াপ করে। ফেসবুকে এসে যত বড় বড় বাণী দেক না কেন, দেখা যায় নিজের জীবনে মেয়েরা অনেক কিছুই নীরবে মেনে নিচ্ছে। মেয়েদের আসলে বিয়ে না করাই ভালো।
– ও হাত পা ধরে মাফ চেয়েছে। আমি জানি বেশী নাটকীয়তা করেছে। বিয়েতে তো চাইলেই ভেঙ্গে দেয়া যায়, কিন্তু বল এখন আমার কোর্টে। বড় জোর ও ল-ইয়ার দিয়ে ব্যাপারটাকে বেশীদিন ঝুলিয়ে রাখবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকে আটকে রাখতে পারবে না। শুধু বুঝতে পারছি না ওকে আরেকটা সুযোগ দেবো কিনা।
-টেকনিকালি, নব্বুই ভাগ ছেলেই বদ। যেগুলো ভালো সেগুলো আবার সময়, সুযোগ কিংবা সাহসের অভাবে ভালো। মাঝে মাঝে অভিযোগ শুনি ছেলে ভালো শ্বশুরবাড়ি খারাপ আর তোর কেইস উল্টো, ছেলে খারাপ কিন্তু বাকি ফ্যামিলি তোর সঙ্গে ভালো বিহেভ করছে।
-হুম, কিন্তু বুঝতে পারছি না আরেকবার দেখবো কিনা। আমার গাট ফিলিং বলছে, এখুনি অন্ধ বন্ধ করো না পাখা।
-মনে হয় না মোহন তোর কোন ক্ষতি করতে পারবে। বরং তুই একটা কাজ করতে পারিস।
-কী, কাজ?
-প্রিপেয়ার্ড হয়ে ওর কাছে যা। ও যদি কোনভাবে অ্যাবিউজ করে, তুই ওটার এভিডেন্স রাখবি। পরে ভাইরাল করে দিবি। আর ও যদি সত্যি ভালো হয়ে যায় তাহলেও তুই তোর মত করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবি।
-তুই তাহলে একমত যে সেকেন্ড ট্রাই করবো?
-সেকেন্ড ট্রাইয়ে তোর হারানোর কিছু নেই। বরং মোহন আগের মত থাকলে ও তোকে হারাবে। তাছাড়া ও নিশ্চয় বুঝতে পারছে ওর খারাপ ব্যবহারের কথা সবাই জেনে গেছে।
-আমিও তাই মনে করি। আমি শেষবারের মত দেখবো।
-হুম, একটু নয় ছয় করলে সোজা লাত্থি দিয়ে চলে আসবি। আর আমি তো আছি, কিছু না করতে পারলে আমাকে জানাবি।
সেদিন আর বেশীক্ষন থাকলাম না। নার্সিং হোম থেকে জানিয়েছে মার শরীর আগের মত খারাপ নেই, ঘরে বসেই দেখশোনা করা যাবে। মাকে আনবার কিছু ফর্মালিটিজ আছে। মোহনের যা খরচ হয়েছিল বাবা ফেরত দিয়ে দেবে, যদিও মোহন আব্বুর বন্ধুর ছেলে হিসেবে আগ বাড়িয়ে অনেকটা জোর করেই সাহায্য করেছিল। আমার ভাই বোম্বেতে একটা চাকুরী পেয়েছে, ভালো বেতন। আব্বুর শেয়ার টাকাও ফেরত এসেছে। ফলে বাড়িতে আবার নার্স রাখা বিশেষ সমস্যা হবে না। কাল মিতি সুইডেন থেকে ফোন করেছিল। মিতিকেও সব কথা খুলে বলেছি। সব শুনে মিতি রেগে বললো,
-তুই কি স্পাইনলেস? এই ছেলেকে এখনো ডিভোর্স দিচ্ছিস না কেন?
-কারণ আমি গড়পড়তা বাঙ্গালীর মত অসহিষ্ণু না। সে মাফ চেয়েছে, আমি দেখতে চাই সে আসলেই পাল্টায় কিনা। যদি না পাল্টায় আমি চলে আসবো।
-ওই নরককুন্ডে আবার যাবি?
-মোহন যেমনই হোক পুরো বাড়িকে নরককুন্ড না বলাই ভালো। এটাও টিপিকাল বাঙ্গালী মত কথা হলো, একজন খারাপ তো সবাই খারাপ। শ্বশুর শাশুড়ি আর মিনুর সাথে আমার সম্পর্ক ভালোই আছে। মিনুও তো বলেছে, তুমি না চাইলে আসবে না।
-ঠিক আছে, তুই যদি মনে করিস সিচুয়েশন খারাপ হলে ট্যাকল করতে পারবি তাহলে গিয়ে দেখে আয়। অন্তত সবাইকে বলতে পারবি ইউ ট্রাইড ইওর বেস্ট। কারণ আমাদের সোসাইটি বিয়ে ভাঙলে মেয়েদেরকেই ব্লেইম করে।
পরদিন সত্যিই আমি মোহনের বাড়িতে ফিরে এলাম। আমাকে দেখে সবচেয়ে খুশী হলেন আমার শ্বশুর সাহেব। বললেন,
-তোমাকে অনেক মিস করেছি মা। কিন্তু মোহন যা করেছে তারপর কোন মুখে তোমাকে আসতে বলি?
আমার শাশুড়ি চুপচাপ মানুষ , উনি কিছু বললেন না, গরম গরম লুচি ভেজে আমার জন্য আনলেন। ওনার স্নেহের প্রকাশ এ রকমই, কথায় না, কাজ দিয়ে। কিন্তু আমাকে দেখে সবচেয় খুশী হয়েছে মিনু। আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমুটুমু দিয়ে মিনু বললো,
-ভাইয়াকে আরেকটা চান্স দেয়ার জন্য থ্যাঙ্ক ইউ ভাবী। তোমাদের মাঝে যাই হয়ে থাকুক, আমি শিওর ভাইয়া আর ওরকম করবে না। আব্বার কাছ অনেক ঝাড়ি খেয়েছে।
বিকেলে মোহন অফিস থেকে ফিরে আমাকে দেখে মনে হলো সত্যিই খুশী হয়েছে। অন্তত এটুকু বুঝতে পেরেছে যে আমাকে জোর করে বেঁধে রাখতে পারবে না। মোহন খুব সাবধানে মেপে মেপে কথা বলছে। রাতে একটা অদ্ভুত অবিশ্বাস্য কাণ্ড হলো। মোহন বললো,
-ছাদে যাবে? আজ মুনলিট নাইট।
আমরা ছাদে গিয়ে দেখলাম সত্যিই শুভ্র আলোয় চারদিক থই থই করছে। মোহন আমার হাত ধরে বললো,
-তুমি চলে এসেছো, আমি খুব গ্রেইটফুল রূপা। তুমি চলে যাবার পর আমি অনেক ভাবলাম, ভেবে ভেবে বুঝলাম আমি তোমার সঙ্গে পিশাচের মত আচরণ করেছি। আমি সত্যিই লজ্জিত।
আমি বললাম,
-তুমি আমাকে অনেক বেশী কষ্ট দিয়ে ফেলেছো মোহন। আমি এসেছি কিন্তু সব ভুলতে অনেক সময় লাগবে। হয়তো কোনদিনই ভুলবো না। তুমি যদি একবারও আগের মত ব্যবহার করো, তাহলে আমাকে আর কখনো ফিরে পাবে না।
-বলেছি তো রূপা আমি নিজেকে বদলে ফেলবো।
এর পরের কদিন মোহনের ভেতর অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। আগে অফিস থেকে রাত করে ঘরে ফিরতো। জানি না কাদের সঙ্গে আড্ডা দিতো কিন্তু এখন সে সময় করে বাড়ি ফিরছে। রাতে বিছানায় সে আর আগের মত জোর করছে না, আমি যেভাবে চেয়েছি সেভাবেই অ্যাপ্রোচ করছে। আমিই বরং বরফের মত ঠান্ডা হয়ে আছি, ওর উষ্ণতায় গলতে আরও সময় লাগবে। আগে কোন কারণে খারাপ ব্যবহার করলে সেটা ভোলানোর জন্য মোহন দামী গিফট কিনে আনতো। এখন ছুটির দিনে এমনিতেই আমরা বেড়াতে বের হই, ও এটা ওটা কিনে দিতে আবদার করে। আমি প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যক্তিগত ব্যবহার্য পছন্দ করি না, তাই ওকে অনেক বলে কয়ে থামাই, আমার পরীক্ষার প্রিপারেশনের জন্য মোহন বেডরুমের এক কোণায় একটা পড়ার টেবিল বসিয়েছে। নতুন কোর আই নাইন ল্যাপটপ কিনেছে। বললাম পুরনো ল্যাপটপেই হবে, মোহন শুনলো না।
কিন্তু মোহন যে হঠাৎ এমন ওয়ান এইটি ডিগ্রী ভালো হয়ে গেছে, সেটাও আমার কাছে চিন্তার কারণ। এটা ঝড়ের আগের শান্ত আবহাওয়া নয় তো?
(চলবে)