প্রেমপ্রদীপ পর্ব-৪৩+৪৪

0
2338

#প্রেমপ্রদীপ
Part–43
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

আজকে সমুদ্র আর আয়নার গায়ে হলুদ। সকাল থেকেই সবাই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। হলুদের অনুষ্ঠান বাসায়ই হবে। তাই রান্না-বান্না সব ঘরেই। পরিচিত অফিস কলিগ, ফ্রেন্ড আর ফ্যামিলি নিয়ে টোটাল দুই পরিবারের গেস্ট মিলিয়ে ৭০ জন গেস্ট। আয়নাদের বাসার ছাদে হবে অনুষ্ঠান। দুইজন কে একসাথেই হলুদ মাখানো হবে। আজ-কাল ওয়েডিং প্লানিং সেক্টরে খুব ডেভেলপমেন্ট হয়েছে। এক যুগে আগেও মানুষ বলত, বাইরের লোক আনায় ঘর কেন সাজাব। আমরা আমরা নিজেরাই সব সাজাব। কিন্তু এখন কম-বেশি অনেকেই ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের সাহায্য নেয়। সমুদ্ররাও নিয়েছে তাদের হেল্প। ছাদে স্টেজ করা হবে। চেয়ার-টেবিল খাবার ব্যবস্থা। লাইটিং সব করে দিবে।

পিউ তড়িঘড়ি করে বের হলো রুম থেকে । বাবার সাথে বাইরে যাবে সে। গাজরা কিনতে হবে। হলুদে সবাই তাজা ফুলের গহনা পড়বে। এখন দুপুর। মেয়ের আবদার পূরন করতেই আবেগ মেয়েক নিয়ে বের হলো। পিউ অনেক বেশি এক্সাইটেড। সে তো ঠিকমতো দুপুরে খেতেই পারেনি!

আবেগ তাকে নিয়ে ফুল কিনতে গেলেও আরো অনেক কিছু বাজার করলো৷ দুপুরের কড়া রোদে পিউ আর আবেগ অস্থির। দুইজনেরই পিপাসা লেগেছে। পিউ যেহুতু বাংলাদেশের আবহাওয়ার সাথে অভ্যাস্ত না তাই তার ফর্সা মুখটা রোদে লাল হয়ে যেতে লাগলো।

পেছন থেকে কেউ পিউয়ের সামনে এক বোতল পানি এগিয়ে দিয়ে বলে, নাও পানি খাও৷

আবেগ আর পিউ দুইজনেই পেছনে ঘুরে দেখে রঙ্গন দাঁড়িয়ে আছে। হাসি হাসি ভাব করে। তার হাতে দুটো বোতল ছিলো। সে দুইজন কেই দুটো বোতল এগিয়ে দিলো।

পিউ কোন কিছু না ভেবেই বোতলটা ছো মেরে নিয়ে ঢকঢক করে খেতে লাগলো। বড্ড তৃষ্ণা পেয়েছিল তার। বাংলাদেশে এতো গরম কেন?কিছু দিন আগেই না শীত শীত ছিলো।

রঙ্গন আবেগকে খুব বিনীত গলায় বলে, আংকেল পানি খান। গরম অনেক।

আবেগ ও এক প্রকার খুশি হয়ে পানি টা হাতে নিয়ে খেল।

রঙ্গন খেয়াল করল পিউয়ের হাতে কোন শপিং ব্যাগ নেই। অথচ ইশরাক সাহেবের দুই হাতই ব্যাগ দিয়ে ভরে গেছে।

সে মনে মনে ভাবে, বাবারা বুঝি এমনই হয়! কখনোই তার সন্তানদের বিন্দুমাত্র কষ্ট পেতে দেয়না। বাবার সাথে শপিং এ আসলে বুঝি সব ব্যাগ বাবাই ক্যারি করে আর ছেলে-মেয়েরা কেনাকাটার আবদার জুড়ে দিতে লাগে। কি জানি! সে তো কোন দিন বাবার সঙ্গে শপিং ও যায়নি তাই জানা নেই৷

পিউয়ের উপর বড্ড হিংসা হতে লাগে রঙ্গনের। সে আবেগের কাছে গিয়ে বলে, ব্যাগ গুলো আমাকে দিন।

— না। না। বাবা। লাগবেনা।

— আরে বাব বললেন আবার ফরমালিটি করছেন কেন? দেন তো ব্যাগ গুলো।

আবেগ বলে উঠে, রোদের মধ্যে তোমার কষ্ট হবে না। থাক লাগবে না।

রঙ্গন বলে, কি যে বলেন না! কিসের কষ্ট! এতো আরামপ্রিয় হলে পুলিশ হতাম নাকি?

বলে জোড় করে আবেগের কাছ থেকে ব্যাগ এক প্রকার টেনে নিল। পিউ মুখ বাকালো। তা দেখে সে বাকা হাসলো।

তখনি আবেগের ফোনে কল আসলো। সে রিসিভ করে দেখল, একটা জরুরি কাজে তাকে অফিসে ডাকা হচ্ছে। কোথায় যেন সিংনেচার লাগবে।

রঙ্গন সব শুনে বলে, আংকেল আপনি যান। আমি পিউকে রেখে আসব৷

আবেগ বললো, আরে না। আমি পিউকে নিয়ে যাব আমার সঙ্গে।

পিউ কিছু বলবে, তার আগেই সে বলে উঠে, আংকেল আপনি কি আমাকে অবিশ্বাস করছেন?

আবেগ স্মিত হেসে বলে, না। না। তা কেন করব?

— তাহলে আপনি যান তো। আমি ওকে নিয়ে যাব।

আবেগ ভেবে দেখল, এটায় মন্দ হয় না। ছেলেটাকে তার বেশ ভালোই লেগেছে। সে বলে উঠে, আজকে আমার ছেলের হলুদ। তোমাকে ইনভাইটেশন দিলাম। আসবে কিন্তু।

— আচ্ছা।

আবেগ এক প্রকার বাধ্য হয়ে অফিস যাচ্ছে। পিউয়ের কাছ থেকে একটু দূরে এসে সে পেছনে তাকালো। রঙ্গন আর পিউকে একসাথে কথা বলতে দেখে তার ভালোই লাগে। আজ-কালের ছেলেরা এই ছেলেটার মতো না। কত ভদ্র একটা ছেলে।

★★★

— পিউ চলো তোমাকে নিয়ে রিকশা ভ্রমণ করাই।

পিউ আগ্রহ নিয়ে বলে, ওই যে তিন চাকার গাড়িগুলোকে রিকশা বলে না? ওগুলাতে উঠব?

রঙ্গন হেসে ফেলে তারপর বলে।,হ্যা। চল। তার আগে বল আইসক্রিম খাবে?

–উহু।

— আরে কেন না?

— আমার কাছে টাকা নেই।

রঙ্গন বিড়বিড়িয়ে বলে, স্বামী থাকলে বউয়ের টাকা লাগে না। তারপর বলল, আরে সমস্যা নাই। আজকে আমি খাওয়াই অন্য আরেক দিন তুমি খাওয়াবা আমাকে। চল চকবার আইসক্রিম খাই।

দুইজন দুইটা চকবার আইসক্রিম কিনে রিকশায় উঠে। পিউয়ের উঠতে একটু অসুবিধা হয় তবুও তার রিকশায় উঠতে পেরে ভালো লাগছে। শ্রাবণ ভাইয়া বলেছিল সে রিকশায় উঠতে চায় কিন্তু ভাইয়া তাকে গাড়ি ছাড়া কোথাও নিয়ে যেতে চায় না। বেশিরভাগ টাইমে তারা উবার ইউস করে। ফাস্ট টাইম রিকশায় উঠে তার ভয়-ভয় ও লাগছে। যদি পড়ে যায়৷

হুট করে রঙ্গন তার কোমড় ধরে বসে। পিউ চেচিয়ে উঠে বলে, কি?

রঙ্গন বলল, সেইভটি ফাস্ট। এক কাজ করো তোমার পা রিকশার মাঝখানে সেই রড দেওয়া সেখানে রেখে চেপে রাখো আর আইসক্রিম খাওয়া শেষ হলে বাম হাত দিয়ে রিকশার হুট ধরবে ততোক্ষন তোমাকে ধরে রাখা আমার দায়িত্ব । রঙ্গনের স্পর্শে মন্দ কিছু অনুভব করছেনা পিউ। তাই সে আর কিছু বলেনা। আসলেই তার ভয় করছিলো। রঙ্গন তাকে ধরে রাখায় আর ভয় করছেনা। সে আইসক্রিম খাওয়ায় মনোযোগ দিল। আজকে আইসক্রিম খেতেও মজা লাগছে। সে বেশ সাবলীল ভাবেই খাচ্ছে। কোন জড়তা নেই তার মধ্যে

রঙ্গন ঘাড় বাকিয়ে পিউকেই দেখে যাচ্ছে। রিকশা আপন গতিতে যাচ্ছে। ঢাকার ধুলোমাখা বাতাস বইছে।সবকিছু তেই আজ প্রশান্তি খুজে পাচ্ছে রঙ্গন। বাস-গাড়ির হর্ণের শব্দে ও বিরক্তি লাগছেনা। কেন? কেন? কেন? এমন লাগছে?

পিউ পাশে বসে আইসক্রিম খাচ্ছে সেজন্য? সে আনমনে হেসে ফেলে তারপর পিউকে উদ্দেশ্য করে বলে, আজকে কি আমি তোমার ভাইয়ার হলুদে আসব?

পিউ খেতে খেতে জবাবে বলে, তোমার ইচ্ছা। আব্বু তো ইনভাইটেশন দিয়েই দিয়েছে৷

— আমি ভেবেছিলাম তুমি আসতে বারং করবে।

পিউ এবারে রঙ্গনের দিকে আশ্চর্য ভরা চোখে তাকিয়ে বলে, কেন মানা করব?

— আমি না গেলে এক পিস রোস্ট, তিন টুকরা গরুর মাংস আর এক প্লেট পোলাও বেচে যাবে।তোমার ই লাভ সেগুলা বাচলে পরের দিন গরম করে খেতে পারবে৷

পিউ চোখ ছোট ছোট করে বলে, বাসায় সব বেশি বেশি করেই আয়োজন করা হচ্ছে। এমনিতেই খাবার বাচবে৷

— পিউ তোমরা অনেক বড়লোক তাই না?

— উহু আমরা বড়লোক না। আমাদের মন বড় তাই আমাদেরকে ধনী মনে হয় তোমার। আসলে যাদের মন বড় তারাই প্রকৃত বড়লোক।

–খুবই সুন্দর বলেছো।

তার আইসক্রিম খাওয়া হয়ে গেল এজন্য সে প্যাকেটটা রাস্তায় ফেলতেই পিউ চিৎকার করে বলে, আল্লাহ কি করলে ? এভাবে রাস্তায় কেউ প্যাকেট ফেলে?

সে মুচকি হেসে জবাবে বলে, বাংলাদেশে সবাই রাস্তায় প্যাকেট ফেলে।

পিউ বলে, ডাস্টবিন নেই?

— আছে। কিন্তু কেউ ইউস করে না।

রিকশার গতি বেড়ে যায়। হুট করে বাতাস বইতে লাগে। পিউয়ের ও খাওয়া শেষ। সে চুপচাপ বসে আছে। সে মজার ছলে বলে, ফেলে দিই তোমাকে?

তারপর পিউকে ঝাকি মারে আস্তে করে। পিউ ঘাবড়ে গিয়ে রঙ্গনকে আকড়ে ধরে বলে, না। না। একদম না! কেন ফেলে দিবে আমাকে? হু?

সে হোহো করে হেসে বলে, তোমাকে কি কোন দিন ফেলে দিতে পারব নাকি? তুমি তো এমন কেউ যাকে আজীবন সযত্নে সংরক্ষণ করে রাখব শ্রেয়সী।

পিউ বেশ খানিকটা কাছে চলে এসেছিল রঙ্গনের। তার দুই বাহুই এটো হাতে চেপে ধরে আছে পিউ।

পিউয়ের মুখে ভয়ের ছাপ।

রঙ্গন হুট উঠিয়ে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণ জগত থেকে বিচ্ছিন্ন মনে হতে লাগে পিউয়ের। রঙ্গন আলতো করে পিউকে জড়িয়ে রাখে এবং তার মুখের কাছে মুখ আনে।

পিউ আতকে উঠে বলে, তুমি আমার সাথে খারাপ কিছু করবে তাই না?

— নাহ। একদম ই না। তোমার ক্ষতি করার স্পর্ধা
আমার নেই।

পিউ বিষ্ময়কর চোখে রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে বলে, কিন্তু সুযোগ তো আছে।

— আমি সুযোগ সন্ধানি না গো। তোমার সাথে খারাপ করতে পারব না৷ কেন জানো? কারন তুমি আমার মায়ের জাত। নারীর অমঙ্গল করার শক্তি পুরুষের নেই। এখন প্রশ্ন করতে পারো, নারীদের ক্ষতি তো পুরুষরাই করে। তাহলে উত্তর হলো, তারা পুরুষ নয়। সত্যিকারের পুরুষ আর পুলিশ নারীদের সব অমঙ্গল থেকে রক্ষা করে। তারা রক্ষাকবচ!

পিউ মুগ্ধতা নিয়ে রঙ্গনের কথাগুলো শুনছে।

রঙ্গন বলে উঠে, পিউ মনি?

রঙ্গনের মুখে এমন আদুরে আওয়াজে পিউমনি ডাক শুনে পিউয়ের মনে কিসব হতে লাগলো। পেটের মধ্যে সুরসুরি হতে লাগে। সে ঠোঁট কামড়ে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। সে হাসল। কি মারাত্মক আর ধারালো সেই হাসি! উফ সোজা পিউয়ের বুকে গিয়ে বিধলো৷

সে বলতে লাগলো, Your fisrt Journey by Rickshaw! And I was there with you.

প্রথম অনুভূতি সবসময়ই পহেলাই থাকে। এর পরে আরো একশবার রিকশায় উঠো এই অনুভূতি আসবে না। আমি তোমার মনে জায়গা পাচ্ছিনা। কিন্তু খুব সুক্ষ্ম ভাবে তোমার মস্তিষ্কে ঢুকে গেছি। এখন থেকে যতোবারই রিকশা দেখবে এই পুলিশের কথা মনে পড়বে তোমার।

পিউ চেয়ে আছে তার দিকে। মুখে কোন কথা নেই তার। রঙ্গন পকেট থেকে গোলাপ বের করে পিউয়ের চুলে পড়িয়ে দিল। সে চুলের ক্লিপ ও সঙ্গে এনেছিল সেই ক্লিপ দিয়ে গোলাপ চুলে আটকে দেয়।

পিউ কিছু বললো না।

–A rose for you. তারপর বললো,

আমি তোমার জীবনে গোলাপের কাটা হতে চাই!

কি ভাবছো তোমার প্রেমিক পাগল হয়ে গেছে? উহু……প্রিয়তমা! আমি একদম ঠিক আছি। আমার কাছে মনে হয় গোলাপ গাছে কাটা থাকে না বরং কাটা যুক্ত গাছে গোলাপ ফুটে৷ গোলাপ গাছের কাটা সদ্য ফোটা গোলাপকে অনিষ্ট হতে রক্ষা করে। আমিও তোমায় সকল অমঙ্গল, অনিষ্ট হতে রক্ষা করে তোমার জীবনের গোলাপের কাটা হতে চাই!!!!

পিউ তব্দা খেয়ে যায়। সে রঙ্গনের প্রিয়তমা কবে থেকে হলো?

পিউ কিছু না বলে রিকশার হুট খুলে দেয়। বাতাস বইছে। সে হুট থেকে নিজের হাতের বাধন ছেড়ে দেয়। তারপর চোখ বন্ধ করে ফেলে। নিজেকে মুক্ত লাগছে। তাকে রক্ষা করার জন্য রক্ষাকবচ সাহেব বসে আছেন। তাহলে আবার তাকেও কেন রিকশা ধরতে হবে? ও তো আছেই!

রঙ্গন পিউয়ের এহেন কান্ড দেখে পিউকে আরো শক্ত করে ধরে যেন সে পড়ে না যায়৷

তারপর বলতে লাগলো, আমি হাত দিয়ে যা ছুই, তাই দুঃখ হয়ে যায়!

পিউ তার প্রতি এতোটাই মুগ্ধ যে এটা বুঝতে অক্ষম হলো যে ভবিষ্যতে তার জন্য দুঃখ অপেক্ষায় আছে।

★★★

আয়না কাচা হলুদ রঙের একটা শাড়ি পড়েছে। সুন্দর করে মেকাপ করে দেওয়া হয়েছে তাকে। শাড়িটাও খুব সুন্দর করে পড়িয়ে দিয়েছে। চোখে নিজে নিজেই কাজল দিলো সে। তারপর আয়নায় নিজেকে দেখে নিল। সত্যি কাচা হলুদ রঙটা তার গায়ে ফুটে উঠেছে খুব দুর্দান্ত ভাবে। পরনের গহনা সব আসল ফুলের। এজন্য আয়নার গা থেকে ফুলের গন্ধ বের হচ্ছে। নিজেকে ফুলবতী লাগছে তার। সে মনের সাধ মিটিয়ে হাত এক ডজন লাল চুড়ি পড়েছে। রেশমি চুড়ি।হাতে আলতা পড়েছে সে।

সে উঠে দাড়ালো । তখনি সমুদ্রের ফোন আসে। সে রিসিভ করতেই সমুদ্র প্রশ্ন করে, সাজ-গোজ হলো?

আয়না বলল, হু৷

— একটা ছবি পাঠাও। দেখতে মন চাচ্ছে তোমামে।

— কোথায়?

— ম্যাসেঞ্জার এ৷

— আমার ম্যাসেঞ্জার নেই৷

— হোট্যাস আপ?

— উহু নেই৷

–তাহলে আরকি করার! এক কাজ করো দ্রুত বারান্দায় আসো।

আয়না তব্দা খেয়ে যায়। সে এক প্রকার ছুট লাগিয়ে বারান্দায় গিয়ে দেখে সমুদ্র কানে ফোন লাগিয়ে তার দিকে চেয়ে মিটমিট করে হাসছে৷

আয়না খুশিতে কেদে দিলো।

চলবে৷

#প্রেমপ্রদীপ
Part–44
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

— ছাদে আসো। তোমার চেহারা প্রদর্শন করি!

— না। না। এখন ছাদে যাওয়া যাবে না।

কথাগুলো আয়না প্রায় ফিসফিস আওয়াজে বললো। যেন কালেভাদ্রেও কেউ তার কথা শুনতে না পায়।

তাকে ব্যঙ্গ করে সমুদ্রও আস্তে করে বলে, কেন? যাওয়া যাবে না? মামী বকা দিবে?

সমুদ্রের রসিকতা করাটা বুঝে ফেলে আয়না। সে মিনমিন করে বলে, এইজন্য না!

— আহা আয়ু আসো তো! আমার চোখজোড়া তোমায় দেখার করে তৃষ্ণাথ। পাচ মিনিটের মধ্যে ছাদে আসো।

বলে সমুদ্র বাসার ভেতরে ঢুকে। আয়নার ভয়ে হাত-পা কাপছে। লজ্জাও লাগছে। ধরা খেলে সবাই হাসবে! সমুদ্র কি জানে না! সে এতোটাও সাহসী না তার মতো। আয়না ভীতু। তার ভয় হয়। সে এক ধ্যানে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল৷

পনের মিনিট পর আবার সমুদ্রের কল এলো। সে রিসিভ করতেই সমুদ্র ঝাড়ি মেরে বলে উঠে, আয়ু! আমি ফিফটিন মিনিটস ধরে তোমার অপেক্ষায় রোদের উত্তাপে পুড়ছি আর তুমি লাপাত্তা! Where are you? আসো!

— বললাম তো সম্ভব না। (করুন গলায়)

সমুদ্র আয়ুর কন্ঠের স্বরের আকুলতা শুনে হেসে দিল এবং বলল, আয়ু! তুমি তো দেখি একটা ভীতুর ডিম! এত্তো এত্তো ভয় নিয়ে রাত্রীযাপন করো কেমনে? ভয়েরা যদি পেটের মধ্যে ব্লাস্ট হয় কিছুটা গ্যাস্টিকের মতো? তাহলে কি হবে? জলদি আসো! নাহলে আমি কেলেঙ্কারি বাধাব।

আয়না এবারো ভয়েই রাজী হয়ে যায়। সমুদ্রের ভরসা নেই দেখা গেল বাসায় এসে পড়েছে।

সে অন কলে থেকেই সিড়ি বেয়ে ছয়তলায় উঠলো। ছাদে উঠতেই কেউ তাকে হ্যাচকা টান মারলো। আয়না জানে এটা সমুদ্র। তবুও সে ভয়ে চোখ বুজে ফেলে।

সমুদ্র তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে এনে বলে, চোখ বন্ধই রাখো! খুলবে না প্লিজ৷

আয়না প্রায় ফিসফিস গলায় বলে, কেন খুলব না?

— কারনটা বলা যাবে না। বলে সমুদ্র নিজ দায়িত্বে তার চোখে নিজের হাত দিয়ে চোখ ঢেকে দিল।

আয়না পিটপিট করে চোখ খুলে রেখেছিল এতোক্ষন। সে এতোক্ষন অল্প-সল্প করে সবই দেখছিল৷ এতোক্ষন সে সমুদ্রের চাপ দাড়ি গুলো দেখছিল। তবে সমুদ্রের চোখে চোখ রাখার সাহস হচ্ছিলনা আয়নার।

আমাদের জীবনে কিছু কিছু মানুষের আগমন ঘটে যাদের চোখে চোখ রাখবার সাহস আমাদের নেই!

আয়নার জীবনে সমুদ্র ও এমনই কেউ একজন। যার চোখে চোখ রাখলেই অজস্র আবেগ-অনুভূতি, আকুলতা, স্বপ্ন, অনুপ্রেরণা, প্রেম, সুখ দেখতে পায় আয়ু। তার এই সময় খুব কান্নাও পায়। আয়নার মনে হয় সমুদ্রের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে এক সমুদ্র পরিমাণ চোখের অশ্রু ঝড়ালেও সমুদ্রের ঋণ শোধ হবে না।

সমুদ্র হুট করে আয়নাকে পাজ কোলে উঠালো। আয়না ভয়ে কেপে উঠে চিৎকার করে বলে, এই! কি করছো কেউ দেখে ফেলবে তো!

— দেখুক। হু কেয়ারস!

— প্লিজ নামাও।

সমুদ্র আয়ুর কথার পিঠে কিছুই বললো না। সে তাকে পাজ কোলে তুলে নিয়ে হাটতে লাগে। ছাদের মাঝ বরাবর এসে আয়নাকে নামিয়ে দিয়ে তার চোখ থেকে হাত সরালো।

আয়না দ্রুত চোখ খুলে ফেলে। তারা দোলনার সামনে দাড়িয়ে আছে। দোলনাটা খুব সুন্দর করে সাজানো। গাদা ফুল দিয়ে সাজানো। আয়না মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেই দোলনার দিকে তাকিয়ে রইল।

আচমকা সমুদ্র তাকে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে কাধে থুতনি রেখে বলে , এইসব ডেকোরেশন আমি নিজ হাতে করিনি। তোমার জামাই এতোটাও কাজের না। ডেকোরেশনের লোক করে দিয়েছে।

আয়না হেসে দিল। দোলনায় অনেক কিছু রাখা আছে। চার-পাঁচ সেট কাচের চুড়ি। আর বিশাল মোটা আকারের একটা বই। যেখানে চকচকে অক্ষরে লেখা, ফেলুদা সমগ্র (সত্যজিৎ রায় ১)।

আয়না মুগ্ধ ও আশ্চর্যে বুদ হয়ে যায়। সমুদ্র কিভাবে জানল তার সবচাইতে প্রিয় চরিত্র ফেলুদা। ফেলুদা সিরিজের সব বই ই তার প্রিয়। প্রিয় এবং অধিকতর প্রিয়৷ এটা তো সমুদ্রের জানার কথা না। কিভাবে জানল সে। আয়নার এখনই বইটা উল্টে-পাল্টে দেখতে মন চাচ্ছ৷

সে বলে উঠে, আমার প্রিয় বই ফেলুদা সমগ্র এটা কেমনে জানলে?

সমুদ্র আয়নাতে বুদ হয়ে উত্তর দিল,

আপনজনের প্রিয়-অপ্রিয়তার খবরাখবর রাখতে হবে। নাহলে আপনতায় টান লাগে।

আয়না মুচকি হাসলো। সমুদ্র আয়নার কাধে মুখ রেখেই বলে উঠে, তোমার বাম হাতটা দাও তো৷

আয়না তার বাম হাত বাড়ালো। সমুদ্র টুপ করে বাম হাতের আনামিকা আঙুলে সোনার আংটি পড়িয়ে দিল।

এরপর বলল, এবারে ডান হাত দাও৷

আয়না ডান হাত এগিয়ে দিল, সমুদ্র ডান হাতের আঙুলে একটা রুপার আংটি পড়িয়ে আয়নাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। আয়নার চোখ-মুখে অজানা খুশি, আনন্দ বিরাজ করছে।

সমুদ্র টুপ করে আয়নার ডান হাতে চুমু খেল। আয়না চোখ বড় করে তার দিকে তাকালো। সমুদ্র লাজুক হাসলো।

এরপর আয়নার ডান হাত নিজের নাকের কাছে ধরে হাতের গন্ধ শুকে বলে, এই তোমরা আজকে কি খেয়েছো? পোলাও না বিরিয়ানি?

আয়না হেসে জবাব দিলো, মোরগ পোলাও।

সমুদ্র বলল, আয়ু তুমি কি বাচ্চা? এখনো ঠিকমতো হাত ধোয়া শিখলে না? খাওয়ার পর ও হাত দিয়ে গন্ধ বের হয়।

আয়না গোল গোল চোখে সমুদ্রের দিকে তাকালো। কিন্তু মুখে কিছু বললো না।

সমুদ্র এবারে দুই হাতই তার হাতের ভাজে আকড়ে ধরে বলে, আজকে এই মূহুর্ত থেকে তোমাকে নিজের করে নিলাম। তোমার প্রতি আর কারো অধিকার রইবে না। এখানে অন্যকারো বলতে তৃতীয় পক্ষ বুঝিয়েছি। অবশ্যই বিয়ের পর ও তোমার প্রতি তোমার বাবা-মা, বোন, নানা-নানি এবং ফ্রেন্ডের অধিকার থাকবে এবং তোমার ও তাদের প্রতি যেসব দায়িত্ব আছে আশা রাখছি তুমি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। আজকে থেকে তোমার ভালো-মন্দের দিকে নজর রাখার দায়িত্ব ও আমার।

আয়না সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে।

সমুদ্র মিটমিট করে হেসে বলে, শেষ সমাচার এই যে, তোমাকে আমি ভালোবাসি। এটা চিরন্তন সত্য। আমি আমার মৃত্যুর আগ অব্দি তোমাকেই ভালোবেসে যাব –ওয়াদা করলাম।

— আমার সামনে আর কখনোই মরনের কথা বলবেনা প্লিজ। মৃত্যুকে আমি ভয় পাই। আমি বাচতে চাই।

— আচ্ছা। বলব না৷

— তোমার এই ঋণ কি কোন দিন শোধ করতে পারব সমুদ্র?

— অবশ্য ই পারবে। বরং খুব ইজিলিই পারবে৷

আয়না কৌতুহল বশত বলে, কিভাবে?

সমুদ্র তাকে আবারো নিজের কাছাকাছি টেনে এনে বলে, দ্রুত শুধু মাত্র-কেবল মাত্র আমার জন্য দুই চোখ থেকে দুই ফোটা অশ্রু বিসজন দাও।

আয়না অদ্ভুত নয়নে সমুদ্রের দিকে তাকালো। সমুদ্র আয়ুর সামনে হাটু গেড়ে বসে বলতে লাগলো, জগতে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদের নাম কি জান?

আয়না মাথা ঝাকালো যার মানে সে জানে।

সমুদ্র হেসে বলে, কি?

–প্লাটিনাম। পযায় সারনির ৭৮ নাম্বার মৌল। পযায় ৬ এবং গ্রুপ ১০। এর সংকেত Pt.

সমুদ্র হাসিমুখে বলে, ভুল! জগতের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে অশ্রুমালা। আমরা অনেকের কারনেই হাসি৷ কিন্তু কাদি খুব কম সংখ্যক মানুষের জন্য । সেই খুব সংখ্যক মানুষ জগতের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ পেয়ে যায়। কিন্তু ওই যে, সবাই বলে প্লাটিনাম সবচেয়ে দামি। তাই অশ্রুর মূল্য না দিয়ে তোমার ভাষায় Pt এর পেছনে দৌড়িয়ে আসল মানিক হারিয়ে ফেলে অনেকে। আমি কিন্তু এমন নই! আমার সোনা-দানা চাই না। দিন শেষে চাই কেউ একজন আমার জন্য কাদুক। আমার জন্য বেলা ফুরাবার আগে ব্যাকুল হোক সে। এই সে এর জায়গায় তোমাকে বসাতে চাই। আমি তোমার কাছে বেশি কিছু চাইনা। শুধু দুফোটা অশ্রু চাই। আয়ু তুমি কি আমার জন্য কাদতে পারবে?

আয়না ও সমুদ্রের দিকে ঝুকে এসে তাকে ঝাপ্টে ধরে ভ্যা ভ্যা করে কেদে দেয়।

সমুদ্র টিটকারি মেরে বলে, তোমার চোখের ডগায় কি চোখের পানির পাইপ লাগানোই থাকে। কওয়াও শেষ পাইপের সুইচ অন করাও শেষ!

আয়না কাদতে কাদতে হেসে দেয়।

সমুদ্র তাকে জড়িয়ে রেখেই বলে, ঋণ তো একবারেই শোধ করে দিলে আয়ু! অশ্রুর যে ধারা বইছে তোমার চোখে এরপর ও কোন ঋণের দাবী রাখা নাজায়েজ।

সমুদ্র কিছুক্ষন পরেই চলে যায়।

★★★

পিউ হলুদ রঙের সালোয়ার কামিজ পড়েছে।এক কালারের কামিজ। হাতে কুচি দেওয়া সঙ্গে মোটা লেইজ। গলার কাজেও কুচি দেওয়া এবং লেইজ লাগানো। আর কোন কাজ নেই৷ কিন্তু ওড়নাটা লাল চুন্ডির কাপড়ের । ফুলের গহনা পড়ায় তাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। সে চুল ছেড়ে দিয়েছে। চুলে মাঝ বরাবর সিথি করে টিকলি পড়েছে। গলায় কাচা গাদা ফুলের মালা। এমনি পিউ দেখতে সুন্দর। আজকে আরোও সুন্দর লাগছে। যার যারা ডান্স করবে তাদের সবার সেইম ড্রেস কোড।

শ্রাবণ আর সমুদ্রসহ সব ছেলেরা ওসেন ব্লু রঙের পাঞ্জাবি। বাসার সবাই রেডি। মা সহ বাড়ির অন্য সদস্যরা হলুদ রঙের শাড়ি পড়েছে।

রোদেলা কানে দুল পড়তে পড়তে রুম ছেড়ে বের হলো।

তাকে দেখে সমুদ্র বলে উঠে,ওই যে আসছে। চল বের হই।

আবেগ আর সমুদ্র একসাথে দাঁড়িয়ে ছিল। রোদেলা তাদের দুইজন কে দেখে থমকে যায়। আজ অব্দি একবারো সমুদ্রের চেহারার সঙ্গে আবেগের চেহারার বিন্দুমাত্র মিল পায়নি সে। অথচ আজ এই শুভ দিনে, ছেলের গায়ে হলুদের দিনে ছেলের চেহারার সঙ্গে ছেলের আব্বুর চেহারার অদ্ভুত মিল পাচ্ছে রোদেলা। এটা কি তার চোখের ভুল!

সে অবাক নয়নে চেয়ে আছে সমুদ্রের দিকে
রোদেলা অনেক আগে থেকেই ভেবে রেখেছিল, সমুদ্রের হলুদের দিন সমুদ্র কে ওসেন ব্লু রঙের পাঞ্জাবি পড়াবে। আজকে তার সাধ পূর্ণ হলো।

সাধ-আহ্লাদ পুরণের মধ্যে ও এক অন্য মাত্রার আনন্দ হয়। এই সুপ্ত আনন্দটা কেবল মাত্র কোন সাধ-আহ্লাদ পুরণ হলেই অনুভব করা যায়।

সমুদ্র মুখ ফুটে বলে উঠে, ভাবা-ভাবি শেষ হলে চলেন বের হই৷

শ্রাবণ পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে বলে, কেন ভাই? আর সহ্য হচ্ছে না বুঝি?

শ্রাবণ কথা গুলো সবার সামনে বলেছে এজন্য সমুদ্র তার দিকে কড়া চোখে তাকালো।

শ্রাবণ দমে যায়। সে আর কথা বাড়ালোনা।

রোদেলা আবেগের পাশে গিয়ে বলে, এই ব্যাগে তোমার ঔষধ আছে। রাতের খাবারের পর নিয়ে নিবে।

— হ্যা। হ্যা। চল তো বের হই।

আবেগ তাগদা দেওয়ায় সবাই বের হলো।

মাইক্রো গাড়ি শ্রাবণের বাবা শৌখন শিকদারের অফিস থেকে আনা হয়েছে। সবাই মিলে একসাথে যাবে জন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া।

ইভানার স্বামী আজকে ডিরেক চট্টগ্রাম থেকে সমুদ্রের হলুদে আসবেন। ফ্লাইট পাচ্ছিলেন না। আর গাড়ি করে আসলে ক্লান্ত হয়ে যাবে এজন্য ফ্লাইটের অপেক্ষায় তার সামান্য দেরি হবে আসতে৷

ছাদে অনুষ্ঠানের আয়োজন তাই সবাই একেবারে ছাদেই উঠে পড়ে। বেশ সুন্দর করেই ছাদ সাজানো হয়েছে।

শ্রাবণ ছাদে উঠতেই দেখল, আলিয়া সাজগোছ করে কার সাথে যেন বেশ বিচলিত হয়ে কথা বলছে। সম্ভবত অপর পাশের ব্যক্তির কথা বুঝতে পারছে না সে। এজন্য বিচলিত।

শ্রাবণ ঢোক গিলল। আলিয়াকে দেখে সে টাস্কি খেয়ে গেল।পিউয়ের মতোই জামা পড়েছে। কিন্তু চুলে বেনি করা। লবেনির প্রতি ভাজে ভাজে ফুল দেয়া। শ্রাবণের পক্ষে আলিয়ার দিক থেকে চোখ সরানো দায়।

সে নিরব দশক হয়ে আলিয়ার কম-কান্ড দেখে যাচ্ছে বেহায়ার মতো। আলিয়ার সঙ্গে ইতিমধ্যে তিন বার চোখাচোখি হয়ে গেছে। তিন বারই শ্রাবণ চব্বিশ টা দাত বের করে হেসেছে।

শেষের বার সে আলিয়াকে ফ্লাইং কিস ও দিয়েছে। আলিয়া অবশ্যই নাগিনীর মতোই ফুসছিল।

প্রেমের সূচনা থেকে শ্রাবণ আলিয়াকে নাগিনী ডাকে। শ্রাবণের বাসায় এক পিচ্চি ঘুরতে এসেছিল এবং সে টিভিতে নাগিন দেখছিল। শ্রাবণ ও সেই পিচ্চির সঙ্গে নাগিন দেখছিল।

তখন সেই নাগিন সিরিয়ালের নাগিনের চেহারার সঙ্গে সে তার আলিয়ার বেশ মিল পায়।

এইজন্য ই আলিয়াকে সে নাগিনী বলে ডাকত।ব্রেকাপের পর নাগিনীর আগে একটা কাল লাগিয়ে দিয়েছে সে।

অনুষ্ঠান জম-জমাট ভাবে জমতে লাগে। পিউ বার বার গেটের দিকে তাকাচ্ছে। রঙ্গন বলেছিল আসবে। কিন্তু সে এলো না কেন? নাকি রওনা দিয়েছে? বাংলাদেশে অনেক জ্যাম হয়। সে জ্যামে আটকা যায়নি তো!

পিউ উদাস হচ্ছে। উদাস মনে শ্রাবণের কাছে গেল। শ্রাবণ বেশ আয়েস করে ফুচকা, চটপটি, নকশি পিঠা খাচ্ছে৷

পিউ বলে উঠে, নাচা-নাচির পর খাও।

— আরে! ততোক্ষনে এইসব বাচবে না। তুই ও খা পিউ। দিব এক প্লেট ফুচকা?

— না। না। এখন আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে না।

শ্রাবণ আরেক প্লেট ফুচকা নিয়ে খেতে খেতে বলে, দ্যাখ!দ্যাখ! ভাইয়া কেমনে ভাবির দিকে তাকায় আছে। ভাই তো দেখি পুরাই ভাবির আচলের মায়ায় আটকা পড়ছে।

— পড়লে পড়বে। সমস্যা কোথায়?

শ্রাবণ হালকা হেসে বলে, মায়া বড় কঠিন জিনিস রে পিউমনি। একবার কারো মায়ায় আটকা পড়া মানে চোরাবালিতে আটকে যাওয়ার মতো। যতোই বের হয়ে আসার চেষ্টা করবি ততোই গভীরে টানতে থাকবে।

তখনই আলিয়ার মুখ দশন হয়ে যায় তার। সে মচমচ করে ফুচকা চাবাতে লাগে।।

সমুদ্র আসলেই আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। না তাকিয়েও উপায় নেই। এতো রূপবতী লাগছে মেয়েটাকে যে সমুদ্র মুগ্ধ! মুগ্ধ তার চয়েজের প্রতি!

সবার আগে নানা-নানি হলুদ লাগালো। নানা দুইজনকে এক হাজার করে টাকা দিল। সমুদ্র নিতে চাচ্ছিল না। কিন্তু পরে আর মানা করেনি।

আপনজন ভালোবেসে কিছু দিলে সেটা মানা করা উচিত না। নানাভাই আগেও তাকে আর আয়নাকে ঈদে সালামী দিত৷ কিন্তু তখন মাত্র পঞ্চাশ টাকা দিত। সেই পঞ্চাশ টাকা পেয়েই তারা কত্তো খুশি হত! খুশিতে লাফাত আয়ু! বহু আগের কথা।

সুখে থাকলে কি সুখময় স্মৃতি মনে পড়ে? কি জানি?

আবেগ-রোদেলা চেয়ারে বসে আছে। দুইজন ই স্টেজের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ জুড়িয়ে ছেলের হাসিমাখা মুখ দেখছে। দুইজনকেই খুব হাসি হাসি লাগছে। চেহারায় আনন্দ ভাব ফুটে উঠছে তাদের।

রোদেলার চোখে পানি চিকচিক করছে। আবেগ তা দেখে ভারী অবাক হয়ে গেল এবং বলল, এতো দিন জানতাম বিয়েতে মেয়ের মা কাদে? তুমি তো ছেলের মা! তাহলে তুমি কেন কাদছো?

রোদেলা আবেগের হাতে হাত রেখে বলে, জানি না! সমুদ্রের আব্বু! আমার আজকে কাদতেও খুব ভালো লাগছে।

আবেগ অবাক হয়ে যায় এবং বলল, কাদতেও ভালো লাগে?

— হ্যা।

— না। না। ভালো লাগলেও কান্না করা যাবে না।

রোদেলা আবেগের দিকে তাকিয়ে বলে, কেন?

আবেগ কিছুটা অবাক হলো। আজকে রোদেলাকে ঠিক আগের দিনের তরুণী বয়সী রোদেলা লাগছে।

সে আস্তে আস্তে বলে, তুমি কাদলে আমার ভালো লাগে না।

রোদেলা বলল, আমি তো আজীবন তোমাকে কষ্ট ই দিয়ে এলাম তবুও কেন ভালোবাস এতো?

— বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। আজকে এই ডাক্তার একটা প্রবাদ সৃষ্টি করলো তাহলো,

আপনহীনতার চেয়ে ত্রুটিযুক্ত আপন কেউ অধিকতর উত্তম।

চলবে৷