বৃষ্টিস্নাত তুমি পর্ব-০৯

0
298

#বৃষ্টিস্নাত_তুমি – (৯)
হুযাইফা মাইশা

ইয়াভকিন একনজর তিহার দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমের দিকটায় তাকালো। পরপরই গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘ যেচে রিলেশন করেছিলি। পেছনে কি করে পড়েছিলি মনে নেই? বিয়ে যেভাবেই হোক ও আমার ওয়াইফ। তুই এমন ইম্পর্ট্যান্ট কেউ না যে তোর কাছে বউকে দেখাতে নিয়ে আসবো।’
‘ প্রপোজ আমি করলেও বা কি, দুই মাসে তো ইন্টারেস্ট তোর কম ছিলোনা। এখন বউয়ের সামনে ভালো সাজছিস!’
‘ ফালতু কথা বন্ধ কর। তোর সাথে কথা বলার মুড নেই আমার।’

হঠাৎই পূর্ণতা বের হলো। কুঁচি সামলিয়ে গটগট পায়ে টেবিলের দিকটায় এগিয়ে যেতে শুরু করলো। তাকে নজরে আসতেই ইয়াভকিন তার পিছু পিছু সেদিকে পা বাড়ালো। পেছনে তিহা ভ্রু কুঁচকিয়ে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। মেয়েটা কোনোদিক দিয়ে কম না। যদিও ইয়াভকিনের সাথে জোর করেই রিলেশন করেছে। ছেলেটা প্রথমে ইন্টারেস্ট দেখালেও তিহার খামখেয়ালিপনা আর খোলামেলা চলা ফেরাই আলাদা হওয়ার মূল কারণ। অতীতের কথা মাথায় আসছে বারবার। ইয়াভকিন আর পূর্ণতাকে একসঙ্গে দেখাই সেটার কারণ।

পূর্ণতা চেয়ারে বসতেই পাশের দুই চেয়ার দখল করলো ইয়াভকিন আর তিহা। যদিও তিহা একটু পর এসেছে। ইয়াভকিন আড়চোখে তাকালো পূর্ণতার দিকে। মেয়েটার চোখমুখ অত্যন্ত স্বাভাবিক। হেসে হেসে ইয়াভকিনের আরেক বন্ধু, সোহানের ওয়াইফের সাথে কথা বলছে। স্বস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো ইয়াভকিন। পাশে বসা শান্ত পূর্ণতার ভেতরকার তান্ড’ব চলা, অশান্ত মনটার অবস্থা একটুও আঁচ পেলোনা ও।

_

সন্ধ্যায় সকল আড্ডার ইতি ঘটিয়ে যার যার বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো সবাই। নিচ অব্দি সকলে একসঙ্গে নামলো। ইয়াভকিনের পাশটায় তিহা ঘুরঘুর করছে। পূর্ণতা খেয়াল করেছে। বিশেষ ধ্যান না দেয়ায় তিহা মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। ইয়াভকিন সোহানের দিকে তাকালো। সোহান বুঝে ফেললো ওর দৃষ্টি। তিহার উদ্দেশ্যে গলার স্বর উঁচু করে বলল,
‘ তিহা, এদিকটায় আয়। দরকার আছে।’

তিহা গেলো ওদিকে। ততক্ষণে সবাই রাস্তার ধারে। যার যার গাড়িতে উঠছে। ইয়াভকিন চট করে পূর্ণতার হাত ধরলো। গাড়ির দিকে অগ্রসর হলো পরপরই। ঝাঁ’ড়া দিয়ে হাত ছাড়িয়ে গাড়িতে উঠে পড়লো পূর্ণতা। শান্ত হয় বসার চেষ্টা করলো। পারলোনা। ইয়াভকিনের সাথে তিহার সম্পর্ক ছিলো। সেটা নিশ্চিত। ব্যাপারটা ইয়াভকিন বলেনি। অবশ্য ও জানতেও চায়নি।

ড্রাইভিং সিটে বসে সিট বেল্ট লাগিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো ইয়াভকিন। অন্যদিকে তাকিয়ে হাঁস:ফাঁ:স করা পূর্ণতাকে একবার পরখ করে, তার দিকে ঝুঁকে এলো, হাত বাড়িয়ে সিট বেল্ট লাগিয়ে সরে এলো। পূর্ণতার সেদিকে বিশেষ ধ্যান নেই। আপাতত তার দৃষ্টি জানালা গলিয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা তিহার দিকে। মেয়েটা এদিকেই তাকিয়ে। মুখে লেপ্টে হাসি। তাকে দেখেই হাসছে। কি কারণে, কে জানে!
গাড়ি স্টার্ট দিতেই পূর্ণতার ধ্যান ভাঙ্গল। খানিক্ষণ চুপ থেকে রাস্তার দিকে মনোযোগ দিলো। একটু পরই উৎকণ্ঠা হয়ে বলল,
‘ এটা তো এপার্টমেন্টের রাস্তা না। উল্টো যাচ্ছেন কেনো?’
‘ তোমায় কে বললো এপার্টমেন্টে যাচ্ছি?’
‘ এখন কোথায় যাচ্ছেন তবে? ফ্ল্যাটে চলুন।’
‘ আরেকটা জায়গায় যাবো। চমৎকার জায়গা, ভালো লাগবে।’
‘ গাড়ি ঘুরান। নয়তো নামিয়ে দিন আমায়, রিকশা নিয়ে ফিরবো। আমার ভালো লাগছেনা, প্লিজ।’

মেয়েটা কথা বলতে বলতে অশান্ত হলো। অস্থির হলো। গলার স্বরও কাঁপা কাঁপা। ইয়াভকিন হঠাৎ গাড়ি থামালো। তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এলো। বলল,
‘ রিল্যাক্স, কি প্রব্লেম? হাই’পার হচ্ছো কেনো?’
‘ কিছুনা, সরুন। আমি বাসায় যাবো। আমার ভালো লাগছেনা।’
‘ চার দেয়ালে বন্ধি থাকার চেয়ে প্রাকৃতিক জায়গায় একটু বাতাস খেলেও মন ভালো হয়, জানো?’
‘ আমি চার দেয়ালেই স্বস্থিবোধ করবো এখন। আপনি যান, আমি বরং নেমে যাই। ‘

সিট বেল্ট খুলে ফেলেছে ততক্ষণে পূর্ণতা। দরজা খুলতে উদ্যত হতেই ইয়াভকিন থামিয়ে দিলো। মহা ধ’মক দিয়ে বলল,
‘ বাড়াবাড়ি করবেনা একদম। গাড়ি ঘুরাচ্ছি। নামতে বলেছি, যে নামছো?’

আগের জায়গায় বসে মাথা নত করে পূর্ণতা। ইয়াভকিন গাড়ি ঘুরায়। নিজেকে ধাতস্থ করে আস্তে করে বলে,
‘ শান্ত হও।’
_

ফ্ল্যাটে ফিরে সর্বপ্রথম রুমে ঢুকে ধরাম শব্দে দরজা লাগায় পূর্ণতা। সে শব্দে নিস্তব্ধতায় ঘেরা ফ্ল্যাটটা কেঁপে উঠে। মেইন দরজা লাগিয়ে একবার সেদিকে তাকায় ইয়াভকিন। ধুপধাপ পা ফেলে এগিয়ে যায় রুমের দিকে।

পূর্ণতা রুমে এসে কাপড় পালটে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। কানের কাছটায় তিহার কথাগুলো ভাসছে। লোকটা জীবনে কি ঘটলো না ঘটলো, তাতে ওর ইন্টারেস্ট ছিলোনা কখনই। এখন কি করে এতো ইন্টারেস্ট জাগলো? আর এমন অদ্ভুত লাগার তো কথাই নয়। আশ্চর্য ব্যাপার-স্যাপার। বালিশে মুখ গুজে নেয়। শাড়িটা এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে ফ্লোরে। চুড়িগুলোর কয়েকটা মাটিতে পড়ে ভেঙে গেছে। কালো রঙের কাঁচের চুড়ি। প্রিয় চুড়ি ওর। সেই প্রিয় চুড়ি ভেঙে গুড়িয়ে গেছে, কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই।

রাতের বেলা খাবারের জন্য ইয়াভকিন ডাকতে আসে। দরজায় নক করতেই মুখের উপর ধুম করে বলে উঠে পূর্ণতা,
‘ আমার কিছু লাগবেনা। আমি এখন ঘুমাবো। ডিস্টার্ব করবেন না।’

চাপা রাগ তখন চড়ে বসে ছেলেটার মাথায়। বে’য়াদব মেয়ে! বারবার এমন দূরদূর করার কারণটাতো তো বলবে? ইয়াভকিন বড় বড় পা ফেলে রুমে আসে। অশান্ত নিজেকে শান্ত করতে সিগা’রেট ধরায়। জানালার গ্রিল একহাতে আকড়ে ধরে। পূর্ণতার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে বারবার।
তিহার সাথে সম্পর্ক থাকাকালীন এমন অনুভব হয়নি কোনোদিন। বরং মেয়েটাকে দিনকে দিন বিরক্তিকর লাগতো। মেয়েটা সাত মাস ওর পিছু পিছু ঘুরেছে। শেষবার প্রপোজ করার পর মুখের উপর না বলায় মেয়েটা সুই’সাইড করার হুম’কি ধা’মকি দিয়েছে। সেদিকে ও পাত্তা দেয়নি কিন্তু বন্ধুমহলের বাকিরা ততোদিনে সব জেনে গেছে। ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে চাইছিলো ইয়াভকিন। বন্ধুত্ব ভাঙ্গতে চায়না, এই তার কারণ। শেষমেশ বন্ধুদের জোরাজুরি আর তিহার অতিষ্ঠ করে তুলা আচরণের কারণে ওমন একটা টক্সি’ক রিলেশনে যেতে হয়েছে। তবে সেটা টিকেছেও খুব কম সময়। ততোদিনে আবেগ টাবেগ কেটে গেছে তিহার। ফাইনাল ইয়ারের শেষ দিকে ব্রেকাপ হওয়ায় পরীক্ষা শেষে আর দেখা হয়নি ওদের। অন্য বন্ধুবান্ধবদের সাথে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করতো ইয়াভকিন। তবে, নিজ থেকে কোনোদিন তিহাকে কল কিংবা ম্যাসেজ অব্দি দেয়নি।

হাতের সিগা’রেট ফুড়িয়ে যায়। হঠাৎ কিছু একটা শান্ত হয় ইয়াভকিন। পূর্ণতা কি বিকালে ওদের কথা শুনে নিয়েছে? শোনারই কথা। ওয়াশরুম থেকে জায়গাটার দূরত্ব ছিলো খুবই নগণ্য!

_

রাত একটা বাজে। গভীর রাত। ক্ষিদের তাড়নায় পা টিপে টিপে বের হলো পূর্ণতা। সেই সন্ধ্যার দিকে রেষ্টুরেন্টে হালকা পাতলা খাবার খেয়েছে। ক্ষিদে তো লাগবেই। সেই ক্ষিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে বেরিয়ে আসে রুম থেকে। লাইট না অন করেই অন্ধকার হাতড়িয়ে এগিয়ে যায় রান্না ঘরের দিকটায়। হঠাৎ স্টিলের কিছু মাটিতে পড়তেই কেঁপে উঠে পূর্ণতা। ভূত-প্রেতে ওর বিশ্বাস ছিলোনা কোনোকালেই। ছোটবেলায় গল্প শুনলেও বড় হওয়ার সাথে সাথে সেসব বিষয় মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হয়েছে। কিন্তু এমন ঘুটঘুটে, নিরব ফ্ল্যাটে হুট করে এমন শব্দ হওয়াটা অস্বাভাবিকই বটে। ছয়তলায় নিশ্চয়ই বিড়াল আসবেনা। আর ইয়াভকিনের রুমের লাইট অফ। সব দিক পর্যবেক্ষণ করতেই মাথা ভনভন করে উঠে ওর। ঘাড় উলটো দিকে ফিরিয়ে নিয়ে জোরে নিঃশ্বাস নেয়।

ততক্ষণে রান্নাঘরের দিকটা থেকে সরে এসেছে ইয়াভকিন। পূর্ণতাকে যদিও সে আশা করেনি। অন্ধকারের মধ্যে ধীরে ধীরে পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে লাইট অন করতেই চমকে উঠে পূর্ণতা। চেঁচানোর আগ মুহুর্তেই চোখ যায় ইয়াভকিনের দিকে। পরপরই ওর কাছ ঘেষে গিয়ে দাঁড়ায়। কাঁপা স্বরে বলে,
‘ কিচেনে আপনি ছিলেন?’

কিছু একটা ভেবে ইয়াভকিন উত্তর দেয়,
‘ না তো, কেনো?’
‘ কিছু একটা পড়েছে, শুনেননি আওয়াজ?’
‘ না।’
‘ তাহলে উঠেছেন কেনো!’
‘ পানি খেতে।’
‘ লাইট অন করেননি কেনো?’
‘ ফ্ল্যাটের কোণা কানা আমার মুখস্থ হয়ে গেছে দেড় বছরে। সামান্য পানি খেতে লাইট অন করা লাগেনা।’
বুক ফুলিয়ে বলে উঠে ইয়াভকিন। চুপসে যাওয়া মুখে কিচেনের দিকে তাকায় পূর্ণতা। একটু থেমে বলে,
‘ আচ্ছা, এদিকে আসুন তো একটু।’

দু’জনে পা মিলিয়ে যায় ওদিকটায়। কিচেনের মেঝেতে স্টিলের গ্লাসটা পড়ে আছে। সেটা দেখে চেঁচিয়ে উঠে পূর্ণতা,
‘ দেখুন, গ্লাস পড়েছে। তাহলে শব্দ শুনেননি কি করে?’
‘ আসলেই শুনিনি।’

চুপসে যাওয়া মুখখানা আরও চুপসে গেলো। হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা তুলে রেখে আগের ন্যায় ইয়াভকিনের পাশ ঘেষে দাঁড়ালো। ভয়টা লাগতোনা, যদি ইয়াভকিন বলতো, তার হাত লেগেই গ্লাসটা পড়েছে। পূর্ণতার চিন্তিত মুখ হেসে বেশ হাসি-ই পায় ইয়াভকিনের। অধর গলিয়ে ফুটে উঠে অস্পষ্ট বাঁকা হাসি। অবশ্য সেটা পূর্ণতার তাকানোর আগেই মিলিয়ে যায়। ইয়াভকিন যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। পিছু পিছু আসে পূর্ণতা। রুমে যাবে কি যাবেনা এই ভেবেই কূল পাচ্ছেনা। ইয়াভকিন নিজের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও থেমে যায়। মেয়েটা এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। চিন্তিত, অস্থির মুখ। এলোমেলো চুল। গভীর মনোযোগ সেসব পর্যবেক্ষণ ছেড়ে ধীর কণ্ঠে বলে উঠে,
‘ ওকে, রিল্যাক্স মিসেস, আজ আমার রুমেই শুতে পারো। যদি প্রব্লেম না থাকে।’

চলবে।