বিধ্বস্ত অনুভূতি পর্ব-০৩

0
4495

#বিধ্বস্ত_অনুভূতি
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ৩
জানালাটা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে খুলে এক পাল্লা খুলেছে৷ ঘরটাতে তন্দ্রার স্বামী অনির রতিক্রিয়ায় ব্যস্ত কোনো মেয়ের সাথে।
দেখেই গা গুলিয়ে উঠেছে তন্দ্রার। তার স্বামী তবে সত্যি পরকীয়ায় আসক্ত?
চোখের সামনে আদিম খেলায় মত্ত মানব-মানবীর অনুভূতি তখন উচ্চ পর্যায়ে কিন্তু তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা তন্দ্রা কোনো রকমে নিজেকে সামলে বেরিয়ে এলো কমলাপুর রেল স্টেশনের পাশের এক বাসা থেকে।

কিছুটা এগিয়ে এসে এক টং দোকানের পাশে বসে পড়ে তন্দ্রা। হাত পা চলছে না। বুড়ো মহিলা দোকান চালায়। কে জানে সে কী বুঝলো?এগিয়ে এলো এক গ্লাস পানি হাতে।
তন্দ্রাকে তুলে ধরে পাশের বেঞ্চিতে বসিয়ে দিয়ে তার হাত মুখে পানি দিয়ে বলল,

“এই গরমে কেউ হাত মুজা পাও মুজা পরে লো?এহনি তো চান্দি ফাইটা মরতা। ধরো পানি খাও।”

তন্দ্রার কানে তখন আশেপাশের কোনো কথাই যাচ্ছে না। তার চোখের সামনে শুধু ভেসে উঠছে তার স্বামীর অন্য নারীর সাথে আদিম নগ্নতার দৃশ্য।

পানি মুখে দিতেই গরগরিয়ে বমি করে দিলো তন্দ্রা। ততক্ষণে মহিলাটা তাকে বাতাস করছে।
নিজেকে সামলে তন্দ্রা শুধু বলল,

“আমাকে একটা রিক্সা ডেকে দিবেন প্লিজ!”

মহিলাটা রিক্সা ডেকে আনতেই তন্দ্রা উঠে বসলো।মহিলার হাতে শ’খানেক টাকার নোট গুঁজে দিতেই রিক্সা চলার জন্য অনুরোধ করে তন্দ্রা।

তাদের বিয়ের দুই বছর চলছে। কিছুক্ষণ আগ অবধিও সব স্বপ্নের মতোন ছিল কিন্তু এখন সব দুঃস্বপ্ন।
আগত ভবিষ্যৎ দেখে ভয়ে শিউরে উঠেছে তন্দ্রা।
রিক্সা নিয়ে সে সরাসরি নিজের বাবার বাসায় চলে এসেছে। মা ভাবীরা প্রশ্ন করলেও কোনো জবাব দেয়নি সে। বিয়ের আগে তার জন্য যে ঘরটা ছিল
এতক্ষণ কোথায় ছিল জানতে চাইলেও তন্দ্রা কোনো জবাব দেয়নি।
রুমে প্রবেশ করে জানালা বন্ধ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে।

কয়েকদিন যাবত অনির পরিবর্তন লক্ষ করছিল।কিন্তু কিছু বলেনি। বিশেষ করে নতুন প্রজেক্টের কাজে যেদিন খুলনা গেল, তার দিন দশেক পর থেকেই এমন পরিবর্তন।

ভেবেছিল হয়তো কাজের জন্য এমন কিন্তু আজ সকালের দেখা ম্যাসেজ তার ধারণা পাল্টে দেয়। নিজেকে ভুল প্রমাণ করার জন্য সে বার বার প্রার্থনা করছিল কিন্তু সত্যের তিক্ততার মুখোমুখি তাকে হতেই হয়েছে৷

নীলিমার পাশ থেকে উঠে একটা সিগারেট ধরায় অনির। সিগারেটের স্বাদটা আজ বড্ড পানসে লাগছে।
তার পাশেই উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে নীলিমা।
নীলিমা! নীলিমা! নীলিমা!

তার জন্য একটা রহস্যের নাম নীলিমা। সাদা মসৃণ পিঠে ছড়িয়ে আছে চুল।হালকা ব্রাউন চুলের কারণে তাকে আরো বেশি আর্কষনীয় লাগছে।

ফোন হাতে নিয়ে অনির দেখলো দুপুর দুটো বাজে। নিশ্চয়ই তন্দ্রা অপেক্ষা করছে ওর জন্য।
বেচারি ওকে ছাড়া খেতে বসে না। ওর খাওয়ার খবর নেওয়ার পর সে খাবার খায়।
কিন্তু আজ তন্দ্রার ফোন বার বার ট্রাই করার পরেও বন্ধ পাচ্ছে সে।

বিকেলবেলা ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে বাহিরে এলো তন্দ্রা।তার মা তখন তার ছোট ভাই বউ কে মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে।
বেশি বেশি করে তেল দিয়ে বেনী করে গুছিয়ে রাখে সে তার পুত্র বঁধুকে অথচ সে কী একবার খেয়াল করে দেখেছে তার মেয়ের মাথার চুল যে খুব রুক্ষ।

বড় ভাবী তন্দ্রাকে ভাত দিলেও মা এখনো আসেনি।খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই তার বড় ভাই এসে পাশে বসেছে।

“তনু কেমন আছিস?”
ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে তন্দ্রা। এরপর মাথা দুলিয়ে বলল,

“ভালো আছি।”

“অনির কেমন আছে? তোর শাশুড়ি? সংসার কেমন চলছে?”

তন্দ্রা একবার ভাবলো সে সব ভাইকে জানাবে।কিন্তু কী একটা ভেবে বলল না।

“ভালোই চলছে।”
“তাহলে না বলে হুট করে চলে এলি যে! একা একা। আগে বলিস নি তুই আসবি?সব ঠিক আছে তো?”
“খবর না দিয়ে আসা যায় না?”
“বিয়ের পর একবার তুই এভাবে এসেছিলি।মনে আছে? তোর ননদ শাড়ি নিয়ে ঝামেলা করায় অনির মেরেছিল তাই এসেছিলি।মাঝে একা আসিসনি তাই মা আর তোর ভাবী ভাবছে……..

” না কিছুই হয়নি।”

তন্দ্রা ভাত খাওয়া থামিয়ে দিলো।এ বাড়িতে আসার অধিকার তার ফুরিয়েছে আগেই সেই নিজের মনে করে অযাচিত চলে এসেছে৷
তাকে চুপ থাকতে দেখে তার ভাই বলল,

“কিছু হলে আমাকে বল বোন, লুকাচ্ছিস না তো!সুখে আছিস তো?

ভাইয়ের কথায় দুচোখ উপচে পানি আসছিলো তবুও সেদিকে পাত্তা দিলো না তন্দ্রা। হাসি হাসি মুখ করে বলল,

“এমনি এসেছিলাম ভাই। আমি সুখেই আছি। তোমরা চিন্তা কোরো না আমার জন্য।আমি আর এভাবে আসবো না।”

“আসবি না ক্যান?আসবি খাবি থাকবি নিজের ইচ্ছেমতো। বাড়ি কী আমাদের একার?”

বড় ভাই চলে যাওয়ার পর তন্দ্রা রান্না ঘরে যাচ্ছিলো প্লেট রেখে হাত ধুতে তখন অনিচ্ছাসত্ত্বেও দুই ভাবীর কথা তার কানে এলো,

“দেখ ছোটো দেখ,তোর জন্য রাখা তরকারি তন্দ্রা অনেকটা খেয়ে নিলো রে। আসবে যে বলে আসবে না?”

“আজ তরকারিটা মজার ছিল।ভেবেছিলাম আবার একটু ভাত খাবো।দেখো না একটু পর পর ক্ষুধা লাগে।”

“আমি রাতে আবার রেঁধে দিবো।মা কে বলিস না, মন খারাপ করতে। কারণ তার মেয়েও পোয়াতি।”

“ঝগড়াঝাটি করে আসছে না কী?”

“জানি না। তবে ওর ঝগড়ার বাতিক নেই।সহ্য ক্ষমতা অনেক বেশি।বিয়ের পর একবার এসেছিল ঝগড়াঝাটি করে। এরপর আর আসেনি।”

তন্দ্রা রান্নাঘরে যায় না। কলতলা থেকে প্লেট হাত মুখ ধুয়ে ঘরে এসে প্লেট গ্লাস জায়গা মতোন রাখে।বোরখা হাতে বসেছে একটু ফ্যানের নিচে ঠিক সে সময়
মা ভাবীরা এলেন। তন্দ্রার সাথে কথা বলছিল। তার মায়ের প্রথম বাক্য ছিল,

“তুই কী আজকেই চলে যাবি?”

হাসি হাসি মুখ করে তন্দ্রা বলল,

“এই তো মা রেডি হচ্ছি।এক্ষুণি বের হবো।”

“এভাবে এলি ক্যান?একটা রাত থেকে যা।”

“না মা।আমি বুঝিনি আমি আসাতে তোমাদের এত ঝামেলা হবে।”

এরপর বড় ভাবীর দিকে তাকিয়ে বলল,

“আবার তোমার তরকারি রান্নার ঝামেলায় ফেললাম গো।কষ্ট করে রেঁধে নিও।”

ভাবীদের বুঝতে সমস্যা হলো না যে তন্দ্রা তাদের কথা শুনেছে। বড় ভাবী তার দুহাত ধরে বলল,

“ভাই তুমি মন খারাপ করেছো? আমি কিন্তু ওভাবে বলিনি।”
“আমি মন খারাপ করবো ক্যান?তোমরা যা বলেছ ভুল তো বলোনি।”

বাবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো তখন আকাশে মেঘ জমেছে। চারদিকের মানুষ যার যার আপন নীড়ে, নিরাপদ স্থানে আপন জনের কাছে যাচ্ছে। তন্দ্রা তখন হাটছে এলোমেলো ভাবে।সে জানে না গন্তব্য কোথায়। কারণ কিছু মানুষের সব থেকেও তো নেই। দুই পরিবার থাকতেও তাদের কোনো ঘর নেই, আপনজন নেই। তাদের ভাসতে হয় কচুরিপানার মতোন। পানির টানে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে।
স্থায়িত্ব হয় কবরের মাটি। তন্দ্রার এলোমেলো পদক্ষেপ গুলো এগিয়ে যাচ্ছিলো তার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।

চলবে

আপনি তন্দ্রা হলে কী করতেন?