#প্রেম_প্রেম_পায়
#স্বর্ণালী_সন্ধ্যা
পর্ব বারো
১২.
মা বের হওয়ার পরই অপরাজিতা হাফ ছেড়ে বাচলো। না জানি তার কপালে কি আছে। আপাতত তো বাচলো। এখন ব্যাপারটা ডাক্তারকে জানাতে হবে। জানালে তার প্রতিক্রিয়া কি হবে তা ভেবেই কুল পাচ্ছে না অপরাজিতা। তার মায়ের মতিগতিও বুঝছে না। কি এক অশান্তি উফফ!!ভাবতে ভাবতেই ঠাস করে শুয়ে পড়লো সে।
ফায়াদ বাসায় পৌছাতেই দেখলো রাফিয়া আর রিজু বসে আছে তার রুমে। রাফিয়া তার রুমের এদিকওদিক ঘুরছে। আর রিজু বিছানায় হেলান দিয়ে ফোন দিয়ে ফোন চাপাচ্ছে। এদেরকে হঠাৎ নিজের রুমে দেখে ভ্রু কুচকে তাকালো।
‘তোরা হঠাৎ এখানে কি করিস?’
কণ্ঠ শুনে রাফিয়া ফায়াদের দিকে তাকালো। তাকিয়ে বলল,
‘ভাইয়া তোমার রুমটাও তোমার মতো নিরামিষ। কিসব পড়াটড়া দিয়ে ভরা।’
ফায়াদ গম্ভীর স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
‘শাট আপ’
রাফিয়াকে ছোট থেকে ফায়াদ অনেক আদর করেছে৷ যার কারনে মেয়েটা এখন বাদর এ পরিণত হয়েছে। ফায়াদকে একটুও ভয় পায় না। ফায়াদ ওকে ওর মতো ছেড়ে রিজুকে বলল,
‘একাই আসছিস?’
রিজু ফায়াদের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,
‘মা আছে ফুপির সাথে। তোমার জীবন নিয়ে বড্ড ব্যস্ত আছে দুই নারী’
ফায়াদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ফেসে গেলাম!’
রাফিয়া ফায়াদের কাছে এসে বলল,
‘ভাইয়া তোমার ফোন দাও’
বের করে ফোন টা দিয়ে দিল ফায়াদ। তারপর সে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুম গেল ফ্রেশ হতে। রাফিয়া আরাম করে বসলো বিছানায়।তারপর ভিডিও কল দিল দূরে অবস্থান করা এক ব্যক্তি কে। ফোন রিসিভ হতেই রাফিয়া ভীষণ নাটকীয়ভাবে বলল,
‘ইশ এই হ্যান্ডসামে ছেলেটা কবে যে আসবে দেশে। তোমার জন্য আমি আজও বিবাহ করি নি।’
উচ্চস্বরে হাসি ভেসে আসলো অপর পাশ থেকে। রিজু থাপ্পড় মারলো রাফিয়ার মাথায়।তারপর মোবাইলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ফারাজ ভাইয়া কেমন আছো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ আছি ভালো। আর রাফিয়া শুন!তোর জন্য তো দেশে একটা রেখে এসেছি!’
রাফিয়া নাক মুখ কুচকে বলল,
‘ওইটা খালি দেখতেই সুন্দর। ডাক্তার মানুষ তো! একেবারে আনরোমান্টিকের ডিব্বা।তার থেকে বড় কথা ওটাকে আমি বড় ভাই মেনে নিয়েছি। ‘
ফারাজ আবারো হাসলো,
‘পাকনা বুড়ি’
রিজু বলল,
‘ওর কথা শুইনো না তো ভাইয়া! আজেবাজে কথা বলে বেশি। তুমি কবে আসবে। আমি তোমাকে ভীষণ মিস করি।’
দেশে আসার কথা শুনে খানিকক্ষণ চুপ থাকলো ফারাজ। তারপর বলল,
‘দেখি’
রাফিয়া বুঝলো ফারাজের আবার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।সে রিজু কে সরিয়ে বলল,
‘ধুরু ভাইয়া তুমি আমার গুরুত্বপূর্ণ কথাই তো শুনলে না।’
ফারাজ নিজেকে চট করে স্বাভাবিক করে বলল,
‘হ্যা হ্যা বল’
‘ফায়াদ ভাইকে বিয়ে দিতে চাচ্ছে সবাই। এতো চেষ্টা করছে কিন্তু ভাই বিয়ে করে না’
‘তারপর?’
‘আচ্ছা! তুমি তো তার ভাই তুমি একটু বলো তো ভাইয়া কি মেয়েদের পছন্দ করে না?ছেলেদের প্রতি আবার—‘
বলার সাথে সাথে কানে টান খেল রাফিয়া।
‘আয়ায়ায়া ছাড়ো ভাইয়া ছাড়ো! আর৷ বলবো না!’
ফায়াদ রাগী ভাবে বলল,
‘বেশি পেকে গেছিস!’
ফোনের স্ক্রিন থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসছে।হাসতে হাসতে বেচারার অবস্থা খারাপ।ফায়াদ ফোন টা নিয়ে বলল,
‘শাট আপ ফারাজ!’
ফারাজ নিজেকে থামিয়ে বলল,
‘স্যরি ভাই’
পরক্ষণেই আবার হাসা শুরু করে দিল। ফায়াদ এর নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করলো। তবে ফারাজকে হাসি খুশি দেখে ভালো লাগছে।
তার এখন মনে হচ্ছে ফারাজ দেশে আসলেই ভালো থাকবে। পরিবারের সাথে থাকলে আবার আগের মতো হাসি খুশি থাকতে পারবে। এভাবে তো জীবন চলে না।
রাতের খাবার খেয়ে অপরাজিতা রুমে গিয়ে গেট লাগালো। এখন তার উদ্দেশ্য হচ্ছে ফায়াদকে ফোন দেওয়া। ফোনটা হাতে নিতেই দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ শুনলো।বিরক্তি ছেয়ে গেছে তার মেজাজে। মাত্রই তো আসলো রুমে৷ এখন আবার কী।
দরজা খুলে দেখলো তার মা দাঁড়িয়ে আছে সাথে তার ছোট ভাই। তাও আবার ওটার কোলে কোলবালিশ। তাদের এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কপাল কুচকালো সে। মায়ের দিকে প্রশ্নাত্নক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
রামিসা স্বাভাবিক ভাবে বলল,
‘আবির তোর সাথে ঘুমাবে আজ থেকে। ‘
অপরাজিতা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,
‘কি?কেন?’
‘এমনি। যা বাবা বিছানায় শুয়ে পড়।’
শেষ কথা টা আবিরকে উদ্দেশ্য করে বললেন। অপরাজিতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলেন তিনি। অপরাজিতা বিরক্তি নিয়ে আবিরের দিকে তাকালো।তারপর জোরে শ্বাস নিয়ে গিয়ে শুয়ে পড়লো।আজ আর কথা বলা হবে না বুঝতে পেরেছে সে।
আবির বোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আপু একটা গল্প শুনাও’
অপরাজিতা নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা দাতে দাত চেপে বলল,
‘চুপচাপ ঘুমা নাহলে থাপ’ড়িয়ে তোকে মায়ের চামচামি করা ছুটাচ্ছি!ঘুমা!!’
আবির ভয় পেয়ে কোলবালিশ নিয়ে অপরপাশ ফিরে গেল।
অপরাজিতার তো মাথায় আগুন ধরে আছে। সে আজ ডাক্তার এর সাথে কথা বলতে পারছে না। তার ভালোমতো জানা আছে মা তার উপর নজর রাখার জন্যই এই ছোট রিপোর্টারকে তার কাছে রেখে গেছে।
কাল ছাড়া উপায় নেই বুঝতে পারলো অপরাজিতা। এখন তার কাজ হলো ফায়াদের ভাবনায় ঘুমের দেশে পাড়ি দেওয়া।
————–
‘স্যার আমার মনে হয় আপনার দেশে যাওয়া উচিত’
ফাইল দেখছিল ফারাজ। কথাটা শুনেই মাথা তুললো,
‘হঠাৎ?’
‘আমি জানি আমার বলা উচিৎ না তবুও বলছি আপনার এতো সুন্দর একটা পরিবার আছে। কেন তাদের থেকে দূরে থাকছেন?’
ফাইল ঘুছিয়ে রাখলো ফায়াদ। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘আসুন নীতি।আমার একটু রিফ্রেশমেন্ট লাগবে।চলুন পাশের কেফএ যাই’
দুজন এ বসে আসে একে অপরের বিপরীত চেয়ারে। কফি দিয়ে গেল একজন এসে। ফারাজ খুব মনোযোগ দিয়ে কফিতে চুমুক বসাচ্ছে। নীতি বুঝার চেষ্টায় আছে ফারাজ আসলে কি বলতে চায়।
কফি শেষ হতেই ফারাজ প্রশ্ন ছুড়লো,
‘আমি বিবাহিত জানেন এটা?’
নীতি অবাক হলো।
ফারাজ নীতির অবাক হওয়া চেহারা দেখে হেসে উঠলো।
‘আপনি স্বভাবে যে শান্তশিষ্ট ব্যক্তি দেখেন ওটা মোটেও আমি না। আমি ছিলাম অনেক চঞ্চল। এমন একটা দিন যেত না যে আমার মায়ের কাছে বিচার না যেত। মারামারি করতাম প্রচুর। মজা মাস্তিতে ব্যস্ত থাকতাম৷ সিরিয়াস শব্দটা আমার ডিকশিনারির বাহিরে ছিল।’
নীতি ক্ষণে ক্ষনে অবাক হচ্ছে৷ ফারাজ আবার বলা শুরু করলো,
‘ভার্সিটি উঠে এক মেয়ের পাল্লায় পড়েছি।মেয়েটা আমার থেকে সিনিয়র এক ক্লাস এর। আমার স্বভাবের সম্পুর্ণ বিপরীতে। কিন্তু ওই যে বলে না? যে বিপরীত জিনিসে আকর্ষণ বেশি। আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।মেয়েটার আশে পাশে ঘুরতাম। কয়েকবার প্রোপোজ করেছি। তার সাথে থাপ্পড় ও খেয়েছি৷ আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই যে আছে তার কাছে বিচারও দিয়েছেন সেই মহারানী।কিন্তু আমি তো আমি। পিছু তো আমি ছাড়বোই না।’
ফারাজ কথা গুলো বলছে আর তার মুখে খেলা করছে এক মৃদু হাসি। নীতি দেখলো সে হাসি। লোকটা যেন এক কল্পনা তে বিরাজ করছে।
‘একটা টাইমে মেয়েটা আমার প্রতি কিছুটা দুর্বল হয়৷ কিন্তু আমার কাছে স্বীকার করে না।আমার উপর এক অদৃশ্য অধিকার দেখাতো। আমি প্রচুর সিগারেট খেতাম৷ ধমকিয়ে সেই সিগারেট ছাড়ালো আমাকে। পড়াশোনায় লাড্ডু ছিলাম। মার্কস কম পেলেই কান ঝালাপালা করা শুরু করলো।মারামারি করার স্বভাব ছিল। মারামারি তে দেখলেই সে এসে আগে চড় মারতো আমাকে। বাজে অভ্যাস গুলো সব ছুটতে লাগলো।’
নীতি বিস্মিত হয়ে বলল,
‘আপনাকে দেখে মনে হয় না আপনি এরকম ছিলেন।’
ফারাজ হাসলো।
‘সময় বদলায়। মানুষ বদলায়। তারপর শুনো!
শুনলাম তাকে একদিন দেখতে আসছে। রাগে আমার অবস্থা খারাপ। ভাই তখন বুঝালো। রাগলে সমাধান হবে না কিছু। ধৈর্য্য ধরতে বলল আমাকে। পরে শুনলাম সেই সম্বন্ধ টা ভেঙে গেছে। ছেলে নাকি ভালো ছিল না। সেদিন বাসায় গিয়ে মাকে বললাম বিয়ে করবো। মা তো অবাক। সব বললাম মা কে। আমার মা-বাবা দুজনেই ভীষণ ফ্রেন্ডলি। তাদের মতো পেরেন্টস পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।মা বলল পড়াশোনা শেষে বিয়ে করতে কিন্তু আমার তো তর সয় না। তার উপর সে আমার এক ইয়ার এর সিনিয়ার।বিয়ের বয়স তো বসে নেই। ভাইও মাকে বুঝালো।শেষ এ উপায় না পেয়ে তার বাসায় গেল। বিয়ে টা সুন্দর ভাবেই হয়ে গেল কোনো এক সুন্দর দিনে। নিজের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য পড়াশোনা চলা কালেই বিয়ে বসলাম।’
বলেই হেসে দিল ফারাজ। নীতি মনোযোগ দিয়ে শুনছে।
‘তারপর?’
‘তারপর খুনসুটি তে চলছিল আমাদের দিন। আমাকে আমার মা মজা করে খোচা মারতো যে ভালোবাসায় পাগল হয়ে বড় ভাইয়ের আগে বিয়ে করে ফেলেছি। যদিও সে আমার থেকে কিছু মিনিটের বড়। বিসনেস এ মন ঢুকলো। সেটাও বুঝার চেষ্টা করতাম বাবার সাথে মাঝে মধ্যে। আর আমার ভাই তখন ডাক্তারি পড়ছিল। ভবিষ্যৎ ডাক্তার ছিল যে কিনা এখন বর্তমান ডাক্তার! সে আমাকে অনেক সাপোর্ট করতো।’
‘সে এখন কোথায়?আপনার ওয়াইফ?’
চুপ রইলো ফারাজ কিছুক্ষণ।তারপর মুখ খুলে বলল,
‘সে এখন নেই ‘
বলতেই এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার গাল বেয়ে।হাত দিয়ে মুছে ফেলল চট করে। নিজেকে ভীষণ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,
‘মরণব্যাধি! দুই বছর পর ক্যান্সার ধরা পড়েছে তার।আমার সামনে একটু একটু করে নেতিয়ে গিয়েছে আমার সেই মানুষটা। কতো চেষ্টা করেছি! কত ডাক্তার দেখিয়েছি হিসাব নেই! তবুও সে রইলো না। প্রতি রাতে তাকে বুকে নিয়ে কান্না করতাম। সে আমার চোখ মুছে দিয়ে বলতো *ভালোবাসি তো!* তার রোগা দেহ আমাকে ভীষণ পীড়া দিত। চোখের সামনে যখন তাকে ব্যথায় কাতরাতে দেখতাম তখন আমার বুকটা ভেঙে চূড়ে চূড়মার হয়ে যেত। এই কষ্ট বুঝানোর নয় নীতি।আমি চোখের সামনে আমার ভালোবাসার মানুষের শেষ দেখেছি একটু একটু করে। তার যাওয়ার পর আমি আমাকেই হারিয়ে ফেললাম মনে হয়। রাতে ঘুমোতে পারতাম না। বুকটা খালি খালি লাগতো। যেখানে তাকাতাম তার স্মৃতি শুধু।স্মৃতি গুলো পাগল করে দিচ্ছিল আমাকে। মায়ের কাছে একদিন কান্না করতে করতে বলেছিলাম মা আমার দম বন্ধ হয়ে আসে৷ এখানের বাতাসে আমি শ্বাস নিতে পারি না। মা বোধহয় বুঝতে পেরেছিল তার ছেলেটা ভালো নেই৷ একটু ভালো থাকার জন্য, একটু প্রানখুলে বাচার জন্য আমাকে পাঠিয়ে দিল এই ভীনদেশে। মা আমাকে শেষ বার বলেছিল *যে যাওয়ার সে চলে গেছে৷ তুই নিজেকে সামলা। তোর ভালোবাসা নিশ্চয়ই তোকে ভেঙে যেতে শিখায় নি।মেয়েটা তোকে একটু একটু করে ভালো করেছে।* তার পর থেকে এখানে এসে ভালো থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি। জাস্ট মাঝে মধ্যে একটু হোচট খেয়ে যাই’
ফারাজ দেখলো নীতি মেয়েটা কান্না করছে। কখন থেকে কান্না করছে তার খেয়াল নেই। সে তো তার স্মৃতি তে বিচরন করছিল।কান্না করতে করতে মুখ লাল হয়ে গেছে নীতির। ফারাজ দেখলো সে কান্না। তার গল্প শুনে কাদছে এই মেয়েটা। অথচ সে এগুলো পাড় করে এসেছে। বুকটা আবারো ব্যথা করছে। মনে করিয়ে দিচ্ছে সুখের স্মৃতি গুলো। আবার উকি দিচ্ছে দুঃখের গুলোও। এই জীবনটা কী এভাবেই চলে যাবে? সুখ কি আর পাবে না সে?
(চলবে)
#প্রেম_প্রেম_পায়
#স্বর্ণালী_সন্ধ্যা
পর্ব তেরো
১৩.
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই অপরাজিতা মায়ের পিছু পিছু ঘুরছে৷ মায়ের মতিগতি বুঝার চেষ্টায় আছে। কিন্তু তার মা একেবারে স্বাভাবিক। কিছুই বলছে না।
মেয়েকে এরকম পিছু পিছু ঘুরতে দেখে রামিসা বুঝতে পেরেছেন কেন এমন করছে।কিন্তু কাজের সময় যদি এমন পিছে পিছে ঘুরে তাহলে মেজাজ খারাপ হয় না! একটা সময় ধমকে উঠলেন তিনি,
‘কি সমস্যা তোর?’
অপরাজিতা থতমত খেয়ে বলল,
‘ন না কোনো সমস্যা না। ‘
রামিসা রাগী ভাবে বললেন,
‘কি চাই তাহলে?আমার পিছে কি?’
‘ না মানে বাবা কোথায়? সকাল থেকে দেখছি না। ‘
‘তোর বাবা ভোর বেলা বের হইসে। কাজের জন্য আবারো ঢাকার বাহিরে গেছে।’
‘ওওওওও’
মেয়েকে এমন হেয়ালি করতে দেখে আবারো ধমকে উঠলেন,
‘গিয়ে টেবিলে বস! পিছে পিছে ঘুরবি না।’
অপরাজিতা ঢোক গিলে টেবিলে বসলো।একটু পর সে বের হবে কোচিং এর জন্য। এডমিশন এক্সাম এর প্রিপারেশন এর জন্য ভর্তি হয়েছে। তার পরিকল্পনা হচ্ছে আগে ফায়াদের কাছে যাবে তারপর কোচিং যাবে।
নাস্তার টেবিলে বসে নাস্তা খাচ্ছিল ফায়াদ। তখনই রাফিয়া এসে বলল,
‘ভাইয়া তোমার ফোনে পুচকি ফুল টা কে?’
শুনে ফায়াদের কাশি উঠে গেল।তার কাশি দেখে সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠলো। আখি বেগম পানি এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘আরে হলো কি?আস্তে খা!’
পানি খেয়ে কাশি থামিয়ে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলল,
‘আমার ফোনে কি তোর?’
রাফিয়া অবাক হয়ে বলল,
‘তোমার ফোন তো আমি সবসময়ই চালাই। এমন তো করো নি আগে। ‘
ফায়াদ যেন আরো ফ্যাসাদে পড়ে গেল। রাফিয়া পুলিশি নজরে বলল,
‘বুঝছো ফুপি তোমার ছেলের তাড়াতাড়ি খাওয়ার কারনে খাবার গলায় আটকে নাই।পুচকি ফুলের নাম শুনে আটকে গেছে খাবার।কি ব্যাপার ভাইয়ায়া?’
সবাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বিশেষ করে তার বাবা। সে ভেবে পায় না তার বাবা তাকে এমন নাকানিচুবানি খাওয়ায় কেন। আগে ফারাজের সাথে মিলে তাকে পঁচাতো।যাক এখন পরিস্থিতি থেকে বাচা দরকার। সে মিথ্যা তো কোনো জীবনেও গুছিয়ে বলতে পারে নি। আজও পারবে না। তাই সে আশা বাদ। তাড়াতাড়ি খাবার শেষ করে উঠে গেল।হাসপাতালে যেতে হবে। তাড়া দেখিয়ে বেরিয়ে এলো।
সে বেরিয়ে যেতেই রাফিয়া খাবার চিবুতে চিবুতে বলল,
‘বুঝছো কিছু ফুপা?’
ফারদিন আহমেদ মাথা দুলিয়ে বললেন,
‘অনেক কিছু বুঝলাম’
রিজু তাদের কান্ড দেখে বলল,
‘বয়স তো কম হয় নি ভাইয়ার। তোমরা এমন শুরু করছো কেন? ভিলেন সাজবা নাকি?’
রাফিয়া মুখ ভেঙচি কেটে আসছে,
‘আসছে মুরোব্বি ভাষণ দিতে!’
রিজু কিছু বলতে যাবে তখন ফারদিন আহমেদ বলে উঠলো,
‘আহা রিজু! ভিলেন হবো কেন? মাত্রই তুমি বললে যে বয়স তো তার কম হয় নি তাই না? এটাই তো কথা। বয়স তো কম হয় নি।এখন বিয়ে করার বয়স তার, প্রেম করার নয়!’
রিজু কপাল চাপড়ালো। এতোক্ষণ তাদের কাহিনি চুপচাপ দেখছিল আখি বেগম ও রিজুর মা নাহিদা বেগম। আখি এবার বলে উঠলো,
‘এতো পেচাচ্ছো কেন তোমরা? প্রেম করলে করুক।প্রেম যেহেতু করবে, বিয়েও করবে। তাই না নাহিদা?’
বলে নাহিদার দিকে তাকিয়ে দেখলো নাহিদা গভীর ভাবনায় ব্যস্ত।আখি বেগম আবার ডাকলো,
‘নাহিদা?’
নাহিদা হুশে ফিরলো এবার। সে বলল,
‘আপা আমি অনেক সুন্দর একটা মেয়ে দেখছিলাম। একেবারে পুতুলের মতো। ফায়াদের সাথে খুব মানাতো।’
আখি বেগমের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছা করলো এবার। এই নিয়ে নাহিদা যে কতোবার মেয়ে দেখেছে ফায়াদের জন্য।তার কাছে সব মেয়েই পুতুলের মতো লাগে। মেয়ে মানেই তার কাছে ভালোবাসার কন্যা। যেন একেকটা মায়াবতী। নিজের মেয়েকেও নাহিদা খুব আদরে আদরে বড় করেছে।সবার আদরে মেয়েটা বাদর হয়ে গিয়েছে।
অপরাজিতা খাওয়া দাওয়া করে আগেই বাসা থেক্র বের হচ্ছে৷ যেহেতু তার পরিকল্পনা আগে অন্যজায়গায় যাওয়া। সে যখন জুতো পড়ছিল তখন রামিসা জিজ্ঞেস করলেন,
‘তুই এতো তাড়াতাড়ি বের হচ্ছিস কেন?’
অপরাজিতা জুতা পড়া শেষ করে মাকে বলল,
‘শুনো মা একটা গল্প বলি। আমাদের এলাকায় আমার মতো একটা মেয়ে ছিল। তার মা যখন তাকে জিজ্ঞেস করতো যে কোথায় যাচ্ছিস তখন কি হতো জানো?’
রামিসা কপালে ভাজ ফেলে বললেন,
‘কি হতো?’
‘এটা হতো।’
বলেই অপরাজিতাকে দরজা খুলে দৌড়ে বাহিরে চলে গেল। রামিসা মেয়ের কান্ডে থম মেরে গেল। তার পেটে থেকে হয়েছে এই মেয়ে? এতো ফাজিল কেন? কি খেয়ে জন্ম দিয়েছেন তিনি একে? হায় আল্লাহ!আসুক আজ বাসায়!
অপরাজিতা রিকশায় বসে বসে হাসছে। মা কে আজ ভালো ভাবে বোকা বানালো। কিন্তু বাসায় গেলে তার কপালে শনি আছে সে ভালোভাবে টের পাচ্ছে এটা।
ভাবতে ভাবতেই রিকশা থামলো হাসপাতালের সামনে। সে ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখলো ফায়াদ মাত্রই প্রবেশ করছিল তার কেবিনে। সে ডাকলো,
‘ডাক্তার সাহেব?’
ফায়াদ পিছে ঘুরে অপরাজিতা কে দেখে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল,
‘এখন এখানে কি?’
অপরাজিতা মনে মনে মুখ ভেঙচি কেটে বলল,
‘গুড মর্নিং ও তো জানাতে পারতেন! না এরে দিয়ে আমিষের আশা নাই’
কিন্তু মুখে বলল,
‘কথা আছে।’
‘আসো ভিতরে’
অপরাজিতা আর ফায়াদ দুজনের প্রবেশ করলো। অপরাজিতা কে চেয়ার এগিয়ে দিল বসার জন্য৷ নিজেও বসলো অপরাজিতার মুখোমুখি।
‘এবার শুরু করো’
‘কি?’
‘কথা আছে বললে যে ‘
‘ওহ হ্যা!’
তারপর অপরাজিতা সব বলল।তার মা যে বুঝতে পেরেছে তার ব্যাপারে। আর ছেলের সাথে দেখা করতে চেয়েছে সেটাও জানালো।
সব শুনে ফায়াদ কপালে আঙুল ঘেঁষে বলল,
‘প্রেম করলাম না একদিনও তার আগেই কেস খেয়ে যাচ্ছি।ওয়াও!’
তার কথা বুঝার চেষ্টা করলো অপরাজিতা।
‘মানে?’
ফায়াদ বলল,
‘মানে কিছু না। আন্টি জানে ছেলে কে?’
‘না’
‘আচ্ছা’
অপরাজিতা জানতে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘এখন কি করবেন?’
‘তোমার জেনে কাজ নেই। তুমি কাজের থেকে অকাজ বেশি করো। তোমার ক্লাস নেই আজকে? ‘
‘আছে তো ‘
‘কখন?’
‘এখন’
এবার হালকা ধমকে উঠলো ফায়াদ,
‘তো এখানে কি তোমার?’
ধমকে অপরাজিতা নিজেকে নিজে শান্তনা দিল৷ তারপর সেও ত্যাড়ামি করে বলল,
‘এখানে আমার জামাই!! আমার একটা নিরা’মিষ ডাক্তার আছে ওটার জন্য আসি। যাচ্ছি! আর আসবো না। আসি বলে ভাব বেড়ে গেছে বুঝেছি!হুহ! দেখে নিব!’
বলেই ফায়াদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে এলো অপরাজিতা। বাহিরে এসে জোরে করে শ্বাস ছাড়লো।অনেক গুলো কথা বলে ফেললো সে। ববাহ বাহ! পরের টা পরে দেখা যাবে। ভাবতে ভাবতে কোচিং সেন্টার এর উদ্দেশ্যে রওনা দিল সে।
ফায়াদ অপরাজিতার কান্ডে তাকিয়ে রইলো। তারপর বিরবির করে বলল,
‘মেয়েটার সাহস বেড়ে গেছে! একসাথে কতো কিছু বললো। আমিও দেখে নিব!’
নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠলো সেও।
ক্লাসে এসে বসতেই অপরাজিতার বিরক্তির সীমা রইলো না। কিছু ছেলে পাশের সারি থেকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। অপরাজিতা এমনিতে মাশাল্লাহ তাই ছেলেদের তাকিয়ে থাকা টা অস্বাভাবিক নয়৷ তবে তার কাছে ব্যাপার টা মজা লাগছে না। এমনভাবে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে যেন তাকে মুখস্ত করছে। ব্যাপারটা আসলেই বিরক্তিকর।
ক্লাস শেষে অপরাজিতা বের হয়ে রাস্তায় হাটছিল। তখনই একটা ছেলে এলো।
‘হাই’
অপরাজিতা আশেপাশে তাকালো। ছেলেটা অপরাজিতাকে আশে পাশে তাকাতে দেখে নিজেও তাকাচ্ছে। তারপর বলল,
‘আশে পাশে কেউ নেই। আপনাকেই বলছি।আমি আপনার সাথেই ক্লাস করেছি আজকে।’
অপরাজিতা ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
‘ওহ আচ্ছা!’
অপরাজিতাকে ভাবলেশহীন দেখে ছেলেটা কথা আগাতে পারছে না। এমনিতে সবাই বলে মেয়েরা নাকি তার জন্য পাগল। আর এই মেয়ে দেখি পাত্তাও দিচ্ছে না।সে আবার বলল,
‘আমি রবিন। আপনার নামটা?’
অপরাজিতা বুঝতে পারছে ছেলেটা তার উপর ক্রাশ নামক বাশ খেয়েছে। কিন্তু তার এই ছেলেকে মোটেও ভালো লাগছে। ক্লাসে যে ছেলেগুলো তাকিয়ে ছিল তার মধ্যে এটাও ছিল। সে রুড হতে চাচ্ছে না কিন্তু ভালো ভাবে কথা বললে তো মাথায় চড়ে বসবে।তাই এখন সে রুডভাবে ভালো ব্যবহার করবে।মেকি হেসে বলল,
‘ক্লাসে তো বলেছিলাম শুনেন নি?’
‘না আসলে খেয়াল নেই এতো মানুষ ছিল’
‘আমার এখন বলতে ইচ্ছে করছে না। বাসায় যাবো। সাইড প্লিজ!’
বলে সে সামনে এগোতে লাগলো কিন্তু রবিন আবারো তার পাশে এসে হাটতে লাগলো।অপরাজিতা এই ছেলের সাথে হাটতে চায় না। সে বিরক্ত হয়ে বলল,
‘আমার সাথে হাটেন কেন? হয় আগে হাটেন নাহয় পিছে হাটেন আজব!’
রবিন ফ্লার্ট করার মতো করে বলল,
‘তোমাকে রাগলে দারুন লাগে তো!’
অপরাজিতার এবার যেনো বিরক্তির শেষ নেই। সে এবার আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করে দাতে দাত চেপে বলল,
‘আরে পাগল ছাগল আমি রাগি নাই। বিরক্ত হচ্ছি।ফ্লার্ট ও করতে পারে না।কি ভাবছেন সে আমাকে সুন্দর লাগে বললে গলে যাবো?আর এটা কোনো বলার মতো বাক্য হলো এই মুহুর্তে বলার জন্য?আমার রাগের অনেক মূল্য আছে যারে তারে দেখাই না। আর আবার যদি ক্লাসে আমার দিকে তাকায় থাকতে দেখি তাহলে চোখ এ মরি’চ দিয়ে দিব বলে দিলাম।আপনার ওই রাম ছাগল বন্ধুদেরও বলবেন আমাকে নিয়ে কানাকানি করতে না। যত্তসব!জীবনে মেয়ে দেখে নাই মনে হয়! ‘
বলে সে রিকশা ডেকে রওনা দিল বাসার উদ্দেশ্যে। রবিন এর চেহেরা দেখার মতো হয়েছে।সে জানতোই না যে অপরাজিতা ধরে ফেলেছে যে তাকে নিয়ে সে ও তার বন্ধুরা কানাকানি করছিল।সে তো আর জানে না যে অপরাজিতা তার থেকে দুই কদম চালু।
রিকশায় বসে অপরাজিতা বিরবির করছে,
‘আসছে স’স্তা মার্কা লাইন নিয়ে ফ্লার্ট করতে। রাগলে নাকি আমাকে সুন্দর লাগে! ভাবে যে একটা প্রশংসা করলেই মেয়েরা গলে যায়।এর থেকে তো আমার নিরামিষ ডাক্তারই ভালো। ফ্লার্ট করার জন্য শব্দ লাগে না উনার। আমি তো উনার চোখের দিকে তাকালেই ডুবে যাই। ইশশ!’
ফায়াদের কথা ভাবতে ভাবতে মনটা আবার ভালো হয়ে গেলো। বাতাস বইছে চারদিকে। পরে সম্ভবত বৃষ্টি হতে পারে। আবহাওয়া টা ভীষণ সুন্দর।রোদ নেই এখন।বাতাসে গাছের ডালপালা গুলো দুলছে।ঠিক তেমনি অনুভূতি গুলোও দোলা দিচ্ছে এই আবহাওয়া তে। কোনো এক সুন্দর মানবকে মনে করার মতো সুন্দর আবহাওয়া।মনে করা লাগে না, সে আপনি এসে উকি দিয়ে যায় মনের কোনে। মোবাইল টা বের করে রিকশায় বসেই ফায়াদকে একটি বার্তা লিখে দিল,
‘শুনেন! আমি কিন্তু আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি।’
(চলবে)