#বিয়ে
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২০
ধ্রুব ওর এই কথা শুনে হাতে থাকা কফির মগ ছুঁড়ে ফেলে গটগটিয়ে হেঁটে নেমে পড়লো ছাদ থেকে। আর তিনজোড়া চোখ একরাশ বিস্ময় চেয়ে রইলো টুকরো হয়ে পড়ে থাকা মগটির দিকে!
সন্ধ্যায় অদ্রি এসে দেখলো ধ্রুব ঘরেই আছে। ও নিজের মনে কিছু কথা সাজিয়ে নিলো। তখন ওদের সামনে ওরকম একটা আচরণ করার কারণে ওরা বিব্রত হয়েছে। তাছাড়া অদ্রি ধ্রুব’র ব্যবহারে বেশ আপসেট। সে রাগ দেখিয়ে লোকের সামনে কি করে এ ধরনের আচরণ করতে পারলো? অদ্রি গলা খাকারি দিয়ে ধ্রুব’র দৃষ্টি আর্কষণ করার চেষ্টা করলো। ধ্রুব শুনেও না শোনার ভান করলো। ব্যর্থ হয়ে অদ্রি ওর কাছে গিয়েই জিজ্ঞেস
করলো,
— আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো। বলবো কি?
ধ্রুব তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
— শুনছি।
অদ্রি কিছুটা রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
— আপনি তখন এরকম একটা কাজ করলেন কেন? ওরা কি ভেবেছে?
ধ্রুব টেবিলে বসে কাজ করছিলো। ওর চোখমুখ কঠিন। অদ্রির প্রশ্ন শুনে ওর গা জ্বলতে লাগলো। তেজ নিয়ে বলল,
— আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই করেছি। তোমার কোনো সমস্যা?
অদ্রি বলল,
— না আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু গেস্টদের সামনে এরকম আচরণ কি ঠিক?
ধ্রুব কি-বোর্ডে কিছু একটা টাইপ করতে করতে বলল,
— তোমাকে এখন এক্সপ্লেনেশন দিতে হবে? কে তুমি?
অদ্রির গলার স্বর ধীর হয়ে এলো,
— ওরা ভেবেছে আপনি আমার জন্যই এরকম করেছেন।
ধ্রুব তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
— ওরা যা খুশি ভাবুক। আমি তো ওদের ভাবনা পাল্টানোর দায়িত্ব নিইনি। আর তোমার জন্য এরকম করবো আমি? তাই মনে হয় আমাকে দেখে? নিজেকে এত ইম্পোর্টেন্ট ভেবো না।
ধ্রুবর আচরণে অদ্রি কেমন মিইয়ে গেলো। এরকম তাচ্ছিল্যযুক্ত ব্যবহার অদ্রির পছন্দ হচ্ছে না। ও আর কি বলবে ভেবে পেলো না। ছোট্ট করে বলল,
— ভাবি না তো।
ধ্রুব ওঠে দাঁড়ালো। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
— গুড।
রাতে অদ্রির প্রচন্ড মাথা যন্ত্রণা করতে লাগলো। দু’বার ওঠে মাথায় পানিও দিয়ে এলো। ইদানীং রাত জেগে পড়াশোনা করার কারণে ওর বেশ ভুগতে হচ্ছে। বইপত্র রেখে কোনোমতে একটা ট্যাবলেট খেয়ে অদ্রি ভেজা চুল নিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়লো। ঠিকঠাকভাবে ঘুমালে মাথা যন্ত্রণাটা হয়তো এবার কমবে।
ভোরের বাতাস ফরফর করে জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকছে। ফুলগন্ধি এক হাওয়া সুবাস ছড়াচ্ছে চারপাশে। সূর্য তখন সবে উঁকি দিচ্ছে, তেজ নেই সেই রোদে।
তির্যক রশ্মি চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় ধ্রুব’র। শোয়া অবস্থায়ই অলস হাতে ঘড়ি দেখে সে, পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ। জানালা থেকে পর্দা সরিয়ে বাইরে দৃষ্টি দিতেই চোখে পড়লো আকাশ। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বিছানায় ওঠে বসে ও। পাশে আদুরে বেড়ালের মতো ঘুমিয়ে থাকা অদ্রিকে দেখে সে। ওকে দেখলেই ধ্রুব’র সমস্ত বোধবুদ্ধি লোপ পায়। ওর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে ধ্রুব। গাল চকচক করছে অদ্রির, আধভেজা চুলগুলো লেপ্টে আছে বালিশের ওপর। অদ্ভুত সুন্দর এই দৃশ্যটি ধ্রুব’র মন কেড়ে নেয়। অদ্রিকে ঘুম থেকে জাগাতে ওর ইচ্ছে হয় না। এভাবেই মন ভরে দেখা যায় ওকে, জেগে থাকলে শুধু ভস্মদৃষ্টির শিকার হতো ধ্রুব। একসময় ওর খেয়াল হয় অদ্রির ভেজা চুলে বালিশ ভিজে আছে, ধ্রুব ওকে ডাকতে গিয়েও থেমে যায়। গতরাতে করা নিজের আচরণের কথা মনে পড়ে। অশ, আবারও একটা ভুল করে ফেললো সে! রাতজেগে পড়াশোনা করে ভোর হওয়ার আগেই মাত্র শুয়েছে, এখন ডাকলে হয়তো ওর কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যাবে। এমনিতেও সামনে পরীক্ষার চিন্তায় অদ্রি রাতে খুব একটা ঘুমায় না। পড়তে পড়তে প্রায়ই রাত কাটিয়ে দেয়। সবকিছু মিলিয়ে ধ্রুব আর ওকে বিরক্ত করে না। নিঃশব্দে পর্দাগুলো টেনে দিয়ে আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করে।
অদ্রির ঘুম ভাঙে আরো আধঘন্টা পর। চোখের পাতা ভার হয়ে আছে। ও আধখোলা চোখে দেখতে পায় ধ্রুবকে। চুলগুলো উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে। বালিশে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকার দরুন গাল বসে গেছে, লাল হয়ে আছে। লম্বা পা দুটো বিছানার বাইরে বেরিয়ে আছে। অদ্রির শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে ওকে। এই লোকটা তার নিজস্ব মানুষ। অথচ! অথচ! কোনোকিছুরই ঠিক নেই। সবকিছু অভিনয়ের মতো। অদ্রির বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম শব্দ হতে থাকে। কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি! ধ্রুব’র তিক্ত আচরণ মনে হতেই অদ্রি তড়িঘড়ি করে বিছানায় ওঠে বসে। কাঁধের ওপর ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো কোনোমতে কাটায় আটকে নেয়, নেমে পড়ে বিছানা থেকে। নিজের বালিশ, চাদর গুছিয়ে ফেলে, মেঝেটা ঝাড়ু দেয়। এরপর একেবারে ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে নিচে যায়। জরিনা এসে ওকে চা দিয়ে যায়। লনের চেয়ারে বসে অদ্রি চায়ের কাপে চুমুক দিতে থাকে। ঠিক তখনই ফ্লোরাকে দেখতে পায় ও। ফ্লোরা আসার পর থেকে অদ্রির সাথেই বেশিরভাগ সময় কাটায়। হয়তো বাড়িতে ওর বয়সী মেয়ে নেই সেজন্য। অদ্রিরও তেমন খারাপ লাগে না। মেয়েটার এখনো ঘুমের রেশ কাটেনি। ফ্লোরাও ওকে দেখে এগিয়ে আসে। ওর পরণে ঘুমের পোশাক। এসেই হাই তুলতে তুলতে অদ্রিকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
— এত সকালে এখানে বসে আছো যে?
অদ্রি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে,
— ফ্রেশ হাওয়া খেতে। তুমি তো সচরাচর এত সকালে ঘুম থেকে ওঠো না। আজ হঠাৎ?
— আর বলো না, ফ্রেন্ডদের সাথে রাতজেগে আড্ডা দিতে দিতে কখন যে সকাল হয়ে গেলো টের পাইনি।
অদ্রি অবাক হয়ে বলল,
— তার মানে রাতে ঘুমাওনি?
— উহু!
অদ্রি নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,
— এখন গিয়ে ঘুমিয়ে নাও, নয়তো মাথাব্যথা হবে।
ফ্লোরা চোখটিপে হেসে বলল,
— তোমার রাতজাগার এক্সপেরিয়েন্স আছে, তাইনা?
অদ্রি স্বাভাবিকভাবেই বলল,
— হুম।
ফ্লোরার মাথায় দুষ্টুমি বুদ্ধি চাপলো,
— কি কি হয়?
অদ্রি ব্যাপারটি ধরতে পারলো৷ মুহূর্তেই ওর রক্তিম
হয়ে ওঠলো। কিন্তু ফ্লোরার উৎসাহের খাতায় ও ভাটা ফেলে দিলো। এই প্রশ্নের উত্তরে বলল,
— পড়াশোনা।
ফ্লোরা ওর উত্তর শুনে শুকনো মুখে বলল,
— তোমারা কখন যে একে-অপরকে ভালোবাসতে শুরু করবে সেটা আমি বুঝতেই পারছি না। আমার তো মনে হচ্ছে এই পড়াশোনা তোমাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে দিচ্ছে!
ফ্লোরার কথা শুনে অদ্রি আলতো হাসলো। ওর পৃথিবীটা খুব ছোট। সেখানে গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া আর কারো অস্তিত্ব নেই। ফ্লোরা ওদের সম্পর্ক হওয়ার ব্যাপারটাকে যতটা সহজ ভাবছে, আদতে তা মোটেও সহজ নয়। রুবিনার স্বপ্ন ছিলো তার মেয়ে পড়াশোনা করে বড় কিছু হবে, বিদেশ থেকে ডিগ্রি আনবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে। মায়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য ছোটবেলা থেকেই কঠোর পরিশ্রম করে ভালো রেজাল্ট করেছে ও। অদ্রি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বিয়েটা ও এখনি করতো না। শুধুমাত্র বাবার হাতের একটি চড়-ই সেদিন ওকে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিলো। নিজের প্রতি
এতটুকু আত্মসম্মান সে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছে চিরদিন। এক মুহূর্তের জন্য ভেবেছিলো হয়তো
তার লাইফ পার্টনার নামক ব্যক্তিটা প্রতি পদক্ষেপে
ওর পাশে থাকবে, ওর সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দেবে।
কিন্তু না, সেই চিন্তাটি বেশিক্ষণ নিজের জায়গা দখল করে রাখতে পারেনি। ভুল প্রমাণ হয়েছিলো বিয়ের দিন রাত্রেই। এও ভেবেছিলো অদ্রি, যে এই বাড়িতে হয়তো সবাই ওকে ভালোবাসবে সমানভাবে। অবশ্য আসার পর সবাই ওকে দারুণভাবে ভালোবেসেছে। শুধুমাত্র ধ্রুব ছাড়া। বিয়ের সময় যদি অদ্রি জানতো ধ্রুব বিয়ে করতে চাইছে না, তাহলে ও কখনোই এ সম্পর্কে জড়াতো না।
প্রথমদিকে করা ধ্রুব’র ব্যবহারগুলো পরবর্তীতে
অদ্রি’র মনকে আরও শক্ত করে দিয়েছে। নিজের বাবাকেই যেখানে এখনো মন থেকে ক্ষমা করতে পারেনি। সেখানে ধ্রুব যতই ভালো ব্যবহার করুক না কেন, শুধুমাত্র লাইফ পার্টনার বলে কেন ওর করা সব অপমান ক্ষমা করে দেবে? ভালোবাসার জন্য অদ্রি এতটা হাভাতে আদৌ হতে পারবে কি সে? ও ভেবে
কুল পায় না। তাছাড়া ধ্রুব তো প্রথমেই বলেছিলো সে অদ্রির লাইফ পার্টনার কখনোই হতে চায় না। অদ্রিকে দেখে ও মুগ্ধ হয় না, শুধু রাগ হয়। অদ্রিকে শুধু জ্বলন্ত দৃষ্টিতে দেখতো। এমনকি ওর ঘরে থাকার জায়গা দেয়নি, না দিয়েছিলো কোনোকিছু ছোঁয়ার অনুমতি। অকারণেই বিয়েটা ভাঙার জন্য অদ্রিকে একটা বাজে অফারও করেছিলো। বিয়েটা হয়তো ছেলেখেলা ছিলো ওর কাছে? সম্পর্ক কি কোনো অফারের ওপর ভিত্তি করে টিকে থাকতে পারে?এসব ভুলে অদ্রি কি করে ধ্রুব’র ভালোবাসা মেনে নেবে? সে কি করে বিশ্বাস করবে সবকিছু ধ্রুব ওর মন থেকে করছে, মন থেকে অদ্রিকে মেনে নিচ্ছে? এত সহজ সবকিছু কীভাবে হয়? সবচেয়ে বড় কথা ধ্রুব ভাবতো, অদ্রি ওর মায়ের ভালোবাসার ভাগ বসাতে এসেছে। আচ্ছা, মায়েদের ভালোবাসার কি আদৌ কোনো ভাগ হয়?
সন্ধ্যাবেলা শায়লা ঠিক করে সবাই মিলে শপিংয়ে যাবে। রাতের ডিনারটাও বাইরে থেকে সেরে আসবে। গতরাত থেকেই অদ্রির মাথাব্যথা। ব্রেকফাস্ট শেষে আজ সারাদিন ও ঘুমিয়েছে। ফ্লোরা গিয়ে ওকে ডেকে তুললো শপিংয়ে যাওয়ার প্ল্যানটা জানালো। অদ্রি অসুস্থবোধ করায় ও যেতে চাইছিলো না। কিন্তু শায়লা একপ্রকার জোর করেই ওকে রেডি করেছে। আশফাক সাহেব, নাজমুল সাহেব শপিংয়ে না গিয়ে তাদের বন্ধুদের গেট টুগেদারে চলে গেলেন। এদিকে ধ্রুবও শপিংয়ে যেতে চাইছিলো না। কিন্তু রাদিফের কারণেই ওরও যেতে হলো। যতীন অফিসের গাড়িটা নিয়ে আশফাক সাহেবদের সাথে গেছে। আর বাড়ির গাড়ির ড্রাইভিং সিটে ধ্রুব বসলো। কিন্তু দেখা গেলো গাড়িতে একজনের জায়গা হচ্ছে না। সেটা দেখে অদ্রি বলে ওঠলো,
— জায়গা তো হবে না মনে হচ্ছে। আমি আর ফ্লোরা তাহলে রিকশা করে আসি?
শায়লা বলল,
— এই সন্ধ্যাবেলা তোদের আমি একা ছাড়বো ভাবলি কি করে?
অদ্রি বলল,
— আরে এটুকু রাস্তা তো, ঠিক চলে আসবো। এই ফ্লোরা যাবে তো?
ফ্লোরা উত্তেজিত গলায় বলল,
— অবশ্যই। রিকশা করে যেতে বেশ মজা হবে।
শায়লা মাথা নেড়ে বলল,
— না না। তোরা গাড়িতে বস, একটু কষ্ট হবে। কিন্তু যেতে পারবো। সন্ধ্যার পর মেয়েমানুষ রাস্তাঘাটে চলাফেরা করা বিপদজনক। যা দিনকাল পড়েছে…
অদ্রি এবার মুখ গোঁজ করে বলল,
— আসলে মাথাটা ধরে আছে তো। চাপাচাপি করে বসা গেলেও আমি হয়তো বমিটমি করে দেব।
ওদের কথোপকথন শুনে এবার রাদিফ শায়লার উদ্দেশ্যে বলে ওঠলো,
— নো টেনশন আন্টি৷ আমি নাহয় ওদের নিয়ে আসছি!
— তুই যাবি?
রাদিফ ভ্রু কুঁচকে বলল,
— কেন নয়? তোমার যাও, আমরা তিনজন না-হয় রিকশা করে চলে আসবো।
ধ্রুব এবার ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে এলো। গাড়ির চাবিটা রাদিফের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
— তোরা যা। আমি ওকে নিয়ে আসছি।
ফ্লোরা শুকনো গলায় বলে ওঠলো,
— তাহলে আমি?
ধ্রুব বলল,
— গাড়িতে করে যাবে।
অদ্রি ফ্লোরার হাত ধরে শক্ত গলায় বলল,
— আমরা তিনজন একসাথে যাবো, আপনি গাড়িতে আন্টিদের নিয়ে আসুন।
ধ্রুব এবার রেগে গেলো,
— তুমি আমার সাথেই যাবে।
[ দেরি হওয়ার জন্য একশো কোটি স্যরি।]
চলবে…