প্রণয় পর্ব-০১

0
813

#প্রণয়
#পর্বঃ১
#তানিশা সুলতানা

১০৩° জ্বর নিয়েও সূচকের রুমের বমি পরিষ্কার করছে তানহা। হাত চলছে না চোখ দুটো খুলে রাখতেও পারছে না। মাথাটাও সোজা করে রাখতে পারছে না ঢলে পড়ে যাচ্ছে। ক্রমশ শরীরের ভর বহন করা কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

জোরে জোরে শ্বাস টানতে টানতে কাপড় ভিজিয়ে ফ্লোর পরিষ্কার করে যাচ্ছে একটু একটু করে। পানিতে হাত পড়তেই সারা শরীর জারিয়ে উঠছে। ঠান্ডাও লাগছে খুব। বমির বিশ্রী গন্ধটা খুব করে নাকে লাগছে। তবুও একটুও চোখ মুখ কুঁচকে নিচ্ছে না। নাকটাও চেপে ধরছে না বা হাত দিয়ে।
নিজের নতুন ওড়নাটা দিয়েই পরিষ্কার করছে।

সূচক হাত পা মেলে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। হুশ নেই তার। একটু আগেই ঢক ঢক করে দুই বোতল মদ গিলে গলগল করে বমি করেছে। খেতে খেতেই হয়ত বাড়িতে ঢুকেছে। কারণ যখন রুমে ঢুকছিলো তখনও টলছিলো। আর হাতে দুটো বোতল ছিলো। আস্ত তানহাকে পর্যন্ত খেয়াল করে নি।
এক মনে খেয়ে গেছে।

তানহা ক্লান্ত চোখে তাকায় সূচকের দিকে। কি নিষ্পাপ মুখটা। এই মুখটা দেখলে তো দুনিয়াটাও ঠান্ডা হয়ে যায়। তাহলে এই বাড়ির কয়েকটা মানুষের কলিজা কেনো ঠান্ডা হয় না?

আর সম্ভব হচ্ছে না। তানহা কাপড়ের টুকরোটা বালিতে রেখে সূচকের পাশেই শুয়ে পড়ে। চোখ দুটো বন্ধ করে আবার চোখ খুলে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় সূচকের দিকে। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাতে কষ্ট হচ্ছে। তাই সূচকের দিকেই ঘুরে শয়। এভাবে ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে।
এই লোকটাকে দেখেই ৪০% সুস্থ অনুভব করছে তানহা। জ্বর বোধহয় কয়েক ডিগ্রি কমে গেছে। চোখ দুটোও জ্বলছে না। গলাও শুকিয়ে যাচ্ছে না। তৃষ্ণা মিটে যাচ্ছে।

শার্টের ওপরের দুটো বোতাম খোলা। বুকের বা পাশটায় রক্ত চিকচিক করছে। সাদা শার্টের অনেক জায়গায় লাল দাগ। কেউ মেরেছে মনে হচ্ছে? কিন্তু কে মারবে? কেনো মারবে? ঠোঁটের কোনেও একটুখানি লাল রক্ত জমাট বেঁধে গেছে শুকিয়ে। চোখের নিচে মোটা করে কালি জমে গেছে। ধবধবে ফর্সা মুখটা কালো হয়ে গেছে। দাঁড়িও অনেকটা বড় হয়েছে। চুল গুলো ঘাড় ছাড়িয়ে পড়বে পড়বে অবস্থা।
পায়ে জুতো। একটা পা ফ্লোরে অন্য পা বেডে। বালিশের দুই ইঞ্চি নিচে মাথা। একটা হাত কপাল অন্য হাত খাটের বাইরে ঝুলে পড়েছে। হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। ঘড়িটার কাঁচ ভেঙে গেছে।

তানহা হাত বাড়িয়ে ছুঁড়ে দেয় সূচকের মুখখানা। একে একে হ্মত গুলোতেও হাত বুলিয়ে দেয়। তানহার গরম হাতে স্পর্শে একটু খানি নরে চরে কপাল কুচকে ফেলে সূচক। তানহা তারাহুরো করে হাত সরিয়ে নিতে যায়। কিন্তু পারে না। সূচক তানহার হাতটা মুঠো করে ধরে ওর দিকে মুখ করে পেটের ওপর একটা হাত তুলে শান্ত হয়ে যায়। তানহা এতখন শ্বাস বন্ধ করে ছিলো। এখন ঠোঁটের কোনে এক টুকরো হাসি ঝুলিয়ে শ্বাস টানে।

হা করে ঘুমচ্ছে সূচক। অসম্ভব বমির গন্ধ আসছে সূচকের মুখ থেকে। গা গুলিয়ে আসার মতো। কিন্তু তানহা সয়ে নিচ্ছে। এই গন্ধটাও ভালো লাগছে। তানহার ঘাড়ের কাছাকাছি সূচকের মুখটা। নিশ্বাসের শব্দটা একদম গলায় এসে পড়ছে। কিন্তু অসুস্থ তানহার অস্বস্তি হচ্ছে না। বরং ভালোই লাগছে। গরম নিশ্বাসেও শরীর জারিয়ে যাচ্ছে।

চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে তানহা। একটু শান্তি প্রয়োজন এখন। জ্বরটা কমানো প্রয়োজন। সুস্থতা দরকার। সকাল হতেই বালতি নিয়ে এই রুম থেকে চলে যাবে। যাতে কেউ বুঝতে না পারে সূচক বমি করেছিলো। বা মদ খেয়েছে।
পেটের ওপর থেকে সূচকের হাতটা নামিয়ে দেয়। খানিকটা শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে কাত হওয়া থেকে চিৎ করে শুয়িয়ে দেয় তানহা। ঠোঁট দুটো এক করে দেয়।
তারপর বালিশটা সূচকের মাথার নিচে দিয়ে নিজে জায়গা করে নেয় সূচকের বুকে।
বুকে নাক ডুবিয়ে গন্ধ শুকে। ঘাম আর পারফিউম মিলে অন্য রকম একটা গন্ধ ভেসে আসছে। এই গন্ধটাও ভালো লাগছে তানহার।
সূচকও দুই হাতে আগলে নেয় তানহাকে৷ পরম শান্তিতে চোখ দুটো বন্ধ করে নেয় তানহা।
এরকম রাত কি আর প্রতিদিন আসবে?

🥀🥀
ফোনের এলার্মে ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙে যায় সূচকের। মাথাটা ভারি ভারি লাগছে। টেনে শুনে চোখ দুটো খুলে। অসম্ভব ভাবে চোখ দুটো জ্বলছে। আবারও খিঁচে বন্ধ করে নেয়। কিন্তু এখন আর ঘুমানো যাবে না। তাই জোর পূর্বক আবারও চোখ খুলে। এখনো ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমটা। দরজা জানালা খোলা থাকলে হয়ত অন্ধকার কিছুটা কমে যেতো।

বুকের ওপর ভারি কিছু অনুভব করতেই কপালে তিনটে ভাজ ফেলে। কোল বালিশ তো এতটা ভারি হতেই পারে না। তাহলে?
অসম্ভব গরম তাপ আসছে বুকের ওপর থাকা ভারি জিনিসটা থেকে। নিজের শরীর টাও গরম অনুভব করছে।
হাত দুটো উঠাতে গিয়ে বুঝতে পারে হাত দুটো কারো হাতের মুঠোয়।

তানহার হাতের মুঠোয় থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে তানহার মাথাটা ধরে আস্তে করে বালিশে শুয়িয়ে দেয় সূচক। জলদি উঠে বসে লাইট অন করে। বুক টিপটিপ করছে।

তানহার মুখটা দেখে কুঁচকানো কপালটা আরও একটু কুচকে ফেলে।

বুঝতে বাকি নেই এই মেয়েটা আজকেও রাত জেগে ওর রুমে বসে অপেক্ষা করছিলো ওর জন্য। কপালে হাত দিয়ে বসে সূচক। এই মেয়েটাকে কি করে বললে বুঝতে পারবে?
হাজার বার বুঝিয়েছে এভাবে রাত-বিরোতে আমার রুমে আসবি না। বাকিরা দেখলে ভুলভাল ভাববে। বদনাম দেবে। খারাপ ভাববে।

কিন্তু কোনো কাজ হয় নি। প্রতিদিনই মেয়েটাকে অপেক্ষা করতে দেখে। বয়স বেশি না। সবে নবম শ্রেণিতে পা দিয়েছে।

সূচক ফ্লোরে দিকে তাকাতেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। এই মেয়েটার ওর বমিও পরিষ্কার করেছে? একে নিয়ে আর পারা যাবে না। কিউট ফেসটার দিকে তাকিয়ে বকাইও দিতে পারে না। ঠোঁট উল্টে কেঁদে দিলেই সূচকের রাগ গলে জলে হয়ে যায়।

দ্রুত বিছানা ছেড়ে নামে সূচক। বালতিটা ওয়াশরুমে চলে যায়। চোখে মুখে পানি দিয়ে আয়নার দিকে তাকাতেই নিজেকে বদ্ধ পাগল রুপে আবিষ্কার করে। একদম জঙ্গল জঙ্গল লাগছে। শার্ট খুলে বুকের বা পাশে হাত দেয়। সেখানকার হ্মতটায় চামড় ধরেছে। এক রাতেই চামর ধরে গেছে।
এই ঘা টাই শিক্ষা দেয় “কষ্ট সারাজীবন থাকে না। আধার শেষে যেমন আলো আসবে। কাটা থকথকে ঘা ও দিন শেষে চামর ধরে যায়। ঠিক তেমন ভাবেই দুঃখও একটা সময় সুখে পরিণত হবে। হবেই”

নিজেকে দেখে তাচ্ছিল্য হেসে দ্রুত ফ্রেশ নেয় সূচক।

বিছানার কাছে গিয়ে ঘুমন্ত তানহাকে কেলে তুলে নেয়। কেউ জেগে যাওয়ার আগে ওকে ওর রুমে রেখে আসতে হবে।

কোলে নেওয়ার পরেও অনুভব করে শরীরটা অসম্ভব গরম। বুঝতে বাকি নেই যে ওর ভীষণ জ্বর এসেছে। কিন্তু এখন কিছুই করা যাবে না।
তাহা দুই হাতে সূচকের গলা জাপ্টে ধরে বুকের ওপর মাথা ঠেকায়। কিছুটা হুঁশে ফিরেছে।

পাশাপাশি রুম হওয়াতে পা চালিয়ে দ্রুত চলে যায়। দরজা খোলাই ছিলো। তোহা উল্টো হয়ে শুয়ে গভীর ঘুম আচ্ছন্ন। ওর পাশে যে ওর বোন নেই এ দিকে কোনো খেয়াল নেই মেয়েটার।
তানহাকে শুয়িয়ে দিয়ে আলমারি থেকে কোম্বল বের করে গায়ে চাপিয়ে দিয়ে তানহার মাথায় হাত বুলিয়ে কিছুখন ক্লান্ত শুকনো মুখ টার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে যেতে নেয় সূচক।

“একটু পানি দিবেন ভাইয়া।

জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট জোরা ভিজিয়ে ক্লান্ত গলায় বলে তানহা।
সূচক কটমট চোখে তাকাতে গিয়েও শান্ত চোখে তাকায়। কারণ মেয়েটা এখনো চোখ খুলে নি। শুধু শুধু রাগ দেখানোটা ঠিক না।

” আনছি।

এই রুমে কোনো কালেই পানি থাকে না। দুই বাঁদর একটাও ঠিক মতো পানি খায় না। সূচক দরজা চাপিয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। ফিল্টার দেখে এক বোতল পানি ভরে আবারও তাহার রুমে যায়।
রুমে গিয়ে দেখে তোহা জেগে গেছে। ঘুম ঘুম কন্ঠে তানহার মাথা টিপে দিচ্ছে।
তানহা টেনে শুনে চোখ খোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না।

সূচক ধুপধাপ পা ফেলে রুমে প্রবেশ করে। সূচকে দেখে তোহার ঘুম উড়ে যায়। সোজা হয়ে বসে দুই হাতে মাথা টিপতে থাকে। তানহাও চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে নেয়।

“ওকে পানিটা খায়িয়ে দিয়ে। সবাইকে ডেকে তুলবি। সাথে আমাকেও

সূচকের কথা শুনে বড়বড় চোখ করে তাকায় তোহা।

” তুমি তো জেগেই আছো। তাহলে তোমায় কেনো ডেকে তুলবো?

ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে তোহা।

“আমি বলছি তাই।
দরজায় কড়া নেরে নেরে ডাকবি আমায়। অনেকবার ডাকবি।
নাহলে ইমনকে বলে দিবো তুই হা করে ঘুমাস।

বলেই চলে যেতে নেয়। আর তখনই

চলবে।