বিধুর রজনী পর্ব-৩+৪

0
233

#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৩]
____________________
৫.
” প্রাসাদে যে জিন্নাত জাতির চলাচল শুরু হয়েছে তা কি তুমি জানও ভাইজান ?”

শেহজাদী আরওয়ার প্রশ্নে ভ্রু কুচকালেন শাহজাদা ইদ্রীস।ডানে বামে তাকিয়ে সর্তক সৃষ্টি নিক্ষেপ করেন।

” কিসব বলছো নূর?সাত সকালে তোমার আবার কি হলো”

” তার মানে তুমি কিছু জানো না।তোমার সাথে কিছু ঘটেনি?”

” কি ঘটবে?তোমার কি হয়েছে বোন বল আমায়।”

“না কিছু হয়নি।আমি আমার কক্ষে গেলাম।”

শেহজাদী আরওয়া অলিন্দ ছেড়ে মহলের দিকে অগ্রসর হলেন।সম্রাট এখন সভায় বসবেন তার সাথে উপস্থিত থাকবেন উজির,সেনাপতি,সভাকবি,কবিরাজ মশাই সহ অনন্যরা।উজিরের সঙ্গে বসে সলাপরামর্শ করছিলেন সম্রাট আব্বাস, সকলের সম্মুখে তখন হাজির হয় শেহজাদী আরওয়া।তাকে দেখে সকলের মনে অজানা আতঙ্ক ভর করে।এই কন্যার স্থিতি নেই কখন কোন আদেশ করে বসেন কে জানে।গত সাপ্তাহে এক প্রহরীর কানে সীসা ঢেলে হ-ত্যার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে তার কথা মত হ-ত্যা করা হয় সেই প্রহরীকে।আজ কোন আদেশে এসেছে শেহজাদী?
মহলে আগরবাতীর সুঘ্রাণ ছড়িয়ে আছে।সম্রাটের পেছনে দাড়িয়ে দুজন টানাপাখা টানছে।শেহজাদী আরওয়া সম্রাটের সম্মুখে এসে প্রথমে সম্রাটকে কুর্নিশ করলেন।

” সুপ্রভাত পিতা।”

“সুপ্রভাত কন্যা।”

” আপনার আজ্ঞা পেলে কিছু কথা বলতে চাই।”

“বলো তুমি কি বলতে চাও?”

” মহলে আজ কবিতার আয়োজন করা হোক সেখানে সকলে উপস্থিত থাকবে।রাজ্যর যত কবি আছে সকলকে সেখানে উপস্থিত হতে হবে আর আমাদের সভাকবি শুরুতে তার কবিতা পাঠ করে শোনাবেন।”

” আয়োজন কি আজকেই চাই?”

” হ্যা আজকেই চাই।আজ অপরাহ্ণে আসর শুরু হবে।”

” বেশ তুমি যা বলছো তাই হবে।”

শেহজাদী মাথা দুলালেন।কিঞ্চিৎ মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন সভাকবির দিকে।

” সভাকবি মশাই শুনে রাখুন আপনার কবিতা যদি আমার মনে না ধরে তবে হাতির পায়ে পিষে মৃ-ত্যু হবে আপনার।”

নড়ে চড়ে বসলেন প্রত্যকে সবাই এই আশংকায় ছিল।কার দেহ থেকে প্রাণ নেওয়ার জন্য রাজকন্যা আজ মহলে এসেছে?তবে এবার সবাই নিশ্চিত শনির দশা তবে আজ সভাকবির উপরে ঘুরছে।

অপরদিকে আজ শেহজাদীর মন শান্ত নেই।গতরাতের সেই জ্বিনের কথা মনে পড়তেই বারবার আবেগী হয়ে উঠছেন তিনি।মনে মনে খুব করে চাইছে সেই জ্বিন আরেকবার তাকে দেখা দিক অন্তত আর একবার কিন্তু কি করে দেখা পাবে সেই অচেনা অজানা ব্যক্তিত্বের।

মহল থেকে দ্রুত নিজের কক্ষে ফিরে এসেছেন শেহজাদী পালঙ্ক বসে পা পা দুলিয়ে উচ্চ বাক্যে ডাকলেন লতাকে।

” আমাকে ডেকেছেন শেহজাদী?”

” কাগজ,রঙতুলির ব্যবস্থা করো আমি ছবি আকঁবো।”

“এত বছরপর হঠাৎ ছবি আকঁবেন?”

“সামান্য দাসী হয়ে আমার কাছে কৈফিয়ত চাইছো?”

” মার্জনা করবেন শেহজাদী আমার ভুল হয়েছে।আমি এক্ষুনি রঙের ব্যবস্থা করছি।”

দাসী লতা ছুটে গেল কক্ষের বাইরে।অনন্য দাসীরা একে একে সব সরঞ্জাম শেহজাদীর কক্ষে এনে রাখলেন।একজন দাসী ভুল ক্রমে শেহজাদীর গায়ে জল রঙের কৌটা ঢেলে দিলেন।ফল সরূপ শেহজাদীর পরনের জামাটা নষ্ট হয়ে যায়।মুহূর্তে রাগান্বিত হলেন শেহজাদী আরওয়া।তার হিংস্রতা ধরা দিল আরেকবার।চিৎকার দিয়ে ঠেকে উঠলেন লতাকে।

” লতা লতা?”

” হুকুম করুন শেহজাদী”

“এই দাসীকে মহলে নিয়ে যাও।সেনাপতি ফারুক মশাইকে নির্দেশ করো এই দাসীকে যেন একহাজার ঘা চাবুক মা/রা হয়।”

শেহজাদীর এমন নির্দেশে কেঁদে ফেললো দাসী।নিজের প্রাণ বাঁচাতে জড়িয়ে ধরলো শেহজাদী আরওয়ার দু’চরণ।

“ক্ষমা করুন শেহজাদী এমন ভুল আর কখনো হবে না।”

মেয়েটির ভুল মার্জনা করলেন না শেহজাদী আরওয়া।তিনি সরে দাড়ালেন এবং লতাকে ইশারা করলেন মেয়েটিকে নিয়ে যেতে বাকি দাসীরা নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলো শেহজাদীর সামনে।

৬.
চিন্তিত ভঙ্গিমায় কক্ষ জুড়ে পায়চারি করছেন শাহজাদা ইদ্রীস তার উত্তজনার কারণ বুঝে আসলো না তাসবীরের।গাত্রে তৈল মালিশ করতে করতে প্রশ্ন ছুড়ে তার বন্ধুর নিকট।

” ইদ্রীস তোমায় চিন্তিত মনে হচ্ছে। ”

” চিন্তা সে তো আমার প্রত্যেক দিনের তালিকা।”।

” তা কি নিয়ে চিন্তিত তুমি?”

” শেহজাদী আরওয়ার নির্দেশ শুনেছো তুমি?আজ নাকি কবিতার আসর হবে যদি সভাকবি তার কবিতা দ্বারা নূরকে খুশি করতে না পারে তবে তাকে হত্যা করা হবে।কিছুক্ষণ আগে এক দাসীকে এক হাজার ঘা চাবুক মা-রার জন্য নেওয়া হয়েছে।নূরের এসব বর্ব/রতা আর সহ্য হচ্ছে না আমার।”

” তুমি ভাই হয়ে তাকে শাসন করতে পারো না?”

“যে মেয়ে পিতাকে অমান্য করে স্বয়ং সম্রাট আব্বাস যার নাম শুনলে সবার হাটু কাপে তাকে শেহজাদী নূর ভয় পায় না সে আবার ভাইকে মান্য করবে?এটা হাস্যকর।”

“অদ্ভুত কিসিমের তোমার বোন।”

” আজ আমার কাছে জিন্নাত জাতির সম্পর্কে জানতে চেয়েছে।প্রাসাদে নাকি জিন্নাত জাতির উপস্থিতি আছে।কে যে ওর মাথায় এসব ঢোকায়।”

শাহজাদা ইদ্রীসের কথায় ঠোঁট টিপে হাসলো তাসবীর।এই মুহূর্তে শেহজাদী আরওয়ার সঙ্গে দেখা করার লোভ কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না তার।

একা কক্ষে সাদা কাগজে রঙের সাহায্য কিছু আঁকার চেষ্টায় আছেন শেহজাদী অনেকদিন যাবৎ চর্চা না থাকায় বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে তাকে।কক্ষের বাইরে দ্বাররক্ষক না থাকায় কায়দা করে বেশ সহজে শেহজাদীর কক্ষে প্রবেশ করেন তাসবীর।

” দ্বিতীয় বার অনুমতিহীন আপনার কক্ষে প্রবেশ করায় ক্ষমা করবেন শেহজাদী আরওয়া নূর!”

কাংখিত কন্ঠে কেঁপে উঠলেন শেহজাদী আরওয়া।কোলে থাকা পাতলা বসনের সাহায্য ঢেকে দিলেন তার মুখ।আবৃতহীন রইলো শুধু দু’নয়ন।ঘুরে তাকালেন শেহজাদী আরওয়া, আড় চোখে তাকালেন বলিষ্ঠ পুরুষ তাসবীরের পানে।তাসবীর আজ নিজেও মুখ ঢেকে এসেছে।

” রাতের ঘুম ভালো হয়েছে শেহজাদী?”

“হ্যা হয়েছে।হঠাৎ আমায় দেখা দিলেন?”

“শুনলাম আমার খোঁজ করছিলেন।”

কিঞ্চিৎ ভ্রু কুচকালো শেহজাদী।হাতে থাকা রঙতুলি পাশে রেখে পরখ করলো তাসবীরকে।এই ব্যক্তির সম্মুখে পড়লে নেতিয়ে যান তিনি।শুষ্ক হয়ে যায় তার কণ্ঠদেশ কি মোহনীয় এই যুবক।

” একদমি নয়।”

“আবার মিথ্যা!প্রাসাদে যে জিন্নাতেরা আছে
তা কিন্তু একমাত্র আপনি জানেন আর কেউ নয়।কারন আমি আর কাউকে দেখা দিচ্ছি না।

” এখানে কেন এসেছেন আপনি?”

“কবিতা শুনবেন?”

মোহিত পুরুষের কন্ঠে কবিতা শোনার তীব্র বাসনায় ছিলেন শেহজাদী আর এত সহজে সুযোগটা পেয়ে মনে মনে বেশ খুশি হলেন তিনি।
” বেশ বলতে থাকুন আমি শুনছি।”

” তবে আমার যে শর্ত আছে শেহজাদী।”

” শর্ত?কিসের শর্ত?”

” আজ যে কবিতার আসর হবে সেখানে আপনি সভাকবিকে হ-ত্যার নির্দেশ দিতে পারবেন না।আমি জানি আপনার মনে তার কবিতা ধরবে না আর না ধরলে আপনি আপনার শর্ত পালনে অটুট থাকবেন।”

“অসম্ভব,আমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাই হবে।”

“তাহলে আর কোনদিন আমি আপনার সম্মুখে আসবো না।”

ভীত চোখে তাসবীরের দিকে তাকালেন শেহজাদী।চোখে মুখে ফুটে আছে ভয়ের আভাস।না চাইতেও তাসবীরের শর্তে সম্মতি জানালেন তিনি।এতে বেশ খুশি হলেন তিনি।

” তা আপনাকে কি বলে সম্মোদন করবো জনাব?”

“তাসবীর।আমাকে তাসবীর বলে ডাকতে পারেন।তবে খবরদার প্রাসাদের কারো সামনে এই নাম উচ্চারণ করবেন না শেহজাদী।”

” কেন?”

“সে উত্তর না হয় অন্যদিন দিব।”

” এবার আপনার কবিতা আবৃতি শুরু করুন।”

শেহজাদী এগিয়ে এলো ক্যানভাসের সামনে হাতে তুলে নিল রঙতুলি। তার পেছনে এসে দাঁড়ালো তাসবীর শেহজাদীর হাতে হাত রেখে ক্যানভাসে রঙতুলি বসাতে রাগান্বিত হয় শেহজাদী আরওয়া।এই সামান্য যুবকের সাহস কি করে হলো শেহজাদীকে ছোঁয়ার।শেহজাদীর রাগান্বিত ভাব ধরতে পেরে তাসবীর নিজে থেকে কথা তুললো।

” ভালোবাসতে পারেন শেহজাদী?”

” আমার জীবনে ভালোবাসা শব্দটির প্রয়োজন নেই।”

” একটু প্রয়োজন বোধ করে দেখুন না,দেখবেন জীবন কী করে পালটে যায় চোখের পলকে।”

” আমি আমার জীবন নিয়ে খুশি আছি।”

” না আপনি খুশি নেই; খুশি নেই আপনি। জীবনের আসল স্বাদ এখনো গ্রহণ করেননি।তবে এবার আমি এসে গেছি পেছনে ফেরার পথ বন্ধ।”

” বন্ধ?তুচ্ছ যুবক আমাকে পরিচালনা করার স্বপ্ন দেখে যাও তবে পূর্ণ হবে না।শেহজাদী আরওয়া নূর’কে কবজা করা এত সহজ কাজ নয়।”

“দয়া করে আমায় সামান্য ভাববেন না।না চাইতেও যে বিষকন্যা’র সাক্ষাৎ আমি পেয়েছি তার বিষে আমার সারাদেহ,মন প্রাণ মস্তিষ্ক বিষঘ্ন হয়ে আছে।সেই বিধুর রজনীর সাক্ষী আমি বার বার হতে চাই।”

“বিধুর রজনী?”

বুদ্ধিমান যুবক তাসবীর কথা ঘুরিয়ে দিলেন,শেহজাদীর হাতে হাত রেখে ক্যানভাসে মনোযোগ বাড়ালেন,কথা রাখতে খুব দ্রুত শুরু করলেন কবিতা আবৃতি।শেহজাদী আরওয়ার কাছে তাসবীরের আবৃতি করা কবিতা যেন বশীকরণমন্ত্র মনে হয়।যা শ্রবণে বার বার কতল হোন তিনি।আর তাসবীর সে তো চতুর যুবক শেহজাদী আরওয়াকে নিজের বশে আনতে সর্বদা সচেষ্ট তিনি।
#চলবে_______

#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৪]
___________________
হিমেল হাওয়ার দাপটে আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গেল শেহজাদী আরওয়ার।নিজেকে সুসজ্জিত পালঙ্কে দেখে খানিকটা ভড়কালেন তিনি।গায়ের কন্থা সরিয়ে খুব দ্রুত নামলেন পালঙ্ক ছেড়ে।কখন ঘুমালেন তিনি?তার পাশে তো তাসবীর ছিল দুজনে একসাথে ক্যানভাসে রঙ নিয়ে খেলছিল তার মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিল তাসবীরের সেই সুরেলা কবিতা।তবে শেহজাদী পালঙ্কে কেন?একে একে দুই যখন মিলাতে ব্যর্থ শেহজাদী তখন ছুটে গেলেন ক্যানভাসের সামনে সেখানে লাল সিল্কি কাপড়ে ঢাকা আছে ক্যানভাস।শেহজাদী আরওয়া দ্রুত হস্তে সরিয়ে দিলেন লাল কাপড় মুহূর্তে বিস্ময়ে হতবাক তিনি।একি দেখছেন!এত সুন্দর ছবি কে এঁকেছে তার ক্যানভাসে?নিশ্চই তাসবীর।শেহজাদী মুগ্ধ দু’নয়নে তাকিয়ে রইলেন ক্যানভাসের পানে যেখানে চিত্রিত হয়েছে শেহজাদীর একটি ছবি।নিখুঁত সৌন্দর্য ধরা দিয়েছে এই ছবিতে মনে মনে শেহজাদী বার বার মারহাবা বললেন।
দ্বার থেকে তখন ভেসে এলো খাসদাসী লতার কন্ঠ।

” কক্ষে আসবো শেহজাদী?”

“এসো।”

লতা কক্ষে প্রবেশ করে শেহজাদীর সম্মুখে দাড়ালেন কিন্তু সবার প্রথমে তার চোখ যায় ক্যানভাসের দিকে।

” মারহাবা মারহাবা।এই ছবি আপনি এঁকেছেন শেহজাদী?এত নিঁখুত এত সুন্দর দু’চোখ জুড়িয়ে গেল যে।”

মুহূর্তে শেহজাদী থমকে গেলেন।তবুও নিজেকে সংযত করে উচ্চ বাক্যে বলে,

” কি বলতে এসেছো তা বলো।”

” সম্রাট আপনাকে ডাকছেন শেহজাদী।কবিতার আসর বসেছে আপনি গেলেই শুরু হবে।”

“তুমি যাও আমি আসছি।”

এক ঘুমে কখন যে মধ্যাহ্ন গড়িয়ে অপরাহ্ণ হয়ে এসেছে টের পেলেন না শেহজাদী।কবিতার আসরে তিনি উপস্থিত ছিলেন ঠিকি তবে মন ছিল উচাটন।তাসবীরের শর্ত অনুযায়ী সভাকবিকে কোন প্রকার শাস্তি দেননি তিনি।

৭.
সম্রাজ্ঞী শাহাবা আজ ভীষণ খুশি।প্রাসাদে তাসবীরের আসার সংবাদটা তিনি সন্ধ্যায় পেয়েছেন।তারপর থেকেই তার হুলুস্থুল কান্ড হেঁশেলে তিনি খুব একটা না গেলেও আজ দাসীদের সঙ্গে তদারকি করেছেন।এই ছেলেটার চলন-বলন,ভদ্রতা খুব সহজেই প্রলুব্ধ করেছে সম্রাজ্ঞী’কে।হেঁশেলে বাটি সাজিয়ে ভাত,পায়েস,মাছ,মাংস সাজাতে ব্যস্ত দাসীরা তাদের নির্দেশ দিচ্ছেন সম্রাজ্ঞী।এই রাজপরিবারে যদি ভদ্র মার্জিত সুশীল ব্যক্তি খুঁজতে হয় তবে নিঃসন্দেহে সম্রাজ্ঞী শাহাবা এবং শাহজাদা ইদ্রীসকে ধরা হবে।

” বেগম এত রান্নার আয়োজন কার জন্য হচ্ছে জানতে পারি?”

এত আয়োজনে দাসীদের মনে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক বিষয়।তাই আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন সম্রাজ্ঞী।তাই খুব সহজে মিথ্যা বলে দিলেন তিনি,

” ইদ্রীসের জন্য।ছেলেটা আমার উপর রেগে আছে তাই ভাবলাম একটু মন ভালো করার ব্যবস্থা করি।

দাসীরা প্রসন্ন হাসলো সবাই খাবারের ঢালা নিয়ে চললো শাহজাদা ইদ্রীসের কক্ষে।যে যার কাজ শেষে বেরিয়ে গেলো সুযোগ বুঝে দ্বার বন্ধ করলেন শাহজাদা ইদ্রীস।মুহূর্তে পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন তাসবীর।ক্ষিপ্র চরণে এগিয়ে এসে সম্রাজ্ঞীর ডান হাত ছুঁয়ে পৃষ্ঠে চুমু খেল।

” বুকে আসো বাবা কতদিন তোমায় দেখি না।এই পাতানো মা’কে ভুলে গেলে এত সহজে?”

” অলকপুরী রাজ্যর আমার আম্মীজানকে ভুলে যাওয়ার সাধ্য আমার কই?”

৮.
রাজ্য জুড়ে আহাজারিতে হতবাক তাসবীর।রাজ্যর দক্ষিণ কোনে আ/গুনের তান্ডবের লীলা খেলা চলছে।ছয়জন প্রহরী এক কোনায় দাঁড়িয়ে যেন রঙ্গমঞ্চের নাটক দেখছে।হতদরিদ্র মানুষগুলোর শেষ সম্বল চোখের সামনে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।ছোট ছোট হাড্ডিসার বাচ্চাগুলো গোলগোল চোখে তাকিয়ে দেখছে তাদের আগামীর দূর্দশা।একজন বৃদ্ধ ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো শাহজাদা ইবনুলের পা।

” দয়া করুন শাহজাদা এভাবে আমাদের শেষ করবেন না।পরিবার পরিজন নিয়ে কোথায় যাব?কে ঠাই দেবে?একটু দয়া করুন শাহজাদা।”

শাহজাদা ইবনুল রাশীদ দ্রুত পিছিয়ে গেলেন।ওষ্ঠে দাম্ভিক হাসি টেনে তাচ্ছিল্য সুরে বলে,

” মুর্খ প্রজা আগে মনে ছিল না?যখন বলেছিলাম এই জায়গা ছেড়ে দাও সবাই।”

“আমরা কোথায় যাব?এ জমি ছাড়া আমাদের ঠাই নেওয়ার জায়গা নেই একটু দয়া করুন শাহজাদা।এ ভিটে আমাদের সবার পূর্বপুরুষদের”

“খামোশ এ ভিটে কার সেটা বড় কথা নয় বড় কথা এই রাজ্যের মালিক সম্রাট আব্বাস তিনি যা বলবেন তাই হবে।”

” এ হয় না।আমরা আমাদের ভিটে ছেড়ে কোথাও যাব না।”

” এত বড় আস্পর্ধা শাহজাদার মুখে মুখে তর্ক।প্রহরী এই বৃদ্ধাকে নিও যাও দু’শ ঘা চাবুকের ব্যবস্থা করো তবেই মুখে লাগাম হবে।”

প্রহরীরা নিজেদের নির্দেশ পালনে তটস্থ রইলো টেনে হিচড়ে নিয়ে গেলেন বৃদ্ধাকে।শাহজাদা ইবনুলের চোখ পড়লো ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ষোল-সতের বছরের কিশোরীর দিকে।ফর্সা ফ্যাকাশে চামড়ায় কালি লেপ্টে আছে,কেমন করুন চাহনীতে অসহায় হয়ে মেয়েটা কাঁদছে।মুহূর্তে শাহজাদা ইবনুলের পুরুষত্ব জেগে উঠেছে।মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বিশ্রি ভঙ্গিমায় কিয়ৎক্ষণ হাসে।

” কি নাম সুন্দরী?”

শাহজাদার কথায় কেঁপে উঠলো মেয়েটি।দু’কদম পিছিয়ে খুবলে ধরলো তার মায়ের হাত।

” ভয় পেওনা আমি কি তোমার মারতে এসেছি?”

” দয়া করুন শাহজাদা আপনার নোংরা নজর আমার মেয়ের উপর রাখবেন না।আমার মেয়ে বাগদত্তা।”

মেয়েটির মায়ের কথা রুষ্ট হলেন শাহজাদা ইবনুল।প্রহরীদের নির্দেশ দিলেন নতর্কির আসরে যেন এই মেয়েকে আজ রাতে রাখা হয়।মেয়েটির নৃত্য উপভোগ করে মধ্যে রাতেই শরীর ভোগ করবেন তিনি।অসহায় মেয়েটি শাহজাদার পায়ে ধরেও রেহাই পেল না নিষ্ঠুর শাহজাদা তার নির্দেশেই বহাল রইলো।


” রাজ্য জুড়ে এই অরাজকতা বন্ধে তুমি কোন ব্যবস্থা কেন নিচ্ছ না ইদ্রীস?এইভাবে রাজ্যর মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে জুলুম করা এবার বন্ধ করা উচিত।রাজ্যের মানুষ যে না খেয়ে খুদা পেটে মৃ/ত্যু বরন করছে সেই খবর রাখ?মেয়েদের ইজ্জতে হাত বাড়িয়েছে তোমার ভাই সম্মানীয় মেয়েদের বানিয়ে তুলছে নর্তকী আর সম্রাট চেয়ে চেয়ে দেখছেন ছিহ এ নাকি রাজ্যর সম্রাট।”

” আমার কিছু করার নেই তাসবীর।পিতা আর ভাইজানের হাতে সব দায়িত্ব আমি আর কি করতে পারি?”

” আল্লাহ বরদাস্ত করবেন না।কোন শক্তিশালী সম্রাট আসবেন এই রাজ্য দখলে আবার যুদ্ধ ঘোষণা করবেন আমার কথা মিলিয়ে নিও ইদ্রীস।”

” আশেপাশে যত ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম রাজ্য সব দখলে নিয়েছেন সম্রাট আব্বাস।দলের সৈন্য সংখ্যা আরো বাড়িয়েছেন,সবাইকে অসিচালনে দক্ষ করেছেন।ঘোড়া শালায় ঘোড়া বৃদ্ধি করেছেন শুনেছি আগামী মাসে অন্য রাজ্য দখলে যাবেন।অলকপুরী রাজ্য এখন বিশাল সম্রাজ্য জুড়ে এই রাজ্যকে দখল করার সাধ্য অন্তত এই সেই সম্রাটের নেই।”

তাসবীর নিরব রইলো ইদ্রীস মলিন মুখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।

” এসব ভেবে কাজ নেই তুমি যতদিন এসেছো আনন্দ ভোগবিলাস করো।অরাজকতা দেখতে দেখতে আমার গায়ে শয়ে গেছে।”

৯.
সম্রাট আব্বাস আজ ভিষণ খুশি অবশেষে তার স্বপ্ন পূর্ণ হতে চলেছে।তেলিকনা রাজ্যর নব সম্রাট সাঈদ শেহজাদী আরওয়াকে বিবাহ করার প্রস্তাব দিয়েছেন।এই সম্রাটের সঙ্গে আত্মীয়তা হলে অলকপুরী রাজ্য আরো শক্তিতে সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠবে।সম্রাট আব্বাস নিজ অবস্থান পাকাপোক্ত করতে এই সুযোগ কিছুতেই হাত ছাড়া করবেন না।
শেহজাদী আরওয়া চিত্রকারের আঁকা ছবিতে সম্রাট সাঈদ’কে কিছুক্ষণ আগে দেখেছেন।সৌন্দর্যে কোন অংশে কম নেই সম্রাট সাঈদ এমনকি চরিত্রের দিক দিয়েও আজ পর্যন্ত কোন দাগ লাগতে দেননি।এই বিবাহ সম্পর্কে শাহজাদা ইদ্রীস মতামত জানিয়েছে তার সাথে সম্রাজ্ঞী শাহাবা নিজেও রাজি।বিশ্বস্ত এই দুজন মানুষের মতামত পেয়ে তেলিকোনা রাজ্যর সাম্রাটকে বিবাহ করতে কোন বাধা নেই শেহজাদী আরওয়ার।

আজ এই বিশেষ দিনে উচ্ছ্বাসিত শেহজাদী দুগ্ধজলে অবগাহন করছেন।খাসদাসী লতা তার হাতে চন্দনের প্রলেপ দিচ্ছেন এবং অনন্য দাসীরা দুগ্ধজলে গোলাপের পাপড়ি ছিড়ে পানিতে ভাসিয়ে দিচ্ছে।গোলাপের মিষ্টি ঘ্রাণ স্নানাগাময় ছড়িয়ে আছে।শেহজাদীর হাসি হাসি মুখ দেখে অনন্য দাসীরা যেন নিশ্চিন্ত।

” লতা জলদি জলদি কাজ সার আমাকে যেতে হবে।”

“শেহজাদীর আর সইছে না যে।আর একটু অপেক্ষা করুন শেহজাদী স্নান যে শেষ পথে।”

” বাগান থেকে সাদা গোলাপ আনার ব্যবস্থা কর আমি আজ খোপায় সাদা গোলাপ বিধঁবো।”

“অবশ্যই আমি দাসীদের নির্দেশ দিচ্ছি।”

শেহজাদীর গোসল শেষে তাকে সাদা রঙের জামা পড়ানো হলো নিজেকে সম্পূর্ণ তৈরি করে পালঙ্কে গিয়ে বসলেন তিনি।সব দাসীরা যখন কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যায় তখনি জানলে বেঁয়ে শেহজাদীর কক্ষে প্রবেশ করলেন তাসবীর।আজ শেহজাদীর রুমে প্রবেশ কর‍তে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে তাকে। চারিদিকে প্রহরীদের আনাগোনায় কিছুতেই সু্যোগ পাচ্ছিলেন না।

” শেহজাদী আরওয়া।”

তাসবীরের কন্ঠে চমকে তাকান তিনি।দ্রুত পালঙ্ক ছেড়ে এগিয়ে এলেন তাসবীরের সম্মুখে।

” কেন এসেছেন আপনি?এক্ষুনি চলে যান বড় ভাইজান আসবে যে।”

” ভয় নেই।আমি কিছু কথা বলতে এসেছি,যদি নির্দেশ করেন তবে কথাগুলো বলতে চাই।”

” বেশ বলুন আপনি কি বলতে চান।”

” আপনি এই বিবাহে সম্মতি দিবেন না শেহজাদী।”

“কারণ জানতে পারি?”

” কারণ আপনাকে আমি বলতে পারবো না।তবে আপনি এই বিবাহ করবেন না।”

” কত বড় আস্পর্ধা!শেহজাদী আরওয়া নূরকে নির্দেশ করছেন?”

” নির্দেশ নয় অনুরোধ করছি।”

শেহজাদী সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন তাসবীরের দিকে।মানুষটা কেমন যেন ছটফট করছে চোখে মুখে ছেঁয়ে আছে অস্থিরতা।

” সম্রাট সাঈদের কি চরিত্রের দোষ?”

” একদমি না।”
“তিনি কি আমার মতো বর্বর অত্যাচারি?”

“একদমি নয় বরং কোমল মনের।”

” তিনি কি আমায় পছন্দ করেন না?”

” সম্রাট সাঈদ নিজে এই বিবাহের প্রস্তাব এনেছেন।”

“তাহলে আমি কেন এই বিবাহে অসম্মতি জানাব?”

” কারণ আমি বলছি তাই।”

তাসবীরের কথায় তাচ্ছিল্য হাসলেন শেহজাদী।দেয়ালে ঘেষে থাকা আরশির সম্মুখে দাড়ালেন তিনি।মাথায় জড়ানো লাল দোপাট্ট গালের কাছটায় এনে নিজেকে পরখ করলেন আরেকবার ততক্ষণাৎ মুখে ফুটে উঠে দাম্ভিক হাসি।

” আমি অলকপুরীর একমাত্র শেহজাদী আরওয়া নূর।যার নির্দেশে রাজ্যের প্রতিটি প্রজা উঠে বসে সে কি না আপনার মতো তুচ্ছ’র কথা শুনবে?আমার কাছে আসার অনুমতি পেয়েছেন বলে কি সব কাজে নাক গলাবেন?আপনি জিন্নাত জাতি এমন কোন কাজ করবেন না যে আমি কঠোর হতে বাধ্য হই।”

শেহজাদী আরওয়ার কথা গায়ে মাখলেন না তাসবীর তিনি কান খাড়া করে শুনছেন বাইরে দ্বাররক্ষকের পায়ের আওয়াজ।দ্বাররক্ষকরা ক্রমশ এগিয়ে আসছে শেহজাদীর কক্ষের সামনে তার সাথে সাথে দাসীদের হাসি হাট্টার আওয়াজ ভেসে আসছে।দ্রুত নিজেকে সামলেন নিলেন তাসবীর।চোখের পলকে শেহজাদী আরওয়ার মুখ বেঁধে দিলেন কাপড় দিয়ে এবং হাত বাধলেন অন্য কাপড় দিয়ে।তাসবীর এত তাড়াতাড়ি এই দুঃসাহসিক কান্ড ঘটালো যে শেহজাদী বুঝে উঠতে পারলেন না কি করবেন তিনি।তাসবীর শেহজাদীর পালঙ্কের নিচে চলে গেলেন দ্রুত একটি লোহার ঢাকনা সরিয়ে শেহজাদীকে নিয়ে নেমে গেলেন পাতালঘরে।শেহজাদী অবাক হয়ে দেখছিলেন তাসবীরের কান্ড।এই পাতালঘরের দরজার ঠিকানা সাধারণ কেউ জানার কথা নয়।রাজ্যর প্রহরী কিংবা দাসদাসীরাও এই দরজা সম্পর্কে জানে না তবে কি করে জানলো তাসবীর?
#চলবে_____