প্রজাপতি উৎসব পর্ব-৪০ এবং শেষ পর্ব

0
725

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ৪০ (শেষ পর্ব)

-রূপা, আমি অনেকবার নিজেকে প্রশ্ন করেছি, এই জীবনের পর যদি অনন্ত জীবন থাকে, তাহলে সেই জীবনটা আমি কার সঙ্গে কাটাতে চাই।
-উত্তর পেলে?
-হ্যাঁ। এই জীবনের পর যদি অনন্ত জীবন থাকে, সেই জীবনটা আমি তোমার সঙ্গে কাটাতে চাই। এই জগতের মোহমায়া ছিন্ন হবার পর অনিশ্চিত অনন্তে যাকে পাশে চাই সেই আমার মনের মানুষ।
-তুমি আফটার লাইফে বিশ্বাস করো?
-বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে ভাবিনি, শুধু ভেবেছি এখানে না হলেও অন্য কোথাও অন্য কোনখানে তুমি ঠিক ঠিক আমার হবে। সেই ভরসায় এই জীবনটা মানুষের মুক্তির জন্য বিলিয়ে দিয়েছি। অথচ কী আশ্চর্য কান্ড।
-কী?
-যেই মুহূর্তে নিজেকে সন্যাসীর মত নির্মোহ করলাম, ঠিক তখনই তুমি ফিরে এলে। আমি বন্ধনের মাঝে মুক্তির স্বাদ পেলাম।
ইউসিএল-এর পেছনে স্টারবাক্‌স কফি শপ। আমরা সেখানে বসে গল্প করছি। আমার কাছে এখনো সবকিছু স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে। এই বিশ্ব লয়ে কেউ একজন আসলেই খেলেছেন। নইলে আমি কেন সোয়াসে পিএইচডি স্কলারশিপ পেলাম? আমার জীবনের নিঃসঙ্গতম মুহূর্তে টিটু ভাই কেন চাকুরী পেয়ে ইউসিএল-এ এলো? অদৃশ্য কোন শক্তি সত্যের কড়া রোদে স্বপ্নের নরম জল ছিটিয়ে রংধনু বানাচ্ছে।
বখাটে রঞ্জনের ফাঁদে পড়ে টিটু ভাইয়ের মত চমৎকার মানুষটিকে আমি প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। আমি একরোখা ছিলাম, কাউকে কথা দিলে সেই কথা ভাঙ্গতে পারতাম না। গোঁয়ার্তুমি যদি অপরাধ হয় তবে আমি সেই অপরাধে দুষ্ট। তার জন্য যথেষ্ট শাস্তিও ভোগ করেছি। আমি টিটু ভাইয়ের সৌম্য মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-টিটু ভাই, তুমি লন্ডনে এসে আমার কোন খোঁজ নেওনি কেন?
-রূপা, আমি কীভাবে জানবো তুমি লন্ডনে আছো? কে জানাবে? তোমাকে শেষ চিঠি লেখার পর জাহাঙ্গীরনগরের কারো সাথেই আমার যোগাযোগ নেই। ওদের সঙ্গে কথা বললে তোমার কথা চলে আসে। খুব খারাপ লাগে। মনে হয় আমার হৃদপিন্ড কেউ কাটা চামচ দিয়ে খুঁচিয়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
-আমাকে অন্তত ইমেইল করে তোমার লন্ডনে চাকুরী পাবার কথা জানাতে পারতে।
-হয়তো আরেকটু থিতু হয়ে জানাতাম। কিংবা জানাতাম না। আমি ভেবেছিলাম মোহনকে বিয়ে করে তুমি সুখী হয়েছো। একটা সুখী পরিবারের আনন্দের বাড়াভাতে ছাই দিয়ে কী লাভ বলো?
-কিন্তু আমি তো সুখী ছিলাম না টিটু ভাই।
-তুমি তো সে কথা আমাকে আগে বলোনি। আজ মাত্র জানলাম তোমার হাজবেন্ড অ্যাবিউজিভ।
-একটা গান আছে, হায় গো, ব্যথায় কথা যায় ডুবে যায় যায় গো। প্রবল ব্যথায় আমারও সব কথা ডুবে গিয়েছিল, আমি বোবা হয়ে গিয়েছিলাম, টিটু ভাই। মন একবার অবশ হলে সব ইচ্ছেরাও অসাড় হয়ে যায়। এখন বলো, ভাবীকে নিয়ে এসেছো নাকি?
-কোন ভাবী?
-একটা রাশিয়ান মেয়ে না তোমার সঙ্গে আঠার মত লেগে থাকতো। আমি ভেবেছি তুমি ওকে বিয়ে করেছো। ছেলেরা তো বেশীদিন কারো অপেক্ষায় থাকে না। আর অপেক্ষায় থাকলেও অপেক্ষার সময়টায় অন্য কারো সঙ্গ নেয়।
-লুদমিলার কথা বলছো?
-হ্যাঁ, লুদমিলা। তুমি বলেছিলে ও ভীষণ সুন্দরী।
-লুদমিলা আমাকে পছন্দ করতো। ওকে জানিয়েছি একজনকে ভালোবাসবো অথচ আরেকজনের সঙ্গে সংসার করবো সেটা আমার দ্বারা সম্ভব না।
-তার মানে তুমি এখনো…
-হ্যাঁ আমি এখনো সেই অতি পুরাতন রূপামুখী টিটু।
রূপামুখী টিটু কথাটা শুনে আমার পাথর বিছানো মনের উপর দিয়ে যেন ঝর্নার কলকল জল বয়ে গেলো। সেই জল কখন চোখের ধারা হয়ে গাল বেঁয়ে নামলো টেরও পাইনি। খুব ইচ্ছে হলো টিটু ভাইকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরি, ওর রুক্ষ চুলে হাত বুলিয়ে দিই, ওকে পাগলের মত চুমু খাই। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
– টিটু ভাই, আমি তো বলেছি তোমাকে মোহন অ্যাবিউজিভ। কিন্তু যেটা বলিনি তা হলো আমি সংসারটা ছেড়ে এসেছি। অথবা বলতে পারো মোহনকে সংসার থেকে আউট করে দিয়েছি।
টিটু ভাই অবাক হলো। কিন্তু একই সঙ্গে ওর দুচোখে চকিত আনন্দের হীরের দ্যুতি খেলে গেলো। টিটু ভাই গম্ভীর কন্ঠে জিগেস করলো,
-এত কিছু হয়ে গেছে? ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছ তো?
– মোহন অ্যাবিউজিভ হাসবেন্ড ছিল বললে কমই বলা হবে। পুরো ডিটেলস তোমাকে একদিন বলবো।
একটুপর আমি পদ্মপাতাকে তুলতে ডে-কেয়ার সেন্টারে গেলাম। টিটু ভাইও এলো আমার সঙ্গে। আমাদের বাসায় পড়ার টেবিলে যৌবনের রবীন্দ্রনাথের ফ্রেমে বাঁধাই করা ছবি আছে। পদ্মপাতা টিটু ভাইকে দেখে বললো, এটা কি সেই লবিন্দ্রনাথ। আমি বললাম, না, এটা টিটু আঙ্কেল। ও রবীন্দ্রনাথের মতই একজন কাইন্ড-হার্টেড মানুষ। পদ্মপাতার সঙ্গে টিটু ভাইয়ের কোথায় যেন সুর মিলে গেলো। টিটু ভাইয়ের কোলে উঠে পদ্মপাতা আর নামতেই চাইছে না।
এরপর চোখের নিমেষে চার মাস উবে গেলো। অতন্দ্রিলা একদিন ভাইবারে কল করে জানালো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২৫ ধারায় মোহনের তিন বছরের জেল হয়েছে। কিন্তু ওর শয়তান বন্ধুরা নতুন নতুন আইডি খুলে আমাকে হুমকি পাঠাচ্ছে, মানসিকভাবে হেনস্তা করতে চাইছে। ওসব এখন গা সওয়া হয়ে গেছে।
আমার অফিস থেকে টিটু ভাইয়ের অফিস পাঁচ মিনিটে হাঁটা দূরত্বে। প্রায় প্রতিদিনই টিটু ভাই আর আমি কোথাও বসে গল্প করি। ধীরে ধীরে টিটু ভাইয়ের নামের পেছন থেকে ভাই শব্দটা রিক্সার হুডের মত নেমে গেছে।। আমার আহত মনের শুকনো ডালপালা আবার শ্যামল-হরিৎ লাবন্যে থই থই করছে।
ডিসেম্বরের এক সন্ধ্যায় টিটু আমাকে আর পদ্মপাতাকে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কাছে একটা রেস্টুরেন্টে আমন্ত্রণ করলো। আমি রূপালী পাড় দেয়া বেনারসি কটন সিল্কের কালো শাড়ি পড়েছি। সঙ্গে ম্যাচিং করে আড়ং-এর রূপালী লকেট। রেস্টুরেন্টে পৌছুতেই দেখলাম টিটু জানালার পাশে একটা টেবিলে আমাদের জন্য অপেক্ষ করছে। কাছে যেতেই টিটূ নিখুঁত ভদ্রলোকের মত চেয়ের ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আমরা চেয়ার টেনে বসবার পর টিটু খাবারের মেন্যু এগিয়ে দিয়ে বললো,
-ডাস ক্যাপিটাল লেখার সময় কার্ল মার্ক্স বেশীরভাগ সময় ব্রিটিশ লাইব্রেরীত পড়ে থাকতেন। ব্রিটিশ লাইব্রেরী তখন ছিল ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ভেতর। আমাদের প্রথম মধ্যবিত্ত ডাইন আউট এই লাইব্রেরীর পাশেই করলাম।
টিটু ভেজি মেল্ট পানিনি, আমি আর পদ্মপাতা পাস্তা অর্ডার করলাম। খাবারের পুরো সময়টা টিটু পদ্মপাতার সঙ্গে বিরাট গল্প জুড়ে দিলো। রেস্টুরেন্টে আসার সময় টের পেয়েছিলাম বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা। এখন জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি তুলোর মত শুভ্র তুষার পড়ছে। ডেজার্ট শেষ করে আমরা খাবারের বিলের জন্য অপেক্ষা করছি। টিটু হঠাৎ পকেট থেকে কলম বের করে পেপার ন্যাপকিনের উপর খস খস করে কী যেন লিখলো। তারপর পেপার ন্যাপকিনটা চার ভাঁজ করে আমাকে দিলো। আমি ভাঁজ খুলে বললাম,
-কই, কিছুই তো লেখা নেই।
টিটু একাট লাইটার দিয়ে টেবিলের উপর রাখা মোম জ্বালিয়ে বললো,
-পেপার ন্যাপকিনটা মোমের কাছে এনে ধরো।
-ইনভিজিবল ইঙ্ক?
-হ্যাঁ
-আমি পেপার ন্যাপকিনটায় আগুনের আঁচ দিতেই অক্ষরগুলো ফুটে উঠলো,
প্রিয় রূপা,
বাইরে এত যে হিম, তার চেয়ে বেশী হিম জমে আছে আমার এই মনে। বরফে ঢেকে গেছে অলিন্দ, নিলয়। শুধু তোমার কাছে এলে বিরহের বরফ গলে জল হয়ে যায়। রুক্ষ মরুভূমি হঠাৎ হয়ে যায় চন্দনের বন । অভাজনে বিনীত আবেদন, আমি কি এই উষ্ণতা আজীবন পেতে পারি? আমি কি রূপা নামের পৃথিবীর সুন্দরতম মানুষটির স্বামী হতে পারি?
ইতি,
রূপামুখী টিটু
প্রবল ভালবাসায় আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার জোগাড়। আমি টিটুর কাছে থেকে এক লহমায় কলম ছিনিয়ে নিলাম। ওর লেখার নীচেই চোখ বন্ধ করে চোখের পলকে আমার উত্তর লিখলাম। তারপর ন্যাপকিনটা আবার ভাঁজ করে টিটুর হাতে দিলাম। আশা নিরাশার দোলায় টিটুর হাত কাঁপছে। টিটু ভাঁজ খুলে মোমের আলোর কাছে ন্যাপকিন ধরতেই আমার প্রাণের কথা প্রাণ পেলো,
প্রিয়তম টিটু,
তিন মাসের ভিতরে উত্থাপিত প্রস্তাব কার্যে পরিণত করিতে হইবে, এই শর্ত মোতাবেক অভাজনের আবেদন অনুমোদন করা হইলো।
ইতি,
টিটুতে টলোমলো রূপা
দু মাস পর ইস্ট লন্ডনের একটঅতি সাধারণ কমিউনিটি সেন্টারে খুব অনাড়ম্বরভাবে আমাদের বিয়ের আয়োজন হলো। ধুমধারাক্কা করে বিয়ে হলে যে টাকা লাগতো তা আমরা বাংলাদেশ এবং কেনিয়ায় কিছু ছেলেমেয়ের বেড়ে ওঠার খরচ হিসেবে জমিয়ে রাখলাম।
গত মাসে আব্বু আম্মুকে লন্ডনে নিয়ে এসেছি। লন্ডনের ডাক্তাররা পরীক্ষানিরীক্ষা করে বললেন, আম্মুর অটোইমিউন ডিমেনশিয়া। ইমিউন সিস্টেমকে ঔষধ দিয়ে কিছুটা চেপে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ওরা সেভাবে চিকিৎসা আরম্ভ করেছে। ওদের ট্রায়াল মেডিসিন বেশ কাজে দিচ্ছে। আম্মু বেশীরভাগ সময় আমাদের চিনতে পারছে। বিয়ের দিন আমাদের দুজনকে জড়িয়ে ধরে আম্মু চুমু দিয়েছে। আব্বু আগের মতই আছে, শান্তশিষ্ট, কোন কিছু নিয়ে কোন অভিযোগ নেই। আমি যে আব্বুর মেয়ে সেটা এখন বেশ বুঝতে পারি।
আমরা বার্কিং-এ চার বেডরুমের বাড়ি ভাড়া নিয়েছি। এই বাড়িগুলো তিন বেড রুমের হয়। আমাদের বাড়ির তিন কোণা ছাদের অংশটা রূপান্তর করে আরেকটা ঘর বানানো হয়েছে। ওটা আমার আর টিটুর বেডরুম। কিন্তু পদ্মপাতাও থাকতে পারবে। তাই আমরা নাম দিয়েছি ত্রিভুজ-ঘর। ত্রিভুজ-ঘরের ছাদে বড় একটা জানালা আকাশের দিকে অপলক চেয়ে আছে। সেই জানালার নাম দিয়েছি ত্রিনয়ন।
আজ আমার জীবনের দ্বিতীয় বাসর। প্রথম বাসরের ভয়ংকর বিভীষিকা আজও আমার গায়ে কাঁটা দেয়। তাই কিছুটা নার্ভাস হয়ে ফুলশয্যার বিছানায় বসলাম। টিটু আমার বাঁ পাশে বসলো। তারপর মোবাইল ফোনে একটা গান ছাড়লো,
এসো এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে,
বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে।
স্বপনদুয়ার খুলে এসো অরুণ-আলোকে
মুগ্ধ এ চোখে।
গান শেষ হতেই টিটু বললো,
-গানের প্রথম লাইনটা সামান্য পুরুষতান্ত্রিক। ঘর তো দুজনের। কেউ কারো ঘরে আসবে না বরং দুজনে একটা ঘর ভাগ করে নেবো। কিন্তু বাকি গানটায় অনেক মায়া লুকনো আছে। তাই না রূপা,
-হ্যাঁ।
আকাশে মেঘ কেটে গেছে। ত্রিনয়ন দিয়ে চাঁদের আলোর বন্যা এসে আমাদের ধুয়ে দিচ্ছে। টিটু দু হাতে আমার মুখটা কাছে টেনে নিলো। তারপর কপালে চুমু দিয়ে বললো,
-পৃথিবী অনেক সুন্দর, রূপা। তারচেয়েও বেশী সুন্দর তুমি।

(সমাপ্ত ধৈর্য ধরে সঙ্গে থাকবার জন্য সবার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি)