#ফেরার_কোন_পথ_নেই ( ৭)
কলমে #রেহানা_পুতুল
শরতের স্বচ্ছ নীল আকাশ। থরে থরে শুভ্র মেঘের ছড়াছড়ি। কোথাও মেঘের ঘনঘটা নেই। ছাদে কাপড় নিতে এসে ভাবুক চাহনিতে চেয়ে আছি দূর আকাশে। মাথার উপরে ছাদ বরাবর দুটো সাদা কবুতর পাক খেয়ে এই উপরে উঠছে। এই কিছুটা নিচে নামছে। তারা ডিগবাজি খেলছে অবাধ আনন্দে। এমন আনন্দ আমার জীবনেও ছিল। সেগুলো এখন কেবলই বিষাদের কাফনে মোড়ানো। ঘন কুয়াশার মত ভীষণ ঘোলাটে। অস্বচ্ছ।
উহু! বুকটা ভার হয়ে আসে ক্ষণে ক্ষণে। দলা পাকানো বেদনারা দলবেঁধে হুড়মুড় করে আবারও আঁখিকোনে জমাট হয়ে গেল। এ কি হলো মাগো! যেন স্বপ্নে দেখা কোন অবিশ্বাস্য কাহিনী আমার জীবনে ফলে গেল।
সত্যি মানুষ যা চায়না পায় তাই। যা ভাবেনা ঘটে তাই। জীবন নাটকের চেয়ে নাটকীয়। কল্পনার চেয়েও কল্পনীয়। কিন্তু এতটা অকল্পনীয় কিছু জীবনে ধেয়ে আসবে সুনামির মতন। ভুলেও ভাবিনি। সবিতো ভালো ছিল। সেই ভালোটা কি কারণে বড্ড খারাপ হয়ে গেল? পছন্দ করে বিয়ে করা আমার প্রতি তার এতটাই অরূচি এসে গেল? আমার সিনিয়র একজনকেই শেষমষ পথ চলার সঙ্গী করে নিতে হলো তাকে? নাকি তাকে ধরে রাখার সামর্থ্যই আমার ছিলনা। তা কি করে হয়। তাহলে পনেরো বছর কিভাবে একই ছাদের নিচে পাড়ি দিলাম। নাহ! এটা তার চরিত্রগত সমস্যা।
ভাবনার সুতো ছিঁড়ল এশার ডাকে।
এই আম্মু ছাদে কি করছ? বাসায় আস। ঘটনা রমরমা?
আমি চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করলাম,
কি হয়েছে আবার?
তোমার সেই আন্টি বনাম সতিন কেঁদেকেটে বাসায় মাথায় তুলে ফেলছে। আমি তার কান্না শুনেই তোমাকে ডাকতে এলাম।
চলতো দেখি কাহিনী কি? নাকি নতুন পাঁয়তারা করছে নাকি কোনভাবে?
আমি চঞ্চল পায়ে ছয়তলা থেকে সিঁড়ি ভেঙ্গে তিনতলায় এসে পড়লাম। বাসায় এসে আমার বেড়রুমে ঢুকলাম। এশাও আমার পাশে আছে। আয়রা চেয়ারে বসে তার ড্রয়িং খাতায় আঁকিবুঁকি করছে রঙতুলি দিয়ে।
বেসিনের সামনে তার হেঁচকি তোলা অঝোরে কান্নার আওয়াজ শুনছি। এহসানকে দেখলাম তৈরি হয়ে নিচ্ছে। তাদের দুজনের সাথে কথা বলার কণামাত্র আগ্রহ নেই আমার।
আমার ভাঙ্গাচোরা মোবাইলটা হাতে নিলাম। সিমকার্ড এখন এই সেটেই আছে। কি করব। নাই মামার চেয়ে কানা মামাও ভালো। ভাসুর গতকাল তাকে হুকুম দিয়ে বলছে হয় আমাকে নতুন মোবাইল কিনে দিতে। নয়তো এটা ঠিক করে দিতে জলদি। অবশ্য তারপর এখনো সেই সুযোগ হয়নি তার। আর ঘুম থেকে লেট করে উঠার কারণটাতো রাতে আমিই করে দিয়েছি।
প্লিজ #রেহানা_পুতুল পেইজে লাইক ও ফলো দিয়ে যুক্ত রবেন। নিরাশ হবেন না। প্রমিজ।
মাকে ফোন দিলাম। গ্রামের বাড়িতে আমার মা একাই থাকে। বাবাকে অল্প বয়সে হারিয়েছি ভাগ্যের নির্মমতায়। আমার কোন ভাই ও নেই। আমরা দুই বোন। নিলা আমার ছোট। ওর স্বামী দেশের বাইরে থাকে। দুই সন্তান নিয়ে ও শশুরবাড়ির একান্নবর্তী পরিবারে ভালো আছে। কিন্তু এই কয়দিন সেও পাগলের মত আছে বোনের এই লাঞ্চিত জীবন দেখে।
মা দুঃখী দুঃখী গলায় আমার বর্তমান পরিস্থিতি জানতে চাইলেন। আমি চোখে দেখা সব মাকে জানালাম। তারপর আবদারের ঢংয়ে বললাম,
আচ্ছা মা আমাদের না সম্পত্তি আছে আব্বার নামের?
হুম আছেতো। কেনরে মা?
মা এগুলো সবকিছুরতো মালিক আমরা দুইবোন। তাইনা?
হ্যাঁ। তবে মনে হয় তোর চাচাও এতে ভাগ পাবে কিছু। কারণ তোর আব্বার কোন পুত্রসন্তান নেই।
আচ্ছা পেলে নিবে। সমস্যা কি? মা আমার ভাগের জায়গাটা বিক্রি করে আমাকে টাকা দিতে পারবা?
জায়গা জমিতো হুট করে বেচা যায়না। সময়ের ব্যাপার। তুই কি করবি টাকা দিয়ে?
মা, যে মানুষটার হৃদয়ে আমার কোন স্থান নেই। তার চোখের সামনে থাকতেও অন্তরটা পুড়ে খাঁক হয়ে যায়। তাই কিছুদিন পরে আলাদা বাসায় উঠব বাচ্চাদের নিয়ে। কিন্তু তাকে ডিভোর্স দিবনা। আমিতো পার্লারের কাজ জানি মা। আবার স্কুলে পড়ার সময় শখ করে সেলাইও শিখেছি না। সেটাও চাইলেই পারব।
তুমি আমাকে দুই লাখ টাকার ব্যবস্থা করে দাও। তোমার কাঁধে গিয়ে তোমার বোঝা হবনা মা। আমি নিজেই স্বাবলম্বী হয়ে উঠব। হয় একটা বিউটি পার্লার দিব। বা সেলাইর বিজনেস শুরু করব। বাইরে জব করলে বাচ্চারা ছন্নছাড়া হয়ে যাবে মা। তাই ওদের কাছে থেকেই আয়ের পথ বের করব।
মাকে বাদল ভাইয়ের সাথে দেখা হওয়ার বিষয়টাও জানালাম। মা অভিমানী স্বরে বললেন,
কত ঘুরল ছেলেটা তোর পিছু। তুই বাদাইম্মনা,বখাটে বলে পাত্তা দিসনি। আর এখন ঢাকায় বড় ব্যবসা করে বাদল। পুরো পরিবার নিয়ে একসাথেই থাকে। বউ মারা যাওয়ার পর আর বিয়েও করলনা। তুই চিন্তা করিসনা। আমি টাকার ব্যবস্থা করছি।
ফোন না রাখতেই টনটন করে আবার বেজে উঠল। রিসিভ করতেই সেজ খালার ক্ষেপানো কন্ঠ শুনে নিজেই ঘাবড়ে গেলাম। সেজো খালার দরাজ কন্ঠের হাঁকডাক আর স্পষ্টবাদিতার জন্য গোটা শশুর বাড়িতে সবাই যেমন আলাদা করে চিনে। তেমনি বেশ সমীহ করে।
আমি নিরীহ গলায় সালাম দিলাম খালাকে। ওয়ালাইকুম আসসালাম। সেই খা* ন* কি মা’**গী কি তোর বাসায় সেইটা বল আগে?
হুম খালা। কিন্তু কেঁদেকেটে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আমিতো আর তাদের সাথে কথা বলিনা। তাই কিছু জানিওনা।
শুন, বাড়িতে তাদের ঘরে সে এক সপ্তাহ ধরে নেই। ছেলেরা নয়ছয় করে এটা ওটা বলছে সবাইকে। কি করবে বল। তাদেরতো মাথা কাটা পড়ল যে। পরে তার ফুফুরা এসে চাপ দিল। অমনি তারা সব বলল। তাদের কাছে অনেকবার ধরা খেয়েছে। ভিড়িও কলে কথা বলার সময়। পরে সে নাকি নিজেই স্বীকার করছে বিয়ের কথা।
তার যুক্তি হলো,
আমিতো পরকিয়া করিনি। পাপ করিনি। বিয়ে করেছি আল্লা রাসুলকে সাক্ষী রেখে।সব বিধবারা সমাজের ভয়ে বিয়ে না করে অবৈধ সম্পর্কে জড়ায়। তারা সমাজের কাছে সাধু। আমি সমাজকে না ভয় পেয়ে আল্লাহকে ভয় পেয়েছি। বৈধ সম্পর্কে জড়িয়েছি। সেতো তার স্ত্রী সন্তানদের এতটুকু অনাদর করবেনা। ফেলেও দিবেনা। তাহলে সমস্যা কোথায়?
তখন আমরা সবাই মিতার পক্ষ নিয়েই তার দুই ছেলেকে ঝাড়তে থাকি। পরে তার ছোট ছেলে মুখ খুলতে বাধ্য হয়। আমার দিকে চেয়ে বলে,
জেঠিমা আপনার ভাগনি শিলা আপুর জামাইর কাছে আম্মু বিয়ে বসেছে। তাই আমরা দুই ভাই বলছি হয় তাকে ছেড়ে দিতে নয় আমার বাবার ভিটা ছেড়ে দিতে। পরে উনি সেই অপশন বেছে নেয়। বড় বাজারে এক রুমের বাসা ভাড়া নিয়েছে। আপনার ভাগনি জামাই ঢাকা থেকে বাইক নিয়ে আসত সপ্তাহে একবার। সেদিন আম্মুও নানান কাজের বাহানায় বাইরে যেত। আমরা দুই ভাইতো আর সারাদিন ঘরে থাকিনা। আর আমার বোনতো মাদ্রাসায় থাকে বোডিং এ।
ও আল্লাগো! আমি তারে পাইলে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। বাড়ির মান ইজ্জত সব মাটিতে মিশায়া দিল সে। তাকে হাতের কাছে পেলে আমিও পিষে ফেলব। এই বলে, আমি বোরকা নিয়ে তার আট বছরের মেয়ের মাদ্রাসায় গেলাম তখনি। সেটাতো আমাদের পাশেই। গিয়ে মাদ্রাসার হেড মিসেস কে সব জানালাম। তারা ভয়ানক রেগে গেল। আমার সামনেই তিনি তাকে ফোন দিল। বুঝলি।
দিয়ে বলল,
আপনি পাপ করেন নি তা ঠিক। দূর একটু দূর সম্পর্কের ভাগনি জামাইকে বিয়ে করেছেন। এটাও জায়েজ। কিন্তু আপনি জেনেশুনে একটা মেয়ের অধিকারে ভাগ বসিয়েছেন। তিনটা সন্তানের ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছেন। এটা অনুচিত। এটা ভুল। আপনার যদি এতই বিয়ে করতে মন চাইল। আপনি বিপত্নীক বা ডিভোর্সি কোন পুরুষকে বিয়ে করতেন। কারোই কোন সমস্যা ছিলনা। আপনার ছেলেরাও মেনে নিত সহজভাবে। কিন্তু আপনি বিষয়টাকে জটিল করে ফেলছেন।
শুন, ফোনের ওপাশ থেকে মিতা কিছু বললে এপাশ থেকে তিনি হই হই বলে উঠলেন,
থামেন। আপনার মুখে ধর্মের কথা আর মানায়না। আমাদের সমাজ শুধু ধর্ম, হাদিস দিয়ে চলেনা। সমাজেরও কিছু নিয়মনীতি রয়েছে। ছিহ! পর্দা ও বোরকার উপর থেকে মানুষের ভক্তি উঠে যাবে ধীরে ধীরে। আপনার মত পর্দার তলায় থাকা নোংরা মানসিকতার নারীদের জন্য। সারকথায় আসি। আপনি ডিভোর্স দিয়ে দিন তাকে বা নিয়ে নিন।
অন্যের জীবনে অভিশাপ হয়ে বাঁচার চেয়ে মরে যাওয়া ঢের ভালো। ধিক্কার! আপনার মেয়েকে মাদ্রাসা থেকে বের করে দিব আমরা নইলে। এর এক চুল ও ব্যতিক্রম হবেনা। ওসব ভুলানো কাঁদায় আমরা ভুলিনা। রাখেন বলে, হেড় মিসেস ফোন লাইন কেটে দিল। এই হলো কাহিনী।
আমি প্রলম্বিত শ্বাস ছেড়ে আরও কিছুক্ষন খালার সাথে কথা বললাম। এবার বুঝলাম মিতার কান্নার কারণ। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ থাকায় তারা আমার কথা শুনতে পায়নি।
দুপুরে আমি বাচ্চাদের জন্য অল্পস্বল্প রান্না করে নিলাম। এহসান চক্ষু লজ্জায় আমার সাথে কথা বলেনা। সামনেও আসেনা।
সেদিন রাতে মিতা মাথা ঢেকে কিচেনে এসে কফি বানাল এহসানের জন্য। রাতে খাওয়ার পর তার কফি খাওয়ার অভ্যাস পুরনো। বলতে গেলে নেশার মত। মিতা ওয়াশরুমে গেল। আমি চুপিচুপি গতরাতের মত আরেকটা হাই ডোজের ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে দিলাম সেই কফির মগে।
অতিরিক্ত কফি,অ্যালকোহল,ঘুমের ট্যাবলেট, স্নায়ূশক্তিকে দুর্বল করে দেয়। “অ্যালকোহল যুক্ত পানীয় টেস্টোস্টেরন মাত্রা কমিয়ে যৌনক্ষমতা হৃাস করে।”
এটা আমার কথা নয়। গবেষক ডাক্তারদের কথা।
“ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়।” বহুল প্রচলিত প্রবাদটা মনে করেই অধরজুড়ে বিগলিত হাসি দিয়ে রুমে ঢুকে গেলাম।
ক্রমশ ঃ ৭