বৃষ্টি_এবং_মায়াবতী ৪র্থ পর্ব ( শেষ পর্ব)

0
1742

বৃষ্টি_এবং_মায়াবতী
৪র্থ পর্ব ( শেষ পর্ব)
***********
৭.
আসিফের অন্যত্র বিয়ে করবার সংবাদ ইদ্রিস মোল্লার কানে পৌঁছতে বেশি দেরী হলো না। ভয়ংকর অপমানে তার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগলো। ছেলের মা আংটি পরিয়ে যাবার পর প্রায় মাসখানেক ধরে তিনি এই বিয়ে উপলক্ষে কেনাকাটা করছেন। বাড়ির প্রথম বিয়ে, তিনি নিজে ময়মনসিংহ গিয়ে পছন্দ করে কার্ড ছাপাতে দিয়েছিলেন। গ্রামের প্রায় সবাইকে দাওয়াত দেয়াও শেষ। এমন সময় এই খবর…। প্রচণ্ড রাগে তার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো ।

তিনি সারা জীবন নিজে যা ভালো বুঝেছেন তাই করেছেন। এই প্রথম স্ত্রীর কথায় ভরসা করে এই বিয়েতে রাজি হওয়াটাই যে তার চরম রকম ভুল ছিল বোঝা যাচ্ছে… । সমাজের কারো কাছে আর মুখ দেখানোর জো রইলো না।

তিনি সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফিরলেন। তার শরীর দিয়ে টপটপ করে ঘাম বেরুচ্ছে। চোখ দুটো টকটকে লাল। রোকেয়া খানম পানি হাতে তার কাছে পৌঁছানো মাত্র তিনি প্রচণ্ড ক্রোধে উন্মাদের মতো ঝাপিয়ে পড়লেন তার উপর । তিনি এক নাগাড়ে কিল, ঘুষি, লাথি মারছেন। বাঁধা দিতে যে এগিয়ে আসছে তাকেও ছাড়ছেন না।
চিৎকার করে বলছেন,
‘সবগুলারে আইজ শেষ করুম। আমার সাথে ফাইজলামি..! ‘
চিৎকার শুনে পাড়া প্রতিবেশীরা ছুঁটে এলেও ইদ্রিস মোল্লাকে থামানো গেল না।

তিনি পাগলের মতো আচরণ করছেন। দেখতে দেখতে হঠাৎ নাক, মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে এলো, তিনি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। সেই জ্ঞান আর ফিরলো না।

*****
ইদ্রিস মোল্লার মৃত্যু হয়েছে দুই সপ্তাহ ।
নীলু বিকালে বাড়ির পাশে তাদের বড় বরই গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে ছিল। দিলু এসে পাশে দাঁড়ালো। নীলু বিড়বিড় করে বললো,

—- দিলু কেউ যদি পাপ করে তাহলে তার উচিত না প্রায়শ্চিত্ত করা?
— এই কথা ক্যান বলতেছ আপা?
— না, এমনেই। সেইদিন সীমা বলতেছিল জামাল ভাইরে সে বাস স্ট্যান্ডের কাছে ডাক্তার সাহেবের সাথে কথা বলতে দেখছিল।
দিলু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
— আমারও ধারণা জামাল ভাই কোন প্যাঁচ লাগাইছে। আজকাল তার মন কত ভালো থাকে দেখ না আপা।
নীলু আপন মনে বিড়বিড় করলো,
— আর দেরী করা ঠিক হবে না। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার এবার সময় হইছেরে দিলু…।

৮.
জামাল নেশা করে মধ্যরাতে ঘরে ফিরছিল। বাইরে ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার। আচমকা নীলু রাস্তার পাশের অন্ধকার ঝোপের ভেতর থেকে ডাক দিল,

— জামাল ভাই একটা কথা আছিল। একটু এইদিকে আসবা ?

জামালের মনে হলো আজ তার নেশা বেশি হয়েছে। কানে ভুল শুনছে না তো ! সে চোখ কচলে তাকালো। না, নীলু বলেই তো মনে হচ্ছে…।

…নেশার ঘোরে তার স্বাভাবিক বিচারবোধ লোপ পেয়েছে। কোন অস্বাভাবিকতা তার চোখে ধরা পড়লো না।

সে জড়ানো গলায় বললো,
— কী কথা কইতে চাস?

নীলু নীচু গলায় বললো,
— খুব জরুরি কথা জামাল ভাই। তিন বছর আগের কাহিনী। আলম স্যার ওই সময় আমাদের বাড়িতে জায়গীর থাকতেন।
— অত আগের কাহিনী এখন শুইনা কী করুম !!

নীলু একটু হাসলো।

— ঘটনা হইলো, এক রাইতে আমি একা একা টয়লেটে যাইতেছিলাম। একজন মানুষ নেশা কইরা সেই সময় ঘরে ফিরতেছিল। আমারে দেইখা সে পেছন থেইকা মুখ চাইপা ধরছিল খারাপ কাজের উদ্দেশ্যে। টাইনা নিয়া যাইতেছিল পাশের জংগলে।
… বাড়ির সবাই তখন গভীর ঘুমে অচেতন…।

আলম স্যারের ঘরটা ছিল কাছে। স্যার মধ্য রাইত পর্যন্ত পড়ত। ওই দিন শব্দ শুইনা তিনি আমারে বাঁচাইতে আসছিলেন সেই লোকের হাত থেইকা। আমারে উদ্ধার কইরা জ্ঞান ফিরাইতে নিয়া গেছিলেন তার ঘরে। পানি আইন্যা মাথায় পানি দিতাছিলেন।
আপনে সেই সময় চিৎকার কইরা লোক জড়ো করছিলেন।
…আমাদের দুইজনের নামে মিথ্যা অপবাদ দিছিলেন।

জামাল ধমকের সুরে বললো,
— আমি ? আমি ক্যান মিথ্যা অপবাদ দিমু ? আমি তো সেই রাইতে যা চোখে দেখছিলাম তাই কইছি।

নীলু অন্ধকারের ভেতর মৃদু হাসল,
— আপনে চোখে কিছুই দেখেন নাই জামাল ভাই । আপনে সেইদিন মিথ্যা অপবাদ দিছিলেন….কারন সেই রাতে আপনে নিজে আমার মুখ চাইপা ধরছিলেন।
…. জ্ঞান হারানোর আগে চান্দের আলোয় আমি নিজের চক্ষে আপনারে দেখছি।

জামাল তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,

— দেখছসই যখন তাইলে তখন কস নাই ক্যান?

— ভয়ে বলি নাই। তাছাড়া, আমার কথা কেউ বিশ্বাস করতো না। তবে না বইলা পাপ করছি। বললে আইজ আলম স্যার বাঁইচা থাকত। বাপজানও মরতো না।
আলম স্যাররে ইদ্রিস মোল্লা সত্যই খুন করাইছে কিনা জানি না কিন্তু সেই খুনের সাথে যে আপনে জড়িত তাতে আমার একটুও সন্দেহ নাই।।

এই প্রথম জামালের চোখে ভয় ফুঁটে উঠলো।

নীলু ফিসফিস করে বললো,
–আলম স্যারের মুখ বন্ধ করতে… নিজের দোষ লুকাইতে আপনে তারে খুন করছিলেন।

জামাল কী উত্তর দিবে ভেবে পেল না।
নীলু কয়েক পা এগিয়ে এলো জামালের দিকে । সে এখন দাঁড়িয়ে আছে জামালের প্রায় মুখোমুখি। প্রচণ্ড ঘৃণায় নীলুর চোখ দু’টো জ্বল জ্বল করছে।

সে গলা নামিয়ে বললো,
…. ওইদিন স্যারের খুনিরে ধরা যায় নাই। আইজ আপনার খুনিরেও কেউ ধরতে পারব না।

হঠাৎ ই … নীলু তার পরনের ওড়নার ভেতরে থেকে বের করলো লুকিয়ে রাখা চকচকে ধারালো গরু কাটার দা টা । জামাল কিছু বুঝে উঠার আগেই সে পর পর দুইবার সর্বশক্তি দিয়ে তার গলায় সজোরে কোপ বসিয়ে দিল।

জামাল কাটা কলা গাছের মতো ঝপ করে মাটিতে পড়লো। নীলু একবারও পেছনে ফিরে তাকালো না।

৯.

সেদিন, ভোর না হতেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে ..।

আকুরটাকুর পাড়ার ১৫৩/এ, একতলা বাড়িটির গেটের সামনে রিকশা থেকে নামল কলাপাতা রঙের শাড়ি পরা অসম্ভব মায়া কাড়া চেহারা, বড় বড় চোখের রূপবতী এক তরুণী। দীর্ঘদিনের দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা, চোখের নিচে পড়া গাঢ় কালি তার স্নিগ্ধতাকে এতটুকুও ম্লান করতে পারেনি।

সে খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বাড়িটির দরজায় কড়া নাড়ল।

শ্যামা ঘুমাচ্ছিল। এই বৃষ্টির মধ্যে এতো সকালে কে ঘর ছেড়ে বেরুতে পারে… ভেবে সে মনে মনে অবাক হলো। বাসার কেউই তখনো ঘুম থেকে উঠেনি। আসিফ আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। দুইদিন হলো তার শরীরটা একটু গরম, জ্বর জ্বর ভাব ছিল । তার উপর আজ এই বৃষ্টি… এ শরীরে বাইরে যাবার প্রশ্নই আসে না।

দরজা খুলে শ্যামা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল । তার সামনে দরজার বাইরে কাকঁভেজা হয়ে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে তাকে ঠিক মানুষ বলে মনে হচ্ছে না তার। বিষন্ন মুখের ঠিক যেন একজন অপ্সরী !

আহ, কী ভীষণ মায়া কাড়া মিষ্টি চেহারা! চোখ দুটো পানিতে ছল ছল করছে। মনে হচ্ছে খুব কষ্টে যেন কান্না আটকে রাখছে।

এর কথাই কি সে এতোদিন শুনেছিল ! কই মেয়েটাকে তো প্রতারক বলে মনে হচ্ছে না তার।

মেয়েটি তার দিকে বড় বড় চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীর কন্ঠে বললো,
— এটা কী ডাক্তার আসিফ সাহেবের বাড়ি?

শ্যামা নিচু গলায় বলল,
—- আপা আমি আপনাকে চিনি। আপনার নাম নীলু। আমাদের বাসর রাতেই আসিফ আমাকে আপনাদের কথা বলেছিল । আপনার কথা এতো অসংখ্যবার ওর মুখে শুনেছি যে এক পলক দেখে আপনাকে চিনতে আমার ভুল হয়নি
… আপনি ভেতরে এসে বসুন।

মেয়েটি মৃদু হাসলো।

— তার দরকার নেই । আমার হাতে সময় খুব কম। আপনাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। শেষ এই ইচ্ছেটা পূরণ হয়েছে এটাই যথেষ্ট।

মেয়েটা তার ব্যাগ খুলে ভেতর থেকে কাগজে মোড়ানো ছোট একটা বাক্স বের করল।।

— আপনার স্বামীর একটা জিনিস আমার কাছে ছিল ।

মেয়েটি পানিতে আধা ভেঁজা কাগজে মোড়ানো বাক্সটা শ্যামার দিকে বাড়িয়ে ধরল।

—তাকে বলবেন, আমার ভাগ্যে যা ছিল সেটাই হয়েছে। উনার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই ।

— কে এসেছে শ্যামা?

শ্যামার ঠিক পেছনে ঘুম ভেঙে শায়লা এসে দাঁড়িয়েছেন, অবাক হয়ে দেখছেন দরজায় দাঁড়ানো মেয়েটাকে।

শ্যামা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো।

কিন্তু মেয়েটি হঠাৎ… কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তাদের বিস্মিত চোখের সামনে তুমুল বৃষ্টির মধ্যেই রাস্তায় নেমে গেল।

শ্যামা বাক্স হাতে তার রুমে ফিরে যাচ্ছিলো। শায়লা তাকে থামালেন।

— তোমার হাতে ওটা কী শ্যামা?

শ্যামা একটু ইতোস্তত করে বললো,

— জানি না । মেয়েটা দিয়ে গেল….. আপনার ছেলের জন্য।

শায়লা.. শ্যামার হাত থেকে ছোট বাক্সটা নিলেন। বাক্সের ভেতর একটা আংটি দেখা যাচ্ছে । মাঝখানে সবুজ রঙের পাথর বসানো । আংটিটা তার অপরিচিত নয়। মাত্র কয়েকমাস আগে এই আংটিটাই তিনি নীলুকে তাদের বাড়ি গিয়ে পরিয়ে দিয়ে এসেছিলেন।

শায়লা প্রচণ্ড ঘৃণায় জানালা দিয়ে আংটিটা বাইরে ছুঁড়ে ফেললেন । গলাটা গম্ভীর করে শ্যামার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন,

—- শোন শ্যামা, তোমাকে একটা কথা বলি। যদি সংসারের শান্তি চাও। স্বামীর ভালোবাসা চাও। আজ এই মেয়ের আসবার খবর ঘুনাক্ষরে আসিফের কানে দিবানা, ভুলেও না…।

শ্যামা তার বুকের ভেতর সুক্ষ্ম একটা অপরাধবোধ অনুভব করলো কয়েক মুহুর্ত । তারপর খুব দ্রুত সেটা ঝেড়েও ফেললো । তার মনে হলো শাশুড়ি একদম সঠিক কথাই বলেছেন।

******
বৃষ্টি কমলো সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে। প্রায় সারাদিন ঘুমিয়ে কাটানোর পর আসিফ সন্ধ্যার পর পর হাঁটতে বের হলো। বড় রাস্তার মোড়ে শামসুর মুদীর দোকান। সেখানে এসে সে দাঁড়ালো। কিছুদিন হলো সে সিগারেট ছাড়বার চেষ্টায় আছে। এখন মনে হচ্ছে সেটা সম্ভব না। আজ আবার ভীষণ সিগারেটের তেষ্টা পেয়েছে। একটা সিগারেট ধরাবে কি না সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।

সামনে কিছু মানুষের জটলা দেখা যাচ্ছে । কিছু একটা নিয়ে তারা উত্তেজিত ভাবে আলোচনা করছে। তাদের কথার কিছু কিছু অংশ তার কানে ভেসে এলো।….আহারে,.. থেতলায় গেছে,..
অনেকক্ষন রাস্তায় পইড়া ছিল,.. কেউ চিনে নাই।

সে দোকানদারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— শামসু ভাই, ভালো একটা সিগারেট দাও দেখি। … আর সামনে কী হইছে। এতো লোক কেন,… কোন ঘটনা?

মুদীর দোকানদার শামসু উদাস মুখে সিগারেট বের করে দিয়ে রাস্তার দিকে তাকালো ।

— আর বইলেন না ভাইজান। সকালে একখান এক্সিডেন্ট হইছে ওই বড় রাস্তায়। বৃষ্টির মধ্যে না দেইখ্যা এক ট্রাক উঠায়া দিসে এক মাইয়ার উপরে, সাথে সাথে শেষ।

—- মেয়েটা কোথাকার? কেউ চিনে নাই?
—— কলাপাতা রঙের শাড়ি পরনে। বয়স অল্প বইল্যা মনে হয়, তয় চেহারা দেইখ্যা চিনোনের উপায় নাই। লাশ এক্কেরে থেতলায় গেছে গা।

আসিফ আকাশের দিকে তাকালো। আবার গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। সে সিগারেটের দাম মিটিয়ে রাস্তায় নেমে এলো।

— লাশ অনেকক্ষন রাস্তার উপ্রে পইড়া আছিল। ভয়ে কেউ কাছে যায় নাই। শেষে পুলিশ আইসা লাশ লয়া গ্যাছে ।

শামসুর শেষের কথাগুলো অন্যমনস্ক তরুন ডাক্তারের কানে ঠিকঠাক পৌঁছলো না। সে দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করেছে। জোরে বৃষ্টি শুরুর আগেই তাকে বাসায় ফিরতে হবে। দুই দিন ধরে এমনিতেই তার শরীর খারাপ।

আসিফ জানতেই পারলো না, ট্রাকের নীচে…. “আত্মাহুতি” দেয়া নারীটি এক সময় তার খুব কাছের কেউ ছিল। যার সাথে তার প্রথম দেখা হয়েছিল এমনই এক বর্ষন মুখর দিনে। ভুল করে যাকে একদিন “আত্মার অংশ” হবার স্বপ্ন দেখিয়েছিল সে।

~সমাপ্ত

গল্পঃ বৃষ্টি এবং মায়াবতী
লেখাঃ মাহবুবা আরিফ সুমি
২৩/৮/২০২০
**** বাস্তবে জামালদের শাস্তি কতটুকু হয় জানা নেই । তবে গল্পের মাধ্যমে হলেও একজন জামালকে যে শাস্তি দিতে পেরেছি এটাই আনন্দের। হিংসা মারাত্মক ব্যাধি। গল্প পড়ে একজন মানুষও যদি নিজেকে শুধরে নিতে পারেন সেটাই গল্পের সার্থকতা হবে।

লাইক, কমেন্ট করে যারা গল্পটি পোস্ট করতে উৎসাহ জুগিয়েছেন তাদের সবার প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।