বিষাদনীড়ে মায়াতরী পর্ব-২২+২৩+২৪

0
226

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [২২]
প্রভা আফরিন
_

ভোরের আলো ফুঁটতেই খন্দকার বাড়িতে ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। চামেলিকে দেওয়া হয়েছে পুরো বাড়ি ধোয়া-মোছা করে পরিষ্কার করার দায়িত্ব। দক্ষিণের পুকুরপাড়ের সামনে রান্না চড়েছে বড়ো বড়ো ডেকচিতে। আজ রান্না করছে বাবুর্চিরা। প্রায় শ-খানিক লোকের খাবারের আয়োজন হচ্ছে। সেসবের দেখভাল করছেন মেহেরুন বানু নিজেই। ওনার খুঁতখুঁতে চোখে বাবুর্চিদের হাজারটা ভুল ধরা পড়ছে। এ নিয়ে গা’লমন্দ করতেও ছাড়ছেন না। এনাম সাইকেলে চেপে এদিক ওদিক দরকারে ছোটাছুটি করছে। পাছে কোনো কমতি না থাকে। আজ চিত্রার বিয়ের পাকা কথা হবে। তারই আয়োজন হচ্ছে। সেই সঙ্গে চিত্রাকে দেখতে আসবে মোক্তারদের মুরুব্বি ও আত্মীয়রা। বিয়ের আগেই দুইপক্ষের ছোটোখাটো এক সমাগম হবে আজ। আতিথেয়তায় কোনো কমতি রাখবেন না রবিউল খন্দকার। কোন বাড়ির মেয়ে নিচ্ছে সেটাও বোঝানো উচিৎ কিনা।

পালিকে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করতে দেখে মেহেরুন বানু ডাকলেন।
“ঘামে দেহি ভিজ্জা গেছোস! রইদের মইদ্য ঘুরাঘুরি করতাছোস ক্যান?”
“তাহলে কী করব?”
“ঘরে যা। বুবুর লগে থাক। আইজ বাড়িতে অনেক মানুষ আইবো। তাগো সামনে যাওনের কাম নাই।”
পালি মাথা দুলিয়ে চলে যেতে নিলে তিনি আবার ডেকে বললেন,
“ঘোষপাড়া থাইকা মিষ্টান্ন আইছে। চামেলিরে গিয়া কবি ভাই, বুবু আর তরে আগে মিষ্টি দিতে।”
পালির চোখ চকচক করে উঠল। একটু আগে সে বাহারি মিষ্টিগুলোই দেখে এসেছে। খাওয়ার কথা মুখ ফুটে বলতে পারেনি।

চিত্রা নিরলস চোখে সকলের ব্যস্ততা দেখছে। এত আয়োজন, ছোটাছুটি সব তার ক্ষীণ অনুভূতিকে নিশ্চিহ্নের পথে আরেক ধাপ তরান্বিত করে। জুলেখা একটি বাটিতে হলুদ-চন্দন বাটা এনেছে। তার মুখের হাসি আজ যেন সরতেই চায় না। বলল,
“দেহিতো জামাকাপড় গুটা। আমার মাইয়ার সোনার বরণ রূপটা একটু পালিশ করি।”

চিত্রার বিরক্ত লাগছে। ইদানীং না চাইতেও সকলের সঙ্গে খিটখিটে আচরণ করে ফেলছে। এখনও তেমনই করার অভিপ্রায় ছিল। কিন্তু মায়ের হাসিটায় ব্যাঘাত ঘটাতে মায়া হলো। সে চুপচাপ সারা গায়ে হলুদ-চন্দনের প্রলেপ দিয়ে গোসল করল। নতুন শাড়ি, গয়নায় মুড়িয়ে তার সৌন্দর্য যেন চোখ ধাঁধিয়ে উঠছে। ফরসা দেহে গোলাপি শাড়ি এক অনন্য মাত্রা যোগ করেছে। পালি এত সাজ দেখে বলল,
“তোমারে রানীর মতো লাগতেছে বুবু। কিন্তু..”
“কিন্তু কী?”
“শুধু মুকুট নেই।”
জুলেখা চিত্রার মাথায় চুমু খেয়ে বলল,
“দরকার পড়লে মুকুটও গড়াইয়া দিমু। আমার মাইয়া রানীর চেয়ে কম না কি?”
পালি ভাবুক চোখে তাকাল। ওর স্বচ্ছ দৃষ্টির ভাষা বুঝে চিত্রা প্রশ্ন করল,
“আরও কমতি আছে?”
“আছে।”
“বলে ফেল।”
“হাসো। হাসিটারই কমতি আছে।”
“পাত্রপক্ষের সামনে মুখ খুলে হাসতেও নেই। তারা অসহায়, গোমড়ামুখ দেখতে বেশি পছন্দ করে।”
“কেন?”
“কারণ পাত্রীদেখা হলো ছোটোখাটো এক বিবাহ নির্ধারণী আদালত, যেখানে পাত্রীকে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে পাত্রপক্ষের প্রশ্ন ও পছন্দের ভিত্তিতে বেকসুর খালাস পেতে হয়। সেখানে অকারণে হাসলে তারছেড়া ভাববে।”
পালি মাথা চুলকে বলল,
“কিছুই বুঝলাম না।”

নিবাসপুরের বড়ো নৌকাটি শালুগঞ্জ এসে পৌঁছালো দুপুরবেলা। মুহূর্তেই পরিবেশ গমগম করে উঠল। বাড়ি ভরে গেল মানুষের কোলাহলে। চিত্রার বুক ঢিপঢিপ করছে। মানতে না চাইলেও তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আজ শুধু তারিখ ঠিক হবে। ওর গলা শুকিয়ে আসে। অস্থিরতা চেপে বসে প্রতিটি শিরায়। বাস্তবতায় আবেগকে পিষে নতুন জীবনের হাতছানি তার দোরগোড়ায়। যা ফেরানোর পথ চিত্রার জানা নেই। মেহেরুন বানু ঘরে ঢুকে নিরবে চিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর দরজা আটকে নাতনির পাশে এসে বসলেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলতে শুরু করলেন,

“আল্লাহ তাঁর বান্দার কপালে যা রাখছে তাই হইব। ভাগ্যরে যত দ্রুত মাইনা নিতে পারবি ততই ভালো। একজনরে ভালোবাসলে যে জীবনে আর কাউরে ভালোবাসা যায় না এমন কোনো কথা নাই। তাইলে দুনিয়াতে অসুখী মানুষই বেশি থাকত। সুখী থাকার অধিকার সবার আছে। রনির আছে বইলা সে ঝামেলা এড়াইয়া চইলা গেছে। সাম্যের আছে বইলা পছন্দের মানুষরে চাইছে। তাইলে তুই ক্যান অসুখী হবি?”

চিত্রা দাদিকে জড়িয়ে ধরল। চেপে রাখা কান্নারা গোপন কুঠুরি থেকে বেরিয়ে এসে ডালপালা মেলল সঙ্গে সঙ্গে। সে হেচকি তুলে আওড়ালো,
“আমিও সুখ চাই দাদি। আমিও চাই। এই স্মৃতির ব্যাথা আমার সহ্য হয় না। কী করে সুখ পাব বলে দাও না?”

মেহেরুন বানু ওকে সামলে নিতে সময় দেন। পিঠের ওপর হাত বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
“সাম্য তর স্বামী হইব, তা নিয়া কোনো সন্দেহ নাই। মন থাইকা মাইনা নে। হের কোনো দোষ নাই। বিয়ার পর তার লগে অবিচার করবি না। একলগে থাকলে দেখবি আপনাআপনিই মায়া পইড়া যাইব। এ জগতে মায়ার চেয়ে বড়ো টান কিছু হয় নারে, বু।”

স্বামী, বিয়ে শব্দগুলো চিত্রার কাছে ভীষণ ভারী মনে হয়। সে মনের কথা অকপটে বলে ফেলল,
“এ জগতে কী বিয়ে ছাড়া সুখী হওয়ার উপায় নেই?”

মেহেরুন বানু রাগ করলেন না। নরম গলায় বললেন,
“জগতে হয়তো আছে, তয় সমাজে নাই। আর সমাজ ছাড়া দেশও নাই। মাত্র তো সতেরো বছর। বিয়া ছাড়া বাঁচার বাস্তবতা বোঝার বয়সও তর হয়নাই, সুখ তো পরের কথা। তর এহনো দুনিয়া চেনা বাকি, বুঝা বাকি। আবেগে এইবার লাগাম টান। জীবনরে স্বপ্নের মতো বাসনা করার আগে দুঃস্বপ্নের কথাও চিন্তা করতে হইব।”

চিত্রা কোনো কথা বলল না। তার ফোঁপানো কমে এসেছে। জুলেখা বাইরে থেকে তাড়া দিলে মেহেরুন বানু চিত্রার চোখের জল মুছিয়ে দিলেন। মাথায় লম্বা ঘোমটা তুলে দিয়ে বললেন,
“মাথা নিচু কইরা রাখবি। ছটফট করবি না। কিছু জিগাইলে নরম গলায় উত্তর দিবি।”

চিত্রাকে মোক্তার বাড়ির মহিলাদের সামনে নেওয়ার পর সকলেই মুগ্ধ হলো। এমনকি তাকে মানতে না চাওয়া রাজিয়ার দৃষ্টিতেও খানিক নমনীয়তা দেখা গেল। সাম্যের বড়ো বোন হাসনা বলল,
“ছেড়ি তো মাশাআল্লাহ, ফুপুর মতোই সুন্দর।”

বিপুল মোক্তার না এলেও তার স্ত্রী নাজনীন এসেছে। তার খুঁতখুঁতে চোখ স্বামীর না হওয়া শ্বশুর বাড়ির ত্রুটি লক্ষ্য করতে ব্যস্ত। হাসনার বলা কথাটা খট করে কানে বাজল তার। ফুপুর মতোই সুন্দর! করবী তাহলে এমনই সুন্দর দেখতে ছিল! করবীকে না দেখেই এযাবতকাল হিংসা করে এসেছে নাজনীন। চিত্রার সৌন্দর্যে সে ছাপ আছে শুনেই কিনা মনের মধ্যে আবারও ঈর্ষা উঁকি দিয়ে লুকিয়ে পড়ল। সে চাপা গলায় বলল,
“দেখ আবার ফুপুর মতোই চরিত্র কিনা।”

রাজিয়া চোখ গরম করে তাকালে নাজনীন চুপ করে গেল। চিত্রা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে সকলের মাঝে বসে আছে। এত মানুষের চাহনি, নানান ধরনের কথায় তার হাসফাস লাগছে। সে আঁড়চোখে এদিক ওদিক তাকাল পরিচিত মুখের খোঁজে। সাম্যের মেজো বোন হেনা তা খেয়াল করে বলে উঠল,
“খুঁইজা লাভ নাই। সাম্য আহে নাই।”

চিত্রা ঝট করে মুখ নামিয়ে নিল। সকলের হাসাহাসিতে লজ্জায়, অস্বস্তিতে বুদ হয়ে রইল সে। রাজিয়া কাছে এসে বসে হবু পুত্রবধূকে ভালো করে দেখেন। সঙ্গে একটা নাকফুল এনেছেন আজই পরিয়ে দিয়ে যাওয়ার জন্য। তখনই খেয়াল হলো চিত্রার নাকে কোনো ছিদ্র নেই। তিনি অসন্তোষের স্বরে বললেন,
“নাকে ফুটা করে নাই ক্যান? ফোঁড়াও নাই?”

নাজনীন বলল,
“আজকালকার শিক্ষিত মেয়েরা শুনেছি বিয়ের পর নাকফুল পড়তে চায় না। তাই হয়তো ফোঁড়ায়নি।”

“সে যতই শিক্ষিত হোক, আমার বাড়ির বউরে নাক ফোঁড়াইতে হইব, নাকফুল পিনতে হইব।”

জুলেখা তাদের অসন্তোষ দেখে এগিয়ে এসে বলল,
“নাক তো বিয়ার দিনও ফোঁড়ানো যায়। আমাগো নাক ফোঁড়ানো নিয়া কোনো ঝামেলা নাই। আপনেরা নিশ্চিন্তে থাহেন।”

নাকফুল আর পড়ানো হলো না। বর্ষার জল-কাদায় ঝামেলা করতে চায়না বলে উভয়পক্ষের সম্মতিতে বিয়ের তারিখ পড়ল ভাদ্র মাসের প্রথম সপ্তাহে। এতসবের কোথাও পালিকে নজরে এল না। মেহেরুন বানু যেন ইচ্ছে করেই তাকে আড়াল করলেন।
__________

পরদিন সকালেই চিত্রার নাক ফোঁড়াতে উঠেপড়ে লাগলেন মেহেরুন বানু। সেই সঙ্গে জুটে গেল পালি। তারও কান ফোঁড়াতে হবে। পালির অবশ্য একবার কান ফোঁড়ানো হয়েছিল ছোটোবেলায়। কানে কিছু না থাকায় বুজে গেছে। আজ চিত্রার সাথে তাকেও ধরলেন মেহেরুন বানু। চিত্রা বিনাবাক্যে নাক ফোঁড়ালো। বিপত্তি বাধালো পালি। চিত্রার নাকে সু’চ ঢোকাতে দেখেই ওর আত্মা কেঁপে উঠেছে। মেহেরুন বানু তাকে ধরতে এলেই সে কান্না জুড়ে দিল। কিছুতেই কান ফোঁড়াবে না। ছোটোবেলায় যেবার কান ফোঁড়ানো হয় পালির সঠিক মনে না থাকলেও সেদিনই সে জ্বরে পড়েছিল খেয়াল আছে। চামেলি তাকে পাশে বসিয়ে সুন্দর সুন্দর কানের দুল পরার লোভ দেখাল, কাজ হলো না। এক পর্যায়ে মেহেরুন বানু যখন ওকে শক্ত করে ধরতে বললে পালি ছোটাছুটি শুরু করল।

বোনের বিয়ে উপলক্ষে হিমাদ বাড়ি এসেছে। রবিউল খন্দকার নিজেই তাকে নিয়ে এসেছে। সে এখন আর আগের মতো নেই। চলনে-বলনে আধুনিকার ছাপ। বাড়ির প্রতি যেটুকু টান ছিল তাও যেন শহরের হাওয়া লেগে উবে গেছে। আচরণ হয়েছে আগের চেয়েও গম্ভীর। জুলেখা তার এই ছেলেকে চিনতে পারে না। শহরে গিয়ে নরম-সরম ছেলেটা হারিয়ে গেছে। এ নিয়ে সে দিনরাত কাঁদছে। হিমাদকে আর ফিরতে দেবে না বলে জেদও ধরেছে। রবিউল খন্দকার আগেরবার দূরত্বটুকু ভালোমতো টের পেয়েছিলেন বলে এবার হিমাদের পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্রই বেশিদিনের জন্য তাকে নিয়ে এসেছে।

হিমাদ সবে সকালের নাশতা করতে বসেছিল। বাইরে হুলুস্থুল শুনে বিরক্ত হয়ে খাওয়া রেখেই সে বাইরে এল। সু’চ কাছে আসা মাত্রই পালি জান ছেড়ে কাঁদতে বসছে। মেহেরুন বানুও হাল ছেড়ে দিলেন। এমন কান্না দেখলে ওনার হাত কাঁপবে। পালি নিজের থেকেও বড়ো একটা ওড়না গায়ে প্যাচিয়ে পুটলি হয়ে বসে আছে। হিমাদকে আসতে দেখে চোখ তুলে চাইলো। তার দুই চোখে উপচে পড়া টলটলে জল। মুখে আতঙ্কের ছাপ। হিমাদ দাতে দাত চেপে একহাতে পালির মুখসহ চোয়াল চেপে ধরে অপর হাতে তার ছোটো দুহাত চেপে ধরে দাদিকে বলল,

“এত আহ্লাদের কী আছে? একমিনিটে কাজ শেষ করো।”

পালি এবার চেষ্টা করেও ছুটতে পারল না। তার চিৎকার হিমাদের হাতের মাঝে হারিয়ে গেল। কান ফোঁড়ানো শেষে মেহেরুন বানু নাক ফোঁড়ানোর কাজটাও সেড়ে ফেলতে চাইলেন। ছোটো বয়সে করলে অত ব্যাথা লাগবে না, ঝামেলাও থাকবে না আর। এবার পালির কান্না মাত্রা ছাড়ালো। হিমাদ নিরবে তাকিয়ে বলল,
“ছেড়ে দাও। বড়ো হোক, ইচ্ছে হলে ফোঁড়াবে।”

চলবে…

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [২৩]
প্রভা আফরিন
_

ভোররাতে ঝড় হয়েছে। জল-কাদায় উঠান, রাস্তাঘাটের নাজেহাল অবস্থা। গাছপালা ভেঙে পড়েছে। ভোরের আলো ফুটতে ঝড় থেমে গেলেও বৃষ্টি থামেনি। থেমে থেমে অবিরাম বারিধারা খসে পড়ছে আকাশের গা থেকে। বাইরে তাকালে মনে হচ্ছে সকাল নয়, সন্ধ্যা হয়েছে সবে। একটু পরই ঘুটঘুটে আঁধারে ঢেকে যাবে চারপাশ। বৃষ্টির সঙ্গে উড়ে আসা শীতল হাওয়ায় আলসেমি জেঁকে বসেছে। কিন্তু রবিউল খন্দকার আলস্য আঁকড়ে বসে থাকতে পারলেন না। এনাম ঝড় শেষ হতেই রাইস মিল হয়ে এসেছে একবার। সেখানে কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হলেও হাটের বেশ কিছু অস্থায়ী দোকান ভেঙে পড়েছে। তিনি কালো ছাতাটা হাতে বের হতে নিলে মেহেরুন বানু বললেন,

“এই কুদিনে বাইরে যাওনের দরকার আছে? আবার যদি তুফান ছুডে?”

“যাইতে হইব, আম্মা। হাটের অবস্থা দেখতে হইব। তাছাড়া আরেকটু বেলা হইলে বদরুল আলমের বাড়িতে বৈঠকে যাইতে হইব।”

“যাবিই যহন খাইয়া যা। কহন আবার ফিরবি ঠিক নাই।”

“এহন সময় নাই, আম্মা। আপনেরা খাইয়া নিয়েন। আর এই পেক-ক্যাদায় পালিরে স্কুলে যাইতে দিয়েন না।”

বৃষ্টিমুখর সকালের ধূসর আলোয় পালি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওলট-পালট হাওয়ার তোরে বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে তার গায়ে। পালির উদগ্রীব দৃষ্টি উঠানের শেষমাথায় ছাতিম গাছের নিচে ভেঙে পড়া হলদে পাখির বাসাটির দিকে। ডাল-পাতার মাঝে পাখিটিও পড়ে আছে। তবে দরজা থেকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না পাখিটি জীবিত নাকি মৃ’ত। পালি বৃষ্টি উপেক্ষা করে একছুটে সেখানে উপস্থিত হলো। পাখি বেঁচে আছে। সে পাখিটা থাবা দিয়ে তুলে যেভাবে গিয়েছিল সেভাবেই ফিরে এলো। বৃষ্টিতে ততক্ষণে পালি আধভেজা। নানির বকা খাওয়ার ভয়ের চেয়েও রঙিন প্রাণীটির প্রাণের চিন্তা তার মাথায় চেপে আছে। সে উলটে পালটে দেখল পাখিটার ডানায় আঘা’ত পেয়ে আহ’ত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে মনটা কেঁদে উঠল তার। আহারে! বাচ্চা পাখিটা!

পাখি নিয়ে শুধু পালিই নয় উদ্বিগ্ন হলো চিত্রাও। সুন্দর পাখিটার উড়তে না পারা যেন তাদের একই ব্যথায় ব্যথিত করল। দুজনে মিলে তাকে খাওয়ালো। সারাদিন আদর যত্ন করে তার নাম দিলো ‘সরিষা’, পালির সরিষা বন্ধু। রাতে তাকে ঝুড়ির মাঝে বন্দি করে রাখা হলো। পরদিন রোদ উঠলে পাখির ভেঙে পড়া বাসাটি জোড়াতালি দিয়ে আবারও গাছের ডালে তুলে সরিষাকে বাসায় ফিরিয়ে দিলো ওরা। এটুকু কাজেই পালি কি যে খুশি হলো! একটি প্রাণীকে সামান্য যত্ন করার মাঝেও যে আত্মিক শান্তি আছে তা যেন উপলব্ধি করতে পারল। সে ঘন্টায় ঘন্টায় এসে উঁকি দিয়ে দেখে যাচ্ছে সরিষা ঠিক আছে কিনা। বিকেলে এনামকে দিয়ে গাছ পেরে এনে নিজের হাতে খাওয়াতেও ভুলল না। মনের মাঝে নানান ইচ্ছে চেপে বসেছে। সরিষা উড়বে, গাছের ডালে বসে ডাকবে আরও কত কী! কিন্তু পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পাখিটিকে আর পাওয়া গেল না। সে উড়ে গেছে। পালি সারাদিন অপেক্ষা করল সরিষা কখন বাসায় ফিরবে। কিন্তু সে অপেক্ষার অবসান আর হলো না। সরিষা বাসায় ফিরল না।
হিমাদ বাইরে থেকে ফিরে উঠানে পা রাখতেই প্রায়ান্ধকারে ছাতিম গাছের নিচে পালিকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। এগিয়ে এসে বলল,

“এখানে কী?”

পালি মুখ ঘুরিয়ে তাকালো। কাঁপা গলায় বলল,
“আমার সরিষা বন্ধু উড়ে চলে গেছে, হিমাদ ভাই। আর ফেরেনি।”

হিমাদ অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে বিষন্ন সন্ধ্যায় অভিমান ভাসিয়ে মেয়েটা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছে। আসলে সেই অবুজ কান্নায় বুঝি মিশে আছে ক্ষণিকের বন্ধুটির জন্য অব্যক্ত মায়া! হিমাদ কী বলবে ভেবে পেল না। একটা কুড়িয়ে পাওয়া পাখির জন্য এত কান্না! কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“সুস্থ হয়েছে তাই চলে গেছে।”

“কিন্তু বাসায় কেন ফিরল না? এখানেই তো সরিষার বাসা।”

“তোদের বানিয়ে দেওয়া বাসা হয়তো সরিষার পছন্দ হয়নি। অন্য কোথাও বাসা বানাবে। এখানে দাঁড়িয়ে কাঁদলে তো আর ফিরবে না।”

“তাহলে কী করব?”

হিমাদ বিরক্ত হয়ে ধমক দিলো,
“ঘরে গিয়ে রাতভরে কাঁদ।”

পালিকে বন্ধুর আশা ছেড়ে ঘরে ফিরতে হলো। পড়াতেও মন বসল না। মেহেরুন বানুর গা গরম বিকেল থেকেই। মুখের স্বাদ তেতো হয়ে গেছে। জ্বর আসছে টের পেয়ে তিনি না খেয়ে, আগেভাগেই শুয়ে পড়লেন। পালিকে ডেকে বললেন,
“গিয়া মামার লগে বইয়া খাইয়া ওঠ।”

পালি মামার সঙ্গে বসে খেলো না। সবার খাওয়া শেষে সে খেতে গেল। চামেলিও আজ বেড়ে দেওয়ার জন্য নেই। সে বিকেলে বোনের বাড়ি গিয়েছে। রাতে থেকে আসবে। পালি নিজেই থালায় ভাত বেড়ে নিল। তরকারির ঢাকনা উঠিয়ে দেখল ঘন ডাল এবং শুটকি দিয়ে বেগুনের তরকারি রয়েছে। অথচ সন্ধ্যায় ইলিশ ভাজার ঘ্রাণ তার নাকে এসেছিল। পালির অবশ্য মন খারাপ হলো না। এই তরকারিই বা কম কিসে! সে নিরবে খেয়ে উঠে নিজের থালা ধুয়ে সাজিয়ে রেখে গেল। এটুকু সে করে মামীর তীরের মতো দৃষ্টিতে নমনীয়তা দেখার আশায়। কখনো দেখা পায় আবার কখনো হারিয়ে যায়।
____________

সেতারা বিবি আজ সকাল সকাল বৃষ্টি মাথায় খন্দকার বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে। মেহেরুন বানুর ঘরে পালঙ্কে পা ভাজ করে বসে বললেন,
“সেতারা বিবি কুনুদিন খারাপ বিয়ার ঘর আনে নাই। আমি আগেই কইছিলাম চিত্রার লইগ্যা মোক্তার বাড়ির ছেড়াই উপযুক্ত। তহন পাত্তা দিলা না। শেষে তো হেনোই ঠিক হইলো।”

মেহেরুন বানু পান এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“কপালে আছিলো। আমরা ঠেকানের ক্যাডা?”

“সে যাই কও আর তাই কও, প্রস্তাব পরথম আমিই আনছি। কাম তোমরা নিজেরা সাড়লেও হিসাবে ঘটক তো আমিই হইলাম না কি?”

মেহেরুন বানু ভ্রু কুচকে সেতারা বিবির পরের কথাটা কী হতে চলেছে ঠাহর করতে করতেই তিনি বলে উঠলেন,
“এইবার কিন্তু রূপা টুপা, টেকাটুকা নিমু না। নাতনি তোমার একখান-ই। আমিও বা আর কয়দিন বাঁচমু! ম’রার আগে স্বর্ণের হার পিনবার চাই।”

মেহেরুন বানু চমকে চোখ বড়ো করে তাকালেন। চিত্রা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। সেতারা বিবির কথা শুনে বলল,
“সোনার হারের বদলে বরং জায়নামাজ, তসবিহ চাইতেন। কখন আবার ম’রে যান! তখন সেই হার তো কাজে আসবে না। আমল থাকলে কাজে লাগবে।”

মেহেরুন বানু চোখ গরম করলেন। বললেন, “তরে কইছি না সবার লগে মজা করবি না? ঘরে যা।”

চিত্রা কপাল কুচকে চলে গেল। মেহেরুন বানু কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। সেতারা বিবিকে চটালে সে গিয়ে মোক্তার বাড়িতে মেয়ের নামে খারাপ কথা ছড়াতে পারে। যা শ্বশুর বাড়িতে চিত্রার ভাবমূর্তি নষ্ট করে আসন্ন ভবিষ্যতে প্রভাব ফেলতেও পারে। সেই আশঙ্কায় তিনি সরাসরি মানা করতে পারলেন না। সেতারা বিবি নিজেও তা জানেন বলেই সুযোগটা নিয়েছেন। আর্থিক অবস্থা বুঝে এমনটা তিনি প্রত্যেকের সাথেই কমবেশি করেন। অনেক গাইগুই করে উপায়ান্তর না পেয়ে অবশেষে চার আনার একটি চেইন বুঝিয়ে দিয়ে তাকে ঘর থেকে বের করা গেল। সেতারা বিবি মনে মনে তাতেই ভীষণ খুশি। তিনি জানতেন বড়ো কিছুই চাইলে ছোটো হলেও একটু সোনা পাওয়া যাবে এবং একইভাবে সে মোক্তার গিন্নির কাছে সোনার বালার আবদার করে এসেছে। কিন্তু সেই সোনার চেইন দেওয়ার জ্বলুনিতে জুলেখা সারাটিদিন সেতারা বিবিকে মনে মনে গা’লমন্দ করে গেল।
________

গায়ে হলুদের আগের দিন হুট করে সাম্য এসে হাজির হলো খন্দকার বাড়িতে। সে পাঞ্জাবি-পাজামা পরে একেবারে নতুন জামাই সেজে এসেছে। মেহেরুন বানুকে দেখে লম্বা সালাম দিয়ে বলল,
“দেখলেন দাদি, সেদিন আমাকে বাইরে থেকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আজ একদম বাড়িতে ঢুকে গেছি।”

সাম্যের চোখে-মুখে বিজয়ের হাসি। মেহেরুন বানু তাকে ঘরে নিয়ে বসালো। জুলেখা ছুটেছে রান্নাঘরে, আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে। সাম্য পালিকে ঘুরঘুর করতে দেখে কাছে ডাকল। ওর চোখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল,
“বাহ! ছোটো বুবুর চোখদুটো তো বেশ সুন্দর।”

পালি মাথা নিচু করে ফেলল। এই প্রথম কেউ সরাসরি তার চোখের প্রশংসা করল। ভীষণ লজ্জা লাগছে তার। সাম্য ওর লজ্জা দেখে হেসে বলল,
“ছোটো বুবু কী এখন শালিকা ডাকলে রাগ করবে?”

পালি ডানে-বামে মাথা দোলালো।
“না, আপনি তো বুবুর বর হবেন।”

“বুবুর বর পছন্দ হয়েছে?”

পালি কী ভেবে বলল,
“বুবুর পছন্দ হলে আমারও পছন্দ।”

সাম্য ঠোঁট উলটে বলে, “বেশ জটিল উত্তর। তোমার বুবুর মনের খবর কী করে পাই বলোতো?”
এরপর এদিক ওদিক নজর বুলিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“বুবুকে একবার ডেকে দাও না।”

চিত্রার এলো অলস পায়ে, কিছুটা আড়ষ্টতাও রয়েছে। সাম্য তাকে দেখেই তরাক করে উঠে দাঁড়ালো। পালি ততক্ষণে ছুটে চলে গেছে। এদিকে আপাতত কেউ নেই। সাম্য স্মিত সুরে বলল,
“অবশেষে চিত্রা নামের পাথর মনের মেয়েটা আমার হতে চলেছে।”

চিত্রা অনুভূতিহীন চোখে তাকাল। শূন্য কন্ঠে বলল,
“ওজন সইতে পারবেন?”

“পারব। ভালোবেসে ফেলেছি যে।”

“আমি আপনাকে ভালবাসি না।”

“কারণ তুমি এখনও আমায় আপন করতে মনস্থির করোনি। আমিই একটু দ্রুত ভালোবেসে ফেলেছি। অধৈর্যবান কিনা! তুমি নাহয় বিয়ের পর বাসবে। আমি অপেক্ষা করব।”

“আপনার অপেক্ষা যদি না ফুরায়?”

“অনন্তকাল তোমার প্রণয় ভিখারি হয়ে থাকব।”

চলবে…

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [২৪]
প্রভা আফরিন
_

আজ প্রথমবার পালি শাড়ি পরেছে। বাসন্তী রঙের জড়ি সুতোর কাজ করা শাড়িটা পালিকে কুচি তুলে পরিয়ে দিয়েছেন মেহেরুন বানু। সেই সঙ্গে গলায় লম্বা পুঁতির মালা। দু’হাতে ভর্তি কাচের লাল চুড়ি। একজোড়া কানের দুলও কেনা হয়েছে তার জন্য, কিন্তু পালির কান শুকানোর বদলে পেকে যাওয়ায় এখন কানে দুটি চিকন শলার কাঠি ছাড়া কিছুই রাখা যাচ্ছে না। এ নিয়ে অবশ্য পালির ভীষণ মন খারাপ। সুন্দর দুল জোড়া সে নিজে পছন্দ করে লেস ফিতাওয়ালার থেকে কিনেছিল। পালির আরও ইচ্ছে ছিল খোপা করে বুবুর মতো ফুলের মালা জড়াবে তাতে। কিন্তু পেকে যাওয়া, ফুলে ওঠা কানের লতি দেখিয়ে ঘুরতে সংকোচ বোধ করল সে। তাই একপাশে সিঁথি কে’টে চুল খোলা রেখেছে যেন কান ঢেকে থাকে। এরপর ধীরপায়ে ঘর ছেড়ে বের হলো।

আজ চিত্রা বুবুর গায়ে হলুদ। খন্দকার বাড়ি লোকে লোকারণ্য হয়ে আছে। এই বাড়ির নিত্য মানুষগুলো ছাড়া আর কাউকেই চেনে না পালি। কার কাছে যাবে, কোথায় বসবে ভাবতে ভাবতে উঠান থেকে রবিউল খন্দকার গলা উঁচিয়ে তাকে ডাকলেন। পালি ছুটে যেতেই হাত ধরে বললেন,

“আমার আম্মাডারে আইজ কত্ত সুন্দর লাগতাছে! কেডা সাজায় দিছে?”
“নানি।”

রবিউল খন্দকার পালির পা খালি দেখে মেহেরুন বানুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“আম্মা, ওরে না একজোড়া নূপুর গড়াইয়া দিতে কইছিলাম?”

“গড়াইতে দিছি। চিত্রার বিয়ার গয়না পালিশ কইরা স্বর্ণকারে বিকালে একলগে দিয়া যাইব।”

রবিউল খন্দকার মাথা দুলিয়ে পালির চুল ঠিক করে দিয়ে বললেন,
“বাড়ির ভিতরেই ঘুরাঘুরি করিস। দূরে যাওনের দরকার নাই।”
“আচ্ছা।”

পালি চলে গেল পুকুরপাড়ে। হলুদের আয়োজন এখানেই হচ্ছে। বাধানো ঘাট রঙ করে তাতে আলপনা আঁকা হয়েছে। ওপরে রঙিন, ঝুলওয়ালা শামিয়ানা টানানো হয়েছে। পেলব রোদ্দুরমাখা ঝলমলে দিনে চারপাশ রঙিন হয়ে উঠেছে। পালি সেখানেই দেখা পেল নিলয়ের। চেয়ারম্যান বাড়ির সকলেই সকাল সকাল উপস্থিত হয়েছে এ বাড়িতে। নিলয় পালিকে দেখে অবাক হয়ে বলল,

“আরেহ! তোরে দেখি চেনাই যায় না। আমার থেকেও বড়ো লাগতেছে।”

“মেয়েরা একটু জলদিই বড়ো হয়। নানি কইছে।”

“কেন? মেয়েদের বেলায় দশমাসে বছর হয় না কি যে জলদি বড়ো হবি?”

“তা হবে কেন?”

“তাহলে আমার সমান হয়ে তুই জলদি বড়ো হবি কেন?”

“তাইতো!”

পালির মনেও প্রশ্ন এলো। পুকুরপাড়ে হলুদ বাটা হচ্ছে। মেহেরুন বানু সেখানেই ছিলেন। পালি কাছে গিয়ে বলল,
“নানি, বুবুর আগে হিমাদ ভাইয়ের বিয়ে দিলে না কেন?”

“হিমাদের বিয়ার বয়স হইছে নাকি যে দিমু? তার বিয়ার এহনো মেলা দেরি।”

“তাহলে বুবুর বয়স কী করে হলো? বুবু তো হিমাদ ভাইয়ের ছোটো।”

মেহেরুন বানু পালির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। মেয়েটা ইদানীং বড্ড বেশি প্রশ্ন করে। বললেন,
“অতকিছু জাইনা কাজ নাই। বয়স হইলে সব আপনে আপনেই জানতে পারবি।”

পাশ থেকে চামেলি বলে উঠল,
“বেডা মানুষের বুড়া হইলেও দশখান বিয়া করতে পারে। আর আবিয়াইত্তা ছেড়ির বয়স বিশ পার হইলেই তারে বুড়ি কয় হগলে। হেইখানে একের বেশি দুই বিয়া হইলে হেই ছেড়ির চরিত্র নিয়া কথা ওঠে। পুরুষে আর মহিলায় মেলা তফাৎ।”

“এমন কেন?”

মেহেরুন বানু বিরক্তি হয়ে বললেন,
“যা বুঝবি না তা নিয়া আজা’ইরা বকবক করবি না। এহন যা এনতে। দুরুস্তমতো কাম করতে দে।”

পালির কৌতুহল না মিটলেও সে কথাগুলো ভুলে দ্রুতই নিলয়ের সাথে মেতে উঠল। আজ সোনি আসেনি। সোনি সেদিনের পর আর বাড়ি থেকেও বের হয় না খুব একটা। আগের মতো দাপটের সঙ্গে কথাও বলে না। একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা মুহূর্তেই তার শৈশব ম্লান করে দিয়েছে। আজীবনের মতো একটি নোংরা স্মৃতি গেঁ’থে দিয়েছে অন্তরে। সোনির পাশে পালির পরিবারের মতো আগলে নেওয়ার কেউ নেই। সব ভুলে নতুন উদ্যমে পরের দিনটা শুরু করার স্পৃহা জাগানোর মতো কেউ নেই। বরং সোনির মা সুযোগ পেলেই মেয়েকে পাত্রস্থ করবে। পাছে গোপন কথাটা জানাজানি হয়ে যায়! মেয়ের নাম রটে যায়! মেয়ের বিয়ে কী করে দেবে তখন? বড়ো মেয়ের সংসারও টিকবে না। সমাজ, সংসারের অসহায়তার মাঝে চাপা পড়ে যাবে সোনি বাল্যকালের দুরন্তপনা, কৈশোরে কলতান। কে জানে, সকলের অগোচরে কত সোনি এভাবেই ম্লান হয়ে যায়?

পালি বুবুর ঘরে যাওয়ার জন্য কুচি আগলে ছুট লাগালো ঘরের দিকে। হিমাদ সবেই সদর দরজার দিয়ে বের হচ্ছিলো। পালি বাইরে থেকে খেয়াল না করায় হিমাদের পায়ে পারা দিয়েই ছিটকে সরে গেল। হিমাদ দাতে দাত চেপে ধমক দিয়ে বলল,
“বেয়া’দব মেয়ে, চোখ কী আকাশে তুলে হাটার জন্য?”

পালি চুপসে গিয়ে অ’প’রাধীর মতো দাঁড়িয়ে রইল। এনাম দৌড়ে এসে পালিকে ভেতরের দিকে ঠেলে সরিয়ে বলল,
“ছুডু মানুষ, ভুল কইরা ফালাইছে। আজকের দিনে আর বইকো না।”

পালি তড়িঘড়ি করে ভেতরে চলে গেল। ব’কা খেয়ে অবশ্য ওর মন খারাপ হলো না। তার মনে হচ্ছে মামীর কাছে কঠিন ব’কা খেলেও আজ মন খারাপ হবে না। কিছু কিছু দিন এমনিতেই মন ভালো থাকে। আর আজ তেমনই একটা দিন।

কাচা হলুদ রঙের শাড়িতে চিত্রার গায়ের রঙ সোনার মতো উজ্জ্বল হয়ে ফুটে আছে। তাতে শোভাবর্ধন করেছে গোলাপ, গাধা ও গাজরা ফুলের গয়না। যে দেখছে তারই মুখ থেকে দু-চারটে প্রশংসামূলক বাক্য বের হয়ে আসছে। চিত্রা নিস্তরঙ্গ নদীর মতো শান্ত। মুখশ্রীতে নেই কোনো বেদনার ছাপ কিংবা উচ্ছাস। মাঝে মাঝে দুষ্টু মেয়েদের কথায় সামান্য লাজুকতা খেলে যায় সাময়িক সময়ের জন্য। সূর্য যখন অলস হয়ে পশ্চিমে মাথা হেলিয়ে দিলো তখন চিত্রার গায়ে হলুদ শুরু হলো। আলপনা আঁকা ঘাট হলুদের ছোঁয়ায় ভেসে গেল। আনুষ্ঠানিক হলুদ ছোয়া শেষ হলো সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই। এরপর গ্রামবাসীর ভোজ হলো মহাসমারোহে।

পরদিন বিয়ের গোসলের আগে চিত্রার আরও একবার গায়ে হলুদ করা হলো। দুপুর নাগাদ বড়ো একখানা ট্রলার এসে থামলো শালুগঞ্জের ঘাটে। তাতে প্রথম দফার বরযাত্রীর সঙ্গে কনের বেনারসি, গহনা নিয়ে এসেছে সাম্যের বড়ো দুইবোন হাসনা ও হেনা। পরের ট্রলারে এলো বর। পরিবেশ গমগমে হয়ে গেল মুহূর্তেই। মেহেরুন বানু পালিকে ডেকে বললেন,
“এত মাইনষের মাঝে থাকনের দরকার নাই। বুবুর লগে গিয়া বইয়া থাক।”

পালি ছুটে এসে চিত্রার পাশে বসে। চিত্রার গায়ে ভারী শাড়ি ও গহনা। নববধূ রূপে তাকে একদমই অন্যরকম লাগছে। যেন একটি কিশোরী হুট করে যুবতী হয়ে গেছে। পালি মন খারাপ করে বলল,
“বুবু, তুমি আজ একেবারে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।”

“বোকা মেয়ে, মন খারাপ করিস না। একেবারে চলে যাচ্ছি না। তবে আজকের পর এই বাড়ির মেহমান হয়ে যাব।”

পালির চোখ ছলছল করে উঠল,
“আমার তোমাকে খুব মনে পড়বে, বুবু। তোমার হাসিটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করবে।”

“তুই কিন্তু কাঁদবি না বলে দিলাম। মায়ের কথা গায়ে মাখবি না কখনো। ফুপির মতো তেজি হতে শেখ। বিয়ের পিড়িতে বসেও যেন পাত্র বদলের ক্ষমতা থাকে।”

শেষ কথাটা কেমন জড়িয়ে এলো তার। পালির কান অবধি তা পৌঁছালো অস্পষ্ট রূপে। চিত্রার স্থির মুখাবয়ব ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে। পালি বলল,
“বুবু তুমি কাঁদছো?”

“আর কাঁদব নারে। আজকের পর চোখের জল ফেলার জন্য কেউ রইলো না আমার। কেউ না। চিত্রা ফুল আজ চিরতরে ঝরে যাবে। আজকের পর যে থাকবে সে শুধুই চিত্রা।”

চিত্রা নিঃশব্দে নিংড়ে দেয় সবটুকু আক্ষেপ। মনের জমানো শেষ আবেগ। কবুল বলার সঙ্গে সঙ্গে একটি কিশোরীর প্রথম আবেগের ব্যাকুলতায় গড়া উষ্ণতম অপেক্ষার মৃ’ত্যু ঘটল।

চলবে..