বাসন্তী প্রেম পর্ব-২৩+২৪

0
456

#বাসন্তী_প্রেম🌼🌼
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#ত্রয়োবিংশ_পর্ব

মুখশ্রী জুড়ে তীব্র রোদের প্রখরতা ছুঁয়ে দিতেই ঘুম ছুটে যায় চোখ থেকে। পিটপিট করে চোখ মেলে উঠে বসে সিরাত‌। ছুটির দিন হওয়ায় বেশ স্বস্তি সহকারে পাশেই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে নিশাত। নিঃশব্দে খাট থেকে নেমে পা বাড়ায় ফ্রেশ হওয়ার উদ্দেশ্যে।
ফ্রেশ হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই বেশ কোলাহলের শব্দ কর্ণপাত হয় সিরাতের‌। সিরাতের উপর ফারিহার দৃষ্টি পড়তেই সে দ্রুত এগিয়ে যায় সিরাতের দিকে।
– “সিরাত আপু, তুমি এসে পড়েছো? এসো আমার সাথে নিচে। জানো ভাইয়া তোমার জন্য কত বড় পার্টি প্ল্যান করেছে! তোমার বার্থ ডে উপলক্ষে আজকে বিশাল আয়োজন করা হয়েছে।”
ফারিহার কথা শুনে সিরাত হালকা নড়েচড়ে উঠে। সাথে খানিকটা বিস্মিত ও হয়।
– “কিন্তু এসবের কি প্রয়োজন ছিল? কাল রাতেই তো বার্থ ডে সেলিব্রেট করা হলো; তাহলে আজ এসবের কি দরকার ছিল! আর তাছাড়া আঙ্কেল কি আদৌ এসব পছন্দ করবেন?”
শঙ্কিত হয়ে বলে উঠে সিরাত‌। সিরাতের এমন অনিশ্চয়তা দেখে পেছন থেকে ফাইয়াজ গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে,
– “কেন সেলিব্রেট হবে না! অবশ্যই হবে। ফাইয়াজ আহমেদ মুগ্ধর একমাত্র প্রেয়সীর বার্থডে সেলিব্রেট হবে না তো আর কার হবে? আমি চাই পেছনের যত খারাপ দিন গুলো সেগুলো সব খারাপ স্বপ্ন হয়ে মুছে যাক। তোমার বর্তমান এবং ভবিষ্যতের প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত আমি তোমাকে হ্যাপি দেখতে চাই। স্পেশাল ফিল করাতে চাই। আর তাই এখন থেকে নো স্যাডনেস; অনলি হ্যাপিনেস হবে মেরি জান!”
ফাইয়াজের কথায় পেছন ঘুরে তাকায় সিরাত‌।
– “কিন্তু,,”
– “কোনো কিন্তু নয়। আর বাবার কথা তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমি সবটা ম্যানেজ করে নিব।
এখন শুধু চুপটি করে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকো, আমি আসছি।”
বলেই ফাইয়াজ হাঁটা ধরল। ফাইয়াজের কার্যকলাপে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় সিরাত‌। মিনিট দুয়েক দাঁড়িয়ে থাকতেই পুনরায় তার সামনে হাজির হয় ফাইয়াজ। হাতের মধ্যে দুটো ব্যাগ ঝোলানো।
– “হাত বাড়াও।”
ফাইয়াজের কথায় ভ্রু কুঁচকে নেয় সিরাত‌।
– “কি হলো হাত বাড়াও, কুইকলি।”
হাত বাড়াতেই সিরাতের হাতে ব্যাগ দুটো ধরিয়ে দেয় ফাইয়াজ।
– “এগুলো আবার কি?”
– “তোমার বার্থ ডে এর সেকেন্ড গিফট। আজ সন্ধ্যায় পার্টির জন্য আমি নিজে সিলেক্ট করে নিয়ে এসেছি আর এটাই তুমি আজ সন্ধ্যায় পড়বে।”
– “কিন্তু,,এসব!”
– “হুস! আর একটা কথা ও না। যেটা বলেছি সেটাই করতে হবে। এখন উপরে চলে যাও, সন্ধ্যে হতে কিন্তু খুব একটা দেরি নেই মেরি জান!”
পাশেই নিশাত দাঁড়িয়ে সবটা শুনে মুখ টিপে হাসছে।
ফাইয়াজের কথাবার্তা শুনে মুখ ফুলিয়ে নেয় সিরাত‌। নিশাতের সামনে যেন লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার মতো অবস্থা। উল্টো পায়ে কোনোমতে হাঁটা দেয় উপরের দিকে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে মনে মনে বিড়বিড় করে উঠে,
– “এই লোকটার মুখে আদৌ কোনোকিছু আটকায় না নাকি! যখন যা আসে মুখে তাই বলে দেয়। এভাবে নিশাতের সামনে আমাকে লজ্জায় ফেলে দেয়া কি খুব প্রয়োজন ছিল?”

সিঁড়ির উপর একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে নিচে তাকিয়ে রয়েছে রিয়া‌। এতক্ষণ ধরে সিরাতের মুখের প্রাণোচ্ছ্বল হাসি দেখে তার শরীর যেন রাগে ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে। সিরাত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই আড়চোখে একবার সিরাতের দিকে তাকিয়ে একবার হাতের ব্যাগের তাকিয়ে বাঁকা হাসি দেয়।
দুপুরের পর শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে ব্যাগের কথা মনে পড়তেই ব্যাগের কাছে চলে যায় সিরাত‌। প্যাকেট খুলতেই তার ভেতর থেকে একটা লং গাউন বেরিয়ে আসে। ড্রেসটার উপর হাত বুলাতেই খেয়াল করে গাউনের বিভিন্ন অংশে পার্লের আর স্টোনের কাজ করা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ড্রেস হাতে নিয়ে মুচকি হাসে সিরাত‌। ফাইয়াজের প্রতি দিনকে দিন তার মুগ্ধতা আর দুর্বলতা দুটোই বেড়ে চলেছে। তার দৃষ্টি শক্তি না থাকা সত্ত্বেও সেটা এক মুহূর্তের জন্যও বুঝতে দেয় না। কিন্তু এই সুন্দর মুহূর্তগুলো কি চিরস্থায়ী নাকি ক্ষণিকের জন্য তার জীবনে এসেছে ভাবতেই সুক্ষ্ম চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে সিরাতের কপালে।

সিরাতের ভাবনায় ছেদ পড়ে নিচ থেকে নিশাতের ডাকে। হাতে থাকা ড্রেসটা বিছানায় রেখে দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে সে। সিরাত রুম থেকে বেরিয়ে পড়তেই পা টিপে টিপে রুমে প্রবেশ করে রিয়া। বিছানায় রাখা ড্রেসের উপর চোখ পড়তেই মুখে আপনাআপনি শয়তানি হাসি ফুটে উঠে তার। হাতে থাকা কেঁচিটার দিকে তাকিয়ে সামনের এগিয়ে যায় সে।
বিশালাকার হলরুমে বিভিন্ন আর্টিফিশিয়াল ফ্লাওয়ার আর বিভিন্ন রকমের কারুকাজের সমন্বয়ে সাজানো হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ছোট বড় সাইজের বেলুন দিয়ে সাজানো। একে একে অনেক গেস্ট ই আসা শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। জাফর সাহেব একবার এসে সবকিছু পরখ করে গেলেও মুখ ফুটে কিছু বলেন নি। ইদানিং ফাইয়াজের সাথে তেমন কোনো কথার সুযোগ হয়ে উঠে না তার। ফাইয়াজ ও হাসিমুখে সবাইকে স্বাগতম জানাচ্ছে। সন্ধ্যে হয়েছে বেশ খানিকক্ষণ আগেই। এখন শুধু সিরাতের আসার পালা। সবাই অধীর আগ্রহে সিরাতের জন্য অপেক্ষা করছে। সবার অপেক্ষার প্রহরের‌ সমাপ্তি ঘটিয়ে গুটি গুটি পায়ে ফারিহা আর নিশাতের সাথে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়ায় সিরাত‌।
ফাইয়াজের দৃষ্টি সিরাতের উপর পড়তেই থমকে যায় কিছুক্ষণের জন্য সে। অলিভ রঙের লং গাউন, তাতে পার্লের আর স্টোনের কাজ যেন ফুটে উঠেছে সিরাতের শরীরে‌। তার সাথে মিলিয়ে চুলগুলোকে সুন্দর করে একসাইডে‌ বিনুনি করে তাতে আর্টিফিশিয়াল‌ পার্ল বসানো। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে সিরাত‌। পিছু পিছু নিশাত আর ফারিহাও নেমে আসে।
ফাইয়াজের একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকায় ব্যাঘাত ঘটে রিয়ার কন্ঠস্বরে।
– “ওও মুগ্ধ,,ইউ লুক সো স্টানিং‌! আজকে তো তোমার দিক থেকে চোখ ফেরানোই যাবে না, ও মাই গড!”
রিয়ার ন্যাকামোজনক‌ কথাবার্তা শুনে বেশ বিরক্ত হয় ফাইয়াজ। তবে সেটা মুখ ফুটে প্রকাশ করে না। ছোট করে থ্যাংকস বলে পাশ কাটিয়ে চলে যায় ফাইয়াজ।
সিরাত নেমে আসতেই ফাইয়াজ হাত বাড়িয়ে দেয় সিরাতের দিকে। সিরাত ও সন্তর্পণে হাত বাড়িয়ে দেয় ফাইয়াজের দিকে।
– “আমি যে নতুন করে প্রতিদিন তোমার প্রেমে পড়ে যাই! বাই চান্স নিজের এই রূপ দিয়ে আমাকে অকালে মেরে টেরে ফেলার কোনো কারণ আছে নাকি, মেরি জান!”
ফিসফিস করে বলে উঠে ফাইয়াজ। ফাইয়াজের কথায় মুখশ্রী জুড়ে লাল আভার রেখা ফুটে ওঠে সিরাতের‌।

– “স্যার, ইনি তো সেই মেয়েটিই যার সাথে পূর্বেও আপনার নানা নিউজ ছাপানো হয়েছিল। আপনার ভাষ্যমতে আপনাদের দুজনের মাঝে কোনো সম্পর্ক ছিল না, তাহলে এই মেয়েটি ওরফে সিরাত আনবার আপনার বাড়িতে কি করছে? কি সম্পর্ক আপনাদের দুজনের?”
বলেই মিডিয়া প্রেসের একজন রিপোর্টার ক্যামেরা সহ স্পিকার এগিয়ে দেয় ফাইয়াজের দিকে। এমন অবাঞ্চিত প্রশ্নে হালকা অস্বস্তি হয় সিরাতের। কিন্তু ফাইয়াজের মাঝে তেমন কোনো ভাবান্তর নেই।
– “বিকজ সে এই আহমেদ বাড়ির বউ, ওরফে ফাইয়াজ আহমেদ মুগ্ধর ফিয়্যনসে‌। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই সিরাত আনবারের সাথে আমার বিয়ে হবে। আশা করি এর পর আর কিছু এক্সপ্লেইন করার প্রয়োজন নেই!”
সোজাসাপ্টা গলায় বলে উঠে ফাইয়াজ। এতে করে রিপোর্টার চুপসে যায়। আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সিরাতকে নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ায় ফাইয়াজ।
গর্জিয়াস ডেকোরেশন করা হার্ট শেপের কেক সামনের টেবিল টায় রাখা‌। সিরাতকে নিয়ে সামনে এগোতেই মিসেস সাবিনা সহ ফারিহা, নিশাত বাকি সবাই কেক কাটার জন্য তাড়া দেয়া শুরু করে। সিরাত ও বাধ্য হয়ে হাত বাড়াতে যাবে তখনই পাশ থেকে ফাইয়াজ বলে উঠে,
– “উহু, এক মিনিট! এত তাড়াতাড়ি কেক কাটলে হবে নাকি? এখনো তো আসল সারপ্রাইজ দেয়াটাই বাকি।”
আবারো সারপ্রাইজ এর কথা শুনতেই কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে নেয় সিরাত‌।
– “সারপ্রাইজ? কেমন সারপ্রাইজ? এত কিছুর পরও আরও কিছু কি বাকি আছে?”
– “ইয়েস মেরি জান, সবে তো শুরু! আরো একটা বড় সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য!”
– “কিন্তু সেটা কি?”
– “ওয়েট, এক মিনিট। আপনারা প্লিজ ভেতরে আসুন!”
ফাইয়াজের কথা ঠিক বোধগম্য হয় না সিরাতের‌। সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে চন্দ্রিকা আর রূপ। ধীর পায়ে সিরাতের সামনে এসে জড়িয়ে ধরতেই চমকে উঠে সিরাত।
– “চন্দ্রিকা আপু তুমি?”
– “হ্যাঁ, পূরবী আমি।”
– “কিন্তু তুমি তো চট্টগ্রামে ছিলে!”
– “হ্যাঁ ছিলাম তবে না এসে পারলাম না। তোর জন্মদিন আর আমি আসব না এটা হয় নাকি? তাছাড়া মিস্টার ফাইয়াজ ই আমার আর ডক্টর রূপের ঢাকায় ব্যাক করার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।”
মুচকি হেসে বলে উঠে চন্দ্রিকা। রূপ ও বিনিময়ে মুচকি হাসি দেয়।
সবার উপস্থিতি যেন সিরাতের আনন্দকে আরো কয়েকগুণ প্রসারিত করে তোলে। ফাইয়াজ ও সবটা একদৃষ্টে মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে। সবার তাড়া পেয়ে সিরাত কেট কাটার জন্য প্রস্তুতি নেয়। কেকের ওপর ছুরি চালাতেই সবাই একত্রে বলে উঠে,
” হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ সিরাত, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ।”
কেকের প্রথম বাইট ফাইয়াজ সিরাতকে খাইয়ে দেয়। একে একে সবাই এক বাইট এক বাইট করে খাইয়ে দেয় সিরাতকে।

– “লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান, এটেনশন প্লিজ! আজকের মতো এত সুন্দর একটা আয়োজনে আরো একটা ছোট কাপল ডান্সের আয়োজন করলে কেমন হয়! আর এই কাপল ডান্সের মেইন কাপল হিসেবে থাকবে আমাদের রকস্টার ফাইয়াজ আহমেদ মুগ্ধ আর আজকের বার্থডে গার্ল সিরাত আনবার পূরবী!”
হুট করে জনসমক্ষে বলে উঠে ধ্রুব‌। সবার দৃষ্টিই ধ্রুবের দিকে। কাপল ডান্সের কথা শুনে আঁতকে উঠে সিরাত। ফিসফিস করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফাইয়াজকে বলে উঠে,
– “ধ্রুব ভাইয়া এগুলো কি বলছেন ফাইয়াজ? প্লিজ না করে দিন। কাপল ডান্স কি করে? আমি তো ডান্স পারি না; আর সবচেয়ে বড় কথা না দেখে কি করে সম্ভব!”
– “ঠিকই তো বলেছে ধ্রুব। আর বাদবাকি রইলো ডান্সের কথা? ডোন্ট ওয়ারি। তোমাকে কিছুই করতে হবে না, তুমি শুধু আমার সাথে স্টেপ বা স্টেপ মিলাবে‌।”
– “কিন্তু?”

– “মিউজিক প্লিজ।”
সাথে সাথেই সব লাইট অফ হয়ে যায়। নীল রঙের মৃদু আলো জ্বলে উঠে।

” অ্যায়‌ মেরে হামসাফার‌,,
ইক জারা ইন্তেজার‌,
সুন সাদায়ে‌ দে রেহি হ্যায়
মাঞ্জিল‌ পেয়ার কি!

অ্যায় মেরে হামসাফার‌,,
ইক জারা ইন্তেজার‌,
সুন সাদায়ে‌ দে রেহি হ্যায়
মাঞ্জিল পেয়ার কি!

ফাইয়াজ-সিরাত , চন্দ্রিকা-রূপ সহ বেশ কয়েকজন ও কাপল ডান্সে অংশ নেয়। ফাইয়াজের সাথে তাল মিলিয়ে মিলিয়ে বাকি স্টেপ ফেলা শুরু করে সিরাত‌।

জিসকো দুয়া মে মাঙা,
তু হ্যায় ওয়াহি রেহনুমা
তেরে বিনা মুশকিল হ্যায়
এক ভি কাদাম চাল না!(২)

বিন তেরে কাহা হ্যায় মাঞ্জিল পেয়ার কি!
অ্যায় মেরে হামসাফার‌,,
ইক জারা ইন্তেজার‌,
সুন সাদায়ে‌ দে রেহি হ্যায়,
মাঞ্জিল পেয়ার কি!
রূপের দৃষ্টি যেন চন্দ্রিকার মুখশ্রীতে আবদ্ধ, যা চন্দ্রিকাকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।
সিরাত ও কোনো প্রকার সমস্যা ছাড়াই স্টেপ নিচ্ছে। কিন্তু হুট করেই ঘোরার সময় ড্রেসের সাইডের স্টিচ খুলে যাওয়ার মতো বিব্রতকর ঘটনা ঘটতেই আঁতকে উঠে সে।
ফাইয়াজের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে তড়িঘড়ি করে জামার সাইড হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে।………..

#চলবে 🍂

#বাসন্তী_প্রেম 🌼🌼
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#চতুর্বিংশ_পর্ব

হঠাৎ এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ায় কোনো কূল কিনারা খুঁজে পায় না সিরাত‌। আতংকিত হয়ে ফাইয়াজের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে ড্রেসের সাইডের অংশ আঁকড়ে ধরে। এদিকে সিরাত হুট করে সরে যাওয়াতে হালকা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় ফাইয়াজ। কিন্তু পরমুহূর্তেই সিরাতের উন্মুক্ত কোমড় সংলগ্ন ড্রেস ভেদ করে বেরিয়ে আসতে দেখে বিস্মিত হয় সে। মৃদু আলোতে ফর্সা শরীরের একাংশ বের হয়ে যাওয়ার মতো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে তড়িঘড়ি করে নিজের গায়ে থাকা কোট খুলে সিরাতের গায়ে জড়িয়ে দেয় ফাইয়াজ। হুট করে ডান্স বন্ধ হয়ে যাওয়াতে সব মিউজিক বন্ধ হয়ে যায়, সাথে করে লাইট গুলোও জ্বলে ওঠে। হলরুমে উপস্থিত সকলের দৃষ্টি সিরাত এবং ফাইয়াজের দিকে স্থির।
সিরাত চুপসে এক কর্নারে ফাইয়াজের কোট গায়ে জড়িয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হুট করে এমনটা হওয়াতে মিসেস সাবিনা বেগম এগিয়ে আসেন। বিচলিত হয়ে সিরাত আর ফাইয়াজকে জিজ্ঞেস করে ওঠেন,
– “কি ব্যাপার সিরাত? কি হয়েছে? ফাইয়াজ?”
সিরাত কোনো কথার উত্তর না দিয়ে ড্রেস হাতে গুটিয়ে নিয়ে উপরের দিকে হাঁটা শুরু করে।
– “মা, আই উইল এক্সপ্লেইন ইউ লেটার‌।”
বলেই ফাইয়াজ ও সিরাতের পিছু পিছু হাঁটা দেয়। উপস্থিত সকলের কাছে ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হয় না। অনেকেই কানাঘুষা শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। রিয়াও এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে সবটা দেখে আনমনেই হেসে উঠে। ধ্রুব সবার নীরবতা ভাঙিয়ে দিতে বলে উঠে জনসমক্ষে,
– “সরি ফর এভরিথিং গাইস। বাট ইটস্ এ ফ্যামিলি ম্যাটার। আপনাদের সকলকে পার্টি এটেনড্ করার জন্য অনেক ধন্যবাদ।”
ধ্রুবের কথায় সকলে একে একে আহমেদ ম্যানশন থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে। চন্দ্রিকা আর রূপ দুজনেই একে অপরের মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে। দৃষ্টিতে দুজনেরই দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
রুমের মধ্যে কোনোমতে প্রবেশ করে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দেয় সিরাত‌। দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে নিশ্চুপ হয়ে বসে পড়ে। সবকিছু যেন অবিশ্বাস্য আর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। একটু আগের ঘটনা মনে পড়তেই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে আতংকে। শরীর থেকে সরিয়ে নিয়ে আলমারি থেকে একটা ড্রেস নিয়ে চেঞ্জ করে নেয় অতিদ্রুত। খাটের উপর ভাবলেশহীন দেহ নিয়ে বসে পড়তেই গত সময়ের ঘটনায় ফাইয়াজ সঠিক সময়ে গায়ে কোট জড়িয়ে না দিলে কি পরিণাম হতে পারত তা নিয়েই ভাবনার জগতে মগ্ন হয়ে যায় খুব গভীর ভাবে। তার ভাবনার সুতো কাটে দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ পেয়ে।
– “সিরাত? আর ইউ ওকে? দরজা খোলো! আমি সত্যিই ভাবিনি হুট করে এমনটা হয়ে যাবে। প্লিজ লেট মি এক্সপ্লেইন। সিরাত?”
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রলাপ বকে ফাইয়াজ। কিন্তু অপর পাশ থেকে কোনো প্রত্যুত্তর না পেতেই চিন্তা আরো এক ধাপ এগিয়ে যায় ফাইয়াজের। দরজায় দ্রুত কড়া নাড়তে থাকে। মিনিট দুয়েক পর দরজা খুলতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। দ্রুত রুমের ভেতর প্রবেশ করে সিরাতের দিকে এগিয়ে যায় সে।
– “আর ইউ ফাইন? লিসেন আ’ম সো সরি, আমি কখনো কল্পনাও করিনি এমন একটা উইয়ার্ড পরিস্থিতি হয়ে যেতে পারে। আমি ইচ্ছে করে করি নি, ট্রাস্ট মি।”
সিরাতের দু গাল নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অস্থির হয়ে প্রলাপ বকে চলে ফাইয়াজ। ফাইয়াজের অস্থিরতায় সমাপ্তি ঘটিয়ে নিঃশব্দে ফাইয়াজকে জড়িয়ে ধরে সিরাত‌। এতেই মুখ থেকে সমস্ত বাক্যালাপ হারিয়ে যায় ফাইয়াজের।
– “আমি জানি আপনি কিছু করেননি। আমার উল্টো আপনার কাছে কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। আপনি ঐ সময় না থাকলে কি হয়ে যেতে পারত! প্লিজ নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে আমাকে ছোট করবেন না।”
নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে উঠে সিরাত‌। ফাইয়াজ ও সিরাতের কথায় মুচকি হেসে তার দু হাত প্রসারিত করে সিরাতকে নিজের বাহুতে আবদ্ধ করে নেয়।
রাতের ডিনার শেষে,,
ব্যালকনিতে এক ধ্যানে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল ফাইয়াজ। পাশেই ঝুলন্ত চেয়ারটাতে কয়েকটা সায়েন্স ফিকশনের বই আর কয়েকটা রোমান্টিক উপন্যাস সহ গিটার টা রাখা। বস্তুত বই পড়ার অভ্যাস খুব একটা তীব্র না হলেও বই পড়লেই প্রশান্তি পাওয়া যায়। কিন্তু আজকালকার এই দুশ্চিন্তা আর নানা ব্যস্ততায় বইগুলোকে তেমন ভাবে ছুঁয়ে দেখা হয় নি।
– “ভেতরে আসতে পারি, মিস্টার ফাইয়াজ?”
পেছন থেকে কোনো পুরুষালী কন্ঠ কর্ণগোচর হতেই ফিরে তাকায় ফাইয়াজ।
– “আরে ডক্টর রূপ, চন্দ্রিকা আপু আপনি? বাহিরে দাঁড়িয়ে পারমিশন নেয়ার কি আছে? ভেতরে আসুন।”
ফাইয়াজের অনুমতি পেয়ে ভেতরে প্রবেশ করে চন্দ্রিকা আর রূপ। ফাইয়াজ ও ব্যালকনি থেকে রুমে এসে পড়ে।
– “আসলে সিরাতকে নিয়ে কিছু ইম্পর্ট্যান্ট কথা ছিল। যেটার বিষয়ে আমরা দুজন ঢাকায় এসেছি সেটার মেইন পয়েন্ট নিয়ে কিছু কথা আছে।”
সোজাসাপ্টা গলায় বলে উঠে চন্দ্রিকা। ফাইয়াজ গভীর কন্ঠে বলে উঠে,
– “হুম বলুন।”
চন্দ্রিকা তার চোখের ইশারা দিতেই রূপ ছোট্ট একটা শ্বাস নিয়ে বলা শুরু করে বক্তব্য আর ফাইয়াজ ও সেগুলো মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকে।

বেশ খানিকটা রাত হওয়া সত্ত্বেও ঘুম নেই চোখে সিরাতের‌। নিশাত বেশ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুম না ধরার ফলস্বরূপ আকাশের স্বল্প আলোয় ব্যালকনিতে চেয়ার পেতে বসে আছে সিরাত‌। জীবনের সব অধ্যায়ের হিসেব মিলানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে চলেছে তার মস্তিষ্ক। তবুও তার মাঝে এক টুকরো প্রশান্তি যেন ডানায় ভর করে চলে আসে মুহূর্তেই। ফাইয়াজ নামক মানুষটা তার জীবনের সাথে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে রয়েছে চাইলেও যেন দুঃখ, কষ্ট সব কর্পূরের মতো মিলিয়ে যায়। এই মানুষটাই তো এত ফ্যাকাশে রংহীন জীবনকে রঙিন করায় প্রচেষ্টা করে চলেছে প্রতিনিয়ত। ফাইয়াজের ধ্যানে মগ্ন হয়ে থাকতে থাকতে এক সময় চোখের পাতায় ঘুম নেমে আসে।

রূপ আর চন্দ্রিকার কথা শোনার পর চেহারায় বেশ গাম্ভীর্য ভাব চলে এসেছে ফাইয়াজের মধ্যে।
– “আর এতকিছুর পরও অপারেশন সাকসেসফুল হওয়ার চান্স মাত্র ১০%। এতটুকুই ছিল ইম্পর্ট্যান্ট কথা। যা কিছু করতে হবে খুব ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ফাইয়াজ। আর তুমি যদি চাও আমি সিরাতের অপারেশন খুব ইমিডিয়েটলি শুরু করব। আর আই হোপ অপারেশন টা যেন সাকসেসফুল হয়!”
রূপের কথায় মেঝে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মাথা তুলে তাকায় ফাইয়াজ। মস্তিষ্ক কাজ করছে না। লাইফের সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট একটা ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেয়া যেন বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে তার কাছে। মাথার চুল গুলো আঙুলে আবদ্ধ করে দু তিনটে নিঃশ্বাস ফেলে সে।
– “ঠিক আছে। সব কন্ডিশনে আমি রাজী। ১০% পসিবিলিটি থাকলেও আমি এ অপারেশন করাতে চাই।”
– “আর ইউ শিওর?”
– “ইয়েস, ডক্টর রূপ! আ’ম শিওর।”
ফাইয়াজের সাথে কথা শেষ হতেই উঠে দাঁড়ায় চন্দ্রিকা আর রূপ। পা বাড়ায় রুমের বাইরের দিকে।

তীব্র রোদের প্রখরতা চোখে সরাসরি পড়তেই নড়েচড়ে উঠে সিরাত‌। টেবিল থেকে মাথা তুলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। হাই তুলে ফ্রেশ হওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় ওয়াশরুমের দিকে। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই চন্দ্রিকার কন্ঠ স্পষ্ট শুনতে পায় সে। নিশাতের সঙ্গে খোশগল্প করতে ব্যস্ত চন্দ্রিকা। হুট করে ফোনে কল আসায় থেমে যায় সে। ফোনের উপর ইয়াসিন আঙ্কেল নামটা জ্বলজ্বল করছে। ঠিক কি উদ্দেশ্যে ইয়াসিন সাহেবের কল এসেছে তা বুঝতে বেশি বেগ পেতে হয় না চন্দ্রিকাকে।

– “আমি একটু আসছি!”
বলেই উঠে পড়ে চন্দ্রিকা।
– “………………..”
– “কিন্তু আঙ্কেল আমি তো আগেই বলেছি আমার পক্ষে ডক্টর রূপ কে বিয়ে করা পসিবল না। তুমি তো সব জানো তবুও কেন? আর আমি ডিসাইড করেছি আমি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ব্যাক করলেই ডক্টর রূপ কে সরাসরি না করে দিব।”
– “………………..”
– “ঠিক আছে আমি রাখছি এখন।”
বলেই কল কেটে দেয় চন্দ্রিকা‌। ছোট একটা শ্বাস ফেলে পেছনে ফিরতেই চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে যায় তার।
– “প্‌,পূ্,পূরবী তুই?”
– “তুমি রূপ ভাইয়াকে ভালোবাসো তাই না?”
গম্ভীর গলায় বলে উঠে সিরাত‌। এতে আরো এক দফা অবাক হয় চন্দ্রিকা।
– “কি সব বলছিস তুই? নিশ্চয়ই তোর কোথাও ভুল হয়েছে। আমি ডক্টর রূপকে ভালোবাসতে যাব কেন?”
– “শুধু শুধু মিথ্যে কথা বলছ কেন? আমি খুব ভালো করেই জানি তুমি রূপ ভাইয়াকে ভালোবাসো, তবুও তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছ কেন যেখানে রূপ ভাইয়া নিজেই তোমাকে ভালোবাসে?”
– “হ্যাঁ আমি জানি ডক্টর রূপ আমাকে ভালোবাসেন আর আমি এটাও স্বীকার করছি যে ডক্টর রূপের প্রতি আমিও দুর্বল হয়ে পড়েছি। কিন্তু আমি দ্বিতীয়বার কারো ভালোবাসার মায়াজালে নিজেকে জড়াতে চাই না। আমি তো আরমানকে ও ভালোবেসেছিলাম, কিন্তু দিনশেষে সে ঠিকই অন্যের সাথে চলে গিয়েছে। তাই আবারো ভয় হয় ডক্টর রূপকে নিয়ে। যদি সেও চলে,,,,”
– “যাবে না, আমার বিশ্বাস। আহামরি তেমন ভাবে আমি রূপ ভাইয়াকে চিনি না তবে এটা জানি তোমার প্রতি তার ভালোবাসা কোনো সাজানো মিথ্যে নয়। আর একটা মানুষের জন্য আর কতদিন নিজেকে কষ্ট দিতে থাকবে চন্দ্রিকা আপু? আরো একবার না হয় নিজের জীবনকে সুযোগ দিয়ে দেখ। দিনশেষে সব কালপ্রহর কেটে গিয়ে ভালোবাসার সফলতা নিশ্চয়ই আসবে।”
সিরাতের কথা শুনে থমকে যায় চন্দ্রিকা। আসলেই কি তাই? তার কি উচিত নিজের জীবনকে নতুন করে আর একটিবার সুযোগ দেয়া?……………

#চলবে 🍂