#বেটারহাফ
#Nishat_Tasnim_Nishi
| পর্ব ১০+১১ |
শাহিনুর বেগম কাঁদার জন্য কথা বলতে পারছেন না। তবুও তিনি অস্ফুটসুরে রাত্রির নাম টা উচ্চারণ করলেন।
রাত্রি উনাকে ধরে সোফায় বসিয়ে দিলো। টেবিলের উপর থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে নিলো। গ্লাস টা শাহিনুর বেগমের দিকে এগিয়ে দিতেই তিনি ঢকঢক করে গিলে ফেললেন।
শাহিনুরের হাত থেকে গ্লাস টা টেবিলের উপর রেখে সে নরম কন্ঠে বললো,–“মা, এবার বলুন কী হয়েছে? ”
শাহিনুর কাঁদতে কাঁদতে রুমের দিকে ইশারা করে বলে উঠলেন,—“শিফা,শিফা!”
রাত্রি কপাল কুচকে তাকায় পেছনে। শাহিনুরকে রেখে সে দ্রুত পায়ে হেটে যায় শিফার রুমের দিকে।
পুরো বিছানা রক্তে ভেসে যাচ্ছে, শিফা বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে। রাত্রির চোখ বড়বড় হয়ে যায়। শিফাকে ধরে সে বসিয়ে দেয়। শিফা অঝোরে কাঁদছে, কষ্টের জন্য সে কথাও বলতে পারছে না।
রাত্রি শিফাকে রেখে দৌড়ে যায় বড় ভাবীর রুমের দিকে। জোরে জোরে সোহাগীর রুমের দরজায় কড়াঘাত করতে থাকে রাত্রি। এত রাতে ঠকঠক আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায় সোহেলের। সে হাত বাড়িয়ে সোহাগীকে ডাকে, সোহাগী তার হাত টা উল্টে সরিয়ে বলে,–“উফফ,ঘুমাতে দাও!”
দুবার ডেকেও সোহাগীর কোনো রেসপন্স না পেয়ে সে বিরক্তি নিয়ে উঠে। রাত্রি বিরতিহীন ভাবে তখনও দরজায় কড়াঘাত করে চলছে।
সোহেলের বিরক্তি আর রাগী কন্ঠে বলে,–“আসছি!”
সোহেলের আওয়াজ পেয়ে রাত্রি থেমে যায়।
দরজা খুলে রাত্রিকে দেখে সোহেল অবাক হয়ে যায়। সে ভ্রু কুচকে রাত্রিকে জিজ্ঞেস করে,–“কী হয়েছে?”
রাত্রি হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,–“ভাইয়া,শিফাকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। ”
সোহেল বড়বড় চোখ করে বলে ” কী?কেনো?”
রাত্রি চুপ করে রইলো। সোহেল রাত্রিকে এড়িয়ে শিফার রুমে ছুট লাগালো। পিছন পিছন রাত্রিও গেলো।
রুমে এসে বোনের অবস্থা দেখে সোহেল পাগল প্রায়।রাত্রি একটা মোটা চাদর দিয়ে শিফাকে পেঁচিয়ে দিলো। সোহেল বোনকে কোলে নিয়ে বাহির হয়ে গেলো। ড্রাইভারকে হাক ছেঁড়ে ডাক দিয়ে হসপিটালের দিকে রওনা দিলো। ওদের পিছন রাত্রি আর শাহিনুর বেগম ও ছুট লাগালো।
★★★
শিফার প্রেগন্যান্সির দুইমাস চলছে। সেদিন শশুড়বাড়ী থেকে শাহিনুর তাকে নিয়ে এসেছেন খবর টা শুনামাত্রই। যেদিন বৃষ্টি চেঁচিয়ে রাত্রির বিষয় বলছিলো সেদিন শিফার জামাই এসেছিলো শিফাকে দেখতে। শিফার জামাই শিফা বলতে পাগল। বউকে অন্ধের মতো ভালোবাসেন তুষার । তাই তো বউ আর বাচ্চার সুস্থ থাকার জন্য শশুড়বাড়ী রেখে গিয়েছেন।
তুষারের মা কড়া আদেশ-নিষেদ দিয়ে বউকে পাঠিয়েছেন। একমাত্র ছেলের একমাত্র বউ। বউয়ের সুস্থতার জন্যই পাঠিয়েছেন।
মেয়ের বাবার বাড়ী থেকে খবর পেয়ে তুষার আর তুষারের মা রওনা দেয় হাসপাতালের দিকে। হাসপাতালে পৌঁছাতে সাড়ে সাত টা বেজে যায় তুষারের।
কিছুক্ষণ আগে ডাক্তার বলেছে বাচ্চা মিসক্যারেজ হয়ে গিয়েছে। কথাটা শুনামাত্রই সবার মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ে। শিফা তো একদম ভেঙ্গে যায়। শাহিনুর বেগম স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন।
তুষারের মা এসে এ খবর শুনে যা নয় তা বলে বেড়াচ্ছেন। আগের বাচ্চা টাও একমাস না হতেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। শাহিনুর বেগম তখন উনাদের বাড়ীতে গিয়ে তুষারের মা কে বাজেভাবে অপমান করে এসেছেন। মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বলেছেন যে, “মেয়েকে দিয়ে নাকি ভারী কাজকর্ম করায়। রাতদিন কাজ করায়।” আরো অনেক কথা শুনিয়ে এসেছিলেন।
এবার তুষারের মাও ছাড় দিচ্ছেন না। তিনিও কম কথা শুনাচ্ছেন না সাগরের মা কে। ঘরবর্তী সকল সদস্য প্রায় বিরক্ত তুষারের মায়ের উপর।
রাত্রি তুষারের মায়ের উদ্দেশ্য বলে,–” আন্টি, পরে এসব বলতে পারবেন। শিফা সুস্থ আছে এটাই বেশ। ”
তুষারের মা রাত্রীর কথা শুনে জ্বলে উঠলেন। তেজী গলায় বলেন,–” তুমি আর কথা বইলো না। নিজেই তো বাজা তুমি কী বুঝবা এসবের?”
তুষারের মায়ের কথা শুনে রাত্রি চুপ করে যায়। যা মুখ ফুটে সাহস করে কথা বলেছিলো সেটাও গায়েব হয়ে যায়।
—” তোমার শাশুড়ির তিন পোলা। বড় দুই পোলার দুইটা বাচ্চা আছে। এরপরেও তোমার জামাইরে আবার বিয়ে করাইছে বাচ্চার লাইগা। আর আমার এক পোলা, মাইয়াও নাই আমার। তাইলে আমি আমার পোলারে দ্বিতীয় বিয়া করাইতে পারুম না?”
তুষারের মায়ের কথা শুনে পুরো ঘরবর্তী মানুষ স্তব্ধ হয়ে যায়। শিফা কাতর দৃষ্টিতে তাকায় নিজের মায়ের দিকে। রাত্রি চমকে উঠে,সোহেল তেড়ে যায় তুষারের মায়ের দিকে।
তুষার এগিয়ে এসে থামিয়ে দেয় সোহেলকে।
—“মা,তুমি এসব কী বলছো? শিফার অবস্থার কথা তো একবার ভাবো।”
—“আমি কী বলছি মানে? সত্য কথা কইছি যে এরলাগি গায়ে ফোসকা পড়তাছে,বুচ্ছোস? আর বাচ্চা না হইলে তোরে দ্বিতীয় বিয়া করামু না?”
—“আহা, মা। তুমি থামবে?”
—“তুই চুপ করে বস। ডাক্তার কী বলেছে শুনিস নাই? বলেছে তোর বউয়ের থাইরয়েড, এজন্যই বারবার ভ্রুন নষ্ট হয়ে যায়। ”
—“উনারা তো আর বলে নাই যে বাচ্চা হবে না।”
—“বাচ্চা হবে, এটারও তো নিশ্চিত দেয় নাই।”
তুষার চুপ করে গেলো। সে জানে, মা কে এখন দুনিয়ার সকল মানুষ এসে বুঝালেও তিনি বুঝবেন না। নিজের কথাই উপরে রাখবেন তিনি। তুষার চোখের ইশারায় বউকে চুপ থাকতে বললো। শাহিনুর বেগম চুপচাপ সব শুনছেন, কী বলবেন তার আদৌ জানেন না তিনি। সোহেল সবাইকে শিফার রুম থেকে বের করে নিয়ে গেলো, সে জানে এখানে তারা থাকলে বোনের আরো কষ্ট হবে।
রাত্রি গরম দুধ নিয়ে এসে বসলো শিফার পাশে। শিফার পিঠ বিছানায় ঠেকিয়ে বসিয়ে দিলো।
—“নাও,ফটাফট খেয়ে নাও। কিছুটা আরাম লাগবে। ”
শিফা গ্লাস টা হাতে নিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাত্রির দিকে। রাত্রি কিছুটা হেসে বলে,–“কী?”
—“তোমার খুব কষ্ট হয়েছিলো তাই না ভাবী?”
রাত্রি হকচকিয়ে যায়। সে নড়েচড়ে বসে বলে,–“কীসের কথা বলছো তুমি?”
—“তুমি যখন জেনোছো বাচ্চা হবে না তোমার তখন খুব কষ্ট হয়েছিলো তাই না?”
রাত্রি হেসে বলে,—“তোমার এখন যেমন লাগছে আমারও ঠিক তেমন লেগেছে । তবে তোমার তো এখনো আশা আছে,আমার তো সম্ভাবনাই নাই।”
শিফা চুপ করে যায়। তা দেখে রাত্রি বলে,—“এসব বাদ দাও। দুধ খেয়ে নাও, আরাম লাগবে।”
শিফা রাত্রির চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,–” ভাইয়া বিয়ে করেছে যে তোমার কষ্ট হয় না? খারাপ লাগছে না?”
রাত্রি মুচকি হেসে বলে,–” আগে হতো এখন হয় না। আর তোমার ভাইয়া আমার কথাতেই বিয়ে তো রাজি হয়েছিলো। আমার জেদ ছিলো বাচ্চার সেজন্যই রাজি হয়েছে। ”
শিফা আরো কিছু বলতে নিচ্ছিলো রাত্রি তা না শুনে তাকে জোর করিয়ে দুধ খাওয়াতে লেগে যায়। ভাগ্যের কী লীলাখেলা যে ভাবীকে আগে শিফা দেখতে পারতো না আজ তার দুঃখ সে অনুভব করছে।
★★★
সকাল দশটা বেজে গিয়েছে এখনও সাগর আর বৃষ্টির ঘুম থেকে উঠার কোনো খবর নেই।
রেহানা বেগম মাহিকে পাঠালেন তাদের ডেকে তুলার জন্য। মাহি নেচে নেচে ওদের রুমের দিলে পা বাড়ালো। দরজায় হালকা আওয়াজ করে কড়াঘাত করলো।
মাহি হাক দিয়ে বলে উঠে,–” ভাইয়া, আম্মু অপেক্ষা করছে টেবিলে। তাড়াতাড়ি আসো।”
ঘন্টা আধেক পর খেতে আসে সাগর আর বৃষ্টি। রেহানা বেগম তাদের দেখে হাসলেন, হাসিমুখে বাইপো কে আদর-সমাদোর করতে লাগলেন।
খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হতেই সাগর মাহিকে বলে,–” মাহি তোমার সাথে আমার কথা আছে। ছাদে আসো। ”
সাগরের কথা শুনে মাহির পেটের ভেতর মুচড়ে উঠে। সে চোখ বড় বড় করে বৃষ্টির দিকে তাকায়। বৃষ্টি মিষ্টি হেসে তাকে অভয় দিয়ে বলে,–“যাও। ”
মাহি মাথা দুলিয়ে না বলে। বৃষ্টি চোখ দিয়ে তাকে শান্ত করে বলে,–“কিছু করবে না যাও।”
মাহি ভয়ে ভয়ে ছাদের দিকে হাটা দেয়। সাগর আগেই চলে গিয়েছে। বৃষ্টি রেহানা বেগমের সাথে প্লেট-ভাসন রান্নাঘরের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। বৃষ্টিকে রেহানা বেগম বারবার বারণ করলো, কিন্তু সে শুনলো না। স্বাচ্ছন্দ্যবোধ নিয়েই সে কাজ করতে লাগলো।
রেহানা বেগম মনে মনে ভারী খুশি হলেন। রেহানা বেগম বৃষ্টিকে তরকারী এগিয়ে দিলেন কাটার জন্য। বৃষ্টি পেয়াজ গোল করে কাটছিলো তখন রেহানা বেগম বলে উঠেন,—“সাগরের মাও কোমড়ে সাড়ী গুজে কাজ করতেন। ”
রেহানার কথায় বৃষ্টি অবাক হয়ে যায়। এভাবে কাটতেন মানে? আর সাগরের মা অর্থাৎ শাশুড়ী মা তো রান্নাঘরের কোনো কাজ করেন না। উনি বলেছিলেন বিয়ের পর থেকেই কাজের মেয়ে সব কাজ করতেন। আর তিনি তো শাড়ী পরে না।
বৃষ্টি কৌতুহল নিয়ে বলে,—“আগে কাটতেন মানে?”
রেহানা বেগম থতমত খেয়ে যায়। তিনি কথা ঘুরিয়ে বলেন,–” তোমার কাটা হয়েছে?বাহ,বেশ সুন্দর হয়েছে তো।”
—“আপনি কথা ঘুরাচ্ছেন কেনো? আমার থেকে কিছু কী লুকাচ্ছেন? ”
—“না,তো।কই, কী লুকাবো?”
বৃষ্টি রেহানা বেগমকে জোর করতে লাগলো।
—“আপনি তখন বলছেন সাগরের মা ও ওভাবে কাটতেন। তাহলে কী এখন যে সাগরের মা তিনি সাগরের মা নন?”
রেহানা বেগম চোখ বড়বড় করে ফেলেন। তিনি বৃষ্টিকে তাড়া দিয়ে বলেন,–” তুমি বড্ড কথা বলো। তাড়াতাড়ি ওগুলো দাও রান্না করতে হবে তো।”
বৃষ্টি আবারো জোর করতেই তিনি বললেন,—“তুমি সাগরকে জিজ্ঞেস করো সে বলবে! ”
বৃষ্টির সন্দেহ এবার আরো গাঢ় হয়ে গেলো। তার মানে সাগরের মা তার আপন মা নন। তাহলে তার আপন মা কে?
চলবে!