প্রেম আমার পর্ব-৫৪+৫৫+৫৬

0
7055

#প্রেম_আমার♥
#পার্ট-৫৪♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
.
🌺
.
প্রায় আধঘন্টা হতে চললো রুশো ভাইয়া এখনো ফেরে নি। ফোনটাও সুইচড অফ বলছে। এবার বেশ চিন্তা হচ্ছে আমার। ২০ মিনিটের মধ্যেই ভাইয়ার যেখানে চলে আসার কথা সেখানে ৩০ মিনিট পাড় হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে ফোনে ট্রাই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে অগ্নি ভাইয়া।

নীবিড় ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অগ্নি ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
—- অগ্নি চল! আই থিংক রুশো ইজ ইন ডেঞ্জার।
.
নীবিড় ভাইয়ার কথাটা বলতে দেড়ি হলেও অগ্নি ভাইয়ার চটজলদি উঠে গাড়ির চাবিটা হাতে নিতে দেড়ি হলো না। দুজন দুজনেই দিকে তাকিয়ে “চল” বলেই এক ছুটে বেড়িয়ে গেলেন সদর দরজা দিয়ে।
ব্যাপারটা এতো দ্রুত ঘটে গেলো যে আমি আর নিত্য আপু শুধু বোকার মতো চেয়ে রইলাম সদর দরজা বরাবর।
পর মুহূর্তেই মাথায় আঘাত হানতে শুরু করে দিলো “বিপদ” নামক ভয়ংকর শব্দটা। যতই চাইছি পজিটিভ থিংকিং করতে ততই আরোও মন নামক অলয়েজ ব্রেইনের বিরুদ্ধে চলা ক্ষেত্রটির মাঝে একটাই প্রশ্ন উঁকি দিয়ে চলেছে, “খারাপ কিছু হলো না তো?”
.
🍂
.
পাঁচ মিনিটের রাস্তা ৯০ কিলোমিটার পার আওয়ার বেগে গাড়ি চালিয়ে ২ মিনিটে পাড় করে হঠাৎ থমকে গেলো অগ্নি। সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে চটজলদি নেমে পড়লো অগ্নি-নীবিড়!

রাস্তার ধারে দুটো ছেলে রক্তাক্ত শরীরে ব্যাথায় গড়াগড়ি খেয়ে যাচ্ছে কিন্তু উঠতে পারছেনা। এদিকে আরোও দুজন ছেলেকে ধরে ইচ্ছেমতো কেলিয়ে যাচ্ছে রুশো। জুডোর Shoulder Wheel, One hand Reversal, Single leg Takedown, Two hand reap সহ বেশিরভাগ ট্রিকস ই এপ্লাই করে ইচ্ছেমতো মেরে চলেছে সে ছেলেগুলোকে। পাশেই রাত্রি বারবার বারণ করে যাচ্ছে রুশোকে যাতে ছেলেগুলো কে ছেড়ে দেয় কিন্তু রুশোর তাতে কোনোই ভাবাবেগ হচ্ছেনা যেনো।
.
অগ্নি-নীবিড় দুজনেই স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছে শুধু। বোঝার চেষ্টা করছে যে এক্সাক্টলি হচ্ছে টা কি! এটা কি আদৌ রুশো? তাদের দুষ্টু-মিষ্টু ড্রিমার?
কয়েক সেকেন্ড ওভাবেই অবাক চোখে রুশো কে পর্যবেক্ষণ করে অগ্নি-নীবিড় ছুট লাগালো রুশোকে থামাতে। ওদের দেখেই পড়ে থাকা একটা ছেলে গোঙাতে গোঙাতে চাপা কন্ঠে বলে উঠলো,
.
—- সাদমান ভাই! আমাদের বাঁচান, আমরা আর কোনোদিনও মেয়েদের বিরক্ত করবো না ভাই। একে থামান ভাই দোহাই লাগে।
.
পড়ে থাকা ছেলেটাকে দেখে এবার নীবিড়ের মাথাও রক্ত চড়ে গেলো। রাগের মাথায় সজোড়ে একটা লাথি মেরে বসলো ছেলেটাকে সে।
.
—- তোরা? স্কাউন্ড্রেল! আগের বার আমার মার খেয়েও শিক্ষা হয়নি তোদের? লোকে ঠিকই বলে, কুত্তার লেজ কোনোদিনো সোজা হয় না। আবে কুকুর তো হাজার গুণ ভালো রে তোদের মতো মানুষের থেকে!
.
বলেই আবারও মারতে যাবে তার আগেই অগ্নি নীবিড়কে টেনে ধরে আটকে দিলো তাকে। তখনও রুশো আগের ছেলেটাকে আঘাত করেই চলেছে।
.
—- নীবিড়, ছেড়ে দে। এমনিতেই মার খেয়ে উঠে দাঁড়াবার মতো অবস্থায় নেই এরা। আপাতত রুশো কে থামাতে হবে।
.
নীবিড় হাত মুঠো করে নিজের রাগটাকে নিজের মধ্যেই দমিয়ে রেখে রুশোকে থামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। অগ্নি রাত্রিকে গাড়িতে গিয়ে বসতে বলে নিজেও রুশোকে টেনে ধরলো,

—- ব্রো, ছেড়ে দাও আমাকে, আজ আমি এই জানোয়ার গুলোকে মেরেই ফেলবো। ও..ওরা আমার রাত্রিকে টাচ করেছে, ওকে আজেবাজে কথা বলেছে। ভালো ভাবে বুঝিয়েছিলাম বাট দে ডিডেন্ট লিসেন টু নি! দে বিহেভিং লাইক বাস্টার্ড!
.
অগ্নি রুশোকে টেনে তুলে নিজের দিকে ফিরিয়ে শান্ত করার জন্য ঝাপটে ধরে বলতে শুরু করলো,
—- আই নো রুশো! প্লিজ এবার থাম। দে আর টু মাচ হার্ড-হিট, রাত্রির কিচ্ছু হয় নি। শি ইজ টোটালি ফাইন রুশো।
.
রুশো এবার অনেকটা শান্ত হলো অবশেষে। নীবিড় এই ফাঁকে ছেলেদুটোকে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে বললো,
—- বাঁচতে চাস তো ভাগ এখান থেকে, তোদের নেক্সট টাইম যেনো আমার চোখের সামনে পড়তে না দেখি। সাথে ওই দুটোকেও নিয়ে যা।
.
ছেলে দুটো যেনো এবার নিজেদের প্রান ভোমরা ফিরে পেলো। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেটে গিয়ে বাকি দুজনকে টেনে তুলে পালাতে লাগলো সবকটা মিলে।

অগ্নি রুশোকে শান্ত হতে দেখে ছেড়ে দিয়ে গাড়িতে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলো। রাত্রি পেছনের সিটে বসে ছিলো, অগ্নি গিয়ে ওর পাশেই রুশোকে বসিয়ে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে৷ পড়লো।
এদিকে নীবিড় রুশোর আনা বাইকে উঠে পড়লো।
.
অগ্নি রাত্রিকে বাড়ি অবদি ছেড়ে আসার জন্য গাড়ি স্টার্ট দিলো। এবার গতি অনেকটা কমিয়েই চালাতে লাগলো অগ্নি যাতে রুশো আর রাত্রি কিছুক্ষণ নিজেদের মতো স্বাভাবিক হয়ে নিতে পারে।

রাত্রি যেনো পুরো বোবা হয়ে গিয়েছে। কি করবে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। রুশোর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। পড়নের সাদা শার্টটা লালবর্ণ ধারণ করছে ছেলেগুলোর ছিটকে পড়া রক্তে। ঘেমে শরীর একাকার। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। চোখের কথা আর নাই বা বলি।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর হুট করেই রুশো রাত্রির মুখপানে ঘুরে রাত্রির বাম হাতটা নিজের দুহাতের মুঠোয় নিয়ে বলে উঠলো,
.
—- হেই এটম বোম্ব, সরি হ্যাঁ আসলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি আমি। ওরা এতো বাজে বাজে কথা বলছিলো ইভেন তোমায় টাচ করতে এসেছিলো। সব মিলিয়ে আই ওয়াস নট ইন মাই কন্ট্রোল।
.
রাত্রি এবার বিস্ফরীত চোখে রুশোর দিকে তাকালো। খুবই সাবধানে হাতটা ছুটিয়ে নিয়ে কড়া গলায় প্রশ্ন করলো,
—- তো? আমার সাথে যাই করুক আপনি এতো রিয়াক্ট করলেন কেনো? আর তখন আমাকে ধরায় এটা বললেন কেনো যে আপনার কলিজায় হাত দিয়েছে?
.
রুশো রাত্রির এমন প্রশ্নে খুবই বাজেভাবে ভড়কে গেলো। রাগের বশে কখন এমন একটা সেন্টেনস উচ্চারণ করে ফেলেছে সে বুঝতেই পারে নি।
এখন কি বলে কাটিয়ে দিবে এর অনুসন্ধানে চোখের মনি এদিক ওদিক ঘুরিয়ে খানিক ভেবে হঠাৎ ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে রুশো প্রতিউত্তরে বললো,
.
—- কত্তো ডাম্ব তুমি এটম বোম্ব! দেখো, তুমি ছুটকির বেস্টু, সেই হিসেবে তুমি ছুটকির কলিজা, এদিকে ছুটকি আবার আমার কলিজা তাই ওর কলিজা মানেই আমার কলিজা। ওর বেস্টুর কিছু হলে আমি জি জবাব দিতাম বলো? তাই বলে ছিলাম আর কি।
.
রাত্রি কিছুক্ষণ চোখ ছোট ছোট করে রুশোকে দেখে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কি অদ্ভুত! একটু আগে যাকে দেখে ভয়ে কুঁকরে উঠতে হচ্ছিলো এখন তাকে আবারও সেই আগের রূপে দেখে স্বস্তি মিললেও অদ্ভুত লাগছে তার।
রাত্রিকে চুপ করে থাকতে দেখে রুশো রাত্রির ধ্যান ভাঙানোর জন্য মজা করে বলে উঠলো,
.
—- আর এটা কি হলো এটম বোম্ব? তুমি তো দিব্যি আমার কাছে এটম বোম্বের রূপ ধারণ করে কথায় কথায় আমার নাকটা ফাটিয়ে বেহাল করে দাও, আর ওদের দেখে মেনি বেড়াল হয়ে গেলে? দ্যটস রিয়েলি নট ফেয়ার।
.
রাত্রি মুচকি হেসে বললো,
—- কারণ আপনি বোকার মতো চুপচাপ নাক ফাটিয়ে নেবার জন্যই বসে থাকেন।
.
রাত্রির কথা শেষ হতেই গাড়ির ব্রেক কষলো অগ্নি। ওরা ওদের গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছে। রাত্রি রুশোকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গেইট খুলে নেমে পড়লো। বড়বড় পায়ে হেটে চললো সে বাড়ির সদর দরজা বরাবর।
অগ্নিদের পেছনে নীবিড়ও এসে বাইক থামালো।
রুশো ঠিক ততক্ষণই স্থির দৃষ্টিতে রাত্রির দিকে তাকিয়ে ছিলো যতক্ষণ পর্যন্ত না সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করে দৃষ্টির অগোচরে চলে যায় তার।
রাত্রি যেতেই আরোও কিছুক্ষণ একই ভাবে চেয়ে থেকেই চোখ দুটো বুজে মনে মনে রাত্রির ছবি কল্পনায় ফুটিয়ে তুললো রুশো। আনমতেই সেই ছবিতে হাত ছুইয়ে মুচকি হেসে উঠলো সে।
.
অগ্নি একবার রুশোকে দেখে নিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে স্টার্ট দিলো। ছুটে চললো সে বাড়ির উদ্দেশ্যে। ওদের পেছন পেছন বাইক নিয়ে ছুটে রওনা হলো নীবিড়ও।
.
🌹
.
বর্তমানে আমার মুখ দিয়ে অনায়াসেই পুরো একটা গোলগাপ্পা ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে। হাহ বলে কি! রুশো ভাইয়া আর ফাইটিং? রুশো ভাইয়া, যে কিনা এসব মারামারি দেখলে দশ হাত দূরে থাকে সে করেছে মারামারি? এও সম্ভব?
.
—- অনু, এবার এটলিস্ট মুখটা বন্ধ কর। ঘরে যত মশা আছে সব তোর মুখে ঢুকে যাবে। (অগ্নি)
.
অগ্নি ভাইয়ার কথায় মুখ বন্ধ করার বদলে আমি আবারও হ্যাবলার মতো মুখ হা করেই ভাইয়ার দিকে তাকালাম। পাশ থেকে নীবিড় ভাইয়া এক হাত দিয়ে আমার থুতনিতে হাত দিয়ে উঁচু করে মুখ বন্ধ করে দিতেই ধ্যান ভাঙলো আমার। হকচকিয়ে উঠে আমি রুশো ভাইয়াকে প্রশ্ন করলাম,
—- রুশো ভাইয়া, তুমি জুডো প্রো হলে কিভাবে?
.
রুশো ভাইয়া টি-শার্ট গায়ে জড়াতে জড়াতে আমার পাশে এসে বসে বলতে শুরু করলো,
—- আসলে হয়েছে কি ছুটকি, আমি একবার ইউএস থেকে টুরে কোরিয়া গিয়েছিলাম। তো ওখানকার একটা জুডো ক্লাবে ভিজিট করি আমি, কোরিয়ান ছেলেরা জুডো প্রাক্টিস করছিলো তো দেখে আমারও ইচ্ছে হলো শেখার তাই ২ সপ্তাহ ওদের সাথেই জুডো শিখি। যদিও ওদের মতো এক্সপার্ট হতে পারিনি ওটুকু সময়ে বাট বেশ কিছু ট্রিকস এপ্লাই করতে পারি।
.
নিত্য আপু এবার মুখ খুললো,
—- আরে বাহ দেবর জি! তুমি তো জাস্ট ফাটিয়ে দিয়েছো।
.
নীবিড় ভাইয়া নিত্য আপুকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
—- আপাতত ফাটা ফাটি অফ করে ঘুমো তোরা রাত পেরিয়ে সকাল হয়ে যাবে।
তাছাড়া রুশোর অনেক এনার্জি লস হয়েছে, হি নিড আ লং রেস্ট।
.
নীবিড় ভাইয়ার কথায় শায় জানিয়ে মাথা নাড়ালো অগ্নি ভাইয়াও। রুশো ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে উঠে পড়লো। আমাদের ঘুমোতে বলে লাইট অফ করে দিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলো ভাইয়ারা।
ভাইয়ারা যেতেই আমি বিছানায় হেলান দিয়ে ভাবতে লাগলাম রুশো ভাইয়া মনে মনে রাত্রিকে এতোটা ভালোবাসে, আদৌ কি রাত্রি বুঝবে ভাইয়াকে?
.
🍁
.
রাত প্রায় ৩ টা বেজে এসেছে, তবুও ঘুম নেই রাত্রির উদ্বিগ্ন চোখে।
রিমিকে ঔষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে রাত্রি অনেকক্ষণ। বর্তমানে সে অবস্থান করছে তার ঘর আর ছাদের মাঝে লাগানো থাইগ্লাসের সামনে। রাতের বেলা থাইয়ের ওপাশে ঘরের ভেতর থেকে কিছু দেখা না গেলেও দিনের বেলা ঠিকই সব দেখা যায়। আবার বাইরে থেকে ঠিক উল্টো। দিনের বেলায় ঘরের ভেতরের কিছু দেখে না গেলেও রাতের বেলায় সবই স্পষ্ট দেখা যায় যদি না পর্দা টানানো থাকে। যেহেতু রাতের বেলা ঘরের ভেতর থেকে বাইরে কিছু দেখা যাবে না তাই রাত্রি জানালার গ্লাসটা সরিয়ে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে আকাশ পানে।
.
রাত্রি আনমনেই ভেবে চলেছে রুশোর কথা, আনমনেই এঁকে চলেছে রুশোর প্রতিচ্ছবি। তার মনে প্রশ্ন জাগছে “আচ্ছা রুশো ছেলেটা এরকম কেনো?” সবসময় হাসি-ঠাট্টায় মত্ত থাকে, সিরিয়াসনেস বলতে যে পৃথিবীতে একটা শব্দ আছে তা রুশোকে দেখে বোঝাই যায় না। আবার হুটহাট রাত্রির একটু কিছু হলে যেনো রুশোকে আর চিনতে পারে না সে। কেনো এতোটা ভাবে রুশো রাত্রিকে নিয়ে? এসব কি শুধুই বোনের বেস্ট ফ্রেন্ড হবার ফর্মালিটিস নাকি নাকি অন্য কিছু? যদি অন্য কিছুই হয় তবে কি সেটা?
.
রুশো ছেলেটা বেখেয়ালি, প্রানবন্ত, রং-তামাশায় মত্ত! অথচ রাত্রির দূর্দিনে সেই তাকে সবথেকে বেশি সাপোর্ট করেছে। অগ্নিকে ভুলে থাকার সবথেকে ইফেক্টিভ সলিউশন সেই বের করে দিয়েছে। নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে রুশোই তাকে বাঁচিয়েছে। কেনো করে সে এসব?
রাত্রি তো অগ্নিকে ভালোবাসে তারপরও কেনো রুশোকে নিয়ে এতো ভাবনায় ডুবতে হচ্ছে তাকে?
.
এরকম আরো হাজারও প্রশ্ন চরকার মতো ঘুরপাক খাচ্ছে রাত্রির মনে। কিন্তু উত্তর শুধুই ফাঁকাসেটের মতো।
অবশেষে রাত্রি ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হয়ে জানালা বন্ধ করে পর্দা টেনে দিয়ে রিমির পাশে এসে বসে পড়লো। রিমির কপালে হাতের উল্টো পিঠ ঠেকিয়ে তাপমাত্রাটা আগের থেকে কমেছে অনুভব করে কাথাটা দিয়ে গা ভালো করে ঢেকে দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো সে।
.
🌸
.
ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরেই আমার চোখ কপালে উঠে গেলো। নিত্য আপুর আব্বু আমাদের বসায় এসেছেন। বর্তমানে ড্রয়ই রুমে আম্মু আব্বুর সাথে কোনো এক বিষয় নিয়ে গভীর আলোচনায় মত্ত হয়ে রয়েছেন উনি।
.
আমায় বাসায় প্রবেশ করতে দেখে আম্মু বলে উঠলো,
—- এইতো অনন্যা চলে এসেছে, জলদি গিয়ে ফেশ হয়ে নিচে আয়। নীবিড় আর অগ্নি আসুক এর মধ্যে, তোদের সাথে কথা আছে।
.
আমি নীবিড় ভাইয়ার আব্বুকে সালাম দিয়ে উপরে চলে এলাম। না জানি কি নিয়ে কথা বলতে চাইছে উনারা! আম্মু কি আংকেল কে বলে দিলো আমার আর নীবিড় ভাইয়ার এক্সিডেন্টলি বিয়ের কথাটা? উনি ঠিক কি রিয়াকশন দেবেন কথাটা শুনার পর?
এসব ভাবতে ভাবতেই ঘরে চলে এলাম অামি। ঘাড় থেকে ব্যাগটা টেবিলের ওপর রেখে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লাম শাওয়ার নেওয়ার জন্য। এতোদিন ক্লাস না করে হঠাৎ আজ এতগুলো ক্লাস করায় মাথাটা ঠিক কাজ করতে চাইছে না। কি এমন হতো যদি পড়াশুনো নাই বা থাকতো? আর পড়াশুনো থাকলে থাকতো, আবার পরীক্ষার আসার কিই বা দরকার ছিলো?
.
🌷
.
ড্রয়ইরুমের সোফায় বসে আছি আমি অগ্নি ভাইয়া, রুশো ভাইয়া, নীবিড় ভাইয়া, নিত্য আপু সাথে বাড়ির বড়রা উইথ এক্সিডেন্টলি শশুড়উল্লাহ!

ভার্সিটি থেকে ভাইয়ারা একটু আগেই এসেছে। রুশো ভাইয়াকেও নাকি আম্মু আসতে বলেছে। ইউএস থেকে আসার পর রুশো ভাইয়া অবশ্য নিজেদের বাসায় কতোদিন ছিল তার হাতে গোনা হিসেব থাকলেও আমাদের বাসায় কতোদিন ছিলো তার হিসেব নেই। আসলে রুশো ভাইয়ার নিজের কোনো ভাই-বোন নেই, একা বাসায় করবে কি? তার ওপর খালামুনি আবার হাই স্কুলের টিচার। যদিও পেশাটা শুধুই শখের বসেই বেছে নিয়েছে খালামুনি তবুও তার জন্য দিনের বেলা বাইরেই থাকতে হয়। তারওপর আংকেলের অফিস তো আছেই। রুশো ভাইয়া ইউএস থেকে ফিরে কয়েকদিন রিল্যাক্স করে আবার আংকেলের কোম্পানি তে জয়েন করেছে।
আজ সকালে বেড়িয়ে আবার খালামুনির বাসা থেকে অফিসে গিয়েছিলো রুশো ভাইয়া। আসার পথে অগ্নি ভাইয়া রুশো ভাইয়াকেও টেনে এনেছে।
.
নীরবতার চাদর ভেদ করে আব্বু নীবিড় ভাইয়ার আব্বুকে বললেন,
—- আচ্ছা তাহলে এখন কথাটা শুরু করা যাক। কি বলেন?
.
নীবিড় ভাইয়ার আব্বু চায়ের কাপটা টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন,
—- অবশ্যই। তা কথাটা হচ্ছে যেহেতু আল্লাহর কালেমা পড়ে নীবিড়-অনন্যার যেভাবেই হোক বিয়ে হয়েই গিয়েছে তাই এবার আমরা চাইছি তোমাদের পারিবারিকভাবে বিয়েটা দিয়ে দিতে। তাছাড়া অনন্যার মতো মিষ্টি একটা বউমা হবে আমার এতে তো আমার আপত্তি থাকার কোনো কথাই না। তাই আমরা ভেবে নিয়েছি অগ্নি-নিত্যর সাথে একই দিনে নীবিড়-অনন্যারও বিয়েটা সেড়ে ফেলতে।
.
এক্সিডেন্টলি শশুর মশাইয়ের কথায় বিষম খেয়ে কাশতে শুরু করে দিলাম আমি। রুশো ভাইয়া তৎক্ষণাৎ টেবিল থেকে পানির গ্লাস আমার হাতে ধরিয়ে দিলো। ঢকঢক করে পুরো গ্লাস শেষ করে তবে শান্ত হলাম আমি।
নীবিড় ভাইয়ার সাথে আমার অলরেডি বিয়ে হয়ে গিয়েছে তারপরও আবার বিয়ের কথাটা শুনেই কেমন একটা বউ বউ ফিলিংস আসছে আমার। কই এতোদিন তো এমন লাগে নি! বাড়ি ভর্তি লোক আসবে, আমায় গহনা, বেনারসি শাড়িতে মোড়ানো হবে, কাজি সাহেব আবারও বুলি আওড়াতে আওড়াতে বলবেন, “বলো মা কবুল!” আবার বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলে বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় বাচ্চাদের মতো হাত-পা ছাড়িয়ে ভ্যা ভ্যা করে কান্না করতে হবে। সব মিলিয়ে অনুষ্ঠান করে বিয়ে পড়ানোর কথা শুনেই এসব সিন কল্পনায় ভাসতে শুরু করে দিয়েছে আমার। গলা ক্রমশ শুকিয়ে আসছে শুধু।
রুশো ভাইয়া আমার এমন অবস্থা দেখে বলে উঠলো,
.
—- লে বিবাহিত ছুটকির আবার বিয়ের কথা শুনে উল্টাউল্টি হচ্ছে!😑
.
চলবে……………💕

#প্রেম_আমার♥
#পার্ট-৫৫♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
.
🌺
.
বিগত ১৫ মিনিট যাবৎ হেচকি তুলে চলেছি আমি। কি এক অদ্ভুত হেচকি যে গ্লাসের পর গ্লাস পানি খেয়েও কোনো কাজেই দিচ্ছে না। ঠিক এই জন্যেই অসম্ভব রকমের ভয় পাই আমি এই হেচকি নামক কন্টিনিউয়াসলি জ্বালাতন করা প্যারাটাকে।

আমার হেচকি হয় দুটো কারণে। তার প্রথম কারণ হলো : মাত্রাতিরিক্ত হাসার ফলে, এন্ড নাম্বার টু হচ্ছে : অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো কাহিনি শুনার পর। যদিও কাহিনী টা শুনিনি শুধু কাহিনীর নামটাই শুনেছি তবুও হেচকি আমায় হ্যালো হায় বলে ঠিকই চলে এসেছে।
.
তখন আংকেলের বলা প্রোপোজাল শুনে বিষম খেয়ে ফেলেছিলাম আমি, তারই সলিউশন হিসেবে পানি খাইয়ে দিয়েছিলো রুশো ভাইয়া। ব্যাস, বিষমের সাথে পানির বিক্রিয়ায় প্রভাবক হিসেবে উপস্থিত ছিলো এক বড় সড় ঝাটকা, অবশেষে উৎপাদ হিসেবে পেলাম ভূমিকম্প সৃষ্টিকারী হেচকি!
আবার এই হেচকিকে প্রশমিত করার জন্য গলায় আবারও জল ঢালতে শুরু করে দিয়েছিলাম আমি। কিন্তু আফসোস হেচকির সাথে পানির বিক্রিয়ায় ফলাফল এলো “No Reaction”!
তখন হেচকি তুলতে তুলতে বড়দের আলোচনার পরিবেশের ব্যাঘাত সাথে নিজের সম্মান রক্ষায় মুখ চেপে ধরে দৌড়ে নিজের ঘরে চলে আসি আমি।
.
বর্তমানে আমার ঘরে উপস্থিত রয়েছে ভাইয়ারা সাথে নিত্য আপুও। রুশো ভাইয়া আমার ননস্টপ হেচকি দেখে মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে বসে পড়ে বললো,

—- লে হালুয়া!
বিবাহিত ছুটকির,
বিয়ের নাম শুনেই এলো হেচকি!
.
অগ্নি ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে আইডিয়া বলেই মুখটা হঠাৎ গম্ভীর করে ফেললো। আমার পাশে বসে মাথা নামিয়ে ভয়ংকর গম্ভীরতা ধারণ করে থম মেরে রইলো ভাইয়া। ভাইয়া ঠিক কি করতে চাইছে তার কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা আমি। বেশ কিছুক্ষণ ওভাবেই থেকে হঠাৎ ভূতের মতো মুখের বিকৃতি বানিয়ে ” ভাউউউ” বলে চেঁচিয়ে উঠলো অগ্নি ভাইয়া। অগ্নি ভাইয়ার হঠাৎ এমন করায় কিঞ্চিৎ চমকে উঠলেও ভয়ের বিন্দুমাত্র ছিটেফোঁটাও পড়লো আমার ওপর। বরং আবারও মৃদুস্বরে হেচকি তুলে কেঁপে উঠলাম আমি। অগ্নি ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে চোখেমুখে বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে চট করে দাঁড়িয়ে পরে রাগী গলায় আমায় উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
.
—- কি রে তুই? ভয় পাস না কেনো?
.
আমি বোকার মতো আবারও হেচকি তুলে পাল্টা প্রশ্ন করে বসলাম,
—- কেনো? তোকে আবার ভয় পাবো কেনো? অার ভয় পেলে কি হবে?
.
অগ্নি ভাইয়া এবার নিজের ডান হাত দিয়ে কপাল চাপড়াতে শুরু করলো। কপাল চাপড়াতে চাপড়াতেই চোখ মুখ উল্টে বলে উঠলো,
—- কি আর হবে? তোর এই ভূমিকম্প সৃষ্টিকারী হেচকিটা অন্তত থামবে রে মাথামোটা।
.
অগ্নি ভাইয়ার কথা শুনে নীবিড় ভাইয়া সচেতন চোখে তাকিয়ে বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলেন,
—- ভয় পেলে হেচকি থেমে যাবে?
.
নিত্য আপু অগ্নি ভাইয়ার জবাব দেওয়ার আগেই বলে উঠলো,
—- মেডিকেল সাইন্সে তো এমন কিছু বলা নেই।
.
অগ্নি ভাইয়া আবারও কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলে উঠলো,
—- সব জায়গাতেই সাইন্স খুঁজে লাভ হয় না গো। ছোট থাকতে আমার হেচকি উঠলে আব্বু হঠাৎ কোনো না কোনো ভাবে ভয় দেখাতো আমাকে। ভয়ে আঁতকে উঠে কখন যে হেচকি চলে যায় টের পাওয়াই যায় না।
.
নীবিড় ভাইয়া অগ্নি ভাইয়ার সলুউশন শুনে এক হাতে তুড়ি বাজিয়ে বলে উঠলেন,
—- আরে আগে বলবি তো! আমি তো জাস্ট তুড়ি বাজিয়েই ওর হেচকি থামিয়ে দিতে পারতাম।
.
বলেই আমার সোজাসুজি এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন উনি। আমার দুই সাইডে নিজের দুহাত রেখে ঠোঁটে বাকা হাসি ঝুলয়ে ক্রমশই ঝুঁকে পড়তে শুরু করলেন সাথে বাড়িয়ে দিতে লাগলেন আমার হৃদস্পন্দন! আমি চোখ বড়বড় করে উনার দিকে চেয়ে রয়েছি। আমি জানি উনি আমায় ভয় দেখানোর জন্যই এমনটা করছেন কিন্তু তবুও ভয় লাগতে শুরু করে দিয়েছে আমার। উনি আমার কাছে আসতে আসতেই বাকিদের উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
.
—- চোখ বন্ধ কর তোরা, নায়তো রুশোর মতো ফুটো হয়ে যাবে।
.
উনার কথাটা বলার সাথেসাথেই ভাইয়ারা সাথে নিত্য আপু উল্টো দিকে এক লাফ মেরে ঘুরে চোখ বন্ধ করে নিলো নিজেদের। রুশো ভাইয়া উল্টো দিকে ঘুরেই বিড়বিড় করে বলতে শুরু করলো,
—- ইয়া আল্লাহ, বাঁচালো মেরে ছুটকি কো…!
.
সাথেসাথেই আমার আবারও হেচকি উঠলো, যা দেখে নীবিড় ভাইয়ার দৃষ্টি আগের থেকে আরোও তীক্ষ্ণ হয়ে এলো। উনি আমার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে শীতল কন্ঠে বলে উঠলেন,
—- এখনোও যায় নি? ওয়েট, লেট মি ডু ওয়ান থিংক।
.
বলেই আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে যেতে লাগলেন উনি। এদিকে আমি চোখ বড়বড় করে উনাকে আটকানোর চেষ্টা করে চলেছি। কিন্তু না উনি কি অার আমার কথা শুনার পাত্র? কোনো কালেই নন, তাইতো আমার কানের লতিতে হাল্কা করে নিজের দাঁত দিয়ে কচ করে কামড় দিয়ে বসলেন উনি। সাথেসাথে আমার পুরো শরীর জুড়ে এক শীতল স্রোত বয়ে গেলো যেনো। আনমনেই মৃদু স্বরে চাপা আর্তনাদ নিসৃত হলো আমার ওষ্ঠদ্বয় দ্বারা।
উনি আমায় ছেড়ে সোজা হয়ে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন। এদিকে আমি ভয়ে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করেই রেখেছি। উনি কিছুক্ষণ আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট কামড়ে ধরে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলেন,
.
—- কি হেচকি চলে গিয়েছে তো?
.
আমি চোখ বন্ধ করেই নিজের গলায় হাত বুলাতে লাগলাম। আরে আসলেই তো আর হেচকি আসছে না আমার। যেখানে উনার আমার কানে কামড় দেবার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত হেচকি উঠা কন্টিনিউ ছিলো সেখানে উনি আমায় ভয় খাইয়ে দেওয়া মাত্রই চলে গেলো! হাহ!
হেচকি আর আসছে না বুঝতে পেরে আমি খুশিতে এক লাফ করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দু হাত উপড়ে তুলে ঘুরতে ঘুরতে বলতে লাগলাম,
.
—- ইয়েএএএ……! হেচকি হ্যাজ গন
হইচই ইজ অন…..!
.
আমার কথা শুনে বাকিরা আমাদের দিকে ঘুরে চোখ মেলে তাকালো। রুশো ভাইয়াও খুশিতে আমার সাথে লাফাতে শুরু করে দিলো।
আমাদের দুই ভাই বোনের এমন কান্ড দেখে হু হা করে হেসে ঘড় কাঁপাতে শুরু করে দিলো নীবিড় ভাইয়া,অগ্নি ভাইয়া আর নিত্য আপু। তাদের হাসির ঝংকার দেয়ালে দেয়ালে বাঁধা পেয়ে প্রতিধ্বনির আলোড়ন সৃষ্টি করে পুরো ঘর জুড়ে বিচরণ করতে শুরু করে দিলো।
.
🍂
.
দেখতে দেখতে কেটে গেলো ৫ টা মাস………!

আমাদের ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল এক্সাম শেষ হয়েছে আজ তারই ফল প্রকাশ সাথে আমার বারো ছেড়ে তেরো অবস্থা হবার কথা।
ওদিকে অগ্নি ভাইয়াদেরও ফাইনাল এক্সাম শেষ হয়েছে ১ সপ্তাহ হতে চললো। কত্তো সুন্দর রিল্যাক্স করে পায়ের ওপর পা তুলে আয়েশ করছে ভাইয়া। ভাইয়ার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে তিনিই একমাত্র যে কি না মাস্টার্স ফাইনলান এক্সাম দিয়েছে যার দরুন ভীষণ ক্লান্ত তিনি। তাই অফিসেও যেতে চাইছে না এই এক সপ্তাহ ধরে।
আর এদিকে একেবারেই তুচ্ছ আমি। রুশো ভাইয়া যদিও আমায় এনকারেজ করে চলেছে কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না। আমার ভয় বাড়ির কাউকে নিয়ে নয়। ভয় তো শুধুমাত্র আমার এক্সিডেন্টলি হাজবেন্ড সাদা বিলাই কে নিয়ে। কারণ গতকাল রাতেই উনি ফোন করে জানিয়ে দিয়েছেন যদি ৪.০০ এর নিচে কোনো ভাবেই পয়েন্ট আসে তবে আমার কপালে শনি গ্রহের থেকেও বড় কোনো শনি রয়েছে।
.
রাত্রি তো একদম ফিলিং চিল মুডে রয়েছে। আন্টিকে ও ভয় পেলেও আন্টি বলেছে ৩.৬৫ আপ হলেই উনি খুশি। আর আংকেল কে ম্যানেজ করা তো ওর এক চুটকির খেল। শুধু মাঝখান থেকে চিপায় পড়েছি আমি। ভয়ে ভার্সিটিও যাই নি আমি। যা দেখার রাত্রি দেখে নিয়ে আমায় জানাবে।
অগ্নি ভাইয়াও যেখানে আম্মু আব্বুর মতো এবার রেজাল্ট মোটামুটি হলেও কিছু বলবে না সেখানে সাদা বিলাইয়ের বাচ্চা থুক্কু উনি তো মেল ভার্সন বাচ্চা কোথায় থেকে আসবে? হোয়াট এভার সাদা বিলাই আমার, না মোটামুটি রেজাল্ট মানবেন আর না চিকন-মাঝারি। উনার একটাই কথা ৪.০০ তো ৪.০০ ই। সাথে মার্কস ও দেখবেন উনি। জীবনটাকে একদম শুকনো মরুভূমির মতো লাগছে আমার।
.
এসব ভাবতে ভাবতেই কানে জাস্টিন বাইবার এর লেট মি লাভ ইউ সং এর টিউন ভেসে আসতে লাগলো। সাথেসাথেই ভেতরটা ধক করে উঠলো আমার। কারণ এটা বর্তমানে কোনো গানের টিউন নয় এটা আমার ফোনের রিংটোন যা জানান দিচ্ছে রেজাল্ট পাবলিশড হয়ে গিয়েছে সাথে আমি ডাব্বাও মেরে গিয়েছি। কাঁপাকাঁপা হাতে ফোনটা হাতে নিতেই স্ক্রিনে বড়বড় অক্ষরে রাত্রির নামটা ভেসে উঠলো যা দেখে আমার মুখে হাসি ফুটে ওঠার বদলে এই প্রথম এক পালা কালো মেঘ এসে জমাট বাঁধলো। এভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যেই না রিসিভ করবো ওমনি লাইন কেটে গেলো। শেষ মুহূর্তে এসে কল রিসিভ করতে এলে যা হয় আরকি। ঠোঁট উল্টে ফোনটা সাইডে রেখে “বাঁচা গেছে” ভেবে কেটে পড়তে যাবো তার আগেই আবারও রাত্রি কল করে বসলো। ইচ্ছে তো করছে দু-তিনটে থাপ্পড় বসিয়ে দেই শাঁকচুন্নিটাকে।
.
তবুও আপাতত রাগটাকে কন্ট্রোল করে প্রচন্ড নার্ভাস নেস নিয়ে রিসিভ বাটন সোয়াইপ আপ করে ফোনটা নিজের কানে ধরলাম আমি।
রাত্রি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে হাসি হাসি ভাব নিয়ে বলতে লাগলো,
—- এই কল রিসিভ করতে এতো দেড়ি করলি কেনো? জানিস আমি ৩.৮৩ পেয়েছি। আজ আমি হেব্বি খুশি ট্রিট দিবো বাসায় যাই আগে।
.
ওর কথার মাঝেই আমি আতংকিত হয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
—- আর আমি?
.
সাথেসাথেই হাসি থামিয়ে মুখি ভার করে ফেললো রাত্রি। যেনো অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে কিছুটা এমন ভাব নিয়েই রাত্রি বললো,
—- আসলে অনন্যা, তোর রেজাল্ট টা আশাজনক হয় নি রে। আমি ভাবিও নি তুই এরকম রেজাল্ট করবি। টেনশন হচ্ছে বাসায় কি বলবি তুই!
.
রাত্রির কথায় গলা আগের থেকেই দ্বিগুণ শুকিয়ে এলো আমার। চোখেমুখে চিন্তার ছাপ ফেলে জিহবা দ্বারা ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলাম,
—- তাও ক…কতো? ফেইল টেইল করেছি নাকি রে?
.
ওমনি রাত্রি এক চিৎকার দিয়ে আমার কানের পর্দা ফাটিয়ে বললো,
—- ৪.০০ পেয়েছিস তুই অনুউউউউ…..! আমি জাস্ট মজা করছিলাম। ট্রিট তো আমি নেবো ওয়েট কর আসছি আমি।
.
বলেই লাইন কেটে দিলো রাত্রি। আমি এখনো মুখ হা করে বসে রয়েছি। আমি যেনো নিজের কান কেও বিশ্বাস করতে পারছিনা। আমি ৪.০০ এর মধ্যেই ৪.০০ পয়েন্ট ই পেয়েছি। এও সম্ভব?
রুশো ভাইয়া আমায় হা করে থাকতে দেখে ঘাবড়ে গেলো। ভ্রু কুঁচকে চিন্তিত মুখে ভাইয়া বললো,
.
—- কিরে ছুটকি, রেজাল্ট জেনেছিস? কি বললো এটম বোম্ব?
.
আমি রুশো ভাইয়ার প্রশ্নের কোনো জবাবই দিতে পারলাম না। মুখ হা রেখেই হাতের চারটে আঙুল মেলে ইশারায় বুঝালাম যে আমি ৪.০০ পয়েন্ট পেয়েছি। আমার ইশারা দেখে রুশো ভাইয়া চোখ বড়বড় করে দুহাতে মুখ ঢেকে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
.
—- নেহিইইইইই! চার টে সাবজেক্টে ফেইল….! না না আমি মানি না। তোর ভার্সিটির টিচার্সদের সাথে আমি দেখা করবো। ওরা ঠিক করে খাতা কাটতে জানে না। আমার ছুটকি চার চারটে সাবজেক্টে ফেইল করার মতো স্টুডেন্টই না।
.
বলেই চট করে দাঁড়িয়ে পড়লো রুশো ভাইয়া। ততক্ষণে ভাইয়ার চিৎকারের আওয়াজ কানে পৌঁছায় আম্মু আব্বু আর ভাইয়াও আমাদের কাছে চলে এসেছে। রুশো ভাইয়া কোন কথার কোন মানে বুঝলো এটা! আমার তো মাথা ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে। রুশো ভাইয়াকে এখন না আটকালে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে ফেলবে তাই চটজলদি ভাইয়ার সামনে দুহাত মেলে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি।
আম্মু তৎক্ষণাৎ এসে ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন ছুড়লো। সাথে প্রশ্ন শুরু করলো আব্বু আর অগ্নি ভাইয়াও।
.
—- আরে কি হয়েছে রুশো? চেচালি কেনো?(আম্মু)
.
—- কিরে চুপ করে আছিস কেনো?(আব্বু)
.
—- এইরে, অনুর রেজাল্ট শুনে চেঁচালি নাকি? তাহলে শিওর ডাব্বা মারছে। (অগ্নি)
.
আমি সবাইকে থামতে বলে কিছু বলতে যাবো তার আগেই ওদের কোনো প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রুশো ভাইয়া আমায় থামতে ইশারা করে বললো,
—- না ছুটকি আমাকে আটকাস না। ওরা পঁচা করে খাতা কেটে পঁচা পঁচা নম্বর দিবে আর আমার ছুটকি বকা শুনবে? না তা হতে পারে না।
.
রুশো ভাইয়ার কথা শুনে অগ্নি ভাইয়া নিজের কপালে হাত দিয়ে চাপড় মেরে বললো,
—- কিহ? অনু ফেইল করছিস তুই? আমি তো জাস্ট মজা করে আস্ক করছিলাম আর সেটাই সত্যি হয়ে গেলো?
.
এবার আর আমার সহ্য হলো না। নিজের শরীরে যতটো শক্তি বিদ্যমান তার সবটা দিয়ে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি,
—- স্টঅঅঅঅঅঅপপপ……!!!!
আমি ফেইল করি নিইইই…..! আমি পুরো ৪.০০ পয়েন্টই পেয়েছি। ৪ সাবজেক্টে গোল্লা খাইনি।
.
আমার চিৎকারে সবাই একসাথে চুপ হয়ে গেলো। মন দিয়ে আমার বলা বাক্যটির অর্থ বুঝতে পেরে একে অপরের দিকে এক পলক চোখ বুলিয়ে নিয়ে অগ্নি ভাইয়া আর রুশো ভাইয়া দুজনে একসাথে খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো,
—- হুউউররররেএএএ!
.
রুশো ভাইয়া নিজের জিহবায় নিজেই কামড় মেরে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলে উঠলো,
—- ইশশসরে সরি ছুটকি একচুয়ালি তোর টেনশন দেখে আমিও টেনশন করতে শুরু করে দিয়েছিলাম যার জন্য তোর দেখানো হাতের চার আঙুল দেখে চারটা সাবজেক্ট ফেইল ভেবে নিয়েছিলাম।
.
আমি ঠোঁট উল্টে ভ্রু কুঁচকে মুখ ফুলিয়ে রুশো ভাইয়ার দিকে তাকাতেই ভাইয়া এক হাত দিয়ে কান ধরে “সরি” বলে করুন চোখে ভাইয়া তাকালো আমার দিকে। আমি রুশো ভাইয়ার এমন অসহায় ফেইস দেখে ফিক করে হেসে ফেললাম। ভাইয়ার নাক টেনে দিতেই ভাইয়া আমায় ধরে খুশিতে লাফাতে শুরু করলো। এদিকে আম্মু-আব্বু এতোক্ষণে খুশিতে মিষ্টি বের করে আমাদের খাইয়ে দিলো। আব্বু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,
.
—- এভাবেই মন দিয়ে পড়াশুনো কর! অনেক বড় হ মা।
.
আমি চোখের ইশারায় সম্মতি জানালাম। এর মাঝেই নীবিড় ভাইয়া-নিত্য আপু সাথে রাত্রি সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো। নীবিড় ভাইয়া দুহাত পকেটে গুঁজে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠলেন,
.
—- পরিশ্রম করে রোজ রাতে পড়ালাম আমি আর ক্রেডিট নিচ্ছে এই স্টুপিড টা?
.
উনার আমায় এভাবে ভেঙিয়ে বলাতে নিমিষেই মুখ ফুলিয়ে ভ্রু কুঁচকালাম আমি। মানলাম শেষের কয়েক মাস উনি আমায় পড়িয়েছেন যেহেতু আমি অগ্নি ভাইয়াকে ভয় পাইনা বলে ওর কাছে পড়ি না। কিন্তু তাই বলে কি সব ক্রেডিট উনার? হাহ! উনি যতই ভালো পড়াক আমি না পড়লে কি আদৌ এতো ভালো রেজাল্ট করতে পারতাম? অবশ্যই না।

আম্মু এগিয়ে গিয়ে নীবিড় ভাইয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
—- এটাও ঠিক। আমাদের বাবুই না পড়ালে এতো ভালো রেজাল্ট হতোই না।
.
আম্মুরও উনাকে সাপোর্ট করায় ফোলা মুখটা আরোও দ্বিগুণ ফুলে উঠলো আমার। নাকে ডান হাত দিয়ে ঘোষা মেরে দাত কটমট করে বললাম,
—- এখনই যদি কয়েক সাবজেক্ট এ ফেইল করতাম তখন ঠিক উল্টো টা বলতে যে ” বাবুই এতো ভালো করে পড়ালো অথচ মেয়ে আমার তাকে ফাঁকি দিতে যেয়ে নিজেই ফেইল করে বসলো!”
.
—- আহহা! এরকমটা হওয়ার চান্স ০% ও নেই। কজ আমি পড়িয়েছি, পড়া না করিয়ে কখনো ছাড়ি নি তোমায়। হোয়াট এভার, মার্কস খুব একটাও ভালো হয়নি। নেক্সট টাইম প্রত্যেকটা সাবজেক্টে ৯৫% মার্কস আমি দেখতে চাই।
.
বলেই সোফায় গা এলিয়ে দিলেন উনি। নিত্য আপু আমায় কংগ্রাচুলেশনস বলে বসে পড়লো উনার পাশেই।
রাত্রকে উনাদের সাথে দেখে আমি প্রশ্ন ছুড়লাম,
.
—- তুই আপুদের সাথে আসলি কিভাবে?
.
রাত্রি আমার মাথায় আস্তে করে চাটি মেরে দিয়ে বললো,
—- গেইটের বাইরেই আমার রিক্সা আর ভাইয়ার বাইক দুটোই দু দিক থেকে এসে একসাথেই থেমেছে। হোয়াট আ কোইন্সিডেন্ট না?
.
আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম,
—- হোয়াটএভার 😒।
.
🌸
.
রাত ১১ টা বেজে ১৬ মিনিট……

পা টিপেটিপে নিঃশব্দে রুশো ভাইয়ার ঘরে প্রবেশ করলাম আমি। রুশো ভাইয়া রকিং চেয়ারে আরাম করে বসে বা হাতে ডায়েরি নিয়ে তাতে ডান হাত দিয়ে কলম ঘুরিয়ে কিছু একটা লিখছে।
বর্তমানে ভাইয়ার ঘরে এমন চোরের মতো চুপিচুপি ঢোকার উদ্দেশ্য ভাইয়া ডায়েরিতে ঠিক কি লিখছে তা দেখা।
যেহেতু ভাইয়া জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে রকিং চেয়ারে বসে রয়েছে সেহেতু আমি পেছন থেকে নিঃশব্দে গেলে ভাইয়ার টের পাবার কথা নয়। সেই হিসেবেই চুপিচুপি ভাইয়ার পেছনে গিয়ে দাড়িয়ে পড়লাম আমি। উঁকি ঝুঁকি মেরে বোঝার চেষ্টা চালাতে লাগলাম ঠিক কি লিখছে ভাইয়া ডায়েরিতে।
.
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ডায়েরির পাতার ভাঁজে চোখ বুলাতেই আমার চোখ একেবারে ছানাবড়া।
রাত্রি লাল রং এর একটা কামিজ পড়ে চোখেমুখে বিরক্তির রেশ ফুটিয়ে নিজের অবাধ্য চুলগুলো হাতখোপা করছিলো ঠিক তখনকারই ছবি ডায়েরির পাতায় বসানো। আজকেই রাত্রি এই ড্রেসটা পড়ে এসেছিলো। আর যতদূর সম্ভব এটা দুপুরের খাবারের আগ মুহুর্তে ছবি।
তার ঠিক নিচেই সামান্য স্পেস রেখে কিছু বাক্য লিখছে রুশো ভাইয়া। অবাক করা বিষয় এই প্রথম রুশো ভাইয়াকে আমি ইংলিশ, থাই, স্প্যানিশ ইত্যাদি ভাষা ব্যতীত শুদ্ধ বাংলায় লিখতে দেখছি। আর একটু ভালো করে উঁকি ঝুঁকি মারতেই লেখাগুলো দৃশ্যমান হলো আমার।
.
“তার অবাধ্য চুলের বাহার
যেনো হৃদয় মাঝের গড়ে তোলে তীব্র হাহাকার!
তার অবিশ্রান্ত চোখের ঘায়েল করা দৃষ্টি,
যেনো বুকের মাঝে ঝড়ায় হাজারো প্রেমে বৃষ্টি!

একি তবে ভালোবাসা?
লুকায়িত শতশত সুপ্ত আশা!
বলতে কি পারবো কভু
মুখ ফুটে তুমি শুধু,
ভালোবাসা আমার…!
তুমিই যে প্রেম আমার….!”

—- (আয়ানা জাহান নুসরাত 💕)
.
রুশো ভাইয়ার লেখনী দেখে আমি পুরাই শকড। নিশ্চয় ভাইয়াকে ভূতে ধরেছে। নাহলে এরকম লেখা কিনা ভাইয়ার দ্বারাও লেখা সম্ভব? ভাইয়া স্টোরি লেখে তবে রোমান্টিক স্টোরি না, বিশেষ করে একশন অথবা রহস্য টাইপ স্টোরি। কিন্তু ভাইয়া যে প্রেমে পড়ে এবার রোমান্টিক কবি হয়ে গিয়েছে তা আমি আজ এসে জানলাম?
উত্তেজনা এতোটাই হাই লেভেলের হয়ে গেলো, যার দরুন মুখ থেকে অটোম্যাটিকালি বেরিয়ে গেলো,
.
—- ইয়া আল্লাহ! একি দেখলাম আমি?
.
পেছন থেকে আমার কন্ঠস্বর কানে পৌঁছায় হকচকিয়ে ডায়েরি বন্ধ করে এক লাফ মেরে উল্টো দিকে ঘুরে দাড়িয়ে পড়লো রুশো ভাইয়া। আমায় দেখে চমকে উঠে ভাইয়া বললো,
.
—- ছুটকি!!!! তুই..! কখন এলি?
.
আমি নিজের বোকামির জন্য নিজেই নিজের মাথায় চাটি মেরে দিলাম। কিন্তু ধরা পড়ে যাবার পরও মিথ্যে বলাটা নিছক বোকামি বলে দাঁত কেলিয়ে বললাম,
.
—- হেহে, দেখে ফেলেছি……!😁
.
রুশো ভাইয়া চোখ বড়বড় করে বললো,
—- কি দেখে ফেলেছিস?
.
আমি আবারও দাঁত কেলিয়ে দিয়ে বিছানায় বসতে বসতে বলে উঠলাম,
—- আমার কাছে লুকিয়ে আর কি হবে? যা দেখার দেখে ফেলেছি আমি। এখন বলো প্রোপোজ কবে করছো আমার বেস্টুকে?
.
ভান্ডা ভালো মতোই ফুটে যাওয়ায় হতাশ হয়ে মুখ কাচুমাচু করে আমার পাশে বসে পড়লো ভাইয়া। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে করুন চোখে ভাইয়া বললো,
—- ও আমায় ভালোবাসে না রে ছুটকি!
.
আমি ভাইয়ার জবাবে বোকা বনে গেলাম। ভ্রু কুঁচকে বললাম,
—- ওমা এ আবার কেমন কথা? ভালোবাসে না তো কি হয়েছে বিয়ে হলে অবশ্যই বাসবে। তুমি বিয়ের প্রপোজাল সময় থাকতেই দিয়ে দাও ভাইয়া। নাহলে দেখবে অন্য কারো সাথে টুপ করে বিয়ে হয়ে যাবে রাত্রির।
আর কাল তো রাত্রির বার্থডে! প্রোপজ করার জন্য পার্ফেক্ট একটা ডে। আমি তো হাল্কাফুল্কা সারপ্রাইজ প্লানিং করেই রেখেছিলাম বাকিটা নাহয় তুমিই করে নাও।
.
আমার কথায় ভাইয়ার মুখে খুব কাছের কিছু হারিয়ে যাবার ভয় দেখা দিলো। ভাইয়া একরাশ ভয় নিয়ে বললো,
—- সত্যি বলছিস তুই? কিন্তু যদি আবার নাক ফাটিয়ে রিজেক্ট করে দেয়?
.
চলবে……………….💖

#প্রেম_আমার♥
#পার্ট-৫৬♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
.
🌺
.
পশ্চিম আকাশে সূর্যের ডুবি ডুবি ভাব। হাল্কা হাল্কা মেঘের বুক চিরে কিরণ ছড়িয়ে দিচ্ছে রক্ত রাঙা সূর্যটা। আর বেশি সময় নেই হয়তো বা ২০ কি ১৫ মিনিটের মাথায় অস্ত যাবে সে।

রুশো ঘড়ি দেখছে, এখন সময় ৬ টা বেজে ৪০ মিনিট। এতোক্ষণে তো তার কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটির চলে আসা উচিত ছিলো। লেইট করছে সে। আধাঘন্টা কি এক ঘন্টা লেইট করলেও কোনো সমস্যা ছিলো না রুশোর। কিন্তু সেখানে ২ ঘন্টা পেড়িয়ে যাচ্ছে অথচ রাত্রির কোনো খবরই নেই। তবে কি সে আসবে না?
আচ্ছা একটা ফোন করে তো দেখাই যায়, কিন্তু আফসোস রুশোর কাছে তো রাত্রির নম্বর টাও নেই। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে কোলের ওপর থেকে আধফোলে বেলুনগুলো সরিয়ে ফোনটা হাতে নিলো রুশো। উদ্দেশ্য অনন্যাকে ফোন করে রাত্রির খোঁজ জানা। সেই ২ ঘন্টা আগে অনন্যারা তাকে এই ক্যাফেতে বসিয়ে ডেকোরেশনে হেল্প করে শপিং মলে গিয়েছে। পরের মাসের প্রথম সপ্তাহেই অগ্নি-অনন্যার, নিত্য-নীবিড়ের সাথে বিয়ে। তাই কেনাকাটাও রয়েছে বেশ।
.
দুবার কল করতেই ওপাশ থেকে অগ্নি ফোনটা রিসিভ করে বলে উঠলো,
—- কিরে রুশো, প্রোপোজ করলি? কি বললো রাত্রি?
আর অনু শাড়ি দেখছে তাই আমি রিসিভ করলাম।
.
অগ্নি কথার জবাবে ঠিক কি বলবে, তা রুশোর জানা নেই। হ্যা বললে সেটা হবে মিথ্যে আবার না বলতে গেলেও কথাটা গলায় জট পাকিয়ে আটকেই যাচ্ছে। ওষ্ঠদ্বয় কাঁপছে তার। নিজেকে সামলে নিয়ে রুশো বললো,
—- ন…না ব্রো। ও আসে নি।
.
রুশোর এই ছোট্ট কথাটাই অগ্নিকে চরমভাবে হতাশ করতে সক্ষম ছিলো। তাই তো নিমিষেই হাসিমাখা মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো তার। কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে পাল্টা প্রশ্ন করে বসলো অগ্নি,
—- তার মানে কি রুশো? আমরা তোকে ২ ঘন্টা আগে ক্যাফেতে ছেড়ে এসেছি। এতোক্ষণ ধরে অপেক্ষা করেছিস তুই? একবার জানাবি তো! অনু নাহয় খোঁজ নিয়ে জানিয়ে দিতো!
.
অগ্নি চিন্তা করছে রুশোকে নিয়ে, যেটা এই মুহুর্তে একদমই ভালো লাগছে না রুশোর। অগ্নির তো এখন হাসি খুশি থাকার কথা। বিয়ের শপিং বলে কথা, নিত্যর গায়ে শাড়ি ধরে ঠোঁট কামড়ে ভ্রু কুঁচকে একের পর এক শাড়ি দেখে চুজ করবে। সেই জায়গায় কিনা তার মুখে হতাশার চিহ্ন। না, এতো শোভা পায় না মোটেই। তাই রুশো তৎক্ষণাৎ হাসার চেষ্টা করলো, তাতে সফল ও হলো বটে। হাসিমুখেই সে বললো,
.
—- ছুটকি কে জানিয়ো না ব্রো! যদি জানতে পারে ওর ডাকে রাত্রি আসে নি তবে কষ্ট পাবে ও। আর মজার কাহিনী কি জানো? আমি এতোক্ষণ অপেক্ষা করার বদলে স্টোরি লিখতে বসেছিলাম, টেরই পাই নি যে ২ ঘন্টা পেড়িয়ে গেছে। আমি আসছি ব্রো তুমি একদম টেনশন করো না।
.
ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো অগ্নি। সে জানে এই মুহুর্তে রুশো নাটক করে হাসছে। এই হাসি কৃত্রিম। এতে প্রাণ নেই। এই হাসি নির্জীব, বড্ড স্বাদহীন! রুশোর প্রাণ খোলা হাসি চেনে অগ্নি। রুশো আর যাই পারুক তার কাছে মিথ্যে বলতে পারে না। মিথ্যে বললেও ঠিকই সে ধরে নিতে পারে। যার কারণে সেই ছোটতেই বকার খাবার ভয় না পেয়ে মিথ্যে বলাই ছেড়ে দিয়েছে অগ্নির কাছে রুশো।
অগ্নি নিজেকে সামলে নিলো ছোট্ট করে “আয় তবে!” বলেই ফোনের লাইন কেটে দিলো। তার মতে রুশোকে মনমরা হয়ে থাকাটা একেবারেই মানায় না। ওর মুখভার হলে যেনো মনে হয় তার আশেপাশের সবকিছুই প্রাণহীন। তার প্রানবন্ত ছন্দময় আচার আচরণ হাসতে বাধ্য করে সবাইকে। আর আজ তারই কিনা মন খারাপ?
.
🍂
.
সাথে করে আনা ভ্যানিলা কেকটার দিকে একবার ঝুঁকে তাকালো রুশো। কি সুন্দর জ্বলজ্বল করছে “এটম বোম্ব” লেখাটা! অনন্যা বলেছিলো এই লেখাটা দেখে নাকি নির্ঘাত তার নাক আবারও ফাটিয়ে টমেটো বানিয়ে দেবে রাত্রি। তখন রুশো হেসে বলেছিলো “ওর স্পর্শটা যে ফ্রি ফ্রি পাচ্ছি এটাই কি অনেক নয়? হোক সেটা ঘুষি কিংবা অধরের স্পর্শ!”
কথাটা মনে পড়েতেই দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো রুশো। চোখ দুটো বুজে জোড়ে একটা শ্বাস নিয়ে ডায়ামন্ড রিংটা পকেটে পুরে উঠে দাঁড়ালো সে। রিংটা তার এটম বোম্বের পছন্দ হবে কি না এই নিয়ে কত ডিপ্রেসড ছিলো সে, অথচ রিংটা দেবার সুযোগই হলো না তার।

কেকটা আবারও তার পূর্বের স্থানে রেখে তার সাজানো ব্যানার আর বেলুনগুলোয় একবার হাত বুলিয়ে হাটা ধরলো সে বাহির পথের উদ্দেশ্যে। গ্লাসের তৈরি দরজাটা টেনে খুলতে নিলেই থমকে গেলো রুশো। ওইতো সে আসছে, তার প্রিয়, তার এটম বোম্ব আসছে। কিন্তু একি আজ তার প্রিয়তম শাড়ি পড়েছে! আজ কি শুধুই জন্মদিন বলেই শাড়ি পড়েছে নাকি অন্য কিছু?
প্রশ্নটা বার কয়েক মনের মাঝে আওড়ে নিয়ে উল্টো পা ফেলে পিছিয়ে এলো রুশো। আবারও তার আগের জায়গায় ফেরত এসে কেকটা বের করে ক্যান্ডেল গুলো প্যাকেট থেকে বের করে কেকের চারিপাশ দিয়ে লাগিয়ে দিলো সে। এর মাঝেই দু জোড়া পায়ের প্রবেশ ঘটলো ক্যাফেতে। রুশো তৃষার্ত দৃষ্টিতে রাত্রির দিকে তাকিয়ে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। যেনো এতোক্ষণের সাধনার ফল এই মাত্রই পেলো সে। অথচ তার প্রিয়তম’র সাথেই যে আরো একজনও এসেছে তার খেয়ালই রাখেনি রুশো। রাত্রি ব্লু কালারের জরজেট শাড়ি তার সাথে ব্লু পাথরের সেট পড়েছে। চুলগুলো এক সাইডে এনে রাখা। এতোটুকু পর্যবেক্ষণ করতেই রুশোর সামনে এসে দাড়ালো রাত্রি। রুশোকে দেখে অবাক হয়ে সে বললো,
.
—- আপনি যে! অনন্যা কোথায়?
.
রাত্রির প্রশ্নের কোনো জবাব দিতেই পারলো না রুশো। মুগ্ধ দৃষ্টিতে একই ভাবে চেয়ে রইলো সে রাত্রির ওই উজ্জ্বল মুখখানায়। রুশোর কোনো জবাব না দেওয়ায় রাত্রি আবারও প্রশ্ন করবে তার আগেই পাশে থাকা ব্যক্তিটি রাত্রির দিকে প্রশ্ন ছুড়লো,
.
—- রাত্রি কে ও?
.
পাশে থাকা ব্যক্তিটির উপরোক্ত প্রশ্নে টনক নড়লো রুশোর। বার কয়েক ছেলেটির দিকে তাকিয়ে তাকে চেনার চেষ্টা করে অবশেষে ব্যার্থ হলো সে। রাত্রি হাসিমুখে পরিচয় করিয়ে দেবার খাতিরে বললো,

—- উনি হচ্ছে অনন্যার কাজিন রুশো আহমেদ! আর রুশো ভাইয়া, ইনি হচ্ছেন আমার কাজিন দিদার কাবির। কালই ঢাকা থেকে রাজশাহী এসেছেন। উনার সাথেই ছিলাম এতোক্ষণ তাই লেইট হয়ে গিয়েছে। আসলে আমার ফোনটা হঠাৎ কাজ করছে না তাই অনন্যাকে জানাতে পারিনি।
.
রুশো ব্যাপারটা গায়ে মাখালো না, হাসিমুখেই দিদারের সাথে হ্যান্ডশেক করে কুশল বিনিময় করে বসতে বললো তাদের।
রাত্রি আবারও রুশো বাদে কাউকে দেখতে না পেয়ে প্রশ্ন করলো,
—- বাকিরা কোথায়?
.
রুশো কিছুক্ষণ কি বলবে ভেবে নিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
—- আসলে এটম বোম্ব! অনেকক্ষণ ধরেই ছিলো সবাই। তুমি আসছো না, কোনো খোঁজ নেই তাই কাজ থাকায় মলে গিয়েছে। আর যেহেতু আমার কোনো কাজ ছিলো না তাই আমাকেই তোমার অপেক্ষা করতে বলেছে সাথে সেলিব্রেশনও।
.
রুশোর মুখে “এটম বোম্ব” ডাক শুনায় ভ্রু কুঁচকালো দিদার, রুশো সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বললো,
—- মে আই এটম বোম্ব? অনন্যা কিন্তু খুব সাধ করে সবটা সাজিয়েছে৷ ওর মন ভেঙোনা প্লিজ।
.
রুশোর করুন গলায় করা রিকুয়েষ্ট ফেলতে পারলো না রাত্রি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আজ রাজি হলো সে। অন্য সময় হলে হয়তো সোজাসুজি না বলে বসতো কিন্তু এতোসব এরেঞ্জমেন্ট দেখে বিবেকে বাঁধা দিলো রাত্রির। হাজার হোক তার জন্যই এতোকিছু করেছে অনন্যা, এখন সে যদি এসব ফেলে চলে যায় তবে বড্ড কষ্ট পাবে মেয়েটা। সাথে এতোকিছুর অপচয়ও হবে।
.
🌹
.
—- ওহ শাট আপ অনন্যা, বিয়েতে কেউ ব্লাক কালারের শাড়ি পড়ে না। ব্লাক বাদে আদার্স কালার নাও। দেখো ব্লু আছে, গ্রিন আছে, রেড আছে, গোল্ডেন আছে….
.
—- আহহা কিন্তু আমি তো ব্লাকই পড়বো! নাহলে বিয়েই করবো না। ভাইয়ায়ায়া….! তোর এই পঁচা বেস্টু কম ভাই বেশি সাদা বিলাইকে বল যাতে আমায় বিয়েতে ব্লাক শাড়িই পড়তে দেয়। নাহলে আমি বিয়েই করবো না।
.
এতোক্ষণ ধরে শাড়ি চুজ করার বদলে কালার নিয়েই তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে ফেলায় অতিষ্ঠ হয়ে সেলসম্যান মাথায় হাত রেখে ধপ করে বসে পড়েছেন শাড়ির পাহাড়ের ওপরই। নিত্য আপু পাশের মলে গিয়েছে আম্মুদের সাথে। এদিকে অগ্নি ভাইয়া কি করবে ভেবে কূল পাচ্ছে না। অনেক ভেবে সামনে থেকে একটা ডিপ রেড বেনারসি হাতে নিয়ে ভাইয়া বললো,
.
—- ওহ ওয়াও অনু! এই শাড়িটা দেখে। এটা পড়লে একেবারে কুইন লাগবে তোকে।
.
আমি ভাইয়ার হাত থেকে টান মেরে শাড়িটা আগের জায়গায় রেখে দিয়ে মুখ ফুলিয়ে বললাম,
—- দরকার নেই কোনো কুইন টুইন হওয়ার। ব্লাক পড়লে যদি আমাকে (witch) ডাইনীও লাগে তাও আমি ব্লাকই পড়বো। তুইও এই সাদা বিলাইয়ের মতোই পঁচা। রুশো ভাইয়াকে আসতে দে খালি, ভাইয়া ঠিকই আমায় নির্দ্বিধায় ব্লাক পড়তে বলবে।
.
একটু থেমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে পড়ায় চটজলদি অগ্নি ভাইয়ার দিকে প্রশ্ন ছুড়লাম আমি,
—- এই ফোন টা দে। রুশো ভাইয়া কি কল করেছিলো? রাত্রিকে প্রোপজাল দিয়েছে কি রুশো ভাইয়া? রাত্রি কি বললো বিনিময়ে? নিশ্চয়ই এক পায়ে খাড়া হয়ে রাজি হয়ে গিয়েছে তাইনা?
.
আমার প্রশ্নে নিমিষেই মুখে ঘন কালো মেঘ এসে ভিড় জমালো ভাইয়ার। ভাইয়া জানে আমার কাছে কিছু লুকিয়ে পার পাবে না তাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে জোড়ে একটা শ্বাস টেনে বললো,
—- রাত্রি যায় নি অনু। হয়তো কোনো কাজে আটকে পড়েছে। তুই মন খারাপ করিস না বোন প্লিজ।
.
ভাইয়ার কথায় ঠাস করে হাত থেকে ব্যাগটা পড়ে গেলো আমার। তাহলে এতোক্ষণ ধরে রুশো ভাইয়া কি করলো? রাত্রি তো যায় নি! না জানি কতোটা কষ্ট পেয়েছে রুশো ভাইয়া। আর সময় নষ্ট করা যাবে না, এক্ষুনি যেতে হবে আমায়, এক্ষুনি!
কথাগুলো মনে মনে বলে নিয়ে শাড়ি গুলো রেখে দিয়ে ব্যাগটা হাতে তুলে নিলাম আমি। মল থেকে বেড়িয়ে যেতে লাগলাম তৎক্ষণাৎ। আমার পেছন পেছন ডাকতে ডাকতে ছুট লাগালো অগ্নি ভাইয়া সাথে নীবিড় ভাইয়াও।
.
🍁
.
ক্যান্ডেল নিভিয়ে কেকটা কেটে নিয়ে রুশোর হাতে এক পিস আর দিদারের হাতে এক পিস ধরিয়ে দিলো রাত্রি। এক টুকরো কেক মুখে নিয়ে খেতে লাগলো সে। তার পছন্দের ভ্যানিলা কেকই অর্ডার দেওয়া হয়েছে। চকলেট কেক ততটা খারাপ না লাগলেও ওর ভ্যানিলাই বেশি ভালো লাগে। সেই সুবাদেই হয়তো অনন্যা নিজের চকলেট কেক পছন্দের সত্ত্বেও ভ্যানিলা ওর্ডার করেছে। কিন্তু রাত্রি অবাক হলো কেকের ওপরে “এটম বোম্ব” লেখাটা দেখে। এটা যে রুশো ছাড়া আর কারোও কাজ নয় তা খুব ভালো করেই জানে সে। কিন্তু পাবলিক প্লেসে তাও আবার কাজিনের সামনে রুশোর নাকটা ফাটানো পসিবল না। তাই চুপ করেই রইলো সে।
.
রাত্রি আজ রুশোর ব্যবহারে বেশ অবাক হচ্ছে। কোনো লাফালাফি নেই, শয়তানি ফাজলামি নেই। কি সুন্দর শান্ত হয়ে রয়েছে সে। কেমন যেনো অদ্ভুত লাগছে রুশোকে আজ তার। এই স্বভাবটা রুশোর সাথে যেনো বড্ড বেমানান। ওকে তো বাচ্চামিতেই মানায়।
.
রুশো মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করে যাচ্ছে। আজ যে করেই হোক তাকে নিজের মনের কথাটা বলতে হবে রাত্রিকে। এমনিতেই অনেক দেড়ি হয়ে গিয়েছে আরও দেড়ি হয়ে গেলে হয়তো শেষমেশ হারিয়ে ফেলতে হবে তার ভালোবাসাকে। তাই নিজেকে শক্ত করে জোড়ে একটা শ্বাস টেনে আচমকাই রাত্রি হাত ধরে বসলো সে। হঠাৎ এভাবে হাত ধরায় চমকে উঠলো রাত্রি। এদিকে ভ্রু কুঁচকে এলো দিদারের।
রুশো কারো দিকে কোনো পাত্তা না দিয়ে রাত্রির সামনে হাটু গেড়ে বসে পড়লো। কাঁপাকাঁপা গলায় সে বললো,
.
—- এটম বোম্ব! তোমায় আমার অনেক জরুরী কিছু বলার আছে।
.
রুশোর থেকে খুবই সাবধানে হাতটা ছুটিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাত্রি বললো,
—- কি বলবেন বলুন! আর এভাবে হাটু গেড়ে বসলেন কেনো?
.
রুশো নার্ভাসনেসের বশে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। বার কয়েক “আমি তোমায় ভালোবাসি!” বাক্যটা মনের মধ্যে আওড়ে নিয়ে বুক ফুলিয়ে জোড়ে একটা শ্বাস টানলো সে। আমতা আমতা করে সে বললো,
.
—- je t’aime…! (France)
.
রাত্রি রুশোর বলা উদ্ভট বাক্যটা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো কিন্তু মানেটা বুঝলো না সে। এরকম কোনো শব্দ ভোকাবুলারিতে আজন্মেও পরেছে কিনা সন্দেহ রাত্রির। অতঃপর কোনো অর্থ বুঝতে না পেরে রাত্রি বললো,
—- মানে?
.
রুশো জিহবায় কামড়ে ধরলো । নিজের বোকামির জন্য বড্ড লজ্জিত সে। সে তো জানে রাত্রি ফ্রেঞ্চ ভাষা বুঝবে না। আর ঠিক সেই জন্যই নার্ভাসনেসের ফলে যে বাংলা বাক্যটা মুখেই আসতে চাইছে না তার, কিভাবে বোঝাবে সে এই কথাটা রাত্রিকে? মনে মনে “ইউ ক্যান ডু ইট রুশো!” বলে খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে আবারও বলে উঠলো রুশো,
—- ti amo….! (Italian)
উপসস সরি! আই মিন, Te quiero! (spanish) আরে ধ্যাত..! কি বলছি আমি?
.
বলে নিজেই নিজের মাথায় চাটি মেরে দিলো রুশো। এদিকে রাত্রি আর দিদার একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। তারা রুশোর কান্ড কারখানার কোনো মানেই খুঁজে পাচ্ছে না। না বাংলা, না হিন্দি আর না ইংলিশ! কোনো ভাষার সাথেই মিল পাচ্ছেনা তারা রুশোর বলা বাক্যগুলোর। রুশোর এরকম উল্টোপাল্টা উদ্ভট ভাষায় বলা দুর্বোধ্য বুলিগুলোয় চরম বিরক্ত হয়ে গেলো দিদার। সাথে রাত্রির চোখেমুখেও বিরক্তি স্পষ্ট। একটু জোড়েই এবার সে বললো,
.
—- কখন থেকে উল্টোপাল্টা কথা বলে যাচ্ছেন। কি বলছেন বলুন তো? রাত হয়ে এসেছে। যেতে হবে আমাদের।
.
রাত্রির ধমক খেয়ে বুকটা ধক করে উঠলো রুশোর। কি করবে ভেবে না পেয়ে চট করে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। এবার যে তাকে বলতেই হবে, যে করেই হোক বলতেই হবে। কিন্তু রাত্রির চোখের দিকে যে তাকাতেই পারছে না রুশো। আর কোনো পথ খুঁজে না এয়ে হুট করেই রাত্রিকে জড়িয়ে ধরলো সে। রাত্রির হাইট রুশোর প্রায় কাধ পর্যন্ত হওয়ায় সহজেই রুশোর হৃদপিন্ডের ডিবডিবে ধ্বনি কানে আলোড়ন সৃষ্টি করলো তার। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলো সে।
রুশো বার কয়েক জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো,
.
—- আমি জানি না তুমি এর প্রতিউত্তরে কি বলবে কিন্তু এটাই সত্যি, আ…আমি তোমায় ভালোবাসি। প্রথম দিন তোমায় দেখেই এই অনুভূতি মনের কোণে নাড়া দিয়েছে আমার। কিন্তু বুঝতে পারে নি। শুধুমাত্র ভালোলাগা ভেবে এড়িয়ে চলে গিয়েছি সেই অনুভূতি। কিন্তু না সেটা শুধুমাত্র ভালোলাগা ছিলো না, ধীরে ধীরে গ্রাস করেছে আমায় সেই অনুভূতি, খুবই তীব্রভাবে গ্রাস করেছে আমায় সেই প্রথম প্রেমের অনুভূতি।
যতোই দিন বেড়েছে ততই তোমার প্রতি দূর্বল হয়ে পরেছি আমি। একটা সময় বুঝতে পেরেছি আমি ভালাবাসা নামক অনাকাঙ্ক্ষিত মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছি, নিজের অজান্তেই নিজের সবটা দিয়ে ভালোবেসে ফেলেছি আমি তোমায়। আমি জানি না তুমি আমায় ফিরিয়ে দেবে নাকি জড়িয়ে নেবে। শুধু এতোটুকু জানি ভালোবাসি। বড্ড বেশি ভালোবাসি তোমায় আমি এটম বোম্ব। বড্ড বেশি…..!
উইল ইউ বি মাইন রাত্রি? ফরএভার?
.
কথা শেষ হতেই কেউ রুশো-রাত্রিকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো। তারা নিজেদের সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে মানুষটিকে দেখার জন্য সচেতন চোখে তাকালো। রুশোর চোখে এখনও জল টলমল করছে। রাত্রিকে কথাগুলো বলার সময় বার বার গলায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছিলো তার।
দিদার রাগে ফুঁসছে। হাতের মুঠো শক্ত করে চেপে ধরে ঝাঁঝালো কন্ঠে রুশোকে উদ্দেশ্য করে দিদার বললো,
.
—- হাউ ডেয়ার ইউ! তুমি আমার ফিয়ন্সিকে আমার সামনেই প্রোপোজ করছো? রাত্রি এই সব দেখানোর জন্য আমায় নিয়ে এসেছো তুমি? তোমায় বার্থডে সারপ্রাইজ তো আমি দিলামই তারপরও কেনো আসতে জোড় করলে? দেখলে তো কি হলো….! আর এক মুহুর্তও এখানে থাকবে না তুমি চলো আমার সাথে।
.
বলেই রাত্রির হাতটা টেনে নিয়ে যেতে লাগলো দিদার। কিন্তু বাঁধা দিলো রাত্রি। দিদারকে চোখের ইশারায় একটু থামতে বলে, রুশোর সামনাসামনি গিয়ে দাড়িয়ে পড়লো সে। রুশো এখনোও ঘোরের মধ্যে রয়েছে। দিদাদের বলা “ফিয়ন্সি” শব্দের অর্থটা খুব সহজ হলেও ভারী লাগছে তার কাছে, বড্ড ভারী।
রাত্রি রুশোর দিকে তাকিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বলতে শুরু করলো,
.
—- ভুল করেছেন আপনি আমায় ভালোবেসে। আম সরি। আমি ভালোবাসি না আপনাকে। আপনার সেটা জানার কথা। তাছাড়া বাড়ি থেকে আমার বিয়ে ঠিক করেছে দিদার ভাইয়ার সাথে। সামনে মাসে আমাদের বিয়ে। এই কথাটাই অনন্যাকে জানাতে দিদার ভাইয়াকে সঙ্গে করে এনেছিলাম আমি। কিন্তু এমন একটা সিনক্রিয়েট হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি।
মাফ করবেন আমায়। দোয়া করি আপনার জীবনে অনেক ভালো কেউ আসুক। যার সাথে ভালো থাকবেন অাপনি, আসছি….!
.
কথাটা বলেই উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো রাত্রি। দিদারকে চোখের ইশারায় “চলুন” বলেই বড়বড় পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো সে।
দিদার-রাত্রি যেতেই রুশো তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। সামনে থাকা টেবিলে সজোড়ে একটা লাথি মেরে দিয়ে বলতে শুরু করলো,
—- আমি তো জানতাম রাত্রি আমায় ভালোবাসে না তাও কিভাবে এক্সপেক্ট করলাম? আমি তো ব্রো না যে প্রোপোজ করার পর নিজের ফিয়ন্সি থাকা সত্ত্বেও সে ছুটে আসবে আমার কাছে। হাও ষ্টুপিড আই এম!
.
বলেই ব্যানার-বেলুন গুলো দেয়াল থেকে ছিড়ে ছুড়ে ফেলে দিলো রুশো। ক্যাফের একজন ওয়েটার রুশোকে এসব করতে দেখে দৌড়ে এসে আটকিয়ে বললো,
—- হোয়াট হ্যাপেন্ড স্যার! আপনারাই তো সাজালেন এখন নষ্ট করছেন কেনো?
.
রুশো কিছু বললো না। মানিব্যাগ থেকে ৫০০০৳ একটা নোট বের করে ওয়েটারের পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বেড়িয়ে যেতে হাটা ধরলো সে।
.
🌸
.
কার থেকে নেমে একপ্রকার দৌড়ে ক্যাফের সামনে গেলাম আমি। আমার পেছন পেছন ভাইয়ারাও দৌড়ে এলো তৎক্ষণাৎ। ক্যাফের গেট খুলে ঢুকতে যাবো তার আগেই দরজা ঠেলে বেড়িয়ে এলো রুশো ভাইয়া। চোখমুখ লাল হয়ে গিয়েছে একদম। চুলগুলোও কেমন এলোমেলো। শার্টের এক দিকের ইন খুলে গিয়েছে। রুশো ভাইয়াকে এরকম অবস্থায় দেখে আমি চমকে উঠে কিছু জিজ্ঞেস করবো তার আগেই ভাইয়া এক ছুটে এসে আমায় শক্ত জড়িয়ে ধরে ফোপাঁতে লাগলো। ফোপাঁতে ফোপাঁতে ভাইয়া বললো,
.
—- ও..ও ভালোবাসে না আমায় ছুটকি! ও…আমার হবে না। কোনোদিনো হবে না। তুই না বলেছিলি ও আমায় ভালোবাসবে কিন্তু না ও আমায় ভালোবাসবে না রে ছুটকি! বিন্দুমাত্রও না!
.
.
.
চলবে……………….💕