ফেরার কোন পথ নেই পর্ব-০৮

0
176

#ফেরার_কোন_পথ_নেই ( ৮)
কলমে #রেহানা_পুতুল
“ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়।” বহুল প্রচলিত প্রবাদটা মনে করেই অধরজুড়ে বিগলিত হাসি দিয়ে রুমে ঢুকে গেলাম।

ডানাভাঙা ডাহুক পাখির মত ছটপট করেই নিশি পার হলো। নিদ্রা এলোনা দুনয়ন জুড়ে। নিদ্রা আমার নির্বাসনে গেল স্বেচ্ছায়। বিদীর্ণ মুখে ফ্রেস হয়ে পোশাক পাল্টে নিলাম তিন সন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দিতে। এগ নুডলস বানিয়ে ওদের টিফিন বক্সে ভরে দিলাম। সেই বেহায়ারা মরার মত পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে স্টোর রুমে। আমি বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একজনের ভুলের জন্যতো আমার তিন সন্তান খেসারত দিবেনা। তারা তাদের রুটিন মাফিক জীবন যাপন করবেই। এতে যেন সামান্যতম ব্যাঘাত না ঘটে। আমার তীক্ষ্ণ নজর সেদিকে সজাগ রয়েছে। পাহারাদারের মতন।

রিকসাযোগে মাহিনকে স্কুলে দিয়ে এশা ও আয়রার স্কুলে চলে গেলাম। সবসময়ের মত তাদের স্কুলের পাশে বসে আছি একটি গাছের বেদিতে।

শরৎকালের প্রকৃতি ভারি কোমল, শান্ত-স্নিগ্ধ, উদার। নিকটে দৃষ্টি পড়তেই দেখি অনেকগুলো শিউলি ফুল ঝরে আছে উজাড় করা রূপ-সুধা নিয়ে। শিউলি ফুলগুলো অনুপম সৌন্দর্য নিয়েও যেন মাটির বুকে হেসে চলছে। ফুলগুলোর সাথে নিজেকে মিলিয়ে নিলাম। আমার ও যেন কারো জীবনে থাকার সময় ফুরিয়ে গেল। ঝরে গেলাম ঝরা পুষ্পের মতই। চুপটি করে সব সামলে নিতে হচ্ছে। বাচ্চাদের সামনে স্বাভাবিক থাকতে হচ্ছে। নিজেই গুড়ো গুড়ো হয়ে গেলে ওরা কার বুকে আশ্রয় নিবে।

শরতের পাতাঝরার দৃশ্যও এখানে পরিস্ফুটিত। বেশকিছু সবুজ বৃক্ষ রয়েছে। সবুজ নির্সগে আমার ভীষণ মায়া ছোটবেলা থেকে। তাই মাথা তুলে চাইলাম একবার উপরের দিকে। মৃদু বাতাসে গাছের কচি শাখাগুলো তিরতির করে দুলছে।

আয়রার ছুটি হবে এগারোটায়। আজ তাকে নিয়ে বাসায় যাবনা। মাহিনকে নিয়ে একবারেই দুপুরে যাব। বাসায় ফেরার কোন তাড়না আমার মাঝে নেই। যাদের জন্য পিছুটান। এখন তারাও বাইরে। আমিও বাইরে।

ভাবনার অকূল সমুদ্রে ডুবে আছি ডুবুরির ন্যায়। ও কি সত্যি সত্যিই মিতাকে ছেড়ে দিবে। বা দিলেও সেটা হবে উপরে উপরে। লোক দেখানো। এসব বহুরূপী লম্পট পুরুষদের সকাল বিকাল আসতে যেতে জুতা দিয়ে চাবকানো উচিত। কথায় কথায় ধর্ম আর হাদীস কপচায়। ধর্ম আর আল্লার নাম বেচে ভুলকে কখনই সঠিক প্রমাণ করা যায়না।

আরেহ অমানবিকের দল। তোদেরতো বিয়েটাও শুদ্ধ হয়নি। প্রথম স্ত্রীর অনুমতি না নিয়ে বিয়ে করলে হয়? হ্যাঁ হয় আমাদের ‘ল ‘ অনুযায়ী। মিতা তুই? তোর দুই ছেলে বড়। তাদের অনুমতি ও সাক্ষী ছাড়া তোর বিয়েওতো শুদ্ধ হয়নি। হাদীস দেখাস তোরা দুজন? হাদীসে চার স্ত্রী রাখা জায়েজ। প্রথম স্ত্রীর অনুমতি লাগেনা। তাও বুঝলাম। কিন্তু হাদিসে কি বলছে পরকিয়া করতে? হাদীস কি আমি জানিনা?

বিধবা নারীর সন্তান বড় হলে তাদের অনুমতিক্রমে ও উপস্থিতিতে বিয়ে সম্পন্ন করতে হয়। আর তুই বলছিস বিধবার অভিভাবক বিধবা নিজেই। ছাগল কোথাকার। এই জানিস হাদীস? নাকি হাদিস তুই বানাস তোর মনগড়া মতন। বিয়ের আগে যে তোরা দুজন এতটা বছর লটরচটর করেছিস? সেটার কি নাম দিবি? সেটা কি তোরা দুজন পরকিয়া করিসনি? ঠকবাজরা কোথাকার। মন চায় একটার গোঁফদাড়ি টেনে ছিঁড়ে ফেলি। মাথা ন্যাড়া করে আলকাতরা লাগিয়ে দিই। জুতার মালা বানিয়ে জন সম্মুক্ষে ঘোরাই। আর তুই মিতার লেবাস খুলে ফেলি। তোর আবার হাত মোজা পা মোজা। যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে তার মনে এত রঙচঙ আসে কিভাবে? ধোঁকাবাজ, চিটিং কোথাকার।

ওই বেয়াদব? হাদীসে কি আছে, সন্তানদের হাত ছেড়ে দিয়ে অন্যের হাত ধরে চলে যাওয়া? সন্তানদের ভবিষ্যত হুমকির মুখে নিক্ষেপ করে নিজের সফল ভবিষ্যত তৈরি করা? তুই মা নয়। মা নামের কলংক। নারী জাতির লজ্জা! থু মারি তোর গালে।

আমি যদি একা হতাম। কবেই উষ্ঠা মারতাম তোদের কপালে। আটকে গিয়েছি কেবল তিন সন্তানের জন্যই। উপর দিয়ে কিছুই বলবনা তাকে। আমি বেশি ঝামেলা করলে যাবতীয় খরচ ও বন্ধ করে দিবে। এমনকি আমার, এশার, মাহিনের নামে যে এফডিয়ার করা আছে ব্যাংকে। সেই টাকাগুলোও দিবেনা প্রতিমাসে। তাই তাকে কৌশলে মারব আমি। এমনভাবে মারব যেন সাপ ও মরে লাঠিও না ভাঙে। খুউব শখ না। একজনে হয়না না? আরো চাইই? মেটাচ্ছি তোর জনমের খায়েশ। তোরে আজীবনের জন্য আমি অক্ষম করে দিব। সর্বশান্ত করে পথে বসিয়ে দিব। ধুঁকেধুঁকে মরবি তুই। তোকে দেখে যেন সেইসব নোংরা মানসিকতার পুরুষদের শিক্ষা হয়। তারা যেন দ্বিতীয় বিয়ে করা ও পর নারীর আসক্তিতে জড়িয়ে পড়ার দুঃসাহস না করে। তোর অনন্তজ্বালা আমি উপভোগ করব বিজয়ীর মত। তুই পথে পথে ঘুরবি ফেরারি আসামির মতো।

এতক্ষন একাকী আপনমনে ক্ষোভ ঝেড়েই একটু স্থির হলাম আমি। উত্তেজনায়, উৎকন্ঠায় এই শরতেও দরদর করে ঘামছি চৈত্রমাসের গা জ্বলা গরমের মত। টিস্যু দিয়ে ঢলে ঘাড় গলা মুছে নিলাম।

মোবাইল হাতে নিয়ে বাদল ভাইকে ফোন দিলাম। কেটে দিয়ে কলব্যাক করল। কুশলাদি জিজ্ঞেস করেই বলল,
সারাদিন তোকে মিস করি শিলা। কতবার মোবাইল হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে আবার রেখে দিই। ফোন দিলে যদি তুই কোন ঝামেলায় পড়ে যাস। এই শংকায়।

দেননি ভালো করেছেন,
বলে মায়ের সাথে বলা কথাগুলো জানালাম। শুনে বলল,
কি করবি সেটা তুই ডিসাইড কর। তবে সেলাইর মেশিন আমি তোকে ফ্রিতেই নিয়ে দিতে পারব একটা। আর একাধিক হলেও অল্পদামে নিয়ে দিতে পারব। পুরান ঢাকায় পাটুয়াটুলীতে আমার এক বন্ধুর সেলাই মেশিনের বড় শো রুম রয়েছে।

আচ্ছা বাদল ভাই। মা টাকা পাঠালেই জানাব আপনাকে। অনেক ধন্যবাদ।

ধন্যবাদ দিবি থার্ড পারসনকে। আমাকে নয়। অবশ্য আমি তোর লাইফে তেমনই। এনিওয়ে বিচলিত হসনা শিলা। মনোবল ধরে রাখ ঘুরে দাঁড়াবার আত্মপ্রত্যয় নিয়ে। সাবধানে থাকবি। বাচ্চাদের সাথে সাথে নিজের যত্নটাও নিস।
আমি তোর জন্য ছিলাম,আছি,রবো অনন্তকাল। শুধুমাত্র চেনা একজন হয়েই। বলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলল উনি।

মুঠোফোনের ওপ্রান্তে বাদল ভাইয়ের অন্তভেদী নিঃস্বাসটা খানিক আমাকে গলিয়ে দিল। তার ব্যথার সূক্ষ্ণ তীরটা বুকের পাঁ পাশে লেগে চিনচিন ব্যথা করে উঠল। বাদল ভাইয়ের হাতছানিতে সাড়া দিলেই কি আজ বেশী ভালো থাকতাম? এমন অযাচিত কল্পনার রেশ কাটল স্কুলের ছুটির ঘন্টার ঢংঢং আওয়াজে।

উঠে গিয়ে আয়রাকে তুললাম। অপেক্ষা করছি মাহিনের ছুটির জন্য। এই ভিতরে ওকে এটা ওটা কিনে খাওয়ালাম তার পছন্দমতো। গল্প প্রথমে 👉রেহানা পুতুল পেইজে দেওয়া হয়। সার্চ করে লাইক ফলো দিয়ে যুক্ত হওয়ার অনুরোধ রইলো।

বাসায় যেতে যেতে ভর দুপুর হয়ে গেল। ডোরবেল বারবার বাজিয়েও ভিতর থেকে দরজা খোলা হলনা। বুঝলাম লক করা বাইরে থেকে। চাবি বের করে লক খুললাম। বাসার চাবি সবসময় আমার কাছে ও তার কাছেও থাকে প্রয়োজনেই। চাবি না রেখে বহুবার সমস্যায় পড়তে হয়েছে।

বাসায় ঢুকলাম। তারা নেই। বুঝলাম মিতাকে নিয়ে গ্রামে গিয়েছে ও। যাক অন্তত এবার স্বস্তির দমতো ফেলতে পারব। মাহিন,আয়রা আনন্দে লাফিয়ে উঠল। মনে হচ্ছে জেলখানার বন্দীদশা থেকে মাত্রই মুক্ত হল দুজন। তাদের কি বলব। আমার নিজের ও এমন মনে হচ্ছে।

ওরা হাতমুখ ধুয়ে নিল। আমি ফ্রিজ থেকে ভাত নিয়ে ওভেনে গরম করে তাদের খাইয়ে দিলাম। পরে মা, বোন, ভাসুর,জা একে একে তাদের সাথে এই বিষয়টা নিয়ে কথা বললাম। তারা যার যার মত করে আমাকে ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করতে বলল।

বিকেলে এহসান বাসায় আসল ক্লান্তপায়ে। আমি আড়চোখে ওর দিকে চাইলাম। ও নিজ থেকেই আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। নিরস গলায় অনুযোগ নিয়ে বলল,

ও চলে গিয়েছে গ্রামে। নয়তো ওর মেয়েকে মাদ্রাসা থেকে বের দিবে। আর প্রেগন্যান্ট অবস্থায় তালাক কার্যকর হয়না। এবারতো শান্তি তোমার।

আমি চনচনিয়ে উঠলাম। আগুনচোখে দাঁত কিড়মিড় করে বললাম,
আমার শান্তি। তোমারতো পুরোদমে অশান্তি এবার।

তাতো অবশ্যই। একটা নিষ্পাপ বাচ্চা বড় হবে পিতা থেকেও নাইর মত করে। তেজী স্বরে বলল ও।

আমি দপদপ পায়ে রুমে ঢুকে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। চিন্তা করলাম,
এ হারামিতো তাকে ছাড়বেনা মনে হচ্ছে। আর জেনেশুনেই মিতা বাচ্চা নিল যেন না ছাড়তে পারে। মনটা আবারো ভার হয়ে এলো। রাতে তার কফি গ্লাসে এক কাপ কফি বানিয়ে রেখে দিলাম। ভুল করলামননা ঘুমের ট্যাবলেট মেশাতেও। ও আমাদের রুমে ঘুমাল। আমি এশার সাথে ঘুমালাম।

সকালে রান্নাঘরে কাজ করছি। এহসান পিছন থেকে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে,
তোমার জন্য গুড় নিউজ আছে একটা।
আমি অবজ্ঞার চোখে কান পাতলাম শোনার জন্য।

মিতার মিসক্যারেজ হয়ে গিয়েছে। পুকুরঘাট থেকে পড়ে গিয়ে।
সে হনহনিয়ে চলে গেল কথাটা বলেই।

এটা আমার জন্য সত্যিই অনেক বড় সুসংবাদ। সে আমার না থাকুক। কিন্তু আমার তিন সন্তানের পিতার ভাগে অন্য একজনের অধিকার ফলে যাক। একজন মা হয়ে এটা আমি কিছুতেই চাইনা। ভেবেই আমার ঠোঁটের কোনে এক চিলতে প্রশান্তির আভা ছড়িয়ে পড়ল।

ক্রমশ ঃ ৮