#প্রেমের_সাতকাহন
#পর্ব_২৪
#সুমাইয়া_জাহান
আজকে বাড়িতে কয়েকজন নতুন অতিথি এসেছে।ভাইয়ুর জন্য যে মেয়ে পছন্দ করেছে তাদেরই কয়েকজন বাড়ির লোক বিয়ে নিয়ে কিছু কথা বলতে এসেছে।আমি সেই সকাল থেকেই কোমর বেঁধে কাজে লেগে পরেছি।একমাত্র ননদিনী বলে কথা!এমনিতে ননদ সম্পর্ক টা নিয়ে অনেক অনেক নেগেটিভ কথা শুনেছি।ননদরা নাকি ভাইয়ের বউদের সহ্য করতে পারে না। তারা সব সময় ভাইয়ের বউয়ের পিছনেই লেগে থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই আমি ঠিক করেছি ধারণা টাকে পাল্টে দিবো!কেন হে আমরা ভোলাভালা ননদরা পঁচা নামক উপাধি টা নিবো?আমরাও যথেষ্ট ভালো মানুষ হতে পারি হুম! আমার মধ্য দিয়েই লক্ষীমন্ত ননদিনী গড়ে তুলে এই সমাজকে দেখিয়ে দিবো।তবে ভাবির পেছনে লাগার পয়েন্টা বাদ দিবো না।পিছনে না লাগলে যে আমার আবার পেটের ভাত হজম হয় না!পিছনে অবশ্যই লাগবো তবে সেটা শুধু মজার ছলেই কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে না।যাইহোক এখন আমি ভাবির বাড়ির লোকেদের জন্য কাজ করতে করতে ভিষণ ক্লান্ত হয়ে গেছি।তবে আমি যেই কাজ গুলো করছি সেগুলোকে আদোও কোনো কাজের পর্যায় পরে কিনা ঠিক বলতে পারবো না।সকাল থেকে যেই যেই কাজ গুলো করে এতো ক্লান্ত হলাম তার লিস্ট টা দিচ্ছি!
তাঁরা আসবে শুনে আমি ভোর ছয়টায় দরজার সামেনে বসে ছিলাম তাদের ওয়েলকাম করার জন্য! আপনারা আমার ঘুম সম্পর্কে আগেই ধারণা পেয়েছেন।ঘুম আমার কতো প্রিয়!সেই প্রিয় ঘুমটাকে এই এত্তো ভোর বেলাতে ব্রেকআপ করলাম।কিন্তু আমি ঘুমের সাথে ব্রেকআপ টা করলেও ঘুম কিন্তু আমার সাথে করেনি সে ঠিক আবার আমার কাছে চলে এসেছে।বড্ড ভালোবাসার সম্পর্ক যে আমাদের!তাই তাদের জন্য দরজা সামনে অপেক্ষা করতে করতে দরজার হাতল ধরেই ঘুমিয়ে পরলাম।হঠাৎ করে একটা বিকট আওয়াজে আমি লাফিয়ে উঠলাম।আসলে দরজায় কান দিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম।এখন ওপাশ থেকে দরজা নক করাতে আমার আওয়াজ টা বিকট আকারে আমার কানে এসে বাজলো।ব্যাপার টা বুঝতে পেরে আস্তে করে একটা শ্বাস নিলাম।হঠাৎ করে আওয়াজ টা হওয়াতে ভিষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!হবু ভাবির বাড়ির লোকেরাই বোধহয় এসেছে।তাই তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলাম।হাত ঘড়িটাতে তাকিয়ে দেখি এখন আটটা বাজে!দূত এতো কষ্ট করে আমার এতো স্বাদের ঘুম টাকে ভাঙ্গিয়ে সেই ভোর বেলাতেই এখানে বসে থাকা সবই বৃথা ছিলো?এঁরা আমাকে আগে জানিয়ে দিলেই তো হতো!যাইহোক এখন যা গেছে তা তো গেছেই এগুলো নিয়ে আফসোস করলে তো আর ফিরে পাবো না!এই বলেই নিজের মনকে শান্তনা দিয়ে ওদের সালাম দিয়ে ভিতরে ঢুকালাম।তারপরের কাজ টা হলো ওদের সামনে কয়টা খাবার ট্রে আনলো তার হিসেব রাখা।সার্ভেন্ট রা একে একে খাবার ট্রে নিয়ে তাদের সামনে দিচ্ছে আর আমি ট্রে গুলোর সংখ্যা গুনছি।মোট চৌদ্দ টা ট্রে। ইসস আর একটা ট্রে বেশি হলেই তো পনেরো টা হয়ে যেতো!সার্ভেন্টদের মধ্যে আবদুল ভাই আছে।তবে ভাইয়ুর থেকে অনেক দূরে দূরে থাকছে আর হাতে একটা ট্রে সর্বদা থাকছে তার!সেইদিন তো ভাইয়ু সামান্য মেয়ে পছন্দের কথা শুনেই ওমন ভাবে পানি ছিটিয়েছে।আর আজ তো আবার মেয়ের বাড়ির লোকরাই সামনে তাই যতোটা ভাইয়ুর থেকে দূরে থাকা সম্ভব ততোটা দূরত্ব বজায় রেখেই চলছে।আমি ওর কান্ড দেখে হাসতে হাসতে শেষ! তবে এখন হাসার টাইম নেই নেক্সট কাজে লেগে পরতে হবে!তাই আর সময় নষ্ট না করে নেক্সট কাজে লেগে পরলাম।মানে কে কে খাচ্ছে আর কে কে খাচ্ছে না সেই খবরদারিতে! একটা রোগা পাতলা লোককে দেখলাম সামনের একটা মিষ্টির ট্রের দিকে একবার তাকাচ্ছে তো আবার আশেপাশের লোকেদের দিকে তাকাচ্ছে।আসলে এখনো কেউ কোনো কিছু খাওয়া শুরু করেনি।সবাই এখন গল্প গুজবের ব্যস্ত মনে লোকটার খিদে পেয়েছে! সবাই এখনো কিছু নেই নি বলে লজ্জায় সেও এখনো কিছু নিতে পারছে না।আহারে!বেচারার কষ্ট টা চোখে সহ্য করার মতো না!লোকটাকে সাহায্য করতে হবে!কিচেন থেকে আরেক থালা মিষ্টি নিয়ে এসে সবার থেকে একটু দূরে একটা টেবিলে থালাটা রেখে।সেই লোকটার কাছে গিয়ে লোকটার কানে ফিসফিস করে বললাম
—- রোগাপাতলা কাকু ওইদিকে চলেন আপনার সামনের মিষ্টির থালার মতোই মিষ্টি এনেছি আমি!ওখানে বসে যতো ইচ্ছে খেতে পারেন।কেউ দেখবে না।
আমার এমন আকস্মিক কান্ডে সবাই সবার কথা বন্ধ করে আমার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। যেন বোঝার চেষ্টা করছে এখানে ঘটছে টাকি?আর সেই কাকুটাকে কথা গুলো বলেছিলাম তার তো রীতিমতো কাশি উঠে গেছে।সবার এমন চাহনি দেখে আমি জোরপূর্বক হাসি দিলাম।
—- মামনি কি করছিলে তুমি?
বাবা প্রচন্ড অবাক চোখে বললেন আমায়।এখন নিজের মাথায়ই নিজে চড় মারতে ইচ্ছে করছে।এই জন্যই কবি বলে ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না। একটু ভেবে চিন্তে তো কাজ টা করাতে পারতাম তা না!হুট করেই সবার মাঝখানে করে ফেললাম।এখন কি জবাব দিবো?
—- বাবা আসলে এই কাকুটাকে আমি মনে হয় আগে কোথাও একটা দেখেছিলাম। কিন্তু কিছুতেই মনে পরছে না।তাই কাকুকে জিজ্ঞেস করছিলাম!
কোনো রকমে একটা বলে দিলাম।আল্লাহ পাপ নিও না এখন মিথ্যে ছাড়া যে আমার উপায় নেই।আমার উত্তর শুনে বাবা হেসে ব্যাপার টা উড়িয়ে দিলো।কিন্তু ভাইয়ু ঠিকই বুঝতে পারছে আমি কোনো একটা গন্ডগোল করছি তাই তো আমার দিকে অসহায় ফেস করে তাকিয়ে আছে।আমি ইশারায় ভাইয়ুর কাছে ক্ষমা চাইতেই ভাইয়ু ইশারায় যা বুঝালো তার মানে এই যে “বোইন মাপ চাই আমার বিয়াডা ভাঙ্গিস না”। ভাইয়ুর কথাটা মনে মনে নিজে একবার উচ্চারণ করে ফোঁস করে একটা শ্বাস নিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালাম।থাকবো না এখানে সেই সকাল থেকে এতো পরিশ্রম টা করলাম।আর শেষে কিনা ভাইয়ুর থেকে এই কথা শুনতে হলো!দাঁড়াও রিমিকে দিয়া যদি আমি তোমারে আচ্ছা মতো শিক্ষা না দিতে পারছি তাাহলে আমি আর তূবাই না!নিজের নাম টাই চেঞ্জ করে ফেলবো হুম!
এই ছিলো আমার কাজের নমুনা না।তবে ভাইয়ুর আজকের ব্যবহারের জন্য অনেক বড়ো মূূল্য দিতে হবে।আচমকাই মাথায় একটা দুষ্ট বুদ্ধি চলে আসলো।
—– তৈরি থেকো মাই ডিয়ার ভাইয়ু!কাম ব্যাক টু ইউর অ্যাংরি বার্ডস!
কথাটা বলতেই মুখে পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠলো।
💗💗
সামনে অনেক গুলো পেপারস নিয়ে বসে আছে উকিল মতো একটা লোক।রঞ্জন এবার তার ইজি চেয়ার থেকে উঠে উকিলের থেকে পেপারস গুলো নিয়ে দেখতে দেখতে বললো,
—- উকিল সাহেব সব কিছু ঠিক ভাবে করেছেন তো!আবার কোনো কিছু কম পরবে না তো!
—- কি যে বলেন স্যার!আজ পর্যন্ত কোনো কিছুকি ভুল হয়েছে?আচ্ছা এর আগের বারও তো পেপারস রেডি করে রেখেছেন। কিন্তু শেষ মেশ তো বিয়েটাও হলো না আর পেপারস গুলোও কাজে লাগলো না!যদি এবারও এমন কিছু হয়?
—- আরে উকিল মিয়া আগের মতো কিছুই হবে না।সব কিছু আমার প্লান মাফিক চলতেছে।এবার পুরো তৈরি হয়ে নেমেছি আমি! এই প্লানে কোনো ফাঁক ফোকর নাই!বিয়ের পরই সব কিছু পাল্টে যাবে।যেমন ভাবে সেইদিন পাল্টে ছিলাম আমার প্রানপ্রিয় নীলাশা ভাবির সামনে আর অতি শ্রদ্ধেয় কাকা কাকিমার সামনে!ঠিক সেই ভাবেই আবারও রক্ত গঙ্গা বইবে কাল সিকদার বাড়িতে!শুধু বিয়েটা একবার হয়ে যাক!আমি একটা জিনিস ততোক্ষণই নিজের কাছে রাখি যতোক্ষণ জিনিস টা আমার প্রয়োজন থাকে।প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ধুলোর মতো উড়িয়ে দেই।
কথাগুলো বলেই একটা বিশ্রী হাসি দিলো রঞ্জন।উকিল লোকটা রঞ্জন কথা গুলো শুনে খুব ভয় পেয়ে পেয়ে গেলো।তাঁকেও প্রয়োজন পর্যন্তই রাখবে তারপর বাকি সবার মতো উড়িয়ে দিবে?কপালে বিন্দু বিন্দু গাম জরতে লাগলো।কি ভয়ানক একটা লোকের সাথে এতোদিন কাজ করতো।এতোদিন জানতো তার স্যারের শুধু সম্পত্তির উপর লোভ আছে। তাই অন্যের সম্পত্তি দখল করতে চাইছে।কিন্তু আজ জানতে পারলো সেটা একটা খুনীও! ভয়ে গা কাটা দিয়ে উঠছে উকিল লোকটার।কোনো একটা অযুহাত দেখিয়ে মানে মানে কেটে পরলেন লোকটা।রঞ্জনের রুম থেকে বেড়িয়েই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো লোকটা!
এদিকে নীর আর তূর্য মিলেও তাদের গুটি সাজাচ্ছে। এরমধ্যেই রঞ্জনের বেশ কয়েকটা কালো ব্যবসা ধ্বংস করেছে।কালকের দিনটা সবার জন্য অন্য রকমের চমক থাকবে।উল্টে যাবে পাসা তবে কার পাসা উল্টাবে? নীর নাকি রঞ্জনের?কিছু তো হবে কাল!যা সবার ভাগ্য বদলে যাবে!দুর্ভাগ্যে না সৌভাগ্যে?
💗💗
দরজায় বেল বাজাবো নাকি বাজাবো না তা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বে দাঁড়িয়ে আছি রিমির বাড়ির দরজার সামনে।কিন্তু সাহস করে বেল বাজাতে পারছি না।যদি দরজা খুলেই রিমির সামনে পরি?কিন্তু না আমাকে তো প্রতিশোধ টা নিতেই হবে!তাই মনে মনে আল্লাহ কে ডাকতে ডাকতেই বেল টা বাজিয়ে দিলাম।একটু বাজতেই রিমির মা এসে দরজা খুললো।আর আমাকে দেখে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললেন,
—- আরে তূবা যে!ভেতরে এসো কতোদিন পর এলে!
নিশ্চয়ই রিমির সাথে দেখা করবে?রিমি উপরে নিজের ঘরেই আছে।যাও তুমি ওর রুমে গিয়ে ওর সাথে গল্প করো আমি তোমাদের জন্য কিছু একটা বানিয়ে আনছি।
কথাটা বলে৷ আর এক মিনিও অপেক্ষা না করে কিচেনের দিকে চলে গেলেন।আমি কি বলতে নিয়েও কিছু বলতে পারলাম না।তাঁর যাওয়ার দিকে তাঁকিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উপরে রিমির ঘরের দিকে রউনা হলাম।আসলে উনি এমনই খুব ভালো সম্পর্ক আমাদের! নিজের মেয়ের মতোই জানেন আমায়।উনার কথা ভাবতে ভাবতেই রিমির ঘরে চলে আসলাম।যেহেতু এ বাড়িতে আমি আগেও অনেকবার এসেছি তাই রিমির ঘর খুঁজে পেতে তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি।
ঘরে ডুকে দেখি জানালার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিমি।কেনো সাড়াশব্দ নেই একদম নিস্তব্ধ! অথচ এই মেয়েটাই এক সময় সাবাই মাতিয়ে রাখতো!সময়ের ব্যবধানে মানুষ কে কতোটাই না বধলে দেয়!আমিও ওর পাশে গিয়ে জানালার সামনে দাঁড়ালাম।ব্যাগ থেকে কার্ড দুইটা বের করে রিমির সামনে ধরলাম।এতে রিমি প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।ওর হাতে কার্ড দুটো ধরিয়ে দিয়ে বললাম,
—- এখানে দুইটা বিয়ের কার্ড।একটা কাল আমার আর আরেক টা সামনের মাশের দশ তারিখ ভাইয়ুর!শুনলাম তোরও নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে!আমাকে তো এখনো দাওয়াতই দিলি না।চুপি চুপি বিয়ে করবি ভেবেছিস?
একটু আগেই আমাদের ভাই বোন দুজনের বিয়ের কার্ডিই ছাপিয়ে এনেছিলো।যদিও দুজনের বিয়ের ডেট আলাদা তাও একসাথেই করলো।কার্ড গুলো হাতে পেতে না পেতেই দুইটা কার্ড নিয়ে এসেছি।কিন্তু রিমি আমার কথায় একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
—- কাটা গায়ে নুনের ছিটে দিচ্ছিস?
—– এই কি বলছিস এগুলো?আমার একমাত্র ভাইয়ের বিয়ে আর তোকে দাওয়াত দিবো না তা কখনো হয়!তাই তো দাওয়াত দিতে চলে আসলাম।
—- হুম সেই!!!
আবারও তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে কথাাটা বললো।
চলবনে,,,,,