বৃষ্টিস্নাত তুমি পর্ব-০৮

0
320

#বৃষ্টিস্নাত_তুমি – (৮)
হুযাইফা মাইশা

পূর্ণতাকে ভিজতে বললেও তার সাথে সাথে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজলো ইয়াভকিনও। বৃষ্টিতে ভেজার শখ কোনোদিনই ছিলোনা ওর। ভার্সিটি লাইফে হুটহাট বন্ধুদের সাথে মজা করে হয়তোনা কয়েকবার ভিজেছে। ইচ্ছাকৃত নয় যদিও।

দু’জনে ভিজে জবুথবু হয়ে ফিরলো বাড়িতে। দরজা খুলে থ বনে গেলেন কাজল। জ্বর বাঁধাবে— বলে একচোট বকলেন ইয়াভকিনকে। সেই বকার একাংশও গেলোনা পূর্ণতার দিকে।
ইয়াভকিন ঘরে এসে চেঞ্জ করে নিলো। পূর্ণতা কাপড় নিয়ে দৌঁড়েছে ইরিনের কাছে। কাপড়চোপড় পাল্টে সেখানে বসে আড্ডা দিয়ে রুমে আসে।
তখন সন্ধ্যা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে শাফায়াতের সাথে কথা বলছিলো ইয়াভকিন। সেদিকে ধ্যান না দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় লুটিয়ে পড়লো পূর্ণতা। আলগোছে গায়ে কম্বল জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। অসময়ে ঘুমানোর মতো বদ-অভ্যাস আছে ওর। তাই চট করে চোখ লেগে গেলো। যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন রুম অন্ধকারে ছেয়ে। দমবন্ধকর পরিস্থিতি। অন্ধকারেই পিটপিট করে তাকালো বার কয়েক। ঠাহর করতে পারছেনা কোনোকিছু। এরপর হঠাৎ লাইট জ্বলে উঠতেই ধুম করে উঠে বসে। উদ্ভ্রান্তের ন্যায় তাকায়। দরজার পাশটায় ইয়াভকিন দাঁড়িয়ে। হাতে প্লেট, সেটায় খাবার। কাজল মেয়েটাকে ডেকে গেছেন কয়েকবার। উঠেনি দেখে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছেন ইয়াভকিনের হাতেই। ইয়াভকিন দরজা লাগিয়ে এগিয়ে আসে। অনুমতি ছাড়াই চট করে হাত ঠেকায় পূর্ণতার কপালে। সেকেন্ডের মধ্যে হাত সরিয়ে নেয়। গা গরম দেখে বলে,
‘ খেয়ে নাও। খেয়ে ঔষুধ খাবে।’
‘ খাবোনা। ক্ষিদে নেই।’
আবার মাথা এলিয়ে চাইলেই বাঁধ সাধে ইয়াভকিন। ধ’ম’কে উঠে,
‘ খাবে নাকি মা’কে ডাকবো?’
‘ শান্তিতে থাকতে দিন তো। মাথা ব্যথা করছে আমার।’
‘ খেয়ে তার পর যা ইচ্ছা করো।’

সেসব কথা কানে না তুলে আবারও মাথা এলিয়ে দিতে চাইল পূর্ণতা। তীব্র মাথা ব্যথার চোটে চোখ বুজে আসছে বারবার। ইয়াভকিন হাত বাড়িয়ে ওর বাহু টেনে ধরে। বিছানার একধারে নিয়ে এসে সোজা করে বসায়। পূর্ণতা থমথমে গলায় বলে,
‘ ধরছেন কেনো? ছাড়ুন।’
‘ ত্যাড়ামি না করে চুপচাপ খাও।’

না পারতে খাওয়া শুরু করলো পূর্ণতা। অর্ধেক খেয়ে রেখে দিলো। কোনোমতে হাত ধুঁয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল। ইয়াভকিন সেদিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্লেটটা একপাশে রেখে দিলো। বাতি নিভাতেই অন্ধকারে আচ্ছন্ন হলো ঘরটা।
খানিক্ষণ পর খুব কাছটায় কারোর অস্তিত্ব টের পেলো ইয়াভকিন। পূর্ণতা মৃদু কাঁপছে। কাঁপুনিটা টের পাচ্ছে ইয়াভকিন। না চাইতেও একহাতে পেঁচিয়ে ধরলো মেয়েটাকে। পূর্ণতা তাপ পেয়ে নিমিষেই শান্ত হলো।

_

দিন কয়েক পরের কথা। গ্রাম থেকে ফিরেছে বেশ কয়েকদিন হলো। ব্যস্ত দু’জনে ভার্সিটি আর অফিস নিয়ে। সন্ধ্যা বেলা আর রাতে যা একটু দেখা হয়। তবে সেটাও বেশিক্ষণ না। সারাদিনের ধকলের কারণে খুব জলদি চোখ লেগে আসে দু’জনেরই।

পূর্ণতা আজ ভার্সিটি যাওয়ার সময় সোফায় নির্বিকার চিত্তে বসে থাকা ইয়াভকিনকে শুধু জিজ্ঞেস করেছে, ‘ অফিস নেই?’
জবাবে ইয়াভকিন ছোট্ট করে বলেছে, ‘ না।’
আর কিছু জিজ্ঞেস না করেই বেরিয়ে গেছে পূর্ণতা।

তপ্ত দুপুরবেলা। হাঁসফাঁ:স করতে করতে ফ্ল্যাটে ফিরলো পূর্ণতা। কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলো ইয়াভকিন। সদ্য শাওয়ার থেকে বেরিয়েছে। কপালে লেপ্টে চুল। চোখমুখেও পানি লেপ্টানো। ক্লান্ত পূর্ণতা ভারী নেত্রপল্লব ঝাঁপটিয়ে সেদিকে তাকাল। সেকেন্ড কয়েকে হুশ ফিরতেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল। যেতে যেতে কানে এল ইয়াভকিনের কথা,
‘ বিকালে একটা জায়গায় যেতে হবে।’
‘ আমাকেও?’
‘ হু।’
‘ আচ্ছা।’
বলে রুমে ঢুকলো পূর্ণতা।

বিকালের দিকে একদম রেডি হয়ে বের হলো ইয়াভকিন। পূর্ণতা তখন রেডি হচ্ছে। বের হতেই তাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো ইয়াভকিন। মেয়েটার পরনে নেভি ব্লু কালার ড্রেস। সেদিকে একবার তাকিয়ে ইয়াভকিন শুধাল,
‘ শাড়ি পড়া যায়না?’

অপ্রস্তুত পূর্ণতা পিটপিট করে তাকিয়ে আবারও রুমে ঢুকল। লোকটার আজ কি হয়েছে, কে জানে!

তড়িঘড়ি করে একটা সিল্কের শাড়ি পড়ে বের হলো পূর্ণতা। তাকে পূর্বের ন্যায় আরেকবার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করল ইয়াভকিন। কি গভীর সে দৃষ্টি! পূর্ণতা অস্থির হয়ে উঠল তাতে। অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
‘ চলুন?’

আচমকা দু’কদম এগিয়ে আসলো ইয়াভকিন। হাত বাড়িয়ে ঝট করে পূর্ণতার খোঁপায় বাঁধা চুলগুলোকে বাঁধন ছাড়া করে দিলো। দরজার দিকে পা বাড়ানো আগে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘ এভাবে..এভাবে সুন্দর দেখায়।’

_

বড় একটা রেষ্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামালো ইয়াভকিন। কৌতুহলী পূর্ণতা চারদিকে তাকাচ্ছে কেবল। ইয়াভকিন হঠাৎ শান্ত কণ্ঠে বলে উঠল,
‘ আমার ভার্সিটি লাইফের বন্ধু বান্ধবরা দেখা করতে বললো। অনেক দিন দেখা হয়না। তার উপর বিয়েতে কাউকে ইনভাইট করা হয়নি। তাই সবাই মিলে ঠিক করলো এখানে দেখা করবে। অসুবিধা তোমার?’

ভ্রু দ্বয় কুঁচকে একবার তার দিকে তাকিয়ে নেমে পড়লো পূর্ণতা। একদম রেষ্টুরেন্টের সামনে এনে বলছে, ‘ অসুবিধা তোমার?’
আশ্চর্য লোক! বিড়বিড় করতে করতে পা বাড়ালো। পেছন হতে বড়বড় পা ফেলে এগিয়ে এলো ইয়াভকিন। ‘ সাবধানে ‘ বলে আলগোছে পূর্ণতার ডান হাতটা নিজের বলিষ্ঠ হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো।

আদতে বন্ধুবান্ধব বললেও এখানে এসেছে তাদের হাজবেন্ড ওয়াইফও। ফ্রেন্ড সার্কেলের প্রায় অধিকাংশই বিবাহিত। ইয়াভকিনকে দেখে সকলেই হইহই করে উঠল। ভার্সিটি লাইফে মুখ্য একজন মানুষ ছিলো ইয়াভকিন। পূর্ণতা অস্বস্থিতে জমে গেলেও বুঝতে দিলোনা কাউকে। হাত ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য চেষ্টা করতেই বাঁধ সাধে ইয়াভকিন। ঘাড় ফিরিয়ে চোখ রাঙায় একবার। পরপরই বন্ধুদের দিকে এগিয়ে যায়। সাথে নিয়ে যায় পূর্ণতাকেও।

পূর্ণতা বসলো ইয়াভকিনের পাশে। গোল টেবিল। পূর্ণতার অন্য পাশটায় তিহা নামের একটা মেয়ে বসেছে। মেয়েটা দেখতে এতো সুন্দর! পূর্ণতাকে দেখে হেসে হেসে পরিচিত হলো সকলে। হাসি মুখে কথা বলে নিশ্চুপ হয়ে গেলো পূর্ণতা। ইয়াভকিন কথা বলতে বলতে একবার ওর দিকে তাকালো। পরপরই কথার মাঝখানে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কি ব্যাপার? কোনো সমস্যা? ওয়াশরুমে যাবে? হু?’
‘ হ্যাঁ, কোন দিকটায় ওয়াশরুম?’
‘ দাঁড়াও আমিও আসি সাথে।’
ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে ইয়াভকিন। পূর্ণতাকে উঠতে বলে সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ তোরা কথা বল।’

পূর্ণতার ওপাশ থেকে তিহা গলা উঁচিয়ে বলল,
‘ এনি প্রবলেম?’
‘ না, একচুয়েলি ওয়াশরুমে…’

কথা সম্পূর্ণ করার আগেই থামিয়ে দিলো তিহা। সুন্দর এক হাসি উপহার দিয়ে বলল,
‘ তুই বোস, আমি যাচ্ছি ওর সাথে।’

ইয়াভকিন বসে পড়ল বটে। তবে আড়চোখে বারবার তাকালো পূর্ণতার দিকে। মেয়েটার অস্বস্থি লাগছে নিশ্চিত!

শাড়ি ঠিক করে বের হতেই তিহা এগিয়ে আসলো। আয়নার সামনে নিজেকে দেখতে দেখতে বললো,
‘ তুমি কিন্তু অনেক সুন্দর, পূর্ণতা। নামটাও দারুণ!’
‘ থ্যাংকিউ।’ প্রত্যুত্তর দিয়ে আলতো হাসলো পূর্ণতা।
‘ হুহ, তোমার বর কিন্তু আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলো। এখন অবশ্য না, কজ ভার্সিটি লাইফ শেষে সবাই যার যার ক্যারিয়ার নিয়ে বিজি হয়ে পড়ে। যোগাযোগটাও কম হয়েছে।
সার্কেলের মধ্যে আমরা দু’জন ছিলাম খুব বেশি ক্লোজ। আই মিন বেষ্টফ্রেন্ডের চেয়েও বেশি।’

শিরদাঁড়া বেয়ে যেন শীতল স্রোত নেমে গেলো পূর্ণতার। তন্মধ্যে তিহার কল আসায় সে বলল,
‘ তুমি যাও পূর্ণতা। আমি কলে কথা বলে আসছি, ওকে?’

মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালেও খানিক্ষণ এখানেই থাকলো পূর্ণতা। বেসিনের দু’পাশে হাত দিয়ে আয়নার নিজেকে পর্যবেক্ষণ করলো একবার। মেয়েটা নিঃসন্দেহে সুন্দরী। আগু’ন সুন্দরী যাকে বলে আরকি। তার উপর কথাবার্তায়ও স্মার্ট। চালচলনের দিক দিয়েও। এমন মেয়ের দিকে যে কারোর নজর যেতে পারে স্বাভাবিক। ইয়াভকিনেরও গিয়েছিল তবে?
নিজের ভাবনায় তব্দা খেয়ে গেলো ও। পরমুহূর্তে নিজেকে শান্ত করে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল।
তক্ষুনি বাইরের দিকটা থেকে তিহার কণ্ঠ আবারও ভেসে এল,
‘ এ’ক্সের সামনে বউকে নিয়ে এসেছিস? দেখানোর জন্যে নাকি? যাইহোক, মেয়েটা দেখতে খারাপ না। কোত্থেকে পেলি? লাভ ম্যারেজ তো হবেই না সিওর। ফ্যামিলির চাপে বিয়ে করেছিস নাকি?’

চলবে..