বৃষ্টি_এবং_মায়াবতী ( ১ম পর্ব)

0
1920

বৃষ্টি_এবং_মায়াবতী
( ১ম পর্ব)

দুপুরবেলা। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে।
আসিফ মেডিকেল থেকে বেরিয়েছিল দুপুর বারোটায় । বেরিয়েই সে সোজাসুজি চলে এসেছে গাঙ্গিনার পার । এখানে রাস্তার ধারে ছোট ছোট করে পাশাপাশি বেশ অনেকগুলো দোকান আছে। তার উদ্দেশ্য ছিল একটা মশারি কেনা। পুরনো মশারিটা নষ্ট হয়ে গেছে । প্রতি রাতে মশারির ফুটো দিয়ে দল বেঁধে মশারা ভেতরে ঢুকে কানের কাছে গান গাইতে গাইতে রক্ত খায়। আলসেমি করে তার নতুন মশারী কেনা হচ্ছিল না । ডেংগু, ম্যালেরিয়া কবে হয়ে যায় কে জানে ! আজ মশারী কেনা হয়েছে ঠিকই কিন্তু তারপর রিকশায় উঠবার আগ মুহূর্তে হঠাৎ এই ঝুম বৃষ্টির কবলে পড়েছে সে । একটা ছোট বইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে আছে তাও প্রায় চল্লিশ মিনিটের মতো হলো। দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি বলে খিদায় পেট চোঁ চোঁ করছে। সময় কাটাতে বই দেখতে দেখতে দুটো গল্পের বইও কেনা হয়ে গেছে তবুও বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই। আসিফ বিরক্ত মুখে দোকানের চারপাশে তাকালো।

বিক্রেতা ছাড়াও দোকানের ভেতরে আরও একজন মানুষ আছে । হাল্কা বেগুনী রঙের সালোয়ার -কামিজ পরা একটা অল্প বয়সী মেয়ে। ঘোমটা দিয়ে মাথা ঢাকা থাকলেও মেয়েটি যে যথেষ্ট রুপবতী তা অনুমান করা যাচ্ছে । …. দেখেও ভদ্র ঘরের মেয়ে বলেই বোঝা যাচ্ছে তাকে । তবে তার আচরণ কিছুটা সন্দেহজনক। প্রথম থেকেই দোকানের একটা টুলে বসে মেয়েটি উদাস মুখে একদৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না ঘরে ফেরার কোন তাড়া আছে তার।

এমন বৃষ্টির দিনে বিক্রি বাটা তেমন একটা হয় না। মফস্বল শহর, আশেপাশের বেশির ভাগ দোকানপাটই এখন বন্ধ।

বৃষ্টি একটু কমে আসতেই আসিফ রাস্তায় নেমে এলো। রাস্তা- ঘাট মোটামুটি ফাঁকা। এইমাত্র একটা খালি রিকশা এসে থেমেছে । আসিফ রিকশায় উঠতে গিয়ে থমকে গেল। সেই মেয়েটি দোকান থেকে বেরিয়েছে, রাস্তার এক কোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওড়নায় চোখ মুচছে। ঘটনা কী কোন সমস্যা হয়েছে নাকি?
…. নির্জন রাস্তা, একটু দূরে কিছু বখাটে ছেলে ঘুরাফেরা করছে। আসিফ চলে যাবে কী না সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। কয়েক মুহুর্ত ইতোস্তত করে সে ফিরে গেল মেয়েটির কাছে।

— আপনি কোথাও যেতে চাইলে এখনই চলে যান। দাঁড়িয়ে থাকবেন না। আকাশের অবস্থা বেশ খারাপ। যে কোন মুহুর্তে আবারও বৃষ্টি শুরু হতে পারে।

মেয়েটি চমকে উঠলো। তাকে দেখে কেমন ভীত সন্ত্রস্ত মনে হচ্ছে । চোখ দুটো ফোলা ফোলা, গালে শুকিয়ে যাওয়া পানির চিহ্ন ।

আসিফের মনে হলো মেয়েটি হয়তো বড় কোন বিপদে পড়েছে । চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বয়স খুবই অল্প। সতেরো, আঠারোর বেশি হবে না হয়তো । সে গলার স্বরে আন্তরিকতা এনে বললো,

— আপনি কোথায় যাবেন বলুন। আমি রিকশা করে দিচ্ছি।

মেয়েটি ধীর কন্ঠে বলল,
— আমি বড় মামার বাসায় যাব।

— আচ্ছা, তো আপনার মামার বাসা কোথায়?
— নওমহল।
— নওমহল কোথায়? বাসার ঠিকানাটা বলুন।
— জানি না। বাসার নম্বর মনে নাই । আগে কখনো একা আসিনি।
—তবে এবার একা আসলেন কেন ?…. আপনার বাসা কোথায় জানতে পারি কি ?
মেয়েটা উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে ফিরে আবার চোখ মুছতে লাগলো ।

আসিফ বিরাট অস্বস্তিতে পড়ে গেল।
মেয়েটি কি তাকে মিথ্যা বলছে.. ? তার একবার মনে হলো এইসব ঝামেলায় তার জড়ানো উচিত হচ্ছে না।
মেয়েটি মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আসিফের ক্ষীন সন্দেহ হতে লাগলো, …. মেয়েটি হয়তো বাড়ি হতে পালিয়েছে।


রোকেয়া মিহি সুরে কাঁদছেন। ভয়ে একটু পর পর তার গলা শুকিয়ে আসছে, কলিজা ধরফর করছে। নীলু সেই সকালে রেজাল্ট আনতে কলেজে গিয়েছে,… দুপুর হয়ে গেছে এখনো ফেরেনি। তিনি মেজ মেয়ে দিলুকে পাঠিয়েছিলেন কলেজে খোঁজ নিতে। সে ফিরে এসে জানিয়েছে, নীলু এবারও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করতে পারেনি। তার চেয়েও ভয়ের কথা হলো…কে কে নাকি তাকে একা একা বাসস্ট্যান্ডের ঐদিকে হেঁটে যেতে দেখেছে।
পরীক্ষায় ফেল করে ভয়ে মেয়ে পালিয়ে গেল না তো ? কী সর্বনাশ..!

নীলুর বাবা ইদ্রিস সাহেব এখনো কিছুই জানেন না । তিনি গতকালই কী এক কাজে গিয়েছেন সিরাজগঞ্জে। । আজ রাতের মধ্যে তার ফিরে আসবার কথা। রোকেয়া খানমের ধারণা, নীলুর বাবা যদি ফিরে এসে দেখেন নীলু ঘরে নাই তবে…মেয়েদেরসহ তাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবেন তিনি।

দিলু এসে পাশে দাড়ালো।

—মা, এতো দুশ্চিন্তা করো না তো। আমার মনে হচ্ছে নীলু আপা ভয়ে বড় মামীর ওখানে গেছে,… ময়মনসিংহ।

রোকেয়া যেন শরীরে শক্তি পেলেন।
— ও দিলু একবার খোঁজ নেস না ফোন করে সত্যি সত্যিই তোর মামীর ওখানে গিয়ে থাকলে শরীফরে দিয়ে যেন সন্ধ্যার আগেই পাঠায় দেয়। এখানকার কাউকে এখন কিছু বলার দরকার নাই। গ্রামের লোকজন বানিয়ে বানিয়ে নানা কথা রটাবে। তোর বাপের কানে গেলে আস্ত রাখবে না।

দিলু বড় মামীকে ফোন করলো।
জানা গেল নীলু সেখানেও যায়নি। হঠাৎ তার মনে পড়লো মামার মৃত্যুর পর বড় মামীরা আগের ভাড়া বাসা ছেড়ে নওমহল নিজেদের বাসায় উঠেছেন বছরখানেক হলো। মামীদের এই নতুন বাড়ির ঠিকানা নীলু আপা জানে না। তাদের একটাই মোবাইল। সেই মোবাইলও বাসাতেই আছে। নীলু আপা রাস্তা ঘাট কিছুই তেমন চেনে না। এই প্রথম দুশ্চিন্তায় দিলু ঘামতে লাগলো ।

*****
আসিফ অনেক চেষ্টার পর জানতে পারলো, বেগুনি রঙের জামা পরা এই মেয়েটির নাম নীলুফার ইয়াসমিন । ডাক নাম নীলু। নীলুর বড় মামা মোয়াজ্জেম হোসেন আনন্দ মোহন কলেজের ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন জানার পর সে কিছুটা আশার আলো দেখতে পেল। তার মনে হলো নওমহল গিয়ে উনার নাম ধরে খোঁজ করলে হয়তো বাসা খুঁজে পাওয়া যাবে। সে অচেনা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে অভয় দিয়ে হাসলো।

নীলু বিশেষ উৎসাহ দেখালো না। মনে হলো অচেনা কাউকে মেয়েটি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না।

সে আসিফের দিকে শুকনো মুখে তাকিয়ে রইলো।

********

নীলুকে নিয়ে আসিফ ওর বড় মামার বাসা পৌঁছলো সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে। তখন বৃষ্টি পুরোপুরি থেমে গেছে। বাসা খুঁজে পেতে সত্যিই খুব বেশি কষ্ট করতে হয়নি তার। এলাকায় গিয়ে নাম, পরিচয় বলতেই অনেকে চিনে ফেললেন। তবে প্রথমে নীলু তার সাথে আসতে চাইছিল না। তাকে বেশ বুঝিয়ে রাজি করতে হয়েছে।
নীলুর বড় মামার বাড়িটি একতলা, বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে তৈরি । বাড়ির চারদিকে দেয়াল দেয়া, সামনে সুন্দর গোলাপ ফুলের বাগান ।

দরজা খুললেন নীলুর বড় মামী মাঞ্জুমান আরা বেগম। বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে। নীলুকে দেখার পরও ভদ্রমহিলার মুখ কেমন ভাবলেশহীন। আসিফের কাছে কেমন অদ্ভুত লাগলো।

চলবে..
(গল্পটি চার পর্বে সমাপ্ত হবে)
©মাহবুবা আরিফ সুমি
**** গল্পটি কপি পেস্ট করা নিষেধ।