বিধুর রজনী পর্ব-৫+৬

0
177

#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৫]
___________________
“কিসসা শুনবেন শেহজাদী?”

“উহহ উউউ”

” কি বলেন বুঝি না।”

” কবিতা বলি?ওই যে আপনার পছন্দের কবিতা।”

“উমমম”

” এবারো বুঝলাম না।থাক আপনার কিছু শুনতে হবে না আপনি বরং আমায় দেখুন।মশার কামড়ে অতিষ্ট হয়ে যাচ্ছি।”

খ্যাপা ষাড়ের মতো তাসবীরের দিকে তাকিয়ে আছেন শেহজাদী আরওয়া।মেঝেতে মশার কামড়ে অতিষ্ট তিনি তবুও তার রাগের কাছে এই মশার কামড় গুলো যেন কিছুই না।হাতের বাঁধন ছাড়াতে তার ছটফটে অবস্থা দেখে যেন ভীষণ মজা পাচ্ছেন তাসবীর।ছয় নয় ভেবে শেহজাদীর মুখের বাঁধন খুলে দিলেন তিনি।

” আপনার সাহস দেখে আমি অবাক হই সম্রাটের কন্যাকে গুম করেছেন।”

” জি আমার সাহস একটু বেশি সেটা আমি নিজেই স্বীকার করি।”

” এই পাতালের সন্ধান কি করে পেলেন?”

” সব সম্রাটের একটি পাতালঘর থাকে তা সবাই যানে।তবে এই পাতাল ঘরের মূল রাস্তা কিংবা দ্বারের খোঁজ কেউ জানে না।এই প্রাসাদের কোথায় কি আছে আমি সব জানি।”

” কি করে জানেন আপনি?”

” জিন্নাতরা সহজে সব জানতে পারে।”

” আপনার কথা আমি বিশ্বাস করি না”

শেহজাদীর কথায় তাসবীর হাসলেন।তাদের মাঝে থাকা গলানো মোমের দিকে তাকিয়ে কিছুটা চিন্তিত হলেন এই মোম শেষ পর্যায়ে, যদি শেষ হয়ে যায় তবে অন্ধকার পাতালে কি করে থাকবেন আরওয়া?

” সবাই নিশ্চই আমার খোঁজ করছে।সত্যি করে বলুন আপনার স্বার্থ কী?সম্রাট সাঈদের সঙ্গে আমার বিবাহ হলে আপনার সমস্যা কোথায়?”

” কঠিন সমস্যা শেহজাদী, বড্ড কঠিন সমস্যা।এই সমস্যার সমাধান আপনি ছাড়া সমাধান হবে না।”

” মানে?”

তাসবীর উঠে গেলেন শেহজাদীর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া গুরুত্ব মনে করলেন না।পকেট থেকে ছোট মোম নিয়ে তা জ্বালিয়ে দূরে সরে গেলেন।আশেপাশে ঘুরোঘুরি করে একটি মরা মানুষের মাথার খুলি পেলেন তা এনে রাখলেন শেহজাদী আরওয়ার সামনে।মানুষের খুলি চিনতে খুব দেরি হলো না শেহজাদীর ফলে ভীতগ্রস্থ হয়ে খিঁচিয়ে গেলেন খানিকটা।

” ওও টা কোথায় পেলেন তাসবীর?”

“পাঁচিলের এক কোণে ছিল।”

” আপনি সরান এই খুলি আমার ভয় লাগছে।”

“ছিহ ছিহ ছিহ শেহজাদী আরওয়া সামান্য ম/রা মানুষের খুলি ভয় পায়?অথচ এত মানুষকে যে অল্প ভুলে হ/ত্যার নির্দেশ দেন তার ভয়াবহ ফল ভোগ করবেন কি করে?

তাসবীরের কথায় শেহজাদীর অনুশোচনা জাগলো না।তিনি বিরক্ত হয়ে চোখ বুঝলেন তাতে যেন ফলাফল উলটো বিপরীত।চোখের পর্দা ফেললে আঁধারে’রা ধরা দেয় এই আঁধার তার ভয় বাড়িয়ে দিল শতগুন।বারবার চোখের সামনে খুলিটা ভেসে উঠছে।অথচ তাসবীরের কোন ভয় নেই তিনি নেড়ে চেড়ে দেখছেন ম/রা মানুষের খুলিটা কি অদ্ভুত সাহস’রে বাবা!

” তাসবীর এখানে ম/রা মানুষের খুলি আসবে কি করে?পাতাল ঘরে তো কেউ আসে না।পাতাল ঘর সবসময় বন্ধ থাকে।আপনি নিশ্চই আমাকে ভয় দেখাতে সঙ্গে করে এনেছেন?”

তাসবীর হাসলেন শেহজাদীর কথা ভেবে খুলিটা সরিয়ে রাখলেন খানিকটা দূরে।

” আপনার দাদাজান অর্থাৎ সাবেক সম্রাট রাজ্য বিজয়ের পর সেই রাজ্যের সম্রাট সম্রাজ্ঞীদের এই পাতালে এনে রাখতেন।দিন দিন অনাহারে,পানির তৃষ্ণায় তারা গলে পঁচে মা/রা যেত।এভাবেই চলতে থাকে একেরপর এক।এই নিয়ম বন্ধ হয় আপনার বাবা অর্থাৎ সম্রাট আব্বাস সিংহাসন আহরোণের পর।সম্রাট আব্বাসের নির্দেশে এই পাতালঘর পরিষ্কার করে ধুঁয়ে মুছে রাখা হয় তারপর আর কারো প্রবেশ এখানে হয়নি।”

বিস্ময়কর সত্য জেনে চাপা উত্তেজনা ধরে রাখতে পারলেন না শেহজাদী আরওয়া।আবাক চোখে তাকালেন তাসবীরের দিকে।

” আপনি কি করে জানলেন?সম্রাট আব্বাসের মেয়ে হয়েও আমি এই সত্য সঠিক ভাবে জানি না।পাতালে আসার ইচ্ছে আমার আগেও ছিল কিন্তু পিতা কখনোই অনুমতি দেননি।”

” পুরোনো সকল রাজ কর্মীরা যানে এই সম্পর্কে।তাছাড়া ইতিহাসে সবচেয়ে নিষ্ঠুর বর্বর সম্রাট হিসেবে আপনার দাদার নাম উল্লেখযোগ্য।”

শেহজাদী আরওয়া ভীতিকর চাহনীতে আরেকবার তাকালেন চারিদিকে।শরীরটা কেমন ছমছম করছে।

” সাবধান শেহজাদী এখানে যে এত মানুষের বদ্ধ আত্মারা জমা আছে তারা আবার যদি প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠে আপনাকে আঘাত করে।”

” ক..কি বলছেন আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন তাই না তাসবীর?”

তাসবীর প্রত্যুত্তর করলেন না।মোম গলতে গলতে শেষ পর্যায়ে আছে তার দিকে নির্নিমিখ তাকিয়ে রইলেন তিনি।প্রাসাদের এখন কি অবস্থা?নিশ্চই কন্যা নিখোঁজ সংবাদে সম্রাট আব্বাস উন্মাদ হয়ে উঠেছে।উন্মাদনায় আবার শেহজাদীর দাসীদের শাস্তি দিয়ে না বসেন!তাসবীরের মনের সকল চিন্তার অবসান ঘটলো শেহজাদী আরওয়ার চোখে চোখ রাখতে।প্রমত্ত হৃদয়টা যেন গভীর ভাবে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।এই মনে যত প্রেম জমা তার অন্তিম এই রমনীর মাধ্যেমেই হবে।

” আমার প্রশ্নের উত্তর আমি পাইনি তাসবীর।আমাকে এখানে বন্দী করেছেন কেন?সম্রাট সাঈদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আপনার কোন স্বার্থে আঘাত লাগলো শুনি?”

“ঘরের চাঁদ কি কেউ বাইরে প্রদর্শিত করে?তাহলে আমার ঘরের চাঁদ আমি বাইরে প্রদর্শিত কেন করবো?”

তাসবীরের তীক্ষ্ণ ধারালো কন্ঠে অবাক চাহনীতে তাকালেন শেহজাদী।এই জিন্নাতের কথার আঘা গোড়া কিছুই মাথায় ডুকছে না তার।কে চাঁদ?কার ঘর?কিসব বলছেন তিনি।
হঠাৎ পাতালের পশ্চিম কোনের দরজায় বিকট শব্দ হলো নিশ্চই কেউ পাতাল ঘর খোলার চেষ্টা করছে।সঙ্গে সঙ্গে মোমের আলো নিভিয়ে দিলেন তাসবীর।ভয়ে চাপা আর্তনাদ করলেন শেহজাদী।শেহজাদীর কন্ঠ কেউ শুনে নিলে আর রক্ষে থাকবে না নিজেকে বাঁচাতে দ্রুত শেহজাদীর মুখ চেপে ধরলেন তাসবীর।

“দুঃখিত শেহজাদী আপনাকে আঘাত করার জন্য।”

ক্রমশ পাতালের দরজার শব্দ থেমে এলো।অন্ধকার নিশ্চুপ পাতালে শুধু দুজন নর-নারীর নিশ্বাস প্রশ্বাসের ধ্বনি এই দেয়াল থেকে ওই দেয়ালে ছিটকে পড়ছে।অতি উত্তেজনায় শেহজাদীর চেতনা হারানোর উপক্রম হয়েছে অন্ধকার পাতালে সেই মৃত মাথার খুলির কথা ভাবতেই গা গুলিয়ে আসছে।শেহজাদী আরওয়ার অবস্থা বুঝতে পেরে তাসবীর তার মুখ ছেড়ে দিল।

” আলো জ্বালান আমার ভয় করছে।”

“মোম ফুরিয়ে গেছে এখন আমাদের আলো ছাড়া থাকতে হবে।”

” আমি পারবো না থাকতে।একটু পানি পা…পানি দিন গলাটা শুকিয়ে গেছে।”

” হায় আল্লাহ আমি তো কোন তরল খাদ্য আনলাম না।একটু ধৈর্য্য ধরুন শেহজাদী।”

শেহজাদীর অস্বস্তিতে অস্থির হয়ে গেলেন তাসবীর।কিয়ৎক্ষণ পর অবস্থার অবনতি ঘটলো শেহজাদী আরওয়া চেতনা হারিয়ে ঢলে পড়লেন মেঝেতে।ঘুমুট অন্ধকারে শেহজাদীর চেতনা হারানোর বিষয়টি সহজে বুঝতে পারলেন তাসবীর।উচাটন মনে দ্রুত বক্ষে জায়গা করে দিলেন শেহজাদীর মাথা।

” শেহজাদী শুনতে পারছেন?শেহজাদী!”

শেহজাদী আরওয়ার সাড়া শব্দ মিললো না এই নিস্তব্ধ রুম জুড়ে।উৎকণ্ঠিত মনে হাসলেন তাসবীর।শেহজাদীর মাথা’টা খানিকটা জোরে চেপে ধরলেন তার বক্ষে।দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বলেন,

” এত তেজ, এত জেদ,এত ক্ষমতা এই অন্ধকারেই হাওয়া!

১০.
প্রাসাদ জুড়ে বিশৃঙ্খলা অবস্থা।শেহজাদী আরওয়া নিখোঁজ সংবাদ ইতোমধ্যে সম্রাট সাঈদের কানে পৌঁছে গেছে এতে বিষয়টা নিয়ে তিনি কোন প্রতিক্রিয়া দেখালেন না বরং সম্রাট আব্বাসকে নিদিষ্ট সময় দিলেন এর মাঝে যে করে হোক শেহজাদী আরওয়া নূর’কে তার সামনে হাজির চাই।তিনি উদয় নগরীর সম্রাট ওয়াহাব কিংবা তার পুত্র মেসবাহ নন যে খালি হাতে ফিরে যাবেন।তিনি তেলিকোনার সম্রাট কিছুতেই খালি হাতে ফিরবেন না।চারিদিকে প্রহরী দাসিদের উপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে হঠাৎ রুম থেকে কোথায় হারিয়ে যাবেন শেহজাদী।যেখান থেকে পারুক শেহজাদী আরওয়ার খোঁজ চাই চাই।

” সম্রাট আব্বাস আপনার নিদিষ্ট প্রহর যে শেষ মুহূর্তে।”

সম্রাট সাঈদের কথায় চিন্তিত ভঙ্গিমায় মাথা দুলালেন সম্রাট আব্বাস।

” এই বিয়ে নিয়ে আমার মেয়ের কোন দ্বিমত ছিল না।বরং হাসিমুখে সম্মতি দিয়েছে কিন্তু হঠাৎ যে কি হয়ে গেল।”

” তা তো শুনতে চাই নি।আমি আমার বেগম’কে দেখতে এসেছি ওইদিকে আমার পিতা মাতা আমার জন্য অপেক্ষায় আছেন কখন তাদের সুসংবাদ জানাব।কি ভেবেছিলেন উদয় নগরীর শাহাজাদা মেসবাহ’র মতো খালি হাতে ফিরবো?তা হচ্ছে না যে।”

সাঈদের কথায় দাঁড়িয়ে গেলেন শাহজাদা ইবনুল উত্তেজিত হয়ে বললেন,

” পিতা বোনের নিখোঁজের পেছনে মেসবাহ’র হাত নেই তো?”

সম্রাট আব্বাস প্রত্যুত্তর করলেন না।সভা ছেড়ে উঠে গেলেন তিনি।আরেকবার প্রবেশ করলেন শেহজাদী আরওয়ার কক্ষে।সব কিছু সুসজ্জিত বেশ গোছানো তাতে বোঝাই যাচ্ছে শেহজাদীকে এখান থেকে কেউ জবরদস্তি করে নিয়ে যায়নি তবে কোথায় গেল শেহজাদি?সম্রাট আব্বাসকে মেয়ের কক্ষে দেখে পেছন পেছন কক্ষে এলেন সম্রাজ্ঞী শাহাবা।

” সম্রাট আমার কন্যার কোন খোঁজ পেলেন?”

” বেগম জান সত্যি করে বলুন কন্যা কোথায় আছে?”

সম্রাট আব্বাসের সন্দিহান কন্ঠে বিস্মিত হলেন সম্রাজ্ঞী।

” কি বলছেন আপনি সম্রাট?আমার কন্যাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা তার দুশ্চিন্তায় জান যায় যায় অবস্থা আর আপনি….”

” আরওয়া যখন তৈরি হচ্ছিল আপনি তখন কোথায় ছিলেন?তাছাড়া এই বিয়েতে আরওয়ার সত্যি কি মতামত ছিল?”

“জ্বি সম্রাট ছিল আরওয়া নিজে খুশি মনে তৈরি হচ্ছিল।আমাকে খাস দাসী লতা নিশ্চিত করেছে এই বিবাহে আরওয়ার মতামত ছিল।আরওয়া যখন তৈরি হচ্ছিল আমি তখন হেঁশেলে ছিলাম।”

সম্রাট আব্বাস কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।তখন দরজার বাইরে অবস্থান করছিলেন উজির হাযম।

” হাযম।”

” জি সম্রাট বলুন।”

” শেহজাদী আরওয়ার দ্বাররক্ষক’দের পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদ করো যদি তারা সঠিক তথ্য দিতে না পারে একশত ঘা চাবুকের ব্যবস্থা করো,চাবুকের প্রহারে কাজ না হলে চামড়া তুলে লবন দিয়ে সিঞ্চন করো।আমার কন্যা কোথাও গেলে এই দ্বার দিয়েই যাবে তাহলে দ্বাররক্ষকরা কি পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিল?”

” যথা আজ্ঞা সম্রাট আপনার নির্দেশ মোতাবেক সবটা করছি।”

” মনে রাখবে এই বিষয়ের সাথে আমার মান সম্মান জড়িত যদি হেরফের হয় তবে দাস-দাসী,প্রহরী তাদের আজ শেষ দিন।”
#চলবে____

#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৬]
__________________
১১
অন্ধকার গহ্বরে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন শেহজাদী আরওয়া।একফালি আলোর আশায় ছুটছেন দ্বিকবিদিক।ঘর্মাক্ত জুলফি হাতের উলটো পিঠে মুছে আবারও দৌড়তে শুরু করেছেন তিনি উদ্দেশ্য আলোর খোঁজে। কিয়ৎক্ষণ বাদে আলোর ঠিকানা তিনি পেয়েছেন তবে সেই স্থানে যাওয়ার আগে কেউ যেন তাকে পেছন থেকে বন্দি করেছে।শেহজাদী আরওয়া পেছনে তাকালেন তাকে ঘিরে ধরেছে বেশ কয়েকটি কঙ্কাল।এত কঙ্কালের মাঝে নিজেকে অসহায় লাগছে পালাতে গিয়েও তিনি বন্দি।এক পর্যায়ে নিজেকে বাঁচাতে বিকট শব্দে চেঁচিয়ে উঠেন শেহজাদী।চোখ মেলতে টের পান এই মুহূর্তে তিনি নিজের কক্ষেই আছেন।তবে এতক্ষণ কি স্বপ্ন দেখছিলেন?কবিরাজ মশাই আড়চোখে তাকালেন সম্রাট আব্বাসের দিকে।

” আমি ঠিকি বলেছি সম্রাট আমাদের শেহজাদী ভয় পেয়ে চেতনা হারিয়েছেন।”

কবিরাজের কথায় কেউ কোন প্রত্যত্তুর করলো না।সম্রাজ্ঞী শাহাবা জড়িয়ে ধরলেন তার কন্যাকে।চোখের কোনে গড়িয়ে পড়ছে নোনা জল।

” আমার আম্মু আমার চাঁদ কোথায় হারিয়ে গেছিলে?”

” মা আমি…”

” হ্যাঁ বলো কোথায় ছিলে তুমি?”

শেহজাদী সচকিতে সবার দিকে তাকালেন।মনে মনে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলেন, গলাটা কেমন শুকিয়ে আসছে তার।

” পানির পাত্রটি দিন।আর সবাই এই কক্ষ ছেড়ে চলে যান।আমি মাতার সঙ্গে একা থাকতে চাই।”

শেহজাদী আরওয়ার নির্দেশে সবাই কক্ষ ছেড়ে গেলেও সম্রাট আব্বাস গেলেন না।তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন পালঙ্কের ধারে।

” আরওয়া তুমি কোথায় ছিলে?কি হয়েছে তোমার সাথে?”

” এই প্রাসাদে যে জিন্নাত আছে তা কি আপনি জানেন?”

“জিন্নাত কিসব বলছো তুমি!”

” হ্যাঁ জিন্নাত সেই জিন্নাত আমায় নিয়ে গেছে আমায় বন্দি করেছে।”

শেহজাদীর অস্থির কথার তালে অবাক হলেন সম্রাট এবং সম্রাজ্ঞী তারা একে অপরের দিকে তাকালেন।এমন অদ্ভুত কথা এই প্রাসাদ নিয়ে এর আগে কখনো শুনেন’নি তারা।

” তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে মা জিন্নাতের প্রবেশ এই প্রাসাদে নেই।”

” জানতাম আপনারা বিশ্বাস করবেন না।তাই…তাই আগেই বলিনি আপনাদের।আমার সব অসহ্য লাগছে চলে যান আপনারা চলে যান এখান থেকে।”

সম্রাট আব্বাস তার বেগমকে ইশারায় বললেন এই কথা যেন পাঁচ কান না হয়।এবং তিনি দ্রুত বেরিয়ে গেলেন কক্ষ ছেড়ে মাথায় তার ভর করেছে আরেক দুশ্চিন্তা।

ইতোমধ্যে সম্রাট সাঈদের কানে পৌঁছে গেছে শেহজাদীর খোঁজ মিলেছে আর তা শুনে বেশ খুশি হলেন তিনি।সম্রাট আব্বাসকে দুশ্চিন্তায় মত্ত দেখে ভ্রু কুঁচকলেন তিনি।

” কোন সমস্যা?শেহজাদী কোথায় ছিল কিছু বলেছেন কি?”

” আসলে শেহজাদী আমার উপর অভিমান করে গা ঢাকা দিয়েছে তাই…”

বেশ সাবলীল ভাবে মিথ্যা বলে ফেললেন সম্রাট আব্বাস।তবে তার মিথ্যা বানী খুব সহজে ধরে ফেললেন সম্রাট সাঈদ,তিনি তার উজিরের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসলেন।

” তাই নাকি তবে আমার তো মনে হচ্ছে অন্যকিছু।সে যাই হোক আমার বেগম এখানে অনিশ্চিত জীবনে বসবাস করছে।আমি টের পাচ্ছি তার সাথে অন্যকিছু হয়েছে আর আপনারা আমার কাছে তা গোপন রেখেছেন।আমি বরং একবার শেহজাদী আরওয়ার সঙ্গে দেখা করতে চাই।”

” অবশ্যই অবশ্যই আপনি অপেক্ষা করুন শেহজাদীর অনুমতি নিয়ে ডেকে পাঠানো হবে।”

সম্রাট সাঈদ শেহজাদী আরওয়ার সঙ্গে দেখা করলেন এবং আরওয়ার মুখ থেকে জানতে চাইলেন তিনি এই বিবাহে রাজি কি না?দুই’চার না ভেবেই শেহজাদী এই বিবাহে সম্মতি দিয়েছেন এতে খুশি হয়েছে সম্রাট সাঈদ তিনি যাওয়ার আগে জানিয়ে যান খুব শীঘ্রই বিবাহের দিন ধার্য হবে।

শেহজাদীর বিবাহের বিষয়টি একে একে সবার কাছে জানা হয়ে গেছে।জেনে গেছেন তাসবীর নিজেও।তখন শেহজাদীর অবস্থার অবনতি দেখে পাতাল থেকে শেহজাদীর কক্ষে ফিরিয়ে আনেন তাসবীর এরপর থেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন তিনি।তাসবীর ইদ্রীসের কক্ষের এক কোনে বসে আছেন ঘাপটি মেরে।শেহজাদী আরওয়ার রুমে নিরাপত্তা আগের থেকেও বাড়ানো হয়েছে।কক্ষের আশেপাশে চারিদিকেই প্রহরীরা রয়েছে।এছাড়াও দাসী লতা সর্বদা শেহজাদীর সঙ্গে কক্ষে অবস্থান করছেন।

” বন্ধু তুমি এখানে?সকাল থেকে কোথায় ছিলে?”

ইদ্রীসের কন্ঠে চমকে যান তাসবীর।

” রাজ্যে ছিলাম ঘুরে ফিরে দেখছিলাম।আমি চলে যাবো।”

“সে কি কথা আর কয়েকদিন থেকে যাও।আগামী মাসে বোনের বিয়ে।”

” শেহজাদীর বিয়ে!”

“হুম সম্রাট সাঈদ তো তাই বলে গেলেন।আগামীকাল প্রত্যুষে পিতা এবং ভাই সবাই মিলে উদয় নগরীতে রওনা হবে।তুমি নিশ্চিন্ত মনে এখানে থাকতে পারো।”

“উদয় নগরী কেন যাবে?”

“উদয় নগরী জয় করতে।পিতার ভয় শেহজাদীর নিখোঁজের পেছনে মেসবাহ’র হাত আছে এবং এই বিষয়টি নিয়ে তিনি শঙ্কিত যদি বিয়ের দিন কোন গণ্ডগোল করে।তাছাড়া পিতা কোন কাঁটা রাখতে রাজি নয় সময় সুযোগ থাকতে থাকতে তিনি কাঁটা উপড়ে ফেলবেন।”

“হুম বুঝলাম।আবার যু/দ্ধ হা-না-হা-নি,রক্তপাত উফফ এসব আমার সহ্য হয়না।”

” আমিও তোমার মতো বন্ধু কিন্তু কি করার আমার রক্তে যে সম্রাটের রক্ত মিশে আছে।এই রাজ্য ছেড়ে যাই কি করে।”
লেখনীতে পলি আনান
তাসবীর মিহি হাসলেন মনে মনে বেশ দুশ্চিন্তায় আছেন কি করে ঠেকাবেন শেহজাদীর বিয়ে?

১২.
ফজরের আযান শোনা যাচ্ছে।সম্রাট সহ প্রাসাদের সকলে নামায সেরে রাজ সভায় উপস্থিত এখনি সবাই উদয়নগরীর উদ্দেশ্য রওনা হবেন।আস্তাবল থেকে চার’শ ঘোড়া,তিন হাজার অসিচালনার দক্ষ লোক,ছয়’শ তীরন্দাজ এবং নয়টি কামান গোলা নিয়ে সম্রাট আব্বাস এবং তার বড়পুত্র ইবনুল বেরিয়ে পড়েছেন উদয় নগরীর উদ্দেশ্যে।এত শক্তিশালী দলকে যে হারানোর ক্ষমতা উদয়নগরীর সম্রাট ওয়াহাবের হবে না তা ভালো করেই যানে সকলে।

দ্বাররক্ষক সকলে তখন ঘুমে কাবু।সম্রাট বেরিয়ে পড়েছেন খবরটা নিশ্চিত হয়ে দরজার কাছে ঘুমিয়ে পড়েছে তারা।তাসবীর সেই সু্যোগ’টা লুফে নিল আশেপাশে তাকিয়ে দ্বার কয়েকবার ধাক্কা দিতে থাকেন কিন্তু শেহজাদী আরওয়ার কক্ষের দ্বার ভেতর থেকে বন্ধ তাসবীরের সুযোগ’টা বিফলে গেল ভাবতেই দাঁত মুখ খিচে রাগ ঝাড়লেন।অতিদ্রুত প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে শেহজাদীর জানলার কাছটায় গেলেন।অন্ধকার আকাশে আজ চাঁদ নেই আর নেই কোন তারা, আজকের আকাশটাও যেন বিষণ্ণ মনে অপেক্ষায় আছে সূর্যের।তাসবীর জানলা টপকে শেহজাদী আরওয়ার কক্ষে প্রবেশ করেন।পালঙ্কের মাঝ বরাবর চাদর মুড়িয়ে ঘুমিয়ে আছেন শেহজাদী।প্রদীপ মিটে মিটে আলোয় অন্ধকার কক্ষের বিষণ্ণ রেষ কাটিয়ে তুলেছে বেশ সাবলীল ভাবে।তাসবীর পালঙ্কে পা তুলে বসে এক ধ্যানে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন শেহজাদীর দিকে।একদিনের আতঙ্কে ভয়ে মেয়েটার মুখখানি কেমন চুপসে গেছে।মনে মনে অনুশোচনা জাগলো তাসবীরের শেহজাদীর কপালে হাত রেখে গায়ের তাপ নির্ণয় করলেন,নাহ স্বাভাবিক আছে।

” শেহজাদী উঠুন ভোর হয়ে এসেছে।”

তাসবীরের কন্ঠে চোখ মেলে তাকালেন শেহজাদী।পাতালের ভয়ে এক নিমিষেই মনে পড়ে গেল তার ফলে দ্রুত শোয়া থেকে উঠে আকস্মিক দু’হাতের সাহায্য ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল তাসবীরকে।নিজের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে না পেরে সহসা মেঝেতে ছিটকে পড়লেন তাসবীর।মানুষটার চাপা আর্তনাদে কোন হেলদোল হলো না শেহজাদীর বরং তিনি নিজেকে বাঁচাতে খুব দ্রুত ছুটে গেলেন দ্বারের কাছে দ্বার খোলার আগেই তাসবীরের নির্দেশে দু’পা থেমে গেল তার।

” কসম শেহজাদী যদি দরজা খুলেছেন তো…”

” তো?”

তাসবীর প্রত্যুত্তর করলেন না বরং ত্বরান্বিত দু’হাতের সাহায্য বন্দি করলেন শেহজাদী আরওয়াকে।

” আমি ভূ-ত নই যে আপনাকে গিলে খাব এত ছুটছেন কেন?মায়া দয়া আপনার নেই তা আমি জানি তবে যে আমার কোমরের কলকব্জা সব ছাড়িয়ে দিয়েছেন তার কি হবে?”

” অসভ্য ছাড়ুন আমায়।দিন দিন আপনি যে দুঃসাহস দেখাচ্ছেন তার ফল কতটা ভয়ংকর হতে পারে সে ধারণা আপনার নেই।”

” আর আমি আমার ক্ষমতা’র ব্যবহার করলে আপনার চৌদ্দ গুষ্টির কি হবে তার ধারণা আপনার নেই।”

” মূর্খ কি আছে আপনার?পিতাকে সব জানিয়েছি তিনি অতি শীঘ্রই আপনাদের ব্যবস্থা করবেন।প্রাসাদে জিন্নাতের চলাচল বন্ধ।

শেহজাদীর কথার পিঠে তাসবীর মিহি হাসে।আলগা হয়ে আসে তার হাতের বাধন।

” আমি জিন্নাত নই শেহজাদী।মার্জনা করবেন মিথ্যা বলায়।রক্তে মাংসে গড়া মানুষ আমি।”

” আবার মিথ্যা?এবার নিজেকে মানুষ সাজাতে চাইছেন।”

“আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে বলেছেন, আর অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুকনো ঠনঠনে, কালচে কাদামাটি থেকে। আর এর পূর্বে জিনকে সৃষ্টি করেছি উত্তপ্ত অগ্নিশিখা থেকে। [সূরা আল হিজর : ২৬-২৭] আমি মানুষ, জিন্নাত নই আর না আছে আমার তেমন কোন ক্ষমতা।”

শেহজাদীর হাত আপনা আপনি ছুঁয়ে দেয় তাসবীরের হাত।তিনি যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না এই লোকটা মানুষ।এতদিন তাসবীরের প্রতি দুর্বল হলেও তা তিনি প্রকাশ করেননি।জিন্নাত আর মানুষ এক হতে পারে না কেউ তা মেনে নেবে না।তাসবীর নামক এই সুপুরুষ মানুষ!ভাবতেই খুশিতে কান্না চলে আসছে শেহজাদীর।

” তাহলে এত সব গোপন তথ্য কি করে জানেন?আপনি তো বলেছেন জিন্নাতরা সব জানে কিন্তু আপনি তো মানুষ।এই প্রাসাদে কিংবা আমার কক্ষে আপনাকে কোন দিন দেখিনি।”

” আমি এর আগেও প্রাসাদে এসেছি এই রাজ্য সম্পর্কে খুঁটিনাটি অনেক তথ্য জানি শেহজাদী।আমি এটাও জানি আপনাকে সকলে অমঙ্গল,অভিশপ্ত ভাবে।যদিও এই কথা দাস-দাসী’রা কেউ জানে না শুধুমাত্র আপনার পিতা এবং বড় ভাই সেটা মানে।”

সহসা মাথা নিচু করে নেন শেহজাদী আরওয়া।এ যে অপবাদ আর সেই অপবাদের কথা আগন্তুক জানলো কী করে?চোখের কোনে চিকচিক করছে নোনাজল।তাসবীর তা ত্বরান্বিত মুছে দিয়ে বলে,

” আমি চব্বিশ’টি রাজ্যে ঘুরেছি।আর সে রাজ্যের শেহজাদীদের মুখ দর্শন করেছি।কখনো চিত্রকর সেজেছি কখনো কবি সেজে তাদের মনোরঞ্জন করেছি তবে আপনার মতো ঘোর আর কারো আদলে পাইনি।আমি বলবো না আপনি অতি সুন্দরি তবে নিঃসন্দেহে বলতে পারি আপনি আমার সুখানুভূতি!”

শেহজাদী আরওয়া নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন।পালঙ্কে পা দুলিয়ে বসলেন তিনি।কোণা চোখে তাকালেন তাসবীরের দিকে অতি দৃঢ় স্বরে বলেন,

” প্রেম নিবেদন করতে চাইছেন নাকি?”

” একদমই নয়।এসেছিলাম শেহজাদি আরওয়ার মনোরঞ্জন করতে।”

“পেরেছেন কি?”

” তা তো অনেক আগেই।তবে যে সে আমার মনোরাজ্য দখল করেছে তার কী হবে?”

শেহজাদী দাম্ভিক হাসি দিলেন।পালঙ্ক ছেড়ে আরশির কাছটায় দাঁড়ালেন।

” সে যাই হোক।আপনি যে বড্ড দেরি করে ফেলেছেন তাসবীর।আসা করি ইতোমধ্যে যেনে গেছেন সম্রাট সাঈদের সঙ্গে আমার বিবাহের দিন নির্ধারিত হয়ে গেছে।”

” তাতে কি?সময় সুযোগ মতো আমি আমার ক্ষমতা দেখিয়ে দিব।”
#চলবে____