বিষাদনীড়ে মায়াতরী পর্ব-১৯+২০+২১

0
139

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [১৯]
প্রভা আফরিন
_

খন্দকার বাড়ির পেছনে সারি সারি মেহগনি গাছ মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির পেছনের অংশে বিস্তৃত ভুমিতে কোনোরূপ চাষবাস না হওয়ায় রবিউল খন্দকার জমি ফেলে না রেখে এক একর জমিতে চির সবুজ মেহগনি গাছ লাগিয়ে ছিলেন। ফেলে রাখা জমিতে বিনাপরিশ্রমে দীর্ঘমেয়াদি এ চাষের ফলাফল লাভজনক বৈ অলাভজনক হলো না। এতদিন ছায়া-বাতাস দিয়ে বড়ো হওয়া গাছগুলো এখন পরিপক্ক এবং বিক্রির জন্য প্রস্তুত। গাছ কা’টাও শুরু হয়ে গেছে। সকাল থেকেই ঠুকঠাক শব্দ ভেসে আসছে পেছন থেকে। অনেকক্ষণ পর পর লোকেদের হৈ হৈ আওয়াজ ভেসে আসছে। বাচ্চারা ছুটে গিয়ে নিরাপদ দূরত্ব থেকে দেখছে মূর্তিমান দানবের মতো গাছগুলো পরিবেশ কাঁপিয়ে, পাখিদের উড়িয়ে মাটিতে শায়িত হচ্ছে। উচ্ছ্বসিত বাচ্চাদের সেই দলে নেই পালির উপস্থিতি। এমনকি বাড়ির ছাদেও সে নেই। এনাম লাকড়ি বানানোর জন্য কিছু ডাল আলাদা করে আনিয়ে উঠানে রোদে শুকাতে দিয়ে বলল,

“চাচি, পালি কই? পোলাপাইন সব ওইহানে ঘুরঘুর করতাছে কিন্তু ওরে তো একবারও চুপি দিতে দেখলাম না। ইস্কুলে গেছে?”

“না, ঘরেই আছে।” মেহেরুন বানুর জবাব।

“বাইর হইলো না যে? শইল খারাপনি?”

মেহেরুন বানু জবাব দিলেন না। দুদিন যাবত পালি একদমই চুপ হয়ে গেছে। স্বাভাবিক আচরণও নিস্তব্ধতায় নিমজ্জিত। কারো সঙ্গে কথা বলছে না। চিত্রার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে না। টিভির ঘরেও দেখা যাচ্ছে না। নিজেকে নিজের ভেতর গুটিয়ে নিয়েছে। হুট করে কেউ ডাকলে চমকে উঠছে। তার এমন আচরণের কারণ মেহেরুন বানু ধরতে পারছেন না। অসুস্থতার লক্ষণ কিংবা জুলেখা কিছু বলেছে কিনা সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেও হতাশ। মেহেরুন বানু রান্নাঘরে গেলেন। দুপুরের রান্না প্রায় শেষ হতে চলল। চামেলিকে ভাত রাধতে বসিয়ে জুলেখা গেছে গোসল করতে। মেহেরুন বানুকে দেখে চামেলি বলল,

“এই গরমে চুলার ধারে ক্যান আইছেন, বড়োমা? সালুন রান্ধা হইয়া গেছে। খালি ভাতটা হইব। আপনে বাতাসে গিয়া বহেন।”

মেহেরুন বানু জিজ্ঞেস করলেন,
“সত্য কইরা ক তো চামেলি, জুলেখায় কী আমার আড়ালে পালিরে কিছু কইছে? মা’রছে?”

“নাতো। আমার সামনে দেহি নাই। আড়ালে হইলে জানি না।”

মেহেরুন বানুর ঢিলে চামড়ায় দুশ্চিন্তার ভাজ পড়ল। এতদিনে মেয়েটাকে যতটুকু চিনেছে প্রতিবাদ করতে না জানলেও আত্মসম্মানবোধ মায়ের মতোই প্রবল। ক’টুকথা শুনলে নালিশও করবে না আবার ভুলতেও পারবে না। পালির সমুদ্রের মতো গভীর চোখদুটো দেখলে মেহেরুন বানু হঠাৎ হঠাৎ চমকে ওঠেন। এইটুকু বয়সে মেয়েটার দৃষ্টিতে গহীনতার বাস। যেন কোনো অশান্ত সমুদ্রের উত্তাল জলরাশির ঝাপটা সয়ে একটি নির্জন দ্বীপ নিভৃতে গড়ে উঠছে। সেখানে নেই সমবয়সী বাচ্চাদের মতো চঞ্চলতা, অবাদ্ধতা কিংবা অপ্রতিরোধ্য কৌতুহল। ধীরস্থির চলনে সবসময় সাবধানতা। মেহেরুন বানুর মনে হলো তিনি মেয়েটাকে যতটা শান্ত দেখতে পছন্দ করেন আসলে ততটা থাকা উচিৎ না। মনের ভেতর আগ্নেয়গিরি বিস্ফো’রণ ঘটালেও বাইরে তা বোঝা যায় না। এমন মানুষের মনের তল পাওয়া কঠিন। কিন্তু তিনি যে পালিকে হাতেল তালুর মতো চিনতে চান, আগলে রাখতে চান সকল খারাপ দিক থেকে। তার মেয়ের রেখে যাওয়া একমাত্র আমানত, পৃথিবীর বুকে তার একমাত্র অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ওনার এলোমেলো ভাবনার মাঝে চামেলি আবার বলল,
“ক্যান বড়োমা? কিছু হইছে?”

“ছেড়িডা দুইদিন ধইরা কিরকম ফাঁপড়ে পড়ছে। ভালোমতো কথাবার্তা কয় না। কেউ কিছু কইল নাকি মা’রল বুঝতাছি না।”

“আমাগো সোনিরও তো দুইদিন ধইরা শইল কাঁপাইয়া জ্বর। খালি আবলতাবল ব’কতাছে।”

“দুইদিন ধইরা?” মেহেরুন বানুর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো।

চামেলি চুলার জ্বাল কমিয়ে গুরুতর ভঙ্গিতে বলল,
“হ। আঁতকা এমন কালা জ্বর বাধাইয়া যে এক্কেরে বিছনায় পড়ছে। মাঠে-ঘাটে ঘুইরা বেড়ায়, কোনোকিছু দেইক্ষা ডরাইলো নাকি! হেরলইগ্যা কবিরাজ দিয়া ঝাড়ফুঁক দিল, টোটকা দিল, কাম তো হইতাছে না।”

মেহেরুন বানু আরকিছু বললেন না। তবে কিছু একটা ঘটেছে এবং তা বাড়ির বাইরে তা নিয়ে আর সন্দেহও রইল না। পালির থেকেই সবটা জানতে হবে। তবে দুঃখজনক হলো পালি তার নানিকে ভয় পায়। মেহেরুন বানুর ইদানীং ভীষণ আফসোস হয় নিজের এই গাম্ভীর্যপূর্ণ স্বভাবের জন্য। এই গাম্ভীর্যের জন্যই কিনা তিনি কোনোদিন প্রিয় স্ত্রী, প্রিয় পুত্রবধূ, প্রিয় মা, প্রিয় দাদি কিংবা প্রিয় নানি হতে পারল না। তিনি গেলেন চিত্রার ঘরে।

চিত্রা আলস্য আকড়ে জানালা ঘেঁষে বসে ছিল। ইদানীং তার কাজ ওই একটাই, আলস্য আকড়ে বসে থাকা। দাদিকে দেখে সোজা হয়ে বসল। মেহেরুন বানু বললেন,
“সারাদিন এক জায়গায় বইয়া থাকোস ক্যান? একটু হাটতে পারোছ না? গায়ে আলো-বাতাস না লাগাইলে শইল ভালা থাকব?”

চিত্রা মাথা দুলিয়ে হালকা হাসল। বলল,
“আলো-বাতাস, রোদ-বৃষ্টি, আগুন সব লাগানোর ব্যবস্থা তো করতেছোই। বিয়ের পর তো কেউ আমায় ঘরে পুতুল বানিয়ে রাখবে না। তাই আগেই বিশ্রাম করে নিচ্ছি।”

মেহেরুন বানু নিরবে তাকিয়ে রইলেন। বলতে চাইলেন, “বিশ্রাম নষ্ট করার কাম কী তুই ঘটাস নাই? আমাগো থাইকা একটা বাইরের ছেড়ারে কী বেশি বিশ্বাস করোছ নাই? ওই ছেড়া যদি ভালো মানুষ না হইত তাইলে? একটা সন্তানরে রক্ত পানি কইরা, আদর, আহ্লাদ দিয়া বড়ো কইরা অনিশ্চিত জীবনে কেডা পাঠাইবো?”
তবে এসব বলা যাবে না। দাদি-নাতনির যুক্তি ও আবেগের দ্বন্দ্বে তিনিই দোষী হবেন। মুখে বললেন,
“এই দিনই দিন না। সামনে পুরা জীবন পইড়া রইছে। কেডা ভালা, কেডা মন্দ সবই বুঝবি।”

একটু থেমে কথা ঘুরিয়ে বললেন,
“যা কইতে আইছিলাম। ইট্টু পালির ধারে গিয়া ব। তর লগে তো ভালোই মিল। জানার চেষ্টা কর কী হইছে তার।”

চিত্রার টনক নড়ল। আসলেই তো! দুদিন যাবত মেয়েটা তার কাছে ঘুরঘুর করছে না। হাসতে অনুরোধ করছে না। নিজের বিষাদে চিত্রা এতটাই ডুবে আছে যে তা খেয়ালও করেনি। সে গেল পালির কাছে। সিড়ির একদম ওপরের ধাপে বসে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে পালি। মুখে নেই কোনো অনুভুতির ছাপ। চিত্রা তার পাশে বসে একহাতে জড়িয়ে ধরতেই পালি কেঁপে উঠে হাতের বন্ধন মুক্ত করে সরে গেল। যেন ছোঁয়া তার অসহ্য লাগছে। চিত্রা অবাক হলো। তবে প্রতিক্রিয়া চেপে বলল,

“আমের রানির মন খারাপ?”

পালি ডানে বামে মাথা নাড়ল।
“তবে এখানে একা একা বসে আছিস কেন?”

“জানি না।”

“আচ্ছা, জানা লাগবে না। কখন থেকে মন খারাপ সেটা মনে আছে?”

পালি টলটলে চোখদুটি তুলে তাকায়। আদ্র গলায় বলে,
“সেই চর থেকে… যখন মা ছিল।”

পালি চিত্রাকে দুহাতে জাপটে ধরে কেঁদে ফেলল। ভয়ার্ত, ঘর্মাক্ত, ছোটো দেহটি কেঁপে উঠছে প্রতিটি নিশ্বাসের সাথে। চিত্রার কোমল আদরের আশ্বাসে ফিরে এল সোলেমানের কথা, ফিরে এল সোনির জীবনের নোংরা সেই দুপুরটা। চিত্রার চোখে পানি চলে এল। এই ছোটো মেয়েটিকে সে যতটা সহজ ভেবেছিল তার জীবনটা ততটাই বেদনাতুর। মেহেরুন বানুও সব শুনলেন। সেদিন সারাটা সময় পালিকে বুকে আগলে বসে রইলেন। সাহস দিলেন, ভরসা দিলেন। তিনি জানে মেয়েটা তরল। এই ভয়ানক স্মৃতি সে মুছে ফেলতে পারবে না। তবে একটু আদর পেলে, ভরসা পেলে বুকে চেপে রাখা ভয়টা কাটিয়ে উঠবে।

মেহেরুন বানু সেদিনই রাতের বেলা চামেলিকে দিয়ে সোনির মাকে ডাকিয়ে এনে সবটা জানালেন। সব শুনে সোনির মা বুক চাপড়ে কাঁদলেন। সম্মান হারানোর কান্না। তবে সে কান্নার শব্দ চার দেয়ালের বাইরে গেল না। মেহেরুন বানু এও জানালেন হাশেম দোকানীকে জনসম্মুখে সালিশ বসিয়ে কঠোর বিচারের ব্যবস্থা করা হবে। সোনির মা এ কথা শুনে মেহেরুন বানুর পা চেপে ধরল।

“আম্মা, এমুন কাম কইরেন না, আম্মা। আপনের পায়ে ধরি।”

মেহেরুন বানু বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে বললেন,
“তুমি বিচার চাও না?”

“আমরা গরীব মানুষ। বদনাম হইলে আমার সোনিরে কেউ বিয়া নিব না।”

“তাই বইল্যা দোষীরে ছাইড়া দিয়া ছেড়ির লগে অন্যা’য় করবা?”

“এই সমাজের মানুষ কিরকম তা কী বোঝেন না? আমার ছেড়িরে কেউ শান্তি দিব না। আমার বড়ো ছেড়িডার সংসার এমনেই ভাঙাচুরা। চাইরমাস হইলো পোয়াতি হইছে। এহন এডি জানলে জামাই ছেড়িরে ত্যাগ দিতে দুইবার চিন্তা করব না। দুই দুইখান ছেড়ি লইয়া কই যামু আমরা? ডুইবা ম’রা ছাড়া যে উপায় থাকব না।”

মেহেরুন বানুর দেহে আগুন জ্ব’লছে। তবে সোনির মায়ের কথা তিনি বুঝছেন। একবার দাগ লাগা মেয়েকে কেউ সোজা চোখে দেখবে না। চামেলি তাল মিলিয়ে বলল,
“হ বড়োমা, আপনে সালিশ বহাইয়েন না। ছুডুডার কপাল তো পু’ড়বই বড়োডারও কপাল পু’ড়ব।”

মেহেরুন বানু বললেন,
“সোনিডা যে সারাজীবন পু’ড়ব।”

“হোক। বড়ো হইতে হইতে ভুইলা যাইব। ওরে চাচার বাড়ি পাঠাইয়া দিমু।”

“তোমার ধারে রাইখা বিপদ ঠেকাইতে পারলা না। চাচার বাড়ি থাকলে এরচেয়ে বেশি কিছু হইব না তার কোনো নিশ্চয়তা আছে?”

সোনির মা কিংবা চামেলি কোনো উত্তর দিতে পারল না। মেহেরুন বানুও সালিশ বসালেন না। চিত্রা এসব মানতে পারল না। সে এনাম চাচাকে ডেকে সংক্ষেপে সব জানাল। এরপর ভেজা গলায় জিজ্ঞেস করল,

“চাচা, আপনার মেয়ের সাথে কেউ এমন করলে কী করতেন? সমাজের কথা ভেবে চুপ থাকতেন?”

“ঠোঁট চুপ থাকত, তয় হাত না।”

“সে আমাদের পালির দিকেও নোংরা চোখে তাকিয়েছে। নোংরা হাতে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছে। না জানি আরও কত বাচ্চার সঙ্গে এমন করেছে!”

পরদিন শেষরাতে হাশেম দোকানীকে মা’রাত্মক আহ’ত অবস্থায় পাওয়া গেল দোকানের ভেতর। ধারণা করা হলো দোকানে ডাকাত পড়েছিল। হাশেম দোকানী ইদানীং টাকা-পয়সায় বেশ ফুলে-ফেঁপে উঠছিল। তারা হয়তো খবর পেয়ে টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নিয়ে দোকানীর এই হাল করে গেছে। সেই সঙ্গে তার দুটি হাত ইহজনমের মতো বিকল করে দিয়ে গেছে।”

_______________

সাম্য সপ্তাহ দুই বাদে আবারও পা রাখল শালুগঞ্জে। লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা পাওয়ার চেষ্টা করল সেই রাগী মেয়েটির। দেখা হলো। ভাগ্যের সু-প্রসন্নতায় কথাও হলো। দুপুরের পর বাড়ির সামনের মোটা কাঁঠাল গাছটায় পালিকে দোলনা বেধে দিচ্ছিল সে। হুট করেই সেখানে আগমন ঘটে সাম্যের। চিত্রা তাকে দেখা মাত্রই কেঁপে ওঠে। লোকটার কত বড়ো সাহস! বাড়ির সামনে চলে এসেছে! সাম্য শুধু ইশারা করল একটু কথা বলতে। নয়ত সে জায়গা থেকে নড়বে না। একই সঙ্গে ভয়, রাগ, জেদ নিয়ে চিত্রা বলল,

“আপনার উদ্দেশ্য কী বলুন তো? আবার কেন এসেছেন? আমাকে বদনাম করার ষ’ড়’যন্ত্র করছেন?”

সাম্য স্বভাবসুলভ হেসে বলল,
“উহু, আপনার রাগী, পাথর হৃদয়ে ভালোবাসার ফুল ফোঁটাতে চাইছি।”

চিত্রা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে উঠল,
“ভালোবাসা পাথরের বুকে ফুল ফোটায়। কিন্তু ফুল একবার পাথরে রূপান্তর হলে তাকে কী আর বদলানো যায়?”

চলবে…

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [২০]
প্রভা আফরিন
_
নিবাসপুর

সকাল সকাল দহলিজ ঘরে সভা বসেছে। কোথা থেকে এক সম্মানিত ব্যক্তি এসেছে, এখন তার জন্য চা, পান বানিয়ে পাঠাতে হবে। রাজিয়া পাকের ঘরে চায়ের হুকুম দিয়ে এসে পালঙ্কে পা গুটিয়ে বসলেন। তিনি এখন ভীষণ বিরক্ত। দিন নেই রাত নেই দহলিজ ঘরে মানুষ আসবে আর তাদের আপ্যায়নে ছুটতে হয় বাড়ির মেয়ে-বউদের! গজগজ করতে করতে চুনের কৌটা থেকে আঙুল ভরে চুন নিয়ে পানে মাখালেন তিনি। এমন সময় হুট করে ছুটে এল হেনা। পালঙ্কে ধরাম করে বসতেই খেকিয়ে উঠলেন রাজিয়া,

“কইলজার মইদ্য কী বাঘে ধরে? দাপাদাপি করোছ ক্যান?”

“মা, সাম্য ব্যাগ গুছাইতাছে। আজকেই নাকি চইলা যাইব।”

রাজিয়া উদ্বিগ্নতার সাথে কিছু বলার আগেই নাজনীনের আগমন ঘটল ঘরে। বড়ো জা’কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“দেখলেন ভাবী, খন্দকার গুষ্টির নাম এই বাড়িতে ঢুকতেই ছেলে আপনাকে মান্য করা ছেড়েছে। ওই বাড়ির মেয়ে ঘরে ঢুকালে কী হবে চিন্তা করেন?”

রাজিয়া বললেন,
“ঘরে ঢুকাইতাছে কেডা?”

“কে না! দহলিজ ঘরে কে আসছে জানেন?”

“কেডা?”

“শালুগঞ্জের চেয়ারম্যান। শুনেছি তিনি খন্দকারদের কাছের মানুষ।”

রাজিয়ার মুখের পেশি শক্ত হলো। নাজনীন আবহাওয়া অনুকূলে দেখে বিনুনি দুলিয়ে, নূপুরের ঝংকার তুলে কাছে এসে বসল। হেনাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“পাকের ঘরে যাও তো হেনা, চা হয়েছে কিনা দেখো।”

ছোট কাকির নির্দেশে হেনা কপাল কুচকে মায়ের দিকে তাকাল। রাজিয়া কী ভেবে তাকে চলে যেতে ইশারা করলেন। হেনা আড়ালে মুখ ভেংচিয়ে ঘর ছাড়ল। নাজনীন কাছে এসে বলল,
“ভাবী, বড়ো ভাইজান যে ইতিমধ্যে একবার শালুগঞ্জের খন্দকার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে শুনেছেন?”

“কী কও?”

রাজিয়া চমকে উঠলেন। এইতো কয়েকদিন আগে সেতারা বিবি পাত্রীর সন্ধান নিয়ে এল বাড়িতে। সাম্য তখন মায়ের পাশেই বসা। রাজিয়া খন্দকার বাড়ির নাম শোনা মাত্র পাত্রীর প্রতি আগ্রহ হারিয়েছে। অন্যদিকে সাম্য খন্দকারদের নাম শুনেই আগ্রহ দেখিয়েছে। ছোটোবেলায় একবার শুনেছিল সেই বাড়ির এক মেয়ের রূপে এ বাড়ির এক পুরুষ পাগল হয়েছিল। পরে কোনো এক কারণে বিয়েটা আর হয়নি। সেই আগ্রহ থেকেই সাম্য কৌতুক করে বলেছিল,
“বিয়ে হোক বা না হোক, একবার নাহয় দেখেই আসি সেই রূপসীকে। যদি জনম বৃথা হয়!”

রাজিয়া ভাবেননি সাম্য আসলেই চলে যাবে। এসে নির্লজ্জের মতো বাবা চাচাদের বলেছে মেয়েটাকে তার মনে ধরেছে। এরপর থেকে মা-ছেলের মাঝে অসন্তোষ বিরাজ করছে। তিনি বললেন,

“হেই গেরামের চেয়ারম্যান আইছে ক্যান?”

“শুনলাম বড়ো ভাইজান ওনার মারফতেই প্রস্তাব পেশ করেছে।”

নাজনীন যে দহলিজ ঘরে কান পেতেছে বুঝতে অসুবিধা হলো না রাজিয়ার। অন্যকোনো বিষয় হলে তিনি এখন ধমকে উঠতেন। তবে বিষয়টা তার একমাত্র ছেলের। বাড়ির পুরুষরা কোনো বিষয়ে মহিলাদের মতামতকে গ্রাহ্য করে না। ফলে অনেক কিছুই মেয়ে-বউরা জানতে পারে না। যেমন এ বিষয়টাও জানতে পারেনি। রাজিয়া বললেন,
“তারা কী কইছে?”

“মনে হয় সম্মতি দেয়নি। আবার নিষেধও করেনি। ঝুলিয়ে রেখেছে। ভাবী, ওই বাড়ির মেয়ের জন্য আপনার ছোটো দেবরের পাগলামি আপনি তো জানেন। দয়া করে ওদের ছায়া এ বাড়িতে আবার পড়তে দেবেন না।”

দহলিজ ঘরের অতিথি বিদায় নেওয়া মাত্রই রাজিয়ার আগমন ঘটল সেখানে। নাজমুল মোক্তার চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছেন। রাজিয়া অসন্তোষের কন্ঠে বলল,
“আমি পোলা বিয়া করামু না।”

নাজমুল মোক্তারের কপালে সুক্ষ্ম বিরক্তির ভাজ পড়ল। ভারী স্বরে বললেন,
“এতদিন ঘুম হারাম কইরা পোলার বিয়া করাইতে পাগল হইলা, এহন আবার মত ঘুরল যে?”

“আমার পোলার বয়স হয় নাই। তেইশ বৎসর একটা বয়স হইলো? আরও দেরিতে বিয়া করামু।”

“বিয়া করাইবা কইছো, হুনছি। এহন মত বদলাইছো তাও হুনলাম। তয় পোলা যেহেতু আমারও সিদ্ধান্ত আমারই হইব।”

নাজমুল মোক্তারের চাহনি ও কথায় বোঝা গেল স্ত্রীর কথায় ওনার মতামত বদলাবে না। রাজিয়া দহলিজ ঘর থেকে বেরিয়ে দোতলায় উঠে ছেলের ঘরের দিকে গেলেন। দোতলার দক্ষিণমুখী, খোলা বারান্দাযুক্ত কক্ষটা সাম্যের। যার সবটা আধুনিকতা ও আভিজাত্যপূর্ণ। কাঠের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলেন সাম্য বিরসমুখে ব্যাগ গোছাচ্ছে। জানালা গলে সূর্যের আলো এসে পড়েছে তার সৌম্যদীপ্ত গায়ে। সাম্য অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র৷ জেলাশহরে থেকে পড়াশোনা করে। ছেলেকে দূরে রাখতে রাজিয়ার মন একদমই সায় দেয় না। তবুও ছেলের পছন্দ মেনে তাকে দূরে পাঠিয়েছিল। কিন্তু সাম্য ছুটিছাটাতেও বাড়ি আসার নাম নেয় না। পড়াশোনা শেষ করে যদি আর নাই ফেরে! তাই তাকে সংসারী ও বাড়িমুখো করতে রাজিয়া ছেলের বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। সে সিদ্ধান্তই এখন কাল হলো। যে ছেলে বিয়ে করবে না বলে জেদ ধরেছিল সে এখন মায়ের অপছন্দের পাত্রীকেই পছন্দ করে বসেছে। রাজিয়া তাতে দ্বিমত করায় বিয়ে-সংসার ত্যাগ করার ঘোষণা দিয়ে আজ দুপুরের ট্রেনে গ্রাম ছাড়বে সে। রাজিয়া তাকে আটকানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন না। সাম্য তার কাছে এখনও সেই ছোট্টো শিশুটি। আজ জেদ ধরে কাল ভুলে যাওয়া ছেলেটার ছোটোবেলার স্বভাব। কাজেই তার গ্রাম ছাড়াটাই এখন যৌক্তিক বলে মনে হচ্ছে ওনার। সাম্যের আব্বা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সাম্যের মত বদলানো বিশেষ জরুরী।
______________
শালুগঞ্জ

গতকাল চিত্রা ও সাম্যকে কথা বলতে দেখে ফেলেছে মেহেরুন বানু। ওনার জেরার মুখে চিত্রা সব সত্যি কথাই বলেছে। ছেলেটিকে আগে কখনো দেখেনি বা পরিচয় ছিল না তা স্পষ্ট করেই জানিয়েছে। মেহেরুন বানু অবিশ্বাস করেননি। তবে খানিক চিন্তিত বোধ করলেন। বড়োদের আলাপ-আলোচনা, সিদ্ধান্ত ব্যতীত হুটহাট এখানে চলে আসাকে ভালো চোখে দেখলেন না। মেহেরুন বানু ভাবলেন এ ব্যাপারে ছেলের সঙ্গে কথা বলবেন। বলা হলো না। তার আগেই চিত্রার মামার মাধ্যমে একটি বড়ো সম্বন্ধ এসে হাজির হলো। ছেলে উচ্চ শিক্ষিত, সরকারি চাকরি পেয়েছে বছরখানিক আগে। পরিবারসহ শহরে থাকে। ছেলের মা চিত্রাকে দেখেছিল তার মামাবাড়িতে। বাড়িতে একটা বিয়ে বিয়ে আমেজ পড়ে গেল মুহূর্তেই। প্রায় দুইমাস ধরে ধীরে ধীরে পাত্র-পাত্রী দেখা, আলাপ, আলোচনা হলো দুইপক্ষে। মতের মিলও হলো। চিত্রা এ ব্যাপারে হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না। তার মৌনতাকে সম্মতি ধরে নিলেন রবিউল খন্দকার। সারা গ্রাম একপ্রকার জেনে গেল খন্দকারের মেয়ের পাত্র ঠিক হওয়ার খবর। কিন্তু বিয়ের তারিখ ঠিক করার আগে হুট করেই বেরিয়ে এল পাত্রের গোপন বিয়ের খবর।

জৈষ্ঠ্যের এক নাভিশ্বাস ওঠা দুপুরে খন্দকার বাড়িতে হাজির হলো স্থুলদেহের এক রমনী। জানা গেল চিত্রার ঠিক করা পাত্রের সঙ্গে তার দুই বছরের বৈবাহিক সম্পর্কের কথা। গোপনে বিয়ে করে তারা সংসার পেতেছিল। সবই ঠিক ছিল কিন্তু ছেলে সরকারি চাকরি হওয়ার পর তাকে আর রাখতে চায়নি। এখন নাকি সে অশিক্ষিত, অসুন্দর। ছেলের পাশে মানায় না। সব জানাজানি হতে সময় লাগল না। রবিউল খন্দকারের তোপের মুখে ছেলের মা কান্নাকাটি করে মাফ চেয়ে বিদায় নিল। অতঃপর বিয়েটা সেখানেই ভাঙল। চিত্রাও একটু হাপ ছেড়ে বাঁচল। এমন এক ধোঁকা খেয়ে আপাতত নতুন করে বিয়ের কথাও কেউ তুলল না। বরং শুকরিয়া করল আগেই সব জেনে যাওয়ায়। নাহলে মেয়েটার কপালে কী যে ছিল! ভাবতেই মেহেরুন বানুর আত্মা কেঁপে ওঠে। আজকাল পরিচিত মানুষদেরও বিশ্বাস করার উপায় নেই।

দিন কয়েক পরের কথা। খন্দকার বাড়ির পরিস্থিতি এখন স্থিতিশীল। তবে সেই স্থিরতা ভঙ্গ হলো সাম্যের আগমনে। সে খন্দকার বাড়ির সামনে এসে উঁকিঝুকি দিচ্ছিলো আকাঙ্ক্ষিত নারীর দর্শন পাওয়ার আশায়। অনেকক্ষণ পেরোনোর পরে সে একটি ছোটো মেয়ের দেখা পেল। এই মেয়েটিকে সাম্য চেনে। দুইবার দেখা করতে এসে এই মেয়েটিকেই চিত্রার সঙ্গে দেখেছে। সাম্য হাতের ইশারায় তাকে ডাকল। পালি কাছে গিয়ে বলল,

“আপনি আবার এসেছেন? জানেন না আপনাকে দেখলে বুবু বিরক্ত হয়?”

“বুবু! তুমি তাহলে শালিকা? তাকে একবার ডেকে দাও না শালিকা। চুপিচুপি।”

“আমি আপনার শালিকা হতে যাব কেন?”

“তাহলে ছোটো বুবু ডাকি? ছোটো বুবু, তোমার বড়ো বুবুকে একবার ডেকে আনো। অনেকগুলো লজেন্স কিনে দেব।”

পালি ছুটে ভেতরে চলে গেছে। সাম্য ভাবল কাজ হয়েছে। এবার তার দেখা মিলবে। চাতক হৃদয় শীতল হবে। তবে চিত্রা নয়, বের হলো মেহেরুন বানু। পালি সরাসরি তাকেই ডেকে এনেছে। সেই সঙ্গে চিত্রাকেও খবর দিয়েছে। চিত্রা মেহেরুন বানুর পিছু পিছু এলো ঠিকই কিন্তু ফটকের বাইরে বের হলো না। আড়াল থেকেই তাদের কথা শুনল।

সাম্য মেহেরুন বানুকে দেখে অপ্রস্তুত হলো ঠিক তবে দ্রুতই নিজেকে সামলে নিল। মেহেরুন বানুর কড়া চাহনির সামনে সাম্য রাখঢাক ছাড়াই বেশ সাবলিল ভাষায় কথা বলল। চিত্রাকে তার ভীষণ পছন্দ তা জানাতেও ভুলল না। মেহেরুন বানু গম্ভীর গলায় বললেন,

“পছন্দ হইলেই তো হইলো না! দুইপক্ষের অবিভাবক আছে। বড়োগো কথা হওয়ার আগে তোমার এমনে আহন ঠিক হয় নাই।”

সাম্য সহাস্যে উত্তর দিল,
“কিন্তু দাদি, আমার বাড়ি থেকে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছিল। আপনারা সাড়া দেননি। এদিকে আপনার নাতনিকে দেখে যে আমার ভেতর অস্থিরতা চেপে বসেছে। আজ কয়েক মাস আমার আরাম হারাম হয়ে গেছে। আপনি তো এসময় পার করে এসেছেন। আমার দিকটা নিশ্চয়ই বুঝবেন।”

চিত্রা বিস্ময়ে নির্বাক মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কত বড়ো নির্লজ্জ! তার কাঠখোট্টা দাদির সঙ্গে এভাবে কথা বলছে! সে ভেবেছিল মেহেরুন বানু এখনই এক ধমক কষাবেন। তবে তেমন কিছু হলো না। তিনি বেশ ঠান্ডা স্বরেই বললেন,

“তোমার বাড়ির লোকরে আইতে কও। বড়োরা কথা কউক। তুমি আর এদিকে আইবা না। গেরামের মানুষ উলটাপালটা ভাববো। পরে আমার নাতনিই ক্ষতিগ্রস্ত হইব।”

চলবে…

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [২১]
প্রভা আফরিন
_
শালুগঞ্জ

এক সাদাকালো ঝুম বর্ষা পালির জীবনে রঙবদল নিয়ে পদার্পণ করেছে। এগারো বছরের বাড়ন্ত দেহকে আহ্বান জানাচ্ছে কৈশরের রহস্যময়, দুর্দমনীয়, প্রলয়ঙ্কারী বর্ষা। যে রহস্যময় পথে খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে। একটু অসাবধান হলেই পিছলে পড়তে হবে। পালির জীবনে এখন ঝিরিঝিরি বর্ষা। ইদানীং তার শরীরে সুক্ষ্ম কিছু বদল এসেছে। বুকের কাছটায় অসম হতে শুরু করেছে। নদীর আঁকাবাঁকা ঢেউয়ের মতোই তার দেহে ঢেউ খেলতে শুরু করেছে। না চাইতেই পালির চোখটা শুধু সেদিকেই চলে যাচ্ছে। পরমুহূর্তেই সতর্ক হয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। কেউ খেয়াল করছে নাতো! অভিজ্ঞ মেহেরুন বানু আগে থেকেই সতর্ক। যার ফলে পালির সবগুলো জামার বুকের কাছটায় এখন কুচি উঠেছে। শুধু কুচিই নয়, তিনি এখন পালিকে ওড়না জড়িয়ে বাইরে বের হতে বলেন। পালির ভীষণ লজ্জা লাগে। কুচি দেওয়া ফ্রক পরে সে অনায়াসে বের হতে পারে। তবে ওড়না গায়ে জড়ালেই তার মনে হচ্ছে সকলে বুঝি জেনে গেল তার পরিবর্তন। এ যে কী অস্বস্তিকর পরিস্থিতি পালি ব্যক্ত করতে পারে না। সে এখন বাড়ি থেকে বের হতে চায় না। মামার সামনে যেতেও সংকোচ হয়। সারাক্ষণ তার পিঠ বিছানো চুল দুভাগ করে সামনে মেলে রাখে।
আষাঢ়ি ঢল থেমে সবে আকাশটা শান্ত হয়েছে। মেঘের ফাঁক গলে অল্পবিস্তর সূর্যরশ্মি উঁকি দিয়েছে বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতিতে। সেই রোদে বসে মেহেরুন বানু গঞ্জে থেকে আনা কদুর তেলটা বাটিতে ঢেলে পালিকে ডাকলেন। বললেন,

“আয় চুলে তেল দিয়া দেই।”

“আমি তেল দিমু না।”

“ক্যান দিবিনা?”

“এমনিই।”

“এমনি কোনো উত্তর হয় না। সারাদিন চুল খুইল্যা ঘুরাঘুরি করোছ। তেল দিলে মাথা ঠান্ডা থাকব। পড়ালেখা করতে মাথা ঠান্ডা থাকন লাগে।”

মেহেরুন বানু তেল দিয়ে ওর চুলে বিনুনি করে ফিতা বেধে দিলেন। চিত্রা পালির আচরণ খেয়াল করে মিটমিটিয়ে হাসে। তা দেখে পালি আরেকদফা কুকড়ে যায়। এইটুকু বয়সে এত লজ্জা মেয়েটার কোথা থেকে আসে চিত্রা বুঝে উঠতে পারে না। সে পালিকে সঙ্গে নিয়ে ছাদে ওঠে।

“এত সঙ্কোচ করার কী আছে? আমাকে দেখ, আমি কী লজ্জা পাই?”

“তুমি তো বড়ো।”

“তুই বড়ো হতে চাস না?”

পালি উত্তর দেয় না। চিত্রা বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে,
“আমিও কিন্তু তোর মতো ছিলাম এক সময়। আস্তে আস্তে বড়ো হয়েছি। তুইও হবি। অনেক পরিবর্তন আসবে। কেউ দেখে হাসবে না, ব্যঙ্গ করবে না। ভাইয়া এবার গ্রামে আসার পর দেখেছিস কেমন দাড়ি-গোঁফ উঠেছে?”

পালি মাথা দোলায়। হিমাদ ভাইকে এবার অন্য রকম লেগেছে। থুতনিতে, কানের সামনে, নাকের নিচে দাড়ি-গোঁফ উঁকি দিয়েছে। আগের চেয়েও বড়ো বড়ো দেখায় এখন। চিত্রা বলল,
“ভাইয়ারও কিন্তু পরিবর্তন এসেছে। সে কী তোর মতো লজ্জা পেয়ে লুকিয়ে থেকেছে? থাকেনি। আমিও থাকিনি। নিলয়, সোনি সবাই বদলাবে। এটা জীবনের খুব স্বাভাবিক চক্র। মেনে নিতে শুরু কর। এখনও অনেক কিছুর সঙ্গে পরিচিত হওয়া বাকি।”
________

সাম্য ফিরে যাওয়ার সপ্তাহখানিক বাদে নাজমুল মোক্তারের আগমণ ঘটলো খন্দকার বাড়িতে। ওনার আগমণবার্তা আগেই পৌঁছেছে রবিউল খন্দকারের কানে। ফলে আপ্যায়নের ব্যবস্থাতেও কমতি রাখা হলো না। নাজমুল মোক্তারের ট্রলার যখন ঘাটে ভিড়ল তখন সূর্য মাথার ওপরে আধিপত্য ছড়িয়েছে। ঘাটে নেমে নাজমুল মোক্তারের প্রথম চোখে বাজল রবিউল খন্দকারের অনুপস্থিতি। ওনাকে গ্রহন করতে শুধু এনাম এসেছে। তিনি সাবলিল ভঙ্গিতেই হাজির হলেন খন্দকার বাড়ি। ঠিক বারো বছর পর পুনরায় এ বাড়িতে আগমন ওনার। সব একই রকম আছে। পলেস্তরা খসা পুরোনো দেয়ালের সুরক্ষা বলয়ের ভেতর বিস্তৃত জায়গা নিয়ে খন্দকার বাড়ি। মরচে ধরা লোহার ভারী ফটক যেন আস্ত এক প্রহরী। সেটা ঠেলে ঢুকতেই বড়ো উঠান। তার সামনে একতলা বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে। একপাশে বিস্তৃত সবুজাভ পুকুর। পুকুরের গায়ে হেলে বিশ্রাম নিচ্ছে হিজল গাছ। তার ছায়াসঙ্গী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে কদম ফুলের গাছ। সব…সব একই আছে। যেমনটা রয়েছে নাজমুল মোক্তারের বাসনা।

তিনি চোখ ফেরালেন সামনে। রবিউল খন্দকার বেরিয়ে এসেছেন। বারো বছর পর দুজনে পুনরায় মুখোমুখি। নাজমুল মোক্তারই প্রথম কথা বললেন। গম্ভীর কন্ঠের দ্বার ভেঙে হাত উঁচিয়ে বললেন,

“সালাম খন্দকার সাব।”

রবিউল খন্দকার মাথা নেড়ে হাত বাড়ালে রুক্ষ দুই হাতের করমর্দন সংঘটিত হলো। ওনার চোখে দীপ্তি খেলে যাচ্ছে। সাধারণত বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্রপক্ষের সামনে মেয়ের বাবার মাথা থাকে নত। তবে তিনি নতশির হলেন না। বরং নাজমুল মোক্তারের নত হওয়া ওনাকে সুক্ষ্ম আনন্দ দিচ্ছে। অনেকদিন পর যেন নিজের আধিপত্যের স্বাদ উপভোগ করছেন। তিনি বললেন,

“আইতে কোনো সমস্যা হয় নাই তো?”

“তা হয় নাই।”

রবিউল খন্দকার নাজমুল মোক্তারকে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলেন। জুলেখা নিজ উদ্যোগে অতিথির সুবিধা অসুবিধা নজরে রাখল। জুলেখার এ বাড়তি আগ্রহও চোখে পড়ার মতো। অন্যসব সম্বন্ধের বেলায় তাকে এতটা কৌতূহলী লক্ষ্য করা যায়নি।

বসার ঘরে মুখোমুখি দুই কাঠের চেয়ারে বসেছেন ওনারা। চামেলির হাত ধরে ঠান্ডা শরবত এসে পৌঁছেছে ততক্ষণে। নাজমুল মোক্তার গলা ভিজিয়ে নিলেন। উভয় পক্ষের মাঝে এক ধরনের চাপা সঙ্কোচ আছে। অনুভুতি লুকানোর প্রচেষ্টায় কালক্ষেপণ হচ্ছে। সেটা কাটিয়ে উঠতেই নাজমুল মোক্তার সাধারণ আলাপ জুড়লেন।

“বাইস্যাকাল তো আইয়া পড়ছে। এহন কী আর পানি ওঠে?”

অতি নগন্য বিষয়। উত্তর নাজমুল মোক্তারেরও জানা। এক গ্রামের পরিস্থিতি সম্পর্কে আশেপাশের গ্রামের হর্তাকর্তারা জানবে এটাই স্বাভাবিক। তবুও রবিউল খন্দকার স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন,
“খাল-বিল ভরাট হইয়া চাষের জমি ডুবে, এইডা তো আগের কাল থাইকাই। তয় টানে পানি ওঠে না।”

“হুনলাম রাইস মিল বসাইছেন। চলে কেমন?”

“বিদ্যুতের সুফল নেওয়ার চেষ্টা আরকি। গেরামে ধানের আবাদ বেশি। ভাবলাম নতুন কিছু করি। আল্লাহর রহমতে ভালোই চলে।”

তিনি একটু থেমে পালটা প্রশ্ন ছুড়লেন,
“নিবাসপুরে না থানা বইছে? আপনেগো লগে খাতিরও মেলা।”

নাজমুল মোক্তার মৃদু হেসে বলেন,
“অস্থায়ী থানা, অস্থায়ী পুলিশ। তয় আইনের লোক যেহেতু খাতির তো করাই লাগে। তারা আবার খাতির পছন্দ করে।”

“তা ঠিক।”

“করবীর মৃ’ত্যু সংবাদে আমি যারপরনাই অবাক হইছি খন্দকার সাব। কতোই বা বয়স! নিজের জেদে চলতে গিয়া প্রাণডাই গেল। তার জন্যই মেয়ে মানুষরে এত স্বাধীনতা দেওয়া লাগে না। যাইহোক, ম’রা মানুষরে না টানি। মেয়েডা যেমনই আছিলো ভালো আছিলো। দোষটা শুধু সময়ের।”

রবিউল খন্দকার নড়েচড়ে বসেন। এই একটা নামের সঙ্গে হাজারো দুঃখ, আক্ষেপ ও ভুলের বাস। আবার মোক্তারদের সামনে ওনার নিচু হওয়ার একমাত্র কারণও এই নাম। নাজমুল মোক্তারের ছোটো ভাইয়ের নাম বিপুল। যার সঙ্গে করবীর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জেদি করবীর কাছে সেই সিদ্ধান্তকে হার মানতে হয়েছে। বিনিময়ে রবিউল খন্দকারের মাথা নত হয়েছে। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

“বিপুলের এহন কী খবর?”

“বছরখানিক পরেই বিয়া করাইছিলাম। বউ শিক্ষিত, উচ্চবংশীয়। সুখেই আছে এহন।”

কথায় কথায় নানান প্রসঙ্গ উঠে এল তাদের মাঝে। বারো বছরের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো একবার ঝালাই করে নেওয়া শুধু। দুপুরের ভারী খাবার শেষে নাজমুল মোক্তার আসল কথায় এলেন। সাম্যের পছন্দ, ওনার ইচ্ছে দুটোই এক। পুরোনো কথা ভুলে নিজেদের সম্পর্ক জোড়ালো করতে চান, চিত্রাকে পুত্রবধূ করতে চান। ছেলের প্রশংসাও করলেন মুখ খুলে। রবিউল খন্দকার বিপরীতে বললেন,

“মেয়ে আমার কলিজার টুকরা। বিয়ে দেওয়া মানে নিজের কলিজা কা’ইট্টা দেওয়া। আমি চাই না বিয়ার পর অতীতের কোনো ক্ষো’ভ আমার মাইয়ার উপরে পড়ুক।”

“কী বলেন খন্দকার সাব। আমার বাড়িতে আজ অবধি কোনো পুরুষ বউয়ের শইল্যে হাত তোলে নাই। বাইরের কেউ তাগো লগে খারাপ ব্যবহার করতে হুনছে কইতে পারব না। তাছাড়া আমারও দুইডা মেয়ে আছে। তাদের বিয়া দিছি। বাপ হওয়ার জ্বা’লা আমিও উপলব্ধি করতে পারি, খন্দকার সাব। অতীতে যা হইছে তা শুধু সময়ের ভুল ধইরা নিছি। মনে আগলায় রাখলে কী আমি এইহানে বইয়া থাকতাম? থাকতাম না। আপনের মেয়ে আমার বাড়িতে রানীর হালে থাকব।”

“তা ময়মুরুব্বি নিয়া আহেন। পাকা কথা সাইড়া তারিখ ফালাইতে হইব।”

জুলেখা চিত্রাকে শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে দুপুরের আগেই। সেই সাজে তাকে বসার ঘরে আনা হলো। নাজমুল মোক্তারের মুখভঙ্গি বলল মেয়ে দেখে তিনি আকাঙ্ক্ষার অধিক সন্তুষ্ট। কথার প্রসঙ্গে বাদ গেল না দাবি-দাওয়ার বিষয়ও। রবিউল খন্দকার নিজেই বললেন,
“আপনাদের দাবি-দাওয়া থাকলে আগেই কইতে পারেন।”

নাজমুল মোক্তার যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন,
“ছি! ছি! এইসব কইয়া লজ্জা দিয়েন না। আমাগো এমন অভাব পড়ে নাই যে মেয়ের বাপের কাছে হাত পাততে হইব। বরং মেয়ের বাড়িতে খরচ কইরা আমরাই বউ ঘরে আনি। এইডা আমাগো পুরান রেওয়াজ। তয় আপনের বাড়িতে খরচ করার সামর্থ্য আমার নাই তাও মানি।”

মেঘলা আকাশের গা ঘেঁষে সন্ধ্যা নেমেছে। শীতল বাতাস যেন আরও একটি তুমুল বর্ষণের আহ্বান করছে। শীতল হাওয়া চিত্রার দেহে শিরশিরে অনুভূতি জাগায়। তার ঘরে আলো নেই। জানালার পর্দা শব্দ তুলে উড়ছে। জুলেখা এসে ঘরে আলো জ্বালিয়ে দিল। চিত্রাকে মনম’রা দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“মন খারাপ করে না, মাগো। বিয়া আজ নাহয় কাল হইবোই। তুই অনেক সুখী হবি।”

চিত্রার অনিমেষ দৃষ্টি পুকুরের গায়ে উড়তে থাকা জোনাকি পোকাদের দিকে। যেন নক্ষত্ররা নেমে এসেছে সেখানে। অথচ আঁধারে কোনো পরিবর্তন আসেনি। বরং সময়ের সঙ্গে তা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। সে বিড়বিড় করে বলল,
“আমার জীবনে সুখ অনেকটা জোনাকি পোকার মতো। উজ্জ্বল কিন্তু আলো ছড়াতে ব্যর্থ।”

চলবে…
[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ]