#বেটারহাফ
#Nishat_Tasnim_Nishi
|পর্ব ২৭|
রাত্রির কথাগুলো যে রসিকতার ছিলো তা টের পেয়েছে সাগর। সে ঘুমের মধ্যেই হালকা হাসলো। মেয়েরা কত ধরনের ঢং আর কত তালে কথা বলতে জানে। তার বউকে না দেখলে সে জানতোই না।
রাতে একরকম দিনে একরকম। কাল রাতে তো অন্য কথা বলতেছিলো এখন আবার কিসব বলছে। আম্মা রাতে ঘুমিয়েছে কি না কে জানে? রাতে তো বলেছেন উনি থাকবেন। সাগর মনে মনে ভাবলো।
রাত্রি দ্রুত পায়ে হেটে বৃষ্টির রুমের সামনে এসে দাড়ালো। দরজা হালকা ঠেলতেই খুলে গেলো। নাস্তার ট্রে টা হাতে নিয়েই পা দিয়ে দরজা ঠেলে ডুকলো সে। বৃষ্টি গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে, তার পাশেই শাহিনুর বিছানায় হেলান দিয়ে গভীর ঘুমে ডুবে আছেন।
রাত্রি শব্দবিহীন হেঁটে ট্রে টা নিয়ে টেবিলে রাখলো। বৃষ্টির পাশে গিয়ে হালকা আওয়াজ করে তাকে পরপর দুবার ডাকলো। বৃষ্টি হালকা নড়ে উঠলো। রাত্রি আবার ডাকলো, বৃষ্টি অল্প চোখ টা খুলে আবার বন্ধ করে ফেললো।
রাত্রি ভ্রু কুচকে তাকালো। রাতে ঘুম হয় নি তা সে বুঝতে পেরেছে। বিছানার পাশে মাটিতে হাটুগেড়ে বসে রাত্রির মাথায় হাত বুলিয়ে কয়েকবার ডাকলো। বৃষ্টি ঘুমের ঘোরেই মুখ দিয়ে বলে,’হু’ ।
রাত্রি এবার ওর হাত টা ধরে টেনে ডাকলো। সাথে সাথে বৃষ্টি চোখ মেলে তাকালো। ওর মষ্তিষ্ক কয়েক মুহূর্তের জন্য হ্যাং হয়ে গেলো।
বৃষ্টিকে উঠতে দেখে সে হাসিমুখে বলে,–“গুড মর্নিং। তাড়াতাড়ি উঠো ঔষধ খেতে হবে।”
বৃষ্টি মাথা নাড়ালো। রাত্রি ফিশফিশ করে বলে,–” আম্মা কখন ঘুমিয়েছে?”
বৃষ্টি ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে,—” শেষ রাতের দিকে। আপনি যাওয়ার বেশ খানেক পর।”
রাত্রি ঘুমন্ত শাহিনুরের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকালো। বৃষ্টি হামি দিতেই সে উঠে দাড়ালো। বৃষ্টির এক হাত ধরলো ওয়াশরুমে যেতে, কারন তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে এখনও দূর্বল।
ওয়াশরুমে ডুকেই সে ঝিম মেরে দাড়িয়ে রইলো। রাত্রি তাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে তাড়া দিলো তাড়াতাড়ি বের হওয়ার জন্য।
ফ্রেশ হয়ে আসতেই বৃষ্টির সামনে এক গাদা খাবার আর ঔষধ নিয়ে বসলো রাত্রি। বৃষ্টি তা দেখে মুখ কুচকালো।
বৃষ্টি ডিম টা খেয়ে নিলো। একটা টোস্ট পুরো খেলো। দুধের গ্লাস থেকে হালকা একটু খেয়েই মুখ বাঁকিয়ে রেখে দিলো।
রাত্রি কঠিন আদেশের সুরে বলে,–” পুরো দুধ শেষ করো। কাল রাতে নাকি ১০৪ ডিগ্রী জ্বর ছিলো। উনি বলেছে আমাকে। চুপচাপ সব শেষ করো।”
বৃষ্টি না চাইতেও জোর করে খেলো। রাত্রি তা দেখে হালকা হাসলো। এক সেকেন্ড না যেতেই বৃষ্টি গড়গড় করে বমি করে দিলো। রাত্রির মুখের হাসি মুহূর্তেই উবে গেলো। সে দ্রুত এগিয়ে এসে বৃষ্টিকে ধরলো। বৃষ্টি আবারো বমি করলো, এবার তার পুরো জামা ভরে গেলো।
রাত্রি এগিয়ে এসে তাকে ধরলো, গ্লাস থেকে পানি নিয়ে তাকে খাইয়ে দিলো। বৃষ্টি আবারো ক্লান্ত হয়ে রাত্রির উপর ভর ছেড়ে দিলো।
রাত্রির খুব মায়া হলো তার প্রতি। কত টা ক্লান্ত দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। এবার নিজের উপর রাগ লাগলো। কেনো সে ওটা ফেলে দেয় নি। বৃষ্টি কে ওয়াশরুমে নিতেই ও আবার বমি করে দিলো। বৃষ্টির চোখে পানি চলে এসেছে, রাত্রি বুঝতে পারছে কষ্ট হচ্ছে তার! সে তার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো।
–” আমি চলে যাওয়ার পর রাতেও কি বমি হয়েছিলো?”
বৃষ্টি হালকা আওয়াজ করে অস্পষ্টভাবে বলে,
—“ন্ না!”
—” ভালো হয়েছে,বমি হয় নি। আম্মা তো বলেছেন যে উনি তোমার খেয়াল রাখবে, কিন্তু তুমি বমি করলে উনি নিজেও অসুস্থ হয়ে যেতেন। আমি অনেকবার বলেছি আমি থাকি না উনি থাকবেন। কাল ছেলের বউয়ের প্রতি তার দরদ একবারে উতলে উঠেছিলো।”
শেষের কথাগুলো রাত্রি ব্যঙ্গ করে বলেছে তা বৃষ্টি বুঝতে পারলো। সে রাত্রিকে থামিয়ে বলে,–” থাক আপু। এভাবে বলবেন না। উনার হয়তো আমার জন্য সত্যিই চিন্তা হয়েছে। নিজের প্রতি হয়তো অপরাধবোধ কাজ করছিলো। উনি কিন্তু সারা রাত জেগে ছিলেন।”
রাত্রি মুখ টা স্বাভাবিক করলো। সে বৃষ্টিকে বলে,—” আমি জানি। কিন্তু তুমি উনাকে চিনো না। উনার মাথায় কেমন ভয়ংকর চিন্তা চলছে তুমি ভাবতেও পারবে না।
আর শুনো, কাল রাতে উনি তোমার সাথে থাকার জন্য সাগরকে আমার রুমে পাঠায় নি। বরং সাগরকে আমার সাথে থাকার জন্য তোমার কাছে এসে থেকেছিলেন। ”
বৃষ্টি তাকাতেই সে আবার বলে,–“তুমি সত্যিই অনেক বোকা, চোখে যা দেখো সেটাই বিশ্বাস করো আর সেটা নিয়েই কথা বলো। ”
বৃষ্টি তাকালো রাত্রির চোখের দিকে। সে বুঝতে পারছে না রাত্রি কি বলছে তাকে?
রাতে তো সাগর আর রাত্রি দুজনেই রাগী গোমড়া মুখে করে এসেছিলো তার রুমে। দুজনের রুমে চেঁচামেচি ভেসে আসছিলো, তখন শাহিনুর তার রুমে এসেছিলো। এরপর তো পিজ্জা বয় আসতেই সাগর তার রুমে এসে সেগুলো দিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর রাত্রিও আসে তাকে দেখার জন্য। দুজনের মুখেই রাগ আর গোমড়া ভাব দেখা যাচ্ছিলো।
শাহিনুর তখন বলেছিলো,–” সাগর!”
—‘জ্বি মা।’
—” তুমি আজ অন্য রুমে চলে যাও। বৃষ্টির সাথে আজ আমি থাকবো। ও অসুস্থ, আমি চাই না তোমার অবহেলায় ও আরো অসুস্থ হয়ে পড়ুক।”
–“কি বলছেন মা?”
সাগর যেতে চায় নি দেখে তিনি জোর করে তাকে পাঠিয়ে দিলেন রাত্রির রুমে। রাত্রি তখন বলে,–” আম্মা আপনিও তো অসুস্থ। আপনি থাকলে আপনিও অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আমি না হয় থেকে যাই। ”
শাহিনুর কঠোর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলে,–” আমি অসুস্থ কি না সেটা আমি দেখবো। মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি না। তুমি নিজের রুমে যাও। বৃষ্টিকে আমি দেখবো, তার মা কে আমি কথা দিয়েছি যে উনার মেয়ের কোনো ক্ষতি হতে দিবো না। ”
ওরা হতবাক চাহনিতে তাকাতেই তিনি চুপ করে গেলেন।
এরপর শাহিনুর নরম সুরে বলে,–“তাছাড়া তুমি নিজেও তো ক্লান্ত, সারাদিন স্কুল করে এসেছো গিয়ে রেস্ট নাও। আমি ওর কাছে থাকি।”
রাত্রি চুপ করে গেলো। সে ঠিক আছে বলে চলে যায়। ব্যাস এটুকুই হয়েছিলো। আম্মা তো আমার ভালোর জন্য আমার কাছে থেকেছিলেন তাহলে রাত্রি আপু কি বলছে?
বৃষ্টি বোকা চাহনী দেখে রাত্রি বিরক্তি নিয়ে বলে,–” হয়েছে ভাবতে হবে না। তুমি কি বুঝেও বুঝতেছো না নাকি আসলেই বুঝতেছো না জানি না। আচ্ছা বাদ দাও। যাও বিছানায় গিয়ে বসো,আমি জামা কাপড় রোদে মেলে দিয়ে আসি।”
রাত্রি বৃষ্টির জামাকাপড় নিয়ে রোদে মেলে দিতে গেলো। সে নিজেই ধুয়েছে।
বৃষ্টি চুপচাপ বিছানায় গিয়ে বসলো। শাশুড়ি মা তখনও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সে গোলকধাঁধায় আটকে গেছে। কে কি বলছে? কে কি চাইছে সে বুঝতে পারছে না।
তার নজর পড়লো রাত্রির ভেজা চুলের দিকে। মনের মধ্যে অজানা অনুভূতি হচ্ছিলো। রাত্রি বারান্দা থেকে আসতেই দেখলো বৃষ্টি তাকে কেমন ভাবে যেনো দেখছে। ঠিক সেদিনের মতো, যেদিন তাকে সে সবার সামনে না বুঝে অপমান করেছিলো।
বৃষ্টি পরপর দুবার কাশি দিলো। সে কেশে উঠতেই শাহিনুর জেগে উঠলো। তিনি রাত্রিকে দেখে অবাক হলেন। রাত্রি এসে বলে,–” আম্মা আপনি গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা করে নিন। সারা রাত তো জেগে ছিলেন আপনি এখন রেস্ট করুন, আমি বৃষ্টির কাছে আছি।”
শাহিনুর কয়েক সেকেন্ড থম মেরে বসে রইলেন। এরপর ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি দিয়ে নিজের রুমে চলে যান। উনি যেতেই রাত্রি বৃষ্টির সামনে এসে বসলো। বৃষ্টি স্বাভাবিকভাবেই বসে রইলো।
—” আমি জানি,তুমি কী ভাবছো? আর কেনো আমাকে এমনভাবে দেখছো। ”
বৃষ্টি হকচকিয়ে যায়। সে একটু হেসে বলে, –“কই কি ভাবছি? আমি তো এমনিতেই বসে আছি।”
–” তুমি যা ভাবছো বিষয় টা তেমন নয়। আমি খুলে বলছি বিষয় টা। তোমাকে তো শাফির কথা বলেছিলাম। ওই যে সেদিন মেবাইলে মেসেজ এসেছিলো এরপর তো স্কুল থেকে আসার পর তোমাকে বলেছিলাম।ওই যে তুমি যখন আমাকে মিটিং এর বিষয় বলতে গিয়েছো। মনে পড়েছে?”
বৃষ্টি মাথা নাড়ালো। তার মনে আছে। সে রাত্রিকে বলতে গিয়েছিলো যে সেদিন সন্ধ্যায় কি হয়েছে! সবাই কেমন রেগে ছিলো তার উপর। রাত্রি সেটা নিয়ে কোনো রিয়েক্ট করলো না। তখন সে, তাকে শাফির বিষয় বলেছিলো। সে সময়, দুজনের মধ্যে হালকা ভাব হয়েছিলো। রাত্রি তাকে প্রমিস করিয়েছে যে এসব যেনো সে এখন কাউকে না বলে। সেও চুপ ছিলো কাউকেই বলে নি। নিজের মধ্যে হালকা কষ্ট অনুভব করছিলো সে। তাও মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখেছিলো।
রাত্রি তার মাথা হেলানো দেখে তাকে রাতের বিষয়গুলো বলে। যে সাগর তাকে কি কি বলেছিলো।
এরপর তো সে কয়েক মুহূর্ত নিরবতা পালন করলো। তারপর সে চুপচাপ গিয়ে টেবিলে কাগজ নিয়ে বসলো তা দেখে সাগর ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকায়। রাত্রি বলে,–“আমি কিছু লিখছি সেটা পড়ার পর কথা বলবেন। ”
রাত্রি লিখতে লিখতে ডেলিভারি বয় ও চলে আসে। সাগর তখন চলে যায়। রাত্রি পুরো লেখা টা লিখে নিজেও বৃষ্টিকে দেখতে যায়।
কাগজে সে পুরো বিষয় লিখে যে কীভাবে সে শাওনের দেখা পায়। কীভাবে সে শাফিকে পাচ্ছে। সব লিখে তাকে বলে। কারন সে যদি মুখ দিয়ে এসব বলতো তাহলে সাগর তাকে সব বলতে দিতো না উল্টাপাল্টা বলতো।
এরপর সাগর যখন রুমে আসে রাত্রি তাকে কাগজ টা আর পেপার টা ধরিয়ে দেয়। সব দেখে সাগর হতভম্ভ হয়ে তাকায়। সে চুপ করে ছিলো। রাত্রি কোনো কথা না বলে গিয়ে ধপাস করে শুয়ে পড়লো।
সাগরও বিছানায় এসে যখন বিছানায় শুয়ে উল্টো দিকে ফিরে ঘুমাতে নিচ্ছিলো তখন রাত্রি বলে,–” এখানে কেনো ঘুমাচ্ছেন? আমি তো বিবাহিত। লজ্জা করছে না অন্যের বিয়ে করা বউয়ের সাথে ঘুমাতে আসছেন?”
সাগর কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। সে নিজের মতো শুয়ে রইলো। জোর করে চোখ বন্ধ করলো। কিন্তু রাত্রি একই কথা বারবার বলছিলো যার ফলে সে রেগে যায়। নিজের ভেতর এতক্ষণ যে অনুতপ্ততা ছিলো সেটা রাগে পরিণত হয়ে যায়। আর তার রাগের স্বীকার রাত্রি হয়ে যায়।
বৃষ্টিকে এসব বলতেই সে বলে,–” আমাকে এসব বলছেন কেনো আপু? আমি কি এসব জিজ্ঞেস করেছি? আপনাদের স্বামী-স্ত্রী র পার্সোনাল ম্যাটার থাকতেই পারে সেটা আমাকে বলার কি আছে? আমি তো এসব জানতে চাইি নি।”
রাত্রি দু সেকেন্ড চুপ করে রইলো এরপর বলে,–” আমি তোমাকে এসব বলতাম ও না। কারন আমি এসব বললে তুমি আবার না বলো আমি তোমাকে জেলাস ফিল করানোর জন্য এসব বলেছি।
কিন্তু এখন যখন দেখলাম তুমি অন্যভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছো তাই সব বললাম। নাহলে আবার সেদিনের মতো যদি তুমি সবার সামনে ভুলবশত উল্টাপাল্টা বলে বসো। ”
বৃষ্টি চোখ তুলে তার দিকে তাকালো । হঠাৎ তার সেদিনের কথা মনে পড়ে গেলো। সাথে সাথে শরীর কাটা দিয়ে উঠলো। সে বিনম্রের সহিত বলে,–” সরি আপু। আমি তখন সত্যিই জানতাম না যে আপনি উনার প্রথম স্ত্রী। আসলে আপনাদের বিহেভিয়ার আমাকে বাধ্য করেছিলো আপনার সম্পর্কে উল্টাপাল্টা ভাবতে। আমি সত্যিই দুঃখিত আমার ব্যবহারের জন্য!”
–” এই মেয়ে,সরি বলছো কেনো? আমি কি তোমাকে কিছু বলেছি? আমি জানি তুমি জানতে না। এখানে তুমি সরি বলছো কেনো? বরং আমাদের সবাইকে তোমায় সরি বলা উচিত।”
বৃষ্টি কিছু বলতে নিচ্ছিলো কিন্তু সাগরকে দেখে চুপ করে যায়। সাগর তখন ই তার রুমে আসে।
এসেই রাত্রিকে ধমক দিয়ে উঠে বলে,–“আমি তোমাকে কি বলেছিলাম?”
সাগরের ধমক শুনে সে কেঁপে উঠলো কারন সে তাকে দেখে নি। সাগর রুমের দিকে তাকাতেই দেখলো টেবিলের পাশে বমি। সে বুঝলো বৃষ্টি আবার বমি করেছে।
বৃষ্টির চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে। তাকে দেখে একদম শুকনো লাগছে। তার ভেতর অস্থিরতা আরেকটু বেড়ে যায়। রাত্রিকে এতক্ষণ আসতে না দেখে সে টেনশনে পপড়ে যায়। বৃষ্টির কোনো খারাপ কিছু হয়ে যায় নি তো। কিন্তু এসে দেখছো দুজনে মুখোমুখি হয়ে বসে কথা বলছে। তার রাগ উঠে যায়।
সে এগিয়ে এসে রাত্রিকে উদ্দেশ্য করে বলে,–” ও দেখি আবার বমি করেছে। ঔষধ খাইয়েছো?”
রাত্রি মাথা নাড়িয়ে বলে না। কারন বৃষ্টি তো বমি করে দিয়েছিলো তাই সে তাকে ফ্রেশ হতে নিয়ে যায় এরপর তো তাকে এসব বলছিলো। ঔষধের কথা তো ভুলেই গিয়েছে সে।
সাগর রাগী চোখে তার দিকে তাকালো। রাত্রি উঠে ঔষধ হাতে নিতেই সে ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে যায়। এরপর নিজেই খাওয়াতে লাগলো তাকে। বৃষ্টি চুপ করে ছিলো সে কোনো কথা বলছিলো না।
বৃষ্টির কপালে হাত দিতেই দেখলো জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। সে চমকে উঠে। রাত্রিকে বলে,–“ওর শরীরে এত জ্বর তুমি দেখো নি?”
রাত্রি মাথা নাড়ায়। সে যখন তাকে ওয়াশরুম থেকে নিয়ে আসে তখন তো জ্বর ছিলো না। এখন ই বোধ হয় বেড়ে গিয়েছে। সাগর তার মাথা নাড়ানো দেখে আরো রেগে যায়, কিন্তু কিছু বললো না। সেখান থেকে উঠে গিয়ে ফোন টা বের করে ডাক্তার কে ফোন দিলো।
তারা দুজন তখন চুপ করে একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিলো। কিছুক্ষণ পর সাগর এসে বলে,–” রেডী হয়ে নাও। ডাক্তার বলেছে তোমাকে নিয়ে যেতে। উনি বলছে জ্বর তো হওয়ার কথা নয়, তোমাকে নিয়ে চেম্বারে যেতে। সেখানে চেক আপ করবেন। উনি খুব ব্যস্ত আসতে পারবেন না।”
বৃষ্টি মাথা নাড়ালো। সে নিজে নিজে উঠলো। কোনোরকম বোরকা টা পরে নিলো। রাত্রি এগিয়ে এসে তাকে হেল্প করলো। সাগর তখন জামা-কাপড় নিয়ে ওয়াশরুম চলে গিয়েছে।
সাগর বেরিয়ে আসতেই রাত্রি বলে,–“নাস্তা করবেন না?”
সাগর কোনো কথা বললো না। সে বৃষ্টিকে বললো, –“আসো।”
শাহিনুরকে বলে তারা বের হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর রাত্রিও বের হয়ে যায় স্কুলের উদ্দ্যশে।
হাসপাতালে পৌঁছাতে এগারোটার বেশি বেজে যায়। প্রিয়ম স্পীডেই গাড়ী চালাচ্ছিলো, তবুও অনেক লেইট হয়ে যায়। এর মধ্যে বৃষ্টির জ্বর উঠানামা করছিলো। বারবার সে অস্থির হয়ে সিটে হেলান দিচ্ছিলো। সাগর তার অস্থিরতা বুঝলো। নিজের ভেতর খারাপ লাগছিলো।
দুপুরের দিকে বৃষ্টিকে চেক আপ করিয়ে বাড়ীর উদ্দেশ্য রওনা দেয় সাগর। প্রিয়মকে সে অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছে। বৃষ্টির অবস্থা এখন ভালো। ডাক্তার বলেছে ঔষধপত্র আর রেস্ট নিলে সে ঠিক হয়ে যাবে। সিরিয়াস কোনো সমস্যা নয় তার। গাড়ী চালাচ্ছিলো হঠাৎ তার রাত্রির কথা মনে পড়ে। গাড়ী একপাশে থামিয়ে সে রাত্রিকে টেক্সট করলো,–” সরি! সকালে আমার মাথা ঠিক ছিলো না। তাই ওমন বিহেভ করেছি। আবারো এতগুলো সরি।”
মেসেজ টা যেতেই রাত্রির ফোন টুং করে ওঠে। সে তখন মনমরা হয়ে ক্লাসে বসেছিলো,বাচ্চা রা লিখছে। মেসেজ টা দেখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে ছিলো। তার মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। সে শুধু মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ছিলো।
চলবে!
#বেটারহাফ
#Nishat_Tasnim_Nishi
|পর্ব ২৮|
মেসেজ টা যেতেই রাত্রির ফোন টুং করে ওঠে। সে তখন মনমরা হয়ে ক্লাসে বসেছিলো,বাচ্চা রা লিখছে। মেসেজ টা দেখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে ছিলো। তার মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। সে শুধু মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ছিলো।
সাগর ফোন টা রেখে দিলো। গাড়ী টা বাড়ীর দিকে চালাতে নিয়েও চালায় নি। মনে মনে কিছু একটা ভেবে সে গাড়ী টা ঘুরিয়ে নিলো। বৃষ্টি উল্টো দিকে গাড়ী চলতে দেখে বলে
–“আরে আরে,আপনি কই যাচ্ছেন? সোজা দিক দিয়েই তো এসেছিলাম আমরা।”
সাগর গম্ভীর মুখে বলে,
—“আমি জানি।”
বৃষ্টি অবাক চাহনী তে তাকালো। জেনেও তিনি উল্টো যাচ্ছেন?কিন্তু কেনো? সে ভাবলো জিজ্ঞেসস করলে বলবে কি না?
সে স্বাভাবিকভাবে বলে,–” আমি কি জানতে পারি? আমরা কই যাচ্ছি?”
–“হ্যা, জানতে পারো। ”
–“তাহলে বলুন।”
—” রিফার বাড়ী যাচ্ছি। দু মিনিট পরেই ওর বাড়ী।”
—“রিফা কে?”
—” আমার কলিগ। আমরা দুজনেই দুটো অফিসের ম্যানেজার পদে আছি। ওর অফিস আমার অফিসের ডানপাশে। আগে একসাথে কাজ করতাম।এখন ও ট্রান্সফার হয়ে চলে গিয়েছে।”
–“ওহ। কিন্তু আমরা এখন ওখানে কেনো যাচ্ছি?”
–“গেলেই দেখবে।”
বৃষ্টি বিরক্তির শ্বাস ছাড়লো। সে মুখ খুলতেই সাগর বলে,–” পরে বলবে, এখন নামো। চলে এসেছি।”
সে আর কোনো কথা বললো না। সাগর গাড়ী টা বড় রাস্তার পাশে পার্ক করেই তাকে নিয়ে বাড়ীর ভেতরের রাস্তা দিয়ে ডুকলো। সরু পথ, ইটের রাস্তা, চারপাশে মাঝারি সাইজের সবুজ গাছপালা। সে তাকাচ্ছে গাছগুলোর দিকে। গাছের একেক পাতা একেক রকম। কোনো টা লম্বাটে, কোনেটা চ্যাপ্টা হালকা হলুদ রং এর আবার কোনে টা ঘাস আর ফুলের মতো। আশেপাশ থেকে অন্যরকম ঘ্রাণ আসছিলো। বৃষ্টি হাটছে আর চারপাশ দেখছে। একটু পর ই তারা বিশাল বাড়ীর সামনে এসে দাড়ায়।
চোখ ধাঁধানো কারুকাজ এ মোড়ানো গেইট।
দরজার সামনেই বসে আছে দাড়োয়ান। সাগরকে দেখেই সে হাত উঠিয়ে সালাম দিয়ে দরজা খুলে দিলো।
সাগর বৃষ্টিকে বলে,’আসো।’
বৃষ্টি ভেতরে এক পা রেখে সামনে তাকালো। আর তাকাতেই সে সম্মোহিত হয়ে গেলো। এত সুন্দর বাড়ী সে আর জীবনেও দেখে নি। যদিও বাংলা মুভি তে বিখ্যাত চৌধুরী বাড়ী আর মির্জা বাড়ী দেখেছিলো কিন্তু বাস্তবে কখনই দেখে নি।
ঘর পর্যন্ত যেতে হলে সরু আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। চিকন রাস্তার দুই পাশে ছোট ছোট ঘাস আর কয়েক ইঞ্চি দূরে দূরে একটা একটা গাছ। গাছগুলোর পাতা সবগুলোই সমান। অর্থাৎ এগুলো সবসময় ছাঁটাই করা হয়। ডানপাশেই ঝর্ণার ছোট পুকুর, রোদের আলোয় তা ঝলমল করছে। শীতল বাতাস বইছে চারপাশে।
সাদা পেইন্টিং এর দেওয়াল, উপরের ইট, সিমেন্টের ঢালাইকৃত চালগুলো রঙ বেরঙ্গের। সামনের দিকেই ব্যালকনি রয়েছে। ব্যালকনির বামপাশেই দুটো গোলাপী রং এর ফুল গাছ। জানালার থাই গ্লাস টা খোলা, বাতাসের কারণে ভেতরের সাদা পর্দা টা উড়ে বাহিরে আসছে। পুরো বিল্ডিং টা দু-তলা। ব্যালকনি থেকে কয়েক মিটার দূরেই ফুলের বাগান। বাগানে নানান রকম ফুল রয়েছে। দূর হতে গাঁদা ফুল আর গোলাপ টাকেই চেনা যাচ্ছে। মুহূর্তেই বৃষ্টির চোখ ধাঁধিয়ে গেলো।
সাগর এলোমেলো পায়ে হেটে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো তার সাথে বৃষ্টি নেই, সে পাশে তাকাতেই দেখে সত্যিই নেই।পেছনে তাকাতে দেখে বৃষ্টি এক দৃষ্টিতে বাড়ীর দিকে তাকিয়ে আছে। সে আস্তে করে তাকে ডাকলো।
অপরপক্ষ থেকে কোনো জবাব নেই। সাগর এবার হালকা আওয়াজ করে ডাকতেই সে কেঁপে উঠলো। সে ‘হ্যা’ বলেই দ্রুড পায়ে ভেতরে চলে আসলো। সাগর তার হাত ধরে হাঁটতে লাগলো, সে চারপাশে মুগ্ধ হয়ে তাকাচ্ছে।
বাড়ীর ভেতরে যেতেই সে আরো মুগ্ধ হয়ে গেলো। রাজকীয় প্রসাদ! সদর দরজা দিয়ে ডুকতেই দেখলো ঘরের মাঝ বরাবর সিড়ি। সিড়ি দিয়ে উঠলে দুইপাশে দুটো রাস্তা! ফ্লোরে সম্পূর্ণ কালো রঙের টাইলসের কাজ। প্রতিটি রুমের দরজার সামনেই রঙিন পর্দা লাগানো। পুরো ঘর নিস্তব্ধ। কাঠের কারুকাজের ছোট বড় ফুলদানি সাজানো রয়েছে টেবিলগুলোয়। দেওয়ালে বড় বড় দামী অনেকগুলো পেইন্টিং লাগানো। সবগুলোই পেস্টেল রঙে আঁকা।
বাড়ীর বাহির যত না সুন্দর তার দ্বিগুণ সুন্দর ভেতর। সে নিজের মতো পুরো বাড়ী ঘুরছে, সাগরকে কিছুই জিঙ্গেস করছে না। তাকে যেনো অদৃশ্য বন্ধন টানছিলো, সব দেখার জন্য।
সাগর ও তার সাথে হাটছিলো, বৃষ্টি নিজের মতো পুরো বাড়ী ঘুরলো। ঘন্টাখানেক লেগে যায় সব দেখতে দেখতে।
সাগর তাকে কিছুই বলছিলো না, সে শুধু দেখছিলো ও কী করে? মূলত তার ফ্রেশ মাইন্ডের জন্যই এখানে নিয়ে আসা। নতুন বাড়ী এটা, অফিসের বসের প্রোজেক্ট কমপ্লিট করার আগেই তার জন্য এ বাড়ী তৈরী করা হয়েছিলো। ডাক্তার সাগরকে বলেছিলো, যে বৃষ্টিকে যেনো খোলামেলা কোথাও ঘুরিয়ে নিয়ে আসে যেখানে আলো বাতাস আছে। আসলে এক জায়গায় থাকার ফলে বৃষ্টির মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন চলে আসে আর এ পরিবর্তনের জন্যই সে এখানে নিয়ে এসেছে।
সব দেখে বৃষ্টি নিচে আসতেই, সাগর সোফা থেকে দাড়ায়। তার সামনে এসে বলে,–“চলো।”
বৃষ্টি তার সাথে হাঁটতে লাগলো। বাড়ী ফিরলো একদম দুপুর নাগাদ। তখন সোহাগী টেবিলে খাবার দিচ্ছিলো। রাত্রিকেও কিচেনে দেখা যাচ্ছিলো। শাহিনুর টেবিলেই বসেছিলেন। ওদের দেখেই তিনি উঠে এগিয়ে আসলেন।সাগরের একদম কাছাকাছি এসেই বলে,–” কী রে ডাক্তার কি বলেছে?”
সাগর গম্ভীর গলায় বলে,–” ঠান্ডা থেকেই জ্বর এসেছে। সিরিয়াস কিছু না, দু-একদিনেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে বলেছে। ওহ,হ্যা এ দুদিন সম্পূ্র্ণ বেড রেস্টের কথা বলে দিয়েছেন।”
কথাগুলো বলে সে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে কয়েক লাফ দিয়ে হেটে সিড়ি দিয়ে তার রুমে চলে গেলো।
খাওয়া-দাওয়ার পর্যায় শেষ হতেই সাগর আর শাহিনুর রুমে চলে গেলেন। ফিহা খেতে আসে নি,সে ঘুমিয়ে আছে। বৃষ্টির খাওয়া তখনও শেষ হয় নি। রাত্রি আর সোহাগী সব গোছগাছ করছিলো। সোহাগীর মুখ কালো , মূলত বৃষ্টির রিপোর্টের খবর শোনার পর থেকেই তার মুখ এমন হয়ে আছে। বাড়ীর এক বউ শহরে থাকে,আরেক বউ স্কুলে চাকরী করে,অন্য জন বেড রেস্ট। তার মানে হলো ঘরের যাবতীয় সব কাজ আমার। আমি তো আর মানুষ না, আমি মেশিন।তাই সবকিছুই আমাকে করতে হবে। ওহ আচ্ছা, আমি তো ঘরের কাজের লোক, সেটা তো একদম ভুলেই গিয়েছিলাম। বিরবির করে উচ্চারণ করলো সোহাগী । চোখমুখে স্পষ্ট তাচ্ছিল্য ফুটে ওঠেছে।
রান্নাঘরে যেতেই বৃষ্টি দেখলো তারা দুজনই কাজ করছে, সে গিয়ে নিজের প্লেট ধুয়ে রেখে দিলো। এরপর সে নিজে নিজেই বলে–“জানেন আজ না আমি এমন সুন্দর একটা বাড়ীতে গিয়েছিলাম যার মতো সুন্দর বাড়ী আমি এর আগে কখনই দেখি নি।”
ওরা দুজনই চুপ। বৃষ্টি নিজের মতো পুরো বাড়ীর বর্ণণা দিতে লাগলো। তার কথার মাঝখানেই রাত্রি বলে উঠে,–“বাহ,বেশ সুন্দর তো বাড়ী। তা তোমরা ওখানে গিয়েছিলে কেনো?”
বৃষ্টি কথা থামিয়ে দেয়। সে ভাবতে থাকে কেনো গিয়েছিলো ওখানে? কোনো জবাব না পেয়ে বলে,–“জানি না। আমি উনাকে জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গিয়েছিলাম কেনো গিয়েছি ওখানে। উনি বলেছেন বলবেন,কিন্তু পরে আর বলেন নি। ওখানে ঘুরে চা-নাস্তা খেয়ে চলে এসেছিলাম।”
রাত্রি চোখ কপালে তুলে বলে,–“স্ট্রেঞ্জ! কেনো গিয়েছো সেটাই জানো না?”
বৃষ্টি মাথা নাড়ায়,সে সত্যিই জানে না। রাত্রি চুপ করে গেলো। মনে মনে বলে,’জানো না নাকি জানাতে চাও না?’ তার মুখে ঘন কালো আঁধার নেমে আসে। কেনো যেনো মনে কষ্ট পায় এটা জেনে যে সাগর অন্য কারো সাথে অন্য কোথাও ঘুরতে গিয়েছে। ফুরফুরে মেজাজ সাথে সাথে বিগড়ে গেলো। অর্ধেক থালাবাসন রেখেই সে হাত ধুঁয়ে চলে গেলো।
রাত আট টার দিকে খুব জোরেই শোরগোল ভেসে আসছিলো সোহেলের রুম থেকে। পরিবারের সদস্যরা সবাই এসে ভীড় জমায় তাদের দরজাস বাহিরে। শাহিনুর দরজায় দুবার ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে বেরিয়ে আসে সোহাগী। এক হাতে তার জামা কাপড়ের ব্যাগ,অন্য হাতে ফিহাকে ধরে আছেন,
মুখ লাল হয়ে আছে,চোখে জল চিকচিক করছে।
শাহিনুর বলে,–“কি হয়েছে? কই যাচ্ছো তুমি?”
সোহাগী ফুঁফিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,–” থাকবো না আর এ বাড়ীতে। চলে যাচ্ছি আমি আমার মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ী।”
সবার চোখেমুখে তখন বিষ্ময়ের ছাপ। শাহিনুর বলে,–” আহা, কি হয়েছে সেটা তো বলো।”
–“কি আর বলবো? সেটা আপনার ছেলেদের কেই জিজ্ঞেস করুন। আপনি তো আল্লাহর রহমতে খুব বড় আদর্শ দিয়ে ছেলেমেয়ে বড় করেছেন। যার জন্য ওরা খুব গর্ভের কাজ করছে।”
শাহিনুর কঠিন গলায় বলে,–“কি হয়েছে সেটা বলো।”
–“কি আর হবে। আপনার মহান ছেলেদের যে গুন রয়েছে সেটাই করেছে। গায়ে হাত তুলেছে আর কি পারে আপনার ছেলেরা? একজন মেরে রক্তাক্ত করে ফেলে আর অন্যজন মেরে বের করে দেয়। আপনি সত্যিই খুব মহান, খুব বড় বড় আদর্শ দিয়েছেন ছেলেদের। যাই হোক আচা করি এ কথা গর্ভ করে বলতে পারবেন লোকজনদের।”
শাহিনুর আর সাগর দুজনেই চটে গেলো তার কথায়। খুব কষ্টে দুজনেই নিজেকে আটকালো। সোহাগী হেসে বলে,–“কি হলো থেমে গেলেন কেনো? আসুন আপনারাও আপনাদের শক্তি দেখান।”
ভেতর থেকে সোহেল সব শুনছিলো, সে খুব রেগে এসে দাড়ায় তার সামনে। সে কিছু করবে তার আগেই চোখ রাঙ্গিয়ে তাকে থামিয়ে দেয় শাহিনুর। কয়েক মুহূর্ত নিরব পরিবেশ বিরাজ করে সেখানে।
শোবার ঘরে বিরাট মিটিং বসেছে। সেখানে আজ এ ঘরের সবার একটা সিদ্ধান্ত হবে। কার কি হবে?কে কি করবে সব নিয়েই আলোচনা হবে। বৃষ্টি খুব নার্ভাস হয়ে গুটিশুটি মেরে বসে আছে একপাশে।
চলবে!
#বেটারহাফ
#Nishat_Tasnim_Nishi
|পর্ব ২৯|
শোবার ঘরে বিরাট মিটিং বসেছে। সেখানে আজ এ ঘরের সবার একটা সিদ্ধান্ত হবে। কার কি হবে?কে কি করবে সব নিয়েই আলোচনা হবে। বৃষ্টি খুব নার্ভাস হয়ে গুটিশুটি মেরে বসে আছে একপাশে।
এত রাতেও সোহাগীর বাবার বাড়ীর লোকজন চলে এসেছেন মেয়ের আর্তনাদ শুনে। ফোনেই সে তার বাপ ভাইকে বলে যে এখনই যেনো তাকে এ বাড়ী থেকে নিয়ে যায়। তারা কি হয়েছে বা কেউ কিছু বলেছে এমন কোনো বাক্য না বলেই সরাসরি রওনা দিয়েছে।
রাত্রি ঘরের বাহিরে দরজার পাশে দাড়িয়ে আছে। বৃষ্টি বিছানার কোনায় বসে আছে। তাকে রেস্ট করতে বলা হয়েছিলো সেজন্য সে বিছানার কোনায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে।
সোহাগীর এক মাত্র বড় ভাই সোহাগ। তার আর ভাই-বোন নেই। তার বাবা-মা ছেলে আর ছেলের বউ এর সাথে থাকে।
‘নেহাত সোহাগী সোহেলকে পছন্দ করেছিলো নাহলে তো ওরা কখনোই সোহেলের কাছে বিয়ে দিতো না।’ এটা হলো উনাদের বক্তব্য। সোহেল অবশ্য কিছু বলছে না। সে চুপ করে দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে।
সোহাগীর বাবার বাড়ীর লোক প্রচন্ড ক্ষেপে আছে। সোহাগ উঁচু গলায় শাহিনুরকে বলে,–” আমি আমার বোনকে নিয়ে যেতে চাই। আপনাদের এই যাযাবর এর সংসারে ওকে রাখতে চাই না।”
শাহিনুর শান্ত গলায় বলে,–” আগে ওদের কাছ থেকে শুনে নেই কি হয়েছে? সামান্য বিষয় নিয়ে ছাড়াছাড়ি? বিয়ে তো কোনো খেলা নয় তাই না?”
সোহেল হেসে বলে,–” আপনাদের কাছে তো বিয়ে টা ছেলেখেলাই। আপনার সংসারে আপনার ছেলেদের কাছে বিয়ে মানেই একটা খেলা। এক বউ ভালো না লাগলে আরেক বউ নিয়ে আসে।”
কথাটা বলে সে আড়চোখে সাগরের দিকে তাকালো। সাগর ফিরেও ওর দিকে তাকায় নি। ও চুপ করে বসে আছে। শাহিনুর রেগে গেলেও মুখে প্রকাশ করলেন না। তিনি সহজ গলায় বলে,–” বড় বউমা তুমি বলো কি হয়েছে?”
সোহাগী বলে,–” কি বলবো আমি? আমি বলবো যে আমার স্বামী আমাকে মারে। আমাকে মেরে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়?”
শাহিনুর বলে,–” সহজ আর স্বাভাবিক ভাবে কি হয়েছে সেই বিষয়টা বলো। সোহেল তোমায় গায়ে কি সত্যই হাত তুলেছে আর তুললেই বা কেনো?”
–” সন্ধ্যায় উনি বাড়ীতে এসেছিলেন। আমি উনার সব কিছু এগিয়েই দিয়েছিলাম। ভুলবশত উনাকে পানির গ্লাস দেই নি খাবার সময়। আর সেজন্য উনি আমাকে বকা শুরু করে দেয় যে খাওয়ার সময় পানি না দিয়ে অন্যসব কেনো দিয়েছি? এটা নাকি অপরাধ আর ও নানান কথা শুনাতে লাগলেন।
সেসব শুনে আমি রেগে গিয়েছিলাম। আর রেগে বলি, ‘আমি তো সবার কাজের মেয়ে তাই না? আমি মানুষ না। আপনার ভাইকে চা একটু দেরী করে দেওয়ার কথা বলতেই না খেয়ে চলে গিয়েছে। আপনাকে পানি না দেওয়ায় আমার পরিবার সহ বলেছেন আমাকে কি কিছু শেখায় নি? ”
এরপর উনার নাকি রাগ উঠে যায়। আর রাগ সামলাতে না পেরে আমার গালে তার হাতের ছাপ বসিয়ে দেন।
ঘরে তিন বউ, সবার নিজের মতো চলে। এক ছেলের বউ শহরে থাকে আর আরেকজনের দুই বউ,একজন রেস্ট নিবে আরেকজন স্কুল কলেজে যাবেন। তার মানে কি আমি হলাম ঘরের চাকরানী?
তারউপরে এক গ্লাস পানি দিতে দেরী হলে আমার পরিবার নিয়ে প্রশ্ন তুলে। আর আমি সেটার জবাব দিলে আমার গায়ে হাত তুলা হয়।
তাহলে আপনি বলুন, কোন মুখে আমি এই নরকে থাকবো?”
শাহিনুর গম্ভীর গলায় সোহেলের দিকে তাকায়। সে মাথা নিচু করে আছে। তিনি কঠোর গলায় বলে,–” সোহেল, ও যা বলছে তা কি ঠিক? তুমি কি এ সামান্য কারণে ওর গায়ে হাত তুলেছো?”
সোহেল মাথা তুলে তাকালো মায়ের দিকে। সে মাথা নাড়িয়ে বলে, –“আমি ওর গায়ে হাত তুলেছিলাম। কিন্তু ও যা বলেছে বিষয়টা সম্পূর্ণ তেমন নয়। আমি বকা দিয়েছিলাম ঠিকই কারন ততক্ষণ পর্যন্ত ও শুধু কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করছিলো। সারাদিন অফিস থেকে কাজ করে ফিরে এসেও যখন ঘরে এসেও দেখি অশান্তি তখন আর মাথা ঠিক থাকে না। ওর তর্ক করাটা বাড়ী ছেড়ে দেওয়া পর্যন্ত চলে গিয়েছিলো। ও চাইছিলো ওকে নিয়ে যেনো আমি বাড়ী ছেড়ে চলে যাই, ও এখানে থাকতে পারবে না। আমি অনেক্ষণ ধৈর্য্য ধরে চুপ ছিলাম, কিন্তু যখন ও থামছিলো না তখন ওর গায়ে হাত তু্লতে বাধ্য হই আর ওকে চলে যেতে বলি।”
সোহাগীর মা রাগান্বিত কন্ঠে বলে,–” তো, আমার মেয়ে ভুল কি চাইছে? তোমার মেঝো ভাই ও তো তার বউকে নিয়ে বাসা ভাড়া করে শহরে থাকে। এখানে আমার মেয়েকে নিয়ে থাকতে কি সমস্যা? এই সামান্য কারনে তুমি আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলেছো?”
এ কথা বলে তিনি দৃষ্টি ঘুরিয়ে শাহিনুরের দিকে তাকালেন। তারপর বলে,–“বেয়াইন, শুনলেন তো আপনার ছেলের নির্লিপ্তি গলায় স্বীকারোক্তি? আমি আর আমার মেয়েকে এক মুহূর্ত ও এখানে রাখবো না।”
শাহিনুর বলে,–” আরে, বেয়াইন। শুনেন তো।”
সোহাগীর মা, মেয়ে আর নাতিনের হাত ধরে টেনে নিয়ে বলে,–”আপনাদের কোনো কথা ই শুনতে চাই না। এখনই আমি আমার মেয়েকে নিয়ে চলে যাচ্ছি। আমার মেয়ে কারো বান্দী না যে সারাদিন কাজ করবে।”
কথাগুলো শেষ করে তিনি এক মুহূর্ত ও দাড়ালেন না। চলে গেলেন তাদের নিয়ে। শাহিনুর পেছন থেকে বারবার ডাকতে লাগলেন কিন্তু উনারা দাড়ায় নি। সোহেল চুপ করে নিচু দৃষ্টিতে দাড়িয়ে ছিলো। যাওয়ার আগে তার দিকে তাকিয়ে তার শাশুড়ি বলে গিয়েছে,
‘সে নাকি কাপুরুষ! ‘
অসহ্যনীয় মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে দুটো দিন কেটে গেলো। সবাই কেমন ছন্ন ছাড়া ভাবে ছিলো গত দুদিন।। কারো মুখেই হাসি নেই,সবার মুখে কালো অন্ধকার ছেঁয়ে আছে। চৌধুরী বাড়ীতে শোকাচ্ছন্ন পরিবেশ! সোহেলের অবস্থা বেশ ভালো না,ও নিহের রুমেই ছিলো দুটো দিন।
সকাল সাত টা বাজে। সাগরের ফোনটা বেজে ওঠলো আওয়াজ করে। শুয়ে থেকেই ফোন টা কানে লাগালো সে।
ফোনের অপাশের কথা শুনে দপ করে উঠে বসেলো সে। এতদিন পর তার বন্ধু শাকিল ফোন দিয়েছে। সে ফোনটা কানে রেখেই বলে,–“কি সত্যি বলছিস তুই? তোদের মেনে নিয়েছে?”
–“হ্যা,শুধু মেনে নেয় নি। আজকে আমার রিসেপশন। সূচি তো খুব এক্সসাইটেট। ও বলেছে তোরে না আনতে পারলে আমার খবর আছে।”
সাগরের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। তার ঘরে কত ঝামেলা চলছে এসব তো আর সে এখন জানাতে পারবে না। এক বছর আগেই সূচিকে নিয়ে পালিয়ে যায় শাকিল। আর আজ এত দিন পর ওদের মেনে নিচ্ছে তাদের পরিবার। এত খুশির সময় সে তো আর তার পারিবারিক ঝামেলা বলে ওদের খুশি নষ্ট করে দিতে পারে না।
সাগর মুখে শুকনো হাসি ফুটিয়ে বলে,–” কংগ্রেস দোস্ত! সূচিকে বলিস আমি ট্রিট নিবো।”
—“ট্রিট নিবি মানে?তুই কি আসবি না?”
—“সরি রে। আসতে পারবো না,খুব বিজি।”
—” তোর বিজির গুষ্ঠি মারি। গাড়ী চলে যাবে যথাসময়ে। কোনো কথা না বলে চুপচাপ তোর বউকে নিয়ে চলে আসবি।”
–“শোন তো,,,”
—” আমার কসম লাগে, তুই আসবি তোর বউকে নিয়ে। সূচী কিন্তু বিয়ে করবে না তুই না আসলে। আর বেশি কিছু বললাম না, বাকিটা তুই জানোস।”
কথা টা বলেই ও ফোন কেটে দিলো। সাগর কয়েক মুহূর্ত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ফোনের দিকে। বিছানা থেকে নামতেই ও খেয়াল করলো বিছানা ফাঁকা। ওর পাশে কেউই নেই। তার মাথায় আসলো বৃষ্টি কই?
ফ্রেশ হয়ে আসতেই দেখলো বৃষ্টি চা নিয়ে রুমে আসছে। বৃষ্টি এখন অনেক স্বাভাবিক আর সুস্থ। কাল ঘুরে আসার পর থেকেই তার কাছে খুব শান্তি লাগছিলো। দম বন্ধকর পরিবেশ থেকে কয়েকদিনের জন্য মুক্ত হতে পেরেছে সে।
সকাল ঘুম থেকে উঠার পরেই তার কাছে অনেক আরাম লাগছিলো, নিজেকে সুস্থ লাগছিলো। উঠেই সবার জন্য নাস্তা বানাতে চলে যায়। ইতোমধ্যে সকলকে দেওয়াও শেষ।
সাগর কোনো কথা বললো না,সে চা টা খেয়ে নিলো। বৃষ্টিকে তার কাপড় বের করতে বলে শাহিনুরের রুমে চলে গেলো।
শাহিনুরের মন-মেজাজ ভালো না। তার সাজানো-গোছানো সংসার টা ধীরে ধীরে ভেঙ্গে যাচ্ছে। কয়েকটা দিন থেকেই তো মানসিক চাপে ছিলেন। সোহাগীর চলে যাওয়া টা তার উপর আরো চাপ প্রয়োগ করে ফেলে। একমাত্র নাতিন ফিহা। সে বুঝি নানুর বাড়ী মানুষ হবে? তার এত ধন-সম্পদের তো কোনো মানেই নেই।
ফোনে কথা বলেছেন তিনি সোহাগীর মায়ের সাথে তার একটাই কথা। আর সেটা হলো তার মেয়েকে নিয়ে যদি সোহেল আলাদা থাকে তাহলে তিনি তাকে আর নাতিনকে পাঠাবেন। নাহলে মেয়েকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দিবেন তিনি।
শাহিনুর প্রথম দিন এ কথা শুনে ফোন টা রেখে দেয়। গত দিন এ কথা নিয়ে ভাবতে ভাবতে তিনি অস্থির ছিলেন। সোহেলের অবস্থা দেখে তার মন টা আর মানলো না। তিনি রাতেই তাদের ফোন দিয়ে নরম কন্ঠে জানিয়ে দিয়েছেন যে, ‘তারা যেভাবে থাকতে চায় সেভাবেই হবে।।’
কথাটা বলেই ফোন টা কেটে দেয়।
কয়েকদিন আগেই তার মেয়েটা কে শশুড়বাড়ী পাঠিয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো খবর পান নি। কি জানে কি হাল অবস্থা তার?
ছেলে মেয়েদের সংসারের এমন অবস্থা তার আর সহ্য হচ্ছে না।
সাগরের আগমনে তার ভাবনার সুতোয় টান পড়ে। তিনি প্রশ্ন বিদ্ধ চোখে সাগরের দিকে তাকায়। সাগর ধীর পায়ে হেটে এসে বলে,–” মা, আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে।”
শাহিনুর চোখ বন্ধ করে বলে,–” তো যা। আমাকে কেনো জিজ্ঞেস করছো?”
সাগর তার মায়ের পায়ের পাশে বসে বলে,–” মা, সমস্যা হলো আমাকে রাত্রিকে নিয়ে যেতে হবে।”
—“রাত্রিকে কেনো নিয়ে যেতে হবে?”
—” আজ শাকিলের বিয়ে। মানে বিয়ের অনুষ্ঠান আর কি।ওদের আগে বিয়ে হয়েছে, আজ সবাইকে দাওয়াত করে খাওয়াবে। সে বলেছে, আমি যেনো বউকে নিয়ে সেখানে যাই।”
শাহিনুর ফট করে চোখ খুলে সাগরের দিকে তাকালেন। মন টা বড্ড কু ডাকছে। গত কয়েক দিন থেকেই খারাপ সংবাদ শুনে আসছেন। তার মন বলছে ছেলে যেনো না যায়। তবুও মুখ ফুটে বললেন যে , ‘যাও, আমাকে বলছো কেনো? তোমার বউ তোমার ইচ্ছা।’
সাগর কয়েক মুহূর্ত ওখানে বসলো।
রাত্রি স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডী হয়ে নিচে নামলো। শাহিনুরকে বলার জন্য তার রুমে আসতেই দেখলো সাগর বসে আছে। সে সেদিকে না তাকিয়ে দিয়ে বলে,’ মা,আমি যাচ্ছি।’
শাহিনুর বলে,–“দাড়াও!”
রাত্রি দাড়িয়ে যায়। সে পেছনে ঘুরতেই তিনি বলে,–” সাগর কই যাবে তোমাকে নিয়ে। আজ স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই।”
রাত্রি অবাক হয়ে তাকায়। সাগর বলে যে তার বন্ধুর বিয়ে আর সেখানে যাবে সে। মুহূর্তেই রাত্রির চেহারার রং বদলে মলিন হয়ে যায়। এই তো সেই ছেলে যার ভাইয়ের সাথে তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো, সেদিন যদি সে পালিয়ে না যেতো তাহলে আজ তার কপালে এত দুঃখ হতো না।
সে সরাসরি বলে,–” না, আমি স্কুল মিস দিতে পারবো না। এমনিতেই গত দুইদিন মিস দিয়েছি। স্টুডেন্টের মা-বাবা ফোন দিয়ে বারবার বলছেন পড়াতে কেনো যাচ্ছি না। আমার পক্ষে সম্ভব নয় স্কুল মিস দেওয়া। আমি সত্যিই দুঃখিত আপনি বরং বৃষ্টিকে নিয়ে যান।”
সাগর আর শাহিনুর দুজনেই একসাথে তাকালো। বৃষ্টিও মাত্র রুমের সামনে এসে দাড়ায় শাহিনুরের চা নিয়ে। তার কানে বাজছে তার নামে কথা চলছে। দুর্ভাগ্যবশত সে পুরো কথা টা শুনে নি। চায়ের কাপ টা নিয়ে ডুকার জন্য রাত্রি সরে দাড়ায়।
সাগর বলে,–” তুমি যা বলছো ভেবে বলছো?ওরা কেউই তো বৃষ্টিকে চিনে না। সবাই তোমাকে চিনে। ওকে ওখানে নিলে তো সমস্যা হবে।”
বৃষ্টি কাপ টা রাখতেই তার হাত কেঁপে উঠে। সে চুপ করে আছে। রাত্রি আর চোখে সবার দিকে একবার তাকিয়ে বলে,–” ওকে নিয়ে গেলে সমস্যা কি? ইজ্জতে লাগবে বুঝি? বিয়ে করার সময় মনে হয় নি? এখন কেনো বউ বলে পরিচয় দিতে লজ্জা করছে?”
সাগর চাদর শক্ত করে ধরে বসে রইলো। বৃষ্টি চুপ করে আছে। শাহিনুর রাত্রির মুখের দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। রাত্রি এত কথা বলছে কীভাবে? ওর মুখে কবে থেকে কথা ফুটেছে? এই তো সেই মেয়ে যে তার ভয়ে কোনো কথা বলতো না। যেমন ইচ্ছা তেমন অত্যাচার করতেন তিনি, তবুও কোনো প্রতিত্তুর করতো না। ওর এত বদলে যাওয়ার পেছনে কারণ কি?
সাগর ওঠে দাড়িয়ে বলে,–“ফাইন। আমি বৃষ্টিকে নিয়েই যাবো। আর ওকে আমার বউ বলেই সবার সাথে পরিচয় করাবো,কথা দিলাম।”
বলেই সে বৃষ্টির হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে গেলো। সাগরের যাওয়ার দিকে কয়েক সেকেন্ড নিরবে চেয়ে রইলো রাত্রি। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। সে আর এক মুহূর্ত দাড়ালো না, ওদের থেকে দ্বিগুন বেগে উল্টো দিকে চলে গেলো। শাহিনুর সব কিছু বসে বসে দেখলেন। চুপচাপ চোখ দুটো বন্ধ করে বিছানায় হেলান দিলেন। তার সোনার সংসার ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে শুধু এক বাচ্চার জন্য। কেউই শান্তিতে নেই। সবকিছু থাকা স্বত্তেও কেউ চিন্তাবিহীন থাকতে পারছে না। সবার মধ্যেই হতাশা আর হতাশা। তার জন্যই সবার এ অবস্থা। নিজেকে তার এখন সবচেয়ে অকার্যকরী জিনিস মনে হচ্ছে।
ঠিক মধ্য দুপুরে তারা এসে পৌঁছালো শাকিলের বাড়ীর সামনে। বাড়ী ভর্তি মানুষ গিজগিজ করছে। গাড়ী রাখার চুল পরিমান জায়গা নেই। সাগর রাত্রিকে ভেতরে গিয়ে অপেক্ষা করতে বলে সে গাড়ী পার্ক করতে চলে যায়।
গাড়ী রেখে বিয়ে বাড়ীতে ডুকে সে বৃষ্টিকে খুঁজতেছে। এত মহিলার ভীড়ে সে তাকে খুঁজেই পাচ্ছে না। এর মধ্যেই আচমকা কেউ এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,” বাবাজি, কেমন আছো?”
সাগর চমকে ওঠে। সে তাকিয়ে দেখে রাত্রির বাবা। কয়েক সেকেন্ডেই তার মুখে নানান রং এসে ভীড় করে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,” ভ্ ভালো। আ্ আপনি এখানে?”
রাত্রির বাবা এক গাল হেসে বলে,” হু। আরে আমি আসতাম না তো। সেদিন ই তো ওদের সাথে আমার সব বন্ধন শেষ হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু পরে যখন মনে পড়লো তুমি আর রাত্রিও তো আসবে তাই আর না করি নি। তারপরেও একটু আধটু জেদ ধরেছিলাম। কিন্তু বেশ সময় নেই নি পরে যদি ওরাও পাল্টি খেয়ে যায়। আমি কিন্তু সবার আগে চলে এসেছি মেয়েকে দেখতে। তোমার ওই বন্ধু আমাকে প্রমিস করে বলেছে যে তুমি নাকি আজ আসবে। যাই হোক বাদ দাও,আমার মেয়ে কই?ওকে দেখছি না যে?”
সাগরের মুখ টা মলিন হয়ে যায়। বুক টা ছেৎ করে ওঠে। রাত্রি কি এর মধ্যে ওর বাবার সাথে যোগাযোগ করে নি? ওর তো ফোন আছে। স্কুল থেকেও তো এসে দেখা করতে পারতো। তাহলে সে যোগাযোগ করে নি কেনো? হোয়াই? সাগর তো ভেবেছে রাত্রি তার বাবার সাথে যোগাযোগ করে। হঠাৎ করেই সাগর কথা শুন্যতায় ভুগতে লাগলো। এমন সময় বৃষ্টি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে সাগরের পাশে দাড়ালো।
চলবে!