#বৃষ্টিস্নাত_তুমি – (১০)
হুযাইফা মাইশা
গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় পূর্ণতা। এই রুমটায় আগে কখনো এসেছে কিনা সন্দেহ। অনুমতি ছাড়া কোনোদিন রুমটায় ঢুকেনি ও। আর ইয়াভকিন রুমে থাকলে ঢুকার প্রশ্নই আসেনা। রুমটা অন্য রুমের তুলনায় বড়। তার উপর দামি দামি আসবাবপত্র। আবার লাগোয়া বড় খোলামেলা বারান্দা। ও চোখ ঘুরিয়ে সব কিছু দেখে। ইয়াভকিন এসে দাঁড়ায় পাশে। হাই তুলে বলে,
‘ এক বিছানায় ঘুমাবে? নাকি বিয়ের রাতের মতো…’
‘ এতো নায়ক সাজার শখ!’
‘ খুব!’
ইয়াভকিন লাইট নিভিয়ে এসে শুয়ে পড়ে। পূর্ণতা ঝটপট উঠে পড়ে বিছানায়। এই বিছানাটা খানিকটা শক্ত। শক্ত বিছানায় ঘুমানোর অভ্যাস নেই ওর। খানিকটা থমথমে গলায় বলে উঠে,
‘ এতো শক্ত কেনো বিছানা?’
‘ হুহ, আমার বুকে শুতে পারো, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড। সেটা বিছানার তুলনায় অনেক সফট।’
বিড়বিড় করে বলায় ঠিক শুনতে পেলোনা পূর্ণতা। গলা উঁচিয়ে বলে,
‘ জ্বি?’
‘ কিছুনা, তুমি কি কিছু শুনতে পাচ্ছো?’
‘ কি?’
‘ এই তো, গটগট করে হাঁটার মতো! শুনতে পাচ্ছো, নাকি আমি ভুল শুনছি?’
গলা শুকিয়ে গেলো মুহুর্তে। দূরত্ব কমালো পূর্ণতা। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ইয়াভকিনের টিশার্টের পেছনের অংশ চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে নিল।
সকাল ন’টা। ইয়াভকিন রেডি হচ্ছে। পূর্ণতা ওর বিছানায় আরাম করে ঘুমোচ্ছে।
রেডি হয়ে ওর পাশে আসে ইয়াভকিন। মেয়েটা ঠোঁট উল্টে ঘুমোচ্ছে। চুল খুলে গেছে। হাত বাড়িয়ে সেগুলো ঠিক করে দিয়ে ইয়াভকিন ওকে ডেকে উঠে,
‘ পূর্ণতা?’
বার কয়েক ডাকতেই পিটপিট নয়নে তাকায় পূর্ণতা। সর্বপ্রথমই ইয়াভকিনের মুখটা আশা করেনি ও। হকচকিয়ে উঠে বসে ও। চোখ কচলিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ কি?’
‘ ভার্সিটি যাবেনা?’
‘ যাব।’
‘ তাহলে রেডি হয়ে নাও।’
‘ আমার অনেক সময় লাগবে। আপনি যান।’
‘ আমি অপেক্ষা করতে রাজি আছি, পূর্ণতা।’
শান্ত কণ্ঠে বলে, সরে যায় ইয়াভকিন। আয়নার সামনে গিয়ে টাই ঠিক করে আবার। পূর্ণতা উঠে পা বাড়ায় নিজের রুমের দিকে।
পূর্ণতা নাশতা খেয়ে তৈরি হতে পাক্কা একঘন্টার বেশি লাগিয়েছে। কম সময়ই লাগতো, ইচ্ছে করে মেয়েটা সময় নিয়েছে। ক্লাস এত জলদি না। কিন্তু সাহেব যখন অপেক্ষা করতে রাজি, তবে আরেকটু করুক। মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতে হেলেদুলে বের হলো পূর্ণতা। ইয়াভকিন শান্ত হয়ে বসে আছে সোফায়, ফোন ঘাটছে। পূর্ণতা গলা ঝেড়ে মনোযোগ আকর্ষণ করতেই উঠে দাঁড়াল। হাতের দামী ঘড়িটায় চোখ বুলিয়ে বলল,
‘ একটু বেশিই জলদি জলদি রেডি হয়ে গেলে না?’
কথাটা ব্যঙ্গ করে বলা। তবে, এই মুহূর্তে তর্ক করার ইচ্ছে নেই পূর্ণতার। সেজন্য কেবল মুখ দিয়ে ভেঙ্গচি কাটলো। ভেঙ্গচি— এই একটা জিনিস সহ্য করতে পারেনা ইয়াভকিন। তার মতে, এটা দেখানো মানেই তাকে অপমান করা। ব্যাপারটা ভীষণ অদ্ভুত। ইয়াভকিন গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে,
‘ এই কাজটা আমার অপছন্দ। এইবার লাস্ট, এরপর যেনো মুখ ভেঙ্গচি কাটতে না দেখি..’
‘ কাটলে কি করবেন?’
দু কদম এগিয়ে আসে ইয়াভকিন। দূরত্ব খুবই কম দুজনের মাঝে। ইয়াভকিন পূর্ণতার দিকে ঝুঁকে,
‘ কি করবো, দেখাই?’
পূর্ণতা পেছনে সরে গেলো। রাগে মুখশ্রী লাল হলো পরক্ষণে। ছোট্ট কথায়ও রেগে গেল ও। কথাটা ও অন্য মাইন্ডে নিয়েছে, সেটা ইয়াভকিন নিশ্চিত। ব্যাপারটা ধরতে পেরে সে বুক ফুলিয়ে হাসলো। মেয়েটা রাগান্বিত মুখ দেখতে মন্দ লাগছেনা। গাড়ির চাবি আঙুলে ঘুরিয়ে, গুনগুন করতে করতে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। উপায় না পেয়ে, রেগে মেগে পিছু পিছু ছুটে পূর্ণতাও।
_
তন্ময় গেটের পাশে ঘুরঘুর করছে। মূলত পূর্ণতার দেখার পাওয়ার জন্য। ভার্সিটিতে আসলে সর্বপ্রথম পূর্ণতা বর্ষার সাথে দেখা করে। প্রায় সারাদিনই বর্ষার সাথে থাকে। একটু আগে দেখে এলো বর্ষা একা। সুতরাং পূর্ণতা আসেনি। তাই সে গেটের পাশে ঘুরঘুর করছে। মেয়েটা ইদানীং এড়িয়ে চলার অভ্যাস বেশ ভালো করেই জব্দ করেছে। মাত্রাও বাড়িয়েছে। সে কতোবার সরাসরি একথা-সেকথা জিজ্ঞেস করেছে কিন্তু ভরা ক্লাস কিংবা ক্যাম্পাসের মধ্যেও মেয়েটা নির্দ্বিধায় এড়িয়ে যায়। ব্যাপারটা অপমানজনকও বটে। এই অপমান আবার পূর্ণতার সঙ্গে নিজেকে জড়ানোর জেদের সাথে যুক্ত হচ্ছে।
পূর্ণতাকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যায় তন্ময়। পূর্ণতা বরাবরের ন্যায় তাকে দেখে ভ্রু কুঁচকিয়ে হাঁটার গতি বাড়ায়। কিন্তু তন্ময় সামনে এসে আটকে দেয়। বেশ তেজি কণ্ঠে বলে,
‘ তোমার সাথে আমার কথা আছে পূর্ণতা।’
‘ সামনে থেকে সরুন।’
‘ আগে কথা শুনো!’
‘ কি?’
‘ আমি তোমায় সত্যিই ভালোবাসি পূর্ণতা।’
‘ মেয়ে পাচ্ছেন না বলে আমার পিছনে পড়েছেন? পড়েও বা লাভ কি? আমি ম্যারিড!’
তখন রাগে তন্ময় অস্থির। খপ করে পূর্ণতার হাতটা ধরে ফেলে ও,
‘ কথাবার্তা বুঝে শুনে বল। আমার পেছনে মেয়ের অভাব না, তবুও তোর পেছনে পড়ে আছি কেন, জানিস না?’
‘ ভাষা ঠিক করুন, এতো মানুষের মধ্যে চ’ড় না খেতে চাইলে হাত ছাড়ুন জলদি।’
তন্ময় হাত ছাড়েনা। বরং আরও শক্ত করে ধরে। ঠিক তখনই গাল জ্ব’লে উঠার ন্যায় এক থাপ্প’ড় গালে পড়ে ও। ব্যাপারটা ধরতে ওর সময় লাগে সেকেন্ড কয়েক। পরপরই হাত আপনা আপনি ছেড়ে দেয়। হাত ঝা’ড়া দিয়ে সামনের দিকে এগোয় পূর্ণতা। আশেপাশের স্টুডেন্টস-রা হতবাক হয়ে তাকিয়ে তন্ময়ের দিকে। রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে যায় তন্ময়।
_
ভার্সিটি শেষে একটা রিকশা ফ্ল্যাটে ফিরে পূর্ণতা। পুরো ফ্ল্যাট খালি। ফ্রেশ হয়ে তরকারি চুলোয় বসাতেই বর্ষার কল এল। কল ধরতেই বর্ষা গড়গড় করে বলে উঠল,
‘ তন্ময়কে ওভাবে থা’প্পড় দেয়া ঠিক হয়নি রে! তাও এতো মানুষের সামনে! ওর বাবা যদি জানতে পারেন, তাহলে?’
‘ অস’ভ্যতামি করেছিলো, তাই চ’ড় খেয়েছে। এ ব্যাপারে কথা বলতে মন চাইছেনা আমার।’
‘ ফ্ল্যাটে একা তুই?’
‘ হ্যাঁ, কেনো?’
‘ এমনি, সম্পর্কটা মেনে নিয়েছিস তাহলে?’
‘ আমি শুরু থেকেই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা চালাচ্ছি বর্ষা। কিন্তু একা একা তো আর সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায়না। অন্য দিকটা থেকেও তো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য জোর দরকার।’
‘ বুঝতে পেরেছি।’
টুকটাক কথা সেড়ে ফোন রাখতেই কলিংবেল বেজে উঠল। হন্তদন্ত হয়ে ছুটল পূর্ণতা। দরজা খুলে ইয়াভকিনকে দেখে সরে আসে। ইয়াভকিন একপলক ওর দিকে তাকায়। মেয়েটার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কোমর আর কাঁধে আড়াআড়ি ভাবে ওড়না বাঁধা। তার উপর হাতে খুন্তি। সেটা দেখে ভ্রু কুঁচকে আসে ওর। অফিস ব্যাগটা সোফার উপর রেখে টাই ঢিলে করে বলে,
‘ খুন্তি কেনো? মা-র-তে এসেছ?’
‘ তাড়াহুড়োয় নিয়ে এসেছি।’
বলতে বলতে সে ছুটে রান্নাঘরের দিকে। মেয়েটা রান্না করার সময় বেশ অস্থির থাকে। ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে আচমকা হেসে ফেলে ইয়াভকিন।
_
রাত তখন এগারোটার উপর। কিচেনে কি যেন করছে পূর্ণতা। স্টিলের সব জিনিসপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সরিয়ে রাখছে। সোফায় বসা ইয়াভকিন টিভি দেখতে দেখতে হাই তুললো। এরপরই টিভি অফ করে ধুম করে উঠে দাঁড়াল। কিচেনের পাশটায় দাঁড়িয়ে বলল,
‘ ঘুমাবা না নাকি?’
‘ আপনি যান না, আমি কাজ সেড়ে আসছি।’
‘ সিওর? চলে যাবো? একা একা থাকবে এখানে?’
থমকে গিয়ে তাকাল পূর্ণতা। লোকটা ওর মনে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। তার মানে কালকে ইয়াভকিনই জেনে বুঝে ভয় দেখিয়েছে ওকে? ব্যাপারটা ধরতে পেরেই পূর্ণতার মাথায় রাগ চাপলো। তবুও সেসব প্রকাশ না করে ভয় পাওয়ার ভান করে বলল,
‘ না না, চলুন।’
বলতে বলতে এগিয়ে গেল। ইয়াভকিন সেসব দেখে মুখ টিপে হাসে। সেটাও ধরে ফেলে পূর্ণতা। আড়চোখে। দুই রুমের ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে পূর্ণতা হাঁসফাঁ:স করা শুরু করল। ইয়াভকিন বলল,
‘ যাও ঘুমাও।’
‘ আমি আপনার সাথে ঘুমোলে খুব সমস্যা হবে?’
ইয়াভকিন ভাব নিয়ে বললো,
‘ ভয় পাচ্ছ নাকি? পাওয়ারই কথা। আমি নাহয় ছেলে মানুষ, ভূত-টুতের সাথে লড়াই করতে পারবো। কিন্তু তুমি তো ভূতকে দেখলেই অজ্ঞান হয়ে যাবে। যাইহোক, আমার সমস্যা নেই।’
তিরস্কারটা নিতে পারলনা পূর্ণতা। এতো এতো কথা শুনিয়ে ইয়াভকিন চলল রুমের দিকে। কি নির্বিকার তার ভঙ্গি! পূর্ণতা নিজেকে শান্ত করে চললো ওর পিছু পিছু। বিছানায় মাথা লাগানোর আগ মুহুর্তে খুব সুন্দর এবং ভয়া’নক এক কান্ড ঘটানোর পরিকল্পনা সাজালো মাথায়! ভেবেই পৈশা’চিক আনন্দ পাচ্ছে সে, আহা!
চলবে।
#বৃষ্টিস্নাত_তুমি – (১১)
হুযাইফা মাইশা
মধ্যরাত। আবছা আলো রুমে বিরাজমান। পর্দার আড়াল হতে ক্ষীণ আলোটা রুমে আসছে। ঝলমল না করলেও আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে সব।
এপাশ ফিরে শুতেই হাতখানা পড়ল পাশের জায়গাটায়। ইয়াভকিন ঘুমের ঘোরেই হাত বুলাল তাতে। জায়গাটা খালি— বুঝতে সময় লেগেছে। ঘুম ভাঙ্গতেও সময় লেগেছে। পিটপিট করে চোখ খুলে সর্বপ্রথম জায়গাটায় চোখ বুলাল। এরপর আবছা আলোয় মাখামাখি হওয়া রুমটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল।
পূর্ণতা তখন তার ঠিক উলটো দিকে দাঁড়িয়ে। খানিকটা এগিয়ে আসে শব্দহীন পায়ে হেঁটে।
মুখের উপর কয়েক গোছা পাতলা চুল উড়ু উড়ু করছে। হাত দিয়ে সরানোর চেষ্টা করতেই চুলগুলো আরো ঝুঁকিয়ে দিলো কেউ। পুরো মুখশ্রীতে সেগুলো এসে পড়তেই কপাল, মুখ কুঁচকালো ইয়াভকিন। তক্ষুনি চুলগুলো সরে গেল। ইয়াভকিনের চোখ-মুখ স্বাভাবিক হল। ঘুমানোর ভান ধরে পড়ে রইল। পূর্ণতা তখন গিয়ে বারান্দার পাশের জানালাটার দিকে এগিয়ে গেল। জানালাটায় কেবল থাই গ্লাস, গ্রিল নেই। থাই গ্লাস খোলার কারণে হুহু করে বাতাস প্রবেশ করছে রুমে। ফ্যান আগেই বন্ধ করে দিয়েছে। পুরো রুমে ঠান্ডা বাতাস। জানালায় কোনোমতে পা ঝুলিয়ে বসলো পূর্ণতা। পরনের সাদা বড় চাদরটা ওর থেকেও বড়। সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তার উপর চুলগুলো সব সামনের দিকে এনেছে। আবছা আলোয় দেখতে কষ্ট হচ্ছে। বসার পর অদ্ভূত স্বরে আওয়াজ বের করল। তাতেও যখন ইয়াভকিন সাড়া দিলোনা, তখন সে নেমে পড়লো। পায়ে নুপুর পড়লো নিঃশব্দে। এই নুপুর গুলো ও কিনেছিল মেলা থেকে। পড়া হয়নি কখনো। আজ সেই সুযোগ এসেছে! নুপুর পায়ে শব্দ তুলে সে বিছানার পাশটায় আসলো। মুখ ঝুঁকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো ইয়াভকিনের দিকে। থুতনিতে আলতো হাত বুলিয়ে সুরসুরি দেয়ার চেষ্টা চালাল। ব্যর্থ হয়ে সোজা দাঁড়িয়ে গেল। নুপুরের আওয়াজ তোলা শুরু করল অনবরত। তক্ষুনি ইয়াভকিন চট করে তাকালো। আবছা আলোয় ঘোলাটে চোখের ওমন দৃষ্টি দেখে ভড়কালেও বিচলিত হলোনা পূর্ণতা। ইয়াভকিন উঠে বসে বলে উঠে,
‘ নাটক শেষ?’
আওয়াজ থামায় পূর্ণতা। অদ্ভুত ভাবে তাকায় ইয়াভকিনের দিকে। চুলগুলোর কারণে একচোখটা খেয়ালে আসে ইয়াভকিন। সে বিরক্ত হয়ে পূর্ণতার হাত খপ করে ধরে, টান দিয়ে বিছানায় ফেলে। এরপর এক টানে পরনের চাদর সরিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। চুলগুলো দু’দিকে সরিয়ে ওর দু’পাশে হাত রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
‘ তুমি নিজেকে চালাক মনে করলেও তুমি কিন্তু ভীষণ বোকা পূর্ণতা।’
তেঁতে উঠে পূর্ণতা,
‘ নির্ল-জ্জ পুরুষ মানুষ! আমার সাথে থাকার জন্যে ভূতের কথা বললেন কেন?’
‘ একই কাজ তো তুমি করলে, আমাকে ভয় দেখানোর জন্যে আমার সাথে থাকতে চাইলে। এর একটা শা’স্তি হওয়া উচিত নয় কি?’
‘ বেশ করেছি, উপর থেকে সরুন। গায়ে পড়ছেন কেন!’
পূর্ণতার গলায় মুখ ডুবালো ইয়াভকিন। ভর ছেড়ে দিয়ে, ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,
‘ এভাবে সারারাত শুয়ে থাকবো। নড়চড় করলে খবর আছে আজ। ভূত সাজার শখ একদম বের করে দিব।’
এক মূহুর্তের জন্য শান্ত হলেও পরক্ষণে চেঁচিয়ে উঠে পূর্ণতা। ইয়াভকিন আলতো হাতে মুখ চেপে ধরে ধ’মকে বলে,
‘ এতো রাতে চেঁচিয়ে মানুষ জাগানোর ইচ্ছা আছে নাকি? মানুষজন উল্টা পালটা ভাববে। তার চেয়ে বরং এভাবেই শুয়ে থাকো।’
অশান্ত, অস্থির হলো পূর্ণতা। ছটফট করতে করতে কেঁদে দিল। হতভম্ব ইয়াভকিন তাকে মুক্ত করে দিয়ে উঠে বসল। হাত বাড়িয়ে পূর্ণতার গাল ছুঁয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ কাঁদছ কেন? এদিকে তাকাও, এই মেয়ে?’
পূর্ণতা পেছনে সরে বসল। কাঁদার মাঝেই আচমকা হেসে ফেলল। ইয়াভকিন ভেবেছে সে সত্যিই কাঁদছে। ছাড়া পাওয়ার জন্যে এর থেকে ভালো উপায় মাথায় আসেনি ওর। খিলখিল করে হাসতেই ইয়াভকিনের মুখশ্রীতে চিন্তার লেশ দেখা দিল। সে গম্ভীর মুখে বলল,
‘ তোমায় সত্যিই ভূতে ধরেছে। এ ভূত ছাড়াতে হবে।’
বলতে বলতে সে এগিয়ে যায়। আগের ন্যায় নিজের বাহুতে পূর্ণতাকে ব’ন্দি করে নিয়ে শুয়ে পড়ে। হতভম্ব পূর্ণতার নিঃশ্বাস নেয়ার জো নেই। তবুও ছটফট করছে। এবার আর কেঁদে কুটে লাভ হলোনা! ইয়াভকিন সেই ফাঁদে পা-ই দিলোনা…
_
সকাল বেলা উঠে নিজের বাহুতে পূর্ণতাকে দেখে খানিকটা থমকালো বটে। তবে, চমকালো না ইয়াভকিন। মেয়েটা ছাড়া পাওয়ার জন্য কেঁদেছে খানিকটা। ছাড়া না পাওয়ায় ঠোঁট উল্টিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমের ঘোরেও বাঁধন খুব বেশি ঢিলে হয়নি।
ইয়াভকিন আলগোছে মেয়েটার মাথা বালিশে রেখে উঠে পড়লো। গা ঝাড়া দিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে নিল একসাথে। বেরিয়ে দেখল পূর্ণতা উঠে গেছে। বসে বসে ঝিমুচ্ছে। চোখ কচলাচ্ছে একটু পর পর। ইয়াভকিন নিজেকে গম্ভীর করে এগিয়ে গেল। চুল ঝাড়া দিয়ে পানি ফেলল পূর্ণতার উপর। মেয়েটা চমকে উঠল। মাথা উপরে তুলে তাকাল। ইয়াভকিন প্রশ্ন রাখল,
‘ রাতে এটা কি করলে তুমি?’
‘ কি?’
‘ বুঝতে পারছ না?’
‘ না।’
‘ এমন একটা কান্ড ঘটিয়ে, তুমি কিনা বলছো…’
কথা সম্পূর্ণ করার আগে উঠে দাঁড়ায় পূর্ণতা। ইয়াভকিনকে বলতে না দিয়ে নিজে বলে উঠল,
‘ আপনি অনেক খারাপ। সামান্য ভয় দেখাতে চেয়েছি বলে ওমন করার কি দরকার ছিল?’
রাগে গজগজ করতে করতে মেয়েটা বেরিয়ে গেল। ইয়াভকিন সেদিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়।
_
ভার্সিটির বাইরের পাশটায় তুমুল ভীড়। পূর্ণতার ক্লাস শেষ হয়েছে সবে। বের হয়ে এমন একপাশে ভীড় দেখে খানিকটা চমকালো বটে। নওশিন এসে দাঁড়াল পাশে। ওদিকে তাকিয়ে বলল,
‘ ফার্স্ট ইয়ারের এক ছেলেকে আধ’মরা করে ফেলেছে।’
পাশ থেকে বর্ষা প্রশ্ন রাখল,
‘ কে মে’রেছে?’
‘ জানিনা।’
‘ একটু দেখে আসি?’
পূর্ণতা মানা করলনা। চাপা কৌতুহলে তিনজনে ওদিকটায় পা বাড়াল। বেশ ভীড়। একটু দূর হতে দেখার চেষ্টা চালাল পূর্ণতা। কাছে যাওয়ার জন্য সাহসে কুলোচ্ছে না বিধায় দাঁড়িয়ে গেল। ভীড় ঠেলে ততক্ষণে ওদিকটায় এগিয়ে গেছে বর্ষা আর নওশিন। মেয়ে দু’টোর এতো কৌতুহল!
পূর্ণতা ফিরে আসতে নিলেই কোমরে হঠাৎ কারো হাতের ছোঁয়া টের পেল। তড়াক করে ঘাড় ঘুরানোর আগেই সে ঘাড়ের পাশটায় ও হাত রাখল। ফিসফিস করে কানের কাছে বলল,
‘ থা’প্প’ড়ের জবাব এভাবেই পাবে তুমি পূর্ণতা।’
পূর্ণতা নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাল। মানুষ আশেপাশে বিধায় তন্ময় তাকে অল্প সময়েই ছেড়ে দিল। ভীড়ের মধ্যে মিশে যেতে যেতে অদ্ভুতভাবে হেসে তাকিয়ে রইল পূর্ণতার দিকে।
যেভাব পারল, সেভাবেই ঠেলেঠুলে বের হলো পূর্ণতা। নিশ্চুপ হয়ে ফ্ল্যাটে ফিরলো একটা রিকশায় চড়ে। ব্যাগটা সোফার উপর শব্দ করে রেখে শাওয়ারের নিচে গিয়ে বসল। ছেলেটার হাতের ছোঁয়া কেমন বি’শ্রী লাগছে ওর! গা গুলিয়ে আসছে! আত্মসম্মানে কি আঘা’তটাই না লাগলো ওর। কতোক্ষণ ওমন চুপ করে থেকে ফুঁপিয়ে উঠল। সর্বদা শক্ত থাকার চেষ্টা করলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজেকে ধরা রাখা যায়না। নিজেকে ধাতস্থ করলো প্রায় ত্রিশ মিনিট সময় নিয়ে। অতঃপর ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কাপড় পালটে বের হলো। ঘড়িতে বাজে তখন আড়াইটে। খালা সকালে রান্না করে গেছেন। কলিংবেলের আওয়াজে সে ওদিকে পা বাড়ায়। দরজা খুলে দিতেই ইয়াভকিন প্রবেশ করে। মেয়েটার মুখের দিকে লক্ষ্য করলনা। হন্তদন্ত পায়ে সোফায় বসে গা এলিয়ে দিল। এসি অন করে এবার পূর্ণতার দিকে তাকাল। মেয়েটা চুপচাপ চলে যাচ্ছিল, ওর ডাকে থেমে গেল,
‘ এই মেয়ে, দেখি এদিকে আসো।’
যন্ত্রের ন্যায় এগিয়ে এল পূর্ণতা। নত মস্তকে দাঁড়িয়ে। ইয়াভকিন শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন রাখল,
‘ কেঁদেছো কেনো?’
জবাব না পেয়ে উঠে দাঁড়ায় ইয়াভকিন। টাই খুলে ছুঁড়ে ফেলে সোফার দিকটায়। এগিয়ে এসে থুতনি ধরে পূর্ণতার মুখ উঁচু করে ধরে। নাকের ডগা লাল মেয়েটার। সূক্ষ্ণ ভাবে লক্ষ্য করলেই চোখের নিচের লেপ্টানো সামান্য কাজলটুকু দেখে ফেলা যাবে। সেদিকেই লক্ষ্য রেখে ইয়াভকিন বলল,
‘ অকারণে, যার তার কারণে কাঁদবে না। চোখের জল যেন শুধু আমার সামনে গড়িয়ে পড়ে, কাজল যেন শুধু আমার সামনে লেপ্টে যায়, সেটা আমার জন্যেই হোক। কেউ কাঁদাতে চাইলে তাকে আমি দেখে নিব, গট ইট?’
চলবে।