বাসন্তী প্রেম পর্ব-৩০ এবং শেষ পর্ব

0
917

#বাসন্তী_প্রেম 🌼🌼
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#ত্রিংশ_পর্ব (অন্তিম পাতা)

গাছের পাতা ঝড়ে পড়ার সময়ের অব্যহতি হয়েছে। আগমন ঘটেছে নতুনত্বের। পুরনো কে বিদায় দিয়ে নতুনত্বের আগমনে ব্যস্ত বিশাল প্রকৃতি। শীতের সমাপ্তি ঘটে বসন্তের শুরু। প্রকৃতির মাঝে ফিরেছে নতুন প্রাণ।
মাঝ থেকে কেটে গিয়েছে প্রায় দুমাস। আজ সকাল থেকেই আহমেদ বাড়িতে সবার মধ্যে চলছে বেশ অস্থিরতা। সকাল সকালই ফাইয়াজ সহ সাবিনা বেগম, ফারিহা, নিশাত, চন্দ্রিকা সবাই বেরিয়ে পড়েছে হসপিটালের উদ্দেশ্যে। সিরাতের চোখের অপারেশন হওয়ার দুমাস পূর্ণ হয়েছে আজকে। সবারই থাকা অধীর অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। হসপিটালে পৌঁছাতেই সবাই দ্রুত সিরাতের কেবিনে পা বাড়ায়। কেবিনে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে ডক্টর রূপ সহ কেবিনে থাকা দু তিনজন নার্স।
কেবিনে সবাইকে উপস্থিত দেখে রূপ মুচকি হেসে এগিয়ে যায়।
– “আর আঙ্কেল, আন্টি আপনারা এসে পড়েছেন?”
রূপের কথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই বেডের উপর বসে থাকা সিরাত হালকা নড়েচড়ে উঠে। মিসেস সাবিনা বেগম মাথা নাড়িয়ে এগিয়ে যান সিরাতের দিকে। নিশাত আর ফারিহাও পিছু পিছু এগিয়ে যায়।
– “আপু তুই ঠিক আছিস?”
সিরাতের পাশে বসে জিজ্ঞেস করে উঠে নিশাত।
– “ঠিক না থেকে আর কোনো উপায় আছে? এ দুমাসের প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত তোমাদের যত্ন, ভালোবাসা শুধু আমাকে কেন একজন মুমূর্ষু ব্যক্তিকেও‌ সুস্থ করার জন্য যথেষ্ট।”
ক্ষীণ কন্ঠে বলে উঠে সিরাত‌। মিসেস সাবিনা সযত্নে হাত বুলিয়ে দেন সিরাতের মাথায়।
– “উহুম, উহুম! এভাবে সারাদিন ইমোশনাল হয়ে থাকলে হবে? এমন করলে সিরাতের ডিসচার্জ কিন্তু ক্যান্সেল হয়ে যাবে। এখন বাকিটুকু আপনাদের ইচ্ছা।”
খানিকটা গম্ভীর হয়ে বলে উঠে রূপ। এদিকে রূপের কথায় তেমন কোনো ভ্রূক্ষেপ না থাকলেও পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু ফাইয়াজের বিচরণ সিরাতের‌। আজ সে তার প্রিয় ব্যক্তিটিকে একদম কাছ থেকে ছুঁয়ে দেখতে পারবে, তার চোখের গভীরতা উপলব্ধি করতে পারবে। কিন্তু ফাইয়াজের অনুপস্থিতি টের পেতেই ভেতরে একপ্রকার শূন্যতা অনুভব হতে শুরু করে সিরাতের‌।
– “ফাইয়াজ আপনি কোথায়? আপনি কি আসেন নি? কিন্তু সর্বপ্রথম চোখ খোলার পর যে আমি আপনাকে দেখতে চাই। কিন্তু কোথায় আপনি?”
মনে মনে বিড়বিড় করে সিরাত।
– “আচ্ছা তাহলে এবার আমরা নেক্সট প্রসেসে এগোই? নার্স, কাম হেয়ার‌!”
রূপের কথামতো একজন নার্স এগিয়ে আসে সিরাতের দিকে। অতঃপর ধীর গতিতে সিরাতের চোখে থাকা ব্যান্ডেজের প্রলেপ খোলা শুরু করে। যতই এক ধাপ এগোচ্ছে ততোই মনের মধ্যে অস্থিরতা তীব্র হচ্ছে সিরাতের‌। ব্যান্ডেজের প্রলেপ খোলা শেষ হতেই নার্স অতি সাবধানের সাথে চোখের উপর থাকা তুলা দুটোকে সরিয়ে নেয়।
– “ওপেন ইউর আইস, সিরাত!”
স্বাভাবিক ভাবে বলে উঠে রূপ। সবাই এক কোণে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। রূপের কথামতো সিরাত ধীরে ধীরে নিজের চোখ খোলার চেষ্টা করে কিন্তু পরক্ষণেই সবকিছু ঝাপসা ঝাপসা মনে হতেই পুনরায় চোখ বন্ধ করে নেয় সে।
– “ধীরে ধীরে চোখ খোলার চেষ্টা করো সিরাত।”
দ্বিতীয় বারের মতো চোখ পিটপিট করে তাকানোর চেষ্টা করে সিরাত‌। এবার পুরোপুরি ঝাপসা না দেখলেও চারপাশে মানুষের হালকা অস্পষ্ট অবয়ব বোঝা যাচ্ছে। মিনিট দুয়েক পর ধীরে ধীরে যেন সবকিছু পরিষ্কার হয়ে আসে। সবকিছু যেন অবিশ্বাস্য লাগছে।
– “আপু তুই সব দেখতে পারছিস? সবকিছু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে? আমাদের সবাইকে দেখতে পারছিস তুই?”
বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে নিশাত। সিরাত কোনো জবাব দেয় না। চারপাশে চোখ বুলাতেই একজন মধ্যবয়সী নারী, একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ আর নিশাতের সমবয়সী মেয়েকে চোখে পড়ে তার‌। সবার উপস্থিতি থাকলেও একজনের অনুপস্থিতি তাকে ভীষণ ভাবে পোড়াচ্ছে।
– “কি হলো পূরবী? তুই কিছু বলছিস না কেন? তুই সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পারছিস তো?”
খানিকটা এগিয়ে বলে উঠে চন্দ্রিকা।
– “হ্যাঁ, চন্দ্রিকা আপু। আমি সব দেখতে পারছি। তোমাকে, নিশাত, ফারিহা, আঙ্কেল, আন্টি আর ডক্টর রূপ সবাইকেই দেখতে পারছি।”
সিরাতের কথায় সবার মুখেই তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে সিরাতকে নিয়ে। কিন্তু সিরাতের দৃষ্টি তখনও দরজার দিকে স্থির। প্রিয় মানুষটির আগমনের অপেক্ষায় মগ্ন সে। এদিকে সেটা সবাই খেয়াল করতেই মিটমিট করে হেসে উঠে।
– “কি ব্যাপার আপু, কাকে খুঁজছিস তুই?”
নিশাতের প্রশ্নে হালকা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় সিরাত‌।
– “ক,ক্,কই? ক্,কি বলছিস? কাকে খুঁজব আমি?”
খানিকটা অপ্রস্তুত ভাবে বলে উঠে সিরাত‌। এভাবে সবার সামনে অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়ে লজ্জায় মাথা উঁচু করে তাকানো সম্ভব হচ্ছে না তার‌। মিসেস সাবিনা চোখের ইশারা দিতেই হাসি থামিয়ে দেয় নিশাত‌। মিসেস সাবিনার নির্দেশনা অনুযায়ী সবাই একে একে ধীর পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যাওয়া শুরু করে। এভাবে হুট করে সবাই চলে যাওয়ার বিশেষ কোনো কারণ খুঁজে পায় না সিরাত‌। ভ্রু কুঁচকে বেড থেকে নিচে নামার জন্য পা বাড়াতেই খটখট শব্দে কেবিনের দরজা খুলে উঠে। হালকা চমকে পাশে তাকাতেই দৃষ্টি যেন সামনে থাকা মানুষটির দিকে আটকে যায় সিরাতের‌।
হলদে শ্যাম বর্ণের চেহারায় অদ্ভুত আকর্ষণ রয়েছে। আর নীল রঙের চোখ দুটোতে যেন লুকিয়ে আছে এক সমুদ্র সমান গভীরতা। ফাইয়াজের চোখের দিকে আবদ্ধ সিরাতের চোখ। পলক ফেলার ও যেন ফুরসৎ নেই। ফাইয়াজ আলতো হেসে এগিয়ে যায় সিরাতের দিকে।
গালে পুরুষালী হাতের স্পর্শ পেতেই শিউরে উঠে সিরাত। সাথে সাথে চোখ দুটোও বুজে আসে।
– “সিরাত?”
ফাইয়াজের ফিসফিস করে বলা নামে আরো একধাপ শিউরে উঠে সিরাত।
– “ওপেন ইউর আইস, মেরি জান!”
চোখ মেলে তাকায় সিরাত। চোখে মুখে একরাশ মুগ্ধতা। নিজের ডান হাত ধীরে ধীরে এগিয়ে ফাইয়াজের চিবুক ছুঁয়ে দিতেই ক্ষীণ কন্ঠে বলে উঠে,
– “ফাইয়াজ?”
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় ফাইয়াজ। নিজের প্রিয় মানুষটিকে চোখ জুড়িয়ে দেখার মতো মুগ্ধতা বুঝি আর কিছুতেই নেই। নিজের হাত দুটো প্রসারিত করতেই ফাইয়াজের বুকে মাথা গুঁজে দেয় সিরাত‌। ফাইয়াজ ও দুহাতে আবদ্ধ করে নেয় নিজের প্রেয়সীকে।
ভালোবাসা। চারটে খানিক অক্ষর দিয়ে তৈরি একটি শব্দ। আর এ শব্দকেই ঘিরেই হৃদয়ের সকল সুপ্ত অনুভূতি। আর ভাগ্যবান সেই মানুষগুলো যারা জীবনের প্রতিটা অধ্যায় নিজের ভালোবাসার মানুষের সাথে পাড়ি দিতে পারে।
আহমেদ বাড়িতে বিশালাকার আয়োজন চলছে। চলবেই না কেন? একই সাথে দু দুটো বিয়ে আহমেদ বাড়িতে প্রথমবারের মতো হতে চলেছে। জাফর সাহেব সকাল থেকেই ডেকোরেশনের বিভিন্ন দেখাশোনার কাজে লেগে পড়েছেন। সাবিনা বেগম ও ঠিক সমপরিমাণ ই ব্যস্ত। নিজের একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা। তাছাড়া ফারিহা আর নিশাতের মাঝেও নিজেদের ভাই বোনকে নিয়ে টানটান উত্তেজনা।
সিঁদুর লালের মাঝে গোল্ডেন মিশ্রণের লেহেঙ্গা পরনে, মেহেদী দিয়ে রাঙানো দু হাতে মুঠো ভর্তি লাল চুড়ি, কপালের সিঁথিতে টিকলি, মুখের উপর হালকা মেকআপের আবরণ। পুরো বধূ সাজে সজ্জিত হয়ে বসে আছে সিরাত‌। ঠোঁটের কোণে লেগে রয়েছে একপ্রকার লাজুকতা। তার ঠিক পাশেই কালো রঙের লেহেঙ্গা পরনে, দু হাতে মুঠো ভর্তি কালো চুড়ি, হালকা সাজসজ্জায় সজ্জিত হয়ে বসে আছে চন্দ্রিকা। বধূ রূপে নাকি মেয়েদের উজ্জ্বলতা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। হয়তো তাই! দুজনকে বধূ বেশে যেন অপরূপ সুন্দরী লাগছে। নিজের ভালোবাসার মানুষকে শেষ পর্যন্ত নিজের, একান্তই নিজের করে পাওয়ার মতো জাগতিক সুখ হয়তো আর কোথাও নেই।
প্রত্যেকটা মানুষের জীবনেই কিছু খারাপ সময় থাকে। তবে কোনোটাই চিরস্থায়ী নয়। দুঃখকে ঘুচিয়ে দেবার জন্য প্রিয় মানুষের সাপোর্ট আর ভালোবাসাই যথেষ্ট। সিরাতের সুস্থ হবার মাঝেই রিয়াকে আদালতের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু কারাগারে যাবার কয়েক মাস পরেই ফাইয়াজকে না পাওয়ার ব্যর্থতা এবং আক্ষেপে ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যেতে শুরু করে রিয়া। যার ফলস্বরূপ কারাগার থেকেই ট্রান্সফার করে মানসিক হাসপাতালে আপাতত রিয়ার ট্রিটমেন্ট চলছে। আর রিয়ার এমন নিকৃষ্ট কৃতকর্মের জন্য রিয়ার মা বাবা উভয়েই অনুতপ্ত।
সিরাত আর চন্দ্রিকা দুজনেরই ধ্যান ভাঙে সদর দরজার সামনে উপস্থিত ফারিহা আর নিশাতের ডাকে। দুজনেই চুপচাপ বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর পা বাড়ায় বাইরের দিকে।
সিঁড়ির দিকে চোখ যেতেই থমকে যায় ফাইয়াজ। তার দৃষ্টি যেন আটকে গিয়েছে তার থেকে কিছু দূরেই থাকা মানুষটির। বধূ বেশে সিরাতের সৌন্দর্য যেন বৃদ্ধি পেয়েছে পূর্বের তুলনায় আরো কয়েক গুণ। বরের সাজে ফাইয়াজের সৌন্দর্য ও কোনোদিক দিয়ে কমে নি বরং বেড়েছে। তার ঠিক পাশেই বসা ডক্টর রূপ। চন্দ্রিকার সাথে মিলিয়ে পুরো কালো শেরওয়ানি, তার উপর হালকা গোল্ডেন কাজ, ফর্সা শরীরে যেন কালো রং ফুটে উঠেছে।
ফারিহা আর নিশাতের সহযোগিতায় চন্দ্রিকা আর সিরাত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। নিচে নামতেই ইয়াসিন সাহেব মুচকি হেসে এগিয়ে যান। তবে কয়েক মাসের ব্যবধানে ধ্রুব নামক ব্যক্তিটার সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে নিশাতের‌। সিরাত আর নিশাতকে যথাক্রমে ফাইয়াজ আর রূপের সামনে বসিয়ে দেয়া হয়। মাঝে স্বচ্ছ কাপড়ের পর্দা যা দিয়ে পরস্পরের মুখ পুরোপুরি না বোঝা গেলেও অস্পষ্ট নয়।
সবাই উপস্থিত হতেই কাজী সাহেব হালকা হেসে ফাইয়াজের দিকে এগিয়ে যায়। অতঃপর কবুল বলার অনুমতি চাইলে সিরাতের মুখশ্রীতে এক পলক তাকিয়ে গটগট করে কবুল বলে দেয় ফাইয়াজ। সাথে সাথে সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠে। ফাইয়াজের পর সিরাতের পালা আসতেই যেন লজ্জারা এসে ভীড় জমায় সিরাতের মুখে।
– “মা বলুন কবুল!”
কাজী সাহেবের কথায় রীতিমতো পাশ থেকে সবাই তাড়া দিতে থাকে সিরাতকে কবুল বলার জন্য। সিরাত ও একপর্যায়ে বলে উঠে কবুল। বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায় সিরাত এবং ফাইয়াজ। পরবর্তীতে একই নিয়ম অনুযায়ী রূপ আর চন্দ্রিকাকে কবুল বলতে বলা হলে দুজনেই কবুল বলে দেয়। চার চারটে জীবনেই সূচনা ঘটে নতুন আরেকটি অদেখা অধ্যায়ের।
বিশাল আকাশের মাঝে পূর্ণ থালার মতো চাঁদটি যেন আজকে একটু বেশিই উজ্জ্বল। চাঁদের টিমটিমে আলোয় চারপাশে অন্ধকার ঘুচিয়ে গিয়েছে। রুমের চারপাশে ছোট বড় ক্যান্ডেল লাইট, গোলাপ আল বেলী ফুলের সমারোহে সজ্জিত। ফুলের গন্ধ নাকে এসে লাগছে বারবার। রাত প্রায় এগারোটার দিকে রুমে প্রবেশ করে ফাইয়াজ। কিন্তু রুমের কোথাও সিরাতকে দেখতে না পেয়ে খানিকটা অবাক হয় সে। কিন্তু পরমুহূর্তেই ব্যালকনি থেকে গুনগুন করে গাওয়া গানের আওয়াজ কানে পৌঁছাতেই মুচকি হাসে সে। গুটি গুটি পায়ে ব্যালকনিতে এগোতেই খেয়াল করে দোলনায় পা ঝুলিয়ে বসে আপনমনে গুনগুন করে গান গাইছে সিরাত‌। ভারী লেহেঙ্গা ছেড়ে হালকা গোলাপি রঙের সিল্কের শাড়িতে আধারী মায়াবতী লাগছে যেন।
ব্যালকনির সামনে গিয়ে খুক খুক করে কেশে উঠতেই পিলে চমকে তাকায় সিরাত।
– “ফাইয়াজ আপনি? কখন এলেন? সরি আমি খেয়াল করি নি।”
– “না না সমস্যা নেই। আমি একটু আগেই এসেছি যখন তুমি গুনগুন করতে ব্যস্ত ছিলে।”
ফাইয়াজের কথায় হালকা লজ্জা পায় সিরাত তবে প্রত্যুত্তরে কিছু বলে না। ফাইয়াজ ও ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে সিরাতের পাশে নিঃশব্দে বসে পড়ে। দুজনের মাঝেই পিনপতন নীরবতা। নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে মাত্র।
– “সিরাত?”
ফাইয়াজের ডাকে পাশ ফিরে তাকায় সিরাত‌।
– “আমার লাইফের বেস্ট ডিসিশন ছিল তোমাকে ভালবাসা। আর দেখ সেটাই এখন আমার জীবনের এখন সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। আমি চাই জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে তোমাকে ভালোবেসে যেতে। প্রতিটা মুহূর্ত তোমার সাথে পার করতে। থাকবে তো আমার সাথে আমার ভালোবাসা হয়ে?”
ফাইয়াজের বলা প্রতিটা কথায় খুব গভীরভাবে সিক্ত হয় সিরাত‌। নীল চোখ দুটোতে এক অদ্ভুত মাদকতা লুকিয়ে আছে যাতে সে ক্রমশই আসক্ত হয়ে পড়ছে।
– “হ্যাঁ, থাকব আপনার ভালোবাসার হয়ে প্রতিটি মুহূর্ত আপনার সাথে। আমিও খুব গভীরভাবে সিক্ত হতে চাই আপনার ভালোবাসায়।”
মৃদু কন্ঠে বলে ধীরে নিজের মাথাটা ফাইয়াজের কাঁধে এলিয়ে দেয় সিরাত। ফাইয়াজ কিছু বলে না শুধু চোখ বুঁজে অনুভব করে। এভাবেই না হয় কেটে যাক বাকি সময়। ক্ষতি কি তাতে?

পেরিয়ে গিয়েছে আরো চারটি বসন্ত। বদলেছে সময়। সাথে বদলেছে কিছু প্রেক্ষাপট। তবে বদলায়নি আদৌ কিছু মানুষের ভালোবাসা।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুচি গুলো ঠিক করছিল সিরাত‌। তখনি শাড়ির আঁচলে টান পড়তেই পেছন ফিরে তাকায় সে। তিন সাড়ে তিন বছর বয়সী দুটো বাচ্চা তার শাড়ির আঁচল ধরে টানছে। বাচ্চা দুটোকে দেখে সে মুচকি হেসে তাদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে।
– “মাম্মাম তোমাকে খুব তুন্দল (সুন্দর) লাকছে(লাগছে)।”
আধো আধো কন্ঠে বলার চেষ্টা করে সামনে থাকা বাচ্চা দুটো। সিরাত খুশি হয়ে বলে উঠে,
– “তাই নাকি? তবে এই মাম্মামের চেয়ে মাম্মামের রাজকন্যা আর রাজপুত্রকে বেশি সুন্দর লাগছে সেটা কি তোমরা জানো?”
বাচ্চা দুটো সিরাতের কথায় খিলখিল করে হেসে উঠে। বাচ্চা বলছি কেন। আরুশি এবং মেঘ। সিরাত এবং ফাইয়াজের ভালোবাসার চিহ্ন। জমজ হওয়ায় দুজনের চেহারাতেই বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
– “কি ব্যাপার? সব আদর মাম্মামকেই দেয়া হচ্ছে। পাপার ভাগ্যেও কি কিছু জুটবে?”
ফাইয়াজের কথায় আরুশি আর মেঘ হেসে দৌড়ে যায় ফাইয়াজের কাছে।
– “আচ্ছা এবার তোমরা খেলতে যাও, পাপা আর মাম্মাম এখনি আসছি।”
ফাইয়াজের কথামতো আরুশি আর মেঘ চলে যায় নিচে। ফাইয়াজ মুচকি এগিয়ে গিয়ে সিরাতের কোমর জড়িয়ে ধরতেই সিরাত আতকে উঠে।
– “কি হচ্ছে কি রকস্টার সাহেব! বাড়িতে এত মানুষ আর আপনি কি শুরু করেছেন? কেউ এসে পড়লে কি হবে!”
– “কি হবে? আমি আমার ওয়াইফি কে একটু জড়িয়ে ধরতেই পারি। এতে অবাক হওয়ার কি আছে? আর কাপল রুমে কেউ জেনেশুনে আসবেও না!”
বলেই দুষ্টু হাসে ফাইয়াজ। সিরাত ফাইয়াজকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলে উঠে,
– “দু বাচ্চার বাবা হয়েও কোনো লাজ লজ্জা নেই! মুখে কিছু আটকায় ও না নাকি!”
– “দু বাচ্চা কেন? একটা ক্রিকেট টিমের বাবা হয়ে গেলেও আমি তো‌ এমনি থাকব।”
বলেই ডোন্ট কেয়ার ভাব নেয় ফাইয়াজ।
– “ধ্যাত! আপনার সাথে কথা বলাই বৃথা!”
বলেই গটগট করে বাইরে চলে যায় সিরাত‌। ফাইয়াজ হাসতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
বিশাল আয়োজন করা হয়েছে আহমেদ বাড়িতে। নিশাত আর ধ্রুবের বিয়ে পারিবারিক ভাবে ঠিক হলেও আজকে শুধু মাত্র এনগেজমেন্টের আয়োজন করা হয়েছে। নিচে নামতেই কর্ণারে থাকা চন্দ্রিকা, রূপ এবং কোলে থাকা বাচ্চার উপর নজর পড়ে সিরাতের‌। চন্দ্রিকা আর রূপের ঘর আলোকিত করে ছোট দু বছর বয়সী রাজকন্যা পিহুর জন্ম হয়েছে। সিরাত এগিয়ে গিয়ে চন্দ্রিকার সাথে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নানারকম খোশগল্পে‌।
সর্বোপরি ভালোবাসার মানুষগুলো তাদের নিজ নিজ ব্যক্তিগত জীবনে পরিপূর্ণ এবং মুগ্ধ।
পড়ন্ত বিকেল। সূর্যের রশ্মির তেমন কোনো তেজস্ক্রিয়তা নেই। রাস্তার দু পাশে ঝড়ে পড়া পাতাগুলো শুকিয়ে মচমচে হয়ে গিয়েছে। লাল আবিরের কৃষ্ণচূড়া গাছে থোকায় থোকায় ফুল ফুটে রয়েছে। বসন্ত প্রায় শেষের দিকে। পড়ন্ত বিকেলের এমন এক মুখর পরিবেশে রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছে ফাইয়াজ আর সিরাত‌। আশেপাশে তেমন কেউ নেই বললেই চলে। ফাইয়াজের হাতের মুঠোয় সিরাতের হাত মুঠো বন্দি। দুজনের ঠোঁটের কোণেই এক চিলতে হাসি।

– “মনে আছে, এমন এক বসন্তেই কিন্তু আমাদের প্রেম পূর্ণতা পেয়েছিল‌। বসন্তের মতোই আমার জীবনের প্রাপ্তি হয়ে এসেছিলে তুমি!”
– “হুম! আর এই বসন্তের রঙের মতোই আমার জীবনও রঙিন হয়েছিল। এই জন্যই তো বসন্তটা আমার কাছে ভীষণ প্রিয়।”
– “যেহেতু আমাদের প্রেম এই বসন্তেই হয়েছিল সেহেতু আমাদের প্রেমের একটা নাম দেয়া যায়, কি বলো?”
– “হুম তা তো‌ দেয়াই যায়, আর সেটাও‌ খুব সুন্দর, মোহনীয় একটা নাম?”
– “কিন্তু সেটা কি?”
– “খুব বেশি দীর্ঘ ও নয় খুব বেশি জটিল ও‌ নয়। বসন্তের এই প্রেম যেন আজীবন #বাসন্তী_প্রেম হয়ে আমাদের জীবনে রয়ে যায়।
ভালোবাসি প্রিয়।”
হেঁটে হেঁটে অনেক দূর চলে যায় দুটো অবয়ব। থাকুক না এমন ভালোবাসাগুলো যা কখনো ফুরাবে না। যেগুলোর কখনো ঘটবে না কোনো সমাপ্তি। প্রকৃতির মাঝে বেঁচে রবে চিরকাল।
অমর থাকুক ভালোবাসা।

সমাপ্ত।