#বৃষ্টিস্নাত_তুমি – (৭)
হুযাইফা মাইশা
সকালে উঠে নিজেকে ইয়াভকিনের অতি নিকটে দেখে খানিকটা ভড়কালো পূর্ণতা। আলগোছে ইয়াভকিনের হাত থেকে নিজের হাতখানা ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে বসলো। একবার ঝুঁকে দেখে নিলো ইয়াভকিন ঘুমোচ্ছে কিনা। গভীর ঘুমে, ভেবেই সে স্বস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে পড়লো।
কিন্তু বোকা পূর্ণতা। ইয়াভকিনের এমন অভিনয় একচুলও ধরতে পারলনা। সে যেতেই চট করে চোখ জোড়া খুললো ইয়াভকিন। ওর গমন পথে তাকিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। মেয়েলি ঘ্রাণে ভরে গেছে বিছানাটা! বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে নেত্রযুগল বন্ধ করলো।
_
মির্জা বাড়ির বসারঘরে আপাতত হুলুস্থুল কান্ড। গতকাল পূর্ণতা ফোন করে জানিয়েছে আজ আসবে। সে কারণে প্রিমা, ওর স্বামী–আবরারকে নিয়ে এসেছে সকাল সকাল। আবরারও বউয়ের আবদারে অফিস ফেলে এসেছে না পারতে। প্রান্ত চেম্বার নিয়েছে এই গ্রামেই। বউকে নিয়ে এখানেই থাকে। আজ চেম্বারে যায়নি।
সকাল সকাল বেরিয়েছে পূর্ণতা আর ইয়াভকিন। আসতে সময় লাগলোনা বেশি। বাড়িতে যেতেই হেনা মেয়েকে দেখে কেঁদে দিলেন। পূর্ণতা কোনোমতে সামাল দিল।
প্রিমা এগিয়ে এসে বোনকে জড়িয়ে ধরল। ওর ছোট্ট ছেলেটা দু’হাত মেলে ঠোঁট উল্টালো। খালামণিকে ওর ভীষণ পছন্দ। মা-বাবার পর এই একটা মানুষের কাছেই ও শান্ত বাচ্চা বনে থাকে। পূর্ণতা হেসে ওকে কোলে তুললো। ইয়াভকিন পূর্ণ দৃষ্টিতে ওকে দেখল। মেয়েটাকে হাসলে কি দারুণ-ই না দেখায়!
বর্তমানে পূর্ণতার রুমে বসা ইয়াভকিন। একটু আগেই দুপুরের খাবার খেয়েছে। এরপর ওকে এই রুমে বসিয়ে, মেয়েটা কোথায় গেছে কে জানে। রুমটা মাঝারি আকারের। ছিমছাম রুম। বড় হওয়ার পর পূর্ণতা বেশি থাকেনি এখানে। ভার্সিটি অফ থাকলে ক’দিন এসে থাকতো।
ইয়াভকিন পুরো রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখলো একবার। দেয়ালে মেয়েটার ছোটবেলার কিছু ছবি। সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো অনেক্ষণ!
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। পূর্ণতার দেখা নেই এখনও অব্দি। ইয়াভকিন ঘরে এতোক্ষণ বসে থেকে অস্থির হয়ে উঠছে ক্রমশ। নিজ থেকে বাইরেও যেতে পারছেনা।
বাড়িটা বড়, একতলা। চারপাশে গাছ-গাছালি। ঠান্ডা-ঠান্ডা পরিবেশ। জানালার ধার হতে একবার ঘুরে আসলো ইয়াভকিন। মেয়েটার রুমে বারান্দা নেই। আছে বিশাল এক জানালা। পুরো রুমটায় চতুর্থ বারের মতো ঘুরঘুর করে দরজা ঠেলে বের হলো। পূর্ণতা কোথায়, খোঁজ নেয়া উচিত! বাইরে আসতেই মুখোমুখি হলো পূর্ণতার ভাইয়ের সঙ্গে। প্রান্ত ওকে দেখে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। বয়সে ও ইয়াভকিনের থেকে খুব একটা বড় নয়। একটু এগিয়ে এসে বলল,
‘ কোনো প্রব্লেম?’
‘ প্রব্লেম না। পূর্ণতা কোথায়?’
‘ ও আসেনি এখনও?’
‘ জ্বি না, কোথায় গেছে?’
‘ ওইতো পাশের বাড়িটায়। গ্রামে ওর বন্ধুবান্ধব কম নেই তো, এইট অব্দি এখানে পড়েছে। এরপর শহরে চলে গেছিলাম আমরা। প্রিমার বিয়ে হওয়ার পর এখানে চেম্বার নিয়ে চলে আসলাম সবাই। কিন্তু পূর্ণতা ওখানেই ছিলো। আসতো মাঝে মাঝে। আসলেই বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা করতে যেতো। এখনও গেছে! খেয়াল নেই সময়ের। এতোক্ষণে তো আসার কথা!’
বলতে বলতে দু’জনে আসলো বসারঘরটায়। তক্ষুনি প্রবেশ করতে দেখা গেল পূর্ণতাকে। শাড়ির কুঁচি সামলে পা টিপে টিপে ফেলে এগিয়ে আসছে। প্রান্ত খানিকটা গলা উঁচিয়ে, ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘ কোথায় ছিলি?’
‘ শেফাদের বাড়িতে!’
‘ এতক্ষণ বসে গল্প করছিলি? ইয়াভকিন যে একা মাথা নেই?’
আড়চোখে একবার ইয়াভকিনকে দেখে নিলো পূর্ণতা। বিড়বিড় করে বলল, ‘ আমাকে ছাড়া উনার দিব্যি চলে। আমি থাকলেই বরং উনি বিরক্ত হোন।’
কপালে ভাঁজ ফেলে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ অনেকদিন পর দেখা হয়েছে তো ভাইয়া, তাই।’
বলতে বলতে পা বাড়ালো নিজের রুমের দিকে। প্রান্ত’র সাথে খানিক্ষণ কথা বলে উঠে পড়ল ইয়াভকিন। চারটার উপর বাজে। পূর্ণতার কি বাড়ি ফেরার কথা মনে নেই?
রুমে এসে চট করে দরজার ছিটকিনি তুলে দিলো। সেটার শব্দে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা পূর্ণতা পাশ ফিরে তাকাল। বিশেষ ভাবাবেগ না দেখিয়ে আগের ন্যায় দৃষ্টি ফেরাল। ইয়াভকিন এগিয়ে গেলো। ইঞ্চি কয়েক দূরত্ব রেখে দাঁড়াল ওর পাশে। বলল,
‘ বাড়ি ফিরবে না নাকি?’
‘ আজ থাকার কথা না?’
‘ বাড়িতে তো বলে আসোনি। আর আজকে থাকলে আবার কালকে বাড়ি যেতে বিকেল হবে। পরশু ঢাকায় ফিরতে হবে তাহলে। তোমার ভার্সিটি, আমার অফিস?’
মুখ গোমড়া হলো পূর্ণতা। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘ ঠিক আছে।’
গটগট করে আয়নার সামনেটায় গেলো ও। টেনেটুনে শাড়ি ঠিক করে আলমারি হাতড়ালো কিছুক্ষণ। ইয়াভকিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর কার্যকলাপ দেখলো। শান্ত দৃষ্টিতে। পূর্ণতা বেরিয়ে যাওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে ইয়াভকিন বিড়বিড় করে বলল,
‘ একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাও মেয়ে, তুমি কি অস্থিরতাদের বলে রেখেছ, তুমি দৃষ্টিসীমানার বাইরে গেলেই তারা যেন দলবল নিয়ে আমার বুকে হা’না দেয়, হুহ?’
পূর্ণতা কি মনে করে একবার এদিকে তাকালো। কথাগুলো শুনেনি যদিও। তবুও একবার তাকিয়ে এরপর বেরিয়ে গেল।
_
আজকাল হুটহাট বৃষ্টি নামে। কখন ধরণীর বুকে ঠান্ডা বৃষ্টির ফোঁটা গুলো আছ’ড়ে পড়ে তার ঠিকঠাকানা নেই। এইতো পূর্ণতা আর ইয়াভকিন যখন বের হলো তখন আকাশ একদম ফকফকা, স্বচ্ছ। গাড়িতে উঠতে না উঠতেই মেঘ মিশ্রিত হলো তা। পূর্ণতা দু’চোখ মেলে সেদিকেই তাকিয়ে আছে। ইয়াভকিন বুঝে পায়না, মেয়েটা কি এতো দেখে মেঘাচ্ছন্ন আকাশে? এতই পছন্দ বৃষ্টি?
খানিক দূরে যেতেই বৃষ্টি নামল। একটু পরে আবার বেগ বাড়লো তার। পূর্ণতা কাঁচ নামিয়ে হাত বাইরে নিলো। টুপটাপ বৃষ্টিতে হাত ভিজছে। মাথা জানালার ধারে লাগানো বিধায় মুখশ্রীতেও বৃষ্টির ফোঁটা লক্ষ্যণীয়। ড্রাইভ করতে করতে একবার সেদিকে তাকাল ইয়াভকিন। পরপরই গাড়ির গতি কমালো।
পূর্ণতার মুখশ্রীতে বিষন্ন ভাবটা স্পষ্ট হচ্ছে ধীরে ধীরে। চোখ দু’টো ফুলে গেছে খানিকটা। ফোলা ফোলা গালগুলো লাল। আসার সময় মা আর বাবাকে ধরে একচোট কেঁদেছে মেয়েটা। যেই সেই কান্না না, হাউমাউ করে কান্না যাকে বলে। এর পর আবার ভাই-বোনকে জড়িয়ে কেঁদেছে। মায়ের রুমেই কেঁদেছে। ইয়াভকিন রুমে ছিলনা ঠিকই, কিন্তু বাইরে থেকে আওয়াজ শুনেছে। পূর্ণতার সেই মন খারাপের রেশ লেগেছে ওর নিজেরও।
পেছন থেকে পানির বোতলটা এনে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে দিলো। পূর্ণতা নিঃশব্দে সেটা নিয়ে কয়েক ঢোক গিলল। আবার হাত বাড়িয়ে ফেরত দিলো বোতলটা। আনমনা হয়ে বসলো আবার। ইয়াভকিন গাড়ির গতি বাড়ালো। খানিক দূরে একটা বড় মাঠ। ওদের গ্রামের ভেতরই। সেখানটায় থামালো।
খানিক্ষন পর গাড়ি চলছেনা দেখে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো পূর্ণতা। ভ্রুযুগল কুঁচকে। ছোট ছোট চোখ করে বলে উঠে,
‘ থামালেন কেনো?’
ঝুঁকে এলো ইয়াভকিন। অতি নিকটে। নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে পূর্ণতার মুখশ্রীতে। পূর্ণতা ভড়কালো, ঘাবড়ালো। পিছনে মাথা নিয়ে নিলো চট করে। লাভ হলোনা বিশেষ। ইয়াভকিন একহাতে ভর রেখে অন্য হাতটা বাড়িয়ে দরজা খুলে দিলো। মুহুর্তেই বৃষ্টির ছটা এসে কিঞ্চিৎ ভিজিয়ে দিলো দু’জনকে। সেদিকে ধ্যান না দিয়ে ইয়াভকিন দূরত্ব কমায়। শান্ত অথচ হৃদয়ে ঢেউ তুলার ন্যায় গাঢ়, ঘোরলাগা কণ্ঠে উচ্চারণ করে,
‘ যাও, বৃষ্টির জল গায়ে মেখে, স্পর্শ করে বৃষ্টিকেও পূর্ণতা দিয়ে আসো।’
.
.
.
চলবে।