#প্রেমের_সাতকাহন
#পর্ব_২৯+৩০
#সুমাইয়া_জাহান
পা টার দিকে যতোবার তাকাচ্ছি ততোবারই মুখ টা আমার কাঁদো কাঁদো হয়ে যাচ্ছে। সকালে ডক্টরের কাছে নেওয়ার পর ডক্টর বলেছে বেশি কিছু হয়নি শুধু একটুু মুচকে গেছে।ডক্টর কয়েকটা ঔষধ লিখে দিয়েছে আর বলেছে কয়েকদিন বেড রেস্ট নিতে কিন্তু ওই বজ্জাতের তা সইলো না!বাড়ি এসে ইয়া মোটা করে ব্যান্ডেজ করে আমার এই চিকনা চাকনা পা টাকে আলুর বস্তা বানাইয়া দিসে।আমি এখন না পারছি হাঁটতে না পারছি এভাবে শুয়ে বসে থাকতে!সেই সকাল থেকেই এভাবে বিছানায় বসে আছি।আমি শুধু একটা সুযোগ পাই তাহলে দেখবি কি রিভেঞ্জ নেই! হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিবো এই তূবা কি জিনিস হুম! মুখে দুই হাত দিয়ে বেডে বসে বসে এসবই ভাবছি একটু পরই নীর আসলো একটা ওয়াটার বোতল হাতে নিয়ে!একটু আগে আমি পানি খাওয়ার নাম দিয়ে একটু হাঁটতে চেয়েছিলাম কিন্তু ওই বজ্জাৎ আমার এই আশাটায়ও পানি ঢেলে দিয়ে নিজেই পানি আনতে গিয়েছে।ওর দিকে না তাকিয়ে অন্য দিকে মুখ করে রাখলাম।ওইদিকে একটা ইয়া বড়ো দেয়াল ঘড়ি টানানো আসে যেখানে এখন স্পষ্ট দেখাচ্ছে এগারো বাজতে এখনো পাঁচ মিনিট বাকি আছে।আমি ওই দিকেই তাকিয়ে আছি নীর আমার পাশে এসে বসে আমার হাতে ওয়াটার বোতল টা ধরিয়ে দিয়ে কড়া গলায় বললো,
—- তাড়াতাড়ি পানি খাওয়া শেষ কর!আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে আমি ঘুমাবো।
নীর হাই তুলতে তুলতে কথা গুলো বললো।আমাদের শরিয়ত মতে বিয়ে হওয়ার পর থেকে আমরা এখন একসাথেই থাকি আগের মতো আলাদা ঘরে থাকি না।আর পাঁচ টা সম্পর্কের মতো আমাদের সম্পর্ক টাও এখন স্বাভাবিক!তবে আমাদের সেই লড়াই ঝগড়া খুনসুটি আগের মতোই আছে বলতে গেলে আগের থেকেও এখন আরো বেশি।তার নমুনা তো ইতিমধ্যে পেয়েই গেছেন।সে যাইহোক এখন আমার মাথায় আগুন জ্বলেছে! আমাকে আজ সারাটাদিন শান্তি নামক বস্তুটার ধারে কাছেও যেতে না দিয়ে এখন নিজে আরামে নাক ডেকে ঘুমানোর জন্য তাড়া দিচ্ছে! কতো বড়ো খারাপ ভাবা যায়!দাঁড়াও তোমার আরামের ঘুম যদি হারাম না করতে পারি তাহলে যে আমি শান্তি হাবা না!ওয়াটার বোতল টা ট্রি টেবিলে রেখে আমার পাশের বালিশ টা নিয়ে নীরের হাতে ধরিয়ে দিলাম।ও আমার করা কাজ গুলো কিছুই বুঝতে না পেরে শুধু ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে আমি কি করতে চাইছি।মনে মনে একটা শয়তানি হাসি দিয়ে মুখটাকে ইনোসেন্ট বানিয়ে বললাম,
—- আমায় পায়ে খুব ব্যাথা করছে?
—- কি বলছিস কি কখন থেকে ব্যাথা করছে? আমায় এতোক্ষণ বলিসনি কেন?ঔষধ খেয়েসিস?এই ঔষধ গুলোতে কাজ হচ্ছে না?আগে বলবি তো!দাঁড়া এখুনি ডক্টর আংকেল কে ফোন করছি!
আমার সামান্য একটা কথায় পুরো পাগলের মতো হয়ে গেছে নীর।সত্যি সত্যি ডক্টর আংকেল কে ফোন করতে নিচ্ছিলো। আমি তাড়াতাড়ি ওর হাত থেকে ফোন টা নিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।আমি সত্যি বুঝতে পারিনি আমার ছোট্ট একটা কথায় নীর এমন রিয়েক্ট করবে।আমি শুধু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি।কতোটা ভালোবাসলে একটা মানুষ এমন করে আমার জানা নেই! সত্যি আমি খুব ভাগ্যবতি এমন একজন কে জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়ে।
—- তূবা কি করছিস তুই? ফোন টা দে ডক্টর আংকেল কে ফোন করতে হবে!নাহলে অনেক দেড়ি হয়ে যাবে!
আমারা ভাবনার মাঝেই নীর ব্যাস্ত হয়ে বলে উঠলো।আমি ফোন টা অন্য সাইডে রেখে ওর দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শান্ত গলায় বললাম,
—- আমার কিচ্ছু টি হয়নি আমি মজা করছিলাম এইটুকুই বুঝিস না?
আমার কথাটা শুনে এতোক্ষণ স্বস্তির নিশ্বাস নিলো নীর।এতোক্ষণ যেন ওর দমটা কেউ আটকে রেখেছিলো। নীরও আমার দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
—- কিন্তু আজ যদি সত্যি সত্যি কিছু হতো তখন আমি মজা ভেবে নিতাম তখন কি হতো ভেবে দেখেছিস সব ব্যাপারে মজা করলেও এই ব্যাপার টায় কখনো মজা করবি না প্লীজ!
আমিও নীরের হাতে হাত রেখে বললাম,
—- কথা দিলাম ইনশাআল্লাহ আর কখনো এমন টা করবো না।
হঠাৎ কিছু একটা মনে পরতেই কপালে ভাজ ফেলে নীরকে জিজ্ঞেস করে উঠলাম,
—- আচ্ছা নীর আমার রুমে তো ক্যামেরা লাগানো ছিলো কিন্তু তুই যে প্রথম দিন আমার রুমে এসেছিলি বেলকনি দিয়ে তারপর ভাইয়ুও এসেছিলো আমার রুমে ওইদিন আমাদের সবাইকে তোরঞ্জন কাকু দেখার কথা!তাহলে কেন দেখেনি সেইদিন?
—- কারণ তখন ক্যামেরাটা লাগানো ছিলো না।ক্যামেরাটা লাগানো হয়েছে সেইদিন যেদিন তুই আর রাতুল শপিং এ গিয়েছিলি।তাই সেই প্রথম দিনের কিছুই দেখেনি।
—- যদি সেদিনই ক্যামেরাটা লাগানো থাকতো তাহলে কি হতো?
আমি ভাবুক দৃষ্টিতে মুখে আংগুল দিয়ে বললাম।পাশ থেকে নীর ইনোসেন্ট মুখ করে বললো,
—- কি আর হতো এতোদিন আর বউ ছাড়া থাকতে হতো না আমায়!ভাবছি কেন যে আমায় সেদিন কাকাবাবু দেখলো না!
ওর কথা শেষ হতে না হতেই আমি শুরু করে দিলাম আমার কিল গুশির হামলা! কি বজ্জাৎ ছেলেরে বাবা!
এভাবেই নানারকম খুনসুটির মধ্য দিয়ে কিছুদিন কেটে গেলো আমাদের। এরমধ্যেই ভাইয়ু আর রিমির বিয়ের দিন টাও এসে গেলো।
রিমি আজ ভিষণ খুশি তার ভালোবাসার মানুষ টা আজ সারাজীবনের জন্য তার হয়ে যাবে। আর কোনো বাঁধা হয়ে তাদের মাঝে কেউ ডুকতে পারবে না।বিয়ের বেনারসি টাতে হাত বোলাতে বোলাতে সেদিনের কথা গুলো আবার মনে করতে লাগলো।এই কয়দিনে যখনই তূর্যের কথা মনে পরে তখনই সেইদিনের কথা গুলো মনে করে রিমি।এতে যেন তূর্যের প্রতি আরো বেশি করে ভালোবাসা অনুভূতি টা কাজ করে!সত্যি রিমি খুব লাকী এমন একজন সত্যি কারে ভালোবাসার মানুষকে জীবনে পেয়ে!এ যুগের কয়টা ভালোবাসা এমন পূর্নতা পায়?হাতে গনা কয়েকটা হয়তো রিমিও সেই অল্প সংখ্যক মানুষদের কাতারে পরে ভাবতেই এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো রিমির মুখে।
সেইদিন আরমান সিকদার যখন তূর্যের জন্য মেয়ে দেখেছেন বলেছে তার পর দিনই তূর্য ঠিক করলো বাবা রিমির কথাটা জানাবে! যেমন ভাবা তেমন কাজ পরদিনই তূর্য রিমির কথা বাবাকে জানায়।ছেলের যেহেতু পছন্দ তাই আরমান সিকদারও আর দ্বিমত করেন নি রিমির সাথে বিয়ের জন্য রাজী হয়ে যান।আরমান সিকদার বাবা হিসেবে কখনোই ছেলে মেয়েদের উপর কিছু জোর করে চাপিয়ে দেননি!নেহাৎ তখন নীরের সম্পর্কে খারাপ ধারণা ছিলো তূবার জীবন থেকে নীরকে তখন সরাতে চেয়েছিলো এছাড়া আর কিছু না।বাবার অনুমতি পাওয়ার সাথে সাথেই তূবার কাছে গিয়ে এই আনন্দের খবর টা বলে তূর্য! কিন্তু তূর্য ঠিক করে এই খবর টা রিমিকে একটা সারপ্রাইজ দিয়ে জানাতে তাই তূবাসহ প্লান করে রিমিকে বলবে অন্য একটা মেয়ের সাথে! কয়েকদিন রিমিকে একটু টেনশনে রাখবে তারপর বিয়ের দিন বর বেশে রিমির সামনে গিয়ে দাঁড়াবে তূর্য! প্লান মাফিকই সব কিছু করলো।এরমধ্যেই আবার রিমিকে একটা পাত্র পক্ষ অনেক দিন আগে থেকেই পছন্দ করে রেখেছিলো এতোদিন রিমির বাবার পিছু পিছু ঘুরছিলো তাঁরা! যেই না রিমি তূর্যের কথা গুলো শুনে রাগে অভিমানে ওই বিয়েতে রাজী হয় সেই সাথে সাথেই ওই পাত্র পক্ষ রিমির বাড়ি হাজির হয়ে যায়!আর ওইদিনই রিমিকে আংটিও পরিয়ে আসে! তূর্য এগুলো জানতে পেরে সাথে সাথেই রিমির বাবা মার সাথে কথা বলে আর সব কিছু জানায়!রিমির বাবা নিজেই ওই পাত্রের সাথে রিমির বিয়েটা ভেঙ্গে দেয়!আর এগুলো সবই রিমির আড়ালে হয়।রিমি কিছুই জানতো না এসবের!যাইহোক তারপর দিন সকালেই রিমির বাবাসহ আরো কিছু আত্মীয়রা মিলে সিকদার বাড়ি আসে রিমি আর তূর্যের বিয়ের পাকা কথা বলতে!সবাই সব কিছু জানা সত্বেও তূর্যের জন্য সবাই রিমির সামনে স্বাভাবিক ব্যবহার করে। সবই ঠিক ঠাক চলছিলো কিন্তু এরমধ্যে তূবা তূর্যের কাছে রিভেঞ্জ নেওয়ার জন্য রিমির কাছে বিয়ের কার্ড টা দিয়ে মাঝখান দিয়ে সব গন্ডগোল পাকিয়ে দিলো।সেইদিন রিমির বাড়ি তূবা গিয়ে ছিলো রিমির মা তূবাকে রিমির হবু শ্বশুর বাড়ির একজন জেনেও তূর্যের জন্য তূবার সাথে সেইদিন রিমির একজন বান্ধবীর মতোই আচরণ করেছে শুধু! তূবা যদি সেইদিন কার্ড টা না দিতো তাহলে রিমি কোনোভাবেই জানতে পারতো না রিমির সাথে তূর্যেরই বিয়ে হচ্ছে। তূর্যের আর হঠাৎ করে সারপ্রাইজ টাও হলো না।তবে একদিন দিয়ে ভালোই হয়েছে রিমিও আর এইকয়টা দিন কেঁদে ভাসয় নি বরং অতি আনন্দের সাথেই বিয়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছে।মনে মনে তূবাকে অনেক গুলা ধন্যবাদও দিয়েছে সেইদিন কার্ড টা দেওয়ার জন্য! তবে এগুলো সবই তূর্যের মুখ থেকে শোনা রিমির! সেইদিন তূর্যই রিমিকে সব বলে দিয়েছে।
💗💗
বিয়ের কাজ শুরু হয়ে গেছে এমন কি কনে কেও আনা হয়ে গেছে!ভাইয়ু একটা মেরুন রঙের শেরওয়ানী আর রিমি ভাবিও মেরুর রঙের একটা বেনারসি পরেছে একদম নিউ কাপল লাগছে।রিমি ভাবি তো লজ্জায় রাঙা মাখা মুখ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে তো তাকিয়েই আছে লজ্জায় মুখ তুলতেই পারছে না।যেন রাজ্যের সব লজ্জা এসে ভীরেছে রিমি ভাবীর মাঝে আজ!আর ভাইয়ু তো বারবার আড়চোখে ভাবির দিকে তাকাচ্ছে! এতে করে ভাবির লজ্জা টা যেন আরো দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে!আমি তো আজ ভিষণ খুশি কতোদিনের স্বপ্ন ভাইয়ুর বিয়ে দেখবো আজ তা পূর্ন হচ্ছে ভাবা যায়।আমরা সবাই অনেক হৈ-হুল্লোড়ের মধ্য দিয়ে বিয়ে টা এনজয় করতেছি।নীর একবার বাবার কাছে যায় তো আবার এই দিকে ওই দিকে নানা দিকে যাচ্ছে মূলত যেতে বাধ্য হচ্ছে!সঙ্গে রাতুল ভাইয়াও আছে! কোমর বেঁধে দুইজনই ভাইয়ুর বিয়েতে লেগে পরেছে।
নীর হাঁপাতে হাঁপাতে এসে আমার পাশে বসে আমার কাঁধে ওর ক্লান্ত মাথাটা রাখলো।ওর এমন অবস্থা দেখে আমার কপালের ভাজ গুলো আরো দৃঢ় হলো।
—- তোকে এতো ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন?
—- এতো কাজ একা করলে তো এমন লাগবেই?
নীরের এই সোজাসাপটা জবাবে আমার কপালের ভাজ টা আরো একটু বৃদ্ধি হলো।তাই আবার জিজ্ঞেস করলাম,
—- একা কেন রাতুল ভাইয়া তো ছিলোই?
আমার এই কথাটায় নীর ফট করে আমার কাঁধ থেকে মাথাটা তুলে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
—- তুই জানিস সে কি কি কাজ করতে ব্যস্ত?
আমি ওর প্রশ্নে কিছু না বলে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। নীর মুখ একটা বিরক্তি সূচক শব্দ বের করে বলতে লাগলো,
—- সে আমাকে কাজে লাগিয়ে দিয়ে মেয়ে পটানোর মতো একটা অতি মহান কাজে ব্যস্ত!এটা নাকি এই বিয়ে বাড়ির সব কাজের থেকেও বড়ো কাজ!তুই ভাব আমি সেই কখন থেকে একটানা খেটে যাচ্ছি আর উনি মেয়ে পটাতে ব্যস্ত!কি জঘন্য ব্যাপার!
আমি নীরের কথা শুনে হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা করে ফেললাম।আমার এমন হাসি দেখে নীর ভ্রুকুটি করে ফেললো।আমি হাসতে হাসতেই জিজ্ঞেস করললাম,
—- তো কোনো মেয়েকে পটাতো পারলো?
নীর যেন আমার মুখ থেকে এই কথাটা কিছুতেই আশা করেনি তাই মুখে দুই দিয়ে সামনের দিকে ঝুকে বসে বিরক্তি নিয়ে বললো,
—- তুই আমার বউ তো?
—- কেন সন্দেহ আছে নাকি তোর?
আমি এখনো হাসতে হাসতেই বললাম।নীর এখনো একই ভাবে বসে থেকে বললো,
—- হান্ড্রেড পারসেন সন্দেহ আছে!নাহলে তুই আমার হয়ে কথা না বলে ওই ছেলের হয়ে কথা বলছিস কেন?
—– সেটা নিয়ে পরে গবেষণা করিস আগে বল রাতুল ভাইয়া একটাও মেয়ে পটাতে পারলো? প্লীজ বল না!
আমার এতো আগ্রহ দেখে নীর আরেকটু বিরক্ত নিয়ে বললো,
—- না! একটাও পারে নি!
—- ওহ্! ইস আমাদের ওনাকে একটা মেয়ে পাটাতে সাহায্য করা উচিৎ!!
—- কেন?আমাদের কেন সাহায্য করা উচিৎ! আর তোর এতো আগ্রহ কিসের ওর উপর বল তো?
ব্যস লেগে গেলো আমাদের টম এন্ড জেরি ঝগড়া। ঝগড়া করে দুইজনেই দুইদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকবো তার কিছুক্ষণ পর আবার এক হয়ে যাবো।আমরা একজন অন্য জনের সাথে কথা না বলে দুই মিনিটও থাকতে পারি না আবার ঝগড়া না করেও থাকতে পারি না।এক অদ্ভুত সম্পর্ক আমাদের!
একটু আগেই বিদায়ের পর্ব শেষ হয়ে আমরা সবাই গাড়িতে উঠেছি বাড়ির উদ্দেশ্যে!বিদায়ের সময় রিমি আর ওর মায়ের একসাথে কান্না দেখে আমি কেঁদে দেই।ভিষণ কষ্ট হচ্ছিলো ওদের দেখে!আর রিমি তো কাঁদতে কাঁদতেই অবস্থা খাবার! ওর মায়েরও একই অবস্থা! তারপর খুব কষ্টে সব কিছু সামলে আমরা গাড়িতে উঠেছি। সামনের টায় ভাইয়ুর আর রিমি ভাবি তারপরের টাই আমরা মানে নীর আর আমি!পিছনের গাড়িতে রাতুল ভাইয়া উঠেছে আসলে বিয়ে বাড়িতেই একটা মেয়েকে পছন্দ হয়ে গেছে তার!তাই সেই তখন থেকেই মেয়েটার পিছনে আঠার মতো লেগে আছে।ওই গাড়িতে মেয়েটা বসেছে তাই সেও ওই গাড়িতে উঠেছে মেয়েটার জন্য!আমার মেয়েটাকে দেখে যতোদূর মনে হচ্ছে তাহলো মেয়েটারও রাতুল ভাইয়াকে পছন্দ হয়েছে।এখন রাতুল ভাইয়াকে একটু বাজিয়ে দেখছে শুধু! যাক অবশেষে রাতুল ভাইয়ার জীবনেও কেউ এলো নীর যতোই রাতুল ভাইয়াকে নিয়ে আমার সাথে ঝগড়া করুন না কেন এতে নীরও খুব খুশি হয়েছে।সবশেষে সব গুলো ভালোবাসার মানুষই তাদের প্রিয় দের পেলো!
💗💗
অবশেষে আমার সেই কাঙ্খিত দিন টা এসে গেলো।যেইদিনের অপেক্ষায় আমি এতো গুলো দিন ছিলাম।আজকের দিনটা কিছুটা দুঃখের আর বাকি আনন্দের!দিনটা কি নাহয় একটু পরই জানলেন!আমি নীরকে খুঁজতেছি কিন্তু কোথায় পাইনি।এতো রাতে কি ছাঁদে থাকবে? প্রচন্ড রকম দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়েই ছাঁদের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।তবে এখানে এসে হতাশ হতে হলো না আমায়!কারণ নীর এখানেই আছে ছাঁদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।এতোগুলা বছর এই দিনটাকে ও মন খারাপ করেই কাটাতো!কিন্তু আজ থেকে আর এইদিনটাতে কখনে মন খারাপ করতে দিবো না প্রমিজ করলাম! পা টিপে টিপে পিছন থেকে ওর চোখ ধরে ফেললাম ও কোনো রিয়াকশন না দেখিয়ে একটা ভারী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,
—- কেন এসেছিস এখানে?
আমি জানি ও আমায় ঠিক চিনতে পারবে তাও একটু না জানার ভান করে মুখ ফুলিয়ে বললাম,
—- আজও চিনে নিলি আমায়?
নীর এবার আমার দিকে ফিরলো।আমার চোখে চোখ রেখে মলিন হাসলো।এমনিতে হলে এরজন্য মজা নিতো কিন্তু এইদিন টাতে আমি ওকে কখনো এর থেকে বেশি হাসতে দেখিনি।তাই আজও তার ব্যতিক্রম হলো না মলিন হেঁসেই বললো,
—- তোর স্পর্শ আমি কখনে চিনতে ভুল করেছি?
—- হুম বুঝলাম আপনি অনেক বড়ো জ্ঞানী মানুষ আপনার সাথে আমি পারবো না।এখন চোখ টা একটু বন্ধ করবেন প্লীজ!
—- কেন??
—- আহহ বন্ধ করতে বলেছি মানে বন্ধ করবি এতো প্রশ্ন করিস কেন হ্যাঁ!আর একটাও কথা বলবি না চুপচাপ চোখ বন্ধ কর এখন!
নীর আমার শুকনো গলার ধমক শুনে আর কথা না বাড়িয়ে চোখ দুটো বুজে নিলো। ও চোখ বুজতেই আমি পিছন থেকে একটা বাটি ওর সামনে ধরলাম।আর তার গ্রান পেয়ে ফট করেই চোখটা খুলে ফেললো নীর!সামনে ওর সেই প্রিয় গাজরের হালুয়া দেখে প্রচন্ড রকম অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হালুয়ার দিকে ইশারা করে বলললো,
—- কি এটা?
এবার সত্যি সত্যি আমার রাগ উঠে গেলো সেই সকাল থেকে চেষ্টা করতে করতে অবশেষে এইটা বানাতে পারলাম কারো হেল্প ছাড়াই আর ও জিজ্ঞেস করছে এটা কি?ভেবেছিলাম আজ রাগ করবো না কিন্তু ওর তা সইলো না সেই আমাকে রাগিয়েই দিলো।গরম চোখে তাকিয়ে বললাম,
—- ওই অন্ধ দেখতে পাচ্ছিস না এটা কি?আচ্ছা যাইহোক এই গাজরের হালুয়া টা আমি নিজে বানিয়েছি প্লীজ একটু হলেও খেয়ে বল কেমন হয়েছে?প্লীজ!
চোখ ছোটো করে অনুরোধের সুরে বললাম।তারপর আবার বলতে লাগলাম
—- শুভ জন্মদিন দিন নীর!সেইদিন যা হয়েছিলো সব ভাগ্যে লেখা ছিলো আমাদের এখানে তোর বা আমার কিছুই করার ছিলো না।জীবন কিছু নিবে আবার দিবে এইটাই তো জীবন! তাহলে কেন তুই সেইদিন মায়ের মৃত্যুর পর থেকে তুই কোনোদিন আর নিজের জন্মদিনের দিন হাসিস নি!মায়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমাদের এটা শিখিয়ে গেছে কাউকে কখনো অন্ধবিশ্বাস না করতে!আমাদের জীবনের অনেক বড়ো একটা শিক্ষা দিয়ে গেছে।আর মায়ের মৃত্যু টা এইভাবেই লেখা ছিলো তাই সেদিন ওইভাবেই হয়েছে।আমরা ভালো না থাকলে কিন্তু মাও ভালো থাকবে না।আল্লাহ আমাদের কাছ থেকে মাকে কেরে নিয়ে হয়তো আমাদের ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ করেছে।আর মৃত্যু তো চিরন্তন সত্য!আজ হোক কাল হোক সবাইকেই তো যেতে হবে মায়ের আয়ু এইটুকুই ছিলো তাই এর থেকে বেশি আমাদের মাঝে মা থাকতে পারেনি।মায়ের খারাপ স্মৃতি গুলো মুছে নিয়ে মায়ের সাথে কাটানো ভালো মুহুর্ত গুলোর কথা মনে করেই মাকে আমরা না হয় মনে রাখবো।প্লীজ এই দিনটাতে তুই আর কখনো এইভাবে মন খারাপ করে থাকিস না!আমার ভিষণ খারাপ লাগে তোকে এইভাবে দেখতে যদিও বা আগে জানতাম না কেন তোর এইদিন টাতে এতো মন খারাপ থাকে!
এক শ্বাসে কথাগুলো বলে আমি হালুয়ার বাটিটা নীরের দিকে এগিয়ে দিলাম।নীর আর যাই করুক না কেন আমার মন খারাপ হয় এমন কাজ কখনোই করবে না।আমার একটু মন খারাপ হলে যে পাগল হয়ে যায় আমার মুখে হাসি ফুটানোর জন্য সে কিনা করবে আমার মন খারাপ! আর তাছাড়াও আমার কথাগুলো নীরের মনে খুব ভালো করেই গেঁথেছে।তাই আর মন খারাপ না করে একটা মুচকি হাসি দিয়ে এক চামুচ হালুয়া নিয়ে মুখে পুরে দিলো।হালুয়াটুকু মুখে দিতেই অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে।অবাক নয়নে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
—- এ এ টা তো মনির হাতের৷ সেই হালুয়ার টেস্ট! এটা তুই কি করে বানালি?
আমি একটু ভাব বললাম,
—– মনির মেয়ে তো মনির মতোই বানাবে তাই না!
নীর এখনো আমার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। তা দেখে আমি ফিক করে হেসে দিলাম।
—- আরে বুদ্দু আমি যখন বাড়ি গিয়েছিলাম তখন মায়ের ঘর থেকে একটা রান্নার বই পাই ওখানে মায়ের সব রান্নার রেসিপি লেখা আছে। মা’ই লিখেছে বোধ হয়!ওইখানে এই গাজরের হালুয়ার রেসিপিটাও ছিলো।ওইখান থেকে দেখে দেখেই আমি আজ সকাল থেকে অনেকবার চেষ্টা করে এইটা বানিয়েছি।আচ্ছা বল না কেমন হয়েছে?
—- কেমন হয়েছে মানে?পুরো মনির মতোই হয়েছে।আর আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না এতো বছর পর আবার সেই আগের টেস্ট খুঁজে পাবো।আজ আমায় তুই জন্মদিনের সেরা উপহার দিয়েছিস।আমি বলে বোঝাতে পারবো না আজ আমি কতোটা খুশি!
নীর কথাগুলো বলতে বলতেই হঠাৎ করে আকাশ থেকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পরা শুরু করলো।আর সাথে আমার একরাশ মন খারাপ নিয়ে এলো।কেন এলো এখন বৃষ্টি টা!এখুনি তো আমায় ভিতরে চলে যেতে হবে একটুও ভিজতে পারবো না এই এত্তো সুন্দর বৃষ্টি টাতে!নীরের বলার আগে আমি চলে যাই এখান থেকে!একরাশ মন খারাপ নিয়ে ভিতর চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পিছন থেকে নীর হাতটা ধরে হেঁচকা টান মারলো।আকস্মিক ভাবে এমব হওয়াতে আমি গিয়ে নীরের বুকের মাঝে পরলাম।অবাক নয়নে ওর দিকে তাকালাম।বৃষ্টির কারণে ওর চুল গুলো থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে আমার মুখের উপর আঁচড়ে পরছে সেদিকে আমার খেয়াল নেই আমি তো এক ধ্যানে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি হঠাৎ করে কি হলো ওর!
—- এতোদিন আমি বারন করা সত্বেও তো বৃষ্টিতে ভেজা বন্ধ করলি না আজ হঠাৎ এতো ভালো হয়ে গেলি কি করে আমি কিছু বলার আগেই নিজে নিজে চলে যাচ্ছিস!কিন্তু আজ যে আমার বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে একটু খানি বৃষ্টিতে ভেজার জন্য!কি করবো বল তো!
ওর এইটুকু কথা যেন আমার কাছে পূর্নিমার চাঁদ হাতে পাওয়া মতো আনন্দের!আমি প্রফুল্লিত হয়ে বলে উঠলাম,
—- সত্যি!!!!
নীর আমার মুখের উপর উপছে পরা চুলগুলো কানে গুঁজে দিয়ে মাথা নেরে সম্মতি জানালো।আমাকে আর পায় কে ভিজতে লাগলাম বৃষ্টিতে! বেশ কিছুক্ষণ ভেজার পর হঠাৎ করে একটা হাঁচি দিয়ে উঠলাম।এতে ভিষণ ভয় পেয়ে গেলাম নিশ্চয়ই নীর এখন বকাবকি করবে!তাই চোখ বুজে নিলাম।আমার ধারনা ভুল প্রমানিত হলো যখন নীর নিজেও একটা হাঁচি দিলো।চোখ খুলে দুজন দুজনের অবস্থা দেখে হেঁসে দিলাম।আজ নেই কোনো ভুলবোঝাবুঝি ভুলবোঝাবুঝি নেই কোনো রাগ অভিমান!আজ মন খুলে বলবো আমাদের প্রেমের সাত কথা! আমাদের #প্রেমের_সাতকাহন এর সাক্ষী হয়ে থাকবে আজ এই বৃষ্টি।যেখানে থাকবে না কোনো রাগ অভিমান থাকবে শুধু আমাদের প্রেমের সাতকাহন।
___________________সমাপ্ত___________________